#মেহেরজান
লেখনীতে – #সোহামণি
পর্ব ৩১
খুব ভোরেই সকলে ঘুম থেকে উঠেছে। ব্যাগপত্র রেডি করছে বৃষ্টিরা। রাউশি ভীষণ খুশি। হাসনা বেগম নাশতা বানাচ্ছেন আর সৃষ্টি মাকে সাহায্য করছে আজ। মেহরান বাইরে গিয়েছে। সাথে নুজাইশও আছে। নুজাইশও খুব ভোরেই যোগ দিয়েছে সবার সাথে। নুজাইশ রাউশির দিকে তাকাতে পারে না। কেমন জড়তা কাজ করে তবে ভালোবাসা সেটা যেন আমরণ পর্যন্ত। নুজাইশ মনে মনে হাসে শুধু। নুজাইশের জীবনে তার জানা মৌরিন যেন আজীবন দূরদর্শী হয়ে থাকবে। নুজাইশ ভীষণ খুশি মৌরিন তার জীবনে এসে। হ্যা সে মৌরিনকে পায় নি তাতে কি? জীবনে যা চাইবে সবকিছু যে পাবে এমন কোনো কথা নেই। মৌরিন যেন দূর থেকেই সুন্দর। দূর আকাশের সেই চাঁদের মতো। এখন শুধু ভাবে ভাগ্যিস মৌরিনকে ভালোবাসার কথা জানায় নি সে। নয়তো মেয়েটা তার সাথে কথা বলতে জড়তায় ভুগতো।
মেহরান আর নুজাইশ বাড়িতে ফিরলো। ততক্ষণে সমস্ত নাশতা রেডি। হাসনা বেগম ঘরে সাজাচ্ছেন। মেহরান মুখে পানি দিলো হাত ধুয়ে চলে গেলো। মূলত সকাল সকাল তারা একটি পুলিশ অফিসারের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলো। সকাল সকাল যাওয়ার কারণ হলো ওই পুলিশ অফিসারই কল করেছিলো নুজাইশকে। নুজাইশ মেহরানকে বলে দুজনে পুলিশ অফিসারের সাথে দেখা করতে গেছে। পুলিশ অফিসার জানিয়েছেন পাওনা টাকার জন্য এক মুদি দোকানী মতিন মোড়লকে কুপিয়েছে। মেহরানের হাত মুষ্ঠিবদ্ধ হয়েছিলো কথাটা শুনে। পাওনা টাকার জন্য মানুষ এতটা নিচে নামতে পারে। মেহরান ক্রেডিট কার্ডটা আনে নি সাথে করে। আপাতত নুজাইশের টাকা দিয়েই চলছে। নুজাইশের দিকে তাকালে নুজাইশ চোখ দিয়ে বোঝায় সে টাকাগুলো পরিশোধ করে দেবে।
নুজাইশ হাত ধোয়ার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলো। দূরে ক্ষেতের দিকে তাকিয়ে ছিলো। মৌরিনের কথাই ভাবছিলো। তখনই রাউশি আসলো। নুজাইশের দৃষ্টি অনুসারে দূরে তাকিয়ে বললো,
“স্যার কি ভাবছেন? খেতে চলুন। হাত ধোবেন? দাঁড়ান আমি পানি ঢেলে দিচ্ছি। ”
মৌরিনের কণ্ঠস্বর শুনে নুজাইশ তার মৌরিনের দিকে তাকালো। মুচকি হেসে বললো,
“একজনের কথা ভাবছিলাম। আমার না হওয়া চাঁদের ব্যাপারে।”
শেষের কথাটা খুব আস্তে করে বললো রাউশি শুনলো না।রাউশির কথায় হাত পাতলো ধোয়ার জন্য। আর জিজ্ঞাসা করলো,
“কার কথা ভাবছিলেন স্যার?”
পরে শিক্ষককে কি জিজ্ঞাসা করছে মনে পড়তেই জিহ্ব কেটে বললো,
“আসলে সরি স্যার।”
নুজাইশ কপাল কুঁচকে বললো,
“সম্পর্কে তুমি আমার ভাবী হও। আবার আত্মীয়তার সম্পর্কে তোমার শ্বশুর আমার বাবার দাদীর বোনের নাতি। এদিক থেকেও আমরা সম্পর্কিত। শুধুমাত্র ভার্সিটির হিসেবে স্যার ডেকো না প্লিজ।নিজেকে ভুড়িওয়ালা, মাথামোটা, গোমড়ামুখো লাগে।আর অফকোর্স আমি গোমড়ামুখো, ভুড়িওয়ালা, মাথামোটা নই। আই নো আ’ম অলসো হ্যান্ডসাম।”
বলে শার্টের কলারটা একটু ধরলো। রাউশি ফিক করে হেসে দিলো। নুজাইশ দেখলো সেটা। তার খুব ভালো লাগলো। রাউশি ভাবুক হয়ে বললো,
“তাহলে আপনাকে কি ডাকা যায় স্যার?”
“আবার স্যার?”
“ওহ সরি সরি স্যার।”
“স্যার!”
“ওহ সরি মি. শাহ।”
“মি. শাহ কি?”
“তাহলে নুজাইশ ভাইয়া।”
“এই রাউশি ভাইয়া না প্লিজ।”
রাউশি ভাবলো কি ডাকা যায়।ভেবে বললো,
“মেহরান যেহেতু নাম ধরে ডাকে। তাহলে আমিও নাম ধরেই ডাকবো। হ্যা আপনি আমার থেকে বড় এমনকি আমার শিক্ষক তবে আমার না নামকরণে একটু কষ্ট হয়।”
“আপনার যা ইচ্ছা তাই ডাকুন মিসেস. মেহরান খান।”
রাউশি হেসে উঠলো। নুজাইশও সঙ্গ দিলো। খাওয়া দাওয়া শেষে মেহরান নুজাইশের ফোন নিয়ে তানজিমকে কল করে জানালো তারা কিছুক্ষণ পর রওনা দেবে।সাবধানে যাওয়ার জন্য বললো মেহরান।
মেহরান রাউশির পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলো। সব শুনলো সে। মেহরান পেছনে ফিরে তাকাতেই রাউশিকে দেখলো। রাউশি একটা মিষ্টি হাসি দিলো। তাকে দেখলেই বোঝা যাচ্ছে রাউশি আজ কি পরিমাণ খুশি। মেহরান রাউশির মাথায় একটা হাত রেখে বললো,
“খুব খুশি আজকে।”
“আপনাকে আমি বিশ্বাস করাতে পারবো না যে আমি অনেক খুশি।তবে মতিন আঙ্কেলের জন্য অনেক খারাপ লাগছে।উনি থাকলে উনিও যেতে পারতেন আমাদের সাথে। কতই না ভালো হতো বলুন।”
মেহরানও দীর্ঘশ্বাস ফেললো।রাউশি পুনরায় বললো,
“শুনুন না।”
মেহরান দুষ্টুমির সুরে বললো,
“বলো না।”
রাউশি মেহরানের এমন কথা শুনে হেসে ফেললো।বললো,
“বৃষ্টি আমার সাথে বসে যাবে। দেখুন আমি এতদিন পর একজন মনমতো বান্ধবী পেয়েছি। ওর কষ্টের কথা আমি জানি। আর ওর অতীতও আমার মতোই।”
বলে ম্লান হাসলো রাউশি।তারপর আবারও বললো,
“আচ্ছা আমরা বৃষ্টিকে আবার বিয়ে দেব।”
মেহরান ভ্রু কুঁচকালো।মাথায় আসলো নুজাইশের কথা।তবে সেটা মেহরান নিজেই করতে দেবে না।কারণ ছেলেটা বিয়ে থেকে বাঁচতেই তাদের সাথে এসেছে।কিন্তু রাউশি বৃষ্টির বিয়ে নিয়ে ভাবছে কেন?আর এত তাড়াতাড়ি।রাউশি আবারও বলল,
“আমরা ওর জন্য যোগ্য পাত্র খুঁজবো ঢাকা গেলে। কি বলেন? ও আগে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করুক তারপর।”
বলেই চমৎকার হাসলো রাউশি।তারপর আবারও বলল,
“ওদের থাকার ব্যবস্থা কিন্তু সব আপনি করে দেবেন।”
মেহরান রাউশির কোমল হাত দুইটা ধরে বলল,
“আমিই করে দেব।এখন শোন একটা কথা।”
রাউশি চোখ দিয়ে বোঝালো ‘কি কথা?’
মেহরান টুপ করে রাউশির গালে একটা চুমু দিয়ে বলল,
“এই কথা।”
রাউশি আশেপাশে একবার তাকালো।এটা বাড়ির পেছনের দিক।তাই কেউ দেখার কথা নয়।তাই নিজেই পা উঁচিয়ে মেহরানের ঠোঁটে হালকা করে ছোট্ট চুমু দিয়ে একমুহুর্তও আর সেখানে না দাঁড়িয়ে চলে গেলো।মেহরান নিম্নের ঠোঁট কামড়ে হাসলো শুধু।
.
বৃষ্টি আর নুজাইশ ঝগড়া করছে।বৃষ্টি উঠোন ঝাড়ু দিচ্ছিলো। নুজাইশ বাশের পাশে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে ছিলো।হাজার বার সড়তে বললেও যখন সড়লো না।রেগেমেগে চেঁচালে নুজাইশ তাকে ডাইনি বললে বৃষ্টি ভীষণ রেগে যায়।নুজাইশও কম না। তবে তাদের এই ঝগড়ার মাঝেই আবার আগমন ঘটে সাঈদের।সাঈদকে এখানে দেখে ভীষণ চমকে গেলো।এই ছেলে এখানে কি করছে? আর জানলোই বা কি করে?
“শুধু তুই আর মেহরান তো প্রকৃতি উপভোগ করতে পারিস না।তাই আমরাও চলে আসলাম।”
‘আমরা’ শব্দটা শুনতেই নুজাইশ ভ্রু কুঁচকালো। সাঈদের পেছনে দেখা গেলো তুষার আর এহসানও আছে। তুষার নুজাইশের কাছে এগিয়ে এসে বললো,
“শালা গে হয়ে গেলি নাকি? এভাবে ঝগড়া করছিস কেন?”
নুজাইশ ভ্রুদ্বয়ের মাঝে ভাঁজ ফেলে এদের দিকে তাকিয়ে আছে। এরা দলবল নিয়ে এখানে কি করতে এসেছে?রাউশি তাড়াহুড়ো করে বাড়ির সামনে আসতেই সাঈদদের দেখতে পেলো।সাঈদদের না চিনলেও এদের সেদিন নুজাইশের বোনের বিয়ের অনুষ্ঠানে দেখেছিলো।তবে এরা এখানে এই সময়ে কি করছে বুঝতে পারলো না রাউশি নিজেও।মেহরান এসে রাউশির পাশে দাঁড়ালো।রাউশি মেহরানকে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এহসান রসিকতা করে মেহরানকে বলল,
“আমাদের চোখে পড়ে না তোদের? এতো ঘেষাঘেষি করিস কেন? সবেই তো বিয়ে হলো।”
মেহরান সেসবে কান না দিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল,
“গাড়ি রেডি আছে?”
সাঈদ বলল,
“গ্রামের রাস্তা ভালো না।গাড়িটা পুলিশ স্টেশনের সামনে রেখে এসেছি।গ্রামের মানুষজন যা গাড়িটা চাবি ছাড়াই ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে যাবে।আসার সময়ও কিভাবে যেন তাকিয়ে ছিলো।”
মেহরান শুনেছে গ্রামের লোকেরা আজকে বৃষ্টিদের বাড়িতে এসে বিভিন্ন ঝামেলা করতে পারে।সাঈদরা সিলেট এসেছিলো একটা কাজে।মেহরান তাদের ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার জন্য বললে সাঈদরা সঙ্গে সঙ্গেই এসেছে।মেহরান বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বলল,
“বৃষ্টি আপত্তি না থাকলে আমি চাইছি এখনই চলে যেতে।নাহলে অনেক ঝামেলার মুখোমুখি হতে হবে।”
বৃষ্টি কি বলবে ভেবে পেলো না।এখনই চলে যাওয়া! তবে না করলো না।মাথা নাড়ালো। মেহরান এগিয়ে গিয়ে বলল,
“ভয় পেয়ো না।আমাদের ওপর ভরসা রাখো। তোমার ভবিষ্যত তুমি নিজেই ঠিক করবে।আমরা শুধু সহায়তা করবো।”
বৃষ্টি মাথা নাড়ালো।মেহরান পেছনে ফিরে রাউশিকে বলল,
“রেডি হয়ে নে।”
মেহরান রাউশি, বৃষ্টি,হাসনা বেগম আর সৃষ্টির জন্য বাজার থেকে জামাকাপড় কিনে এনেছে গতকাল বিকেলে।
সবাই রেডি হয়ে গ্রামের মেঠোপথ দিয়ে রওনা দিলো।গ্রামের লোকেরা কেমন চোখে তাকিয়ে ছিলো।তবে আসার সময় কোনো ঝামেলা হয় নি।কারণ সেইসময়ে গ্রামের মানুষজন কম ছিল।সবাই যে যার ঘরে ছিলো।শুধু কিছুজন বাদে।পুলিশ স্টেশনের সামনে আসার পর সাঈদরা গাড়িতে উঠে বসলো। সবাই উঠে বসলো। হাসনা বেগম কেমন মুখ শুকনো করে রেখেছেন।স্বামীর কবরের পাশে গিয়ে কিছুক্ষণ বসে ছিলেন আসার আগে।বৃষ্টি, সৃষ্টিও ছিলো।তাদের চোখ দেখলেই বোঝা যায় মানুষগুলো কান্না করেছে।বুক ভার করে নিজগৃহ ছেড়ে যেতে হচ্ছে।তবে নিজেদের ভবিষ্যতের জন্য হলেও তো ছাড়তে হবে বাড়ি।বৃষ্টি রাউশির প্রতি চিরকৃতজ্ঞ থাকবে।
মাইক্রো বাসটাই বারোজনের বসার সিট হওয়ায় খুব সবাই যার যার মতো করে বসেছে। সাঈদ গাড়ি ড্রাইভিং করবে। নুজাইশ, এহসান, তুষার মিলে অহেতুক কথাবার্তা বলছে।বৃষ্টি আর রাউশি দুজনে একসাথে বসেছে।সৃষ্টি বসে রয়েছে হাসনা বেগমের পাশে। আর হাসনা বেগম চোখ বুজে বসে রয়েছেন।
এদিকে মেহরান সবার পেছনে কেমন চিন্তিত মুখে বসে আছে।কোনো বিষয় নিয়ে মেহরান আজ খুব চিন্তিত।মেহরানের চোখেমুখে গাঢ় চিন্তার ছাপ। তবে ঠিক কি বিষয় নিয়ে চিন্তির মেহরান সেটা কেউই জানে না।
চলবে….
#মেহেরজান
লেখনীতে- #সোহামণি
পর্ব ৩২
মধ্যরাতে বাড়িতে পৌঁছালো মেহরানরা। বাড়ির সবাই সেই দুপুরেই এসে পৌঁছেছে। উর্মিলা বেগম আর রূপা বেগম ছেলেমেয়েদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন সেই বিকেল থেকে। যখন এসে পৌঁছালো তখন মেয়েকে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দেন রূপা বেগম। মেয়ে সুস্থ আছে দেখে আল্লাহর কাছে হাজারও শুকরিয়া আদায় করতে ভুলেন না।
এদিকে হাসনা বেগম, বৃষ্টি আর সৃষ্টি এতবড় বাড়ি দেখে ভীষণ হতবাক। হাসনা বেগমের কিছুটা সন্দেহ ছিলো মেহরানদের নিয়ে তবে এখন যেন আসলেই বুঝতে পারলেন এরা বড়লোক সব মানুষজন। হাসনা বেগম কেমন যেন লজ্জা পেতে লাগলেন যখন বাড়ির দুই কর্ত্রীকে দেখলেন। উনাদের আভিজাত্যপূর্ণ দেখে নিজেকে ভীষণ তুচ্ছ মনে হলো। বৃষ্টি নিজেকে দৃঢ় রাখলেও লজ্জা হচ্ছিলো তবে রাউশি যখন তার হাত ধরে উর্মিলা বেগম আর রূপা বেগমকে পরিচয় করিয়ে দিলো নিজের বান্ধবী আর আশ্রয়দাতা হিসেবে তখন বৃষ্টি ভীষণ খুশি হয়েছিলো।
মেহরান আসার সময়ই বাবা আর মাকে সবকিছু খুলে বলেছেন বৃষ্টিদের ব্যাপারে। উর্মিলা বেগম আর রূপা বেগম সাদরে গ্রহণ করেছেন উনাদের। এতে করে হাসনা বেগমও কিছুটা স্বস্তি পান।উর্মিলা বেগম ছেলেমেয়েদের জন্য গরম গরম রান্না করে রেখেছেন। নিশ্চয় সবার খিদে লেগেছে।তবে কেউই আর খেলো না।ঘুমানোর জন্য সবাই চলে গেলো নিজ নিজ রুমে।উর্মিলা বেগম বৃষ্টিদেরকে রুম দেখিয়ে দিয়েছেন।সবাই যার যার রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেও রাউশি যখন নিজের রুমের দিকে যাচ্ছিলো মেহরান পথ রোধ করে দাঁড়ায়।আর হাত ধরে টেনে নিজের রুমে নিয়ে যায়।
রাউশিকে নিজের রুমে এনে দরজা লাগিয়ে দিয়ে খাটের সামনে গিয়ে শার্ট খুলতে থাকে মেহরান। এটা দেখে রাউশি ভীষণ হতবম্ভ হয়ে যায়।চোখে হাত দিয়ে মাথা দুদিকে বার বার নাড়িয়ে বলল,
“এসব কি করছেন কি আপনি?”
মেহরান কপাল কুঁচকে চোখে মুখে হাত দিয়ে থাকা রাউশির দিকে তাকালো,
“শার্ট খুলছি।আর কি করবো? আর এভাবে চোখেমুখে হাত দিয়ে আছিস কেন?”
“আপনি শার্ট খুলছেনই বা কেন?”
“আমি কি ফ্রেশ হবো না?”
রাউশি তব্দা খেয়ে গেলো।মেহরানের দিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়ালো। মেহরান কাভার্ড থেকে একটি টি-শার্ট বের করে ওয়াশরুমে ঢুকতে যাওয়ার আগে রাউশিকে বলল,
“রুম থেকে বের হবি না। নয়তো ভালো হবে না।”
“কিন্তু আমি_”
বাকি কথাটা বলার আগে মনে পড়লো মেহরান আর রাউশি এখন স্বামী স্ত্রী।এখন তাদের একসাথেই থাকতে হবে।তাই আপত্তি করলো না মেহরানের খাটের ওপর গিয়ে বসলো। মেহরান বের হলে নিজেও ফ্রেশ হয়ে নিবে।তবে এর জন্য দরকার জামা কাপড়।তাই নিজের রুমে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে মেহরান ওয়াশরুম থেকে মাথা বের করে বলল,
“তুই চাইলে আমার সাথে এসে শাওয়ার নিতে পারিস।”
রাউশি চোখ বড় বড় করে তাকালো।মেহরানের ঠোঁটে দুষ্টু হাসির রেখা দেখে লজ্জা পেয়ে অসভ্য বলে মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিলো।মেহরান ঠোঁট কামড়ে হেসে ওয়াশরুমের দরজা লাগিয়ে দিলো।এই সুযোগে রাউশি নিজের রুম থেকে প্রয়োজনীয় জামাকাপড় নিয়ে এলো। মেহরান আধঘণ্টা শাওয়ার নিয়ে বেরোলো ট্রাউজার, টিশার্ট পড়ে। রাউশি মেহরানের দিকে তাকালো।ভেজা চুলগুলো টাওয়াল দিয়ে মুছছে মেহরান।রাউশি ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকলো।মনে মনে বললো এই মানুষটাকে আজ ভীষণ সুন্দর লাগছে।
মেহরান রাউশিকে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল,
“আজ সারারাত আমার দিকেই তাকিয়ে থাকিস।এখন যা ফ্রেশ হয়ে নে।”
রাউশি চোখ নামিয়ে নিলো।জামা কাপড় হাতে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো। রাউশিও আধঘণ্টার মতো শাওয়ার নিয়ে বের হলো।মেহরান ল্যাপটপের সামনে বসে রয়েছে।কাজ করছে।তবে রাউশি বের হতেই তার দিকে তাকালো।রাউশিকে ভেজা চুলে এমনিতেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শাসালো,
“ঠান্ডার মাঝে এভাবে ভেজা চুলে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?ঠান্ডা লাগানোর জন্য?”
রাউশির ভেজা চুল হতে টপটপ পানি পড়ছে। মেহরান টাওয়াল নিয়ে তার দিকে এগিয়ে আসলো। আর রাউশি মিষ্টি করে হেসে বলল,
“ঠান্ডা লাগুক, তাতে কি?অসুস্থতার বাহানায় আপনার থেকে সহস্র সেবা পায় আমি।এই সেবা পাওয়ার জন্য হলেও বার বার অসুস্থ হতে চাই আমি।”
মেহরান রাউশির দিকে এগিয়ে এসে মাথা মুছে দিতে থাকে। কেমন অন্যমনস্ক হয়ে বলে,
“যদি আমি না থাকি তখন?”
রাউশির বক্ষস্থল কেঁপে উঠলো।তবে নিজেকে শান্ত রাখলো।শান্তভাবেই জবাবে বলল,
“এমনটা কখনোই হবে না।আপনি আর আমি অনেকদিন একসাথে বেঁচে থাকবো।আর আপনি আমার সেবা করে যাবেন। আর ভুলেও না থাকার কথা মুখে আনবেন না প্লিজ।”
মেহরান হাসলো।রাউশির চুল ভালোভাবে মুছে দেওয়া শুরু করলো।রাউশি মেহরানের দিকে তাকিয়ে আছে।মেহরানের মুখটা কেমন যেন চিন্তিত লাগছে।এখন যদি কিছু জিজ্ঞাসা করে মেহরান তাকে কিছুই বলবে না। তাই রাউশিও খুব একটা ঘাটলো না। শুধু ভাবতে লাগলো মানুষটার মন কিভাবে ভালো করা যায়?
রাউশিকে ভাবুক দেখে মেহরান বলল,
“কি ভাবছিস?”
“আপনার কি মন খারাপ?”
“এমন কিছুই নয়।”
“আচ্ছা তাহলে চলুন ঘুমিয়ে পড়ি।”
মেহরান ভ্রু কুঁচকালো।এক হাতে রাউশির কোমড় জড়িয়ে ধরে বলল,
“ঘুমাবি?”
“হু।”
মেহরানের এমন জড়িয়ে ধরাতে রাউশির শরীর ক্ষণে ক্ষণে কাঁপছে মনে হলো। মেহরান রাউশির কানের কাছে পড়ে থাকা চুলগুলো কানের পেছনে গুজে দিয়ে রাউশির মুখের দিকে ঝুকে কপালে গাঢ় চুম্বব এঁকে দিলো।রাউশির কোমল গালে হাত রেখে বলল,
“ভালোবাসি আমার রাউশিকে।ধন্যবাদ তোকে, আমার জীবনে আসার জন্য। আমার বাকি জীবন তোর নামেই লিখে দিলাম রাউশি।”
রাউশি হুট করেই মেহরানের গলা জড়িয়ে ধরলো।মেহরানের গালে একটা কিস দিয়ে বলল,
“আপনাকেও ধন্যবাদ মেহরান সাহেব। আমার জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায় এতো মধুময় করার জন্য।”
মেহরান রাউশির নাকে নাক ঘষে।রাউশির নিশ্বাস ভারি হয়।দুজনেই দুজনের নিশ্বাসের গতি মাপতে থাকে।আর ভাবতে থাকে ভবিষ্যৎ নিয়ে।
.
খুব সকালে উজান বাড়ি থেকে বেরিয়ে কোথায় যেন চলে গিয়েছে।বাবা মা কেউই তার সাথে কথা বলছে না।সেও কথা বলার সাহস করে নি।মেজো চাচা আর মেজো চাচীকে দেখলেও কেমন যেন লজ্জা লাগে। তবে মাহমুদ খান উজানকে কখনও দোষারপ করেন না।কিন্তু উজান বুঝে নিজেকে। তার জন্যই রাউশি এত বড় বিপদে পড়েছিলো।চিন্তা একটাই মেয়েটা কি আদও তার সাথে কথা বলবে? নাকি ফিরেও তাকাবে না?
উজানকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় রূপা বেগম দেখলেন।বড় জা-কে অনুনয় করে বললেন,
“ছেলেটার চোখমুখ কেমন শুকিয়ে গেছে আপা।তুমি আর কতদিন ছেলেটার সাথে কথা না বলে থাকবা? ভাইজান নাহয় রেগে আছেন কিন্তু আপনি? ছেলেটা আমাদের সাথেও মেপে মেপে কথা বলছে লজ্জায়। ওর কোনো দোষ নেই আপা।তুমি ওর সাথে একটিবার কথা বলো।”
উর্মিলা বেগম প্রত্যুত্তরে বললেন,
“থাকুক ও ওর মতো।ওর ব্যাপারে আর একটাও কথা বলিস না আমায়।রুটি গুলো ভেজে ফেল তুই। বাসায় মেহমান আছে।”
রূপা বেগম মুখ গোমড়া করে চুপ হয়ে গেলেন। তাজবিরকে কোলে করে রোকসানা বেগম আসলেন।রাত থেকে তাজবিরের জ্বর উঠেছে।এখনও তাপমাত্রা কমে নি ছেলেটার। রাতে একজন ড. এসে দেখে গেছে তাজবিরকে। কিছু ঔষধ দিয়েও গেছে।তবে তা দিয়েও যেন কোনো কাজ হয় নি।তাজবিরকে এ অবস্থায় দেখে উর্মিলা বেগম গালে হাত দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,
“শরীরটা কেমন লাগছে বাবা?”
তাজবির ছোট করে উত্তর করলো,
“ভালো বড় মা।”
ছেলেটা কেমন নেতিয়ে গেছে একরাতেই। জ্বর কিছুতেই কমছে না তাজবিরের। রূপা বেগম এগিয়ে এসে তাজবিরের মাথায় হাত দিয়ে বললেন,
“ছেলেটাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলেই তো হয় রে ছোট।”
“আর বলো না মেজো আপা।ওর বাবাকে বললাম শুনলোই না।”
উর্মিলা বেগম বললেন,
“সে কি কথা? ওকে আজকেই হাসপাতালে নিয়ে যাও।এত জ্বর শরীরে।এখনও কমছে না।কিছু খাইয়ে হাসপাতালে নিয়ে যা। তানজিমকে সাথে নিয়ে যা।”
রোকসানা বেগমও ছেলের দিকে তাকিয়ে কথা মানলেন।একবার জিজ্ঞাসা করলেন,
“মেহরানরা এসেছে?”
“হ্যা রাতেই এসেছে।”
রোকসানা বেগম ছেলেকে খাওয়াতে চাইলেন তবে তাজবির কিছুই খেলো না।
সকাল নয়টার দিকে সবাই ঘুম থেকে উঠলো।তানজিম আরও আগে উঠেছে। মায়ের সাথে ভাইকে নিয়ে হাসপাতালে গেছে তারা।এদিকে এসব ব্যাপারে না জানা রাউশি আর মেহরান নিচে নেমে আসতেই বড়দের দেখে রাউশির কেমন লজ্জা লাগলো যখন মনে পড়লো মাহতাব খান এখন তার শ্বশুর। অথচ রাতে উর্মিলা বেগমকে দেখে কথাটা মনে পড়ে নি।কিন্তু এখন কেমন যেন কথাটা মনে পড়ে লজ্জা লাগছে।
মাহবুব খান মেহরান রাউশিকে একসাথে নামতে দেখে প্রশান্তির হাসি হাসলেন। তারা এগিয়ে আসতেই মাহবুব খান রসিকতা করে বললেন,
“বৌমা, আসার সময় কোনো অসুবিধা হয় নি তো?”
রাউশি ভীষণ লজ্জা পেলো। মাহমুদ খান, মাহতাব খান হেসে উঠলেন।মাহতাব খান বড় ভাইকে বললেন,
“আহা ভাইজান মেয়েটাকে লজ্জা দিচ্ছো যে?”
“আমি আমার বড় বৌমার সাথে কথা বলছি ছোট।লজ্জার কিছু নেই।”
বলে হাসলেন তিনি।সিড়ি বেয়ে নিচে নামলো বৃষ্টিরাও।বৃষ্টি আর তার পরিবারকে দেখে সবাই তাদের দিকে তাকালো।মাহবুব খান সৌজন্য হেসে হাসনা বেগমকে বললেন,
“আসুন আসুন।আপনাদের আসার সময় কোনো সমস্যা হয় নি তো?”
“না ভাইজান, আইতে কুনো সমস্যা হয় নাই।”
মাহবুব খান সামনের ফাঁকা চেয়ারগুলো দেখিয়ে বললেন,
“বসুন, বসুন।আপনাদের জন্যই অপেক্ষা করছিলাম সবাই।”
সবাই সকালের নাশতা খেতে বসলো। সকালের প্রহরটা ভালোভাবেই কেটে গেলো। রাউশি আর মেহরান বারান্দায় বসে কফি খাচ্ছিলো বিকেলের টাইমে।তবে মেহরানের কি যেন একটা ইমারজেন্সি কল আসাতে মেহরান ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়ে।তারপর রাউশিকে রাতে ফিরতে দেরি হবে বলে সেভাবেই চলে গেলো।মেহরানের এহেন কাজে আর চিন্তিত মুখশ্রী দেখে রাউশি নিজেও চিন্তিত হলো।
চলবে…..
(ভুলক্রুটি হলে ক্ষমা করবেন।)