মৌমোহিনী পর্ব-১০

0
9

#মৌমোহিনী
পর্ব-১০

ভিডিও দেখতে দেখতে আরিফের মনে হলো সে কোনো নাটকের মঞ্চায়ন দেখছে। এই নাটকের পাত্র পাত্রী অভিনয় করছে নাকি সত্যিই তারা কাহিনীতে ঢুকে গেছে তা এক রহস্য। এদের বাহ্যিক আচরণের সাথে সাথে মনস্তাত্ত্বিক যে ভয়ানক খেলা চলছে তা ওদের চোখমুখ দেখে অন্তত আরিফের বুঝতে কষ্ট হলো না৷ পৃথিবীর সব রগরগে সিনেমা কিংবা ওয়েব সিরিজ এই মোবাইলে ধারণ করা ভিডিওর সামনে ফিকে মনে হবে। আরিফ মন্ত্রমুগ্ধের মতো কেবল চেয়ে রইলেন। তার হৃৎস্পন্দন বাড়তে লাগল ক্রমশ।

মনিকা একটা কালো শাড়ি পরেছে। ওর ফরসা গায়ের রঙ ফুটে আছে অন্ধকারের মাঝে আলোর মতো। ঠোঁটে লাল টকটকে রক্তরঙা লিপস্টিক। প্রথমে এই মুখটাই চোখে পড়ল। ভিডিও অপশনটা অন করে সামনে দাঁড়াল মনিকা। হাসল সুন্দর করে। উড়ন্ত চুমু পাঠিয়ে দিল মোবাইলের ক্যামেরার দিকে। তারপর পিছু হটে গেল ধীরে ধীরে।

ঘরের যে অংশটা ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে সেখানে একটা বিছানা, বেডসাইড টেবিলের ওপর রাখা টেবিল ল্যাম্প আর টুকটাক জিনিসপত্র, পাশে একটা ডিভান দেখা যাচ্ছে।

ডিভানের ওপর একটা কালো কোট পড়ে আছে। মনিকা এগিয়ে গিয়ে সেটা তুলে নিল। বুকে জড়িয়ে ধরে ঘ্রাণ নিল। যেন তার ভীষণ প্রিয় কোনো মানুষের গায়ে জড়িয়ে ছিল কোটটা৷

কোটের পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট মুখে পুরল। বেডসাইড টেবিল থেকে লাইটার নিয়ে জ্বালিয়ে নিল সেটা। ক্যামেরার দিকে পেছন ঘুরে বেডসাইড টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে কিছু একটা করল সে। কী করল বোঝা গেল না। এরপর দেখা গেল ডিভানে পায়ের ওপর পা তুলে বসে আরামে সিগারেটে টান দিচ্ছে।

“তুমি দিন দিন চেইন স্মোকার হয়ে যাচ্ছো সুইটি!”

কথাটা বলল সেই ব্যক্তি, যে এইমাত্র বাথরুমের দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকেছে। ওর হাত মুখ ভেজা। মনিকা আধখাওয়া সিগারেটের বাকিটুকু অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। একটা তোয়ালে এনে মুছিয়ে দিল লোকটার হাত-মুখ। এরপর তোয়ালেটা মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে ওর গলা জড়িয়ে ধরল। লোকটা দুই হাত দিয়ে ধরল মনিকার সরু কোমর।

কোনো গান বাজছে না, তবুও যেন কিসের তালে নাচতে থাকল দুজন। দু’জনার চোখ দু’জনার চোখে। যেন পৃথিবীর সবচেয়ে আকর্ষণীয় বস্তু এদের কাছে একে অপরের চোখ।

গান না থাকলেও ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হিসেবে বৃষ্টির শব্দ চলছে। মাঝে মাঝে বাজ পড়ছে। কিন্তু তাদের কোনো হেলদোল নেই। দু’জন দু’জনায় ডুবে গেছে পুরোপুরি।

একসময় লোকটা মনিকার ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিল। মনিকা এমনভাবে কেঁপে উঠল যেন ওর সারা শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেছে। মোবাইলের এই ক্যামেরাতেও সেটা স্পষ্ট বুঝতে পারল আরিফ। তারপরেই শুরু হয়ে গেল এক আদিম খেলা যেখানে কে কাকে ধরাশায়ী করতে পারে এটাই যেন আসল সাসপেন্স। আরিফের ইচ্ছে হলো ভিডিও বন্ধ করে দিতে। কিন্তু পারলেন না তিনি।

একটা পর্যায়ে এসে মনিকা লোকটাকে ছুঁড়ে ফেলল বিছানায়। লোকটা তখন যেন উন্মাদ হয়ে গেছে। মনিকাকে টেনে ফেলতে চাইছে নিজের বুকের ওপর। কিন্তু মনিকার দৃষ্টি অন্যরকম হয়ে গেছে। টানাহেঁচড়ার এক পর্যায়ে সে বেডসাইড ল্যাম্পটা হাতে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলল মেঝেতে। সশব্দে কাচ ভেঙে ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে৷ লোকটা হতভম্ব হয়ে মনিকার হাত ছেড়ে দিল। মনিকা ছুটে গিয়ে এক টুকরো কাচ তুলে নিল হাতে। কাচটার চোখা অংশ নিয়ে লোকটার গলার কাছে ধরল। এতক্ষণ প্রবল পুরুষত্ব জাহির করা লোকটা যেন হঠাৎই ঘাবড়ে গেল।

“কী করছো তুমি?”

“কী করছি তুমি বুঝতে পারছো না?” নেশা ধরানো গলায় বলল মনিকা। তার দিকে তাকালে মনে হচ্ছে চোখ পুড়ে যাবে। ওর গায়ের শাড়িটা খুলে ফেলা হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। পরনে শুধু কালো ব্লাউজ আর পেটিকোট। সে লোকটার দিকে আরেকটু ঝুঁকে গেল। কাচটা ওর গলা ছুঁই ছুঁই।

“মনিকা!” ধমকে উঠল লোকটা। এতক্ষণ তার চোখে যে নেশা জেগেছিল সেটা কেটে গিয়ে জড়ো হয়েছে ভয়।

মনিকা হাসল। “তুমি আজকে এখানে কেন এসেছ আমি জানি।”

লোকটা স্বাভাবিক গলায় বলল, “কেন এসেছি মানে? তুমিই মেসেজ পাঠিয়েছিলে আসার জন্য।”

“সেটা তো আগেও পাঠিয়েছি। তখন তো আসোনি। এই ঝড় বাদলা পেরিয়ে কেন এলে?”

“ঝড় বাদলার দিনেই কি রোমান্স ভালো জমে না?”

“একটা সত্যি কথা বলবে?”

“কী কথা?”

“আমাকে কিভাবে খু ন করতে চাইছিলে?”

“তোমাকে আমি খু ন করব কেন? কী যা তা বলছ!”

“উফ! ন্যাকামি করো না তো, বলো না।”

“মনিকা ডার্লিং! এই রোমান্টিক মুহূর্তে তুমি এসব উল্টোপাল্টা কথা কেন বলছো? প্লিজ কাচটা ফেলো, আমার বুকে এসো। তোমাকে অনেক অনেক…”

“শশশশ….” ওর ঠোঁটে আঙুল রেখে বলল মনিকা। “কথা বলো না। এই শেষ সময়ে এসে মিথ্যে শুনতে ইচ্ছে করছে না। তুমি খুব রেগেছিলে যখন এসেছ। তারপর আমার সাজ দেখে তোমার রাগ পড়ে গেল। ভাবলে শেষবারের মতো মধু খেয়ে তারপর মৌমাছিটাকে মেরে ফেলবে। তাই না?”

“তুমি…”

“উহু, কথা নয়৷ তুমি জানো, তোমাকে আমি ভালোবাসি।”

“আমিও তোমাকে ভালোবাসি ডার্লিং!”

“তাই?” হাসতে হাসতে ফেটে পড়ল মনিকা। যেন প্রচন্ড মজার কোনো জোকস শুনে ফেলেছে। হাসতে হাসতে চোখে পানি চলে এলো তার। কাঁদতে লাগল এরপর। কয়েক ফোটা পানি চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল। তারপর আবার হাসতে শুরু করল সে। শরীর দুলিয়ে হাসতে লাগল। হাসির এক পর্যায়ে হাতের কাচটা নামিয়ে বিদ্যুৎ গতিতে কে টে ফেলল অন্য হাতের ধমনী৷ এত দ্রুত ঘটনা ঘটে গেল যে শিউরে উঠল আরিফ। লোকটাও ঘাবড়ে গিয়ে ধরে ফেলল ওকে।

কাচটা ধারালো ছিল। ক্ষতটা দেখে বোঝা গেল যথেষ্ট গভীর হয়েছে। রক্তে ভেসে যেতে থাকল সাদা বিছানা। মনিকার মুখে এখনো হাসি। লোকটা হতবুদ্ধির মতো দাঁড়িয়ে রইল। রক্ত বিছানার চাদর শুষে নিচ্ছিল। মনিকা কা টা হাতটা বিছানার বাইরে রাখল। ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়তে লাগল সাদা টাইলসের মেঝেতে।

লোকটা এতক্ষণে যেন সম্বিত ফিরে পেল। তোয়ালেটা নিয়ে চেপে ধরল মনিকার হাতে। তোয়ালেতে ল্যাম্পের কাচের টুকরো লেগে ছিল। একটা টু্করো বিঁধে গেল তার নিজের হাতে। রক্ত গড়িয়ে পড়ল তার হাত বেয়ে। মিশে যেতে থাকল মনিকার রক্তের সাথে।

মনিকা আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে যেতে থাকল। মৃ ত্যুর কোলে ঢলে পড়ার আগে মৃদুস্বরে সে শুধু বলল, “আমি জিতে গেলাম। তুমি হেরে গেলে।”

যখন মনিকার দেহে আর প্রাণের চিহ্ন রইল না, তখন লোকটা উঠে দাঁড়াল। তোয়ালে থেকে কাচ ঝেড়ে সেটা পেচিয়ে দিল মনিকার হাতে। এরপর দ্রুত পরিষ্কার করতে লাগল সবকিছু৷ মেঝে থেকে সাবধানে কাচের টুকরো তুলে ফেলল। বাথরুম থেকে বালতি আর মপ এনে মেঝের রক্ত মুছে ফেলতে লাগল। যত মুছতে লাগল তত যেন আরো ছড়িয়ে যেতে থাকল। তবে এল পর্যায়ে সব পরিষ্কার হয়ে এলো। বিছানার চাদর তুলে মুড়িয়ে নিল। ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে একটা বড় পলিথিন নিয়ে এলো কোথা থেকে। সেটাতে ঢুকিয়ে দিল চাদর আর মনিকার শাড়ি।

মনিকার শরীরটা কোলে করে বিছানা থেকে নামিয়ে ডিভানে শুইয়ে দিল। বিছানার তোষক তুলে উল্টে বিছিয়ে দিল। অপর পিঠে রক্তের দাগ দেখা গেল না। আরেকটা চাদর এনে বিছিয়ে দিল বিছানায়।

এরপর ভালোমতো ঘরের প্রতিটা কোণা পরখ করে দেখল। এই পর্যায়ে আরিফের একবার ভয় হলো মোবাইলটা দেখে ফেলবে না তো? কিন্তু লোকটার দৃষ্টি তখন কেবল রক্তের ছিটেফোঁটা খুঁজছে। তার সুদূর কল্পনাতেও বোধহয় নেই যে মনিকা এমন কিছু করতে পারে।

মনিকার যত জিনিস ছিল এখানে সব সে এনে জড়ো করতে লাগল সেই পলিথিন ব্যাগে। অ্যাশট্রে থেকে ছাইয়ের কণা মুছে নিল। মনিকার কোনো চিহ্ন রইল না সেই ঘরে আর। শুধু মনিকার দেহটা পড়ে রইল ডিভানে। ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে গেল লোকটা৷ একটু পর ঢুকে মনিকাকে কোলে তুলে নিয়ে গেল বাইরে।

এতক্ষণ দম বন্ধ করে রেখেছিল আরিফ। গোয়েন্দা হলেও সে জীবনে প্রথমবার এরকম দৃশ্যের সাক্ষী হলো। ভেবেছিল ঘটনা এখানেই শেষ৷ কিন্তু শেষ হলো না৷ লোকটা আবার ফিরল। বাথরুমে গিয়ে আবারও হাত মুখ ভালো করে ধুয়ে এলো। ওর শার্টের হাতায় রক্ত লেগেছিল। সেটা বোধহয় পরিষ্কার করার প্রাণপণ চেষ্টা করা হয়েছে। এবার কোট পরে প্যান্টের পকেট থেকে চিরুনি বের করে চুল আঁচড়ে নিল সুন্দর করে। ঘরটা আবার ভালোমতো চেক করল। ডিভানে মনিকার চুল পেয়ে সেটা পকেটে ভরে নিল। তারপর লাইট বন্ধ করে বেরিয়ে গেল। এরপর আর কিছু নেই৷ আরো তিন ঘন্টা ভিডিও হলেও তাতে কেবলই আঁধার।

স্তব্ধ হয়ে কতক্ষণ বসেছিলেন জানেন না আরিফ। যখন তিনি উঠে দাঁড়ালেন তখন তার শরীর রাগে জ্বলে যাচ্ছে। লোকটা খু ন না করলেও খু নী। রক্তের দাগ আছে, ভিডিও এভিডেন্স আছে৷ এখন আর কিছুতেই সে পালাতে পারবে না৷ “তোমার কাউন্ট ডাউন শুরু মিস্টার ফারহান রুশদি!” আপনমনেই বললেন আরিফ।

কিন্তু মনিকার লা শটা কী করেছে সে? কোথায় লুকিয়েছে? এই বাড়িতেই কোথাও? নাকি অন্য কোথাও?

বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে গিয়ে এতক্ষণে তার মনে পড়ল চিলেকোঠার কথা৷ পুরো বাড়ি খুঁজলেও চিলেকোঠা তো খোঁজা হয়নি! কারন একতলা বাড়ির ছাদে যাবার কোনো সিঁড়ি তার চোখে পড়েনি। তাহলে ওপরে আছেটা কী? কেমন করে উঠল মনিকা? পুরো বাড়ি তো সে খুঁজে ফেলেছে৷

আবার বেরিয়ে এলেন তিনি। বুড়োকে ধরলেন। “ছাদে ওঠার সিঁড়ি কোথায়?”

বুড়ো জানালো, এই বাড়ির ছাদে ওঠা নিষেধ। তাই সিঁড়িও নেই। আগে লোহার সিঁড়ি ছিলো, তবে মালিক সেটা ফেলে দিয়েছে৷ একটা মই আছে স্টোররুমে রাখা৷ জরুরি প্রয়োজনে সেটা দিয়েই ওপরে ওঠা হয়৷

আরিফ মই এনে ছাদে উঠলেন। চিলেকোঠার দরজার তালা ভাঙা। শুধু ছিটকিনি লাগানো। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলেন তিনি৷ মনিকা যেসব বলেছিল সেগুলো পাওয়া গেল। পাওয়া গেল ওই লেখাটাও। শুধু একটা নতুন জিনিস পেলেন তিনি৷ পুরানো লেখাটার ওপর টাটকা একটা লেখা।

“শত্রুর শেষ রাখতে নেই।”

কে লিখেছে এটা? মনিকা?

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু