মেহবুব পর্ব-৬+৭

0
7

‎#মেহবুব
‎#তাবাসসুম_তোয়া
‎#পর্বঃ৬+৭

‎আমি চোখ মুখে পানি দিলাম অনেকক্ষণ ধরে। এ্যনি আপু আমাকে ধরে নিয়ে গেলেন ওনার ওয়ার্ডে,বসিয়ে পানি খাওয়ালেন।

‎তারপর দুজনে চুপচাপ এলাম তারিক ভাইয়ের কেবিনের সামনে। আমি কিভাবে যাবো? কান্না, লজ্জা মিলিয়ে অনুভূতি একদম ঘেটে আছে! মাথাটা ধরেছে ভীষণ! কি এক পাগলামি করলাম। ইস যদি ভ্যানিস হয়ে যাওয়ার জাদু জানতাম! এ্যনি আপুকে বললাম,

‎” আপনি যান আমি আসছি। ”

‎আপু ভিতরে চলে গেলে আমি কেবিনের দরজায় থাকা ছোট গ্লাসটা দিয়ে ভিতরে দেখলাম। তখন ভিতরে শুধু আন্টি আর বাপ্পি।
‎তারিক ভাই নার্সের দিকে তাকাতেই, আপু কিছু বললেন। তারিক ভাই এবার আন্টির দিকে ফিরে কিছু বললেন হয়তো। আন্টিকে দেখলাম গেটের দিকেই আসছেন। আমার মনে হলো ছুটে পালায়। ভবঘুরে হয়ে যায়! এই দুনিয়া আর ভালো লাগে না।

‎সত্যিই পালাতে চাইলাম কিন্তু পিছনে ফিরতেই দেখি নির্ঝর ভাইয়া। উনি আমাকে দেখে মিষ্টি করে হাসলেন। আন্টি বেরিয়ে এসেছেন ততক্ষণে। আমি স্বাভাবিক হলাম। আন্টি আমাকে জড়িয়ে নিয়ে ভিতরে নিয়ে গেলেন৷ নির্ঝর ভাইয়াও ভিতরে এলেন। বেডের খানিকটা সামনে দাড়ালাম। তারিক ভাই আজ প্রথম সালাম দিলেন। বলিষ্ঠ সে কন্ঠস্বর,

‎”আসসলামু আলাইকুম। কেমন আছো মুনিবা? ”

‎আমি কোনমতে উত্তর করলাম। আমার দৃষ্টি অবনত।

‎” ওয়ালাইকুম আসসালাম। ”

‎ আন্টি বলে চললেন,

‎” আর বলো না আব্বু,তোমার অবস্থা শুনে আমার মেয়েটার পাগলের মতো অবস্থা হয়েছিলো। আমরা পৌঁছানোর আগেই পৌঁছে গেছে সে। তারপর কি এক ঝামেলা, কেউ কি চেনে তাকে? কি পরিমান ছুটোছুটি করেছে সে আল্লাহই জানে! এসে দেখি ওয়েটিং জোনে একা বসে বসে কাঁদছে! একদম রক্তশূণ্য চেহারা।আমি তো ওকে দেখেই আরেক চোট ভয় পেয়েছি! তারপর আমরা সবটা সামলেছি। অফিসারদের পরিচয় দেবার পর স্যরি বলেছে! ”

‎আমি একবার উনার দিকে চোখ তুলে তাকিয়েছি, তখনই দেখি উনি নির্ঝর ভাইয়ের দিকে কেমন দৃষ্টিতে তাকালেন! সাথে সাথে নির্ঝর ভাইয়ের চেহারা চেঞ্জ হয়ে গেল!
‎নির্ঝর ভাই সোজা হয়ে দাড়িয়ে বললেন,

‎” আমি ছিলাম না স্যার, সত্যি বলছি, আমি জানিই না এতো কাহিনি হয়েছে। আমি অনেক পরে এসে পৌঁছেছি! ”

‎উনি রেগে গেলেন কি! তবে শান্ত চেহারা থেকে সেই গাম্ভীর্য মাখা চেহারায় ফেরত গেলেন!

‎” দুপুরে খাওয়া হয়েছে তোমাদের? ”

‎আমাকে বললেন নাকি আন্টিকে, জানিনা! আমি আন্টির দিকে তাকালাম। আন্টি আমার দিকে, উনি আমাদের দুজনকে একনজর দেখে এবার বাপ্পিকে জিজ্ঞাসা করলেন,

‎”বাপ্পি, আম্মুরা কেউ খায়নি দুপুরে?”

‎”হ্যাহ, খেয়েছে তো? ”

‎” কি খেয়েছে? ”

‎” আম্মু আর মুনিবা বাটার বান খেয়েছে সাথে কফি।”

‎উনি ভীষণ হতাশ হলেন,

‎” দুপুরের খাবার বাটার বান? ”

‎” আরে বাবা এটাই কত জোর করে খাইয়েছি মেয়েটাকে! ”

‎” আর তুমি?এ কেমন কথা আম্মু! তুমি বাটার বান খাও? দুপুরে ভাত না খেলে যার হয়না! আমাকে এই হাসপাতালের বেডে শুয়েও তোমাদেরকে নিয়ে চিন্তা করতে হবে! ”

‎বাপ্পি টিটকারি করে বললো,

‎”বুঝোনা ভাইয়া “সহমরন যাত্রা!” এই উপমহাদেশ থেকে সহমরন প্রথা উঠে গেছে আরোও দুইশো বছর আগে! আর এনারা দুজন এই যুগে এসেও তোমার সাথে যাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন! ”

‎উনি রাগী চোখে তাকালেন। বাপ্পি থেমে গেল! নির্ঝর ভাইয়ের দিকে তাকাতেই, ভাই বললেন

‎”আমি বিষয়টা দেখছি স্যার! আপনি চিন্তা করবেন না।”

‎উনি তখন আমাদের দিকে তাকিয়ে কাঠকাঠ কন্ঠে বললেন

‎” আপনারা দুজন বাইরে যেয়ে আগে আয়নায় নিজেদের চেহারা দেখবেন! চেহারা ঠিক না করে আর কেউ আমার সামনে আসবেন না! ”

‎বলেই পাশ ফিরে শুয়ে পড়লেন। ব্যাপারটা তার ভালো লাগলো না মোটেও। নির্ঝর ভাইয়ের পিছনে পিছনে আন্টির সাথে করে বেরিয়ে আসতে গেলাম। তখনই শুনতে পেলাম,

‎” আম্মু তোমার মেয়েকে বলো, আমি সুস্থ আছি! এখানে এতো কষ্ট করে আসা লাগবে না! উনি যেন নিজের দিকে খেয়াল রাখেন! ”

‎ বুঝলাম উনি বেশ ক্ষেপেছেন! আপনি করে বলছেন! অভিমান জমেছিল আমার আর উল্টো আমিই রাগী রাগী ধমক খেয়ে ফিরে যাচ্ছি! নিজের কয়লার মতো চকচকে কপালকে এক বালতি সমবেদনা জানালাম মনে মনে! আমার অবস্থা তখন ‘যার জন্য করি চুরি, সেই বলে চোর!’

‎_________________

‎তারপর থেকে আমি যেন ভিআইপি হয়ে গেলাম। সবাই আসতে যেতে আমাকে সালাম দেয় । সৈনিকদের এতো সম্মানের জ্বালায় আমি লজ্জায় কোথায় লুকাবো টের পেলাম না। সিরিয়াসলি, হলে ফিরে সিদ্ধান্ত নিলাম আর যাবো না। এতো সম্মান নেওয়া যাচ্ছে না। আবার উনিও নিষেধ করেছেন কিন্তু ঐ যে মন মানলো না! তারপরের দিন কিভাবে কিভাবে জানি চলে গেছি।

কেবিনের সামনে পৌঁছে হুশ হলো আমি চলে এসেছি। সেদিন ভিতরে গেলাম না। এরপরের দুদিনও আমি গেলাম কিন্তু উনার কেবিনে আর যাইনি। বাইরে থেকে দেখে ফিরে এসেছি। আন্টির সাথে দেখা হতো, বাপ্পির সাথেও। কিন্তু ভিতরে যাওয়ার সাহস হয়নি! কারন আমার চেহারা তখনও ঠিক করতে পারিনি। খেতে পারি না আমি, জোর করলেই কি খাওয়া যায়!

‎ সেদিনও কেবিনের বাইরের ওয়েটিং জোনে পেতে রাখা চেয়ারে বসে ছিলাম। দেখি উনি বের হয়ে এলেন নিজ পায়ে। আমি বুঝলাম আমার উল্টো ঘুরে দৌড় দেওয়া উচিত কিন্তু দৌড় আর দিতে পারলাম না!

‎উনার নিষেধ শুনিনি! আমি উঠে দাড়িয়ে সালাম দিলাম। উনি চুপচাপ আমার দু’চেয়ার পরে বসলেন!

আমি দাড়িয়ে ছিলাম। উনি ইশারা করলেন। বসো! উনার দৃষ্টি সামনের দিকে। বললেন

‎” আন্টি আঙ্কেল কেমন আছেন? ”

‎”আলহামদুলিল্লাহ। ”

‎পড়াশোনা কেমন চলছে?

‎”আলহামদুল্লিলাহ ভালো। ”

‎” গত এক সপ্তাহ ধরে তো এখানেই থাকা হচ্ছে, তাহলে পড়াশোনা ভালো হয় কি করে?”

‎আমাকে চুপ দেখে বললেন

‎”মুনিবা,আমাদের জীবনটা এমনই। যেকোন সময় কফিনে মুড়িয়ে পতাকা জড়িয়ে আমাদের লাশটা ফিরবে বাড়িতে। মেনে নিতে পারবে তখন ?”

‎আমার হৃদয়টা কেঁপে উঠলো। আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম, তার মানে এগুলো বলতে উনি এসেছেন? মানুষটা সবসময় সরাসরি কথা বলে, আমি শান্ত কন্ঠে বললাম,

‎”আমাদের জীবন, মরন সবটাই খোদাতায়ালার হাতে। আমরা কেউই জানি না কতদিন বাঁচবো, তবে যে কয়দিন বাঁচতে চাই সেই কয়দিন …

‎গলাটা ধরে এলো আমার। আমি চুপ হয়ে গেলাম..

‎ঠোঁট আঙ্গুল দিয়ে আড়াল করে হাসলেন যেন।

‎”কাঠিন্য তোমার এতো পছন্দের! সংগ্রামী জীবন চাও! অপেক্ষার জীবন? এই যে এখন সামান্য আঘাতে পাগল হয়ে যাচ্ছো! তখন যে দিশেহারা হয়ে যাবে না সে গ্যারান্টি কোথায়!”

‎মানুষটার শুধু হেয়ালি!আমার অভিমান দানা বাধতে থাকলো,

‎”আপনি দিশেহারা হবার মতো অবস্থায় রাখেননি আমাকে! যেভাবে ট্রেনিং দিয়েছেন এতগুলো বছর! আপনি পরীক্ষা নিয়ে দেখতে পারেন, আমি একদম ফিট আছি। আর আমার কাছে অপেক্ষায় জীবন,জীবন মানেই অপেক্ষা! ”

‎”অতি দুঃখের সাথে জানাচ্ছি তুমি এবারের পরীক্ষায় ফেল করেছো? ”

‎আমি তীব্র অভিমান নিয়ে বললাম,

‎” না, ফেল করিনি! ”

‎উনি এবার আমার দিকে এক পলক তাকালেন।

‎” বিদ্রোহী হয়ে উঠেছো বেশ! ”

‎আমি কথা বললাম না। উনি বলে চললেন

‎”হিউম্যান সাইকোলজি সম্পর্কে তোমার ধারণা আছে? মানুষ যখন কিছুই পায় না তখন সামান্য পেলেই ভীষণ খুশি হয়ে যায়! কিন্তু যখন পেতে শুরু করে এবং পেতেই থাকে তখন আরোও বেশি পেতে চাই, পেতে পেতে একসময় লোভী হয়ে উঠে। সেই চাহিদা কখনও শেষ হয় না। আমি তোমাকে সময় দিতে পারবো না মোটেও! কখনও বা কোন খবরও পাবে না আমার!
‎তখন হাজারটা অভিযোগ থাকবে! কেন থাকছি না। কেন এতো অল্প সময় দিই! তখন?

‎”সব অভিযোগের ভিড়ে আমি শুধু একজনকেই চাইবো। ”

‎খানিকটা হেসে বলে উঠে

‎” ভেবে বলছো তো? ”

‎” হুম। ”

‎”মুনিবা আমাদের জীবন, দেশের জন্য রবের জন্য উৎসর্গকৃত। সো তুমি কিন্তু লিস্টে অনেক পরে আসছো। অন্য স্বাভাবিক মানুষের সাথে জীবন কাটালে লিস্টের একদম উপরে তোমার জায়গা হতো। ”

‎” যে লিস্টের উপরে থাকে তাকে কখনও ফার্স্ট পজিশন দখল নেওয়ার চেষ্টা করা লাগে না! ”

‎” এতোটা কনফিডেন্ট?”

‎আমি পাশ ফিরে হাসলাম।

‎” এখন কি আমাদের সাথে খুলনায় ফেরার কোন সুযোগ আছে? ”

‎মাথা নাড়লাম আমি

‎ “আছে! ”

‎” কিভাবে? সামনে সেমিস্টার ফাইনাল। এখন তো নিয়মিত ক্লাস, সিটি চলার কথা! বাপ্পীর তো তাই চলছে দেখছি। ”

‎” সারাবছর খুব মনোযোগের সহিত ক্লাস পরীক্ষা দিয়েছি। কিছুদিন বন্ধ দিলে কিচ্ছুটি হবে না। ”

‎”এটা কি ডিপার্টমেন্টের ঘোষণা নাকি তোমার কথা?”

‎” আমি আপনাদের সাথে যাচ্ছি। আমার ক্লাস পরীক্ষা লাগবে না! ”

‎আবারও থমকে তাকালেন উনি

‎”এই বিদ্রোহী চেতনা কি কোনভাবে আম্মুর থেকে পাচ্ছো? ”

‎তখনই একজন উর্ধতন সেনা অফিসার এলেন। উনি সাথে সাথে উঠে স্যালুট দিলেন। আমিও দূরে সরে দাঁড়ালাম।

‎” ইয়াংম্যান আমাদের গর্ব! কি অবস্থা তোমার বলো?”

‎” একদম ফিট স্যার। ”

‎” গুড”,আমার দিকে তাকিয়ে শুধলেন? ওয়াইফ। ”

‎” নো স্যার, উড বি। ”

‎স্যার আমার দিকে মিষ্টি করে হাসলেন। আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন,

‎” মিস? ”

‎”মুনিবা মুবাশ্বিরা, স্যার। ”

‎”মুনিবা, আহমেদ তারিক আমার ভীষণ প্রিয় একজন ছাত্র। ভীষণ চৌকস আর বুদ্ধিমান একটা ছেলে। এমন মেধাকে নার্চার করতে হয়। দেশের জন্য একটা খাঁটি সম্পদ সে। এমন একটা সম্পদকে আগলে রাখতে হয়। আমি আশা রাখছি তুমি সেটা পারবে। কি পারবে না? ”

‎আমি উত্তর করলাম,

‎” ইয়েস স্যার। ”

‎” that’s like a good girl. ”

‎উনারা দুজন ভিতরে চলে গেলেন। আমিও চুপচাপ দাড়িয়ে থাকলাম বাইরে। আমার কানে ভাসছে

‎ ” উড বি ”

‎কবে আমি তার উড বি হলাম? নাকি এতো গুলো বছর ধরেই আমি তার উডবিই ছিলাম! আমার ভীষণ ভালো লাগলো উনার স্পষ্ট কথা।

‎উনি বেশ কিছুদিনের ছুটি পেলেন। সুস্থ হলে কর্মস্থলে ফিরতে হবে। হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জ দেওয়া হলো।
‎আন্টি আঙ্কেল উনাদের নিজস্ব প্রাইভেট কার নিয়ে এসেছিলেন। আমিও সেটাতেই তাদের সাথে যোগ দিলাম। বলতে গেলে বাধ্য হলাম। আমি অবশ্য ট্রেনে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু উনার কঠোর নিষেধ ‘একা যাওয়ার অনুমতি নেই’। উনি আমাকে একা ছাড়তো না এটা আমিও জানতাম। এতগুলো দিন ঢাকা টু খুলনা আসা যাওয়া করেছি কখনও একা আসার অনুমতি দেননি। আর আব্বুও কখনও আমাকে একা ছাড়েননি! আম্মুর সাথে তার যোগাযোগ ছিলো। আম্মুই বলতেন, ছেলেটা টেনশন করে তোকে নিয়ে!

‎ আর তাই উনি আন্টিকে বললেন
‎”আম্মু তোমার মেয়েকে সাথে নাও!”

‎উনার সাথে জার্নি করবো ভাবতেই হৃদয় কেঁপে উঠছিলো! এতোটা মুখোমুখি আমরা কোনদিনই হয়নি! এতোটা সময় একসাথে! এক গাড়িতে! ভাবতেই অন্তর ইয়া আল্লাহ বলে চিক্কুর দিচ্ছিলো। আমি পালাতে চাইছিলাম।পারবো না! কেমনে সম্ভব! কিন্তু আমি পড়েছিলাম আটকা! চাইলেও যেটা থামাতে পারবো না! নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টায় রত ছিলাম। বুঝ দিলাম। আন্টি আঙ্কেল সবাই থাকবে!

‎উনি সবাইকে বিদায় জানাচ্ছিলেন। উনাদের মধ্যে একটা ব্যাপার দেখলাম উনারা কখনও ইনফর্মাল কথাবার্তা বলে না৷ যা বলে সবটাই ফর্মাল আর মার্জিত ! শুধু নির্ঝর ভাইকে দেখলাম একটু ক্লোজ এবং মাঝে মাঝে সাহস করে ইনফর্মাল কথা বলেন। উনি হতাশ কন্ঠে তারিক ভাইকে বললেন,

‎” এরপর থেকে আপনাকে আর জীবিত দেখতে পারবো না স্যার,এটা ভেবে খারাপ লাগছে? ”

‎আমি কথাটা ধরতে পারলাম না। মুখ ফসকে বলে ফেললাম

‎”কেন? ”

‎নির্ঝর ভাই মুখ টিপে হাসলেন আর বললেন,

‎” স্যার বিবাহিত হয়ে যাবেন কিনা, তাই! ”

‎আমি পড়লাম ভীষণ লজ্জায়। সাথে সাথে উল্টো হেটে আন্টির পিছনে গিয়ে দাড়ালাম৷ তারা হাসতে হাসতে কথা চালিয়ে গেল। আমি আন্টির পিছন থেকে একবার উঁকি দিলাম। উনি জলজল চোখে আমার দিকেই তাকিয়ে ছিলেন! আমি আবারও লজ্জায় লুকিয়ে পড়লাম।

‎বাপ্পি ড্রাইভ করলো। আর আমরা তিনজন পিছনে বসলাম। আন্টি আঙ্কেল মাঝারি গড়নের হলেও আমি ছিলাম চিপকুস। যার কারনে তিনজন বসতে সমস্যা হলো না৷ আমি পড়ে থাকলাম আমার আন্টির কোলের ভিতরে! যে সত্যিকার অর্থেই আমার আরেকটা মা ছিলো ছোটবেলা থেকেই। বাপ্পি টিটকারি করে বললো

‎”মুনিবা তুই চলিস কেমনে? বাতাসে উড়াই নিয়ে যায় না তোকে? তোকে ভাইয়ের পাশে একটুও মানাবে না! ”

‎আমার ইচ্ছে হলো গাধাটাকে কয়েকটা দিই! সে থামলো না। আমি মাঝে মাঝে আন্টিকে ডেকে বিচার দিতে থাকলাম। আঙ্কেল আর উনাকে দেখলাম সিটে মাথা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। দুজনেই বড্ড গম্ভীর!
‎আর এদিকে আমাদের দুজনের নটখট চলতেই থাকলো৷ যখন বাপ্পি বেশি বলে ফেললো, উনি মাথা উচু করে বাপ্পির দিকে চোখ গরম করে বললেন

‎” বিহেইভ ”

‎বাপ্পি থেমে গেল! এই দৃশ্য পিছন থেকে দেখে আমার চোখে ভাসলো সেই দিন! ক্লাস টু’তে পড়ার সময়কাল। প্রথম যেদিন আমাকে রক্তচক্ষুর দৃষ্টি দিয়েছিলেন উনি!

‎জীবন কোথা থেকে আমাদের কোথায় নিয়ে যায়! যে মানুষটাকে আমার বিরক্ত লাগতো সেই মানুষটাই এখন আমার সবচেয়ে আপন হতে চলেছে। আমার ভাবনার ঘুড়ি বাতাসে উড়তে থাকলো সেই প্রাইভেট কারের জানালা বেয়ে ঐ আকাশে… উড়ন্ত মেঘের ভেলার সাথে!

‎সে ছিলো লাজুকতায় মোড়ানো এক অভ্যাস। একটু তাকায় একটু চোখ ফিরাই। পরক্ষনেই আবারও দেখার সাধ জাগে! সারা রাস্তায় চোখ বন্ধ থাকলেও উনি হঠাৎ মাঝে মাঝে এক/দুবার লুকিং গ্লাসের দিকে তাকাচ্ছিলেন। যদিও সে দৃষ্টি ছিলো পরিমিত একদম হাতে গোনা। কখনও গাড়ি হার্ডব্রেক করলে কিংবা কোন বড় গাড়ি পাশ দিয়ে খুব জোরে গেলে উনি চোখ খুলেই আগে গ্লাসে দেখছিলেন! সতর্কতার দৃষ্টি! সেটা কি আমাকে নাকি সবাইকে! আমার সাথে চোখ মিলতেই নামিয়ে নিচ্ছিলাম দু’জনেই। ঐ ওটুকু দৃষ্টিই আমাকে নাজুক করে দিচ্ছিলো! আমি ভীষণ ভাবে মিস করলাম প্রাইভেট কারের সামনে আর পিছনের সিটের মধ্যে পর্দা দেওয়া থাকলে ভালো হতো৷ জার্নিতে একটুও কষ্ট হতো না আমার। উনার সামান্য ঐ দৃষ্টিই যেন আমার শরীরে কাঁটা দিচ্ছিলো বার বার। সেই দৃষ্টিকে কি বলে? আমি দৃষ্টি বিশ্লেষণ করছিলাম! মনোহরি হৃদয়স্পর্শী নাকি তীক্ষ্ণ ! এক দৃষ্টি এফোড় ওফোড় করে দিয়ে যায় সবকিছু!উনি হঠাৎ ঘুম ভেঙে খেয়াল করছিলেন সব ঠিক আছে কিনা? নাকি এমনি স্বাভাবিক দৃষ্টি! অথচ আমি কেন স্বাভাবিক ছিলাম না সারা রাস্তা? আমার মনে হল উনাদের সাথে আসায় ঠিক হয়নি, আলাদা আসলেই বরং ভালো ছিলো! এমন ভয়ংকর দৃষ্টির মুখোমুখি হতে চাই ক’জন! পুরোটা জার্নিতে আমি বাতাসে ভেসে থাকলাম। জীবনের সবচেয়ে স্মরনীয় জার্নি ছিলো সেটা।

‎_________________________

‎সেবার বাসায় ফিরে আমাকে দেখে আমার আম্মুও পাগল হয়ে গেল! আমি নাকি আরো বেশি চিকনা হয়ে গেছি! হলে খাওয়া দাওয়া করি না! কিভাবে করতাম! আমি গত কয়েকদিনের ভারেই ওজন ঝরে গেছে কয়েক কেজি!

‎সেইদিন সকালে মুহাইমিনকে হুটোপুটি করে রেডি করাচ্ছি! ওর স্কুলে দেরি হয়ে যাচ্ছে! বাসায় থাকলে আব্বু, মুহাইমিনের সকল দায়িত্ব আমার কাঁধেই থাকে! ও গেটে দাড়িয়ে আমি দৌড়ে এসেছি টিফিন বক্সটা দিতে, ওমনি দেখি মুহাইমিনের সাথে উনিও দাড়িয়ে! আমি ইয়া আল্লাহ বলে দ্রুত বক্সটা রেখেই উল্টো দৌড়ে রুমে চলে এসেছি! আমার মাথায় ওড়নাও ছিলো না তখন আবার চুল গুলোও খোলা ছিলো!
আমি দৌড়ে বালিশের নিচে মাথা ঢেকে অসাড় হয়ে পড়ে থাকলাম! উফফ এটা কোন কাজ হলো? ভীষণ কেমন লাগছিলো! লজ্জা খারাপ লাগা একসাথে !

আমি বুঝলাম আমার পাশে কেউ বসেছে। আমার পিঠে হাত দিলো। আমি সাথে সাথে বালিশ সরিয়ে দেখি আন্টি! আন্টি হাসছেন

‎” কি হয়েছে,ওমন করে দৌড়ে এলি কেন? ”

‎আমি চুপ হয়ে উনার পেট জড়িয়ে মুখ গুজে থাকলাম।
‎আন্টি লজ্জা দিলেন!

‎”তোর এই বিশাল লম্বা চুল দেখে আমার ক্যাপ্টেনের হুশ উড়ে গেছে! ”

‎আমি উঠে চলে যেতে নিলে, বললো

‎” আরে চলিস কই। তোর সাথেই তো কথা বলতে আসলাম।মেয়ের জামাই বাইরে বসে আছে ”

‎তখন আম্মু এলেন রুমে। আন্টি বললেন

‎” সুফিয়া মেয়ের জামাই বাইরে বসে আছে। মেয়েকে নিয়ে যেতে চাই! কি বলো? ”

‎আম্মু হাসলেন।

‎”আমার আবার কি? মেয়ে তো তোমারই ছিলো এতোগুলা বছর! কিন্তু দেখছো কি অবস্থা করেছে নিজের! ভাবছিলাম কয়েকদিন খাইয়ে দাইয়ে মোটাতাজা করি। ”

‎”নাহ, বিয়ের বাতাস গায়ে লাগলে এমনিই মোটা হবে। তোমার জামাইয়ের হাতে পড়লে সব ঠিক হয়ে যাবে। ”

‎আমি আর বসে থাকতে পারলাম না। উঠে রান্নাঘরে চলে এলাম! বড়দের কথার মাঝে আমার কি?

‎বাইরের রুমে আব্বুর সাথে আঙ্কেল আর উনি কথা বলছেন আর ভিতরের রুমে আম্মুরা দুজন। আমি চুপচাপ দুই পাশে তাকাচ্ছি। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি এ বাড়িতে আমার সময় ফুরিয়ে এসেছে। আমি এখন অন্য ঘরের বাসিন্দা হবো! এই বাড়ি, এই ঘর ক’দিনের! আমার অনুভূতি গুলো কেমন খাপছাড়া হতে থাকলো! আমি পারবো না উনার সামনে যেতে অসম্ভব! কেমনে! রান্নাঘরের দরজায় দাড়িয়ে আমি বিশাল এক সত্য আবিষ্কার করলাম! আর সেটা হলো! এ জীবন মাত্র কদিনের! দেখতে দেখতে একুশটা বছর কেটে গেল! আমি কবে কবে এতো বড় হলাম! সেদিন না আমরা দুজনই ছোট্ট ছিলাম! হুটোপুটি ছুটোছুটি করেই কেটে গেল একুশটা বছর!

চলবে।‎