মেহবুব পর্ব-১১+১২

0
10

‎#মেহবুব
‎#তাবাসসুম_তোয়া
‎#পর্বঃ১১

‎ফজরের নামাজে উনি ইমামতি করলেন। আমি উনার পিছনে দাড়িয়ে নামাজ পড়লাম। উনি বললেন কফি খাবেন। তাই কফি বানাতে কিচেনে এসেছি। কফি হাতে নিয়ে গিয়ে দেখি উনি ঘুমিয়ে গেছেন।
‎ফোন দুটোর একটা ভাইব্রেট করছে। আমি তাড়াতাড়ি সেটা নিয়ে ভাইব্রেট বন্ধ করে টেবিলের উপরে রাখলাম। ফোন যে আমার সবচেয়ে বড় সতীন হবে এটা আমার বদ্ধমূল বিশ্বাস! সারাক্ষণ অনবরত বাজতেই থাকে!

‎মানুষটা কিছুক্ষণ ঘুমাক। উনার রেস্টটা খুবই জরুরি! কিন্তু সে কথা উনাকে কে বোঝাবে? উনি কি শুনবেন। আমাকে বলে ছুটোছুটি অথচ নিজে? আমি ঘুমন্ত মানুষটাকে দেখলাম অনেকক্ষণ! ঘুমন্ত উনাকে দেখার এই এক সুবিধা ঐ বড় বড় চোখ জোড়া বন্ধ তাইতো আমার দেখতেও সমস্যা হলোনা। কি সুন্দর শান্ত শীতল নদীর মতোই ঘুমিয়ে আছেন! অথচ জেগে থাকলে খরস্রোতা নদী! কি তার তর্জন গর্জন! আমার বড্ড ইচ্ছে হলো ছুঁয়ে দেখার অথচ সে হিম্মত নেই! তাকিয়ে থাকতেই কি ভীষণ লজ্জা আমাকে ঘিরে ধরছে!

‎আমি উনার কফিটা কিচেনে রেখে এসেছি। তারপর আলতো পায়ে হেটে সিড়ির পথ ধরলাম। কফি হাতে ছাদে গেলাম!

‎আমার নতুন জীবনের নতুন সূর্যোদয় দেখতে! সেদিনের সূর্যটা তখনও উদিত হয়নি। হবো হবো ভাব।
‎কবুতর গুলো উড়ে বেড়াচ্ছে খাঁচার ভিতরে। আর বাক বাকুম শব্দ করছে। আমি খাঁচার গেট খুলে দিলাম। উনার বড্ড শখের জায়গা এটা। আমি ছোটবেলা থেকে শুনেছি। একবার একটা বনবিড়াল এসে উনার পছন্দের একটা লোটন কবুতরকে মেরে রেখে গেছিলো! সেই শোকে উনি যে কত পাগলামি করেছেন শুনেছিলাম!
‎কফিটা শেষ করে সূর্যোদয় দেখছিলাম।

‎বেশ খানিকক্ষণ পর টের পেলাম কেউ উঠে আসছে। আমি কবুতরের খাঁচা পেরিয়ে একদম ঐ পাশের দেয়ালে গিয়ে লেগে থাকলাম। আমার মন বললো উনিই আসছেন! এতো সকালে আর কে আসবে?
‎আর উনার সামনে পড়তে ইচ্ছে করছে না একটুও।এতো এতো লজ্জা লাগছে! যে ইচ্ছে হচ্ছে মাটির সাথে মিশে যায়!

‎উনিই ছিলেন এবং আমাকে খুঁজেও পেলেন এক মূহুর্তেই, এসেই দিলেন এক ধামকি।

‎”এই তুমি আমার চুল গুলোকে নষ্ট করতে চাও?
‎কেন ওগুলোকে বেধে রেখেছো? তোমাকে না হেয়ার ড্রায়ার দিলাম! ”

‎আমি চোখ নিচু করে দাড়িয়ে আছি সকালটা শুরু হলো ধামকি দিয়ে। নাহ বিবাহিত জীবনের প্রথম সকালে গরম গরম ধামকি!
‎উনি হাত ধরে নিচে নিয়ে গেলেন। তারপর নিজ দায়িত্বে নিজেই চুল গুলোকে শুকিয়ে দিলেন। আমি আবারও লজ্জায় মাটির সাথে মিশলাম! অথচ সে নির্বিকার! আমার ইচ্ছে হলো বলতে ‘ আপনার নির্লিপ্ততা আমাকে একটু ধার দেন, আমিও বাঁচি এই হাঁসফাঁস অবস্থা থেকে! অথচ তা বলা হলো না! আমি বললাম

‎” আপনার ঘুম প্রয়োজন।”

‎ উনি বললেন

‎” তোমাকে প্রয়োজন, আমার কফি কই? ”

‎কথাটা শুনে হৃদয়ে ঘন্টা বাজলো,পালাতে চাইলাম! আমি বললাম

‎”নিয়ে আসি? ঘুমাচ্ছিলেন দেখে রেখে এসেছি। ”

‎” আচ্ছা যাও ”

‎আমি কফি নিতে আসলাম, চা বসালাম সবার জন্য। এটা সেটা করে সময় ক্ষেপন করছি। রুমে যেতে পারছি না কিংবা আর যাবো না । চা বানানো শেষ করে সেটা বড় ফ্লাস্কে ঢেলে রাখলাম। আমি এর আগেও আন্টির সাথে এ কাজ করেছি।
‎এরপর কফি হাতে যখন রুমে ঢুকবো তখন পা চলতে চাইলো না। যেতে পারছি না নিজের রুমেই! উনার সামনে পড়তে ইচ্ছে করছে না। উনি স্বাভাবিক হলেও আমি মোটেও স্বাভাবিক হতে পারছি না! কাজিনের মেয়ে রুমু যাচ্ছিল ওকে দিয়ে দিলাম কফি মগটা।

‎এরপর আমি ফ্লাস্ক হাতে নেমে এলাম নিচতলায়।

‎উনি কিচেনে এসে আম্মুকে দেখে বললেন

‎” তোমার মেয়ে কই? কফি আনতে পাঠালাম আর দেখছি হারিয়ে গেল! ”

‎” মাত্র তো তোমার খালাদের জন্য চা নিয়ে গেল নিচে! কফি না রুমুকে দিয়ে পাঠালো? ”

‎আমি চা নিয়ে নিচে গিয়ে দেখলাম কেউ উঠেনি
‎তাই ফ্লাস্কটাকে ওখানে রেখে এদিকে ওদিকে দেখছি। তখন দেখি উনি সিড়ি দিয়ে নেমে আসছেন৷ আমি দৌড়ে দরজার আড়ালে চলে গেলাম ! পড়বো না উনার সামনে! আল্লাহ বাঁচাও!

‎উনি এসেই আমাকে পেয়ে গেলেন! কেমনে এতো সহজে পাচ্ছেন ? ঈগলআই সম্পন্ন মানুষ!
‎দরজার ওপাশ থেকে টেনে এনে একদম সামনে দাড় করালেন। আমি চোখ বন্ধ করে ফেলেছি ।এতো দ্রুত টান দিয়েছেন বাতাসে সাই করে ভেসে সামনে এসে পড়েছি।উনি চুপচাপ দেখলেন কিছুক্ষণ। আমি চোখ খুলতে নিলেও আবারও আটকে দিলাম! উনি ফু দিলেন আমার চোখেমুখে ! তারপর বললো

‎”বুঝলাম না মানুষ বিয়ে করেছি নাকি ইদুর! হুটহাট কোন গর্তে লুকায় টের পায় না। খুজেও পায়না৷
‎বলি কি ইদুর সাহেবা নাকি বিড়াল ছানা! আমি যে কদিন আছি আর কোনো গর্তে লুকায়েন না৷ প্লিজ! আপনাকে খুজে পেতেই আমার অনেকটা সময় চলে যাচ্ছে! ”

‎আমি চোখ খুলে তাকালাম। উনি ভ্রু নাচালেন,

‎” কি সমস্যা? কফি কই আমার? ”

‎আমি মাথা নিচু করে ফেললাম! আমি কিচ্ছুটি বলতে পারলাম না। উনি আবারও আমাকে কোলে করে দোতলায় নিয়ে গেলেন!

‎দরজা আটকে বললেন

‎ ” স্বামীর নির্দেশ মানা ফরজ। সো তোমার স্বামীর নির্দেশ হচ্ছে চোখের আড়াল হবে না৷ ”

‎আমি আস্তে করে বললাম

‎ ” আপনার ক্ষত দেখবো।”

‎উনি বললেন

‎” নেই সেরে গেছে। তুমি এসেছো না? ”

‎তারপর রুমের পর্দা টেনে আবারও শুয়ে পড়লেন। আমি বললাম

‎ “কফি? ”

‎” খাবো না, কিছুক্ষণ ঘুমাবো” বলেই আমাকে টেনে নিয়ে কোলবালিশ বানিয়ে শুয়ে পড়লেন! কি সুন্দর! নিজেকে কি পুতুল মনে হচ্ছে! সামান্য স্পর্শেই জ্ঞান হারাচ্ছি! কি এক নাজুক অবস্থায় পড়ে আছি আমি!

‎___________________

‎সকালে নাস্তার পর উনি বের হবেন। আব্বুর ওখানে যাবেন। আমি যেতে চাইছি উনি বললেন

‎”রাতে আব্বুকে নিয়ে চলে আসবো। তুমি রেস্ট করো। তোমার রেস্ট দরকার! ”

‎আমি উনার এটা ওটা এগিয়ে দিচ্ছি। উনার প্রত্যেকটা জিনিসে হাত দিতে আমার হাত কাঁপছে!

‎গাড়ির চাবিটা বাপ্পির রুমে। আমি দরজায় গিয়ে দেখলাম বান্দরটা মুহাইমিনকে কোলবালিশ বানিয়ে ঘুমুচ্ছে। আমি ভিতরে গেলাম না। সাকিবকে বললাম,

‎ “গাড়ির চাবিটা? ”

‎সাকিব দিলো।
‎উনাকে চাবিটা দিতেই উনিও এগিয়ে এলেন। ড্রেসিং টেবিলের উপরে থাকা টিস্যু বক্স থেকে টিস্যু নিয়ে আমার ঠোঁটের লিপস্টিক মুছে দিতে দিতে বললেন

‎” এটা আর পরো না, হ্যাঁ? It tastes weird! ”

‎শুনেই আমার কান ঝালাফালা হয়ে গেল। গাল দিয়ে গরম ধোঁয়া বের হলো!
‎তখনই বাইরে মামা এসে দাড়িয়েছেন। ডাকলেন উনাকে। উনি বের হয়ে গেলেন। আমি
‎দৌড়ে বিছানার পড়ে বালিশ চাপা দিয়ে থাকলাম। ‘উফফ! এটা কোন কথা! ‘

‎কিছুক্ষণ পর টের পেলাম কেউ পাশে! আমি সাথে সাথে বালিশ সরিয়ে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করলাম! দেখি উনি হাসছেন! আমি উঠতে নিলাম উনি উঠতে দিলেন না, আরো হেলে আসলেন আমার দিকে!! চোখে চোখ রেখে বললেন

‎”এটা তোমার স্বভাব তাই না? ”

‎” কোনটা ”

‎”এই যে কিছু হলেই বালিশ চাপা দিয়ে পড়ে থাকো! ”

‎আমি বললাম

‎”আপনি আমাকে লজ্জা দিচ্ছেন! ”

‎উনি ভ্রু দিয়ে ইশারা করে বললেন

‎”যে কারনে এটা মুছলাম সেটা তো শেষ করা হলো না। ”

‎_____________________

‎ঐদিন দুপুরে বৌ ভাতের পর প্রায় সব মেহমান চলে গেল। উনার রেস্ট দরকার। তাই কেউ ভীড় করলো না। আমি অপেক্ষা করছিলাম কখন আব্বু আসবে। সবাইকে বিদায় দিয়ে বার বার ঘর টু বারান্দা করছিলাম।
‎বিকালের পর আব্বু এলেন৷ মোটামুটি সুস্থ। মাইল্ড স্ট্রোকের মতোই হয়েছিলো।
‎বাকিদিন কেটে গেল আব্বুর পাশে বসেই।

‎রাতের দিকে আমি আম্মুর পাশে বসেই ছিলাম। উনি আসলেন। আব্বুর ব্লাড সুগার চেক করলেন। প্রেসার মাপলেন। অক্সিজেন স্যাচুরেশন চেক করলেন! তারপর ঔষধ পত্র গুলো ঠিকমতো বুঝিয়ে দিলেন আমাকে আর আম্মুকে,

‎” তিনবেলা সময় ধরে ঔষধ গুলো খাইয়ে দেবে । ”

‎বাসায় থাকতে আব্বুর ঔষধ গুলোও আমি খাইয়ে দিতাম। উনি চলে গেলেন। আমি বসেই থাকলাম। কি করবো? আম্মু হয়তো সরাসরি বলতে পারলেন না, বললেন

‎”রুমে অবশ্যই ওয়াটার পট নিয়ো, সাথে কিছু স্ন্যাকস। কিচেনের সেলফে তারিকের ওয়াটার পটটা আছে। ”

‎আমি কিচেনে গিয়ে চুপচাপ দাড়িয়ে আছি। লাইটও জ্বালায়নি। কি করবো? কই যাবো? আমার কোন যাওয়ার জায়গা নাই! উনাকে দেখলাম রুম থেকে বের হলেন। আমি একদম সেলফের সাথে লেগে থাকলাম। উনি এদিকটা দেখে চলে গেলেন! টের পেলাম ছাদে যাচ্ছেন। তারপর আবারও রুমে ফিরে গেলেন৷ উনি কি আমাকেই খুজঁছেন?

‎তখন মনে হলো কেউ এলো কিচেনের দিকে। কিচেনের দেয়ালে লাগোয়া ফ্লিটার থেকে পানি নিচ্ছিলো বাপ্পি। অন্ধকারে আমাকে খেয়াল করেননি। আমি বললাম

‎”বাপ্পি উনার ওয়াটার পটটা কোথায়।”

‎ঐ উযবুকটা এমন এক চিৎকার দিলো আমারই জান বের হয়ে গেল তাতে ! ছেলে মানুষ এতো ভয় পায় জানা ছিলো না।
‎আমি সাথে সাথে লাইট জ্বালালাম। সবাই দৌড়ে এসেছে। বাপ্পি তখনও বুকে থুথু দিচ্ছে।

‎” বাসায় একটা ভূতনি নিয়ে এসেছো আম্মু? অন্ধকারে দাড়িয়ে থাকে! ”

‎উনি কেমন চোখে তাকালেন। তারপর আমার হাত ধরে নিয়ে গেলেন রুমে।
‎হঠাৎ এমন কান্ডে আমি হাসছিলাম খুব। কিন্তু উনার চেহারার দিকে তাকিয়ে হাসি উবে গেল!

‎রুমে এসে গেট আটকে দিলেন। আমার গলা শুকিয়ে গেল!

‎”কোথায় ছিলে তুমি? আমি তোমাকে মাত্র খুঁজে এসেছি। ছাদেও গিয়েছি, কিচেনেও গিয়েছিলাম!
‎অন্ধকারে কি করছিলে? কি সমস্যা? সবসময় পালাই পালাই কেন! ”

‎আমি চুপচাপ পড়ে থাকলাম। এ যে গতরাতের মানুষটা নয়। এযে কঠিন মানুষটা! । উনি বললেন

‎” কথা বলো, বলো কি সমস্যা আমি শুধরে নিচ্ছি। তুমি যা চাইবে তাই হবে! তবুও স্বাভাবিক হও। ”

‎আমি এবার সাহস করলাম।
‎আমি উনার চোখ দুটো হাত দিয়ে ঢেকে বললাম

‎”এই দুটো সমস্যা! ”

‎উনি হেসে উঠলেন।

‎”এখন কি আমি তাকাবোও না”

‎এমন ভাবে তাকালেন আমি বললাম

‎”এই ভাবে তাকানো যাবে না!”

‎ উনি আরেকটু অন্যরকম করে তাকালেন। আমি আবারও বললাম

‎”না এই ভাবেও না। ”

‎উনি আমার দিকে আরোও প্রখর দৃষ্টিতে তাকালেন! আমি সে দৃষ্টি টের পেলাম! আর আমার ভুল বুঝতে পারলাম। আমি চুপ হয়ে মাথা নামাতে গেছি উনি আমার গাল ধরে ফেললেন।

‎” উহু মুখ নামাবে না। ”

‎আমি বললাম “সরি।” আমার চোখে আর্জি!

‎উনার চোখে প্রখরতা সাথে দুষ্টুমি! উনি দৃষ্টি আরোও প্রখর করলেন। আমার অন্তর কেঁপে উঠলো!!এক দৃষ্টি দিয়েই পড়ে ফেলেন পুরোটা হৃদয়! দৃষ্টিটা একদম হৃদয়ে গিয়ে বিদ্ধ হয়! আমি সে দৃষ্টিতে মাতাল হয়ে যাচ্ছিলাম! আমি চোখ বন্ধ করতে নিলেই বললো,

‎”উহু চোখ বন্ধ করলেই কঠিন পানিশমেন্ট পাবে! ”

‎আমি আবারও আর্জি পেশ করলাম চোখে চোখে। সে আর্জি মঞ্জুর হলো না!

‎আমি ভাবছি উনি হয়তো আমার জন্যই দৃষ্টি চেঞ্জ করছিলেন একবারও টের পায়নি উনি এতোটা সিরিয়াস হয়ে উঠছেন!
‎আমি পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম সে দৃষ্টির গভীরতায়। কিন্তু চোখ সরানোর পারমিশন দিলেন না। আমার গলা শুকিয়ে গেল!
‎আমি চোখে চোখে আর্জি জানিয়েই গেলাম। আমি নিশ্বাস নিতে ভুলে গেলাম! একটা সময় হার মেনে চোখ বন্ধ করে ফেললাম।

‎আমি কাঁপছি! আবেগের এই খেলায় আমি বড্ড কাঁচা খেলোয়াড!
‎উনি আমার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললেন

‎” আমি সবসময় এই ভাবেই তাকায়। আর এভাবেই তাকাবো। তোমাকে সহ্য করতে হবে! তোমাকেই সব সহ্য করতে হবে,মেহবুব! ”

‎আমি থরথর করে কেঁপে উঠলাম, সে ফিসফিসানিতে পুরো স্নায়ুতন্ত্র ঝা ঝা করে উঠলো!
‎সেই ধীমিস্বর ছড়িয়ে পড়লো প্রতিটি নিউরনে নিউরনে, প্রতিটি লোমকূপের গোড়ায়!

‎আমার মনে হলো আমি পাগল হয়ে যাবো! কি ঝড়কে বরন করেছি আমি! এ তো পাগলা ঝড়! এ ঝড় সামলানো কি আমার কাজ!

চলবে….

‎#মেহবুব
‎#তাবাসসুম_তোয়া
‎#পর্বঃ১২

‎বিয়ের দুদিন পর সেই অঘটনটা ঘটালাম,
‎আমি মিস অঘটন ঘটন পটীয়সী।
‎উনি নিচে আসছেন এটা দেখতেই আমি দৌড়ে গেলাম চাবি নিয়ে৷ আর দৌড়ে যেতে গিয়ে ডাইনিং এর চেয়ারে পা বাধলো আর সেই চেয়ার উল্টে আমার পায়ে পড়লো। ব্যাস! খানিকক্ষণ উঠতে পারলাম না। আর ধড়াম করে পড়া চেয়ারের শব্দ চলে গেছে নীচ অব্দি। আম্মু আমাকে ধরে বসে থাকলেন। আমার চোখ বেয়ে নামলো বর্ষার ঢল! বাপ্পি গেট খুলে দিলো। উনি দৌড়ে উঠে এসেছেন উপরে। আমাকে আর আম্মুকে বসে থাকতে দেখে দৌড়ে এলেন, এসেই আমার পা’টা আগে ধরে দেখলেন। দাড় করাতে চাইলেন কিন্তু পারলাম না।পা ফেলতে পারলাম না, বেঁকিয়ে গেল! আমি তখন উনার মুখের দিকে তাকাতে পারলাম না। চোখ দুটো একদম লাল করে আমার দিকে তাকালেন। চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন

‎” সবসময় ছুটোছুটি ”

‎ বাপ্পিকে বললেন

‎” গাড়িটা বের করো।”

‎আম্মুকে বললেন

‎”আম্মু ওর বোরকা আনো। ”

‎আম্মু বোরকা আনলেন না, আনলেন আমার বড় খিমারটা,সেটাই পরিয়ে দিলেন। বাপ্পি ততক্ষণে নিচে হর্ণ বাজাচ্ছে। উনি বললেন

‎”আম্মু বরফ দাও”

‎আম্মু একটা হাফ লিটারের পানির বোতল বরফ করা ছিলো সেটা বের করে দিলেন। আম্মু আমাকে ফু দিয়ে দিলেন। আমি ব্যাথায় মরে যাচ্ছিলাম! উনি কোলে করে নিচে নিয়ে গাড়িতে বসলেন। তারপর পা’টা দেখলেন ভালো ভাবে। তারপর বরফটা লাগাতে থাকলেন আলতো হাতে! উনি শুধালেন

‎”ভীষণ ব্যাথা? ”

‎আমি মাথা ঝাঁকালাম। পা’টা ফুলে উঠেছে অনেকখানি, পায়ের পাতাতে হয়তো ফ্রাকচার হয়েছে!

‎আমি কাঁদছি ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে। টিস্যু দিয়ে চোখ মুছে দিচ্ছেন, তবে আমার দিকে তাকাচ্ছেন না আর!
‎উনি বললেন

‎” আমি আব্বুকে কি জবাব দেবো? দু’দিন হয়নি তার মেয়েকে এনেছি! ”

‎ঝাঁপসা দৃষ্টিতে দেখলাম উনি চোখ মুখ একদম শক্ত করে আছেন! কি অগ্নিমূর্তি! নাকি মর্মাহত! বুঝতে পারলাম না!

‎হাসপাতাল পৌঁছে হুলস্থুল কান্ড বাধালেন ক্যাপ্টেন আহমেদ আল তারিক! উনার বন্ধু একজন ডাক্তার। খুব দ্রুতই সব হলো। এক্সরে ধরা পড়লো মেটাটার্সাল আর টার্সাল মিলিয়ে হাড় ফাটছে ৬ টা।

‎কিছু পেইন কিলার দেওয়া হলো! আরোও ঔষধ পত্র প্রেসক্রাইব করে আর কি কি করতে হবে বলে দিলেন। বেড রেস্ট চার-সপ্তাহের!

‎উনি বাসায় ফোন দিয়ে ডিপ ফ্রিজে পানি রাখতে বললেন। প্রধান ট্রিটমেন্ট বরফ দিতে হবে অনবরত আর বেড রেস্ট! অবশ্য এই পুরোটা সময় বরফ দিয়েই যাচ্ছেন একজন নার্স! তাই ব্যাথাটা বেশ খানি কমেছে!

‎বাসায় ফিরেছি রোগী হয়ে। আমি মূলত এসেছিলাম রোগীর সেবা করতে। বিয়েটাও তাড়াতাড়ি হলো উনার সেবা করবো সেই সিদ্ধান্তে, এখন উল্টো উনি তিনবেলা আমার সেবা করছেন! বরফ দেওয়ার পুরোটা দায়িত্ব উনি পালন করলেন।

‎কিন্তু সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, উনি আমার দিকে তাকাচ্ছেও না আবার কথাও বলছেন না! আমি ছটফট করছি! কি করলে উনি মানবেন! আমি কয়েকবার সরি বলেছি। কিন্তু আমার কঠিন পুরুষের এতো শক্ত কঠিন রুপ কি আমার জানা ছিলো?
‎পরের দিন সকালে আম্মুকে বললেন,

‎” আমার ফিরতে হবে, রিপোর্ট করতে বলেছে এই সপ্তাহেই! ”

‎আমার প্রাণ বের হয়ে গেল! এতো দ্রুত সময় ফুরিয়ে গেল!
‎ঐদিন সকালে খাবার নিয়ে যখন এলো, আমি বললাম
‎” সরি আমি বুঝতে পারি নাই ওভাবে পড়ে যাবো! প্লিজ! ”

‎উনি আমার চোখের দিকে না তাকিয়েই খাইয়ে দিচ্ছেন! তারপর যখন ঔষধ দিলেন, আমাকে সেটা খাইয়ে চলে যেতে নিলে আমি হাত আঁকড়ে ধরলাম। উনি হাতের দিকে তাকালেন৷ আমি ছাড়ছি না উনিও যাচ্ছেন না। হাত ধরে কাছে টানতে চাইলাম কিন্তু বিশাল মানুষটাকে নড়াতে পারলাম না। চুপচাপ দাড়িয়ে থাকলো। পুরো একদিন হয়েছে উনি এমনটা করছেন। আমি এবার কান্না করছি আর বললাম!

‎”আর এমন হবে না, ওয়াদা করছি। প্লিজ! ”

‎উনি বসে পড়লেন। আমি সাথে সাথেই একপাশ থেকে উনাকে জড়িয়ে ধরেছি!
‎উনি যা রাগ করার করুক! আমি মানবো না। উনি কেন আমাকে দূরে রাখছেন! আমি কি ইচ্ছে করে করেছি?
‎উনি আমার সাহস দেখে অবাক হলেন মনে হয়।
‎উনি পাশ ফিরে আমার দিকে তাকালেন। আমিও উনার চোখের দিকে তাকালাম! উনি তাকিয়েই থাকলেন৷ আমার সাহস আরো বেড়ে গেল। উনার মান ভাঙ্গাতে আমি সেদিন অনেক গুলো সাহসী কাজ একসাথে করলাম! যেটা এমনি সময় ভাবতেও আমার গায়ে কাটা দিতো!

‎__________________


‎আব্বু, আম্মু, মুহাইমিন সবাই আসলো। আব্বু তো ভীষণ মর্মাহত হলেন। অনেকক্ষণ কথাই বললেন না। চুপচাপ আমার হাত ধরে বসে থাকলেন।

‎” কিভাবে হলো বাবা?
‎একটু শান্ত ভাবে চলাচল করবে না? ”

‎আমি কি বলবো! আব্বু নিজে বসে বসে ফল কেটে খাওয়ালেন। আব্বুর অফিস আছে৷ বিয়ের জন্য কয়েকদিনের ছুটি নিয়েছিলেন। তাই যেতেই হবে। আমাকে দোয়া কালাম পড়ে ফু দিয়ে গেলেন। এই কাজটা আব্বু ছোট বেলা থেকেই করতেন। কখনও সামান্যতম বিপদ হলেই আব্বু বার বার আমাদের দোয়া পড়ে ফু দিয়ে দিতেন।
‎আম্মু থাকলেন সারাদিন।

‎” কি করলি?
‎ছেলেটার চেহারার দিকে তাকানো যাচ্ছে না! নিজেকে দোষী মনে করছে! ”

‎” এখানে উনার দোষ কোথায়? ”

‎”এত বছর কিছু হলো না, আর ওর কাছে নিয়ে আসছে আর ওমনি এতোবড় দূর্ঘটনা! ”

‎ঐদিন সারাদিন উনি বাসাতেই থাকলেন কিন্তু আম্মু আমার পাশে থাকায় বার বার দরজা দিয়ে দেখে চলে যাচ্ছিলেন। আম্মু সেটা বুঝলেন, তাই সন্ধ্যার দিকে মুহাইমিনকে নিয়ে চলে গেলেন৷ বাপ্পি পৌঁছে দিলো।

‎রাতে রুমে ঢুকে সেই ফোন! কথা বলছেন আর এটা ওটা করছেন। কথা শেষে আমার পাশে বসলেন। আমাকে কোলের মধ্যে টেনে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন

‎” তুমি ঢাকা ফিরে যাবে কিভাবে?তোমার সেমিস্টার ফাইনাল কবে? ”

‎” সামনের মাসে ”

‎”ক্লাস করা লাগবে না? কত গুলো পরীক্ষা মিস দিয়েছো এ পর্যন্ত? ”

‎আমি মাথা নিচু করে ভাবলাম। উনি বললেন,

‎”এতো গুলো বছর কোন অঘটন ঘটলো না আর যখনই আমি আমার বুকে আনলাম ওমনি এতোবড় দূর্ঘটনা হলো।”

‎উনার কণ্ঠে লুকানো দুঃখটা আমি স্পষ্টই বুঝতে পারলাম। সান্ত্বনা দিতে পা উঠিয়ে বললাম

‎ “এই দেখেন আমি একদম সুস্থ। কোন ব্যাথা নেই!ফোলাটাও কমে গেছে! ”

‎উনি সত্যিই উঠে গিয়ে পা টা ভালো ভাবে দেখলেন কি অবস্থা!

‎আমি মাথা নিচু করে বসে থাকলাম।
‎উনি দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লেন। মনে হচ্ছে ভাবছিলেন কি করবেন!
‎আমিও চিন্তায় পড়ে গেলাম। পা সুস্থ না হওয়া অব্দি উনি ছাড়বেন না। আবার ক্লাস পরীক্ষা মিস যাচ্ছে। আমিও ভাবতে বসে গেলাম। গতদিনও সিআরের মেসেজ পেলাম। পরশু দিন আরেকটা সিটি আছে। কিন্তু কি করা! আমার কাছে এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শুধুই একজন! কিন্তু সেই একজনই আমার ক্লাস পরীক্ষা নিয়ে বেশি তটস্থ! উনি ঠিক করেছিলেন বিয়ে শেষে উনি ফিরে যাবার সময় আমাকে হলে রেখে যাবেন। সপ্তাহখানেকের ব্যাপার! কিন্তু পা ফাটিয়ে আমি পড়ে রইলাম। আর উনারও সময় ফুরিয়ে আসছে। আমিও ভাবছি সেও ভাবছে। আমি খেয়াল করিনি সে আমার দিকে তাকিয়ে। আমি কানের কাছের চুল একটা একটা করে টেনে নিয়ে কামড়াচ্ছি আর ভাবছি। এটা বলতে গেলে আমার আরেকটা অভ্যাস! চিন্তা করলেই চুল কামড়ায়!

‎হঠাৎ খেয়াল করলাম উনি আমার দিকেই তাকিয়ে! কি অদ্ভুত দৃষ্টিতে! আমি সাথে সাথে চুল ছেড়ে দিয়েছি।
‎উনি আরোও এগিয়ে আসলেন!

‎” Peculiar woman, আর কি কি স্বভাব আছে তোমার? ”

‎আমি থতমত খেয়ে গেলাম।

‎” নেই। ”

‎” নেই না? ”

‎আমি ঝাঁকালাম, নেই!

‎কেমন করে তাকালেন, আর তাকিয়েই থাকলেন! আমি বুঝলাম বিপদ সংকেত সাত ছাড়িয়ে মহাবিপদ সংকেত আটের পথে! আমি এবার কই পালাই! আমি বালিশ হাতে নিয়েছি, চেহারা ঢাকবো ঢাকবো, উনি ঔখান থেকেই হাত বাড়িয়ে বালিশটা ধরে নিলেন। বললেন

‎” আজ থেকে আমি তোমার বালিশ, আমাকে দিয়ে তোমাকে ঢেকো। ”


‎চলবে….