#মেহেরজান
লেখনীতে- #সোহা
পর্ব ৬
আয়াশকে দেখতেই মুখ ঘুরিয়ে নেয় রাউশি। রাগ লাগছে তার।এই ছেলে এখানে কি করছে?ভার্সিটিতে তো ভর্তি হবে না আর। আর কি কাজে আসতে পারে?আবার তাদেরই ডিপার্টমেন্টে?নাকি জবের জন্য এসেছে?তখনই হালকা আওয়াজে শুনতে পায় আয়াশের সাথে তাদের ডিপার্টমেন্ট হেড কথা বলছেন।
“আপনি আজ থেকেই ক্লাস নিতে পারেন মি. আয়াশ।”
রুনা পাশ থেকে বলে,
“এই থেমে গেলে যে?”
পেছনে একবার তাকিয়ে আবারও বলে,
“ইনি মনে হয় নতুন লেকচারার।আজ এসেছে।ডিপার্টমেন্ট হেড গতকালই বলে রেখেছিলেন।”
রাউশি এবার কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়ে। শেষমেষ কিনা তারই ভার্সিটি, ডিপার্টমেন্টে। কিভাবে সহ্য করবে ওই জানোয়ারকে? ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে রাউশির। রুনা টেনে নিয়ে যায় রাউশিকে।ক্লাসে এসে সবাই মিলে গল্প করতে থাকে।রুনা জিজ্ঞাসা করে,
“সকালে তোমার সাথে একটা হ্যান্ডসাম ছেলে দেখলাম সে কি তোমার বয়ফ্রেন্ড?”
রুনা যে মেহরানের কথা বলছে এটা রাউশি বুঝে যায়।চটজলদি রুনার ধারণা পালটে দিয়ে বলে,
“কিসের বয়ফ্রেন্ড।আমার কাজিন ভাই সে।”
রুনার চোখ চকচক করে ওঠে।পাশে বসা মিলি খুশি হয়ে বলে,
“আরেহ ছেলেটা তো একদম জোস।আমার দারুণ লেগেছে।সেটিং করিয়ে দিও।যেহেতু তোমার কাজিন।”
চোখ ছোট ছোট করে মিলিকে দেখে রাউশি। মিলি রাউশিকে দেখে দাত কেলিয়ে হাসে। রাউশি বলে,
“মেহরান ভাই অনেক রাগী।”
রুনা বলে,
“হোক রাগী।ভালোবাসায় শান্ত বানিয়ে ফেলবো।”
কথাটা শুনে বাকিরা হেসে ওঠে।ক্লাসে এখনও স্যার আসে নি।তাই এতো গল্প করছে সবাই।
“এই রুনা তুই এতো লুচু কেন?”কথাটা হাসিব বলে ওঠে।হাসিবের কথা শুনে রুনা তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে।হাসিব, নাঈম আরও একটি ছেলে যার নাম ইউসুফ সে রুনাদেরই পাশের সাড়িতে তাদের বরাবর বেঞ্চে বসে।রুনা হাসিবের চুল টেনে দেয়। হাসিব চেঁচিয়ে ওঠে।
” ছাড় আমাকে।কি করছিস কি?চুল ছাড়।”
“ছাড়বো না।তোর চুল ছিড়ে এগুলো দিয়ে মালা বানাবো।”
হাসিবের পাশে বসা নাঈম বলে,
“চুল দিয়ে মালা কিভাবে বানায় রুনা?”
“আগে হাসিবের মাথার চুলগুলো ছিড়ে নেই তারপর তোর পালা।”
বাকিরা হাসছে।রাউশি ভাবনা মত্ত।আয়াশ কি তাদের ক্লাসও নিবে?রুনা যেহেতু বলছে লেকচারার তাহলে নিতেও পারে।রাউশির এসব ভাবনার মাঝে ক্লাস গম্ভীর হয়ে উপস্থিত হয় নুজাইশের।সবাই উঠে সালাম দাঁড়ায়।রাউশিরা শেষের এক বেঞ্চ আগে বসেছে।তারাও উঠে দাঁড়ায়।নুজাইশ সালামের উত্তর দিয়ে সবাইকে বসতে বলে। কথামতো সকলে বসে পড়ে।নুজাইশ একটি চ্যাপ্টার পড়ানো শুরু করে।পেছনে রুনা আর হাসিব ঝগড়া করছিলো শান্তস্বরে তবে সেটা নুজাইশ শুনে ফেলে।সামনে তাকিয়ে রাউশির দিকে আগে চোখ যায়।রুনাকে না দাড় করিয়ে সে রাউশিকে উদ্দেশ্য করে দাড়াতে বলে।রাউশি থতমত খেয়ে যায়। কোনো কথা না বলে সেও দাঁড়িয়ে যায়।
“কথা বলছো কেন ক্লাসে?”
রাউশি যথেষ্ট বুদ্ধিমান।দোষটা তার নয়।তবুও তার নামে অভিযোগ উঠেছে।তাও সে মাথা নিচু করে ভদ্রভাবে উত্তর দেয়,
“ক্ষমা করবেন স্যার।এমনটা আর হবে না।”
নুজাইশ এবার কিছুটা চমকিত হয়।ভাবটা প্রকাশ করে না।মেয়েটার ব্যবহার আর কথাটা শুনে নিজেও মুগ্ধ হয়।এবার মেয়েটাকে ভালোভাবে খেয়াল করে নুজাইশ।দেখতে কিছুটা হলিউড অভিনেত্রী ‘ডাকোটা ফান্নিং’ এর মতো তবে চোখের মণি ঘনকালো।নুজাইশ আর কিছু বলতে না পেরে বসতে বলে।রাউশিও বসে পরে। নুজাইশ আবারও নিজ কাজে মন দেয়। বোঝানোর পর এবার সে প্রশ্ন করে সবার উদ্দেশ্যে,
“এনি কুয়েশ্চন এনিওয়ান?”
একটি মেয়ে তালগাছের মতো দাঁড়িয়ে বলে,
“স্যার।”
নুজাইশ মেয়েটির দিকে তাকাতেই মেয়েটি আবারও বলে,
“নো কুয়েশ্চন স্যার।”
ক্লাসের সবাই হেসে ওঠে।রাউশিও হেসে ওঠে।সেই মেয়েটি আবারও বলে,
“আমি তো শুধু আপনাকেই দেখছিলাম।”
আবারও হাসে সবাই।কয়েকজন তো উত্তেজনার ঠেলায় হাত তালিও দিয়ে ওঠে।নুজাইশ রেগে যায়।ধমকে ওঠে মেয়েটিকে। মেয়েটি নুজাইশ স্যারের ধমক খেয়ে বসে পড়ে।নুজাইশ হাতঘড়িতে টাইম দেখে নেয়। আর এক মিনিট বাকি আছে এই ক্লাসের। তখনই ডিপার্টমেন্ট হেড ক্লাসের দরজার সামনে আসে।নুজাইশের থেকে অনুমতি চায় আসার জন্য।ক্লাসে আসেন তিনি।পেছন পেছন আয়াশও উপস্থিত হয়।এতক্ষণ এসবের দিকে খেয়াল না থাকলেও ডিপার্টমেন্ট হেড কবির স্যার যখনই বলেন,
“ইনি আপনাদের নিউ লেকচারার।”
তখনই চোখ বড় বড় করে মাথা তুলে সামনে তাকায়।আর আয়াশকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে।আয়াশকে হাসিমুখে সবাই সালাম জানায়।আয়াশও সালামের উত্তর দেয়।এরই মাঝে তার চোখ পেছনের বেঞ্চের স্টুডেন্টদের দিকে যেতেই চোখ ছানাবড়া হয়ে যায় রাউশিকে দেখে।আয়াশ রাউশির দিকেই তাকিয়ে থাকে।এই ভার্সিটিটা শহরের নামকরা একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। খুব কষ্টে এখানে লেকচারার এর পদ পেয়েছে।এখন যদি আবার এই খান পরিবার তার পেছনে লাগে তাহলে বাঁচা মুশকিল হয়ে যাবে আয়াশদের।আয়াশ এতক্ষণ রাউশির দিকেই তাকিয়েছিলো।পাশে থাকা কবির স্যার বারকয়েক আয়াশকে ডাকতেই আয়াশ সৎবিৎ ফিরে পায়।কবির স্যারের দিকে ফিরে তাকাতেই কবির স্যার হেসে বলেন,
“আপনি যদি চান, এখনই এই ব্যাচে এক্সট্রা একটা ক্লাস নিতে পারেন।”
আয়াশ চটজলদি বলে,
“না স্যার আগামীকালকে। আজ একটু ক্লান্ত আমি।”
কবি স্যারও মাথা নাড়ায়।দুজনে চলে যায়।তবে আয়াশ যাওয়ার আগেও রাউশির দিকে একবার তাকিয়ে চলে যায়।আয়াশের এমন চাহনী রাউশির মোটেও সহ্য হচ্ছিলো না। আয়াশ যেতেই হাফছেড়ে বাঁচে।রাউশি মোটামুটি একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে এই আয়াশকে নিয়ে।এবার সে আয়াশকে আচ্ছা মতো শিক্ষা দেবে এই ভার্সিটিতেই।
.
অবসন্ন বিকেল।পক্ষীকলতানে আশপাশ মুখরিত।ছাদে পাতানো দোলনায় বসে দোল খাচ্ছে রাউশি।তার মন ভালো নেই।দিন গুলো কেমন নিরব লাগে।বাড়িতে এত এত মানুষ থাকতেও নিজেকে একা মনে হয় তার।কি যেন একটা নেই এই অনুভুতি বড্ড পীড়া দেয় তাকে।গাড়ির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।কেউ এসেছে হয়তোবা।রাউশিকে ডাকার জন্য ছাদে আসে তানিয়া।
“রাউশিপু।”
রাউশি পেছনে তাকায়।তানিয়া তার কাছে আসে।আর বলে,
“নিচে এসো।মেহরান ভাই তোমাকে ডাকছে।”
“কেন?”
“জানিনা।ভাইয়া বললো তোমার নাকি কিসের প্রয়োজন।”
“কিসের প্রয়োজন?”
“এটা তো জানি না।চলো চলো।নিচে চলো।”
“এই দাড়া তানি।”
তানিয়া থেমে রাউশির কাছে আবারও আসে।রাউশি বলে,
“মেহরান ভাই কখন এসেছে?”
“এইতো এইমাত্র আসলো।আমাকে নিচে দেখে তোমায় ডাকতে বললো।”
ওহ বলে রাউশিও উঠে দাঁড়ায়।নিচে নেমে আসে দুজনে।তবে নিচে মেহরান নেই। উর্মিলা বেগমকে দেখে রাউশি উনার কাছে যায়।উর্মিলা বেগম রাউশিকে দেখতেই হাসে।মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
“মৌরি মা যা রেডি হয়ে নে।মেহরান তোকে নিয়ে শপিং এ যাবে।তোর তো কিছু জিনিস কিনতে হবে তাই না।”
‘মৌরিন’ নামটায় বাড়ির কেউ ডাকে না।শুধু উর্মিলা বেগমই খুব আদর করে ‘মৌরি’ ডাকেন।এতে অবশ্য রাউশিরও ভালো লাগে।মাথা নাড়িয়ে নিজের রুমের উদ্দেশ্যে পা চালায়।রুমে এসে রেডি হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে।তানিয়াও তার পিছু পিচু এসেছে।রাউশি দুটো ড্রেস বের করে তানিয়াকে বলে,
“কোনটা ভালো হবে তানি?”
“তোমাকে লাল ড্রেসে সুন্দর লাগে।এই লাল জামাটা পড়ো।”
অদ্ভুত হলেও রাউশির লাল রঙ ভীষণ পছন্দের।লাল আর হলুদ।রাউশির মতে লাল আর হলুদ রঙ একে অপরের জামাই বউ।এটা সে ছোট থেকেই ভেবে আসছে।এমনকি লাল রঙের সাথে সে কখনোই অন্য রঙ সহ্য করতে পারে না বললেই চলে। রাউশিও লাল ড্রেসটা নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে।কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে আসে। লাল সালোয়ার কামিজ।ওড়নাটাও লাল।দেখতে ভীষণ সুন্দর লাগছে রাউশিকে।রাউশির চুলগুলো বেশি লম্বা নয়।ঘাড় সমান হতে আরেকটু লম্বা।চুলগুলো ঝুটি করে নেয়। তানিয়া রাউশির কাছে এসে বলে,
“আপু তোমাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে।”
রাউশি হালকা হাসে।তানিয়াসহ দুজনে বেরিয়ে যায় রুম থেকে।রূপা বেগম কআজ করছিলেন মেয়েকে দেখে চমৎকার হাসেন। কাছে গিয়ে গালে হাত রেখে শুধান,
“মাশাল্লাহ আমার মেয়েটাকে খুব সুন্দর লাগছে।কারো নজর না লাগুক।এখন যা মেহরান বাইরে তোর জন্য অপেক্ষা করছে।”
রাউশিও বাইরে বেরিয়ে আসে।মেহরান কালো শার্ট আর প্যান্ট পড়ে ছিলো। রাউশি কাছে যেতেই ফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকা মেহরান চোখ তুলে সামনে তাকায়।রাউশিকে আসতে দেখে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে।রাউশির মাঝে কোনো জড়তা নেই।নেই কোনো ভয়। বাড়ির সব ছেলেমেয়েগুলো যখন মেহরানকে বেশ ভয় পায় সেখানে রাউশি খুব শান্ত।মেহরানের মন হঠাৎ করেই বলে ওঠে ‘মেয়েটাকে আজ একটু বেশিই সুন্দর লাগছে’।চোখ জুড়ে মুগ্ধতার মাত্রা বেড়ে যায় মেহরানের।রাউশি কাছে আসতেই মিষ্টি সুঘ্রাণ নাকে এসে লাগে মেহরানের।নিমিষেই তার খিটখিটে মেজাজটা শান্ত হয়ে যায়। ঘোরে চলে যায় নি মেহরান।রাউশির থেকে চোখ ফিরিয়ে গাড়ির দরজা নিজেই খুলে দেয়।রাউশি তার পাশ দিয়ে গাড়িতে উঠে বসে।রাউশির চুল থেকে সুমিষ্ট ঘ্রাণ বেরোতেই মেহরানের খুব করে মন যেন চেয়ে উঠলো রাউশির চুলে একবার নাক ডুবাতে।পরক্ষণেই নিজের ভাবনাকে ঠেলে দিয়ে নিজেও গাড়িতে উঠে বসে।সিটবেল্ট লাগিয়ে একবার রাউশির দিকে তাকায়। রাউশি সিল্টবেল্ট লাগিয়েই ভদ্রভাবে বসে আছে।মেহরানের অনুভুতিটা আজ অন্যরকম সুন্দর মনে হচ্ছে।তার যেন রাউশিকে খুব করে একবার বলতে ইচ্ছে করছে “রাউশি লাল রঙে তোকে খুব ভালো মানায়।”
এমন অনুভুতি খুবই নতুন মনে হয় মেহরানের কাছে।রাউশি অন্যদের তুলনায় আলাদা।মেয়েটার এই দিকটা যেন নজরকাড়া লাগে মেহরানের।সামনে তাকিয়ে গাড়ি স্টার্ট দেয়।মেহরান রাউশিকে বলে,
“কেমন কাটলো ভার্সিটির প্রথম দিন?”
রাউশি আয়াশের কথা মেহরানকে বলবে কিনা ভাবছিলো।তবে সেটা না বলে উত্তর দেয়,
“ভালো কেটেছে ভাইয়া।”
“যদি বন্ধুবান্ধব হয়ে থাকে আজ তাহলে তারা ব্যতীত অন্য ছেলেদের থেকে দূরে থাকবি।আর ছেলে বন্ধুদের সাথেও এত মিশবি না।”
রাউশি মেহরানের দিকে তাকায়।মেহরানের কথাটা বোধগম্য হলেও উদ্দেশ্য বোধগম্য হলো না।খুব ছোট করেই মেহরানই আবার বলে,
“আজ এই মুহুর্ত থেকে কেউ একজন হয়তো সহ্য করতে পারবে না।”
চলবে…
#মেহেরজান
লেখনীতে- #সোহা
পর্ব ৭
মেহরানের আস্তে করে বলা কথাটা রাউশি শুনতে পেলো কি পেলো না সেটা বোঝা গেলো না।কারণ সে তো ব্যস্ত জানালার বাইরের দৃশ্য দেখতে।মেহরান রাউশির দিকে একবার আড়চোখে তাকায়।মেয়েটাকে কেমন উদাসীন মনে হচ্ছে তার কাছে। মেহরান গলা ঝেড়ে বলে,
“তোর কি মন খারাপ রাউশি?”
রাউশি মেহরানের দিকে ফিরে তাকিয়ে বলে,
“এমনটা নয় ভাইয়া।”
“তাহলে এভাবে চুপচাপ বসে আছিস?ওইদিন তো খুব ঝরঝরা ছিলি।”
‘ঝরঝরা!’ শব্দটা মানে বুঝতে পারলো না রাউশি।বোকা চাহনীতে তাকিয়ে রইলো মেহরানের দিকে।মেহরান আড়চোখে একবার দেখে রাউশিকে।সেও কিছু বলে না আর।মেহরানের ফোন বেজে ওঠে।বাম হাতে সেটা নিয়ে দেখে তার পিএ রোজি কল করেছে।এই মেয়েকে মেহরানের একদম অপছন্দ।কিন্তু অপছন্দ হলেও চাকরি থেকে বের করে দিতে পারছে না।কারণ মেয়েটিকে মাহবুব খান ছেলের জন্য হায়ার করেছেন। মেহরান কল রিসিভ করে না।পরপর দুবার কল আসে।তবুও যখন মেহরান রিসিভ করছিলো না তখন পাশ থেকে রাউশি বলে,
“আপনাকে কেউ কল করছে ভাইয়া।রিসিভ করছেন না কেন?”
“জরুরী কোনো কাজের নয় তাই।”
গম্ভীর আওয়াজে এমন জবাব শুনে রাউশি মুখ ঘুরিয়ে সোজা হয়ে বসে।এই লোকের কি আবার রাগ উঠলো নাকি ভাবতে থাকে।মাঝেমাঝে এমন গম্ভীর আর রুক্ষ আওয়াজ শুনলে রাউশির রূহ কিছুটা হলেও যেন কেঁপে ওঠে।
আধঘণ্টা পর শপিং মলের সামনে পৌঁছে যায় তারা। রাউশি গাড়ি থেকে নেমে যায়। মেহরান গাড়ি পার্কিং করে আসছি বলে গাড়ি নিয়ে পার্কিং লটে যায়।রাউশি একটু সাইডে দাঁড়িয়ে থাকে।রাউশির কাছে আজ লোক সমাগম একটু বেশিই মনে হচ্ছে।এইযে সে সাইডে দাঁড়িয়ে আছে তাও আশপাশ দিয়ে অনেক মানুষ আসা যাওয়া করছে।মেহরানকে শার্টের হাতা গুটিয়ে গুটিয়ে আসতে দেখে রাউশি।মনে মনে বলে লোকটাকে আজ সুপুরুষ লাগছে কালো শার্টে।মেহরান রাউশি সামনে আসতেই ‘চল’ বলে।মেহরান আগে হাঁটছে রাউশি তার পিছু পিছু।মলে ঢুকতেই মানুষের ভিড় দেখে রাউশি কপাল কুঁচকে নেয়।মেহরান হাঁটছে তবে এবার রাউশির পাশে।হঠাৎ রাউশি তার বাম হাতে কারো স্পর্শ পায়।বাম হাতের দিকে তাকাতেই দেখে মেহরান তার বাম হাত দিয়ে একহাতে পেছন থেকে রাউশিকে জড়িয়ে ধরেছে।চোখ বড় বড় মেহরানের দিকে তাকায় রাউশি।মেহরান নির্বিকার ভঙ্গিতে হেঁটে যাচ্ছে সাথে রাউশিও হাঁটছে।রাউশি ভাবতে থাকে মেহরান ভাই কেন তাকে এভাবে ধরেছে?মেহরান ভাই কি তাকে পছন্দ করে?এসব ভাবতেই চোখ কপালে ওঠার জোগাড় রাউশির। রাউশি মেহরানের হাতটা ছাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে তবে ছাড়াতে পারে না।মেহরান গম্ভীর আওয়াজে বলে,
“লোকের ধাক্কা খেতে না চাইলে চুপচাপ হেটে যা।”
রাউশি এবার বুঝে যায় মেহরান কেন তাকে পেছন থেকে এক হাতে জড়িয়ে ধরেছে। এদিকে রাউশি কি না কি ভাবছিলো এসব ভাবতেই নিজেই লজ্জায় পড়ে যায়।চুপচাপ হাঁটতে থাকে।
রাউশি জামা চুজ করার সময় মেহরান ফোনে কারোর সাথে কথা বলছিলো। মেহরান রাউশির কাছে এসে বলে,
“তুই চুজ করতে থাক।আমি একটু কথা বলে আসি।একটুপরই আসবো।কোথাও যাবি না একদম।”
কথাটা বলে মেহরান চলে যায়।রাউশি নিজের মনমতো জামাকাপড় দেখতে থাকে। তখনই তার থেকে একটু দূরে একটি ছেলে আর মেয়েকে ঝগড়া করতে শুনে।সেদিকে তাকিয়ে দেখে ছেলেটা আর কেউ নয় বরং নুজাইশ স্যার।তবে নুজাইশের সাথে ওই মেয়েটা কে সেটা বুঝতে পারে না রাউশি। রাউশি ভাবে নুজাইশের গার্লফ্রেন্ড হবে হয়তো।কিন্তু এই ভরা মানুষের সামনে এরা এভাবে ঝগড়া করছে কেন?
নুজাইশ তার বড় বোন নুসফারের সাথে শপিং এ এসেছিলো।নুসফা আর নুজাইশের সম্পর্ক সাপে নেউলে হলেও আজ বাধ্য হয়ে তাদের দুজনের একসাথে এই শপিং করতে আসতে হলো।এর কারণ নুসফারকে দুদিন পর দেখতে আসবে। নুসফারের কিছু জিনিস কেনার প্রয়োজন ছিলো তাই সেটা তার মা নাজমা বেগমকে বললে তিনি তার ভাইকে নিয়ে যেতে বলেন।নুজাইশ যেতে না চাইলেও মায়ের ধমকে রাজি হয়ে যায়। নুজাইশ মা ভক্ত।মা-কে অনেক ভয় পায় সে।তাই মায়ের কথাতেই এই ঝগড়ুটে’টার সাথে আসতে হলো।নুজাইশ চেচিয়ে বলে,
“তুই এখানেই থাক আমি চলে গেলাম।”
নুসফা বলে,
“যা যা।”
নুজাইশ রেগে চলে যাওয়ার জন্য পেছনে ফিরে তাকাতেই মৌরিনকে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভুত দেখার মতো চমকে ওঠে।নুজাইশ আজ সকালে মৌরিনকে ভালোভাবে দেখার পর হতেই এখানে সেখানে মেয়েটাকে দেখতে পাচ্ছে। মোটেও ভালো থাকতে পারছে না নুজাইশ। নুজাইশ এটা তার ভ্রম মনে করে মৌরিনের সামনে গিয়ে বলে,
“তোমার সাহস কত মৌরিন তুমি আবারও আমাকে তাড়া করছো?”
রাউশি হতবম্ভ হয়ে যায়।এই লোক বলে কি? আবার মৌরিন ডাকছে কেন?নুজাইশ নিজের মাথার চুল হাত দিয়ে টেনে ধরে।আশেপাশের মানুষ জন কেমন করে যেন তাকিয়ে থাকে তাদের দিকে।নুজাইশ বলে,
“দেখো মৌরিন এটা ঠিক নয় আমি তোমার টিচার।টিচার স্টুডেন্টের মাঝে_”
বাকি কথাটা যেন বলতে পারে না।গলা দিয়ে আসছে না কথাটা।রাউশি এবার নিজেকে সামলে বলে,
“স্যার আপনি কি ঠিক আছেন?”
এবার নুজাইশ ভালোভাবে দেখে এটা সত্যিকারের মৌরিন।এবার যেন নুজাইশ আকাশ থেকে পড়ে।এতক্ষণ এই মেয়ের সামনে কি পাগলামীটাই না করলো ভাবতে থাকে।লজ্জা পেলেও ক্ষণবাদেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
“ওহ আ’ম সরি মৌরিন।ইটস যাস্ট আ প্র্যাঙ্ক।”
কথাটা বলে নুজাইশ আবার নিজেই হাসতে থাকে।লজ্জায় যে তার মাথা কাটা যাচ্ছে এটা মোটেও বুঝতে দেওয়া যাবে না। নুজাইশ আবারও বলে,
“তা তুমি এখানে একা কি করছো?শপিং করতে এসেছো?ওহ করো করো।”
নুজাইশ ভাবছে এখান থেকে কেটে পড়লেই সে বাঁচে।তাই নুজাইশ মৌরিনের থেকে বিদায় নিয়ে বড় বড় পা ফেলে চলে যায়। রাউশি নুজাইশের যাওয়া দেখে।সে তো নুজাইশের এমন আচরণে চমকে গিয়েছে। আসলেই কি প্র্যাঙ্ক নাকি অন্যকিছু ভাবতে থাকে।টিচার কি কখনো শিক্ষার্থীর সাথে এমন প্র্যাঙ্ক করে কিনা জানা নেই রাউশির। তখনই ভেতরে আসে মেহরান।রাউশির কাছে এসে ব্যস্ত আওয়াজে বলে,
“আর ইয়্যু ডান রাউশি?”
রাউশি নিজের হাতের দিকে তাকায়। শুধু মাত্র একটা ড্রেস হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেহরান রাউশির চোখ অনুসরণ করে সেদিকে তাকাতেই বুঝে যায় যে রাউশির এখনো হয় নি।তাই এবার সে নিজেই রাউশির জন্য ড্রেস পছন্দ করতে শুরু করে। আর রাউশিকে তার পিছু পিছু আসতে বলে। রাউশি শুধু অবাক চোখে মেহরানকেই দেখে যাচ্ছে।মানুষটার চয়েজ সেন্স খুব ভালো।
সবকিছু কেনা শেষ হলে মেহরান শপিং ব্যাগগুলো নিজেই হাতে নেয়।রাউশিকে জিজ্ঞাসা করে,
“আর কিছু বাকি আছে তোর?”
রাউশি দুদিকে মাথা নাড়ায়।আর কিছু বাকি নেই।হাটার সময় রাউশি হোঁচট খেয়ে পড়ে যেতে নিলে মেহরান রাউশির বাম হাত ধরে ফেলে।বলে,
“আস্তে হাঁট আর দেখেশুনে হাঁটাচলা কর।চোখ কোথায় রেখে হাঁটিস?”
রাউশি তো ভালোভাবেই হেঁটে যাচ্ছিলো। মাঝে মধ্যে এমন হওয়া স্বাভাবিক।মেহরান পার্কিং লটে গিয়ে গাড়িটা নিয়ে আসে। রাউশি গাড়িতে উঠে বসে।মেহরান গাড়ি স্টার্ট দেবে তখনই কেউ একজন আবার তাকে কল করে।মেহরান ফোন বের করে ফোনের স্ক্রিনে চোখ দিতেই রেগে যায়। রোজি আবারও কল করছে।কল রিসিভ করে রুষ্ট আওয়াজে জিজ্ঞাসা করে,
“তোমার সমস্যা কি?”
রোজি ওপাশ থেকে বলে,
“স্যার আমি আপনার গাড়ি পেছনে দাঁড়িয়ে আছি।আসলে আজ রাতে আপনার ঢাকার বাইরে যাওয়ার কথা ছিলো।আগামীকাল খুব গুরুত্বপূর্ণ মিটিং আছে আপনার।কিন্তু আপনি আমার কলই রিসিভ করছেন না।”
ফোন কানে নিয়েই একবার পেছনে তাকায় মেহরান।সত্যিই রোজি পেছনে দাঁড়িয়ে আছে।এই মেয়ে জানলো কিভাবে মেহরান শপিং মলে?নাকি বাবা বলেছে?মেহরান তার বাবাকে পরে দেখে নেবে ভেবে নেয় মেহরান।আগে এই রোজির একটা বিহিত করতে হবে।রোজি মেহরানের সিটের জানালার কাছে আসে।মেহরান কাঁচ নামিয়ে ঝাঝালো গলায় বলে,
“কি?”
রোজি একবার রাউশির দিকে তাকায়। মেয়েটাকে সে চেনে না। তবে রোজির যেন হুট করেই মেজাজ খারাপ হয়,
“স্যার আপনার তো আজ ঢাকার বাইরে যাওয়ার কথা ছিলো।কিন্তু আপনি উনার সাথে কি করছেন?”
মেহরান চোখমুখ শক্ত করে বলে,
“তার কৈফিয়ত কি তোমায় দেবো আমি? মিটিং ক্যান্সেল করো।আমি যাব না।”
রাউশি শুধু ড্যাবড্যাব করেই তাকিয়ে আছে। এই মেয়েটাকে সে চেনে না।তবে মেয়েটার পোশাক আশাক খুবই মডার্ন।মেয়েটি আবারও রাউশির দিকে তাকিয়েই প্রশ্ন করে,
“কিন্তু স্যার এটা করলে তো আমাদের কোম্পানীরই ক্ষতি হবে।আপনার এভাবে যার তার সাথে সময় কাটানো উচিত নয়।আপনার বাবা জানতে পারলে রেগে যাবেন।”
রাউশির চোখজোড়া ছোট ছোট হয়ে যায়। মেহরান এবার প্রচণ্ড রকমের রেগে যায় বুঝি।ধমকে বলে,
“আমি কি আমার বাবাকে ভয় পায়?এনসার মি?ভয় পায়?চলে যাও এখান থেকে।”
ধমক খেয়ে এবার কিছুটা দমে যায় রোজি। মেহরান রাগে শ্বাস নিচ্ছে ঘনঘন।রাউশির দিকে একবার তাকিয়ে রোজির দিকে চক্তচক্ষু নিক্ষেপ করে মাথা একটু এগিয়ে নিয়ে বলে,
“ওকে নিয়ে ‘যার তার’ শব্দটা উচ্চারণ করা মোটেও ঠিক হয় নি তোমার।মেহরান খানের অতিপ্রিয় কিছুকে এভাবে অপমান করার শাস্তি তোমাকে পেতে হবে রোজি।বিদায়।”
চলবে……