মৌমোহিনী পর্ব-০১

0
7

#মৌমোহিনী
পর্ব-১
সুমাইয়া আমান নিতু

মেয়েটার প্রোফাইল পিকচারে চোখ আটকে গেল তৌকির সাহেবের। একটু আগেই ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে সে। নাম মনিকা চৌধুরী, নিকনেম মৌটুসী। অনেকগুলো মিউচুয়াল ফ্রেন্ড দেখে মেয়েটার প্রোফাইল চেক করতে ঢুকেছিলেন তিনি। কিন্তু চোখ আটকে গেছে শুরুতেই। পিঠখোলা ব্লাইজে তার চমৎকার দেহবল্লরী ফুটে আছে। ঠোঁটে রহস্যময় হাসি। চোখে অদ্ভুত রকমের দ্যুতি৷ অনেকদিন তিনি এমন মেয়ে দেখেননি। তার কেমন ঘোর লেগে গেল সেদিকে চেয়ে থেকে।

কিছুক্ষণ পর তিনি মেয়েটার প্রোফাইলটাও একটু ঘেটে দেখলেন। সমসাময়িক নানা বিষয়ে লেখালেখি করে মেয়েটা৷ বেশ বুদ্ধিমতী বলেই মনে হয়। পড়াশুনা করছে প্রথম সারির প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে।

আর বেশি ভাবাভাবির দিকে গেলেন না তিনি। রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করে ফেললেন৷ এরপর সোজা চলে গেলেন মেয়েটার প্রোফাইলের ‘Photos’ অপশনে।

অনেকক্ষণ ধরেই গভীর মনোযোগে কিছু করতে দেখে তার স্ত্রী প্রিয়াঙ্কা জিজ্ঞেস করলেন, “করছোটা কী তুমি?”

তৌকির সাহেব মুখ তুলে চাইলেন, “হু?”

“এত মনোযোগ দিয়ে কী দেখছো?”

“একটা জরুরি লেখা পড়ছিলাম।”

“ওহ!”

তৌকির সাহেবের মেয়ে তিন্নি এসে বাবার গলা জড়িয়ে ধরলে তিনি স্ক্রিন লক করে ফোনটা আলগোছে পাশে রেখে দিলেন। তারপর নানা কাজে ডুবে যাওয়ার আর তার মনে রইল না মনিকা চৌধুরীর কথা।

তিনদিন পর মনিকার প্রোফাইল থেকে নতুন একটা ছবি আপলোড হলো তার স্টোরিতে। তৌকির সাহেব ছবিটা অকারণেই খুঁটিয়ে দেখলেন। কেন মেয়েটার প্রতি এত আকর্ষণ হচ্ছে কে জানে! বোধহয় এমন ব্যক্তিত্বে ঝলমল করা সুন্দরী তিনি বহুদিন দেখেননি৷ একসময় তার স্ত্রী ছিলেন তার দেখা সে সময়ের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বুদ্ধিদীপ্ত তরুণী। জীবনের আরেক প্রান্তে এসে সেই মেয়ের সৌন্দর্যে এখন ভাটার টান পড়েছে। যদিও প্রিয়াঙ্কা এখনো ভীষণ স্মার্ট, তবুও শরীর আর স্বভাবের সেই চটকটা আর নেই। এজন্যই কি তার চোখ নতুন কাউকে খুঁজে বেড়াচ্ছে?

তিনি নিজের অজান্তেই হাসির রিয়েক্ট পাঠিয়ে দিলেন ছবিটাতে। এটা কেমন হলো? সাথে সাথে মেসেজ পাঠালেন তিনি, “স্যরি, ভুলে রিয়েক্ট চলে গেছে।”

মেয়েটা একটু পর রিপ্লাই করল, “ইটস ওকে! আপনি হাসলেও আমি মাইন্ড করতাম না।”

“কেন?”

“হাসলে হার্ট ভালো থাকে। আমার ছবি দেখে যদি হার্টের উপকার হয় তো হোক না!”

“বরং উল্টোটা। আপনার ছবি দেখলে হার্টের উপকারের বদলে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বেড়ে যায়।”

“ওমা তাই নাকি? তাহলে ছবি আপলোড কমিয়ে দিতে হচ্ছে!”

“না না, তা কেন? কিছু কিছু হার্ট অ্যাটাক স্বাস্থ্যের জন্য ভালো।”

“আপনি ফ্লার্ট করছেন!”

“আপনার মতো কারো সাথে ফ্লার্ট করাটা কি অস্বাভাবিক?”

“উহু, তবে আপনার ব্যক্তিত্বের সাথে যাচ্ছে না।”

“পুরুষ মানুষের যেসব জায়গায় দুর্বল হয় তার মধ্যে একটা হলো নারীর সৌন্দর্য।”

“প্রশংসার জন্য ধন্যবাদ। আমার এখন ক্লাস আছে। আপনার সাথে কথা বলে খুব ভালো লাগল। আবার কথা হবে।”

তৌকির সাহেব ফোন রেখে কাজে ডুবে গেলেন৷ খানিক পর তার অবচেতন মনে প্রশ্ন এলো, ইদানীং এক্সপোজ এক্সপোজ খেলা বেড়ে গেছে৷ এরকম মেয়েরা সুন্দরমতো আগে পুরুষদের সাথে কথা বলে, তারপর সব স্ক্রিনশট ফাঁস করে দেয়। যদি তারও স্ক্রিনশট ফাঁস হয় তাহলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে৷ তিনি আবেগের বশে এত কথা বলে ফেলেছেন৷ এখন ফেঁসে গেলে কেমন হবে? স্ক্রিনশট ইতিমধ্যে নিয়ে ফেললে কথা ডিলিট করে লাভ হবে না।

কিছুক্ষণ ভাববার পর তার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেলো৷ তিনি ফেসবুকে পোস্ট করলেন, তার আইডি কিছু সময়ের জন্য হ্যাক হয়েছিল। আবার উদ্ধার করা গেছে৷ এর মধ্যে তার আইডি থেকে কোনো ব্লান্ডার হয়ে গিয়ে থাকলে তিনি ক্ষমাপ্রার্থী।

পোস্ট দিয়ে নিশ্চিন্ত মনে আবার কাজে ডুবলেন তিনি। আর ঝামেলা নেই।

দিনকতক আর মনিকা কোনো ছবি আপলোড দিল না। তৌকির সাহেবের সাথে কোনো কথাও হলো না৷ মেয়েটা সারাদিনই ফেসবুকে পোস্ট করে, বিভিন্ন ফানি কিংবা সিরিয়াস বিষয় শেয়ার করে৷ সেগুলো খুব আগ্রহ করে পড়েন তিনি, তবে রিয়েকশন দেন খুব কম, বেছে বেছে।

প্রায় সপ্তাহখানেক পর এক বৃষ্টির দিনে আবার মনিকার ছবি দেখা গেল স্টোরিতে। মেয়েটা বুঝি শাড়ি ভালোবাসে! পিঠখোলা সাদা ব্লাউজ, গায়ের সাথে ভিজে লেপ্টে থাকা সবুজ শাড়িতে ওকে প্রচন্ড আবেদনময়ী লাগছে। তৌকির সাহেব বহু চেষ্টাতেও সেদিক থেকে চোখ ফেরাতে পারলেন না। ছবিটার স্ক্রিনশট রেখে দিলেন তিনি। দেখা গেল একটু পরপর সেটা বের করে দেখছেন৷ পাগল হয়ে গেলেন না তো? নিজেরই সন্দেহ হতে লাগল তার।

***

তৌকির সাহেব সরকারের যে পদে চাকরি করেন তা কোনোভাবেই হেলাফেলা করার মতো নয়৷ এত গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে এতখানি ক্ষমতা হাতে রেখে নিজের কাজটা দায়িত্বের সাথে করার মতো কঠিন আর কিছু হয় না। রোজ রোজ এই লড়াইটা লড়তে হয় তার৷ মাঝে মধ্যে এত কাজের প্রেশার নিতে ইচ্ছে করে না। ইচ্ছে করে কোথাও চলে যেতে। একেকবার মনে হয়, টাকাপয়সা তো কম নেই, মাসখানেকের জন্য যদি নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া যেত? পাহাড়ি কোনো এলাকায় বাস করা যেত ক’টা দিন?

এই উদ্ভট ইচ্ছেটা তার শুধু আজ না, বহুদিন ধরেই হয়। আজকাল যেন তা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। কিছুই ভালো লাগে না। ফাইলপত্র ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। কাজে মন বসে না।

একদিন প্রিয়াঙ্কা জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার কি কোনো সমস্যা হয়েছে?”

প্রিয়াঙ্কাকে ইদানীং খুব বিরক্তিকর চরিত্র বলে মনে হয়৷ এমনকি তিন্নির জন্যও আগের মতো টান কাজ করে না। কেন তিনি এমন হয়ে যাচ্ছেন বুঝে উঠতে পারেন না তৌকির সাহেব। তিনি জবাব দিলেন, “হুম। কথা বলতে ভালো লাগে না এখন।”

প্রিয়াঙ্কা কী বোঝে কে জানে! এ নিয়ে আর উচ্চবাচ্য করে না সে।

একদিন মনিকার একটা পোস্টে চোখ আটকে যায় তৌকির সাহেবের।

“বড় ইচ্ছে হয় কিছুদিনের জন্য কোথাও নিরুদ্দেশ হয়ে যেতে! সাথে থাকবে প্রিয় কোনো মানুষ। পৃথিবী থেকে আলাদা হয়ে থাকব শুধু আমরা দু’জন। জমাবো কিছু স্মৃতি, যা রূপোর বাক্সে ভরে রেখে দেব মনের গহীনতম কোণে। কোনো ধুলো পড়বে না তাতে। যখন ইচ্ছে হবে বের করে দেখব। একটু ছুঁয়ে দেব। আবার রেখে দেব অতি যত্নে।”

তৌকির সাহেব নিজেকে আটকাতে পারেন না। মেসেজ করেন, “আমারো আপনার মতোই হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু এত সুন্দর করে বলতে পারি না।”

মনিকা উত্তর দেয়, “কোথায় হারাতে ইচ্ছে হয়?”

“জানি না।”

“আমার সাথে যাবেন?”

তৌকির সাহেব তৎক্ষনাৎ কোনো উত্তর দিতে পারেন না। কেমন যেন হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। আচমকা আসা আনন্দের স্রোত তাকে ঠেলে নিয়ে যেতে থাকে দূরে কোথাও, যেখান থেকে সুখের দরজাটা স্পষ্ট দেখা যায়।

তিনি লিখলেন, “আপনার সাথে যাব মানে?”

মনিকা কিছুটা সময় নিয়ে লিখল, “দেখুন, আমি আধুনিকা। অত সংষ্কার নেই মনে। আপনি চাইলে আপনার সাথে আমি ঘুরতে যেতে পারি। আমরা একে অপরের সঙ্গী হিসেবে যাব ফিফটি ফিফটি শেয়ারে। আমার সঙ্গ আপনাকে দেব, বিনিময়ে আপনি আমার খরচ বহন করবেন। তবে দু’জনেই সবকিছু ভুলে কেবল যাব কিছু সুখস্মৃতি বাক্সবন্দি করে আনতে।”

তৌকির সাহেবের কথা হারিয়ে গেল। অনেকক্ষণ পর তিনি জবাব দিলেন, “যাচ্ছি আমরা।”

***

কিছুদিন পর তিনি যখন মনিকার হাত ধরে ব্যাংককের এক বিলাসবহুল হোটেল কক্ষে পা রাখলেন, তখন তার নিজেরই কেমন যেন অবিশ্বাস্য লাগতে থাকল সবটা। সত্যিই কি তিনি অর্ধপরিচিত এক নারীর হাত ধরে এতটা চলে এলেন? নিষিদ্ধ আকর্ষণ এতটাই তীব্র হতে পারে?

মনিকাকে তিনি বলে রেখেছিলেন, তার শাড়ি পছন্দ। মেয়েটা শাড়ি পরে আসেনি ঠিকই, তবে গোসল করে একটা শাড়ি পরে বের হলো।

বেগুনী রঙের সিল্কের শাড়ির আঁচল বুকের একপাশ ঢেকে রাখলেও অপর পাশ উন্মুক্ত। সাদা পাথর বসানো ব্লাউজ দেখে মনে হচ্ছে তাতে হীরের টুকরো জ্বলজ্বল করছে৷ তৌকির সাহেবের মনে হচ্ছে ওর বুকে সত্যিকারের হীরকচূর্ণ সেঁটে দিলে মন্দ হতো না। কিন্তু তার তেমন সাধ্য নেই।

মনিকার চোখে মাদক চাহনি। এক আঙুলের ইশারায় সে কাছে ডাকে তৌকির সাহেবকে।

তিনি নিজেকে আর সামলে রাখতে পারেন না। ডুবে যান মনিকা নামক রহস্যময়ীর গভীরে। তবুও রহস্য যেন শেষ হয় না৷ থ্রিলার গল্পের পাতার মতো মতো ওর ভাজে ভাজে নতুন রকম উত্তেজনার খোঁজ পেতে থাকেন তিনি।

(চলবে)