#মেহেরজান
লেখনীতে- #সোহা
পর্ব ২
ব্যবসার সুবাদে মাহমুদ খান রাজশাহী থাকেন।বড় ভাই মাহবুব খান আর ছোট ভাই মাহতাব খান ঢাকায় থাকেন।সেখানেই তাদের ব্যবসা।কিন্তু আজ সবার ছোট বোন মালিহাসহ মাহমুদ খানদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছেন।ঢাকায় ফিরে যাওয়ার কথা বলার জন্য।কারণ এখন মেহরান যেহেতু এসে গেছে সেই ব্যবসার হাল ধরবে।রাউশিকেও এবার নিজেদের সাথে নেওয়ার কথা ভাবেন।আয়াশ যখন দেশে ফিরলে তখনের ব্যাপার তখন দেখা যাবে।তবে রাউশির আগমনী বার্তা আর তার সাথে ঘটা কাহিনীটা শুনতেই সকলের রক্ত গরম হয়ে ওঠে।মাহবুব খানের ছোট ছেলে উজান আর মাহতাব খানের বড় ছেলে তানজিম তো ক্ষেপে গিয়েছিলো।বড় ভাই মেহরানের ধমকে চুপ করে আছে এখন ছেলে দুটো।খান বাড়ির সবাই রেগে আগুন।মাহবুব খান,মাহতাব খান এবং তাদের ছোট বোন মালিহা খান কখনো ভাবতে পারেননি ভাইয়ের বাসায় এসে আজ এমন কথা শুনতে হবে।মাহমুদ খান বারবার স্ত্রীকেই বকে যাচ্ছেন আর চেঁচাচ্ছেন।মাহমুদ খানের মতে তার স্ত্রীর জন্যই তার একমাত্র আদরের মেয়েকে আজ এত অপমানিত হতে হলো।যেখানে কিনা ছোট থেকে তিনি মেয়েকে উচ্চৈঃস্বরে একটা কথাও পর্যন্ত বলেন নি সেখানে তার স্বামী কিনা আজ দ্বিতীয় স্ত্রী নিয়ে বাড়িতে ফিরেছে কাউকে কিছু না জানিয়ে।মাহমুদ খানের বড় ভাই মাহবুব খানও রেগে আছেন।তবে তিনি নিজেকে যথাসম্ভব সংযত রেখেছেন।কিন্তু মাহমুদ খান স্ত্রীর ওপর রাগ ঝেড়ে যাচ্ছেন সেই অনেক্ষণ হলো।
“তোমার জন্যই আজ এমনটা হলো।আমি মেয়েটাকে কখনো তোমার ভাই পো’র সাথে বিয়ে দিতে চাই নি।অথচ তোমারই যতসব জেদ।এখন দেখলে তো তোমার আদরের ভাই পো কি কুকাজ করলো?ওই ছেলেটাকে আমি ছেড়ে দেবো না।জেলের ভাত খাইয়ে তারপর ছাড়বো।”কথাগুলো রূপা বেগমকে চেঁচিয়ে বলে মাহমুদ।রূপা খানিক দূরে মাহবুব খানের স্ত্রী উর্মিলা বেগমের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন,মুখে শাড়ির আঁচল ঢেকে।অন্যপাশ হতে মাহতাবের স্ত্রী রুকসানা বেগম স্বান্তনা দিচ্ছেন।রূপার চোখদুটো জ্বলে চিকচিক করছে।
মাহবুব খান বিরক্ত হয়ে বলেন,
“আহ শান্ত হও মাহমুদ।রূপাকে দোষ দিচ্ছো কেন?”
তৎপর মালিহা খান বলে ওঠেন,
“রূপাকে সেদিন আমরাও বারণ করেছিলাম এমনটা না করতে।তবুও আমাদের কারোর কথা শুনেনি।”
রূপা মাথা নিচু করে অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে আছে।তিনবছর আগে সবাই নিষেধ করেছিলো এই রাউশির বিয়ে নিয়ে।তখন রাউশি সবে ইন্টার দ্বিতীয় বর্ষে।তবে রূপা ভাইয়ের কথা রাখতে বাড়ির সকলকে বোঝান।কেউ রাজি ছিলো না কিন্তু মাহবুব খান রূপাকে নিজের বোনের মতো দেখতেন।তাই তো তিনি রাজি হয়ে যান।মাহবুব খানের রাজি হওয়াতে সকলেরই না চাইতেও রাজি হতে হয়।তবে আদরের সেই ছোট মেয়েটির এমন দিন দেখতে হবে কখনো ভাবেননি মাহবুব খান।
মাহমুদ রাগে ফুঁসছেন।শান্ত রাখতে পারছেন না নিজেকে।মাহবুব খান রূপাকে বলেন,
“রূপা তোমার ভাইয়ের ছেলে এমনটা মোটেও ঠিক করে নি।ডিভোর্সের ব্যাপারটা আমি আগামীকালই দেখছি।আর তুমিও ওই পরিবারের সাথে কোনো যোগাযোগ আর রাখতে পারবে না।”
রূপা মাথা তুলে তাকায়।মাহমুদ খান বড় ভাইয়ের এই কথা শুনে বলে,
“ভাইজান এমনিতেই ছেড়ে দেব ওদের।আমার মেয়েকে ওরা এভাবে এভাবে তিনটে বছর আটকে রেখেছে।তাদের গুণধর ছেলে বিদেশে থেকেও বাড়িতে দু তিন বারের বেশি আসতে দেয় নি।আবার এখন ওই কুলাঙ্গার আরেকটা বিয়ে করে এনেছে। এরপরও আমি ওদের ছেড়ে দেবো?”
মাহতাব খানও এবার মেজো ভাইয়ের কথায় সায় দিয়ে বলেন,
“হ্যা তাইতো।ওদের উচিত শিক্ষা দেওয়া উচিত।”
রূপার খারাপ লাগছে।যত যাই হোক রায়হান তার বড় ভাই।তবে মেয়ের সাথে যা হয়েছে এটা ঠিক নয়।তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।মেয়েটার কালো মুখ,বিষণ্ণ চোখ দেখেই স্পষ্ট মেয়েটা কত কষ্ট পেয়েছে।এদিকে তার ভাই রায়হান তো এমন নয়।আগে যদি জানতো আয়াশ রাউশিকে পছন্দ করে না তবে বিয়ের ব্যাপারটা কখনোই ভাবতো না রূপা।মাহতাবের কথা শুনে এবার পাশে বসা মেহরান বলে,
“শান্ত হন চাচা আপনারা।আমি ব্যাপারটা দেখবো।আপাতত রাউশির খেয়াল রাখা জরুরি।”
মাহবুব খান ছেলের দিকে একপলক তাকিয়ে উঠে দাঁড়ান।স্ত্রীর কাছে গিয়ে বলেন,
“রাউশির খেয়াল রাখবে।মেয়েটা মানসিক যন্ত্রণায় ভুগবে।এটা আমরা কেউ দেখতে পারবো না।রূপা মেয়ের কাছে যাও।”
মেহরান মাথা নিচু করে কিছু ভাবছে।
.
নিজের রুমে লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে রাউশি।তার পাশেই বিছানার ওপর বসে আছে মালিহা খানের ছেলে নাহিন, ছোট মেয়ে মাইশা আর মাহতাব খানের বড় মেয়ে মাইশার সমবয়সী তানিয়া আর পরিবারের সবচেয়ে ছোট সদস্য তাজবির।বাচ্চাটার বয়স এখনও এগারো।তানিয়া ডাকে রাউশিকে,
“এই রাউশি আপু আর কেঁদো না প্লিজ।তুমি কাঁদলে আমাদের খারাপ লাগে তো।ভালোই হয়েছে ওই শয়তানটাকে আমরা কেউই পছন্দ করতাম না। আগামীকাল তোমাদের ডিভোর্স এর সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বড় বাবা।”
পাশ থেকে ছোট্ট তাজবির বলে,
“হ্যা রাউশিপু ওঠো না।দেখো আজ আমরা সবাই এসেছি।তুমি কোথায় আমাদের সাথে মজা করবে। তা না করে তুমি পড়ে পড়ে কাঁদছো?”
মাইশাও বলে,
“হ্যা রাউশি আপু তুমি কান্না করো না।তোমাকে কাঁদতে দেখলে আমাদের খারাপ লাগে।”
আপেলে এক কামড় দিয়ে নাহিন বলে,
“ঢং করা বাদ দিয়ে উঠে পর রাউ।কালকেই চলে যাব আমরা।ঢাকা গেলে আয়াশ মায়াশ সব ভুলে যাবি।”
রাউশি এবার সত্যি সত্যিই গা থেকে লেপ সড়িয়ে উঠে পড়ে।চোখদুটো লাল,ফুলে গেছে।শীর্ণ দেহে উঠে দাঁড়ায়।তানিয়া রাউশির কাছে এসে বলে,
“কেঁদো না রাউশিপু। এবার আমরা সবাই একসাথেই থাকবো।আগামীকাল দুপুরেই এই শহর ছেড়ে চলে যাব।”
কথাটা শুনে তড়িৎ বেগে তানিয়ার দিকে তাকায় রাউশি।বলে,
“কেন?”
“জানিনা আমি।বড় বাবা ঠিক করেছেন।”
মন সায় না দিকেও কম্পমান আওয়াজে শুধায় ‘ওহ’।রাউশির মামা রায়হানদের বাড়ি রাজশাহীতেই।ছোট বেলায় যখন এখানে এসেছিলো তারা রায়হানদের সাথে ওঠাবসা বেশি হতো।প্রতিদিনই রায়হানদের বাড়িতে আসা যাওয়া চলতো তাদের।কিশোরী জীবনে পা রাখতেই মামাতো ভাই আয়াশের প্রতি একটা অনুভুতি সৃষ্টি হয়।কৈশর জীবনের আবেগ বলা চলে।তবে তাদের যে বিয়ে হয়ে যাবে এটা কস্মিনকালেও ভাবে নি রাউশি।খুশি ছিলো সে তবে আয়াশের গম্ভীর মুখ দেখে তখন না বুঝলেও বিয়ের পর যখন বিদেশ চলে যায় তখন বুঝেছে।তার সংসার না টিকে থাকার সম্ভাবনা খুব বেশি।যেটা তিনবছর পরই হলো।তবুও রাউশি এই তিনবছর রায়হানদের বাড়িতেই থেকে কাটিয়েছে।সেখান থেকে ভার্সিটি যাওয়া আসা করতো।তবে পরিশেষটা যে এভাবে হবে তারও জানা ছিলো না।কষ্ট পায়নি রাউশি, কারণ সে জানে আয়াশ তাকে কখনো পছন্দ করতো না।তবুও আবেগাপ্লুত হয়েই কান্না করেছে।রাউশি ঠিক করে সুন্দর একটি জীবন গঠনের কথা।প্রথম অধ্যায় শেষ করে দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু করার কঠোর প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় সে মনে মনে।তবে এই নতুন জীবন শুরু করার আগে তাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ সাড়তে হবে।তখনই রুমে প্রবেশ করেন মালিহা খান।রাউশির কাছে এসে জড়িয়ে ধরেন একবার।তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন,
“রাউশি মা তুই একদম ভেঙ্গে পড়বিনা।আমরা সবাই আছি তোর সাথে বুঝলি।”
রাউশি মাথা নাড়ায়।
.
এক রাত পেরিয়ে পরদিন রাউশি বাড়ি থেকে লুকিয়ে বের হয়।আজ বিকেলের দিকেই রওনা দিবে তারা ঢাকা উদ্দেশ্যে। তবে এখন তার খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ করতে হবে।বাড়ি থেকে একটু দূরে গিয়ে সিএনজির জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।তখনই একটি কালো গাড়ি সেখানে এসে থামে।গাড়ির কাঁচ নামতেই ভুত দেখার মতো চমকে ওঠে রাউশি।মেহরান বসে আছে ড্রাইভিং সিটে।কিন্তু মেহরান জানলো কিভাবে সে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে?সে তো বোরখা,হিজাব খুব ভালোভাবে জড়িয়ে তাকে যাতে কেউ না চিনতে পারে সেভাবেই বাড়ির পেছনর গেইট দিয়ে বেরিয়েছে।তার ভাবনার মাঝে মেহরান রুক্ষ গম্ভীর স্বরে বলে,
“পালিয়ে বেড়ানোর স্বভাব আছে দেখছি?”
রাউশি কি উত্তর দেবে বুঝতে পারছে না।এখন যদি তার বেড়িয়ে যাওয়ার কথাটা বাড়ির সবাইকে বলে দেয় তার বাবা কিছু না বললেও বাড়ির বাকিরা নিশ্চয় বকা দেবে।রাউশি মিনমিন করে বলে,
“একটা জরুরী কাজে বেরিয়েছিলাম।”
মেহরান রাউশির দিকে তীক্ষ্ণ চাহনী রেখে শুধায়,
“কি কাজ?”
রাউশি আমতা আমতা করতে থাকে।
মেহরান গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে বলে,
“উঠে এসো।”
রাউশি তৎক্ষনাৎ বলে,
“না না ভাইয়া আমি একাই যেতে পারবো।”
মেহরান চোখ রাঙায়।তার চোখ রাঙানি দেখে ভয়ে বুক কেঁপে ওঠে রাউশির।এই লোকটাকে সে ছোট বেলায় ভয় পেতো।এখনও কেমন বাঘের মতো লাগে তার কাছে মেহরানকে।অগত্যা বাধ্য হয়ে গাড়িতে উঠে রাউশি।মুখ গোমড়া করে বসে থাকে।অবশ্য কেউ লক্ষ করবেনা সেটা।কারণ রাউশির মুখ ঢাকা।
“কোথায় যাবে?”
আবারও সেই গম্ভীর আওয়াজে রাউশি রুষ্ট হয়।কথায় কি ঝাঁঝ না মেশালে এই লোকের শান্তি হয় না?সেই মুখ গোমড়া করে উত্তর দেয়,
“মামার বাসায়।”
বলেই মুখে হাত দেয়।মুখ ফসকে বলে ফেলেছে।ভ্রুকুটি হয় মেহরানের।এই সময়ে রাউশি সেখানে গিয়ে কি করবে?
“কিসের জন্য?”
রাউশি আবারও আমতা আমতা করতে থাকে।মেহরান রাউশির মামা বাড়ি চেনে না।ঠিকানা জানতে চাইলে রাউশি এবার খুশি খুশি ঠিকানা বলে দেয়।বাসার সামনে নামতেই মেহরানও তার পিছু পিছু নামে।রাউশির কিছু বলারও নেই।ভয় পায় সে লোকটাকে।এখন যদি যেতে নিষেধ করে পরে না আবার বাড়ির সবাইকে বলে দেয়।বাড়ির কলিংবেল অনবরত বাজাতে থাকে রাউশি।কিছুক্ষণ পর আয়াশই দরজা খুলে দেয়।রাউশিকে দরজার সামনে দেখে অবাক হয়।রাউশির পেছনে মেহরানকে দেখে এই অবাকত্ব আরও গভীর হয়।রায়হান আর আমেনা বেরিয়ে আসেন ঘর থেকে কে এসেছে দেখতে।রাউশি কিছু না বলে হুট করেই আয়াশের গালে পরপর বড়সড় দুটো চড় বসিয়ে দেয়।এতে চমকে যায় আমেনা তবে রায়হান সাহেব চুপ।আয়াশের নব্য স্ত্রী অনিমাও এটা দেখে হতবম্ভ হয়।পেছনে দাঁড়ানো মেহরানও যেন অবাক হয়।কিন্তু তার ঠোঁটের কোণে ক্ষীণ হাসির রেখা দেখা যায়।আয়াশ গালে হাত দিয়ে অগ্নিঝড়া গলায় বলে,
” আমার বাড়িতে এসে আমায় মারছিস তুই?তোর এতো সাহস হলো কিভাবে?”
আরেকটা চড় বসিয়ে দেয় রাউশি আয়াশের গালে।আর স্বাভাবিক গলায় দাম্ভিকের সাথে বলে,
“এভাবে।”
থেমে আবারও বলে,
“প্রথম দুটো হলো আমার জীবনের তিনটে বছর নষ্ট করার জন্য।আর শেষেরটা হলো রাউশি খানের সাথে উঁচু গলায় কথা বলার জন্য।আমার তো লজ্জা করছে তোর মতো একটা ছেলের প্রতি আমার অনুভুতি এসেছিলো।ছি।আমি কত ভুল ছিলাম।তোকে জেলে পাঠাতে পারতাম।তবে আমি সেটা করবো না।কারণ হলো রায়হান মামা।উনার কষ্ট আমার সহ্য হবে না।কিন্তু তোকে শুধু এই তিনটে চড় মেরেও আমার রাগ ক্ষান্ত হচ্ছে না।তবুও তোর নতুন জীবনের শুভেচ্ছা রইলো।দেখা যাক কেমন কাটাস সেই জীবন।”
রাউশির তুই তুকারি শুনে সবাই চমকে যায়।রাউশি সেসবে পাত্তা না দিয়ে রায়হান সাহেবের দিকে তাকিয়ে বিনম্র গলায় বলে,
“কাজটা তোমার কাছে খারাপ লাগলেও আমি মনে করছি আমি ভালো কাজ করেছি।ভালো থেকো মামা।আসি।”
রায়হান সাহেব মাথা নাড়ান শুধু।ঠোঁটে খুশির এক হাসি।রাউশি আর একটা সেকেন্ডও দাঁড়ায় না সেখানে।এমনকি রায়হান সাহেব আর আমেনা বেগমের সাথেও কথা বলে না।সে জানে আমেনা বেগম ছেলের এমন কাণ্ডের সাথে পরোক্ষভাবে জড়িতে।কিন্তু রায়হান সাহেব ক্রুটিপূর্ণ ছিলেন না।মেহরানও তার পিছু পিছু আসে।মেহরান ভাবে মেয়েটার আত্মসম্মানবোধ প্রখর।এমনকি মেহরান নিজেও বুঝতে পারে নি রাউশি এমন কাজ করবে।রাউশি গাড়িতে বসে পড়ে।নিকাবের আড়ালে প্রশান্তির হাসি।মেহরান নিজ সিটে এসে বসে গাড়ি স্টার্ট দেয়।
রাউশি হুট করেই ভঅয় ডর ভুলে গিয়ে খোশমেজাজে বলে ফেলে,
“একটা ডিজে গান ছাড়ুন না ভাইয়া।”
মেহরান চোখ রাঙিয়ে তাকায় আবারও।রাউশি চুপসে যায়।’সরি’ বলে ছোট করে।মেহরান জানালারা বাইরে তাকিয়ে হাসে।সত্যিই একটি গান ছেড়ে দেয় গাড়িতে।
চলবে..
#মেহেরজান
লেখনীতে- #সোহা
পর্ব ৩
সন্তান খারাপ হলে বাবা মায়ের কষ্ট।তবে আয়াশের জন্য শুধুই রায়হান সাহেবের যত কষ্ট হয়েছে।ছেলেটাকে ছোট থেকেই আদরে আদরে মানুষ করেছে আর এখন তার এই প্রতিদান দিচ্ছে।আমেনা বেগমও জেনে গিয়েছিলেন ছেলে বিদেশে গিয়ে আরেকটা বিয়ে করেছে তবে এ বিষয়টি তিনি গোপন রেখেছেন সকলের থেকে।রাউশিও ঘটনাটা জেনে গিয়েছিলো সেদিন সকালে যেদিন আয়াশ বাড়িতে ফিরেছে দ্বিতীয় স্ত্রী নিয়ে। অথচ আমেনা বিষয়টা জেনেও কাউকে জানান নি।শুধুমাত্র নিজেদের অবস্থা রাউশির মাধ্যমে আরও সচ্ছল করার জন্য।এদিকে আয়াশও কখনো তার বাবাকে অন্য পছন্দের কথা বলেনি।নয়তো কখনোই রাউশির জীবন নষ্ট করে দিতেন না তিনি।খুব আফসোস করছেন রায়হান সাহেব এখন। রায়হান সাহেবের জীবনেই যত দূর্ভোগ নেমেছে।ছেলেকে নিজেরই কয়েকটা চড় মারতে ইচ্ছে করছে।মারতেও গিয়েছিলো তবে স্ত্রী আমেনার জন্য পারে নি।আমেনার সাথেও ব্যাপক ঝগড়া লেগেছে রায়হান সিকদারের।আয়াশদের রুমে ঢুকেন আমেনা।ছেলের পাশে গিয়ে ছেলের গালে হাত বুলিয়ে বলেন,
“ওই মেয়েটা আমার ছেলেকে চড় মারলো।”
আয়াশের আরও মেজাজ চটে যায়।এমনিতেই নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছিলো রাউশির কথা মনে করিয়ে দিতেই আরও বেশি রেগে যায়।
“ওই মেয়েটাকে আমি ছাড়বো না।সাহস কত আমাকে চড় মারার।”
আমেনা ছেলের কথায় সায় দিয়ে বলেন,
“উচিত শিক্ষা দিবি একদম।”
আয়াশ ধপ করে বিছানায় বসে পড়ে।অনিমা বসে বসে নখ পরিচর্যা করছে।এদিকে এসব কথাগুলো বাইরে থেকে রায়হান সিকদার শুনতে পেতেই রুমে এসে এবার আয়াশের গালে দুটো চড় লাগিয়ে দেন।আয়াশ রেগে গেলেও বাবাকে কিছু বলতে পারে না।রায়হান সিকদার চেচিয়ে বলেন,
“মা ছেলে মিলে মেয়েটার জীবন ধ্বংস করে ক্ষান্ত হওনি এখনও?আর কি চাও তোমরা?এক কাজ করো আমাকেই মেরে ফেলো, তোমাদের এসব তামাশা আর আমাকে দেখতে হবে না ইহজনমে।”
আমেনা বিরক্তির সাথে তাকায় রায়হান সাহেবের দিকে।ছেলের মেজাজ খারাপ বিধায় টেনে নিয়ে নিজেদের রুমে নিয়ে যান রায়হান সিকদারকে।এ নিয়ে বাড়িতে বেশ কিছুদিন ঝামেলা হওয়ার আশঙ্কা আছে বলে মনে করেন আমেনা।
.
গাড়ির জানালার বাইরে থেকে ঠান্ডা হাওয়া এসে গা ছুয়ে দিচ্ছে রাউশির।মেহরান রাউশির ডিজে গান ছেড়ে দেওয়ার কথাটা শুনে সত্যিই সত্যিই মুহুর্তক্ষণে একটি গান ছেড়ে দেয়।গানটি বাজতে শুরু করে,
“আজ প্রতি রাতে জেগে থাকি তোমার আশায়,
তুমি চলে গেছো তাই,বিরহের গান গাই।”
এমন গান শুনতেই কেঁশে ওঠে রাউশি।চোখ বড় বড় করে মেহরানের দিকে তাকায়।মেহরানের মুখ গম্ভীর।রাউশি আশ্চর্য ভাব নিয়ে বলে,
“এটা আবার কি গান মেহরান ভাইয়া?”
মেহরান গম্ভীর স্বরেই জবাব দেয়,
“তোর দশা অনুসারে দিয়েছি।”
মেহরান তার বর্তমান দশা নিয়ে মজা করছে দেখে রেগে যায় রাউশি।রাগে নাকের ডগা লাল হয়ে যায়।মেহরানকে সে ছোট থেকেই ভয় পেতো এবং দেখতে পারতো না কিন্তু এখন যে কার চেহারা দেখে নিজের মাথা খেয়ে এই বদলোকের সাথে কথা বলছে সেটাই বুঝতে পারছে না।মেহরান আড়চোখে রাউশির দিকে তাকায়।মুখে নিকাব লাগানো থাকায় বোঝা যাচ্ছে না রেগে আছে নাকি অন্যকিছু?তাই সে আবারও গাড়ি চালানোতে মন দেয়।এদিকে গাড়িতে তখনও সেই গান বেজেই চলেছে।রাউশির আর সহ্য হচ্ছে না এমন গান।এটা কোনো গান হলো?সে তো শুনতে চেয়েছিলো একটি ডিজে গান।কিন্তু বিরহের গান তো মোটেও শুনতে চায় নি সে।রেগে গিয়ে আবারও মুখ ফুলিয়ে বসে থাকে।তবে সেটা নিকাবের আড়ালেই ঢাকা থাকে।গাড়িটা বাড়ির সামনে এসে থামতেই রাউশি তাড়াহুড়ো করে নেমে যায়। মেহরানও নামে।রাউশি বাড়িতে ঢুকতে নিয়েও আবার ফিরে এসে মেহরানকে বলে,
“ভাইয়া মোটেও বাড়ির কাউকে বলবেন না প্লিজ।”
মেহরান নিরুদ্বেগ কণ্ঠে সামনের দিকে দৃষ্টি রেখে বলে,
“আর যদি বলে দেই।”
নিজের ভয় আর জড়তা পাশ কাটিয়ে নিকাবের আড়ালে মুখ ভেংচে বলে,
“তাহলে আপনি একটা বাদাইম্মা।”
‘কি’ বলতে না বলতেই রাউশি বাড়ির পেছনের দিকে এক দৌঁড় দেয়।এখন তার যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিজের রুমে পৌঁছাতে হবে যে করেই হোক।সকলের নজর পেরিয়ে নিজের রুমে ঢুকতে ভাই বোন সবাইকে দেখে চমকে ওঠে রাউশি।বুকে হাত দিয়ে বলে,
“তোরা এখানে কি করছিস?ভয় পাইয়ে দিয়েছিলি।”
সবাই বিস্মিত কণ্ঠে একসাথেই বলে ওঠে,
“মেহরান ভাইয়ের সাথে কোথায় গিয়েছিলি তুই?”
প্রশ্নটা এমন ভাবে করেছে যেন রাউশি কোনো এলিয়েনের সাথে এসেছে।রাউশি দরজা লাগিয়ে পেছন ফিরে নিকাবটা খুলে জবাব দেয়,
“একটা কাজে গিয়েছিলাম।”
আবারও সবাই একসাথে বলে,
“কি কাজ?”
বিরক্ত হয় রাউশি।এসব প্রশ্নের উত্তর সে কাউকে দিতে রাজি নয়।তাই জবাব না দিয়ে কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ফ্রেশ হওয়ার জন্য ঢোকার আগেই সবগুলো এসে রাউশিকে ঘিরে ধরে।তানিয়া বলে,
“রাউশিপু মেহরান ভাইকে নিয়ে কোথায় গিয়েছিলে বলো না?”
“এমন ভাবে জিজ্ঞাসা করছিস যেন তার সাথে কোথাও যাওয়া মানা।”
পাশ থেকে আবার নাহিন বলে,
“মানা নয় এটা হলো দুঃসাহসিক ব্যাপার।”
রাউশি ভ্রু কুচকে বলে,
“কেন?সে কি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নাকি?”
নাহিনই সে প্রশ্নের উত্তর দেয়,
“বড় মা’র কাছে শুনেছি মেহরান ভাই অনেক রাগী।এই বিষয়ে কিন্তু আমরাও জানি। ছোটবেলায়ও দেখেছি আমি কত রাগী মেহরান ভাই।এইযে আজ সকালে নাকি কোন লোককে বেধরম পিটিয়েছে তানজিম ভাইয়ের থেকে শুনলাম।”
রাউশির রূহ কেঁপে ওঠে সবেগে।যেই কথা বলে এসেছে আজ মেহরানকে সে যদি মেরে মাটিতেই পুতে দেয়?পরক্ষণেই মনে পরে সে তো মেহরান ভাইয়ের বোন তাকে মারতে পারবে না।তবুও মনে মনে ঠিক করে ওই লোকের থেকে দূরে দূরে থাকতে হবে।
.
ডিভোর্সের সমস্ত কাগজপত্র রেডি।রাউশির সেখানে সাক্ষর করতে বিন্দুমাত্র হাত কাঁপেনি।এখন পালা হলো আয়াশের।তাদের বাড়িতে কাগজ পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।রাউশিরা সকলেই রেডি রাজশাহী ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য।প্রিয় শহর রাজশাহী ছাড়তে মন না চাইলেও রাউশিকে চলে যেতে হবে।কারণ এই শহরে থাকলে সে ভালো থাকবে না।যতই দুষ্টুমিতে,আনন্দ করে থাকার চেষ্টা করুক মনের কোণে কোথাও ফাঁকা ফাঁকা ভাব কিন্তু এখনও রয়ে গেছে।প্রিয় বন্ধুবান্ধবদের থেকে ফোনালাপেই বিদায় নিয়েছে।কথা দিয়েছে সময় হলে দেখা করে যাবে রাজশাহী। রাউশি তার মামা রায়হানের জন্য খারাপ লাগছে।তবে তারও কিছু করার নেই।
আর কিছুক্ষণ পর সন্ধ্যা হবে।তপ্ত রোঁদের উষ্ণতা এখন কমে এসেছে।আকাশে সাদা সাদা মেঘগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।দেখতে অদ্ভুত সুন্দর।বারান্দা দিয়ে আজকের আকাশটা কিছুক্ষণ উপভোগ করে রাউশি।মায়ের ডাকে নিচে নেমে আসে।সবাই রেডি হয়ে আছে।সদর দরজার সামনে মেহরানকে উজানের সাথে কথা বলতে দেখেই নাহিনের পেছনে লুকিয়ে পড়ে রাউশি।নিজেকে এখন কিশোরী মনে হচ্ছে তার।অথচ রাউশির বয়স এখন একুশ।আর কয়েকমাস পেরোলে বাইশে পা দেবে।এমন একটা বয়সে এসে এসব বাচ্চামোই মনে হচ্ছে তার।মেহরান চলে যেতেই রাউশি নাহিনের পেছন থেকে সড়ে আসে।সবাই মিলে উদ্যত হয় বাইরে যাওয়ার জন্য।কাজিনরা সবাই এক গাড়িতে উঠবে বলে ঠিক করেছে।তাই সবার পেছনে গাড়িটিতে এক এক করে সকলে উঠে পড়ে।আর বাকি দুইটা গাড়িতে বাড়ির বড়রা।কয়েক ঘণ্টার রাস্তা জমিয়ে আড্ডা দিতে পারবে সবাই।এই মনোষ্কামনা তাদের মুহুর্তেই পরিবর্তন হয় যখন দেখে তাদের গাড়িতে মেহরান ড্রাইভিং এর জন্য উঠেছে।রাউশির পাশে বসা তাজবির রাউশির কানে কানে বলে,
“রাউশিপু আজ আড্ডার বারোটা বাজবে আমাদের।যম আমাদের সাথেই আছে।তাই বেশি আনন্দ উৎফুল্ল করা যাবে না।”
রাউশিও চুপ থাকে সাথে বাকিরাও।মেহরান সবাই উঠেছে কিনা সেটা একবার পেছন ফিরে দেখতেই প্রথমে চোখ যায় রাউশির দিকে।মনে পড়ে রাউশির সকালে বলা কথাটা।রাউশির সাথে মেহরানের চোখাচোখি হতেই রাউশি দ্রুত চোখ সড়িয়ে জানালার বাইরে তাকায়।মেহরান সবার উপস্থিতি বুঝতে পেরে গাড়ি চালানো শুরু করে।গাড়ি আপন গতিতে চক্তে থাকে।জানালার পাশে বসে রাউশি বাইরে তাকিয়ে থাকে।প্রিয় শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছে তাই কান্নাও পায় তার।আধঘণ্টা বাদে রাজশাহীর শেষ প্রান্তে গাড়ি থামিয়ে মেহরান বলে,
” কার কিছু লাগবে নাকি? বা কারোর ওয়াশরুমের প্রয়োজন হলে যেতে পারিস।গাড়ি আর থামবে না পরে।”
সবাই একসাথেই নেমে পড়ে।রাউশিও আস্তে আস্তে নেমে যায়।গাড়ির দরজার সামনে মেহরানকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দ্রুত মাইশার পাশে গিয়ে দাঁড়ায় রাউশি।মাইশা একটি দোকান থেকে কিছু চিপস কিনছে।বাকিরাও নিজেদের পছন্দসই জিনিস কিনছে।হঠাৎ রাউশির পাশ ঘেষে কেউ দাড়াতেই চোখ তুলে পাশে তাকায়।এক প্রাপ্তবয়স্ক লোক তার গা ঘেষে দাড়িয়েছে।ঠোঁটে বিশ্রি হাসিটা দেখেই গা গুলিয়ে ওঠে রাউশি।সড়ে যেতে চাই রাউশি তবে লোকটি আরও পাশ ঘেষতেই এবার রাউশি ক্ষেপে গিয়ে এক চড় দিয়ে বসে লোকটিকে।ধমকে বলে,
“সাহস কি করে হয় আপনার আমার সাথে নোংরামি করার?”
মেহরান দূর থেকে এসব লক্ষ্য করছিলো।লোকটির এরূপ ব্যবহারে তারও মাথা গরম হয়ে যায়।সামনে পা বাড়াতেই রাউশির কর্মকাণ্ডে থেমে যায়।রাউশি আবারও চেচিয়ে বলে,
“তোদের মতো জানোয়ারদের জন্যই নারীরা নিরাপদ নয়। তোকে আজ আমি খুন করবো।”
বলে মাটিতে পড়ে থাকা একটি ছোট অথচ শক্তপক্ত গাছের ডাল দিয়ে মারা শুরু করতেই নাহিন এসে থামায় রাউশিকে।রাউশি হাঁপাতে থাকে।তার আজকের এই ঘটনায় মনে পড়ে গিয়েছিলো ভার্সিটির এক বান্ধবীর কথা।যাকে ধর্ষণ করা হয়েছিলো।এবং মেয়েটা মারাও গিয়েছিলো।তাইতো এখন রণমুর্তি ধারণ করেছে রাউশি।নাহিন রাউশিকে টেনে নিয়ে গাড়িতে বসায়।পরপর সকলেই উঠে পড়ে।তবে মেহরান কিছু কাজ করবে বলে সবাইকে গাড়িতে থাকতে বলে।কিছুক্ষণ পর সেও গাড়িতে এসে বসে একবার রাউশির দিকে তাকিয়ে গাড়ি চালানো শুরু করে।রাউশি স্পষ্ট দেখেছে মেহরানের ঠোঁটের মুগ্ধ করা হাসি।
চলবে…
(ভুল ক্রুটি হলে ক্ষমা করবেন।)