মেহেরজান পর্ব-১৭+১৮

0
4

#মেহেরজান
লেখনীতে – #সোহামণি
পর্ব ১৭

আয়াশ ভীষণ ক্লান্ত।সবে বাসার রান্না শেষ করে বিশ্রামের জন্য খাটে গা এলিয়ে দিলো। ভার্সিটি থেকে এসেই বাসার সব কাজ করা শুরু করেছে।আমেনা বেগনের পায়ের গোড়ালিতে ব্যাথা সেজন্য বেশি হাটাচলা করতে পারেন না। আরিশা পাব্লিকে পড়াশোনা করছে।হলে থাকে।শুক্রবারে আসে শুধু বাসায়। আর অনিমা!সে তো দিব্বি নিজের বেপরোয়া জীবন কাটাতে ব্যস্ত।আজ নাকি বোন বান্ধবীর পার্টিতে গিয়েছে।সেখান থেকে এখনও ফেরে নি।আয়াশ ভেবে পায় না এত তাড়াতাড়ি বান্ধবী কোত্থেকে পেলো সে।অনিমার ফ্যামিলি বিদেশে স্যাটেল। আয়াশের জন্যই সে বাংলাদেশেই পড়ে আছে বলে অনিমার অভিযোগ।এসব তথ্য হিসেবে করলে আয়াশ ঠিক বুঝে উঠতে পারে না এই মেয়ের এতো তাড়াতাড়ি বন্ধুবান্ধব জুটলো কিভাবে?অবশ্য বিদেশের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী অনিমা।এসব কিছুই না।আয়াশ হতাশার শ্বাস ফেলে শুধু। মনে মনে ভাবে খাটি সোনা চিনতে ভুল করেছে সে।এই জীবনে আর এই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে পারবে না।ক্লান্ত শরীর কোনোরকম টেনে তুলে রুমের বাইরে এলো। তার মায়ের রুমের সামনে গিয়ে আমেনা বেগমকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“মা খেতে এসো।”

দরজা ঠেলে ভেতরে একবার পরখ করে। আমেনা বেগম শুয়ে আছেন।আমেনা বেগমকে দেখলে আয়াশ ভীষণ কষ্ট পায়। মায়ের শরীরও বেশি ভালো নেই।আয়াশ মায়ের পায়ের কাছে গিয়ে বলল,
“আম্মা খাবে চলো।”

আমেনা বেগম কোনোভাবে উঠে বসেন। ছেলেকে একবার দেখেন।কয়েকদিনেই ছেলেটা কেমন রোগা-সোগা হয়ে গেছে। ফ্যাকাসে মুখ।আমেনা বেগম ছেলেকে বলেন,
“বাবারে আমরা অনেক বড় ভুল করেছি কি?”

ধ্বক করে ওঠে আয়াশের বুক।ভেসে ওঠে রাউশির মুখটা।নিজেকে যথাসম্ভব সংযত রেখে কথা ঘুরিয়ে জবাবে বলল,
“আম্মা তোমার শরীর খারাপ।খেয়ে দেয়ে ঔষধ খেয়ে নাও।কাল ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব।”

আমেনা বেগমকে তুলে উঠালো আয়াশ। আয়াশকে ধরে ডাইনিং টেবিল পর্যন্ত নিয়ে গেলো।চেয়ার টেনে বসালো।পাতে খাবার বেড়ে দিলো মাকে।আমেনা বেগম বেশি খেতে পারলেন না।কয়েক লোকমা খেয়েই উঠে গেলেন।পা টিপে টিপে আস্তে আস্তে চলে গেলেন নিজ রুমে।আয়াশও মায়ের এমন অবস্থাতে বেশি খেতে পারলো না। এঁটো প্লেটগুলো ধুয়ে ঘড়িতে সময় দেখে ১০টা বেজে যাচ্ছে প্রায়।আর অনিমা এখনও এলো না।আয়াশ মায়ের রুমে গিয়ে ঔষধগুলো খাইয়ে গায়ে কাথা টেনে দিয়ে দরজা ভিড়িয়ে নিজের রুমে চলে এলো। অনিমার উপর রেগে অনিমার নাম্বারে কল করে আয়াশ।অনেকবার কল দিয়েও কল রিসিভ করলো না অনিমা।তখনই আবার অনিমার নাম্বার থেকে কল ব্যাক আসলো। আয়াশ কল রিসিভ করে শক্ত গলায় বলল,
“কোথায় তুমি?বাসায় আসার নাম নেই কোনো?তুমি তো এখানের কাউকে চেনো না তাহলে কিভাবে এতো ঘোরাঘুরি করছো?তোমার কি মনে হচ্ছে না তুমি বেশিই করে ফেলছো?”

আয়াশের কথা শেষ হতেই অনিমার বদলে অন্য কন্ঠের একটি মেয়ে জবাবে বলল,
“অনিমা ড্রাংকড হয়েছে বেশি।আমার বাসায় এসেছে।আজ বাসায় যেতে পারবে না মনে হচ্ছে।আগামীকাল আসবে।”

রেগে গেলো আয়াশ।চোয়াল শক্ত করে বলল,
“ওকে আজকেই বাসায় আসতে হবে।ঠিকানা বলুন আমি নিতে আসছি।”

মেয়েটি ঠিকানা দিয়ে দিলো মেসেজে। আয়াশ বেরিয়ে গাড়ির চাবি নিয়ে বেরিয়ে গেলো।লোকেশন অনুযায়ী একটি বিল্ডিংয়ের সামনে এসে দাঁড়ায়।অনিমার নাম্বারে আবারও কল করতেই সেই মেয়েটি কল রিসিভ করে বলে,
“কাইন্ডলি চারতলার বাম পাশের ফ্ল্যাটে আসতে পারবেন প্লিজ?”

আয়াশ দাতে দাত চেপে কল কেটে দিয়ে উদ্যত হয় যাওয়ার জন্য।কথামতো সেই ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়িয়ে কলিংবেল বাজাতেই দরজা খুলে যায়।ভেতরে তাকিয়ে দেখে অনিমা কিছু ছেলের সাথে ডলাডলি করছে মাতাল অবস্থায়।ছেলেগুলো অনিমার গায়ের ওপর পড়ছে।আরও বেশি রেগে গেলো আয়াশ।দরজা খুলে দেওয়া মেয়েটাকে পাশ কাটিয়ে রুমে ঢুকে অনিমার কাছে গিয়ে অনিমাকে সপাটে চড় মারলো সবার সামনেই।সেখানে কয়েকজন ছেলেমেয়ে ছিলো।অনিমা এদের সাথেই অবাধ ঘোরাফেরা করছে।মাতাল অনিমা তাল সামলাতে না পেরে সোফা থেকে ফ্লোরে পড়ে যায়।ছেলেগুলো আয়াশের দিকে তাকালো।আয়াশ অনিমার হাত ধরে টেনে বের করে নিয়ে গেলো।মনে মনে ঠিক করলো এই মেয়ের একটা ব্যবস্থা করতে হবে তাকে।

.

“এই রাউশি!”

চেনা পরিচিত আওয়াজে নিজের নাম শুনে পেছনে ফিরে তাকালো রাউশি।মিলিকে এখানে দেখতে পেয়ে নিজেও চমকালো কিছুটা।এদিকে মিলি তো নিজেও চমকিত। রাউশি এখানে কি করছে?ব্যস্ত মিলি বোনকে খোঁজার জন্য যাচ্ছিলো তখনই রাউশির মতো কাউকে দেখে পিছু নেয়।আর যখন ভালোভাবে দেখলো যে এটা আসলেই রাউশি তখন ডাক দিলো।মিলি রাউশির কাছে এসে বলল,
“আমি কল্পনা করতে পারি নি যে তোমাকে পেয়ে যাব।”

রাউশি হাসলো।বলল,
“আমিও।”

দুজনের কথার মাঝে সেখানে একটি ছেলে আসলো।ছেলেটি মিলিকে একবার তো রাউশিকে একবার দেখলো।এরপর মিলির কাঁধে হাত রেখে বলল,
“আহা, বিয়েবাড়িতে শত লাল গোলাপের মাঝে গিয়ে আজ আমার চোখ গিয়ে পড়লো একদম অন্যরকম সবুজ গোলাপের ওপর। তা মিলি এই সবুজ লাবণ্য গোলাপটি কোন কাননের?”

মিলি হেসে উঠলো বড় ভাইয়ের কথা শুনে। কাঁধ থেকে হাতটা সড়িয়ে দিয়ে বলল,
“এই সবুজ গোলাপটি যেই কাননেরই হোক তোমার ধরাছোঁয়ার বাইরে বুঝলে।”

মুখ ভেংচালো রাওনাফ।রাউশি তাদের কথাই শুনছিলো।রাওনাফ এবার রাউশির দিকে তাকিয়ে বলে,
“আপনার নামটা কি জানতে পারি মিস?”

রাউশি আড়চোখে একবার আশেপাশে তাকালো।উত্তর দিলো,
“মৌরিন খান রাউশি।”
“ওয়াও!হোয়াট এ নেইম।”

তখনই সেখানে আগমন ঘটে মেহরানের। সোজা রাউশির পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।মিলি দেখে চিনলো মেহরানকে।রাওনাফ চিনতে পারলো না।মিলি হেসে জিজ্ঞাসা করলো,
“ভাইয়া কেমন আছেন?আমি রাউশির বান্ধবী মিলি।”

মেহরান হাসিমুখেই জবাবটা দিলো,
“আলহামদুলিল্লাহ। আশা করি তুমিও ভালো আছো মিলি।”

মিলি মাথা নাড়ালো।মেহরান রাউশির দিকে তাকালো আর বলল,
“তোর মা ডাকছে তোকে।”

রাউশি বুঝলো লোকটার নিশ্চিত সহ্য হচ্ছে না রাওনাফ এখানে থাকায়।রাউশি মিলির হাত ধরে নিজের দিকে টেনে বলল,
“ঠিক আছে আমি আর মিলি যাচ্ছি।”

মিলিকে নিয়েই হাঁটা ধরলো রাউশি।মেহরান তাকিয়ে থাকলো সেদিকে।রাওনাফ কিছুটা হলেও আন্দাজ করলো বিষয়টা হেসে মেহরানকে বলল,
“তাহলে__”

মেহরান রাওনাফের দিকে তাকালো।এই ছেলেটাকে একটু আগে দেখেছে সে। পাত্রের চাচাতো ভাই।অনেক্ষণ যাবৎই রাউশিকে ফলো করতে দেখেছে মেহরান। তাইতো কিছুটা জেলাস হয়েই এলো এদিকে।রাওনাফের কথা শেষ করার আগেই জবাব দিলো,
“সবুজ এই গোলাপটা আমার কাননের অতি সযত্নে বেড়ে ওঠা ফুল।”

কথাটা বলেই চলে গেলো মেহরান। রাওনাফ হাসলো।মেহরান নুজাইশের কাছে গেলো। ছেলেটা সিগারেট খাচ্ছে। মেহরানকে দেখে মেহরানের দিকে একটি সিগারেট এগিয়ে দিলো।মেহরানও হাত বাড়িয়ে নিলো।এপাশে মানুষজন নেই। জায়গাটা সুনসান, নিরব।এইপাশটায় আঁধারেরা রাজত্ব করছে নির্ধিদ্বায়।মেহরান সিগারেটটা মুকজে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
“এই অভ্যাস কবে থেকে?”

নুজাইশ সহসা বলল,
“যেদিন থেকে পছন্দের মানুষের আসল পরিচয় জেনেছি।”

মেহরান সিগারেটে এক টান দিয়ে ঠোঁট উচিয়ে ধোঁয়া নিঃসৃত করলো,
“বাড়ির বাগানে যেদিন একটি গোলাপ ফুঁটলো সেদিন আমিই বেশি খুশি হয়েছিলাম।ছোট থেকেই মনে একটা ধারণাই পুষে রেখেছিলাম ফুলটা বড় হলে একান্তই আমার নিজের মৃত্তিকায় রোপণ করে রাখবো একদম সমূলে ।তবে সেই আশায় জল ঢেলে দিলো গোলাপ গাছটার মালিক।আমি অন্যত্র যাওয়ার পর মালিক চাড়াসহ তুলে অন্যত্র দিয়ে দিলো।আমার সমস্ত আশায় ঢেলে দিলো এক বালতি পানি।নিরাশায়, হতাশায় দিন কাটছিলো আমার।তুই নিজেও সাক্ষী।তবে সেই হতাশার মাঝে আমার অন্ধকারত্ব একটা সময় আলোর সমীপে আসলো।গোলাপের চাড়াটা সুস্থসমেত আবারও বাড়ির আঙ্গিনায় রোপণ করা হলো।একবুক আশা নিয়ে দেখলাম চাড়াটা। তখনও কত তরতাজা আর কাটায় ভর্তি।তবে ধীরে ধীরে বাড়ির আঙ্গিনা থেকে মনের আঙ্গিনায় আসতে শুরু করেছে।”

নুজাইশের কাঁধে হাত রাখলো,
“এখন বল আমি কোনো ভুল করেছি?”

নুজাইশ পুরো কথাটা শুনেছে মন দিয়ে।সিগারেটে শেষ টানটা দিয়ে বলে,
“আসলে গোলাপ এতই আকর্ষণীয় যে সবার নজরেই পড়ে যায়।শালা সাবধানে রাখতে পারিস না?”

মেহরান হেসে উঠলো।নুজাইশ আবার বলল,
“আমি নাহয় ছ্যাকাটা খেয়ে সাধু হয়ে গেলাম অন্যদের থেকে সাবধান।”

মেহরান সিগারেটে আরেক টান দিয়ে বলল,
“মেহরানের সম্পদ মেহরান আগলে রাখতে জানে।”

চলবে……

#মেহেরজান
লেখনীতে- #সোহামণি
পর্ব ১৮

সকাল থেকেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে আজ। তবে এখন আবার মেঘে গর্জন হচ্ছে।বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।শুক্রবার দিন হওয়ায় বাড়িতে আজ সবাই আছে।বৃষ্টির দিনে খিচুড়ি খাওয়ার মজায় আলাদা। আর সেটা যদি হয় উর্মিলা বেগমের হাতের তৈরি তাহলে তো কোনো কথায় নেই।বাড়ির ছেলেমেয়েদের জন্য আজ নিজ হাতে ভুনা খিচুড়ি রান্নার পরিকল্পনা করেছেন উর্মিলা।বাইরে মেঘ ডাকছে আর বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে এদিকে দোতলায় বসার ঘরে বাড়ির ছেলেমেয়েরা সবাই মিলে লুডু খেলায় মেতে রয়েছে। রাউশি সোফায় গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে আর বাকিরা খেলায় মত্ত।তখনই রাউশির চোখ যায় মেহরানের রুমের দিকে।মেহরান দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দৃষ্টি তার দিকেই।রাউশি তড়িৎ বেগে উঠে বসলো। ভালোভাবে বসে খেয়াল করলো মেহরান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তারই দিকে তাকিয়ে।রাউশি বিড়বিড় করে বলল,
“কি তীক্ষ্ণ চাহনী।”

“একদম শকুনের মতো।” পাশ থেকে উজান কথাটা বললো।খেলায় হেরে যাওয়াতে রাউশির পাশে এসে বসেছে ছেলেটা।উজানের কথা শুনে তার দিকে ফিরে তাকালো রাউশি।উজান দাত কেলিয়ে হাসলো।রাউশি উজানকে পেয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
“আচ্ছা উজান ভাই,এই মেহরান সবসময় গোমরামুখো হয়ে কেন থাকে?আর রাগ রাগ ভাব তো আছেই।মেহরান মানুষ নাকি ভিনগ্রহ থেকে পৃথিবীতে আছড়ে পড়া কোনো প্রাণী?”
“কি বললি?ভাইকে নাম ভিনগ্রহের প্রাণী বললি আর নাম ধরে ডাকলি?”
“হ্যা ডেকেছি, তো কি হয়েছে?”
“দাড়া ভাইকে বলে দিচ্ছি তুই ভাইকে ভিনগ্রহের প্রাণী বলেছিস।”
“বলো মেহরান আমায় কিছুই বলবে না।”

উজান কি যেনো ভাবলো।তারপর বাঁকা হেসে বলল,
“এটা বললে নিশ্চিত সিরিয়াস হবে, যে তুই ভাইকে নাম ধরে ডাকছিস যাতে অভ্যাস হয়ে যায়।অর্থাৎ তুই ভাইকে বিয়ে করতে চাইছিস।”

রাউশি চোখ বড় বড় করে তাকালো।এ বলে কি?এমন মনোভাব আপাতত মাথায় আনে নি রাউশি।আর উজান কিনা বিয়ে পর্যন্ত গেলো।রাউশি মেহরানকে ভাই বলে ডাকতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করে না।নাম ধরে ডাকতেই যেন তার ভালো লাগে।উজান দাত কেলিয়ে হেসে বলল,
“দাড়া ভাইকে বলি।”

উজান উঠতেই যাবে এর আগেই রাউশি উজানকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
“এই না না ভাইয়া এটা বলো না।”
“না আমি তো বলেই ছাড়বো।”
“উজান ভাই প্লিজ এমনটা করো না।”
“ঠিক আছে বলবো না তবে একটা শর্ত আছে।”

রাউশি ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই উজান রাউশির পাশে বসে বলল,
“সিলেট তো আজ বিকেলেই যাচ্ছি।আসলে সিলেটে আমার খুব পছন্দের কিছু একটা আছে।যা সম্পর্কে ভাই জেনে গেছে।এখন আমি চাইছি ভাইকে তুই বোঝা।”
“কিইই আমি?”

উজান মাথা উপর নিচ তুলে বোঝালো হ্যা। রাউশি মেহরানের দিকে একবার তাকালো। মানুষটা এখন ফোনে কথা বলছে।মুখে গম্ভীর ভাবটা এখনও রয়েছে।নিশ্চয় উজানের বিষয়টা জানতে পেরে নাকোচ করে দিয়েছে।এখন এই বিষয়েই যদি আবার রাউশি কিছু বলে তো কাঁচা চিবিয়ে খাবে। মাথা নাড়িয়ে না বোঝাতেই উজান মেহরানকে বলে দেবে বলে উঠে দাড়াতেই রাউশি সম্মতি জানালো।উজান তো মহাখুশি।মেহরান দূর থেকে রাউশি আর উজানকে কথা বলতে দেখে কাছে এগোয়। উজানের পাশে গিয়ে বসতেই উজান উঠে দাঁড়ায়।কারণ সে রাউশি আর মেহরানের ঠিক মাঝখানেই বসে ছিলো।মেহরান ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলো,
“সমস্যা কি?”

উজান উত্তরে বলল,
“আমি তোমাদের কপোত-কপোতীর মাঝে বসে থাকতে পারবো না।”

বাকিরা একটু দূরে ছিলো আর খেলাতে এতটাই মত্ত ছিলো শুনলো না এদের কথাবার্তা।উজানের কথাটা শুনে রাউশি কেঁশে উঠলো।চোখ রাঙিয়ে উজানের দিকে তাকাতেই পাশে তাকিয়ে দেখে মেহরানের ঠোঁটের কোণে ক্ষীণ হাসি।রাউশি ভালোভাবে তাকাতেই মেহরান একদম স্বাভাবিক হয়ে যায়।উজান সেখান থেকে চলে যেতেই মেহরান আয়েশী ভঙ্গিতে বসে। রাউশি উশখুশ করছে।উঠে যেতেও পারছে না আবার বসে থাকতেও পারছে না।কি একটা বিপদ।তানিয়া আর মাইশাকে ইশারায় ডাকতে চাইলো।হিশ হিশ শব্দ করলো।রাউশির এমন কাজে মেহরান গম্ভীরভাবে প্রশ্ন করলো,
“টয়লেটে পেয়েছে তো চুপচাপ যা।এভাবে বসে বসে হিশ হিশ করছিস কেন?”

এমন কথায় রাউশি লজ্জা পেলো খানিক। এদিকে সামনে খেলায় মত্ত সবাই তাকালো পেছনে।তাজবির এগিয়ে এলো রাউশির দিকে।মেহরানের দিকে তাকিয়ে রাউশির দিকে তাকিয়ে বলল,
“এই রাউশিপু মেহরান ভাইয়া কি তোমায় বকছে?”

রাউশি তাজবিরের দিকে তাকালো।মেহরান এক ভ্রু উঁচিয়ে তাকিয়ে আছে দুজনের দিকে।রাউশি আড়চোখে মেহরানের দিকে তাকিয়ে এখান থেকে কেটে পড়তে সুযোগ পেয়ে কথা ঘুরিয়ে বলল,
“চল তাজবির আমার রুমে যাই।তোকে আমার ফোনে গেম খেলতে দেব।”

তাজবির খুশিতে মাথা নাড়ালো অনেকবার। ছেলেটা ফোনে এতো গেইম খেলতে পারে। তবে তখনই রূপা বেগম উপরে উঠে এসে বলল,
“এই তোরা এখনও এখানে বসে খেলছিস? খাবি কখন?তাড়াতাড়ি আয়।বেলা গড়াচ্ছে। আরেকটু পর তো রওনা দিতে হবে।”

মায়ের কথাটা শেষ হতে না হতে রাউশি তাজবিরের হাত ধরে মা’কে পাশ কাটিয়ে নিচে নেমে গেলো।মেয়ের এমন কাজে কপাল কুঁচকালো রূপা বেগম।বাকিরাও ধীরে ধীরে নামতে লাগলো।মেহরান সোফা থেকে উঠে নিজের রুমে হাটা ধরতেই রূপা বেগম জিজ্ঞাসা করলেন,
“মেহরান বাবা, তুমিও এসো।”

মেহরান থামলো। রূপা বেগমকে বলল,
“মেজো মা আমার এখন একটু কাজ আছে।তুমি বরং কাউকে দিয়ে আমার খাবারটা পাঠিয়ে দাও।”

রূপা বেগমও মাথা নাড়িয়ে চলে গেলেন। মেহরান নিজের রুমে ঢুকে গেলো।নিচে হৈ-হুল্লোড় পড়ে গেছে ছেলেমেয়েগুলোর। বাড়ির কর্তারা নেই তাই এতো চিল্লাফাল্লা করছে আজ।মাইশা চেয়ার টেনে ধরতেই তানজিম সেই চেয়ারে বসে পড়ে।মাইশা রেগে যায়।তানজিমের মাথার চুল টেনে দিয়ে রাউশির পাশে গিয়ে বসে পড়ে। নাহিন প্লেটে গরম গরম খিচুড়ি আর ইলিশ মাছ ভাজা নিয়ে গপাগপ খাওয়া শুরু করে দিয়েছে অলরেডি।এটা দেখে তানজিম বলল,
“শালা আস্তে আস্তে খা।রাক্ষসের মতো এভাবে খাচ্ছিস কেন?যেন কত বছরের অভুক্ত তুই।”

নাহিন খেতে খেতেই রোকসানা বেগমকে বলল,
“ছোট চাচী দেখো তোমার ছেলে আমায় কিসব বলছে।আমি বছরে একবার এসে এমন চান্স পেয়ে থাকি আর তোমার ছেলে আমার সাথে দূর্ব্যবহার করে।”

রোকসানা বেগম তানজিমকে ধমকে বললেন,
“এই তানজিম ছেলেটা একদিন মাত্র আসে। এভাবে এসব কি বলিস?চুপচাপ খা নয়তো চলে যা।”
তারপর নাহিনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“বাবা তুই তোর ইচ্ছেমতো খা।”

নাহিন বিজয়ের হাসি হাসলো।উজান নাহিনের কাঁধে চাপড় মেরে বলল,
“তোর মতো এতো গাধা আমি আমার জীবনে আরেকটা দেখিনি।”

খাবার মুখে নিয়েই উজানের দিকে তাকালো নাহিন।চোখ দিয়ে প্রশ্ন করলো কি গাধামি করেছে সে।উজান নিজের প্লেটে খিচুড়ি নিয়ে বলল,
“কিছুদিন পর বুঝতে পারবি।”

নাহিন পাত্তা না দিয়ে খাওয়া শুরু করলো আবারও।রূপা বেগম অন্য একটি প্লেটে খাবার সাজিয়ে গুছিয়ে দিচ্ছিলো উর্মিলা বেগম এসে জিজ্ঞাসা করেন,
“এটা কার জন্য?”
“মেহরানের জন্য আপা।”
“এই ছেলেটা না কি যে করে?”

রূপা বেগম প্লেট হাতে নিয়ে যেতে নিলে উর্মিলা বেগম কিছু একটা মনে করে বলেন,
“খাবার বেশি করে দে রূপা।আর রাউশিকে দিয়ে পাঠিয়ে দিস।”

রূপা বেগম বিষয়টা স্বাভাবিকভাবে নিলেও উর্মিলা বেগম চক্ষু হাসলেন।রাউশি নিজের প্লেটে খাবার নিয়ে সবে এক লোকমা মুখে তোলার জন্য রেডি হচ্ছিলো সে সময় রূপা বেগম এসে বললেন,
“যা তো রাউ মা এটা মেহরানকে দিয়ে আয়।”

রাউশি ঠোঁটে ঠোঁট চেপে দাতে দাত পিষে মায়ের দিকে তাকালো।রূপা বেগম চোখ দিয়ে ইশারা করলেন যেতে।রাগে হাতের লোকমাটা প্লেটে জোর দিয়ে ফেলে দিলো। যার দরুণ সেখান থেকে কিছু ভাত নাহিনের মুখে গিয়ে লাগলো।নাহিন ওর পাশেই বসে ছিলো।নাহিন এটা দেখে ক্ষেপে গেলো।বলল,
“পুরো প্লেটটাই মুখে ছুড়ে মার আমায়।”

রাউশি উঠে দাঁড়িয়ে নাহিনের পায়ে নিজের পা দিয়ে আঘাত করলো।নাহিন চেঁচিয়ে উঠলো।রাউশি মায়ের হাত থেকে ট্রে-টা হাতে নিয়ে ধুপধাপ পা ফেলে উপরে উঠে গেলো।উর্মিলা বেগম মনে মনে হাসলেন।রূপা বেগম নাহিনের দিকে টিস্যু এগিয়ে দিলেন আর বললেন,
“এই মেয়েকে নিয়ে আর পারি না।”

উপরে এসে মেহরানের রুমের সামনে এসে দাড়ালো।ট্রে-তে থাকা খাবারগুলোর দিকে একবার তাকালো।খিচুড়ি একপ্লেট,সাদা ভাতও একপ্লেট,একটা বাটিতে গরুর গোস্ত ভুনা, ইলিশ মাছ ভাজা আর অমলেট। মুখ ভেংচালো রাউশি।এতো খাবার খাবে কিভাবে এই লোক?রাক্ষসের বাপ নাকি? দরজায় নক করতেই ভেতর থেকে উচ্চৈস্বরে আওয়াজ এলো,
“দরজা খোলা আছে।”

রাউশি দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই দেখে মেহরান বারান্দার সামনে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে।রাউশিকে দেখেনি এখনও। রাউশি খাবারের ট্রে-টা খাটের পাশে সেন্টার টেবিলে রেখে চলে যেতে নিলে পেছন থেকে মেহরান বলল,
“দাড়া।”

রাউশি হাটা থামিয়ে দিলো।পেছনে ফিরে দেখলো মেহরান তার দিকেই তাকিয়ে আছে।মেহরান সোফায় বসে বলল,
“আমি কি যেতে বলেছি?”

রাউশি সেখানেই সং সেজে দাড়িয়ে রইলো। মেহরান কাউকে ফোন দিয়ে আবারও কথা বলতে শুরু করলো।সেসব কানে নিচ্ছে না রাউশি।পেটে যে তার খিদা জলন্ত আগুনের মতো পুড়িয়ে দিচ্ছে সব।কথা বলার সময় রাউশিকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চোখ দিয়ে ইশারা করলো বসার জন্য।রাউশি মেহরানের দিকে তাকিয়ে থাকায় ইশারাটা বুঝলো।না চাইতেও বসলো খাটের ওপর । মেহরান কল কেটে দিয়ে ফোন টেবিলের ওপর রেখে হাত উঁচিয়ে আড়মোড়া ভাঙলো।রাউশি আড়চোখে দেখলো সেসব।মেহরান উঠে এসে খাটের ওপর বসে রাউশির দিকে তাকিয়ে গম্ভীরভাবে বলল,
“আমার হাত ব্যথা খাইয়ে দে আমায়।”

রাউশি আকাশ থেকে পড়লো।এই লোক বলে কি?খাবার যে এনে দিয়েছে এটাই অনেক।আবার খাইয়ে দেবে এসব কেমন কথা?রাউশি না বলতেই যাবে তার আগেই মেহরান বলল,
“কিছুদিন পর থেকে নিত্যদিনের কাজ হবে এটা।তাই আগে থেকেই অভ্যাস থাকা অতি জরুরি।”

রাউশি রাগ করে বলল,
“আপনার হাত তো ঠিক আছে।”
“মুখের ওপর কথা বলছিস?”
“এমন কিছুই না।”
“তাহলে কি বলছিস এসব?”
“জানি না।”
“খাইয়ে দে।”
“পারবোনা।”
“তাহলে গালে একটা চুমু দে।”
“পারবোনা।”

উত্তর দেওয়ার পরই রাউশি বুঝতে পারলো মেহরানের কথাটা।বিস্মিত হয়ে তাকালো মেহরানের দিকে।মেহরান তার দিকেই একদৃষ্টে তাকিয়ে।রাউশি উঠে দাড়ালো। লজ্জা পেয়ে উঠে চলে যেতে নিলেই মেহরান হাত ধরলো রাউশির।রাউশি থমকে গেলো। অনুভুতিগুলো আবারও বেসামাল হয়ে পড়লো।এই লোকের কাছে থাকলেই তার অনুভুতিগুলো টালমাটাল হয়ে ওঠে। বাহিরে যেমন ঝড়বৃষ্টি রাউশির মনেও তেমনই ঝড় উঠে গেলো।মেহরান রাউশির কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“তুই না’ই দিতে পারিস,তবে আমি তো এই ভুল করবো না।”

বলেই টুপ করে রাউশির গালে একটা চুমু খেলো।

চলবে….