#মেহবুব
#তাবাসসুম_তোয়া
#পর্বঃ৪+৫
আমার মেডিকেলে চান্স হলো না। আমি ভীষণ ভেঙে পড়লাম। আমার সারাজীবনের স্বপ্ন মেডিকেলে পড়া! বিশেষ করে আর্মড ফোর্সেস মেডিকেলে ( AFMC)।
উনার পাশাপাশি থাকতে চেয়েছি এজন্য। কিন্তু আমার মেডিকেলেই আসলো না। তবে চারটা পাবলিক ভার্সিটিতে টিকলাম। কিন্তু সেই চান্সে আনন্দিত হলাম না মোটেও! আমার সকল আনন্দ ম্লান হলো মেডিকেলের দুঃখে। সেই মুচড়ে পড়ার অসহনীয় যন্ত্রণার সময় কেউ একজনের ফোন পেলাম! তার ফোন পেয়ে আমার সকল দুঃখ গায়েব হয়ে গেল! যে ছিলো আমার কাছে জাদুর সোনার কাঠি রুপোর কাঠি মতোই!
ফোন কানে নিয়ে সালাম দিলাম, নম্বরটা অপরিচিত,
” আসসালামু আলাইকুম, কে বলছেন? ”
” ওয়ালাইকুম আসসালাম, তারিক স্পিকিং ”
কন্ঠ শুনেই আমার হার্ট অ্যাটাক হলো। হার্ট ব্লক হয়ে গেল! সেখানে এয়ার সার্কুলেশন বন্ধ হয়ে যাওয়ার দরুন আমি দম বন্ধ হয়ে হ্যাং হয়ে থাকলাম!
উনি কেন ফোন দিয়েছেন! সবসময় চেয়েছি ফোন দিক কিন্তু এখন যখন ফোন দিয়েছে ওমনি আমার কথা বন্ধ হয়ে গেল। উনি কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বললো,
” মুনিবা, grow up,মেডিকেলে চান্স না পেলে কি মানুষ খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দেয়? রুম আটকে বসে থাকে?”
আমার আবারও কান্না পেলো! আমি কি পরিমান দুঃখে আছি উনি কি করে বুঝবেন! উনি তো সারাজীবন সবকিছুতে সেরা ছিলেন!
”মুনিবা, জীবনের শুধু একটা পরীক্ষায় সফল হওনি, তার মানে কি তুমি ব্যর্থ? জীবনের আরকিছুই বাকি নেই! সব শেষ! বলো? ”
” না,তবে অনেক বেশি চেষ্টা করেছিলাম! সবচেয়ে বড় স্বপ্নের জায়গা এটাই ছিলো। অনেক রাতের অক্লান্ত পরিশ্রম ব্যর্থতাই পর্যবসিত হলো! ”
”ব্যর্থ কোথায় হলে? অনেক গুলো ভার্সিটিতে চান্স পেয়েছো শুনলাম ? ”
” ঢাবি,জাবি, সাস্ট আর খুবিতে।”
”গুড, এগুলো সফলতা নই? সারা বাংলাদেশের কত হাজার স্টুডেন্ট পাবলিকে চান্সের চেষ্টা করে জানো ? কতজন পায়? তাদেরও কি রুম আটকে বসে থাকা উচিত?
আমি কিছু বলতে পারলাম না। উনি বলে চললেন,
”জয় আর পরাজয় দুটোই আমাদের জীবনের শিক্ষক-একজন শেখায় কেমন করে উঠতে হয়, আরেকজন শেখায় কেমন করে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় ! বুঝেছো? ”
” জ্বি ”
” কোথায় ভর্তি হতে চাইছো? ”
”জাবিতে কেমিস্ট্রি আসবে৷ ওটাতে। ”
”নাহ,ওটাতে নয়। ঢাবিতে কোনটা আসবে? ”
”বোটানি।”
”ওকে গুড। এটাই। ”
”ঘাস লতাপাতা নিয়ে পড়ে কি করবো? ”
”তাহলে?”
”কেমিস্ট্রি? ”
খানিকক্ষণ চুপ থেকে বললেন
”নাহ জাবিতে পড়ার অনুমতি নেই আমার তরফ থেকে৷ এখন তুমি দেখো কি করবা?তোমার ইচ্ছে। একজন স্বাধীন মানুষকে তো কেউ জোর করতে পারে না? ”
অনুমতি নেই কথাটা এতো আপন লাগলো! মনে হলো আমি তার! একান্তই তার! আর আমার সকল বিষয় তার অনুমতিতেই চলে! আমি লজ্জায় বিছানায় মুখ গুজলাম!
আমাকে চুপ দেখে বললো,
” খাবারে আর অনিয়ম হবে? ”
” উহু। ”
”আম্মুকে একবার ফোন দিও, দুশ্চিন্তায় আছেন তোমাকে নিয়ে ”
” আচ্ছা ”
”ওকে গুড গার্ল। রাখছি তবে”
আমি চুপ করেই থাকলাম। উনিও।
কিছুক্ষণ পর আবারও শুনলাম
”মুনিবা? ”
”আমি আপনাকে ফোন দিতে পারি মাঝে মাঝে?”
” নাহ ”
“মেসেজ?”
” নাহ ”
আমি আর কিচ্ছুটি বললাম না। আমার গলা আটকে আসলো! খট করে ফোনটা কেটে গেল। আমি অনেকক্ষণ সেটা কানে নিয়ে বসে থাকলাম। না পাওয়ার মাঝে যতটুকু পেলাম ততটুকুতেই আমি খুশী!
ঢাবিতে ভর্তি হয়ে উঠে গেলাম সুফিয়া কামালের গণরুমে। আমার নতুন সংসার শুরু হলো একটা বিছানা একটা বালিশ আর একটা ছোট্ট ট্যাংকের সাথেই।
_______________________
এরপর কেটে গেল কতগুলো মাস। একদিন খবর পেলাম উনি ভীষণ ভাবে আহত হয়েছেন।
উনার পোস্টিং তখন বান্দরবানে ছিলো। পাহাড়ে ড্রাগ ডিলার আর পাহাড়ী আদিবাসী সন্ত্রাসীদের সাথে তুমুল বন্দুক যুদ্ধ হয়েছে। সেখানে কতগুলো ডিলার,এজেন্ট ক্রসে মারা পড়েছে।
সেই ভয়াবহ ত্রিমুখী যুদ্ধে সেনাবাহিনীর অবস্থা নাজুক হয়েছে। অনেকেই ভীষণভাবে আহত হয়েছেন। পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের একাংশ ঘটনাস্থলে এসে আহত সেনা কর্মকর্তা, সৈনিকদের নির্দয়ভাবে পাহাড় থেকে ফেলে দিয়েছে! তাদের ঘাটি উৎখাতের উদ্দেশ্যেই মূলত সেনাবাহিনীর এই অপারেশন ছিলো!
গুলিবিদ্ধ অবস্থায় উনি যখন পড়েন ছিলেন উনাকেও পাহাড় থেকে ফেলে দেওয়া হয়েছে।একজন নাকি শহীদ হয়েছেন! কথাটা শুনে আমি থরথর করে কেঁপে উঠলাম! উনাকে ঢাকা সিএমএইচে আনা হয়েছে হেলিকপ্টার যোগে, সাথে আরোও গুরুতর আহতদের কয়েকজনকেও।
আন্টি আঙ্কেল সিএমএইচে আসার পথেই আম্মুকে খোঁজ দিলেন।
সে খবর পেয়ে আমি কেন যেন পাগল হয়ে গেলাম!আমার মাথায় কাজ করছিলো না!কিচ্ছু ভাবতে পারছিলাম না। মাথা পুরো ফাঁকা হয়ে গেল। মনে হলো আঘাত গুলো আমার শরীরে হয়েছে! আমার সারা শরীরে ব্যাথা! আমি থরথর করে কাঁপছিলাম! ইয়া আল্লাহ, এ কোন বিপদে হলো! মনে হচ্ছিল বুলেট এফোড় ওফোড় করেছে আমার দেহ! আমার ছটফটানি দেখে আমার রুমমেট সানি দৌড়ে এসে আমাকে ধরলো।
আন্টিরা তখনও খুলনা থেকে এসে পৌঁছাননি। আমি পৌঁছে গেলাম। আমি পুরো সিএমএইচ কয়েক রাউন্ড দিলাম কিন্তু কোথাও উনাকে খুঁজে পেলাম না। ঠিক কোন বিল্ডিং-এ আছে? কোন ওয়ার্ডে কিচ্ছু জানা হলো না আমার!
উনার সাথে আমার লিগাল কোন সম্পর্ক ছিলো না, যার কারনে প্রাইভেসি মেইনটেইন করলো ওখানকার প্রটোকলে দায়িত্বরত সেনা সদস্যরা। তারা কেউ আমাকে সাহায্য করতে চাইলো না।
এদিকে আমি পাগল প্রায়। কোনো ডেস্কে যোগাযোগ করেও কোন খোঁজ আমাকে জানানো হলো না। আমি হতাশ হয়ে বসে থাকলাম হাসপাতালে ওয়েটিং জোনে! মনে তখন ভীষণ ভয়! কি অবস্থা উনার! হৃদয়টা কাঁপছে বার বার! কত যে কাঁদছি সেটা শুধু আমিই জানি! একবার দেখতে দিলে কি হয়? খোঁজটা অন্তত দিতে পারতো!
বাপ্পি এলো আগে, তারপর আন্টি আঙ্কেল পৌঁছালেন, তাদের সাথে তখন আমাকেও এলাউ করা হলো! তবে গুরুতর আহতদের দেখার কোন সুযোগ নেই। আজ একটা ওটি হয়েছে এবং আগামীকাল আরোও একটা ওটি। তারপর, অবস্থার উন্নতি হলে তবেই দেখা পাওয়া যাবে! আমাদের অপেক্ষা করতে হবে দুদিন।
আমরা অপেক্ষারত এরমধ্যে বিকালের দিকে সকল আহতদের রিলেটিভদের বিফ্রিং রুমে নেওয়া হলো। সেখানে, লেফটেন্যন্ট নির্ঝর আমাদেরকে ব্রিফ করলেন কি ঘটেছিল। অল্প খানিকটা কথা আমার মাথায় ঢুকলো।
”সেনারা চারিদিক থেকে পুরো এলাকাটা কাভার করে রেখেছিলো। ঘাঁটিতে অল্প কিছু ছেলে ছোকরা টাইপের রিপেজেন্টেটিভ ছিলো! যাদের কাছে তেমন কোন ওয়েপন ছিলো না৷ ইয়াবার একটা বড় চালান এসেছিলো মিয়ানমার থেকে নাফ নদীপথে । আমাদের টার্গেট ওটাই ছিলো!
ওদেরকে সারেন্ডার করতে বলা হয়েছিল। এবং ওরা সারেন্ডার করেছিলো। কিন্তু ওদের মধ্যেই উপজাতির যারা ছিলো তাদের মধ্যে থেকে কেউ একজন এলাকায় তাদের আটক হওয়ার খবর পাস করেছিলো৷ এই খবরে আদিবাসী সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ আমাদের উপর আক্রমণ করে। ঢালু পথ বেয়ে নেমে আসতে আসতেই, আটককৃতদের এবং মালামাল গাড়িতে তোলার আগেই হামলা হলো৷ এই অর্তকিত আক্রমণে অনেকের গায়েই গুলি লাগে।
নিজেদেরকে কভার করার সুযোগ পান নি উনারা। বাদবাকি সবাই আন্ডার কভার হয়ে ঐ সব সন্ত্রাসীদের সাহসের সাথে মোকাবেলা করে।
ক্যাপ্টেন তারিক স্যার, সিরাজ স্যার, আনাম স্যার কয়েকজনকে জাহান্নামে পাঠিয়েছেন। আবার কয়েকজনের পায়ে গুলি করে আটক করতেও সমর্থ হয়েছিলাম কিন্তু পরে তারা পালিয়ে যেতে সমর্থ হয়।
সিরাজ স্যারের মাথায় যখন গুলি লাগলো, তখন সেই ক্রিমিনালকে ডাউন করতে সমর্থ হন তারিক স্যার কিন্তু অন্যপাশ থেকে আসা আরেকটা গুলি উনার কাঁধের নিচে বিদ্ধ হয়৷ সেই মূহুর্তে প্রচুর গুলি করছিলো তারা এবং ঝাঁকে ঝাঁকে আদিবাসী সন্ত্রাসীরা চলে এসেছিলো।
আমরা বাধ্য হই হটে যেতে। তারিক স্যার গুলি খেয়েও অনেকটা পথ দৌড়ে এসে কভার নিয়েছিলেন, কিন্তু দুজন অস্ত্রধারী উনার পিছনে পিছনে এসে সম্মুখ লড়াইয়ে স্যারকে তারা ছুরি দিয়ে ঘায়েল করে এবং খাদের কিনার থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। স্যার পুরোপুরি নিচে পড়েননি। গাছের গোড়ায় বেধে ছিলেন! এজন্য উনার তখনও জ্ঞান ছিলো! সিরাজ স্যারসহ আরোও বেশ কজন পাহাড়ের ঢালু পথে তখনও পড়ে ছিলেন। সেই সন্ত্রাসীরাই স্যারদের টেনে এনে খাদের মধ্যে ফেলে দেয়।
আমাদের ব্যাক আপ ফোর্স ততক্ষণে হাজির হলে আমরা স্যারদেরকে উদ্ধার করতে সমর্থ হই । সিরাজ স্যারকে খুজে পেতে বেগ পেতে হয়। ধারনা করা হয় উনি গুলি লাগার পর পরই শাহাদাত বরন করেছেন! ”
আমি বিমূঢ় হয়ে পড়ে থাকি। আমি শুধু মানুষটাকে এক নজর দেখতে চাচ্ছিলাম। বাপ্পি কেমন শান্ত শীতল হয়ে গেছে। আমাকে এসে শান্তনা দিলো। আন্টি চুপচাপ আমাকে জড়িয়ে ধরে থাকলেন। উনিও কাঁদছিলেন। তারিক ভাই নাকি সেদিন খারাপ স্বপ্ন দেখেছিলো। এজন্য আন্টিকে বলেছিলেন,
” আম্মু কিছু হলে দায়দাবী কিছু রেখো না। ক্ষমা করে দিও। আমার জীবন তো দেশের জন্য, আল্লাহর জন্য উৎসর্গকৃত! ”
আমরা চুপচাপ অপেক্ষা করলাম। লেফটেন্যান্ট নির্ঝর সবার সাথেই পরিচিত হলেন। আমার পরিচয় শোনার পর বেশ কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলেন, সেটা আমি ঠিক টের পেলাম! উনি অবাক হয়ে বললেন
” আমি আশা করি নাই আপনি আসবেন! ”
” ভাইয়া আমি আপনার ছোট! ”
” জানি, তবে সম্পর্কে ছোট নন। ”
আমি উনার কথা বুঝলাম না। কি সম্পর্ক উনার সাথে আমার! কিভাবে বড় হলাম?
আমাদেরকে বিদায় দিয়ে দেওয়া হলো। বলা হলো জ্ঞান ফিরলে হাসপাতালে থেকেই ফোন দিয়ে জানানো হবে। হাসপাতাল কম্পাউডে ভীড় করার কোন উপায় নেই। আমরা ক্যান্টিনে গিয়ে বসলাম।
_____________________
সেই অপেক্ষার সময় গুলো খুব বড্ড কঠিন ছিলো। আমাদের সবার খাওয়া দাওয়া বন্ধ হয়ে গেল! আন্টি আঙ্কেল বাপ্পির ফ্লাটে উঠলেন। ওরা কয়েকজন মিলে একটা ফ্লাট ভাড়া করে থাকতো। সেখানে একট্রা রুম ছিলো অভিভাবকদের জন্য! আমি প্রতিদিন সন্ধ্যায় হলে ফিরতাম আবার সকালে চলে আসতাম! আড়াই দিনের দিন উনার জ্ঞান আসলো! তবে দেখা করতে দেওয়া হলো না। দেখা করতে দেওয়া হলো তৃতীয় দিন,
সেইদিন বিকালে আমাদেরকে নিয়ে যাওয়া হলো সুসজ্জিত কেবিনটাতে। বেশ কয়েকজন ডাক্তার নার্স আগে থেকেই ছিলো সেখানে। আন্টি আঙ্কেল ছেলের পাশে গেলেন।
আন্টিকে উনি নরম কণ্ঠে সালাম দিলেন। আন্টি কাঁদতে কাঁদতে জড়িয়ে ধরলেন ছেলেকে। আঙ্কেল ছেলের পাশে দাঁড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। বাপ্পিও গিয়ে ভাইকে জড়িয়ে ধরলো। সবাই কাঁদছে।
ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছিলো উনাকে। ফর্সা মানুষটাকে কোনভাবেই বোঝার উপায় ছিলো না উনি ফর্সা! এতোটা পুড়ে গেছে ত্বক। আমি একটা নার্সের পিছনে দাড়িয়ে ঝাঁপসা চোখে উনাকে দেখতে লাগলাম। উনি আমাকে খেয়াল করেননি। আমি বুঝলাম। অবশ্য অসুস্থ মানুষটা চারিদিকে চোখ তুলে তাকাতেও পারছেন না। সে পরিস্থিতিতে উনি নেই। তবুও কথার তেজ কমেনি। স্বাভাবিক ভাবেই কথা বলার চেষ্টা করছেন। বোঝাচ্ছেন কিচ্ছুটি হয়নি, উনি সুস্থ! আমি দেখছি তার ব্যান্ডেজে মোড়ানো শরীর।
কাঁধ থেকে বুকে ব্যান্ডেজ যেখান থেকে সার্জারীর মাধ্যমে বুলেট বের করা হয়েছে! মাথায় ব্যান্ডেজ যেটা ফেটেছে পাহাড় থেকে পড়ে, সাথে গায়ে, হাতে পায়ে অনেক জায়গা কেটে গেছে সেগুলোতেও সেলাই দিয়ে ব্যান্ডেজ পেঁচানো! বলতে গেলে সারাদেহে ব্যান্ডেজ।
আল্লাহ নিজ হাতে উনাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন!
আমি উনাকে দেখে সহ্য করতে পারছিলাম না।কিছুতেই না! শুধু কাঁপছিলাম! কি পরিমান তেজি মানুষটা একদম মিইয়ে আছে যেটা দেখা আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না!
কি পরিমাণ কষ্ট পাচ্ছেন, সেই কষ্ট যেন আমিও অনুভব করছিলাম আর শিউরে উঠছিলাম। আমার কান্না পাচ্ছিল ভীষণ! নাকি কাঁদছিলাম! জানি না। বেশ অনেকক্ষণ দাড়িয়ে দাড়িয়ে যখন রুমালে চোখ নাক মুছতে মুছতে একাকার তখন সেটা নোটিশ করলেন নির্ঝর ভাইয়া। উনি আমার নাম ধরে ডাকলেন,
” মুনিবা আপু এদিকে এগিয়ে আসেন। ”
আমি ঝাঁপসা চোখে তাকিয়ে দেখলাম এবার উনি আমাকে খেয়াল করলেন। কেমন করে জানি তাকালেন। অবাক হয়েছেন কি?কেন আমার কি আসার কথা ছিলো না? উনার ঐ দৃষ্টি দেখে আমি আর এগোতে পারলাম না। আরোও বেশি নার্সের পিছনে সরে গেলাম। আমার ভীষণ ভীষণ অভিমান হলো! কেন ছেড়ে চলে যাচ্ছিলেন! উনার এতো কিসের তাড়া! উনি জানেন না!
উনি জানেন না?
কেউ তার অপেক্ষায় আছে?থাকবে?
তবে?
তবে কেন?
উনি কোনদিনও আমাকে বুঝতে চাননি! আমার অভিমান আকাশ ছুলো। সাথে কান্নার বেগ বাড়লো এবং কাঁপুনিও। কান্না আটকাতেই পারছি না। অনেক কষ্টে মুখ চাপ দিয়ে ধরে কান্না আটকাচ্ছি। নার্স আপুটা আমার অবস্থা দেখে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। নির্ঝর ভাইয়া হাসলেন।
”আজ দুদিন তো শক্ত ছিলেন? আজ কি হলো? ”
সত্যি আমি নিজেও লজ্জিত হচ্ছি এতো গুলো মানুষের সামনে নিজেকে সামলাতে ব্যর্থ হচ্ছি দেখে, আমি থামতে চাইছি কিন্তু পারছিলাম না। উনাকে ওমন ভাবে দেখে কেন জানি সহ্য হচ্ছিলই না!
”এই আপু স্যার সুস্থ হয়ে গেছে তো, এগিয়ে এসে দেখেন ”
আমি ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে হয়ে পড়লাম। বাপ্পিও এগিয়ে এলো। কোনমতে নিজেকে শান্ত করে নির্ঝর ভাইকে বললাম,
”সরি ভাইয়া, একটু আসছি।”
আমি দৌড়ে বের হয়ে গেলাম প্রায়। বাপ্পিও আসছিল। আমি নিষেধ করলাম
” আসিস না, আমি ঠিক আছি! ”
আমি দৌড়ে ওয়াশরুমে গেছি। সেখানে গিয়ে কান্নারা আর বাধা মানেনি! কিভাবে সহ্য হয়! নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করছি৷ অন্যরা কিভাবে সহ্য করে! কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই নার্সটা এলো৷ আমাকে জড়িয়েই ধরলো প্রায়। বললো
”সরি আপু, স্যারের নির্দেশ আপনি শান্ত না হওয়া অব্দি জড়িয়ে ধরে রাখতে হবে! ”
একথা শুনে আমার কান্না আরোও বেড়ে গেল। হাসপাতালের বেডে শুয়েও অর্ডার করা হচ্ছে!
চলব।