মেঘ বলেছে তুমি আমার পর্ব-১৩

0
294

#মেঘ_বলেছে_তুমি_আমার❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ১৩
_______________

সন্ধ্যা জুড়ে বিষণ্ণতা। নিজ রুমে চুপচাপ বসে আছে অহনা কোনোকিছুই ভালো লাগছে না তার। সেই আহিয়ান যাওয়ার পরে রুমে এসে যে ঢুকেছে তারপর আর বের হয় নি অহনা। তার কোনো কিছুই যেন ভালো লাগছে না। অহনার বিষণ্ণ মাখা সময়েই তার রুমের দরজা নক করলো বুশরা বললো,

‘ ওই অহনা সারাদিন এভাবে রুমে বসে থেকে কি করছিস বাহিরে আয় জলদি।’

অহনা শুনলো খানিকটা উচ্চস্বরে বললো,

‘ তুমি যাও আপু আমি আসছি।’

বুশরাও শুনলো। বললো,

‘ আচ্ছা দ্রুত আয়। নিচে সবাই অপেক্ষা করছে কিন্তু।’

‘ এই তো আসছি আপু।’

বুশরা চলে গেল। আর অহনা আরো কিছুক্ষণ বসে থেকে নিজেকে পরিপাটি করে মাথায় ওড়না মুড়িয়ে ছুটলো নিচে।’
___

নিচে খানিকটা নাস্তা পানি খেল সবাই সাথে বিয়ে নিয়ে টুকিটাকি আলোচনা। ডেকোরেশনের লোকেদের কবে আসতে বলবে, গায়ে হলুদে কারা কারা আসবে ইত্যাদি ইত্যাদি নিয়ে কথা হচ্ছিল। অহনা ওসব শুনে বেশিক্ষণ টিকতে পারলো না সুযোগ বুঝে চলে এসেছে কোনো মতে। আজ সন্ধ্যার ভোজনে নীলয় নিচে নামে নি তার খাবার উপরে পাঠানো হয়েছে, নীলয়ের অফিসে কি নাকি কাজ ছিল। অহনা নিশ্চুপে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলো। হঠাৎই কি হলো অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটতে গিয়ে পায়ে সিলিপ কেটে পড়ে যেতে নিলো সে সঙ্গে সঙ্গে তাকে ধরে বসলো নীলয়। মাত্রই অহনাকে পাশ কাটিয়ে যেতে নিয়েছিল সে। অহনা অন্যদিকে ঘুরে থাকায় নীলয়কে নজরে পড়ে নি। অহনা স্তব্ধ নজরে তাকালো নীলয়ের দিকে, অহনার চাহনিটা যেন বুঝলো নীলয়। বললো,

‘ এভাবে বিয়ের কনেদের অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটতে নেই অহনা পড়ে টড়ে গেলে কি হবে জানো তুমি?’

অহনা নিজেকে সামলালো নীলয়ের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে অপরাধীর স্বরে বললো,

‘ আই এম সরি।’

নীলয় কিছু বলে না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে কতক্ষণ। অহনা যেতে নেয় কিন্তু নীলয় পথ আটকায়। বলে,

‘ কি হয়েছে তোমার? আহিয়ান আসার পর থেকেই দেখছি তুমি একটু কেমন কেমন করছো? শরীর ঠিক আছে তো।’

অহনা অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে নীলয়ের দিকে বলে,

‘ হুম আমি ঠিক আছে।’

এতটুকু বলেই অহনা চলে যায়। আর নীলয় অনেকক্ষণ নিশ্চুপে দাঁড়িয়ে থাকে। অদ্ভুত স্বরে বলে,

‘ আজ মেয়েটা এমন করছে কেন?’
____

নতুন একটা সকাল। আকাশ ছুঁয়ে উঠেছে রোদ্দুর সেই রোদ্দুরের ছোঁয়াগুলো জানালা বেয়ে উঁকি মারছে নীলয়ের রুমে। নীলয় একটু নড়তেই সেই রোদ্দুরটা সোজা এসে পড়লো নীলয়ের চোখে মুখে এতে খানিকটা বিরক্ত হলো নীলয়। ঘুমের মধ্যেই চোখ মুখ কুঁচকে ফেললো সে। বিরক্তির স্বরে কিছু বলতে নিবে এরই মাঝে ছায়া জনিত কিছু একটা নীলয়ের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ালো রোদ্দুরকে আঁটকে ধরে। মুখে ছায়া পড়তেই নীলয়ের চোখ মুখ কোঁচকানোর ভাবটা নিমিষেই পালিয়ে গেল তখন। নীলয় আর একটু আরাম করে বালিশটা ঝাপটে ধরে ঘুমালো। এভাবে কেটে গেলে কতক্ষণ হঠাৎই কি ভেবে যেন চোখ জোড়া খুলে ফেললো নীলয় আশপাশে তাকালো বার কয়েক কেউ কি এসেছিল তার রুমে। নীলয় জানালার দিকে তাকালো জানালার পর্দাটা পুরোপুরি মেলে দেওয়া। নীলয় বুঝেছে কেউ একজন সত্যি তার রুমে এসেছিল আর জানালার পর্দা টেনে দিয়ে গেছে। কারণ কাল রাতে জানালার পর্দাটা এমন ছিল না। এরই মাঝে রুমে প্রবেশ করলো নীলয়ের মা। বললেন,

‘ আর কত ঘুমাবি নীলয় এবার তো উঠ?’

মায়ের ডাকে নিজের ভাবনা থেকে বের হলো নীলয়। বললো,

‘ মম তুমি কি কতক্ষণ আগেও আমার রুমে এসেছিলে?’

নীলয়ের মা বেশ অবাক হয়ে বললো,

‘ কই না তো আমি তো মাত্রই এলাম।’

প্রতিউত্তরে শুধু এতটুকুই বললো নীলয়,

‘ ওহ,

এরই মাঝে চায়ের কাপ হাতে রুমে ঢুকলো নীলা। বললো,

‘ চাচিমা নীলয় ভাইয়ার চা তুমি নিচে রেখে এসেছিলে?’

নীলার কথা শুনে বিছানার কাঁথাটা ভাঁজ করতে করতে বললো নীলয়ের মা,

‘ দেখছিস একদমই ভুলে গিয়েছিলাম। দে তোর নীলয় ভাইয়াকে?’

নীলা শুনলো চায়ের কাপটা নীলয়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে দৌড়ে ছুটে গেল। নীলয় আটকাতে চাইলো ওকে বলতে চাইছিল নীলা এর আগে তার রুমে এসেছিল কিনা কিন্তু নীলয় কিছু বলার আগেই নীলা ছুটে গেল। নীলয় চায়ের কাপে চুমুক দিল।’
___

গমগমে রোদের ভিড়ে গায়ে লুঙ্গি, ফতুয়া আর মাথায় গামছা বেঁধে ট্রাক্টর চালাচ্ছে নীলয়ের বাবা। আর দূর থেকে বাবার এমন কাণ্ড দেখে চোখ মুখ সব কেমন একটা হয়ে গেল নীলয়ের। নীলয় চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো তার বাবার দিকে। এটা কি আধও তার বাবা নাকি তার বাবার মতোই দেখতে কোনো মানুষ। নীলয়ের ইচ্ছে করছিল দৌড়ে গিয়ে বাবাকে জিজ্ঞেস করতে,

‘ ড্যাড এগুলো তুমি কি করছো?’

কিন্তু ফসলের জমিতে যে কাঁদা ওসবের মধ্যে একদমই যেতে ইচ্ছে করছে না নীলয়ের। নীলয় দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এমন সময় পিছন থেকে জহির বললো নীলয়কে,

‘ নীলয় ভাইয়া ভুতুড়ে বাড়ি ঘুরতে যাবে?’

নীলয় অবাক হয়ে পাশ ফিরে তাকালো অদ্ভুত স্বরে বললো,

‘ ভুতুড়ে বাড়ি মানে,

জহির কিছু বলবে এরই মাঝে নীলা এসে বললো,

‘ ওসব ভুতুড়ে বাড়ি টাড়ি কিছু না নীলয় ভাইয়া আমরা কুচুটে বুড়ির বাড়ির যাচ্ছি তুমি যাবে আচার খেয়ে আসবো আনে?’

নীলয় এদের কথার আগামাথা ঠিকভাবে বুঝতে পারে না তাই প্রশ্ন করে,

‘ কুচুটে বুড়ি কে?’

নীলয়ের কথা শেষ হতেই সেখানে উপস্থিত হয় অহনা। নীলাকে ধমকে বলে,

‘ কুচুটে বুড়ি কি নীলা রাঙা দাদি বলতে পারিস না।’

নীলা মাথা নিচু করে রয়। আর অহনা নীলয়কে উদ্দেশ্য করে বলে,

‘ আসলে আমাদের বাড়ি থেকে আর কতদূর এগিয়ে রাঙা দাদির বাড়ি আমরা সপ্তাহ অন্তত একবার যাই দাদিমার কাছে উনি ভীষণ সুন্দর আচার বানান। একাও থাকেন তাই আর কি। আমরা এখন যাবো ওখানে আপনি যাবেন আমাদের সাথে?’

নীলয় তার বাবার ট্রাক্টর চালানোর দিকে তাকালো। কাঁদায় বাবার অবস্থা যাচ্ছে তাই এসব দেখতে থাকলে নীলয় না জানি বাবার সামনে কি করে বসে তার চেয়ে এদের সাথেই যাওয়া যাক। নীলয় অনেকক্ষণ ভেবে বললো,

‘ হুম যাবো চলো,

নীলয়ের কথা শুনে ভিতর থেকে খুব খুশি হয়েছে অহনা। তবে বাহিরে তা প্রকাশ করলো না। হাঁটা শুরু করলো সবাই একসাথে।’

মাটির রাস্তা যার একদিকে গ্রামের বাড়ি আর অন্যদিকে বয়ে চলছে খাল, খালের ভিড়ে এক দুইটা নৌকাও যাচ্ছে। খালের ওপারেই রয়েছে বিশাল ফসলের জমি। গাছের ডালে পাখির বাসা। নীলয় আশপাশ তাকাতে তাকাতেই এগোতে লাগলো সাথে এটা ওটা প্রশ্ন করতে লাগলো অহনাকে। অহনাও নীলয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো।অন্যদিকে জহির আর নীলা অহনা নীলয়ের ছাড়িয়ে আরো আগেই এগিয়ে গেছে।’

রাঙা দাদির বাড়ি যাওয়ার আগে গ্রামীণ ভাষায় গাছ দিয়ে তৈরি একটা লম্বা হাক্কা বা গাছ ফেলে ব্রিজের মতো বানানো আছে। তবে সেটা খুবই চিকন। চিকন গাছ আর বাস দিয়ে বানানো হাক্কা। হাক্কার নিচে খাল। নীলয় এত চিকন ব্রিজ থেকে বললো,

‘ আমাদের এটার ওপর দিয়ে যেতে হবে?’

অহনা মাথা নাড়ায় বলে,

‘ জি।’

অহনার কথা শুনে বিস্মিত স্বরে বললো নীলয়,

‘ যদি পড়ে যাই।’

অহনা হাল্কা হাসে। বলে,

‘ পড়বেন না আসুন যাই।’

বলেই অহনা এগোতে লাগলো যা দেখে নীলয় বললো,

‘ আমি যাবো না তোমরা যাও,

‘ আরে ভয় পাচ্ছেন কেন আমি আছি তো।’

‘ তারপরও আমায় সত্যি ভয় লাগছে অহনা যদি পড়ে যাই এসবে আমি কখনো হাঁটি নি।’

‘ হাঁটেন নি তো কি হয়েছে আজ হাঁটবেন?’

তাও নীলয় ওটা দিয়ে পাড় হতে নারাজ। অহনা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বলে,

‘ আপনার জুতোটা খুলে ফেলুন নীলয় সাহেব?’

নীলয় অবাক হয়ে বললো,

‘ জুতো খুলবো?’

‘ হা এতে আরো সহজে এটা পার হতে পারবেন দেখবেন?’

নীলয় এবার শুনলো মেয়েটা এতবার তাকে যাওয়ার জন্য বলছে এবারও না বললে বাজে দেখায় নীলয় তার পায়ের সু জুতো খুলে ফেললো অহনা নীলার হাতে নীলয়ের জুতা ধরিয়ে দিয়ে ওপারে রাখতে বলে নীলাও শুনে। তারা এ নিয়ে এই হাক্কাটা চারবার পাড় করলো। অহনা নিজের হাতটা এগিয়ে দিলো। খুব শীতল স্বরে বললো,

‘ আমার হাত ধরে আসুন নীলয় সাহেব দেখবেন ভয় লাগবে না।’

অহনার কথাটায় যেন মুগ্ধ হলো নীলয়। মুগ্ধ হয়েই নিজের হাতটা এগিয়ে দিলো অহনার দিকে। অহনাও ধরলো নীলয়ের হাত। তারপর উপরে থাকা বাঁশটা ধরতে বললো অহনা। নীলয় শুনলো, তারপর ধীরে ধীরে বাঁশ আর অহনার হাত ধরে হাঁটতে লাগলো দুজন। খালি পায়ে হাঁটার জন্য আরো বেশি যেন ভালো লাগছে নীলয়ের। হাক্কার একদম শেষ প্রান্তে আসতেই আচমকা একটা ধমকা হওয়া আসলো এতে হাল্কা করে হাক্কাটা নড়ে উঠলো। অহনা জুতো না খোলার জন্য শেষে গিয়ে পড়ে যেতে নিলো। সঙ্গে সঙ্গে অহনার হাত ধরে নিজের দিকে টানলো নীলয়। আচমকা হাতে টান লাগতেই অহনা এসে পড়লো সোজা নীলয়ের বুকের কাছে। কাছাকাছি হলো দুজন, চোখে চোখে দৃষ্টি আটকালো দুজনেরই। নীলয় হঠাৎই মনে মনে আওড়ালো,

‘ এই যে আমি না চাইতেও তোমার চোখে চোখ রাখছি, কাছাকাছি হচ্ছি, হৃদয়ে খানিকটা যন্ত্রনা হচ্ছে ভালো লাগাটা বার বার সৃষ্টি হচ্ছে। এটা কি আধও ঠিক হচ্ছে রমণী?’

চলবে….