❝মোহ মেঘের আলাপন ❞
লেখিকা: “নূরজাহান আক্তার আলো”
[২৫]
এক সপ্তাহ পরের ঘটনা,
দিনটি শনিবার। ঘড়িতে সময় আটটা বিশ। মেঘাচ্ছন্ন অম্বর।
বইছে ঝড়ো বাতাস।মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে মেঘের গর্জন।
মেঘের রুপ দেখে মনে হচ্ছে মুষলধারে বৃষ্টি নামবে। ভাসিয়ে দিবে পুরো শহর। ভোর থেকেই বাইরের আবহাওয়া খারাপ। তবুও আদিত্য সকালের নাস্তা সেরে রেডি হচ্ছে। তাকে বের হতে হবে। জরুরি মিটিং আছে উপস্থিত থাকাটা আবশ্যিক।
কিন্তু মেধা তাকে যেতে দিতে নারাজ। বার বার বলেও কাজ হলো না দেখে মুখ গোমড়া করে বেলকণিতে দাঁড়িয়ে আছে।
বাতাসের সঙ্গে উড়ছে রাস্তার ধুলোবালি।নড়ছে গাছপালাও।
সেই সঙ্গে উড়ছে পাশের ছাদে ঝুলতে থাকা কারো বিছানার চাদর। হয়তো গতদিনে কেউ চাদরখানা তুলতে ভুলে গেছে।
মেধা সেদিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে আদিত্যকে এক
নজর দেখে নিলো। আদিত্য শার্ট খুঁজছে। একের পর ড্রেস সরিয়ে শার্ট খুঁজে পাচ্ছে না সে। মেধা দেখেও না দেখার ভাণ করে দাঁড়িয়ে রইল। খুঁজছে খুঁজুক তাতে তার কী? খুঁজেও দিবে না, যা ইচ্ছে করুক। এদিকে একটা টি-শার্ট অথবা শার্ট কিচ্ছুই খুঁজে পাচ্ছে না আদিত্য। গতদিনে কতগুলো টি-শার্ট
, শার্ট, প্যান্ট কিনেছে সে, সঙ্গে মেধার কয়েকটা ড্রেস।মেধার ড্রেসগুলো সুন্দরভাবে ভাঁজ ভাঁজ করে তুলে রাখা। তাহলে ওর গুলো কোথায়? আসল কাহিনি বুঝতে পেরে অহেতুক আর না খুঁজে সে মেধাকে ডাকল। মেধা শুনেও নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছে। দু’এক ফোঁটা করে বৃষ্টি পড়ছে মাটির বুকে। শুকনো মাটি বৃষ্টির ফোঁটাগুলোকে সাদরে ঠাঁই দিচ্ছে বুকের মাঝে। তখন পুনরায় আদিত্যের বিরক্তমিশ্রিত ডাক শোনা গেল। সে কথা বলছে না, কিছু বললে জবাবও দিচ্ছে না, এড়িয়ে যাচ্ছে। তার মুখে জড়ো হয়েছে একরাশ চাপা অভিমান।ওর কান্ড দেখে আদিত্য মুচকি হাসল। ঘাড়
ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিলো অভিমানিনীকে। মেধার মুখজুড়ে অভিমানে ছড়াছড়ি। আদিত্যের ডাক উপেক্ষা করতে মেধা
কানে ইয়ারফোন গুঁজে দিয়েছে। গান বাজছে। অথচ তার মনে পড়ে আছে রুমে থাকা নিষ্ঠুর মানবের কাছে। যাকে সে কিছুক্ষণ আগে কত্ত সুন্দর করে জড়িয়ে ধরে বলেছে,
-”না গেলে হয় না? একা একা ভালো লাগবে না আমার।”
-”যেতেই হবে কাজ আছে।”
একথা বলে সে শার্ট খুঁজতে শুরু করেছে। কিন্তু মেধা নাস্তার টেবিলে যখনই শুনেছে আদিত্য বাইরে যাবে। তখনই সে চট করে তার সব জামা কাপড় ওয়াশরুমের বাথটাবে চুবিয়ে এসেছে। নে এবার যা! বেশি করে যা! কী সুন্দর করে বললো দামই দিলো না। এবার দেখ কেমন লাগে। বউ হয়েছে,এমনি এমনি ছেড়ে দিবে? তাছাড়া শাশুড়ী বলে দিয়েছে সব সময় অধিকার খাটাতে, তাকে বুঝিয়ে দিতে, সে এখন বিবাহিত।
একথা ভেবে অভিনয় ছেড়ে সে রুমে চলে গেল। আদিত্য শার্টের কথা জিজ্ঞাসা করতেই সে ওয়াশরুম দেখিয়ে দিলো।
তারপর বিছানায় টান টান হয়ে শুয়ে পাশ বালিশ বুকে জড়িয়ে বললো,
-”দারুণ ওয়েদার, একটু ঘুমায়।”
তার এই কান্ডে আদিত্য দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। কাকে কী বলবে তার বোধগম্য হলো না। তাই অফিসে জানিয়ে দিলো মিটিং ক্যান্সেল। তারপর এগিয়ে গিয়ে মেধার শরীর ওর সমস্ত ভর ছেড়ে চোখজোড়া বন্ধ করে বললো,
-”দারুণ ওয়েদার, একটু ঘুমায়।”
-”আরে আরে এভাবে কেন? সুন্দরভাবে ঘুমাও।”
-”উহুম, আমাকে যেতে না দেওয়ার শাস্তি। ”
-”উফ, সরো আদিত্য, লাগছে আমার। আর এত ওজন কেন তোমার?”
-”আমার ওজন ঠিকঠাকই আছে, ঘুমাও।”
-”এভাবে..! ”
মেধা তার কথা সম্পূর্ণ করার আগেই তার ঠোঁট আদিত্যের দখলে। কিল, খামচি, দিয়েও তার থেকে কোনোভাবে নিস্তার মেলে না। একটা সময় নিজে থেকেই শান্ত হয়ে যায়। অনুভব করতে থাকে প্রিয় মানুষটার স্পর্শগুলো। সেদিন সারাদিনই বৃষ্টি নামলো। সঙ্গে মেঘের গর্জন। রাস্তাঘাটেরও স্যাঁতস্যাতো অবস্থা। তাই আদিত্যও আর বের হলো না। এ সুযোগ তাকে
নাস্তাবুদ করে ছাড়ল মেধা। বিকেলের দিকে বৃষ্টিও কমলো, আকাশও পরিষ্কার হলো। মেধা এবার জেদ ধরলো মামনির সঙ্গে দেখা করতে যাবে। আদিত্য অন্য কোথায় যাওয়ার কথা বললেও শুনলো না। একটা সময় জেদ করলো, কান্না করে চোখের পানি, নাকের পানি এক করলো। তখন আমান কল করলো মেধাকে। মেধা কাঁদতে কাঁদতে কলটা রিসিভ করে স্পিকার অন করে টিস্যু দিয়ে নাক মুছছে। সেই টিস্যু ছুঁড়ে মারছে আদিত্যের দিকে। আমানের কল দেখে আদিত্য লেপটপ নিয়ে সোফায় বসেছে। তখন আমান মেধার কান্না করার কারণ জেনে বললো,
-”তোর হিরোর উপর চাপ সৃষ্টি করে বাসায় ফিরে আয়। যদি আসিস তবে তোকে স্বর্ণের রিং গিফ্ট করবো। আমাদের প্ল্যান ভাইয়া ধরে ফেলে নি তো? আমি ভাইয়াকে খুব ভালোবাসি। ছোটবেলার মতো কথা না বলে শান্তি পাচ্ছি না। প্লিজ বোন, তোরা ফিরে আয়। তোদের ছাড়া বাসায় থাকতে পারছি না আমি। আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে। ভাইয়াকে বোঝা আমি আর এমন ভুল করবো না। আমি রিহ্যাবে চলে যাবো। যত দিন নেশা পুরোপুরি কাটছে তোদের সামনে দাঁড়াবো না।”
আদিত্য একথা শুনে দৃষ্টি তুলে তাকালো মেধার দিকে। মেধা জোরপূর্বক দাঁত কপাটি বের করে হাসলো। ওর হাসি দেখে
আদিত্যের আর কিছু বুঝতে বাকি নেই। সে উঠে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। সেটা দেখে মেধা করুন দৃষ্টিতে তাকালো। এই আমানও না একটা গাধা। কখন কী বলতে হয় তাও জানে না। ধরা খেয়েও আমানকে জানালো না বরং স্বাভাবিকভাবে
জিজ্ঞাসা করলো,
-“ভাইয়া মামনি কেমন আছে?”
-”ভালোই আছে। তবে মনমরা হয়ে থাকে কিছু জিজ্ঞাসা বলে নয়তো চুপ থাকে।”
-”ভাইয়া কি এখনো রেগে আছে আমার উপর?”
-”হুম, এভাবে হবে না। তুমি সরাসরি আদিত্যের মুখোমুখি হও। কথা বলো, হয়তো মুখ ফিরিয়ে দিবে, মারতেও পারে, তবুও মুখোমুখি হও। এভাবে সমাধান হবে না। ভুল যখন করেছো সমাধান তোমাকেই খুঁজতে হবে। জীবন সুন্দর। এই সুন্দর জীবনকে এভাবে নষ্ট কোরো না ভাইয়া। বুঝে না বুঝে দোষ করে ফেলেছো এখন স্বীকার হলে ছোট হয়ে যাবে না তুমি। আদিত্য কেমন তুমি তো জানো?তোমাকে ঠিক কতটা
ভালোবাসে তাও জানো। আমি আর কিছু বলবো না এবার যা করার তুমিই করো।”
আমান পুরো কথা মন দিয়ে শুনে কল কাটলো। মেধা নীরবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে আদিত্যের কাছে গেল। আদিত্য বাইরে যাচ্ছে তৈরি হচ্ছে। পরনে ব্ল্যাক টি-শার্ট ও জিন্স। পরিপাটি
বেশভূষা। তাকে দেখে মেধাও ঝটপট তৈরি হয়ে আদিত্যের পিছু বেরিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো। আদিত্য কিছু বললো না বরং নিজেই সিটবেল্ট বেঁধে দিলো। আদিত্য মেধাকে নিয়ে একটা কফিশপে বসলো। কিছুক্ষণ পরেই আদিত্যের বন্ধুরা আসলে জমপেশ আড্ডার সঙ্গে খাওয়া দাওয়াও হলো। এর
পর শপিংমলে গিয়ে আরো কয়েকটা শার্ট কিনে অফিসের দিকে গেল। অফিস বন্ধ হয়ে গেছে স্টার্ফরাও চলে গেছে। শুধু ম্যানেজার আছে। তাদের দেখে ম্যানেজার ছুটে এলেন।
আদিত্য নিজের কেবিনে ঢুকে জরুরি ফাইল দেখতে থাকল।
আর মেধা তার কেবিনের নজর বুলাতে লাগল। তবে তার খু্ব পছন্দ হলো আদিত্যের একটা ফটোফ্রেম। ড্যাসিং লুকে
আদিত্য দাঁড়িয়ে আছে। বেশ লাগছে দেখতে। যাকে বলে প্রথম দেখাতে যে কারো নজর কাড়বে। তা দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেললো মেধা। এই ছবি এখানে রাখবে না সে। হিংসা হচ্ছে ওর। আদিত্য কীসব আলোচনা করছে ম্যানেজারের সঙ্গে। সে সবে কান না দিয়ে পুরো অফিস ঘুরে দেখলো। তারপর কাজ সেরে ওরা বেরিয়ে গেল বাসার উদ্দেশ্যে। কিন্তু জ্যামে পড়ে গাড়ি আঁটকে গেল ঘন্টার পর ঘন্টা। সামনে এগোতেই হঠাৎ আদিত্যের বাবার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। দুটো গাড়িই পাশাপাশি। উনি ছেলের মুখের দিকেই তাকিয়ে ছিলেন। খুব কষ্টে অশ্রু লুকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। ছেলে যদি পর করে দিতে পারে উনি কেন পারবে না? মেধা উনাকে দেখে কথা বলে যেতে চাইলে আদিত্য তার মুখপানে তাকিয়ে রইল। না বারণ করলো আর না যেতে বললো। আদিত্য বাবাই তখন বললেন উনার ফিরতে আরো লেট হবে। উনি অন্য কোথাও যাচ্ছেন। একথা শুনে মেধা মলিন হাসল। যা বোঝার বুঝতে পেরেছে। হয়তো সে আর পারবে না সবাইকে এক করতে।
সম্পর্কের তার গুলো ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে, দূরত্ব বাজছে। এভাবে
চলতে থাকলে কেউ ভালো থাকবে না, কেউ না। এসব ভেবে সে কিছু বলতে গেলে আদিত্য বললো,
-”আগামী পরশুদিন দেশ ছাড়ছি আমি। এখনই তুমি তোমার মামনির কাছে চলে যাও। এত প্ল্যান, এত অভিনয়, করতে হবে না তোমাদের। সত্যি বলতে কী জানো? আমার সঙ্গের চেয়ে বাকিদের সঙ্গই তোমার বেশি প্রয়োজন।তুমি আগেও বুঝতে না আমায় আর এখনো বুঝো না। থাক সেসব কথা যেখানেই থাকো খুব ভালো থেকো। আর মাস শেষে তোমার একাউন্টে নিদির্ষ্ট একটা এমাউন্ট পৌঁছে যাবে।”
-”এবার কিন্তু বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে।”
-”হওয়াটা কি স্বাভাবিক নয়?”
-”তখন আমান ভাই….!”
-”উহুম আর একথা কথাও শুনতে চাচ্ছি না আমি। আমার আপনজন আমাকে যেসব আঘাত দিয়েছে। আমরণ ভুলতে পারব না আমি। প্রতিটা মানুষের ধৈর্য্য বলে কিছু আছে। এই
যেমন ধরো, তোমার কথায় বলি। তোমাকে ভালোবাসি বলে তুমিও কম ফায়দা উঠাও নি। তোমার জন্য আমানের গায়ে হাত তুলেছি, বাসা থেকে বেরিয়ে এসেছি। যাতে তাকে একটু হলেও কিছু অনুভব করাতে পারি। সে ভুল করেছে। কখনো কখনো ভুলের মাসুল ভয়ংকর হতে পারে৷ অথচ তুমি ওর সঙ্গে এক হয়ে আমাকেই বোকা বানাতে চেয়েছো। বুদ্ধি কী একা তোমার আছে, আমার নেই? ‘তুমি ছোট, বয়সও কম’
ঠিক এই একটা কথায় প্রেক্ষিতে আর কতবার ছাড় দিবো বলো তো আমায়? আমাদের সম্পর্কের শুরু থেকে আমার সঙ্গে কী করেছো একটা ভাবো তো। তুমি আমার, তাই এই আমিটার তোমার জন্য পাগল। একথা কিন্তু তুমিও জানো।
বাবা -মাকে ছাড়া থাকছি, আমার মা আমাকে ছাড়া মুখে ভাত তুলে না। সেই মায়ের সঙ্গে এক সপ্তাহ হলো কথা বলি নি। কেন জানো? এমন না আমানের জন্য। এর বিশেষ এক কারণও আছে। উনাদের জন্য আমান আজকে ভুল পথে।
আমি জানতাম, আমান আর মিষ্টির কথা। তাদের বিয়ের কথাও আমার অজানা ছিলো না। কিন্তু আমার মামা মিষ্টির পরিবারকে পছন্দ করে নি। এজন্য খুব চাপ দিচ্ছিলো বিয়ে দিয়ে দেওয়ার জন্য। মিষ্টির পরিবার ঠিক তাইও করেছিলো। কিন্ত মানতে পারে নি সে সু’ ই’ সা’ ই’ ড করেছে। মিষ্টি মারা যাওয়া পর আমান নেশার জগৎ ডুববে থাকে। আমার বাবা তখনো লাগাম টেনে ধরলে আর আমান এমন টা হতো না।
তোমার মামনি ভালোবাসার টানে ছেলেকে রিহ্যাবে রাখতে পারেন না। এত করে বুঝিয়েও কাজ হয় না। যার জন্য দিনে দিনের আমানের এত অধঃপতন। সকালে বললো না? সে অনুতপ্ত এমন ভুল কখনো করবে না? সামনে তাকিয়ে দেখো তোমার আমান ভাই নেশায় বুদ হয়ে পড়ে আছে।”
মেধা তড়িৎ গতিতে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে অদূরে থাকা বাগানে বেশ কয়েকজন ছেলে দুই পা মেলে শুয়ে আছে। তাদের মধ্য আমানও আছে। ছোট ভাইয়ের অবস্থা দেখে আদিত্য মলিন হাসলো। কিছু বলার নেই তার। তারপর আদিত্য গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে চলে এলো সেখান থেকে। মেধা নীরবে অশ্রু ঝরাচ্ছে। তখন আদিত্যই বললো,
-”বাসা ছেড়েছি কারণ আমার বাবা মায়ের ভাষ্যমতে, আমি আমানকে হিংসা করি। উনারা আমানের নামে অফিসসহ, আরো দু’টো ফ্ল্যাট লিখে দিয়েছে। আমাকেও দিয়েছে আর আমি নিজেও কিছু করেছি। একদিন আমান নেশা করে খুব অশান্তি করছিলো বাসায়। বাবাকে রেগে ধাক্কা দিয়েছিলো। সেদিনও আমানকে খুব মেরেছিলাম আমি। তখন মা বলে ‘আমি আমানকে হিংসা করি। সুযোগ পেয়ে নাকি এভাবে মেরেছ।” যেদিন বাসা ছাড়লাম সেদিন আমার ভাগের সব কিছু তাকে দিয়ে এসেছি আমি। শুধু এটা বোঝাতে আমার ভাইকে আমি হিংসা করি না। আমিও তার ভালো চাই।কিন্তু কথা হচ্ছে তোমরা কেউ আমাকে বুঝো না, কেউ না।”
এসব কথা শুনে মেধা কোনো কথায় বলতে পারলো না। তার শব্দভান্ডার যেনো শূন্য। বেশ কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আদিত্যের মুখপানে। আদিত্যের মুখভঙ্গি স্বাভাবিক। যেনো খুব সাধারণ কথা বলে চলেছে সে। মেধা আর নিশ্চুপ থাকতে পারলো না। ঢোক গিলে প্রশ্ন ছুঁড়বার আগে আদিত্য বললো,
-“আমার মনে হচ্ছে আমার একা থাকা প্রয়োজন। সম্পর্কের
বন্ধনগুলো আমাকে বড্ড পীড়া দিচ্ছে।”
-“তুমি চলে গেলে আমি বেঁচে থাকবো কি করে?”
-“পৃথিবীর বুকে অন্যান্য বিধবা’রা যেভাবে বাঁচে।”
To be continue…………!!
❝মোহ মেঘের আলাপন ❞
লেখিকা: “নূরজাহান আক্তার আলো”
[২৬]
-“পৃথিবীর বুকে অন্যান্য বিধবা’রা যেভাবে বাঁচে।”
একথা কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই মেধা অশ্রুসিদ্ধ নেত্রে তাকিয়ে রইল। মুখে রা শব্দ নেই। এই প্রথম আদিত্য এত কঠিন কথা শুনালো৷ যে কথা সে কল্পনাতেও আনে না। আচ্ছা, বিধবার কথা বলতে কী তার বিবেকে বাঁধল না? যতগুলো অভিযোগ আছে জানাতে পারতো, দু’ চার থাপ্পড় মেরে ওর ভুল ধরিয়ে দিতে পারতো। তাই বলে একথা বলবে? একবার ভাবলো না সে কষ্ট পাবে কী না? আদিত্য সামনে দৃষ্টি রেখে গাড়ি ড্রাইভ করছে। সে পূর্বের মতোই স্বাভাবিক, নিশ্চল। মেধা দৃষ্টি তুলে জবাবে কিছু বলতে পারল না। ওর নির্বোধ কান্না গলায় দলা পাকিয়ে কিছু উচ্চারণ করতেই দিলো না। শুধু অঝরে ঝরে গেল অশ্রুধারা। কিয়াৎকাল সেভাবেই থম মেরে বসে রইলো সে। তারপর আদুরে বিড়ালছানার মতো আদিত্যের দিকে সরে এসে বাহুতে মাথা ঠেকালো। পরক্ষণেই শব্দ করে কেঁদে উঠলো। এ কান্না হৃদয় পোড়া কান্না। আদিত্যের বাহুতে মুখ গুঁজে শব্দ করে ফুঁপিয়ে কাঁদছে সে।মেধাকে এভাবে কাঁদতে দেখে তখন আদিত্য বললো,
-”বিধবা হওয়ার কথা বলেছি হও নি তো এখনো। তার আগে এত কান্নাকাটি।”
মেধা নিশ্চুপ। সে কান্নাতে ব্যস্ত। আদিত্য তখন মোড় পেরিয়ে
তাদের বাসার সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে বললো,
-”এসে গেছি, যাও তোমার মামনীর কাছে। ভালো থেকো।”
একথা বলে আদিত্য তাকে ছেড়ে দিলেও মেধা ছাড়লো না। বরং আরো শক্ত করে খামচে ধরলো আদিত্যের বুকের শার্ট। বারবার মাথা নাড়িয়ে বোঝাতে লাগল, সে যাবে না,কিছুতেই না। তবে কান্নার চোটে মুখ দিয়ে কথা বের হলো না। আদিত্য বাসার দিকে একবার তাকিয়ে মেধাকে বললো,
-”যেখানে তুমি ভালো থাকবে সেখানেই রেখে যাচ্ছি। তোমার তো আমাকে বাদে সবাইকে প্রয়োজন।”
-”না, আ আমার তোমাকেই লাগবে শুধু, তোমাকেই। প্রমিস,
আমি আর এমন করবো না। এবারের মতো মাফ করে দাও।
বিশ্বাস করো আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারব না, মরেই যাবো। তুমি ছাড়া আমার পুরো পৃথিবী অন্ধকার।”
-”ওহ আচ্ছা।”
-”সত্যি বলছি আমি ভালো বউ হয়ে দেখাবো। তোমার যোগ্য হয়ে উঠবো। প্লিজ আমাকে রেখে যেও না।”
-”লোক দেখানো কাজে স্বার্থকতা নেই।”
-”আদিত্য আর একবার সুযোগ দাও। সত্যি তোমাকে ছাড়া আমি শূন্য। বাবা মায়ের পর তুমি আর মামনী আমার ছায়া।
এখন তুমি যদি ছেড়ে যাও আমি একেবারে শেষ হয়ে যাবো, মরে যাবো।”
-”আগে মনে ছিল না?”
আদিত্য জোর করে তার বুক থেকে মেধার মুখ তুলে চোখে চোখ রাখল। মেধার চোখ অশ্রুজলে টইটুম্বুর। তারপর শান্ত ভাবে বলতে থাকলো,
-“প্রিয়জনের মূল্য বুঝলে হলেও দূরত্বের প্রয়োজন। প্রিয় কারো অনুপস্থিতি যদি তোমাকে ভীষণভাবে পোড়ায়, বুকে দহন সৃষ্টি করে। তাহলে বুঝবে তুমি ভালোবাসতে শিখেছো।
তোমার হৃদয় অন্য কারো দখলে। শোনো, ভালোলাগা আর ভালোবাসা এক নয়। তুমি বোধহয় ভালো লাগাতেই আঁটকে আছো। ভালোলাগা ক্ষণিকের, যেটা অস্থায়ী। যদিও বিয়ের পর এসব কথা মোটেও শোভনীয় নয়। কিন্তু বর্তমানে আমার মনে হচ্ছে আমাদের আরো সময় নেওয়া উচিত ছিল।একথা কেন বলছি জানো, কারণ তুমি তোমার অনুভূতি নিয়ে নিজে সন্দিহান। নিজের মন কী চাই তুমি এখনো জানো না।বোঝো না প্রিয় মানুষটাকে। এমনকি তার চাওয়া পাওয়ার দাম নেই তোমার কাছে। তার প্রতি তোমার অনুভূতিও নিষ্প্রাণ।”
-”আমি তোমাকে ভালোবাসি আদিত্য।”
-”এজন্যই আমার মূল্য এত ঠুনকো তাই না?
-” এতকিছু জানি না, জানতেও চাই না। আমি তোমাকে কোথায় যেতে দিচ্ছি না, মানে দিচ্ছি না। এরপরেও যদি যাও, আমি সুইসাইড করবো, পাক্কা প্রমিস।”
-”আবেগ দিয়ে জীবন চলবে না মেধা। আর সবকিছুতে রাগ, জেদকে, প্রশ্রয় দিতে নেই। কারণ আবেগ আজ আছে কাল নেই। সময় তোমাকে আবেগের রুপ দেখিয়ে দিবে। এর চেয়ে তুমি সময় নিয়ে ভাবো তোমার মনকুঠুরিতে আমার অবস্থান ঠিক কোথায়।”
-”বাসায় চলো।”
-”এসেছিই তো, ভেতরে যাও তুমি।”
-”না, আমি আমার সংসারে ফিরতে চাই।”
-”সংসার তোমার সঙ্গে গড়তে চেয়েছিলাম। ভাগ্যে নেই, বাদ দাও। তবে সংসার সাজাতে হলে বিশ্বাস, দায়িত্বশীলতা আর ভালোবাসার প্রয়োজন। যেখানে আমাদের সম্পর্কে এসবের স্থান নেই সেখানে সুখী সংসারের কথা ভাবাও বোকামি।”
-”এভাবে কথা বলছো কেন তুমি? ওহ এখন আমাকে ভালো লাগছে না তাই না?”
-”তোমাকে বুঝতে আর বোঝাতে আমি এবার ক্লান্ত। আমার
অনুভূতি অনুভব করতে পারলে একথা বলতে পারতে না। ”
মেধা দৃষ্টি নত করে আদিত্যের বাহুতে মাথা ঠেকাল। এতবার বলেও তাকে নামানো গেল না৷ জোরপূর্বক নামানোর ইচ্ছেও আদিত্যের নেই। তাছাড়া বেলকণিতে ওর বাবা মা হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। হয়তো ভেবেছেন তারা ফিরে এসেছে। বাবা মায়ের প্রতি আদিত্যের অনেক অভিমান জমেছে, অনেক। সে বাসা ছেড়ে যাওয়ার সময় তার মা একবার নিষেধ করতে পারতো। প্রয়োজনে মেরে হলেও তাকে আঁটকাতে পারতেন। কিন্তু তা করে নি। উনি তো এটাও জানতেন আদিত্য উনাকে ছাড়া থাকতে পারে না। ছোট থেকেই সে খুব মা ভক্ত। বাইরে খাবারে তার পেটও ভরে না। যতক্ষণ না মায়ের হাতের রান্না পেটে পড়ে। অথচ ওর মা তার অভিমান তো বুঝলো না বরং উনিও অভিমান করে চুপ থাকলেন। বড় হয়ে গেছে বলে কী শাসন করতে পারতেন না? মনে মনে এসব ভেবে গাড়ি স্টার্ট করে সেখানে থেকে চলে এলো তারা। ওদেরকে যেতে দেখে সীমা বেগম আঁচলে চোখ মুছে ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বললেন,
-”আমার ছেলে মেয়েরা কত বড় হয়ে গেছে তাই না? আমার আদিত্যটা হয়তো ভুলেই গেছে আজ তার মায়ের জন্মদিন। প্রতি বছরের মতো এবারও আমার তিন ছেলে মেয়ের জন্য উপহার কিনে এনেছি। সেই সঙ্গে অপেক্ষা করছি তারা এসে কখন বলবে, ‘আম্মু আমরা তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি। এ বার বোধহয় কেউ আসবে না আমার কাছে। মূল্যহীন হয়ে গেছি কী না!”
সহধর্মিণীর কথা শুনে আদিত্যের বাবা এবার মুখ খুললেন,
-”সেদিন আদিত্যকে না নিজে আঁটকালে আর না আমাকে আঁটকাতে দিলে। এটা কী ঠিক হয়েছে? আমাদের ছেলেটা এখন বড় হয়েছে সীমা, তার নিজস্ব সুখ-দুঃখ মান অভিমান আছে। আর আমান যা করেছে রাগ করা কী স্বাভাবিক নয়? তাছাড়া আমাদের কী উচিত ছিলো না আদিত্যকে যেভাবেই হোক আঁটকানো। আমরা তো জানতাম রাগের বশে যাচ্ছে সে। সেদিন আঁটকালে এই ঘটনা এতদূর অবধি গড়াতো না।”
-“মেধার বয়স কম। বুদ্ধিই বা কতটুকু বলো? তারা আলাদা হয়েছে একপক্ষে ভালোই হয়েছে। দু’জন একসঙ্গে থাকবে, একে অপরের বুঝতে শিখবে৷ একে অন্যের চাওয়াকে গুরুত্ব
দিবে। আর সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে গেলে বোঝাপড়াটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ একটা সম্পর্কের খুঁটিই হচ্ছে বোঝাপড়া। এই সুযোগে ওদের সম্পর্কের ভীতটা আরো মজবুত হোক।”
-”ভেবে চিন্তে যখন এই সিদ্ধান্ত নিয়েছো তাহলে এখন কষ্ট পাচ্ছো যে?”
জবাবে সীমা বেগম শুধু হাসলেন। এই উত্তরটা উনার জানা নেই।তারপর উনারা নীরবে অশ্রু ঝরিয়ে রুমে চলে গেলেন।
সেদিন রাতে আমান বাসাতেই ফিরলো না। কিন্তু আদিত্যের মাঝরাত থেকে ভীষণ জ্বর এলো। জ্বর কমছে না দেখে মেধা দিশাহারা হয়ে ব্যাঁকুল হয়ে কাঁদতে কাঁদতে সীমা বেগমকে কল করলো। সীমা বেগম তখনো অপেক্ষায় ছিলেন উনার ছেলে মেয়েদের।উনার মন বলছিলো, কেউ উয়িশ করুক বা না আদিত্য উনাকে যেভাবেই হোক উয়িশ করবেই করবে।
মাঝরাতে যখন ফোনে রিংটোন বেজে উঠলো তখন উনার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। মেধার নাম্বার দেখে হাসি দীর্ঘ হলো।
কিন্তু কল রিসিভ করতেই শুনতে পেলে মেধার কান্নার শব্দ। ক্ষণিকেই উনার হাসি মিলিয়ে বুকটা কেঁপে উঠলো। তখন মেধা জানালো আদিত্যের জ্বরের কথা। উনি একথা শুনেই চট করে আদিত্যের বাবাকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। যথাসময়ে তারা আদিত্যের ফ্ল্যাটে পৌঁছালেন একজন মাঝ বয়সী ডাক্তারকে নিয়ে। ডাক্তার বলার আগেই সীমা বেগম বালতিভর্তি পানি এনে মাথায় ঢালতে থাকলেন। বার বার ডাকতে থাকলেন ছেলের নাম ধরে। সহজে আদিত্যের জ্বর
আসে না, আর আসলে ভীষণভাবে ভুগতে হয়। মায়ের ডাক শুনে আদিত্য অনেক কষ্টে একবার তাকিয়ে দেখলো। মাকে দেখে শুকনো ঠোঁটে কিঞ্চিৎ হাসির রেখা দেখা দিলো। সেই সঙ্গে চোখ ফেটে গড়িয়ে গেল অশ্রুকণা। সীমা বেগম নিজে
মুছে দিলেন সেই নোনাজল। উনি বুঝতেও পারলেন ছেলের কষ্টটা। তখন আদিত্য মায়ের হাতটা বুকে চেপে ধরে বিরবির করে বললো,
-”আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি মা, ভীষণ ভালোবাসি। প্রতিবছরের মতো এবারও চাইছি, আল্লাহ আমার আয়ুটুকু তোমাকে দিকে। আর তুমি আমাদের সবার মা হয়ে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকো। ”
To be continue………!!