মৌমোহিনী পর্ব-০৭

0
8

#মৌমোহিনী
পর্ব-৭

লুনা ল্যাটে কফিশপের একটা কোণায় পাশাপাশি বসে দু’জন ধীরে ধীরে কফিতে চুমুক দিচ্ছে। পুরো কফিশপটা কফির ঘ্রাণে ভরপুর হয়ে আছে। সাথে মৃদু পিয়ানোর ধ্বনি বেজে চলছে। বেশ পশ কফিশপ। পুরোটা ডার্ক থিমে বানানো। দেয়ালে এবস্ট্রাকট পেইন্টিং ঝুলছে। বছরের পর বছর চেয়ে থাকলেও এর অর্থ বের করা যাবে না, কিন্তু দাম নিশ্চয়ই আকাশছোঁয়া! নরম আলোতে সবার চোখমুখ প্রশান্ত দেখাচ্ছে। মুশফিকের থেকে কবিতা শুনতে শুনতে মনিকার মনে হলো কবিতা পড়ার জন্য জায়গাটা চমৎকার! একটা রোমান্টিক ভাইব আছে।

একটা কবিতা শেষ করে মুশফিক হাসলেন৷ মনিকার মনে হলো কী সুন্দর হাসি! কী সুন্দর ঠোঁট! চুমু খেতে ইচ্ছে করছে। সে একটু বিরক্ত হলো নিজের ওপর। লোকটা তার সাথে অন্তরঙ্গ হবার প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখায়নি। কেবল কবিতা, আর স্মৃতিচারণ নিয়েই আছে। কিছুটা বাউণ্ডুলে চরিত্র, কিন্তু পোশাক আশাকে পকেটের অবস্থা আন্দাজ করতে কষ্ট হয় না৷ ভালো সময় কাটাতে চেয়েছিল, সময় খারাপ কাটছে না। তবে তারও কেমন যেন নেশার মতো হয়ে গেছে শরীরী ভালোবাসার ব্যাপারটা। ওটা না হলে যেন ঠিক জমে না৷ এসব কবিতা টবিতা সব হলো ধোঁয়ার মতো, ধরা যায় না, অনুভব করা যায় না৷

“কী ভাবছ এত?” জিজ্ঞেস করলেন মুশফিক৷

“উমম… না, কিছু না।”

“এই, ‘কিছু’ শব্দটা আবার বলোতো?”

“কেন?”

“আহা বলো না!”

“কিছু।”

“আবার!”

“কিছু।”

“এটা বলার সময় তোমার ঠোঁটটা গোল হয়ে আসে, তখন এত সুন্দর লাগে দেখতে!”

মনিকা হাসল। মনে মনে বলল, ভালো লাগলে চুমু খা! কে বাঁধা দিচ্ছে? তা না করে কিছুমিছু হাবিজাবি বলাচ্ছিস! বেকুব লোক!

মনিকা আজ শাড়ি পরে এসেছে। মেরুন জামদানি শাড়ি। কপালে ছোট্ট টিপ, কানে ঝুমকা, আর খোপায় বেলীফুলের গজরা। গজরাটা ওকে তৌকির কিনে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন শাড়ির সাথে পরে দেখাতে। সে দেখাচ্ছে মুশফিককে। ভাবতেই হাসি পেয়ে গেল।

মুশফিক আবার কবিতা পড়তে শুরু করে দিয়েছেন। কবিতা আর কাল্পনিক প্রেম বাদে দুনিয়ার কোনোকিছুর প্রতি কি এর ইন্টারেস্ট নেই নাকি? সে শাড়ি ঠিক করার বাহানায় বুকের একপাশটা আরেকটু বের করে দিল।

সেটা আঁড়চোখে দেখে মনে মনে হাসলেন মুশফিক ওরফে আরিফ। ওরে ছটফটানি পাখি, এত সহজে তোমাকে ধরে ফেললে কাজ হবে? ওই শরীরটুকু দিয়ে তুমি হাওয়া হয়ে যাবে। আমার যে মনের গভীরের সত্যিটা জানা চাই!

কফিশপ থেকে বের হয়ে আরিফ ড্রাইভ করে মনিকাকে বাড়ি পৌঁছে দিলেন। ওর বাড়ির সামনে এসে গাড়ির পেছনের সিট থেকে কয়েকটা প্যাকেট বের করে ওর হাতে দিয়ে বললেন, “তোমার জন্য এনেছি। প্লিজ নাও, না করো না।”

মনিকা খুশি হয়েই নিল। তাকে নিজের ফ্ল্যাটে ইনভাইটও করল। কিন্তু মুশফিক রাজি হলেন না। তার নাকি জরুরি কাজ আছে।

মনিকা নিজের ফ্ল্যাটে ঢুকে প্যাকেট খুলল। চমৎকার একটা ড্রেস। সাথে মানানসই জুয়েলারি। নেকলেসটা দেখে সে প্রথমে ডায়মন্ড ভেবে লাফিয়ে উঠতে যাচ্ছিল। কিন্তু পরে বুঝল ওটা ডায়মন্ড নয়। ডায়মন্ড কাট মাত্র৷ অবশ্য প্রথম দেখাতেই কোনো বিনিময়মূল্য না নিয়েই ডায়মন্ড, তাও এত ভারী নেকলেসে, সেটা আশা করাটা একটু বেশিই বাড়াবাড়ি। যাকগে, এটাও কম সুন্দর না।

মনিকার মনে হলো, লোকটা কি তবে সত্যিই তাকে কাছে পেতে চায় না? কেবল কল্পনার প্রেমিকার মতো চেহারা বলে দেখেই সুখ পেয়ে যাচ্ছে? কে জানে! প্রথমদিন লোকটার কথা বিশ্বাস হলেও পরে মনে হয়েছে সবটাই গাঁজাখুরি গপ্পো! তাকে পটানো কঠিন ভেবে ওসব বলেছে। সে যে পকেট গরম থাকলেই শুয়ে পড়তে পারে তা হয়তো জানে না৷ আজ তার ব্যবহারে সে তাই অবাকই হচ্ছে। ফ্ল্যাটে যাবার আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দিল কেন?

******

“তোমার কি কাণ্ডজ্ঞান বলে কিছু নেই? মানে একটুও থাকবে না তা কেমন করে হয়? এই তোমাকে আমি এত জরুরি মিশনে পাঠিয়েছি? আমিই একটা গর্ধব।” প্রচন্ড রাগে ফেটে পড়তে পড়তে কথাগুলো বললেন ফারহান রুশদি। তরুণ রাজনৈতিক নেতা বাইরে যতটা নম্র, রেগে গেলে ততটাই ভয়ানক। এই রাগ এর আগে একবারই দেখেছে মনিকা, যখন সে তার পার্সোনাল নাম্বারে রাতের বেলা কল করে ফেলেছিল, যেটাতে তার কল করা এলাওড ছিল না৷

মনিকা ভীত কণ্ঠে বলল, “আমি কী করেছি?”

“আজকে কার সাথে বাইরে গিয়েছিলে? কে তোমাকে ড্রপ করে গেছে?”

“তুমি আমার প্রোফেশন জানো।”

“তোর প্রোফেশনের মুখে আমি ****। অ্যাই, তোকে আমি টাকা কম দিচ্ছি? তৌকিরের থেকে তুই টাকা কম নিছিস? তাহলে আরো কিসের টাকা লাগে তোর? তোকে আমি শুরুতে বলে নিছিলাম না এই মিশন চলাকালে আর কারো সাথে মেশা যাবে না? বলি নাই?”

বলেছিলেন তিনি। কিন্তু কথাটা তেমন জোর দিয়ে নয়, হালকাভাবে বলায় অতটা মনেই ছিল না মনিকার। আর তাছাড়া সে ভেবেছিল এটা শুধুই সেফটি পারপাজে বলে রাখা। এখন তো কোনো ঝামেলা হচ্ছে না। সে বলল, “ওর সাথে আমি জাস্ট কফিশপে গেছি৷ কবিতা শুনিয়েছে শুধু। হাতটা পর্যন্ত ধরেনি। তাতে কী হয়ে গেছে?”

রাগ কিছুটা সামলে নিয়ে ঠান্ডা মাথায় প্রশ্ন করলেন ফারহান, “তোমার ব্যক্তিগত বিষয়ে কিছু জানতে চেয়েছে?”

“না।”

“কিছুই না?”

“একটা শব্দও না।”

“না হোক, তবুও সমস্যা আছে৷ ওর সাথে সব যোগাযোগ বন্ধ করে দাও। ফেসবুক প্রোফাইল লক করে দাও। নতুন কাউকে অ্যাড করবে না। আর তৈরি থেকো। কাল দিনের যে কোনো সময় তোমাকে শহর ছাড়তে হবে। গাড়ি যাবে তোমার বাসার সামনে। চুপচাপ বেরিয়ে যাবে। হ্যান্ডব্যাগ ছাড়া আর কিচ্ছু নেবে না। যেন মনে না হয় দূরে কোথাও যাচ্ছো। যাবার আগে যে সিম দিয়ে তৌকিরের সাথে কথা বলো সেটা আর অন্য যেটা দিয়ে বাকিদের সাথে কথা বলো সেটাও নষ্ট করে বাথরুমে ফ্ল্যাশ করে দেবে। তোমাকে ট্রেস যেন না করা যায়। মোবাইল যেটা সবসময় ব্যবহার করো সেটাও রেখে আসবে৷ ছোটো মোবাইলটা আনবে, সাথে এই সিম।”

মনিকা স্তব্ধ হয়ে শুনছিল। জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু কেন?”

“যা বলছি করো। পরে সব বলব।”

মনিকা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “আমার কি লাইফ রিস্ক আছে?”

“আরে না বাবা, তোমাকে কেউ চব্বিশ ঘন্টা নজরে রাখছে। মানে স্পাই লাগিয়েছে।”

“তুমি জানলে কেমন করে?”

“তুমি চব্বিশ ঘন্টা আমারও নজরবন্দিতে আছো ডার্লিং। আমার স্পাই অন্য স্পাইকে ধরে ফেলেছে। এখন ধরা খেলে তুমিও মরবে, আর আমিও। তাই চুপচাপ বেরিয়ে পড়বে।”

কল রেখে ফারহান রুশদি পায়চারি করতে লাগলেন ঘরময়। এই কাজে আরো ইন্টেলিজেন্ট কোনো মেয়ে ব্যবহার করা উচিত ছিল। এই মেয়েটাও বুদ্ধিমতী, তবে লোভী। সবকিছুর লোভ ওর। টাকাপয়সা, শরীর, ভালোবাসা। স্পাইগিরি এভাবে হয় না। তবে তার হাতে সবচেয়ে সুন্দর ট্রামকার্ডটা ছিল এই মনিকাই। তৌকিরকে পটাতে সুন্দরীর দরকার ছিল৷

হয়তো এসবের মধ্যে ওর চেয়ে তার নিজের নির্বুদ্ধিতাই বেশি ছিল, সেই একটু তাড়াহুড়ো করে ফেলেছিল। এখন মেয়েটাকে কী করা যায়? ও সব জানে। ওকে সরিয়ে ফেলবে নাকি?

*******

তৌকির সাহেব অসুস্থতার জন্য দু’দিন অফিস থেকে ছুটি নিয়েছেন৷ প্রোজেক্ট স্থগিত হওয়াতে ছুটি পেতে অসুবিধা হয়নি। বাসায় বসে কেবল মাথায় আজেবাজে চিন্তা আসছে তার। তিন্নি এদিকে মহাখুশি। স্কুল থেকে ফিরে বাবাকে দেখে সে আনন্দে আটখানা হয়ে গেছে। তৌকির সাহেব খেয়াল করলেন মেয়ের সাথে খেলতেই ভালো লাগছে, চিন্তা থেকে সাময়িক মুক্তি পাওয়া যাচ্ছে। তার যা টাকাপয়সা এখন আছে, তাতে চাকরি চলে গেলে শহরে টেকা কঠিন হয়ে যাবে। বড়জোর বছরখানেক চলতে পারবেন। তিনি চাকরির ফাঁকফোকর দিয়ে আসা সম্পদের দিকে কখনো হাত বাড়াননি। তার নৈতিকতা তাকে সেদিকে যেতে দেয়নি। সেটা করলেই বরং ভালো হতো, এখন এই বয়সে এসে চাকরি খোয়ালে কী অবস্থা হবে তা ভাবতে ভাবতে অস্থির হতে হতো না। আবার এটা ভেবেও হাত কামড়াতে ইচ্ছে করে যে, মনিকার ব্যাপারটাতে তার কেন নৈতিকতা কাজ করল না?

এগারোটার দিকে তার ফোনে জুবায়ের আলমের কল এলো। তিনি কল রিসিভ করে সালাম দিলেন।

জুবায়ের আলম বললেন, “আপনার সাথে কথা ছিল, কিন্তু অফিসে এসে দেখি আপনি ছুটিতে।”

“স্যার খুব জরুরি দরকার? আসব?”

“না না, আপনি অসুস্থ, রেস্ট নিন। আমি ফোনেই বলছি। আচ্ছা তৌকির সাহেব, আপনার কি কাউকে সন্দেহ হয়?”

তৌকির সাহেব ঢোক গিলে বললেন, “জি? কী নিয়ে?”

“আরে প্রোজেক্টের তথ্য লিক হওয়া নিয়ে?”

“নাহ, আমার তো মাথায় কিছু ঢুকছে না। কাকে সন্দেহ করব বলুন তো?”

“কায়সার ছেলেটাকে আমার সুবিধার মনে হয় না। জয়েনিংয়ের পর থেকে দেখছি প্রচন্ড লোভী এই ছেলে। আমি ওকে প্রোজেক্টে নিতে চাইনি। কিন্তু রিজভী স্যারকে কেমন করে এই ছেলে হাত করেছে কে জানে? আপনাকে বলে রাখলাম কেবল৷ আর কাউকে বলতে ভরসা পাচ্ছি না। কে কী মনে করবে, কার সাথে কার যোগসাজ যোগসাজশ আছে তা তো জানি না। আপনাকে নিয়ে চিন্তা নেই বলেই বললাম। এসব অবশ্য আমার কাজ নয়, তদন্ত কমিটির কাজ। আপনি অফিসে এলে আরো ডিটেইলড আলোচনা করা যাবে। এখন রেস্ট নিন বরং।”

তৌকির সাহেব কিছুক্ষণ থম ধরে বসে রইলেন৷ সাইড টেবিল থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে ঢকঢক করে ঢেলে দিলেন গলায়। তিনি ভেবেছিলেন সব সন্দেহের তীর তার দিকে! এদিকে স্বয়ং জুবায়ের আলম সন্দেহ করছেন আরেকজনকে! তাকে কি কেউ সন্দেহও করছে না? তার ধরা পড়ার সম্ভাবনা কি তবে কম?

আরিফকে ফোন করে কথাটা জানিয়ে দিলেন তিনি। আরিফ একটু চিন্তিত। জিজ্ঞেস করলেন, “মনিকার খবর জানিস?”

“না তো, যোগাযোগই হয় না কবে থেকে!”

“ওই মেয়ে দু’দিন আগে পালিয়েছে। এমনভাবে পালিয়েছে যে সন্দেহ করার উপায় ছিল না। আমার লোক বেশিদূর ফলো করতে পারেনি। তার আগেও হাওয়া হয়েছে। হয়তো শহর ছেড়ে উধাও হয়েছে। আমাকেও ফেসবুক থেকে আনফ্রেন্ড করে আইডি লক করে দিয়েছে। এতকিছু করেও আমি ধরা খেলাম কেমন করে বুঝলাম না৷ এ সহজ খেলোয়াড় নয় রে, বারবার টেক্কা দিয়ে যাচ্ছে। আমি বোধহয় সহজ শিকার ভেবে ভুল করে বসেছিলাম।”

“তাহলে?”

“দেখছি।”

তৌকির সাহেব বুঝলেন আরিফ ব্যাপারটা পার্সোনালি নিয়ে ফেলেছে। এখন সমাধান না করে ছাড়বে না।

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু