মেহবুব পর্ব-১+২

0
2

‎#মেহবুব
‎#তাবাসসুম_তোয়া
‎#পর্বঃ১

‎আমার আজও মনে পড়ে, আমি তখন ক্লাস টু’তে। বছরের মাঝামাঝি কোন এক সময়ে বাপ্পি আমাদের কিন্ডারগার্টেন স্কুলে ভর্তি হয়েছিল! ওর বাবা বদলি হয়ে এসেছিল এবং কি এক জটিলতা ছিলো তাই বছরের মাঝামাঝি সময়েই ওরা শহর চেঞ্জ করেছিল৷

‎ক্যাবলাকান্ত বললে ভুল হবেনা একদম উজবুক ছেলেটা প্রথম দিনেই পিটি প্যারোডের সময় দৌড়ে এসে আমার পায়ে দিলো এক পাড়া! এমন ভয়াবহ পাড়া ছিলো সেটা,যে আমার পায়ের কনিষ্ঠা একদম পিষে গেল মনে হলো। আমি চিৎকার দিয়ে উঠে অটোমেটিক আত্মরক্ষার্থে ওকে দিয়েছিলাম জোরে এক ধাক্কা। কিভাবে দিয়েছিলাম মনে পড়ে না। তবে সেই ধাক্কায় উজবুকটা পড়লো গিয়ে মক্কায়!ধারাভাষ্যকার চৌধুরী জাফরুল্লাহ শারাফাতের ভাষায় যাকে বলে,একেবারে সীমানা ছাড়িয়ে মাঠের বাইরে! ও এতোটা দূরে গিয়ে পড়বে কে জানতো?

‎ঠিক তখনই একজোড়া রক্তচক্ষু দৃষ্টি আমাকে ছুয়ে গেল তীক্ষ্ণ ভাবে! বাপ্পির বড় ভাই তারিক ভাই। উনার চোখ দেখেই আমি এতো ভয় পেয়েছিলাম যে ভ্যাঁ করে কান্না জুড়ে দিলাম। উনি সেদিন নির্দয়ের মতোই আচরণ করলেন। একবারও আমার দিকে এগিয়ে এলেন না। নিজ ভাইকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করলেন। উনি তখন কোন ক্লাসে জানি পড়তেন! আমার জানা ছিলো না!

‎মিনারা মিস আমাকে আদর করে শান্ত করলেন।এরপর থেকে আমি তারিক ভাইকে এতো বেশি ভয় পেতাম! উনাকে দেখলেই কোন কিছুর পিছনে লুকিয়ে পড়তাম! কখনও পিলার, কখনও বেঞ্চের নিচে,কখনও বা ক্লাসে ছুট দিতাম! এমন ভাবেই চলছিল দিনকাল।

‎এরমধ্যে আরেকদিন বাপ্পি উজবুকটা আরোও একটা কান্ড ঘটালো। নাক ঝেড়ে হাত ঝাড়া দিতেই সেই সর্দি এসে পড়লো আমার স্কার্ফে! একদম আমার মুখের কাছাকাছি! আমি তো সেটা দেখেই তুমুল চিৎকার। দৌড়ে এলেন দিলারা মিস। উনি টিস্যু দিয়ে সেটা পরিষ্কার করলেন আর বাপ্পিকে এই ব্যাপারে সর্তক করলেন। গাধা বাপ্পি সেই নালিশ করলো তার বড় ভাইকে,আমার সামনেই অদূরে দাড়িয়ে আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বললো, আমি নাকি মিসকে দিয়ে তাকে বকা খাইয়েছি। সেদিনও তারিক ভাই আবারও আমার দিকে রক্তচক্ষু দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন!

‎এভাবেই দিনকে দিন গাধাটা আমার কাছে অসহ্যকর হয়ে উঠেছিলো। সাথে গাধার বড়ভাইটাও।
‎ওমা এর মধ্যে একদিন বিকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি সেই বান্দারা আমাদের বাসায়। বাপ্পি তার ভাই আর বাবা মা সহ ! আমি আকাশ থেকে পড়লাম যেন! এরা আমাদের বাড়িতে কেন?
‎তারিক ভাইকে দেখেই সেই যে ঘরের দিকে দৌড় দিলাম! আজও দৌড় কালও দৌড়! আর বের হয়নি! বাপ্পির আম্মু আমাকে রুমে এসে আদর করে গেলেন। আন্টির সে কি আদর। উনার মেয়ে নেই! কিন্তু মেয়ের শখ ছিলো ভীষণ। সেজন্য আমাকে আদরটা যেন একটু বেশিই ছিলো।

‎উনারা চলে গেলে জানতে পারলাম তারিক ভাইয়ের বাবা আমার আব্বুর ছোটবেলায় জানের জিগার দোস্ত!

‎জগতে এতো মানুষ রেখে ঐ বড় বড় চোখের মানুষটাকেই কেন আব্বুর বন্ধুর ছেলে হতো হলো সেই হিসাব আমার মিললো না কখনও! সেই গরুর মতো চোখ জোড়ার মানুষটাকে আমার সহ্য হতো না একবিন্দুও,এমনকি আমার সহ্য হয়নি বড় হওয়া অব্দিও। অবশ্য এটাও সঠিক সেই গুরুগম্ভীর মানুষটা কোনদিনও আমার সাথে কথা বলেনি!
‎নট এ সিঙ্গেল ওয়ার্ড! কোনোদিন না! খুবই অবাক
‎করা ব্যাপার ছিলো সেটা। আমরা প্রায় পনের বছর ধরে পরিচিত ছিলাম তবুও উনি কোনদিন একটা ওয়ার্ড আমাকে বলেননি! আর তাই আমিও কোনদিন বলিনি। অবশ্য বড় হওয়ার পর উনার সামনে আমি কোনদিনই পড়িনি। সেটা ইচ্ছাকৃতই ছিলো।

‎শুনেছিলাম উনি রাজশাহী ক্যাডেট কলেজে পড়তেন। বাড়িতে আসতেন অনেক পরে পরে। যার জন্য দেখাই হতো না উনার সাথে। আর উনি হয়তো হাতে গোনা এক দুবার এসেছিলেন আমাদের বাড়িতে। যার কারনে বাপ্পির সাথে মোটামুটি একটা নটখট সম্পর্ক থাকলেও উনি ছিলেন একদম ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। বাপ্পির সাথে আমার স্কুল কলেজ একই ছিলো! বারো বছরের বন্ধুত্ত্ব প্রায়।

‎আমি তখন এইট কিংবা নাইনে! তারিক ভাইয়ের এক রিলেটিভসের বিয়েতে গিয়েছিলাম। আমার মনে হলো, উনি ঘুরে ফিরে আমাকে কয়েকবার নোটিশ করলেন!আমার সাথে চোখাচোখিও হলো! আমি ভীষণ অবাক হলাম! ঐ কয়েকবারে দৃষ্টিতেই আমার কেমন যেন অনুভূতি হলো! ঐ যে কথায় আছে না, মেয়েদের সিক্সথ সেন্স অনেক হাই!

‎সেই তখন আমার ছোটবেলার দূরন্তপনায় ভাটা পড়েছে অনেকটাই,আমি তখন শান্তশিষ্ট মেয়েটা। যে সবসময় আম্মুর বোরকার কোণা ধরে ঘুরে বেড়ায়! সেদিনও যথেষ্ট শালীনভাবেই ছিলাম আমি। হজ্জ্ব থেকে ফিরে আব্বু আমার জন্য খুব দামী এরাবিয়ান বোরকা সেট নিয়ে এসেছিলেন। বিয়েতে আমি সেটাই পরেছিলাম। সাথে আম্মু আব্বু থাকায় কোনরূপ এদিকে ওদিকেও তাকাতে পারিনি। পুরোটা সময় ভদ্র মেয়ের মতোই আম্মুর পাশে বসেছিলাম। সেদিন আমার ভদ্রতা দেখে নাকি দুইটা বিয়ের প্রস্তাবও এসেছিলো! আম্মু বাসায় এসে একথা বলতেই আমি হেঁসে গড়াগড়ি খাওয়ার জোগাড়!


‎তবে উনার ঐদিনের দৃষ্টি আমাকে অনেকদিন ভুগালো! কেন সেটা আমার জানা হলো না! কেন উনি ওমন করে আমাকে বার বার দেখছিলেন? কি জানি! ছোট্ট আমার মাথায় ঢুকলো না!

‎আম্মুর সাথে জামান আন্টির যোগাযোগ চলতো সবসময়ই। তারিক ভাই ISSB তে টিকেছেন সেই নিয়ে বিশাল এক আনন্দের উৎসব শুরু হলো যেন! আন্টি তো ভীষণ খুশি। তিনবেলা ফোন দিয়ে ছেলে কখন কি করেন সব আপডেট দিতে থাকেন। এদিকে আমিও ফোনে কথা বলার পুরোটা সময় আম্মুর পাশে এ বাহানায় সে বাহানায় ঘুরঘুর করতে থাকি!

‎এর মাঝে তারিক ভাইয়েরা সবাই এলেন একদিন মিষ্টির প্যাকেট হাতে৷ আমি তিনতলার উপর থেকে উনাদের আসতে দেখলাম। সামনে যাওয়ার সাহস হয়নি৷ তখন আমি যথেষ্ট বড়৷ বাইরের মেহমানের সামনে যায়না একদমই৷ কিন্তু ঐদিন উনাকে দেখতে ইচ্ছে হলো ভীষণ! কতদিন পর এসেছেন! আন্টি ভিতরে আমার রুমে এসে আমার সাথে গল্প করলেন অনেকক্ষণ।

‎তারপর আঙ্কেল ভাইয়েরা সবাই নামাজে চলে গেলে আমি গেলাম দরজা বন্ধ করতে৷ ঠিক তখনই উনি যেন কোন কারনে ফিরে এসেছিলেন। আমি দরজা আটকাবো ওমনি উনি দরজা হাত দিয়ে থামিয়ে দিলেন। আমি চোখ উচিয়ে উনাকে দেখে দরজা ছেড়ে সরে দাড়ালাম৷ তারিক ভাইয়ের আর্মি কাটিং চুল, সাথে পুড়ে যাওয়া চেহারা দেখে ভীষণ অবাক হব কি মর্মাহত হলাম! মানুষটা চেনার মতোই ছিলো না। কি পরিমান গাধার খাটুনি তিনি খেটেছেন সেটা উনাকে দেখে খুব বুঝলাম। উনি আমার দিকে খুব স্বাভাবিক দৃষ্টি দিলেন, যেন উনি আশা করেছিলেন আমায়! তারপর হাতের ঘড়িটা খুলতে খুলতেই একবার আম্মু বলে ডাকলেন, কিন্তু আন্টি আসছেন না দেখে উনার ঘড়িটা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। আমি কাঁপা হাতে সেটা ধরতেই উনি গটগট পায়ে নেমে চলে গেলেন! আমার মনে প্রশ্ন জাগলো নামাজে কি ঘড়ি পরে যাওয়া যায় না?তবে? আমি উনার ঘড়িটা ধরেও ধরতে পারছিলাম না। এতোটা লজ্জা লাগছিলো! হাতের মুঠোয় পুরে যেন উনার স্পর্শকে অনুভব করার চেষ্টা করছিলাম!

‎সেদিন আমি নিজেকে চিনতে পারছিলাম না, এ আমি অন্য আমি! এ আমির কি হলো?
‎আমি ঘড়িটাকে সেন্টার টেবিলের উপর রেখে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম। আমি কি এর আগে কখনও ঘড়ি দেখিনি! তবে ঘড়িটা কেন এতো আপন লাগছিলো? আমি করলাম কি, আমার ফুল হাতা জামার নিচে ঘড়িটা পরে থাকলাম। লম্বা মানুষটার বড় ঘড়িটা আমার চিকনা হাতে ঝুলে থাকলো ব্যসলেটের মতোই! পড়েই যাচ্ছিল, কোনরকমে পতন ঠেকালাম। আমি সেটাকে পরে থাকলাম উনারা ফেরা অব্দি,তবে লুকিয়ে চুপিয়ে।

বাপ্পি তখন আমার সাথে অনেক ফ্রী। তবে পরিমিত ডিস্টেন্স বজায় রাখতো সবসময়ই। আমার রুমের দরজায় এসে নক করে বললো

‎” মুনিবা, ভাই তোর কাছে ঘড়ি দিয়েছিলেন? ”

‎ আমি দরজার ঐ পাশ থেকে বললাম

‎” আমার ঘড়িটা ভীষণ পছন্দ হয়েছে যদি ফেরত না দিই তবে ভাইয়া কি আমায় মারবে? ”


‎চলবে..

‎” তুই ভাইকে চিনিস না। ভাই উনার জিনিসে কাউকে হাত দিতেই দেয় না। এমনকি আমাকেও না। ”

‎আমি দরজার ওপাশ থেকে হাতটা বের করে দেখালাম

‎” দেখ আমার হাতে খুব মানিয়েছে না? সত্যি বলবি? ”

‎সিরিয়াসলি আমি জানতাম না তারিক ভাই আমার রুমের সামনের বেসিনে তখন ফ্রেশ হচ্ছিলেন! উনিও ঘুরে দেখেছেন আমার হাতে ঘড়ি! আমি ভেজিয়ে রাখা দরজার ওপাশ থেকে কিছুই জানলাম না।

‎বাপ্পি হাসলো খুব। তারপর ভাই চলে গেলে, আমাকে বললো,

‎”ভাই কিন্তু মাত্র দেখেছে তোর কান্ড! ”

‎”কি বলিস?কিভাবে? ”

‎”কথা না বাড়িয়ে ঘড়িটা দে!”

‎আমি ইয়া নফসি ইয়া নফসি করতে করতে ঝটপট ঘড়িটা খুলে তাকে দিয়ে দিলাম।

‎যাওয়ার আগে আন্টি আমাকে একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করলেন। উনি সবসময় আমাকে আম্মু বলেই ডাকতেন।

‎” তোমার কোনটা বেশি পছন্দ আর্মি, নেভি নাকি এয়ার ফোর্স? ”

‎আমি খানিকটা ভাবলাম, তারপর বললাম

‎” আর্মি, কেন ভাইয়ের না আার্মিতে রিকমেন্ডেড হয়েছে ? ”

“‎ও সিলেক্টেড হয়েছে কিন্তু ঠিক কোন ফোর্সে এস্যাইন করবে সেটা এখনও সিলেক্ট হয়নি। ও সবার মতামত নিচ্ছে কার কোনটা পছন্দ৷ ওর অবশ্য নেভি পছন্দ। ”

‎আমি আঁতকে উঠে বললাম

‎ ” কি বলেন! নেভিতে তো সারাবছর সমুদ্রেই থাকবে! এমন ভয়াবহ পছন্দ কেন? তাইলে তো ভাইয়ের বৌ টিকবে না হান্ড্রেড পার্সেন্ট!”

‎একথা শুনে আন্টি হাসতে হাসতে ডাইনিং এ চলে গেলেন। তারপর তারিক ভাইকে ডেকে বললেন

‎ ” মুনিবা বলেছে তোর বৌ টিকবে না। ”

‎তারিক ভাইয়ের গুরুগম্ভীর কন্ঠস্বর

‎” কেন? ”

‎”ঐযে তুই নেভিতে যেতে চাস। সারাবছর থাকবি সমুদ্রে! ”

‎আমি পর্দার ফাঁক দিয়ে দেখলাম, উনি হালকা করে চোখে হাসলেন। একদম অস্পষ্ট হাসি! বললেন

‎”বৌ না টিকলে তো মহাবিপদ। ”

‎আন্টি আমার কথা গুলো ভাইয়ের সামনে গিয়ে বলবেন এটা জানলে আমি টু শব্দটিও করতাম না!

‎উনারা চলে গেলেন। একদিন পর তারিক ভাইও চলে গেলেন। আমি জানতাম উনি পতেঙ্গাতে যাবেন BNA তে কিন্তু পরে জানলাম নাহ উনি ভাটিয়ারীতে গেছেন BMA তে। উনি আমার ইচ্ছের এতোটা মূল্যায়ন করলেন নাকি স্বেচ্ছায়/একাডেমি থেকে এই সিদ্ধান্ত দেওয়া হলো জানি না তবে ব্যাপারটা ভীষণ ভালো লাগলো। আমি তো এটা শোনার পর আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে আলহামদুলিল্লাহ বলে চিৎকার দিলাম!

‎______________________________

‎কয়েকদিন পরে আমার নামে একটা পার্সেল আসলো। আমি কোচিং থেকে ফিরে পার্সেলটা রিসিভ করলাম। পার্সেলের উপর একদম টাইপ করার মতো হাতের লেখা দেখেই বুঝে গেলাম পার্সেলটা কে পাঠিয়েছে। আমি উনার হাতের লেখা চিনতাম। বাপ্পি খুব প্রশংসা করতো। প্লাস আমাকে কয়েকবার উনার হাতের লেখা দেখিয়েছে যখন উনাদের বাড়িতে গেছি, বেশীরভাগ সময়ই উনি তখন বাড়িতে থাকতেন না ৷

‎আমি কাঁপা কাঁপা হাতে পার্সেলটা খুললাম। সেটার মধ্যে একটা লেডিস ঘড়ি ছিলো! একদম উনার জেন্টস ঘড়িটার লেডিস ভার্সনটা। উনার সাথেই মিলিয়ে কিনেছেন বোঝা গেল!

আমি আল্লাদে আটখানা হয়ে গেলাম। সেই ঘড়ি মাথায় রাখি নাকি বুকে রাখি সেই অবস্থা! ঘড়িটা আমার একদম নিত্য সঙ্গী হয়ে গেল৷ আমি ঘুমালেও ঘড়ি পরে ঘুমায়৷ নাহয় বালিশের পাশে রাখি। যক্ষের ধনের মতো আগলে রাখি ঘড়িটা! আম্মু সে কথা আবার জামান আন্টির সাথে গল্প করলেন৷ আর জামান আন্টি সে কথা কানে তুলে দিলেন সেই গুরুগম্ভীর মানুষটার কানে! উনি নাকি আমার কান্ডে হেসেছেন। এটা আমাকে জানালো আম্মু! আমি সে কথা শুনে অবাক হলাম। উনি হাসতে জানেন?
‎কই আমি তো কোনদিন দেখিনি!

‎আমি কল্পনায় তার হাস্যরত চেহারা দেখতে পারছিলাম৷ তখনও অব্দি উনি আমার ভাই ছিলেন। আমি উনার ঘড়ি দিতে চাচ্ছিলাম না বিধায় উনি আমার জন্য, মুহাইমিনের( আমার ছোটভাই) আর বাপ্পির জন্য তিনটা ঘড়ি গিফট করেছিলেন। ব্যাপারটা দু পরিবারের সবার কাছেই স্বাভাবিক ছিলো! কিন্তু আমার কাছে মনে হতো ব্যাপারটা খানিকটা অন্যরকম! নাকি আমার জানায় কোন ভুল ছিলো? উনি কি সত্যিই আমাকে নিয়ে কোন কিছু ফিল করতেন নাকি সবটাই আমার কল্পনা ছিলো! সঠিক জানতাম না তখনও। আস্ত মানুষ পড়ে ফেলার মতো বয়স কি আমার হয়েছিল?যেখানে মানুষটা ছিলো ওতোটা গুরুগম্ভীর!

‎____________________________

‎কাটতে লাগলো মাসের পর মাস,সেটা বছর পেরুলো।

‎আমি জানতাম উনি বাসায় নেই, তবুও কলেজ শেষ করে আমি উনাদের বাসায় সামনের রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসতাম। কত হেঁটেছি সেই পথটা বেয়ে। আসলেই পথটা ছিলো আমার হৃদয়ের পথ! খুব ভালো লাগতো সেই বাসায় সামনের ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা ল্যাম্পপোস্ট,ল্যাম্পপোস্টের পাশের বকুল গাছটা,অদূরের বটগাছ! সকাল কিংবা দুপুরের পরও সেই ল্যাম্পপোস্টের নিচে প্রচুর পিপিলিকা মরে পড়ে থাকতো। বোঝা যেত গতরাতে সেগুলো ল্যাম্পপোস্টের আলোয় উড়ছিলো। আমি দাড়িয়ে দাড়িয়ে গুনতাম!কতগুলো পিপিলিকা সেখানে!

‎আমি মাসের পর মাস সেই পথ ধরে হেঁটে গেছি।
‎দূর থেকে উনাদের দোতলা দেখতে আমার ভীষণ আপন আপন লাগতো! রাস্তার সাথেই লাগোয়া বাড়িটা! আমি উনার রুমের জানালাটা দেখতাম। উনি না থাকলেও সেটা খোলা থাকতো৷ আন্টি নিয়মিত খুলতেন। মনে হতো উনার থেকেও এই বাড়িটা আমার বেশি প্রিয়! জন্ম জন্মান্তরের সম্পর্ক আমার এই বাড়ির সাথেই। যদিও আঙ্কেলের বার বার বদলি হতে থাকলো কিন্তু আন্টি আর গেলেন না। এখানে এই বাড়িতেই স্থায়ী হলেন।

‎এমনই একদিন ধরা পড়ে গেলাম। সত্যি বলতে আমিও এটাই চাইতাম। সেই পথ ধরে হেটে যেতাম শুধু এটুকু আশায় যদি একবার উনার দেখা পায়! সেইদিন আমি জানতাম না উনি এসেছেন। আমি মনের আনন্দ বাসাটা দেখতে দেখতে পার হচ্ছি৷ উনাকে খেয়াল করিনি। উনি ছাদে ছিলেন৷ উনার অনেক গুলো কবুতর ছিলো৷ সেগুলোকেই হয়তো খাবার দিচ্ছিলেন। আন্টিও পাশে ছিলেন। আমাকে যেতে দেখে উনি শব্দ করে আন্টিকে ডাক দিলেন। আন্টি তাড়াতাড়ি এদিকে এসে আমাকে থামালেন

‎” মুনিবা তুমি এদিকে কেন আম্মু? ”

‎আমি তো থতমত খেয়ে গেলাম। কি বলবো? বললাম

‎”আন্টি কলেজ থেকে ফিরছি ”

‎”তোমার কলেজ তো এদিকে না? ”

‎আমি ধরা পড়লাম এবার। এক সেকেন্ডের মতো ভেবে উত্তর করলাম

‎”আন্টি রাখীর বাসা এদিকে। ওর সাথে ঘুরতে এসেছিলাম। এখন আসি আন্টি ”

‎আন্টি থামিয়ে দিলেন।

‎”দাড়াও, এতদূর এসেছো আর আমার বাসায় না এসে ফিরে যাচ্ছো? তা হবে না। উঠে এসো।”

‎আমি পাশের মানুষটার দিকে তাকালাম। তার দৃষ্টি আমাকে শূন্যে ভাসাচ্ছে। সে হয়তো টের পেয়েছে। আন্টি তারিক ভাইকে বললেন।

‎”আব্বু গেটটা খুলে দিয়ে এসো। ”

‎কথাটা আমি শুনতেই আমার হৃদপিণ্ডে ঢোল বাজতে শুরু করলো! আমি বাড়ির সামনে এগিয়ে আসতেই, উনি চাবির গোছা হাতে টুংটাং শব্দ করতে করতেই নেমে এলেন । আমি গেটের বাইরে দাড়িয়ে চুপচাপ। কত বছর পর, নাকি শতাব্দী পর দেখলাম! এক ঝলক উনাকে দেখে দৃষ্টি নত করে সালাম দিলাম।

‎”আসসালামু আলাইকুম, ভাইয়া ”

‎উনি কোন উত্তর করলেন কিনা আমি শুনতে পেলাম না। সত্যি বলতে আমি না উনাকে ঠিক ভাবে কোনদিনই দেখার সুযোগ পায়নি! বলতে গেলে তাকাতে ভয় পেতাম। ঐ এক ঝলক যা দেখতাম! মানুষ টাকে সেদিন একদম অন্যরকম লাগলো!

‎কেচকি গেটটা খুলে গেটম্যানের মতোই সরে দাড়িয়ে থাকলেন। সাথে চিরচেনা সেই লুক। আর্মি কাটিং সাথে গাম্ভীর্য। ছেলে থেকে বলিষ্ঠ পুরুষে রুপান্তরিত হয়েছেন নাকি অন্য কিছু! চেহারার মধ্যে একটা অন্যরকম ব্যাপার ছিলো।
‎উনার প্রতিটি পদক্ষেপ এতোটা গাম্ভীর্যমাখা ছিলো! আমি ক্রাশ খেতাম বার বার! তবে বুঝতে দিতাম না কখনও! আমি সিড়ি দিয়ে উঠে আসতেই উনি আবারও গেটে তালা দিয়ে চলে এলেন।
আমি তাড়াতাড়ি করে পা চালিয়ে চলে গেলাম ছাদে। ওমা দেখি আন্টি নেই ছাদে! আমি আসছি দেখে উনি দোতলায় নেমে এসেছিলেন। আমি যখন কবুতর গুলোকে দেখছি তখন তারিক ভাই আবারও উঠে এসেছেন ছাদে। তাকে দেখে আমি আবার জমে গেলাম! তাড়াতাড়ি করে জায়গা ত্যাগ করলাম। উনি একবার সেই বড় বড় চোখ জোড়া তুলে তাকালেন আমার দিকে। এক দৃষ্টিতেই আমি কুপোকাত হলাম! বিশাল মানুষটা সবসময় আমার কাছে ছিলো ভয়ের।

‎আমি নেমে এলাম দোতলায়। আন্টি ভীষণ আদর করলেন। গরমে ঘেমে-নেয়ে এসেছি তাই ফ্যানের নিচে বসিয়ে ঠেসেঠুসে দু গ্লাস শরবত খাওয়ালেন। তারপর উনার থ্রিপিস দিয়ে আমাকে পাঠিয়ে দিলেন গোসলে। বললেন

‎” আজ ফিরতে পারবে না৷ আমি সুফিয়া(আম্মু) কে ফোন দিয়েছি। ও নিজেও অবাক হলো তুমি এতদূর কেন এসেছো? ”

‎গোসল নামাজ শেষে আন্টির রুমে বসে ছিলাম। উনি ড্রয়িং এ বসে টিভি দেখছেন। L সাাইজের পাশাপাশি তিনটা রুম। আন্টির রুমটা L এর মাথা। আমি সেখানের দরজা থেকে উঁকি দিয়ে দেখলাম তারিক ভাই খেলা দেখছে। লিভারপুল আর ম্যানসিটি। আমি ভাইয়ের পিছনটা দেখতে পারছি এবং পুরোটা টিভি। প্রথমে উঁকি দিয়ে দেখার পর আমার সাহস বেড়ে গেল। আমি আবারও দরজা দিয়ে মাথা বের করে উঁকি দিলাম, ঠিক তখনই তারিক ভাইও ঘাড়ের পিছনে হাত বোলাতে বোলাতে হঠাৎ করেই পিছনে ফিরলেন। আমি একদম ধরা খেলাম! সাথে তিনিও। দুজনেই ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। আমি রুমের মধ্যে ঢুকে গেলাম আর বের হলাম না আর উনি টিভিটা বন্ধ করে নিজের রুমে চলে গেলেন!
‎সেদিনই প্রথম দুজনেই দু’জনের সামনে মুখোমুখি ধরা পড়লাম!

‎আমি আন্টির সাথে রান্নাঘরে চলে গেলাম। সবার জন্য টেবিল রেডি করলাম। আন্টি উনাদের আগে ডাকলেন না। আন্টি আমাকে টেবিলে বসিয়ে নিজ হাতে খাইয়ে দিলেন। আন্টির সালোয়ার কামিজে আমাকে একদম আলখেল্লা পরা পাগলির মতোই লাগছিলো। তবুও ওড়নাটাকে সুন্দর করে হিজাবের মতো পিন করে ডাইনিং এ আন্টির হাতে খাচ্ছিলাম। সেটা দেখে বাপ্পি এসে টিটকারি করলো! ওর মনে হয় হিংসে হলো!

‎” এই তুই আমার মায়ের হাতে খাস কেন? এতো বড় ধাড়ি মেয়ে তোর হাত নেই! ”

‎আন্টি ধামকি দিয়ে বিদায় করলেন। বাপ্পি মুখ ভেঙচি দিয়ে চলে গেল! আন্টি বলে চললেন,

‎” আমার মেয়ের ভীষণ শখ ছিলো। আল্লাহর কাছে চেয়েছিলাম বাপ্পিটা যেন মেয়ে হয়। কিন্তু হলো ছেলে! কি আর করা! আল্লাহ না দিলে কি করবো।”

‎বাপ্পিকে দেখলাম তারিক ভাইয়ের রুমে গেল। আমি ওদিকে তাকাতেই দেখলাম তারিক ভাই এদিকেই তাকিয়ে। আমাকে দেখার সাথে সাথে মোবাইলের দিকে নজর দিলেন। বাপ্পি ভাইয়ের সাথে চুপচাপ কি যেন বলাবলি করলো, আবারও ফিরে এসে শুধালো

‎”এই তুই সত্যি বলতো এদিকে কেন এসেছিস? রাখীর বাসা তো আরোও দু’বাড়ি পরে! ”


‎চলবে….