#মেহেরজান
লেখনীতে- #সোহামণি
পর্ব ৩৫
আজ দুপুরের রোদটা ভীষণ মিষ্টি। গাড়ির জানালার কাঁচ ভেদ করে মেহরানের হাতে এসে পড়ছে সেই রোদ। মেহরান এসব উপেক্ষা করে প্রিয়তমার কাছে ছুটে চলেছে। মস্তিষ্ক জুড়ে শুধুমাত্র একটাই বচন রাউশি যেন ঠিক থাকে। তাকে রাউশির নিকট এই মুহুর্তেই অদৃশ্য কোনো শক্তিলয়ে পৌঁছাতে। তবে সেটা কি আর সম্ভব। মেহরান গাড়ি চালাচ্ছে অথচ হাত অবিরত কাঁপছে। সকালে মেয়েটা কল করেছিলো অথচ মেহরান রিসিভ করে নি। মেহরানের বুক পুঁড়ছে। রাউশি নিশ্চয় অনেক্ষণ যাবৎ অপেক্ষা করেছিলো মেহরানের কলের আশায়। হতাশার দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো মেহরান। হুট করেই আবার ভয়ানক রকমের কাশি উঠে গেলো তার। গাড়িটা সামনে গিয়ে থামালো। আর কাশা শুরু করলো। গাড়ির পাশ দিয়ে মানুষজন হেঁটে যাওয়ার সময় আড়চোখে দেখছে তো কিছুজন উঁকি মেরেও দেখছে কার এতো ভয়ানক কাশি উঠেছে। মেহরান নিজেকে থামানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছে বারবার। আবারও রক্ত বের হলো। এবার নাক দিয়েও রক্ত বের হলো। সামনে থাকা টিস্যু থেকে কয়েকটা টিস্যু নিয়ে নাক মুখ মুছলো মেহরান। কাশি থামছে না। শ্বাস নিতেও এখন সমস্যা হচ্ছে। গাড়ির জানালা খুলে দিলো। ঠান্ডা হাওয়া এসে চোখেমুখে লাগলো। তবে কাশির বেগ কমলো না। শ্বাস নিতে পারছে না মেহরান।
নুজাইশ গাড়ি নিয়ে সেই রাস্তা দিয়েই যাচ্ছিলো। হঠাৎ অপোজিট সাইডে চোখে যেতেই দেখলো মেহরানের কালো গাড়িটা। তবে সে শিওর নয় ওটা মেহরানের গাড়ি কিনা? যখন দেখলো ড্রাইভিং সিটের মানুষজন কেমন যেন করছে তখন গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে গেলো সেদিকে। গাড়ির কাছে আসতেই ভয়ানক কাশির আওয়াজ শুনে ধারনা করে মেহরান হবে। একদম গাড়ির জানালার কাছে গিয়ে যখন দেখে মেহরান কাশছে। চোখমুখ লাল হয়ে গেছে তখন হতবম্ভ হয়ে মেহরানকে ডাকলো নুজাইশ।
“এই মেহরান!”
পরিচিত মানুষের কণ্ঠস্বর শুনে কাশতে কাশতেই পাশে ফিরে তাকালো মেহরান। নুজাইশকে দেখে ভরসা পেলো কিছুটা। বলার চেষ্টা করলো,
“মেডিকেল হাসপাতালে চল।”
নুজাইশ না বুঝে মেহরানকে ধরলো। জিজ্ঞাসা করলো,
“কষ্ট হচ্ছে? দাড়া তুই কষ্ট করে নাম গাড়ি থেকে আমি গাড়ি চালাচ্ছি। নাম।”
মেহরান খুব কষ্টে নামলো নুজাইশকে ধরে। নুজাইশ মেহরানকে ধরে পাশের সিটে বসালো। ওর গাড়িটা একবার তাকালো। আশেপাশের লোকেশন দেখে ফোন বের করে কাউকে কল করলো। ওপাশ হতে রিসিভ হতেই উমুক জায়গা থেকে তার গাড়ি রিসিভ করতে বললো। নুজাইশ ড্রাইভিং সিটে এসে বসলো। পানি খেয়ে মেহরান তখন কিছুটা থেমেছে। সিটে হেলান দিয়ে বসে আছে। নুজাইশ গাড়ি চালাতে চালাতেই উদ্বীগ্ন কণ্ঠে বলল,
“তোর আগামীকালই আমেরিকা চলে যাওয়া উচিত চিকিৎসার জন্য। নয়তো এই রোগ ভয়াবহ স্টেজে চলে যাবে ভাই। বোঝার চেষ্টা কর।”
মেহরান চোখ বুজে থাকা অবস্থায় বিড়বিড় করে আওড়াল,
“তাড়াতাড়ি গাড়ি চালা। আমার রাউশির এক্সিডেন্ট হয়েছে।”
বিড়বিড় করে বললেও নুজাইশ ঠিকই শুনতে পেলো। আর হতবম্ভ হয়ে গেলো। বিনা মেঘে যেন বজ্রপাত পড়লো মাথায়। একপ্রকার চেঁচিয়ে বলল,
“কি?”
মেহরান হতে কোনো উত্তর এলো না। নুজাইশ আবারও চিন্তিত আওয়াজে কাঁপা গলায় জিজ্ঞাসা করল,
“মৌরিন এক্সিডেন্ট করেছে মানে কি মেহরান? সত্যিই বলছিস?”
মেহরান উত্তর করলো না। নুজাইশ পাশ ফিরে দেখলো মেহরান এভাবেই পড়ে রয়েছে। নুজাইশ ভয় পেয়ে গেলো। গআড়ি সাইডে থামিয়ে মেহরানকে ধরে একটা হাত মেহরানের গালে ধরে ঝাকিয়ে বলল,
“এই মেহরান! এই মেহরান!”
মেহরান উত্তর করলো না। নুজাইশ পার্লস চেক করলো। শ্বাসক্রিয়াও চলছে। অজ্ঞান হয়েছে ছেলেটা। নুজাইশ ঘামছে। প্রচন্ড রকমের ঘামছে সে। চোখমুখ কালো হয়ে গেছে নিজেরও। মেহরানের মুখটাও ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। নুজাইশ মাথার চুলে হাত দিলো। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে তাড়াতাড়ি হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা হলো। এই মুহুর্তে রাউশিকে যে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে সেখানে যাওয়া যাবে না। সাঈদের হাসপাতালে যেতে হবে। নুজাইশ গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দিলো। নিজের পাগলের মতো লাগছে তার নিজেরও। একদিকে রাউশির এক্সিডেন্টের খবর তো অন্যদিকে প্রানপ্রিয় বন্ধুর এই ভয়ানক অসুস্থতা। এ কেমন ভয়ানক পরিস্থিতি?
.
রাউশির জ্ঞান ফিরলো আঠারো ঘণ্টা পর। পায়ের অসহ্য রকমের যন্ত্রণায় দাতে দাত চেপে সহ্য করে নিলো। নিভু নিভু চোখ দুটো প্রথমেই খুঁজলো প্রিয় মানুষটাকে। অনুভবের চেষ্টা চালালো তার অনুভুতি। পাশে তার বাবা তার হাত ধরে বসে বসে ঘুমোচ্ছেন কোনোভাবে। আর অন্যপাশে তার মা একটি চেয়ারে বসে দেয়ালে হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছেন। রাউশি এপাশ ওপাশ খুঁজে চললো মেহরানকে। তবে দেখা পেল না মানুষটার। সদ্য জাগ্রত হওয়া মস্তিষ্ক প্রশ্ন করলো ‘মানুষটা কি তার এই অবস্থা সম্পর্কে জানে?’
বেশি ভাবতে পারলো না। মাথা ঘুরছে প্রচণ্ড রকমে। শরীরে এক বিন্দু পরিমাণও শক্তি নেই তার। সমস্ত শক্তি যেন অপচয় হয়ে গেছে। রাউশি ওঠার চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হলো। চোখের কোণ বেয়ে দুফোটা নোনাজল গড়িয়ে পড়লো। মেহরান কোথায়? বাবা মা-র পরে সে মানুষটার মুখ দেখলেও যন্ত্রণা কিছুখানি হয়তো কমতো।
এদিকে মাহমুদ খানের হাত নড়তেই চোখ খুলে তাকাতেই রাউশিকে জাগ্রত দেখলেন।স্ত্রীকে ডাকলেন,
“রূপা, রাউশি মার জ্ঞান ফিরেছে। তাড়াতাড়ি এসো।”
রূপা বেগমও ধরফরিয়ে উঠলেন। মেয়ের কাছে এসে মেয়ের মুখে গালে হাত দিয়ে কাঁদো কাঁদো স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন,
“এখন কেমন আছিস মা?”
রাউশি বিড়বিড় করে আওড়ালো,
“মোটামুটি।”
মাহমুদ খান রাউশির হাতটা ধরে বললেন,
“মা’রে কষ্ট হচ্ছে রে খুব?”
রাউশি মাথা নাড়ালো। বোঝালো কষ্ট হচ্ছে। ডান চোখের কোণ বেয়ে আবারও জল বেরোলো। মাহমুদ খান মেয়ের চোখে জল দেখে তা মুছে দিলেন। রাউশি ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় জিজ্ঞাসা করার চেষ্টা করলো,
“মেহরান কো_”
বাকি কথাটা বলতে পারলো না। গলা ধরে এলো তার। হাতটা কাঁপছে। কাঁপছে বুক। তার কেন যেন মনে হচ্ছে মেহরানও খুব একটা ভালো নেই। মাহমুদ খান রাউশির হাত শক্ত করে ধরে বললেন,
“মেহরান আসে নি রাউশি মা। ওকে ফোন করেছিলাম, তবে ফোন বন্ধ। ছেলেটা কোথায় আছে কেউ জানে না।”
রাউশি কান্নাভেজা গলায় খুব কষ্টে থেমে থেমে বলল,
“উনি কি ভালো আছেন বাবা?”
মাহমুদ খান যেন নিজেও চমকে গেলেন। আসলেই তো সারাটাদিন ছেলেটাকে ফোনে পাওয়া যায় নি। কোনো বিপদ টিপদ হলো না তো। বড় ভাইজান তো বললেন চিন্তা না করতে।
হয়তোবা ব্যস্ত। কিন্তু রাউশির ওপর কি আসলেই মেহরান তার নিজের ব্যস্ততা দেখাতো। মোটেও নয়। তাহলে কি মেহরান বিপদে পড়েছে? মাহমুদ খান মেহরানকে নিয়ে ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। ছেলেটা কোথায় আছে কি করছে কেমন আছে এটা কেউ জানে না।
মেয়ের চিন্তায় চিন্তায় মেহরানের সুস্থতা নিয়ে ভুলেই গিয়েছিলেন তিনি। রূপা বেগমকে রাউশিকে দেখতে বলে বেরিয়ে গেলেন তিনি। বাইরে উজান, তানজিম, নাহিন, তানিয়া বসে বসে ঘুমাচ্ছে। এরা কেউই বাড়িতে যায় নি। রাউশি যতক্ষণ না পর্যন্ত সুস্থ হয় ততক্ষণ পর্যন্ত থাকবে বলেছে। মাহবুব খান দূরের একটি চেয়ারে কপালে হাত দিয়ে বসে আছেন। পাশে উর্মিলা বেগম বসে আছেন।
মাহমুদ খানকে দেখে উর্মিলা বেগম স্বামীর হাত ধরে ঝাকালেন। মাহবুব খান স্ত্রীর ডাকে তাকালেন। স্ত্রীর চোখে ইশারা করে সামনে তাকালেন। মাহমুদকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে তাড়াহুড়ো করে কাছে আসলেন।
রুমে একবার উঁকি দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,
“রাউশি মা কেমন আছে? জ্ঞান ফিরেছে?”
উর্মিলা বেগম কেবিনের ভেতরে ঢুকে গেলেন। মাহমুদ খান বড় ভাইকে আশ্বস্ত করলেন,
“রাউশির জ্ঞান ফিরেছে ভাইজান। মেহরানকে খুঁজছে এখন।”
বুক ভার হয়ে এলো মাহবুব খানের। মাথা নামিয়ে ফ্লোরে তাকালেন। সমস্ত কষ্ট ছাপিয়ে চোখে বেয়ে দুফোটা জল গড়িয়ে পড়লো। কি করে বলবেন তিনি; যে মেহরান নিজেও ভালো নেই। মেহরানের যে থার্ড স্টেজ ফুসফুসে ক্যান্সার। সে নিজেও এখন হাসপাতালে চিকিৎসারত অবস্থায় আছে। ছেলেকে দেখতে যেতে চাইলেও পারেন নি যদি সবাই সন্দেহ করে!
নুজাইশ বিকেলের দিকে মাহবুব খানকে মেহরানের মরনব্যাধির কথা জানিয়েছেন। সেই সাথে এও জানিয়েছে যে মেহরান নাকি পরিবারের কাউকে বলতে নিষেধ করেছে। মাহবুব খান সেখানে যেতে চাইলেও নুজাইশ বারণ করেছে মেহরানের কথায়। ছেলের সাথে একটাবার দেখা করতে চাইলেও পারলেন না। নুজাইশ জানিয়েছে মেহরানকে আমেরিকা নিয়ে যাওয়া হবে। চিকিৎসার জন্য অনেকদিন সময় লাগবে। মাস খানেকও লাগতে পারে। এই রোগের সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা আমেরিকাতেই হয়। এখনও থার্ড স্টেজে আছে। যদি ফোর্থ স্টেজে চলে যায় তবে মৃত্যু নিশ্চিত। সর্বোচ্চ পাঁচ বছর বাঁচবে। তবে মেহরানকে যে অনেক বছর বেঁচে থাকতে হবে তার রাউশির জন্য!
মাহমুদ ভাইকে এমন নিরব দেখে আর মাথা নিচু দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মাহমুদ চিন্তিত স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন,
“ভাইজান, মেহরান কি সুস্থ আছে?”
মাহবুব চোখ তুলে তাকালেন। এমনিতেই রাউশি অসুস্থ। এই সময় যদি বলেন যে মেহরান সুস্থ নেই। ছেলেটা নিজেও মৃত্যুর সাথে বাজি লড়ছে। তবে এই সময় একটা হুলস্থুল কান্ড বয়ে যাবে। ঘুর্ণিঝড় বয়ে যাবে পুরো পরিবারে। মাহবুব খান আল্লাহর দরবারে জানতে চাইলেন। কি এমন পাপ করেছেন সে যে ছেলেমেয়েদের একের পর এক কষ্ট সহ্য করতে হচ্ছে?
মুখ ফুটে কোনোরকম বললেন,
“আসলে ওর একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ পড়ে গেছে রে মাহমুদ। আমেরিকায় যেতে হয়েছে। ফিরতে অনেকদিন লাগবে। এটা তোকে বলতে পারি নি কারণ তোরা যদি মন খারাপ করিস।”
মাহমুদ খান ভাইকে সন্দেহ করলেন,
“মন খারাপ মানে ভাইয়া? এসব কি বলছো? আর সত্যিই কি মেহরান কাজের জন্যই আমেরিকা গিয়েছে? নাকি তুমি আমাদের থেকে কিছু লুকোচ্ছো?”
মাহবুব খান চুপ হয়ে গেলেন। চোখ এদিকে ওদিকে ঘোরাতে লাগলেন। মাহমুদ খান বড় ভাইকে ধরলেন। অন্যপাশে নিয়ে গিয়ে বললেন,
“ভাইজান, আপনি আমার থেকে অন্তত কিছু লুকাবেন না। দয়া করে সমস্ত সত্যিটা বলুন।”
মাহবুব খান মেজো ভাইয়ের হাত ধরে হু হু করে কেঁদে দিলেন,
“মাহমুদ রে, আমার ছেলেটাও ভালো নেই রে। ওর ফুসফুসে ক্যান্সার ধরা পড়েছে।”
মাহমুদ খান ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লেন। মাহবুব খান নিজেও তার পাশে বসলেন। মাহমুদ খান মাথায় হাত দিলেন। এ কি হচ্ছে তাদের পরিবারের সাথে?
হাত পা কাঁপছে অবিরত। প্রেশার বেড়ে যাচ্ছে উনার। উঠে দাঁড়িয়ে যেতে নিলে মাহবুব খান আটকালেন। চোখ রাঙিয়ে বললেন,
“খবরদার। কাউকে জানাবি না এই কথা। তাহলে মনে রাখিস মেহরান ভুলে যাবে তুই কে? এটা মেহরান কাউকে জানাতে নিষেধ করেছে।”
মাহমুদ খান থেমে গেলেন। মাথায় আসলো এমনিতেই রাউশি অসুস্থ। এখন যদি আবার মেহরানের কথা বলা হয় তাহলে অবস্থা বেগতিক হয়ে যাবে।মাহমুদ খান বসে পড়লেন। কাউকে কিছু বললেন না।
.
সময়টা তখন একদম ভোররাতের দিকে। পাঁচটা কি ছয়টা হবে? উর্মিলা বেগম আর রূপা বেগমকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে রাউশির জন্য। উনারাও চলে গেলেন। ছেলেমেয়েদেরও সাথে পাঠিয়ে দিলেন মাহবুব খান। একপ্রকার জোর করেই সবাই চলে গেলো। হাসপাতালে শুধু থেকে গেলেন মাহবুব খান আর মাহমুদ খান।
ঠিক তখনই কালো হুডি গায়ে, মুখে মাক্স, মাথায় ক্যাপ পড়নে এক যুবক আসলো হাসপাতালে। মাহবুব খান যখন দেখলেন বুঝে গেলেন কে এ?
মেহরান সোজা হেঁটে মাহবুব খান মাহমুদ খানের কাছে গেলো। শরীরটা এখন কিছুটা সুস্থ থাকলেও আজই আমেরিকা চলে যাবে। ফ্লাইটের টিকিটও কাটা হয়েছে। মেহরানের সাথে যাবে আলভি, এহসান আর তুষার। এহসান আর আলভি বাইরের দেশে চাকরি পেয়ে গেছে কিছুদিন আগে। আর তুষার মেহরানের সাথ দেওয়ার জন্যই যাবে। মেহরান প্রথমে না করলেও যখন রাউশির কথা বলা হলো মেহরান উপলব্ধি করলো তাদের এখনও সুন্দর একটি সংসার শুরুই হয় নি। তাকে যে রাউশির সাথে অনেকদিন বাঁচতে হবে। নাকোচ করলেও পরবর্তীতে আর না করেনি মেহরান।
তবে খুব ভোরে বাবাকে বলে রাউশির সাথে দেখা করতে আসবে বলে ঠিক করে। মাহবুব খানও রাজি হয়ে যান। তাইতো সবাইকেই পাঠিয়ে দিয়েছেন তিনি। মেহরান তাদের সামনে আসতেই মাহবুব খান কেঁদে ছেলেকে জড়িয়ে ধরলেন।
“বাবা, তুই আজই আমেরিকা চলে যা বাবা। আমরা আর কত কষ্ট সহ্য করবো? একদিকে রাউশি আর অন্যদিকে তুই?”
মেহরান উত্তর করলো,
“আজই চলে যাব। রাউশিকে দেখতে দাও এখন।”
মাহবুব খান ছাড়লেন ছেলেকে। মেহরান মাহমুদ খানের দিকে একবার তাকালেন। মাহমুদের চোখদুটো ভেজা। বোঝা গেল মানুষটা কেঁদেছে।
মেহরান রাউশিকে যে কেবিনে এডমিট করা হয়েছে সেই রুমে ঢুকলো। ফ্যাকাসে মুখে সাদা কাপড় গায়ে জড়িয়ে চাদর গায়ে দিয়ে ঘুমিয়ে আছে রাউশি। মূলত ঘুমের ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে রাউশিকে। মেহরান রাউশির পাশে গিয়ে চেয়ার টেনে বসলো। রাউশির কোমল হাত দুটো ধরলো। রাউশি কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠলো। হয়তোবা তার মন টের পেয়েছে তার মেহরান এসেছে!
মেহরান এক হাতে মাস্ক খুলে নিজের শুষ্ক ঠোঁটজোড়া রাউশির হাতের উল্টোপিঠ ছুয়ে দিলো। এবারও কেঁপে উঠলো রাউশি। মেহরান আরেক হাত দিয়ে রাউশির কপাল হতে গালে স্পর্শ করলো। রাউশির ঠোঁটজোড়া সেসময় কাঁপছে। মেহরান রাউশির কপালে নিজের ঠোঁট ছোয়ালো। কান্না পেলো খুব। চোখের কোণ বেয়ে জল গড়িয়ে রাউশির গালে পড়লো। রাউশি এবারও কাঁপলো কিছুটা। প্রিয় মানুষের ছোয়া হয়তোবা অনুভব করতে পেরেছে। নিজের শুষ্ক ঠোঁটজোড়া রাউশির ঠোঁটজোড়ায় ছুয়ে দিলো মেহরান।
সোজা হয়ে বসে রাউশির হাত নিজের গালে ঘষে বলতে লাগলো,
“রাউ, তোর অনেক কষ্ট হচ্ছে নারে? জানিস আমারও অনেক কষ্ট হচ্ছে। তোর এই অবস্থা দেখে বুকের ভেতর যে কি পরিমাণ আগুন জ্বলছে সেটা কিভাবে দেখায় তোকে বল? ”
গলা ধরে এলো মেহরানের। পুনরায় বললো,
“আমিও অসুস্থ জানিস? তবে চিন্তা নেই। এইযে আমি সুস্থ হওয়ার জন্য এতদূর যাচ্ছি তোকে ছেড়ে। জানিস আমার কি পরিমাণ কষ্ট হচ্ছে জান? আমার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে জানিস? আল্লাহ সব কষ্ট কেন আমাদের দুজনের মাঝেই ঢেলে দিয়েছে রে রাউশি? আমরা তো কারও কোনো ক্ষতি করিনি।”
বলতে বলতে রাউশির হাত ধরে কেঁদে দিলো মেহরান। রাউশি শরীর ঈষৎ কেঁপে উঠলো। মেহরান পুনরায় বলা শুরু করলো,
“আমার ফিরতে দেরি হলেও আমি সুস্থ হয়ে ফিরবো রাউ। তুই আমার জন্য একটু কষ্ট করে অপেক্ষা করিস। জানিনা তুই কিভাবে থাকবি? আর আমিই বা কিভাবে থাকবো? তবে সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য আমাকে সুস্থ হতে হবে তো নাকি? তুই সুস্থাবস্থায় থাকলে আমাকে হয়তো এই কথাটাই বলতি। ”
রাউশির হাতের উল্টোপিঠে গাঢ় চুম্বন আবারও এঁকে দিলো মেহরান।কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বলল,
“বেঁচে থাকলে আমাদের আবারও দেখা হবে একটি সুন্দর শুভক্ষণে। তখন তুইও সুস্থ থাকবি আর আমিও সুস্থসবল থাকবো। তোর কারণেও অন্তত আমি সুস্থ হওয়ার সম্পূর্ণ চেষ্টা করে যাব। আমার মেহেরজানের জন্য। তোর সাথে হাজারও স্বপ্ন বুনন বাকি। সেটা তো বুনতে হবে নাকি? আর যদি_”
থামলো মেহরান।বুক ভরে একটা শ্বাস নিলো।কোনোরকম কাঁপা গলায় বলল,
“আর যদি ওখানেই মারা যায়, আমার মৃত্যু সংবাদ শুনলে তুই মোটেও ভেঙ্গে পড়বি না। মনে রাখবি সবসময় মেহরান তোর আশেপাশেই থাকবে। তোকে ভালোবাসবে। আমি ছিলাম,আছি থাকবো শুধুই তোর একান্ত মেহরান হয়ে। শেষ একটাই কথা বলে যাচ্ছি। খুব ভালোবাসি জান। খুব বেশিই ভালোবাসি।”
আরেকবার রাউশির গালে চোখে মুখে চুমুখেয়ে উঠে দাঁড়ালো মেহরান। চোখ বুজে কষ্টের এক শ্বাস নিয়ে ছোট্ট করে বলল,
“আসি তবে, আমাদের আবারোও দেখা হোক।”
চলবে…..
#মেহেরজান
লেখনীতে- #সোহামণি
পর্ব ৩৬
গ্রীষ্মের তাণ্ডবে বিরক্ত প্রকৃতি। বিরক্ত মানুষও।তবুও কিছুই করার নেই। বিভিন্ন মৌসুমের বিভিন্ন রূপ সহ্য করেই তো যুগ যুগ, হাজার হাজার বছর ধরে এই পৃথিবী চলে আসছে।মানুষজন, পশু-পাখি প্রকৃতি সবারই সয়ে গেছে।
কপাল বেয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়লো রাউশির। হাটা থামিয়ে ব্যাগ থেকে একটা টিস্যু বের করে ঘাম মুছলো। আবারও হাঁটা শুরু করলো ফুটপাত ধরে। পাশে যানবাহনের আনাগোনা তো রয়েছেই। অতিরিক্ত শব্দে মাথা ঘুরছে তার।ব্যাথা করছে বাম পায়ে প্রচুর ব্যথা করছে।গত সাত মাস যাবৎই এই কষ্ট সহ্য করে আসছে রাউশি। তবে মনের কষ্ট এই কষ্টের কাছে একদমই তুচ্ছসই৷ পায়ের অতিরিক্ত ব্যথায় হাঁটতে এতটাই কষ্ট হচ্ছে যে রাউশি এই তপ্ত রৌদ্রেরঝাঁজের নিচে রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়লো।হাপালো কিয়ৎক্ষণ। ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে ধক ধক করে পুরো পানি ভর্তি বোতল শেষ করলো। সামনে চোখ যেতেই দেখলো একটা বটগাছ। জায়গাটায় কিছুটা নিরিবিলি রয়েছে। রাস্তা থেকে বেশি দূরে নয়।
রাউশি সেদিকে হাঁটা ধরলো।কোনোরকম খুঁড়ে খুঁড়ে হেঁটে সে স্থানে পৌঁছে ইটের বানানো বেঞ্চটাতে বসে পড়লো।বাম পায়ের দিকে খেয়াল করতেই দেখলো পা-টা ফুলে রয়েছে সাথে লালও হয়ে গেছে। মৃদু যন্ত্রণায় চোখ বুজলো রাউশি। এই গাছটির নিচে কিছুটা ঠান্ডা বাতাস রয়েছে।সেই বাতাসে শ্বাস নিলো বারকয়েক।মেহরান নামক প্রিয় পুরুষটার কথা মনে পড়লো ভীষণ করে। মানুষটা কি করছে এখন?
আমেরিকা চলে গিয়েছে আজ প্রায় সাড়ে সাত মাস। অথচ রাউশির সাথে একটাবারও কথা বলে নি।এমনকি শুধু রাউশিই নয় পরিবারের কারোর সাথেই কথা বলে নি।কি এমন ব্যস্ততা তার? যে কারোর সাথেই কথা বলতে পারছে না?রাউশি যে এতগুলো দিন কতটা যন্ত্রণায় কাটিয়েছে সেটা কি মেহরান জানে?জানবেই বা কি করে খোঁজ রাখে কি?
রাউশি প্রতিরাতেই কান্না করে মেহরানের জন্য। ফোন করে মেহরানকে তবে মেহরানের নাম্বার বন্ধ থাকে সবসময়। বড় চাচাকে অনেকবার বলেছে মেহরানের সাথে কথা বলতে চায় সে তবে মাহবুব খান সরাসরিই বলেছেন মেহরান তার সাথে কথা বলতে ইচ্ছুক নয়।রাউশির দোষটা কোথায় এটাই জানে না রাউশি।শুধু জানে সে মেহরানের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর, মেহরানের সুদর্শন মুখশ্রী অনেকদিন যাবৎ দেখেনি। আর সে এতটাই যন্ত্রণায় ভুগছে যে প্রতি রাতেই ঘুমের ঔষধ খেতে হয় তাকে।
মেহরানের কথা মনে পড়তেই কান্না পেল রাউশির। এ জীবন জীবন নয়।এ হলো মরণ যন্ত্রণা।মাঝে মাঝে বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাও থাকে না রাউশির।বৃষ্টির সাথে সমস্ত কথা শেয়ার করে।বৃষ্টি তাকে স্বান্তনা দেয়।তবে রাউশির আজও অজানা মেহরানের রাগের কারণ,মেহরানের এতমাস আমেরিকা থাকার কারণ আর মেহরানের তার সাথে কথা না বলার কারণ।আচ্ছা মেহরান কি জানে তার এক্সিডেন্টের কথা? উনি কি জানেন রাউশি ঠিক কতটা কষ্টে আছে?
রাউশি গাছে হেলান দিয়ে বসে থাকলো।চোখ বেয়ে কয়েকফোটা নোনাজল গড়িয়ে পড়লো নিচে।সেমুহুর্তে কাঁধে কারও স্পর্শ পেতেই চোখ তুলে পাশে তাকালো।বৃষ্টিকে দেখে আবারও চোখ বুজে বসে রইলো রাউশি।বৃষ্টি রাউশির পাশে বসলো।শান্ত আওয়াজে জিজ্ঞাসা করল,
“তুমি হঠাৎ এই জায়গায়?বাড়িতে কখন যাবে? আর একা কেন?”
বৃষ্টি মাস তিনেক আগে একটা চাকরি পেয়েছে। একটা ফ্যাশন হাউজে। ভালো বেতন হওয়ায় মা আর বোনকে নিয়ে রাউশিদের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে একটা বিল্ডিং এ একটা ফ্ল্যাটে উঠেছে। মাঝেমধ্যে রাউশিকে দেখার জন্য যায় বৃষ্টি। রাউশি যখন বাড়িতে থাকে না তখন সবাই চিন্তিত থাকে। বৃষ্টি অফিসের ছুটি নিয়েই রাউশিকে সেসময় খুঁজতে বের হয়।আর এই বটগাছের নিচেই খুঁজে পায় বেশিরভাগ সময়। অফিসের বস ভালো হওয়ায় বৃষ্টি এই কাজ করতে পারে।
বৃষ্টির কথা শুনে রাউশি সহজ সরল উত্তর দিলো,
“আমার পুরো জীবনটাই একা।এসেছিলামও একা, মরে যাবও একা।অন্য কাউকে আশা করি না।একজন তো মরুভূমির বুকে এক পশলা বৃষ্টি নামিয়েই উধাও।”
থামলো রাউশি।বৃষ্টির হাত ধরে বলল,
“আচ্ছা বৃষ্টি।মেহরান কি জানেন? আমি ঠিক কতটা তৃষ্ণার্ত?উনার মুখদর্শন হচ্ছে না আজ কতদিন।উনার কণ্ঠ নিঃসৃত কথা শ্রবণ হয় নি কতদিন।উনি কি জানেন আমি ঠিক কি পরিমাণ উনাকে চাই।”
বৃষ্টি হতাশার শ্বাস ফেললো।মেহরানের এমন হুট করে আমেরিকা চলে যাওয়া আর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার ব্যাপারটা সবারই অজানা।বৃষ্টি এতমাস যাবৎ শুধু রাউশিকেই দেখে আসছে।কি নিদারুণ কষ্টে রাউশি এই কয়মাস কাটিয়েছে।রাতে বালিশে মুখ গুজে কান্না করেছে অবিরত।মাঝে মাঝে মেহরানের ছবি দেখে দেখে সারারাতই কান্না করেছে।রাউশির বিষাদময় সেই অশ্রুকণার ছাপ তাদের বাড়ির প্রতিটি কোণায় কোণায় রয়েছে যেন।মেয়েটার এত সুন্দর মুখখানিতে এখন বিষাদে ছেয়ে থাকে।প্রিয় মানুষের জন্য আর্তনাদ করতে করতেই যেন বয়সের ছাপ পড়েছে মুখে।
“বৃষ্টি আমায় পানি খাওয়াও না একটু।”
বৃষ্টির ধ্যান ফিরলো।সাইড ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে রাউশিকে দিলো। রাউশি পানি খেলো।পানি খাওয়া শেষেই হঠাৎ মুখে হাত দিয়ে হু হু করে কেঁদে দিলো।
কান্নাভেজা গলায় অভিমান মিশিয়ে বলল,
“মেহরান কি জানেন? আমি তৃষ্ণার্ত হয়ে পানি খেয়ে আজও শান্তি পায় না? আমি ভালো নেই বৃষ্টি। তীব্র যন্ত্রণায় আমার বক্ষপট হতে ভয়ানক আর্ত চিৎকার ভেসে আসে। সেই চিৎকার এতটাই নির্মম যে আমি ভালো থাকতে পারছি না। কেন উনি এভাবে চলে গেলেন?”
বৃষ্টি রাউশির মাথায় হাত দিয়ে স্বান্তনা দেওয়ার বৃথা চেষ্টা করলো।চোখের অশ্রু ভারী হলো রাউশির।হেঁচকি তুলে কাঁদতে লাগলো।এক সময় থেমে গেলো।বৃষ্টি টিস্যু বাড়িয়ে দিতেই সেটা নিয়ে চোখমুখ মুছে উঠে দাঁড়ালো।বৃষ্টি ধরল রাউশিকে। রাউশি বৃষ্টির সাহায্যে সামনে এগিয়ে গেলো। আর বলতে লাগলো,
“মানুষটা আবারও ফিরে আসুক আমার জীবনে,অন্ধকারের এক উৎস আলো হয়ে। আমি সেই আলো অনুসরণ করে হেঁটে যাব আজীবন।”
বৃষ্টি রাউশিকে দেখলো শুধু।তার কিছু করার নেই।
.
নুজাইশ রাউশি আর বৃষ্টির যাওয়া দেখলো দূর থেকে।গাছের আড়ালো দাঁড়িয়ে ছিলো সে।রাউশির কষ্টে সে নিজেও ব্যথিত।রাউশি সবসময়ই ওই বটগাছটির নিচে এসে বৃষ্টির পাশে বসে কান্না করে। নুজাইশ তা দূর থেকে দেখে।কিন্তু কিছু করতে পারে না।নুজাইশ চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রুজল মুছে নিলো।ফোনের লক খুলে কিছুক্ষণ আগে তোলা রাউশির ছবিগুলো দেখলো। হোয়াটসঅ্যাপে তুষারের নাম্বারে সেন্ড করলো। পাশে দাঁড় করানো গাড়িতে উঠে বসলো। গাড়িটা উলটো ঘুরে চলে গেলো অন্য কোথাও।
এদিকে ওয়াশিংটন ডিসি শহরের,
দশতলা বিল্ডিং এর একটি সপ্তম তলার একটি ফ্লোরে বেডে শায়িত মেহরান।ছয়মাস আগেই তার অপারেশন হয়ে গিয়েছে। মেহরান কোমায় চলে গেছে। সেদিন অতিরিক্ত ধুমপানের কারণে ফুসফুসে ভীষণ চাপ পড়ে। রক্ত জমাট বাঁধে। কিছু কিছু জায়গায় ব্লক হয়ে যায়। লিভারে সমস্যা দেখা দেয়। এমনকি ভালো ভাবে পরীক্ষার পর জানা যায় অতিরিক্ত টেনশন আর এই ফুসফুসের ক্যান্সারের কারণে ব্রেন টিউমারও ধরা পড়েছে। এই কথা শুনে সবাই এতটাই হতবাক হয়ে পড়েছিলো যে মেহরানের বেঁচে থাকা নিয়ে সবাই আশঙ্কায় ভুগছিলো।তবে আল্লাহর রহমতে মেহরান বেঁচে গেলেও কোমায় চলে গিয়েছে। আজ প্রায় ছয়টা মাস যাবৎ বিছানায় শায়িত সে। চোখ মেলে তাকায় না।আর না নড়াচড়া করে।শুধু ধীরে ধীরে শ্বাস নেয়। মেহরানের পাশে বসে আলভি, এহসান, তুষার প্রত্যেকটা দিন আহাজারি করে কান্না করে। রাউশির কথা বলে। মুখের সামনে নুজাইশের পাঠানো রাউশির ছবিগুলো ধরে।তবে মেহরান চোখ খুলে সেসব দেখে না। ডাক্তাররা বলেছেন আর একমাস পর যদি মেহরান চোখ না খুলে,জ্ঞান না ফেরে তবে আর কখনোই চোখ খুলে তাকাবে না।আজীবন কোমায় পড়ে থাকবে সে।
তুষার মেহরানের বিছানার পাশে বসলো চেয়ার টেনে। কাঁপা গলায় আগের মতোই রাউশির ছবিটা মেহরানের সামনে দেখিয়ে বলল,
“দেখ, তুই নিজেও কষ্টে আছিস। এই মেয়েটাকেও এত কষ্টে রেখেছিস। এখন সত্যিই বলতে ইচ্ছে করছে তুই খুবই নিষ্ঠুর আর নির্দয়।”
এহসান থাই গ্লাসের সামনে দাঁড়িয়ে ছলছল চোখে হাসপাতাল থেকেই বাইরের শহরের দৃশ্য দেখছিলো তুষারের কথা শুনে কষ্ট ছাপিয়ে কেঁদে দিলো।মেহরানে কাছে এসে মেহরানের গাল ধরে কাঁদতে কাঁদতেই বলল,
“দোস্ত, দেখ তোর রাউশি ঠিক কি পরিমাণ কষ্ট পাচ্ছে।আমরা নাহয় নিজেদের সামলাচ্ছি কোনোভাবে।আমাদের পরিবার পরিজন আছে।কিন্তু রাউশির? এত কঠিন অতীত ফেলে তোকে নিয়ে এত সুন্দর এক জীবনের স্বপ্ন দেখেছিলো।অথচ দেখ ওর সেই স্বপ্ন শুরু হতে না হতেই শেষ।অন্তত ওর জন্য সুস্থ হয়ে যা ভাই।চোখ খুলে তাকা মেহরান।”
সেসময় একজন শেতাঙ্গ নার্স ভেতরে প্রবেশ করলেন।এহসান আর তুষারকে এখানে এত চেচামেচি করতে দেখে ইংরেজিতেই বলল,
“Why are you shouting here? can’t you let him be in peace for a day?”
এহসান বিড়বিড় করে গালি দিলো।হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলো সে।তুষার বসে রইলো।তবে নার্স তাকেও বের করে দিলো।নার্স কাজ করছিলেন কারোরই খেয়ালে আসলো না মেহরানের ডান হাতের বুড়ো আঙুল কিঞ্চিৎ নড়েছে।
চলবে.