#মৌমোহিনী
পর্ব-১৭
“জাকির! তুমি কি বাড়ি চলে গেছ?”
“জি স্যার।”
“দুপুরের বিরিয়ানির কিছু কি অবশিষ্ট ছিল? অল্প একটু বা উচ্ছিষ্ট হলেও চলবে।”
“ছিল স্যার। রকি অসুস্থ হয়ে পড়ায় পুরো খাবার শেষ করতে পারিনি, হয়তো ডাস্টবিনে পাওয়া যাবে।”
“এখুনি অফিসে যাও, সেটুকু উদ্ধার করো। পাওয়া গেলে ফোন করবে, আমি জানিয়ে দেব কী করতে হবে।”
“জি স্যার।”
জাকির ছেলেটা বুদ্ধিমান। অতিরিক্ত কোনো প্রশ্ন না করে সোজা কাজে নেমে পড়াই তার স্বভাব৷
রুশদির একজন বন্ধু আছেন ফরেনসিক বায়োকেমিস্ট। তাকে ফোনে পাওয়া গেল। তিনি জানালেন স্যাম্পল পাঠিয়ে দিলে তিনি টেস্ট করে আগামীকালের মধ্যে রেজাল্ট জানাতে পারবেন।
জাকির এক ঘন্টার মধ্যেই স্যাম্পল জোগাড় করে তার কাছে পৌঁছে দিয়ে এলো। এখন কেবল অপেক্ষা।
অনেকক্ষণ এলোমেলো ড্রাইভ করার পর একটা রেস্টুরেন্টের সামনে গাড়ি থামালেন ফারহান রুশদি। দুপুর থেকে কিছুই খাওয়া হয়নি। দুপুরে বাড়ি থেকে পাঠানো বিরিয়ানিটা দেখে বেশ খুশি হয়েছিলেন তিনি। খাবার পরিবেশন করার কথা বলে হাতমুখ ধুয়ে এসেছিলেন। কিন্তু খেতে বসার আগেই একটা জরুরি কল আসায় তক্ষুনি বেরিয়ে পড়তে হয়েছিল। ফেরার কোনো ঠিক ঠাকানা ছিল না বলে খাবার খেয়ে ফেলতে বলেছিলেন তার এসিস্টেন্টকে। বের হয়ে গাড়িতে বসে নাঈশার কল রিসিভ করেছিলেন। বউকে অল্প একটু মিথ্যে বলেছিলেন খাওয়ার ব্যাপারে। কিন্তু ঘটনাটা আসলে কী ঘটেছে?
বেশ রাত হয়ে গেছে। রেস্টুরেন্টে লোকজন কম। তিনি মাস্ক পরে ভেতরে ঢুকে একটা কোণার দিকের টেবিলে বসলেন। স্টেক, গ্রিলড স্যামন আর মাশরুম স্যুপ অর্ডার করলেন৷ খেতে খেতে আর কোনোকিছু নিয়েই ভাবলেন না তিনি। খাওয়া শেষে এক কাপ কড়া কফি নিয়ে বসলেন ভাবতে।
মানুষের মস্তিষ্ক মাঝে মাঝে খুব দ্রুত কাজ করে। সেজন্যই রকির ব্যাপারটা শোনামাত্র তার মাথায় ক্লিক করে গেছে পেটের অসুখের ব্যাপারটা৷ এই কথাটা প্রথম তিনি শুনেছিলেন তার স্ত্রী নাঈশার কাছ থেকে। নাঈশার সাপ বিষয়ে প্রচুর ইন্টারেস্ট। ওর গ্যালারিতে ঢুকলে হুটহাট সাপের ছবি সামনে পড়ে যায় বলে তিনি ওর মোবাইল থেকে দূরে থাকেন৷ নাঈশা একদিন গল্পে গল্পে বলেছিল, সাপের বিষ এক ধরনের প্রোটিন৷ এটা সুস্থ মানুষ খেয়ে ফেললে তেমন ক্ষতি হবার সম্ভাবনা থাকে না৷ কিন্তু যদি পরিপাকতন্ত্রের কোথাও ক্ষত থাকে তাহলে বিষ রক্তে গিয়ে সর্বনাশ হতে পারে৷ কথাটা হুট করেই তার মাথায় চলে এসেছিল তখন৷
নাঈশা তার খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে কখনো মাথা ঘামায়নি। এই পর্যন্ত কোনোদিন দুপুরে খাবার পাঠায়নি৷ তাই আজ পাঠানোতে তার একটু অবাক লেগেছিল। কিন্তু সন্দেহ লাগেনি!
নাঈশা এমন করবে কেন? তাকে মে রে ওর কী লাভ? তিনি যতদূর বুঝতে পারেন মেয়েটা তাকে ভালোবাসে। ভালোবেসেই বিয়ে করেছে। তাহলে? তিনি কি ওভারথিংকিং করছেন? হয়তো রকি অন্য কিছু খেয়ে ফেলেছিল যা ওর জন্য বিষাক্ত।
রুশদির অস্থির লাগতে শুরু করল। যতই নাঈশাকে ইনোসেন্ট ভাবার চেষ্টা করছেন ততই যেন তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে, কিছু একটা ঝামেলা আছে। আছেই!
নাঈশা কি তবে মনিকার ব্যাপারটা জেনে গিয়েছিল? কিন্তু কিভাবে? ওই গোয়েন্দাটা কিছু বলেছে? বলতে পারে! তিনি এলোমেলো ভাবতে ভাবতেই বেরিয়ে পড়লেন রেস্টুরেন্ট থেকে। ভালো লাগছে না কিছু৷ এত বড় খুশির সংবাদের সাথে এরকম জটিলতা জড়িত থাকবে তা তিনি কল্পনাও করেননি। মনিকা মেয়েটা সত্যিই তার কপালে শনি হয়ে এসেছিল। নয়তো নাঈশা তো ভড়কে যাবার মেয়ে নয়!
শ্বশুরবাড়ি থেকে ফোন আসছিল। তিনি মোবাইল অফ করে গাড়ি ছোটালেন অজানার দিকে। রাস্তার একধারে হেডলাইটের আলোয় একজোড়া কপোত-কপোতীকে দেখা গেল দুনিয়া ভুলে তীব্র প্রেমে ভেসে যাচ্ছে একে অপরকে জড়িয়ে নিয়ে। তার মনে হলো গলাটা শুকনো লাগছে। তার কারো সঙ্গ প্রয়োজন। এই সময়গুলোতে মনিকার কোনো তুলনা ছিল না। তবে মনিকা এখন অতীত। মনে পড়ল আরেকটা মেয়ে আছে, মনিকার মতো না হলেও খারাপ না। ওকে ফোন করলেন তিনি। বললেন তৈরি থাকতে, তিনি ওকে গাড়িতে তুলে নেবেন।
চলতে চলতে তার মনে হলো, বাড়ির বউ আর বাইরের মেয়েদের সবচেয়ে বড় পার্থক্য হলো, বাড়ির বউ ছলাকলা করতে পারে না। আর ছলাকলা জানা মেয়েতে অভ্যস্ত হয়ে গেলে বাড়ির বউকে একেবারে ডালভাত মনে হয়।
মেয়েটাকে নিয়ে হোটেল রুমে ঢুকেই সাথে নিয়ে আসা হুইস্কির বোতল খুলে গলায় ঢাললেন। মেয়েটা এসে গা ঘেঁষে বসল। তার শার্টের বোতাম খুলতে লাগল একটা একটা করে, সময় নিয়ে। বেশ ভালো লাগছে এখন৷ আগামী কয়েক ঘন্টা সবকিছু ভুলে একটু ভালো সময় কাটালে মাথা আর মন দুটোই ফ্রেশ হবে।
********
আরিফ হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছেন। দাউদকান্দি টোল প্লাজায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে টোল দেবার সময় পেছন থেকে বিশাল এক ট্রাক এসে ধাক্কা দিয়েছে তার গাড়িতে। তার পাশে দাঁড়ানো একটা মোটরবাইক আরোহীকে উড়িয়ে দিয়েছে। লোকটা বেঁচে আছে না মরে গেছে জানেন না আরিফ। তার নিজের জ্ঞান ছিল না। কারা যেন হাসপাতালে নিয়ে এসেছে৷ এখন জ্ঞান ফিরেছে৷ মাথা কিছুটা কাজ করছে। রাগ লাগছে ভীষণ। এই পোড়া দেশে জানের কোনো নিরাপত্তা নেই৷ কে কখন কোথায় ম রবে কিছুই বলা যায় না৷ আবার একটা মানুষকে মেরে খু নী আরামসে ঘুরে বেড়ায় প্রশাসনের নাকের নিচ দিয়ে। দেখবার কেউ নেই। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন আরিফ।
তবে একটা খু নীকে হয়তো তিনি ধরতে পারবেন৷ তার কাছে এখন প্রমাণ আছে। সলিড প্রমাণ।
চাঁদপুরে সেই মেয়ের বাড়িতে গিয়েছিলেন তিনি। তার পরিবারের থেকে জানতে পেরেছেন মেয়েটার মুখ একেবারে রক্তাক্ত ছিল। কাচ বিঁধে ভয়ানক অবস্থা হয়েছিল মুখের। চেহারা দেখে ওকে চেনার কোনো উপায় ছিল না৷ তারা চিনেছে জামাকাপড় দেখে। যদিও ওর হাত পা দেখে মা আর বোনের সন্দেহ হয়েছিল এটা তাদের মেয়ে না, কিন্তু জামাকাপড়, আইডি কার্ড সব ঠিকঠাক থাকায় তাদের কথা কেউ পাত্তা দেয়নি৷ মেয়েটাকে দাফন করে ফেলা হয়েছে সেদিনই।
আরিফ তখন সেই হাইওয়ের পাশে পাওয়া লা শের ছবি দেখালে মেয়েটার বাবা হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন৷ তিনি নিশ্চিতভাবে জানালেন এটাই তাদের মেয়ে। তাহলে যাকে তারা দাফন করলেন সেটা কে?
আরিফ তাদের কিছুই খুলে বলেননি। তবে আশ্বাস দিয়ে এসেছেন মেয়ের আসল লা শ তারা পাবেন। আর এই রহস্যেরও একটা সমাধান হবে। কিন্তু ফেরার পথে এই দুর্ঘটনায় পড়তে হলো।
পুরো শরীর ব্যথা করছে তার৷ কাল উঠতে পারলে হয়!
মনে মনে একবার ট্রাক ড্রাইভারকে, একবার নিজের ভাগ্যকে আর একবার ফারহান রুশদিকে গালি দিলেন তিনি। তারপর চুপচাপ শুয়ে রইলেন পাশের বেডের রোগীর স্যালাইনের ব্যাগের দিকে চেয়ে। এক ফোঁটা এক ফোঁটা করে স্যালাইন যাচ্ছে তার শরীরে।
একসময় চোখে ঘুম লেগে এলো তার। তিনি স্বপ্নে দেখলেন মনিকা তার সামনে বসে খিলখিল করে হাসছে৷ হাসির দমকে তার খোলা চুল বারবার মুখের ওপর এসে পড়ছে। সে চুলগুলোকে মুখের ওপর থেকে সরিয়ে কানের পাশে গুঁজে দিচ্ছে। আবারও হাসতে হাসতে চুল সামনে চলে আসছে।
তিনি স্বপ্নের ভেতর মেয়েটার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন। সে দূরে সরে গেল। তিনি ডাকলেন, “প্রিয়াঙ্কা….”
*********
বিকেলের মধ্যে রুশদির হাতে অনেকগুলো তথ্য চলে এলো। বিরিয়ানির ল্যাব রিপোর্ট চলে এসেছে।
যেটা জানা গেছে সেটা হলো, বিরিয়ানিটা ক্ষতিকর ছিল না৷ হ্যাঁ, তাতে সাপের বি ষ মেশানো হয়েছিল। কিন্তু তাপে সেটার কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে গেছে রান্নার সময়ই। তাই ওটা খেলে কারো রক্তে বি ষ মিশে গিয়ে তার মা রা যাবার সম্ভাবনা ছিল না। এজন্য হয়তো এতজন খেয়েও কারো কিছুই হয়নি। হয়তো রকির অন্য কোনো সমস্যা হয়েছিল। তবে সেটা হয়েছে বলেই রুশদি এই বি ষ মেশানোর ব্যাপারটা জানতে পেরেছেন বলে মনে মনে রকিকে অনেক ধন্যবাদ জানালেন তিনি।
যদিও নাঈশার ব্যাপারটা তাকে নিশ্চিত করল অন্য একটা ঘটনা। ল্যাপটপে এক ইমেইল আইডি থেকে অন্য একটায় সুইচ করতে গিয়ে তিনি দেখলেন নাঈশা তার একটা মেইল আইডি দিয়ে এই ল্যাপটপে একবার ঢুকেছিল৷ এটাতে বহু বাইরের মানুষের মেইল আসে।
তিনি কৌতুহলবশত ঢুকলেন সেটাতে। পাসওয়ার্ড সেভ করাই ছিল।
ঢুকে কিছুক্ষণ ঘাটাঘাটির পর যা মনে মনে আশা করেছিলেন সেটা পেয়ে গেলেন তিনি। মনিকার সেই মেইল!
তিনি এখন নিঃসন্দেহ যে নাঈশা সত্যিই তাকে খু নের প্ল্যন করেছিল।
মাথাটা কাল থেকে এলোমেলো ছিল। আজ গরম হতে শুরু করেছে। রাগে তার সব শিরা উপশিরা দপদপ করছে৷ একটা একরত্তি মেয়ে তাকে খু ন করবে! এত সোজা! সে যে অবস্থানে আছে তাতে বাঘা বাঘা লোকই তার কিছু করতে পারবে না৷ আর একটা মেয়ের এত সাহস! তাও নাকের ডগায় বসে…. ভাবতে পারলেন না তিনি। উঠে দাঁড়িয়ে পায়চারি করতে লাগলেন৷ যা করার আজই করতে হবে। বউ, বাচ্চা দুটোকেই খতম করে দেয়া দরকার। সাথে বাপটাকেও৷ সব শেষ হলে তিনি নিজে দলের একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে বসবেন। এসব ফালতু ঝামেলা আর ভালো লাগছে না৷ কিছু একটা প্ল্যান করতে হবে খুব দ্রুত।
********
প্রিয়াঙ্কা ইজ কলিং….
আরিফ কল ধরলেন, “হ্যাঁ প্রিয়াঙ্কা বলো।”
প্রিয়াঙ্কা কান্নাভেজা গলায় বলল, “কেমন আছো তুমি? কোথায় আছো?”
“এইতো হাসপাতাল থেকে রিলিজ দিয়েছে। এখন ঢাকার দিকে রওনা দিচ্ছি।”
“এই শরীর নিয়ে আসতে পারবে তুমি? দুটো দিন হাসপাতালে থাকতে নাহয়?”
আরিফ হেসে বললেন, “রিলিজ দিয়ে দিলে কেমন করে থাকব? আর আমি এত বেশিও ব্যথা পাইনি। ওই শরীরে একটা ঝাঁকুনি লেগে ভেতরের কলকব্জা একটু নড়েচড়ে গেছে আর কয়েক জায়গা কেটে ছড়ে গেছে। এখন বাড়ি ফিরে রেস্ট নিলেই ঠিক হয়ে যাব।”
প্রিয়াঙ্কা কেঁদে ফেলল, “আমি এইমাত্র শুনলাম তোমার মায়ের কাছে। আমাকে কেউ বলেনি। তোমাকে দেখতে যেতেও পারলাম না।”
“কাঁদো কেন? পাগল নাকি? তুমি এখন কোথায়?”
“হাসপাতালে।”
“আমি আসছি ওখানেই। তখন দেখো, আমিও তৌকিরকে দেখে আসবো। ওর অবস্থা কেমন?”
“এখন অনেকটা ভালো। তোমার আসতে হবে না। তুমি সোজা বাড়ি গিয়ে বিশ্রাম নাও। আমি গিয়ে দেখে আসবো।”
“হুম!”
কলটা রেখে আরিফের কেন যেন ভালো লাগতে লাগল। হাসপাতালেই যাবে সে৷ প্রিয়াঙ্কা তাকে দেখতে চেয়েছে যখন, তাকে মৃ ত্যু আগলে বসে থাকলেও তিনি ঠিকই যেতেন।
হাসপাতালে পৌঁছুতে পৌঁছুতে সন্ধ্যা হয়ে এলো।
তৌকিরের কেবিনে ঢুকতেই আরিফ দেখতে পেলেন একটা চমৎকার পারিবারিক দৃশ্য! তৌকির শুয়ে আছে, তার হাত ধরে বসে আছে তার মেয়ে তিন্নি, আর গভীর মমতায় তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে প্রিয়াঙ্কা।
প্রিয়াঙ্কা তাকে দেখতে চেয়েছে বলে তিনি ছুটে এসেছেন, কিন্তু এই মুহূর্তে তিনি বুঝতে পারলেন, ওটা বোধহয় কেবলই ভদ্রতা ছিল। প্রিয়াঙ্কা যাকে ভালোবাসে, তার জন্য তো সে নিজে পাগলপারা হয়ে ছুটে এসেছিল! এখন বুঝি ওদের মাঝে বোঝাপড়াও হয়ে গেছে!
তাকে দেখে ওরা সবাই খুশি হলো। কয়েক মিনিট বসে থেকে বিদায় নিলেন আরিফ। বলা চলে বেরিয়ে এলেন থাকতে না পেরে।
প্রিয়াঙ্কাকে তিনি ভালোবাসতেন সেই ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির পর থেকেই। প্রিয়াঙ্কা মূলত তারই বন্ধু ছিল। তৌকিরের সাথে ওর পরিচয় হয়েছিল তার কাজিন হিসেবে। তার আর প্রিয়াঙ্কার কত ভালো ভালো স্মৃতি জমা হচ্ছিল! তিনি কেবল সুযোগ খুঁজছিলেন ওকে মনের কথা বলার জন্য। কিন্তু কেন যেন বলা হয়ে উঠছিল না। কেবল মনে হতো, বললে যদি বন্ধুত্বটা নষ্ট হয়ে যায়?
এরপর একদিন প্রিয়াঙ্কাই তাকে খুব জরুরি কথা বলবে বলে ডাকল। সেদিন প্রিয়াঙ্কার ভাবভঙ্গি আর ইতস্তত ভাব দেখে তিনি ধরে নিয়েছিলেন বুঝি সেও তাকে ভালোবাসে!৷ বুঝি সেই ভালোবাসার কথাই বলতে এসেছে আজ! কিন্তু তাকে ভেঙেচুরে দিয়ে সেদিন প্রিয়াঙ্কা বলেছিল, সে তৌকিরকে ভালোবাসে!
আরিফের মনে আজও প্রিয়াঙ্কার জায়গা তেমনি রয়ে গেছে। তিনি মনিকাকে যে গল্পটা শুনিয়েছিলেন তার কবিতা লেখার, তার কিছুটা সত্যি ছিল! তার সব কবিতা ছিল প্রিয়াঙ্কার জন্য। এমনকি মনিকাকে দেয়া নাম, ‘মোহিনী’ মূলত তিনি প্রিয়াঙ্কাকে মনে মনে ডাকতেন৷ কখনো বা সামনেও বলে ফেলতেন, তিনি মোহিনীর জন্য বিয়ে করেননি। কিন্তু সেই মোহিনী কে তা কেউ কোনোদিন জানতে পারেনি।
গতরাতের স্বপ্নে মনিকাকে দেখে একটা বিষয় পরিষ্কার হয়ে গেছে। তিনি মনিকার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলেন। সেটা ঠিক মনিকার কারনে নয়৷ মনিকার হাসি, ওর চাহনি আর কানের পাশে চুল গোঁজা আবছাভাবে যেন প্রিয়াঙ্কার তরুণী বয়সের কথা মনে করিয়ে দেয়৷ কোথাও না কোথাও ওর ভেতর প্রিয়াঙ্কার একটা ছায়া ছিল। সেই ছায়াটাই তাকে মনিকার দিকে আকৃষ্ট করেছে, তাকে দিয়ে এতকিছু করিয়ে নিয়েছে!
আচ্ছা, তৌকিরও কি এজন্যই মনিকার প্রতি ঝুঁকে গিয়েছিল? কে জানে!
********
“সত্যি করে বল তো বাচ্চাটার বাপ কে?” নাঈশার হাতদুটো পেছনদিকে মুচড়ে ধরে কানের কাছে মুখ নিয়ে হিসহিসিয়ে জিজ্ঞেস করলেন রুশদি। নাঈশা দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “পাগল হয়েছ তুমি?”
“এটা আমার বাচ্চা না। হলে তুই তোর বাচ্চার বাপকে মারতে চাইতি না। সত্যি করে বল!”
“শয়তান তুই নিজেই তো দুশ্চরিত্র, খু নী! সবাই কি তোর মতো?”
“কালনাগিনী! তুই এখন দেখবি আমি কী কী করতে পারি, তোর চোখের সামনে তোর বাচ্চা ম রবে। তোর মা বাপ মর বে। কিন্তু তুই বেঁচে থাকবি, তিলে তিলে শেষ হবি তুই। রোজ একবার করে ম র বি আমার হাতে। তখন বুঝবি স্বামীকে বি ষ খাওয়ানোর আসল মজাটা কী!”
হর্নের শব্দে বাস্তবে ফিরে এলেন রুশদি। স্ত্রীর সাথে কাল্পনিক সংঘর্ষ বেশ উপভোগ করছিলেন জ্যামে বসে। এভাবে মা র তে মন চাইলেও তিনি কিছু করতে পারবেন না। একে হারাতে হবে বুদ্ধি দিয়ে। দাবার কোর্টে এখন চাল দেবেন শুধু তিনি।
একটা ফোন এলে তার কাছে৷ গোয়েন্দা আরিফের সব তথ্য জানার জন্য লোক লাগিয়েছিলেন তিনি। তারই ফোন। সব শুনে রুশদির রাগটা আবার প্রচন্ডভাবে চড়ে উঠল। এই দুই টাকার গোয়েন্দা পিছনে পড়েছে তার। আঠার মতো লেগে আছে একেবারে৷ তাকে চ্যালেঞ্জ করার ফলাফল ওর জন্য মোটেও ভালো হবে না। লোকটাকে অপমান করার তীব্র ইচ্ছে চেপে রাখতে পারলেন না রুশদি৷ ওর নাম্বারটা নিয়ে ফোন করে বসলেন।
“হ্যালো!”
“কেমন আছেন?”
গলাটা শুনে কেমন একটা লাগল আরিফের৷ সত্যি কি রুশদি ফোন করেছে? ঠান্ডা, সরীসৃপের মতো কণ্ঠ!
তিনি স্বাভাবিকভাবেই বললেন, “বলুন।”
“আমার পেছনে লেগেছেন কেন?”
আরিফ কোনো উত্তর দিলেন না।
রুশদি হাসলেন। হাসতে হাসতে বললেন, “করুন যা খুশি। যত এভিডেভেন্স আছে সব নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ুন। তারপর দেখুন কে বেশি শক্তিশালী! আমি না আপনি!”
কয়েক সেকেন্ড ওপাশে নিরবতা দেখে গলা চড়িয়ে এবার রুশদি বললেন, “দু’টাকার গোয়েন্দা হয়ে নিজের লিমিট যে জানে না তার পরিণতি কী হয় তোকে আমি দেখিয়ে দেব শা লা!”
ফোনটা কেটে দিলেন রুশদি৷ মনে মনে আরো কিছু গালি দিলেন। ঠিক কাকে দিলেন নিজেও বুঝতে পারলেন না।
আজ তিনি খুব কনফিডেন্ট৷ তই কনফিডেন্সের উৎস তার জানা নেই। তবে মনে হচ্ছে আজ তার সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। তিনি নিজের প্রিয় গাড়িটা আজ নিয়ে বের হয়েছেন। এটা সেই গাড়ি যেটাতে মনিকার লা শ স্থানান্তর করেছিলেন তিনি৷ প্রচুর ডিএনএ পাওয়া যাবার সম্ভাবনা আছে বলেই গাড়িটা তিনি রেখে দিয়েছিলেন গ্যারেজে।
আজ তিনি নিজ হাতে গাড়িটা পরিষ্কার করেছেন। কোনো সূত্র রাখেননি৷ কেউ কিছু খুঁজে পাবে না এখান থেকে।
শ্বশুরবাড়ি রওনা দিয়েছেন রুশদি। সব প্ল্যান সেট হয়ে গেছে৷ আজই শেষ করে দেবেন নাঈশার বাচ্চাটাকে। ওটাকে নিজের বাচ্চা বলতে রাজি নন তিনি৷ নাঈশাকে সেই অপরাধের শাস্তি একটু একটু করে দেবেন তিনি যা সে কোনোদিন করেইনি৷ ঠোঁটে একচিলতে হাসি ফুটে উঠল তার।
শ্বশুররের আলিশান বাড়ির সামনে গাড়িটা থামালেন ফারহান রুশদি। ভেতরে ঢুকতে যাবেন, ঠিক তখনই তার মোবাইলে একটা মেসেজ এলো। দেখলেন গোয়েন্দার নাম্বার থেকে এসেছে মেসেজ। অনেকগুলো ছবি তাতে। ছবিগুলো দেখে স্থির হয়ে গেলেন তিনি।
মনিকার মৃ ত্যুর সময়ে তোলা ছবি আর ওর শাড়ি পরা অন্য মেয়েটার লা শের ছবি। লোকটা কি তবে সত্যিই বের করে ফেলেছে সবকিছু? রুশদির নার্ভাস লাগতে শুরু করল।
গ্লাভ কম্পার্টমেন্ট হাতড়ে একটা সিগারেটের বক্স পেলেন৷ এটা মনিকার মৃ ত্যুর দিনে পকেটে ছিল তার৷ পরে কখন যেন এখানে রেখেছিলেন। বের করা হয়নি আর। এই জায়গাটা পরিষ্কারও করা হয়নি। সেফটির জন্য সেদিনের পর সিগারেটের ব্র্যান্ড বদলে ফেলেছিলেন তিনি৷ কিন্তু এখন হাতের কাছে এটাই আছে। প্রবল সিগারেটের তৃষ্ণা পাচ্ছে তার। ঠান্ডা মাথায় ভাবা দরকার।
তিনি সিগারেট ধরালেন৷ ধোঁয়া ছাড়ার সাথে সাথে ভাবতে লাগলেন পরের পদক্ষেপ কী নেবেন। অনেক ভাবলেন তিনি। ভাবতে ভাবতে সিগারেটও ফুরিয়ে এলো৷ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন একসময়। ব্যাপারটা অতটাও জটিল হবে না মনে হয়।
আজকাল এআই দিয়ে ছবি বানানো ব্যাপার না৷ কয়েকটা ছবি মিথ্যে বলে চালিয়ে দেয়া যাবে৷ কোর্টে এসব দূর থেকে তোলা ছবি বা ভিডিও কোনো কাজে আসবে না৷ তার যেহেতু অনেক শত্রু, তাই এসব ষড়যন্ত্র বলেও চালিয়ে দেয়া যাবে। তাছাড়া যদি মনিকার আসল লা শও পোস্টমর্টেম করা হয়, তবুও তাকে দোষী বলা যাবে না, কারন মনিকাকে তো তিনি খু ন করেননি! মনিকা সু ই সা ই ড করেছিল! তার ওপর তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার জন্য এই গোয়েন্দার ক্যারিয়ার খেয়ে দেয়া যাবে!
আর রইল বাকি নাঈশা। ওর ব্যাপারে যা ভেবেছিলেন তাই করবেন।
গাড়ি থেকে বের হয়ে গাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে আয়েশ করে শেষ সিগারেটটা ধরালেন তিনি৷ শ্বশুরের বাড়িটার দিকে চাইলেন। নতুন বাড়ি না কিনে শ্বশুরকে হটিয়ে দিতে পারলে এটাতেই তো থাকা যায়। বেশ চটক আছে বাড়িটার!
মুচকি হেসে সিগারেটে টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়লেন। হঠাৎ নাকমুখ জ্বালা করতে শুরু করল তার। বুকে চাপ ব্যথা শুরু হলো। শরীরের ব্যালেন্স যেন হারিয়ে যেতে থাকল। বসে পড়লেন তিনি। ভেতরের সবকিছু বেরিয়ে আসতে চাইছে। পুরো শরীর যেন পাক খাচ্ছে ভেতরের দিকে। তিনি খেয়াল করলেন নিঃশ্বাস নিতে পারছেন না৷ হাত পা অবশ হয়ে যাচ্ছে। কয়েক সেকেন্ডের মাঝে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন তিনি। শরীরটা নিস্তেজ হয়ে এলো।
বাড়ির সামনে এক গার্ড লক্ষ্য করছিলো তাকে অনেকক্ষণ ধরেই। সে বুঝতে পেরেছিলো ওটা ফারহান রুশদির গাড়ি। কিন্তু নিজে থেকে যে ভেতরে ঢুকছে না তাকে তো কিছু বলা যায় না। হঠাৎ তাকে পড়ে যেতে দেখে দৌড়ে এলো গার্ড। তার কেমন সন্দেহ হলো লোকটার অবস্থা দেখে। হাত ধরে পালস চেক করল সে। নাহ, পালস পাওয়া গেল না।
হাসপাতালে নেবার পর ফারহান রুশদিকে মৃ ত ঘোষণা করা হলো।
********
পরের অনেকগুলো দিন ঝড়ের মতো কেটে গেল। ময়না তদন্তে জানা গেল রুশদির শেষ সিগারেটের তামাকে মেশানো ছিল সা য় না ই ড। সেটা কে বা কারা মিশিয়েছিল তা জানা গেল না। আরিফের পাঠানো ছবি পাওয়া গেল রুশদির মোবাইলে। মনিকার কেসটা নিয়েও ঘাটাঘাটি হলো খানিকটা। কিন্তু লোকটা যেহেতু আর বেঁচে নেই, তাই আরিফও আর এসব খোলাসা করলেন না। যতটুকু জানালে ব্যাপারটা মিটে যাবে ততটুকু জানালেন কেবল। রুশদির এসিস্ট্যান্ট আর ফরেনসিকের বন্ধুর থেকে এটা জানা গেল যে তার খাবারে সাপের বি ষ মিশিয়ে আগেও তাকে মারার চেষ্টা করা হয়েছে৷ কিন্তু সেটা কে করেছে তা পরিষ্কার নয়। সব মিলিয়ে মামলাটা অমীমাংসিতই রয়ে গেল।
এর মাঝে নির্বাচন চলে এলো। নাঈশা রুশদি ফারহান রুশদির জায়গায় দাঁড়ালো নির্বাচনে। বিপুল ভোটে জয়লাভও করল।
কেউ জানতে পারল না ফারহান রুশদির আসল ঘাতক কে। কিন্তু আরিফের একটা সন্দেহ রয়ে গিয়েছিল। তিনি পুরো তদন্তের খুটিনাটির দিকে নজর রাখছিলেন৷ একদিন হঠাৎ কী মনে হতে তিনি মনিকার মৃ ত্যুর সময়ের ভিডিও ফুটেজটা নিয়ে বসলেন। বড় স্ক্রিনে ভালো করে পুরোটা দেখলেন কয়েকবার। একটা সময়ে তার কাছে পরিষ্কার হয়ে এলো সবটা।
মনিকা রুশদির পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট ধরিয়ে নিয়ে ক্যামেরার দিকে পিঠ দিয়ে বেডসাইড টেবিলে কিছু একটা করেছিল। তার টেবিলের সামনে যাবার আগের আর সরে যাবার পরের ফুটেজ ভালোমতো দেখলে বোঝা যায় টেবিলে অনেক হাবিজাবি জিনিসের মাঝে একটা সিগারেটও পড়েছিল। মনিকা সেটাই রুশদির সিগারেটের প্যাকেটে ঢুকিয়ে দিয়েছিল৷ এজন্য পরের দৃশ্যে ওটা আর টেবিলের ওপর দেখা যায়নি।
মনিকা এজন্যই লিখে রেখে গিয়েছিল, শত্রুর শেষ রাখতে নেই!”
তবে মনিকা সা য় না ই ড কোথায় পেয়েছিল সেই রহস্যের কিনারা স্বয়ং আরিফও করতে পারেননি কোনোদিন।
(সমাপ্ত)
সুমাইয়া আমান নিতু