মৌমোহিনী পর্ব-১৫

0
8

#মৌমোহিনী
পর্ব-১৫

ফারহান রুশদি আজ বাড়িতে ঢুকলেন একটা বড় আইসক্রিমের বক্স হাতে। অনেকগুলো কোণ আছে তাতে। তার মনটা বেশ ভালো। যেভাবে যা চেয়েছিলেন, পুরোটাই হয়েছে৷ পডকাস্ট আপলোড, সেটার অংশবিশেষ কেটে কেটে মুখরোচক ক্যাপশন আর ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক লাগিয়ে বিভিন্ন ডিজিটাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেয়া, সবটাই ঠিকঠাকমতো হয়েছে। বাকিটা পাবলিকই করে দিয়েছে।

দেশের মানুষ তাকে পছন্দ করে। বিশেষ করে ইয়াং জেনারেশন। আর প্রায় সব বয়সী মেয়ে ভক্ত তো তার আছেই। তিনি একসময় ভাবতেন শুধু ইয়াং মেয়েরা তার জন্য পাগল। এরপর একদিন তার ফেসবুকের মডারেটর তাকে ইনবক্সে আসা মেসেজের একাংশ দেখিয়েছিল। তিনি অবাক হয়ে দেখেছিলেন তার মায়ের বয়সী মহিলারাও খোলামেলা আঁটোসাঁটো পোশাকে আবেদনের ভঙ্গিমায় ছবি তুলে পাঠিয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে যাচ্ছে। তার এসবের প্রতি তেমন আগ্রহ নেই। মানুষ তাকে যেভাবেই পছন্দ করুক না কেন, ভোটটা দিলেই হলো।

পডকাস্টে কী পোশাক পরে যাবেন সেটার গবেষণা অনেকদিন ধরে হচ্ছিল। কোন পোশাকে তাকে একইসাথে হ্যান্ডসাম দেখাবে, আবার পূতপবিত্র মনে হবে; ভিডিওর কোন এঙ্গেল, কোন কালার গ্রেডিং আর টোনে তাকে নিষ্পাপ, মানবিক আর একইসাথে প্রাণচঞ্চল মনে হবে, প্রতিটা বিষয়ে প্রফেশনাল সহযোগিতা নেয়া হয়েছিল। সব মিলিয়ে এটা একটা পারফেক্টলি লঞ্চড নিখুঁত প্যাকেজ ছিল!

শ্যুটিংয়ের একটু আগে তার এসিস্ট্যান্ট তাকে বলেছিল জনতা যেহেতু তার আর তার স্ত্রীর জুটিটাও বেশ পছন্দ করে, তাই স্বামী স্ত্রীর ভালোবাসা নিয়ে কিছু একটা বলার জন্য। লাস্ট মোমেন্টে ডিসাইড হয়েছিল বলে মাথায় যা এসেছে তিনি তাই বলে দিয়েছেন। আইসক্রিমের ব্যাপারটায় তিনি অতটা কনফিডেন্ট ছিলেন না৷ কিন্তু দেখা গেল এটাই হিট হয়ে গেছে।

হিট যখন হয়েছে, নাঈশাও নিশ্চয়ই দেখেছে। আর দেখলে নিশ্চিত মন মেজাজ খারাপ করে বসে আছে। সেজন্য ব্যাকআপ হিসেবে আইসক্রিমের বক্স আর কিছু কথার ডালা সাজিয়ে নিয়ে এসেছেন তিনি। লিফট তার বাসার ফ্লোরে এসে পৌঁছুলে তিনি বের হয়ে একটু পারফিউম লাগিয়ে নিলেন। এই এপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ে থাকতে আর ভালো লাগে না তার। শ্বশুরবাড়ির মতো বড় একটা বাড়ি যে কবে হবে! নির্বাচনটা জিততেই হবে, ভাবলেন তিনি।

কলিংবেল চাপলেন। নাঈশা দরজা খুলল। সাধারণত কোনো গৃহকর্মী দরজা খুলে থাকে। নাঈশার চোখমুখ কেমন যেন দেখাচ্ছে।

“তোমার কি শরীরটা ভালো নেই?”

নাঈশা কোনো জবাব না দিয়ে তার হাতের বক্সের দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালো।

তিনি হেসে ভেতরে ঢুকলেন। বক্সটা খুলে তার থেকে একটা কোণ বের করে নাঈশার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে আবেগী গলায় বললেন, “দিস ইজ ফর ইউ মাই বিউটিফুল ওয়াইফ! প্লিজ রাগ করে থেকো না, ওটা স্ক্রিপ্টে লেখা ছিল! বাট আই প্রমিজ, যা বলেছি আজ থেকে সেটা অক্ষরে অক্ষরে পালন করা হবে। এখন আমরা কি একটা আইসক্রিম ভাগ করে খেতে পারি?”

নাঈশা কোনো কথা বলল না। নির্লিপ্ত মুখে মোড়ক খুলে এক কামড় খেয়ে স্বামীর দিকে বাড়িয়ে দিল। রুশদি কোণটা নিয়ে খেতে খেতে মনে মনে নিজের পিঠ চাপড়ে দিলেন। কথা দিয়ে ম্যানেজ কী করে করতে হয় তা তার থেকে শেখা উচিত লোকের। অবশ্য বউ পুরোপুরি ম্যানেজ হয়েছে কি না বোঝা যাচ্ছে না৷ মুখটা গম্ভীর করে রেখেছে। শালী বড়লোকের মেয়ের ঢংয়ের শেষ নেই!

কোনো রিস্ক নেয়া যাবে না। এখন নাঈশাকে রাগিয়ে দেবার অর্থ নিজের পায়ে কুড়াল মারা। ওর বাবা মেয়ে বলতে অজ্ঞান। মেয়ে অভিযোগ করলে তাকে লাথি মেরে বের করে দেবে দু’মিনিটে। এতকিছু করার পরেও হারামি বুড়ো তাকে দেখতে পারে না। নাঈশা সেদিন মনিকার মেসেজ দেখে ফেলায় এমনিতেই অনেকটা সর্বনাশ হয়েছে। তাদের সম্পর্কে বিশ্বাসের জায়গাটা ঢিলে হয়ে গেছে। এখন কিছুতেই কোনো ভুল পদক্ষেপ নেয়া যাবে না।

আজ সারাদিন প্রচন্ড পরিশ্রম গেছে। রুশদির পুরো শরীর ব্যথা করছে। ইচ্ছে করছে গরম পানিতে গোসল করে নরম বিছানায় ডুবে যেতে। কিন্তু জীবনে কিছু পেতে হলে অনেক কষ্টই সহ্য করে নিতে হয় হাসিমুখে। তিনি স্ত্রীর মন রক্ষা অভিযান চালিয়ে গেলেন। রাতে শোওয়ার পর প্রচন্ড ক্লান্ত শরীরেও কাছে টেনে নিলেন স্ত্রীকে।

নাঈশা চুপচাপ সহ্য করে নিল সবটা। আজ বাবার সাথে কথা বলার পর তার মন অন্যরকম হয়ে গেছে। জীবনটা আমরা যেভাবে চালাতে চাই সেরকম হয় না। হাতে যত ক্ষমতাই থাকুক না কেন, সৃষ্টিকর্তার নিজের নেয়া সিদ্ধান্তের বিপরীতে যাওয়া আমাদের পক্ষে কখনো সম্ভব হয় না৷ কিছু নিয়তি মেনে নিতে হয়। আর নিয়তি বদলাতে গেলে প্রচন্ড কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়। আর সেই সিদ্ধান্ত নিতে গেলেও প্রবল মনের জোর থাকতে হয়। তার সেই মনের জোরের উৎস ছিল তার বাবা। এখন আর বাবার ওপর ভরসা করে থাকার উপায় নেই।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে নাঈশা। স্বামীকে জড়িয়ে ধরে গভীরভাবে। রুশদির প্রতি বিয়ের আগে সে যে পরিমাণে আসক্ত ছিল তাতে যদি ভবিষ্যৎ দেখার সুযোগ থাকত তবুও কি সে তাকে বিয়ে করত? হয়তো করত। জেনেশুনে ঝাপ দিত আগুনে। পোড়ার পর বুঝতে পারত কত কষ্ট হয়। যেমন মোহিনী মেয়েটা আগে থেকে জেনেও ওর ভালোবাসায় পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে।

******

প্রিয়াঙ্কা খবরটা পেলেন সকালবেলা। তিনি গতকাল বাড়িতে যোগাযোগ করার পর ক্রমাগত ফোন আসছিল দেখে বিরক্ত হয়ে মোবাইল বন্ধ করে রেখেছিলেন৷ আজ সকালটা সুন্দর ছিল। দু’দিন বৃষ্টির পর ঝকঝকে রোদ দেখে মনটাও ভালো হয়েছিল একটু৷ কোন ফাঁকে তিন্নি গেম খেলার জন্য তার মোবাইল অন করেছে দেখেননি তিনি। ভাগ্যিস করেছিল। তিনি খবরটা পেলেন মায়ের মুখে। তৌকির আইসিইউতে! তার হার্ট ফেইলিউর হয়েছে! লাইফ রিস্ক আছে!

প্রিয়াঙ্কা ঘামতে লাগলেন ক্রমাগত। এত অস্থির লাগছে! প্রথমটায় তার মনে হয়েছিল, বিশ্বাসঘাতক লোকটার যা খুশি হোক, তার কিছু যায় আসে না। কিন্তু তারপর থেকেই মনটা ছটফট করতে শুরু করেছে। তৌকিরের হাসিমুখ, তার অস্তিত্বের কথা ভেবে ভেতরটা ছিঁড়ে আসছে৷ কোনোভাবেই নিজেকে সামলাতে পারছেন না তিনি।

খবরটা পাবার আধঘন্টার মধ্যে তিনি তিন্নির হাত ধরে বেরিয়ে পড়লেন হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। পুরো রাস্তা কাঁদতে থাকলেন কেবল। তিন্নি মায়ের অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে গেছে। ক্রমাগত মাকে প্রশ্ন করে যাচ্ছে। প্রিয়াঙ্কা কোনো উত্তর দিতে পারলেন না তাকে। যেদিন সেই মেয়েটার সাথে তৌকিরের ছবিগুলো দেখেছিলেন, তার মনে হয়েছিল লোকটার প্রতি তার অধিকার, মায়া, ভালোবাসা সব নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু আজ তারই জীবন সংশয় আছে জেনে প্রিয়াঙ্কার মনে হচ্ছে তার পুরো পৃথিবী ভেঙেচুরে আসছে।

********

হাসপাতালে তোকিরের কিছু আত্মীয়স্বজন এসেছিল। এরপর যখন প্রিয়াঙ্কাও চলে এলো, তখন আরিফ বেরিয়ে পড়লেন। ইমারজেন্সি বলে দুদিনের ছুটি নিয়েছেন তিনি। তাই অফিসে না গিয়ে সোজা ছুটলেন মুন্সিগঞ্জের দিকে। তার মাথায় একটা থিওরি দাঁড়িয়ে গেছে। সে মোটামুটি নিশ্চিত ওই মর্গে যে দুটো মেয়ের লা শ আছে তার মধ্যে কোনো একটা মনিকার।

সেই রাতে রুশদি মনিকার লা শ গুম করতে নিয়ে গিয়ে বাস এক্সিডেন্টের সামনে পড়ে যায়৷ তখন তার মাথায় আইডিয়া চলে আসে। এক্সিডেন্টের ঝামেলার মধ্যে সে কোনো একটা মেয়ের লা শের সাথে মনিকার লা শ অদল বদল করে দেয়। তাকে হাসপাতালের কেউ না কেউ অবশ্যই সাহায্য করেছিল। সেই মেয়েটার সাথে মনিকার জামাকাপড়ও বদলে নিয়েছিল। তারপর ওই মেয়েকে ফেলে দিয়েছে রাস্তার পাশে। এজন্যই মনিকার লা শ ওই হাসপাতালে পড়ে আছে, কেউ শনাক্ত করতে পারেনি। ওকে কেউ চিনলে তো শনাক্ত করবে! সবাই হয়তো ধরে নিয়েছে এই মেয়ে বাস এক্সিডেন্টেই মা রা গেছে। কিছুদিন পর বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করে দেয়া হবে।

কী দারুণ বুদ্ধি বের করেছিল লোকটা! ওর মগজের তারিফ করতেই হবে। তুখোড় বুদ্ধিমান না হলে এত অল্প সময়ে এত ওপরে ওঠা যায় না। ওর বিরুদ্ধে কেমন করে দাঁড়াবে জানে না আরিফ, কাজটা ভীষণ কঠিন হবে! শুধু মনিকার লা শটা পারে তাকে সেই যুদ্ধে অবতীর্ণ হবার সবচেয়ে বড় অস্ত্রটা দিতে। তিনি গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিলেন।

মর্গে পৌঁছে লা শ গুলো দেখতে চাইলেন তিনি। বললেন শনাক্ত করতে এসেছেন তার আত্মীয় কি না।

প্রথম মেয়েটার মুখের ওপর থেকে কাপড় সরালেন। এ মনিকা নয়। অবশ্য মেয়েটা বেশ লম্বা আর স্বাস্থ্যবতী হওয়ায় তিনি আশাও করেননি এটা মনিকা হবে।

কিন্তু পরের লা শ টার গড়ন হুবহু মনিকার মতো। সাদা কাপড়ে ঢাকা শরীরটা। পায়ে পায়ে সেদিকে এগিয়ে গেলেন আরিফ। বুক ঢিপঢিপ করছে। কাঁপা হাতে তিনি কাপড়টা সরালেন। দেখলেন মেয়েটার চেহারা। হিমঘরের ঠান্ডায় রাখা রক্তশূণ্য ফ্যাকাসে একটা মুখ।

মুখটা মনিকার নয়!

আরিফের ইচ্ছে হলো সেখানেই বসে পড়তে। তার প্রচন্ড হতাশ লাগছে এখন৷ তার এই থিওরিও ভুল প্রমাণিত হলো! কিন্তু তা তো হবার কথা ছিল না! আর সামনে কোনো পথ খোলা নেই। নিজেকে কোনোক্রমে সামলে টলোমলো পায়ে বেরিয়ে পড়লেন তিনি।

তবে কি মনিকার লা শের মরিচীকার পেছনে ছোটা বন্ধ করে দিতে হবে তার? একটা খু নের ভিডিও এভিডেন্স থাকার পরেও কোনো শাস্তি দিতে পারবেন না অপরাধীকে? তবে কী লাভ হলো তার গোয়েন্দা হয়ে?

এই পেশায় ঢোকার সময় তার রক্ত গরম ছিল খুব! মনের ইচ্ছেটা ছিল স্পষ্ট, দেশের সব অপরাধীকে শাস্তি দেয়াবেন তিনি। ধীরে ধীরে বুঝতে পেরেছেন এই চিন্তা কেবল অসম্ভব নয়, হাস্যকরও বটে! তবে নিজের কাজটা তিনি করে গেছেন পুরোপুরি সততার সাথে।

কিন্তু এই কেসটা অন্যরকম৷ এর ব্যর্থতা তাকে হয়তো আজীবন পোড়াবে।

গাড়িতে গিয়ে বসলেন তিনি। ফিরে যাবেন নিজের ঠিকানায়। চাবি ঘোরাতে গিয়ে হঠাৎ নতুন একটা সম্ভাবনা খেলে গেল তার মাথায়৷ নেমে পড়লেন আবার। সব দরজা বোধহয় এখনো বন্ধ হয়ে যায়নি।

********

গতকাল মোহিনীর চিঠি পড়ে নাঈশার গা গোলাচ্ছিল। শরীর অবসাদে ছেয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু বাবার সাথে কথা বলার পর বাবা যখন একটা ভিডিও পাঠালেন, সেটা দেখার পর থেকে শরীরের প্রতিটা কোষ যন্ত্রণা নীল হয়ে গেছে নাঈশার। ওটা দেখার সময় মনে হচ্ছিল কেউ তার গায়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। কী ভয়ানক লোকের সাথে সংসার করছে সে!

মোহিনীর চিঠি পড়ে তার পুরোটা বিশ্বাস হয়নি। ওকে খু ন করা হবে বা আগেও ফারহান একটা খু ন করেছিল, দু’জনেই গর্ভবতী ছিল, এসব পুরোটাই নাঈশার কাছে অতিরঞ্জিত মনে হয়েছিল। কিন্তু ভিডিও দেখার পর তার সবই বিশ্বাস হয়েছে। এটাও মনে হচ্ছে যে কাল ফারহানের প্রয়োজন পড়লে তার সাথেও সে এই একই কাজ করতে পারে। লোকটা তাকে একফোঁটাও ভালোবাসে না৷

তার ওপর বাবার সুরে একটা কিন্তু কিন্তু ভাব তার মনটাকে আরো বিষিয়ে দিয়েছে। বাবা তাকে সাপোর্ট করছে, তাকে বলছে ফারহানকে ছেড়ে চলে যেতে, তার প্রতি মমতাও দেখাচ্ছে, কিন্তু সে ফারহানকে দল থেকে বের করবে না। তাহলে ওর শাস্তিটা হবে কেমন করে? মেয়ের সাথে এত বড় অন্যায় করার পরেও বাবার দলে বিশ্বাসঘাতক, খু নী টা থেকে যাবে! হাহ!

তবে মাথা একটু ঠান্ডা হয়ে আসার পর সে এটা উপলব্ধি করতে পেরেছে যে ফারহানকে এখন দল থেকে বের করে দেয়াটা তার বাবার জন্য এক ভয়ানক আত্ম ঘাতী সিদ্ধান্ত হবে। এটা সে বাবাকে করতে বাধ্য করতে পারে না৷

এরপরই খুব ঠান্ডা মাথায় সে নতুন একটা প্ল্যান করেছে। সে এত সহজে সব ছেড়ে চলে যাবার পাত্রী নয়৷ এসব সহ্য করার তো প্রশ্নই আসে না৷ এখন সে প্রতিশোধ নেবে। এমন প্রতিশোধ যা ফারহানের দূরতম কল্পনাতেও নেই।

ফারহানকে দল থেকে সরানো যাবে না, কিন্তু যদি পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়া হয় তবে? তবে সাপও মরবে আর লাঠিও ভাঙবে না৷

নাঈশা রাজনীতিবিদের মেয়ে। ছোটোবেলা থেকে রাজনীতির বাঁকগুলো সে চিনতে শিখেছে বাবাকে দেখে দেখে। কোন সময় কোন চালটা দিতে হবে এটুকু সে ভালো করেই জানে। ফারহান রুশদিকে সরিয়ে দিয়ে তার জায়গায় নির্বাচনে দাঁড়াবে সে নিজে, নাঈশা চৌধুরী নয়, নাঈশা রুশদি হয়ে। ফারহানের খু নের দায় গিয়ে পড়বে অন্য দলের ওপর। ফারহানের জনপ্রিয়তায় ভয় পেয়ে তাকে সরিয়ে দিয়েছে ওরা- এমনটাই রটিয়ে দেয়া হবে।

বুদ্ধিটা তার মাথায় এসেছিল একটা রিল দেখে। তার আর ফারহানের ছবি দিয়ে গান লাগিয়ে ‘রোমান্টিক কাপল এভার’ ট্যাগ দিয়ে বানানো রিলটায় মিলিয়ন মিলিয়ন ভিউ হয়েছিল! তখনই নাঈশা বুঝতে পেরেছে তাদের জুটি জনপ্রিয় মানে তো শুধু ফারহান জনপ্রিয় নয়, সে নিজেও জনপ্রিয়। অকালে স্বামী হারানো মেয়েটার প্রতি পাবলিকের প্রচুর সিম্প্যাথি থাকবে। ফারহানের সব ভোট সে হাতিয়ে নিতে পারবে ঠিকঠাক চালগুলো চালতে পারলেই।

এসব প্ল্যান করে ফেলার পরে নাঈশা শান্ত হয়ে এসেছিল অনেকটাই। এরপর ফারহান এলো। তাকে আইসক্রিম খাওয়ালো। রাতে কাছে টেনে নিলো। নাঈশা বাঁধা দেয়নি একটুও৷ ফাঁ সির আসামীও শেষ ইচ্ছে পূরণ করার সুযোগ পায়৷ তার প্রাণপ্রিয় স্বামী পাবে না কেন? মন ভরে আদর করেছে সে কাল ফারহানকে। শেষবারের মতোই করেছে। এই মর্ত্যলোকে তাদের আর দেখা হবে না৷

সারারাত জেগে পরিকল্পনার খুটিনাটি ঠিক করে ফেলেছে নাঈশা।

সকালে খুব সুন্দরভাবে বিদায় দিয়েছে ফারহানকে। এগারোটার দিকে কাজের লোকেদের বলেছে বিরিয়ানি রান্না করতে। ফারহান খেতে চেয়েছে, রান্না করে যেন তার অফিসে পাঠিয়ে দেয়া হয়।

বিরিয়ানি রান্নার পুরোটা সময় সে নিজের ঘরে বসে থেকেছে। কেবল একবার গিয়ে লবণ দেখার নাম করে বিরিয়ানিতে মিশিয়ে দিয়েছে সাপের বি ষ।

এই লাইওফিলাইজড বি ষ সে সংগ্রহ করেছিল অনেক আগে বাবার এক বন্ধুর কাছ থেকে। বিয়েরও আগে থেকে এই জিনিস তার কাছে আছে। কিন্তু কেউই এই খবর জানে না। ফারহানও না। শুকিয়ে গুড়ো করা বি ষ বলে নষ্টও হয়ে যায়নি এটা এতদিনে। যে তাকে বি ষটা দিয়েছিল সে বলেছিল এটা দশ বছর পর্যন্ত কার্যকর থাকবে। সেই হিসেবে এখনো এটা ভালো থাকার কথা।

বি ষ মিশিয়ে আবার নিজের ঘরে চলে এসেছে সে। বিরিয়ানি প্যাক হয়ে ফারহানের অফিসে চলে গেছে, সে ওটার ধারেকাছেও যায়নি। ওই বিরিয়ানিই সে নিজেও খেয়েছে। বাড়ির কাজের লোকেরাও খেয়েছে। কিন্তু কারোরই কিছু হয়নি। খাওয়াদাওয়া শেষে সে তদারকি করে নিশ্চিত করেছে বিরিয়ানির একটুও যেন বেঁচে না থাকে। সবটা শেষ হয়েছে, এবং প্লেট থেকে শুরু করে হাড়িও ধুয়ে ফেলা হয়েছে। এঁটোকাটা যা ছিল সব ফেলে দেয়া হয়েছে। নাঈশা এরকম রোজই করে, পরিচ্ছন্নতার বাতিক আছে তার। তাই কেউ কিছু সন্দেহও করেনি।

কারো কিছু না হবার কারন হলো সাপের বি ষ এক ধরনের প্রোটিন। এই প্রোটিন সহজেই হজম হয়ে যায় সুস্থ ব্যক্তির। কিন্তু যার পাকস্থলীতে ক্ষত আছে, তার পেটে এই জিনিস গেলে বি ষ ক্ষতের মাধ্যমে পৌঁছে যাবে রক্তে, তারপর রক্তের মাধ্যমে হৃদপিণ্ডে পৌঁছে সেটা বন্ধ করে দেবে চিরতরে!

ফারহানের আলসার আছে। ওর ওপর এই বি ষ কাজ না করে যাবে না।

বেচারা ফারহান! নাঈশা চৌধুরীর সাথে এতদিন সংসার করেও তুমি জানতে পারোনি দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে সে কত বি ষা ক্ত ছোবল দিতে পারে!

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু