মৌয়ের সংসার পর্ব-০৩

0
2

#মৌয়ের_সংসার (৩)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি

দু’মাস কেটে যায়। ইতিমধ্যে পলাশের বিয়ে হয়ে যায়। এই খবর শোনার পর থেকে মৌ তার সঙ্গে কখনো যোগাযোগ করেনি। পলাশ যাতে যোগাযোগ না করতে পারে সেই ব্যবস্থা করেছে। যদিও কষ্ট তার হয়েছে তবে সেটা সে প্রকাশ করেনি। কাউকে বুঝতে দেয়নি। স্বাভাবিকভাবে জীবন-যাপন করছে। পলাশের বিয়ের দিন কাজল মৌকে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলো,“তুমি নিজেকে এত স্বাভাবিক রাখছো কিভাবে?”

“কারো জন্য কারো জীবন থেমে যায় না৷ আমাদের দু’জনার জীবনই তার নিজ গতিতে চলবে। এসবের মাঝে কষ্ট প্রকাশ করে নিজেকে দূর্বল করার মানে হয় না। যা ঘটে গেছে তা গেছে।সেটা তো পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। তাই সবটা মেনে এগিয়ে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।”
মৌ যথেষ্ট স্বাভাবিক কন্ঠে কথাগুলো বলে। কাজল তার এতটা মনোবল দেখে সত্যি অবাক হয়। সেই সঙ্গে খুশিও হয়। সত্যি তো। যা জীবনে ঘটে গেছে সেটা তো পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। তাহলে শুধু শুধু নিজেকে দূর্বল প্রমাণ করে লাভ কি? এক্ষেত্রে কাজলের তার অতীতের কিছু স্মৃতি মনে পড়ে যায়। কিশোরী বয়সে তার জীবনে প্রেম এসেছিলো। তবে সেই প্রেম সফল হয়নি। তার প্রেমিক বিদেশ যাওয়ার পর অন্য মেয়ের সঙ্গে জড়িয়ে যায়। যেদিন তার প্রেমিক বলে,“স্যরি কাজল। আমি তোমাকে ঠকাতে চাইনি। কিন্তু হয়ে গেছে।”

কাজল তার কথা মানতে পারে না। সে বিশ্বাস করে না। সে কান্নায় ভেঙে পড়ে। তার প্রেমিক তার সঙ্গে সব সম্পর্ক শেষ করে চলে যাচ্ছে এটাই সে মেনে নিতে পারে না। নিজের আবেগ ধরে রাখতে না পেরে তার কাছে অনুরোধ করে বলে,“তুমি আমাকে ছেড়ে যেও না। আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি। তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না।”

সেদিনের পর বহুরাত জেগেছে কাজল। কান্না করে অজস্র সময় নষ্ট করেছে। বেহায়ার মতো তার প্রেমিকের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে। সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়লে এখন হাসি পায় কাজলের। আবেগের বশে নিজের মূল্যবান কতই না সময় নষ্ট করেছে। তার প্রেমিক তার কাছে কখনো ফিরে আসবে না জেনেও তার পিছনে ঘুরে নিজেকে শেষ করেছে। সেই স্থান থেকে উঠতে কাজলের বেশ সময় লেগেছে। আজ হাসি পেলেও সেই দিনগুলো খুব কষ্টের ছিলো। তবে সেদিন যদি কাজল মেনে নিতে পারতো তার প্রেমিক তাকে ধোঁকা দিয়েছে। সে আর ফিরবে না। তাহলে হয়তো সামনে এগিয়ে আসা সহজ হতো। আজ অবশ্য কাজল খারাপ নেই। তার জীবনে নতুন একজন এসেছেও। তার সঙ্গে বিয়ে ঠিক। খুব শীঘ্রই তাদের বিয়ে হবে। তবে অতীতের কথা ভাবলে আজও তার বুক কাঁদে। কিভাবে নিজেকে সামলে এতটা এসেছে সেসব ভাবলে আফসোস হয়। সত্যি তো কষ্ট প্রকাশ করে লাভ নাই। কাজল তো দূর্বলতা প্রকাশ করেছিলো। বিনিময়ে ওপর পাশের মানুষ সেটার সুযোগ নিয়েছে। সেটাকে মজা হিসাবে নিয়েছে। এসব ভেবে কাজল মৌকে জড়িয়ে ধরে। মৌ ম্লান হাসে।

____

সময় কেটে যায়৷ মৌ তার স্মৃতিতে পলাশের অধ্যায়টা শেষ করে দেয়। এরই মাঝে তার বাবা ফোন দিয়ে অবশ্য বিয়ের বিষয়ে কথা বলে। মৌ তার বাবাকে পাত্র দেখতে বলে। অবশ্যই তার শর্ত মানবে এমন পাত্র। সেই সঙ্গে সে আগে কথা বলে সব পরিস্কার করে নিবে। তার বাবা রাজি হয়। তার বাবা অবশ্য মায়ের মৃ ত্যুর পর থেকে তাকে কোন বিষয়ে জোর করে না। এখানেও করবে না জানতো মৌ। পলাশের সঙ্গে সম্পর্ক থাকায় এতদিন পাত্র দেখতে বারণ করেছিলো। ইচ্ছে ছিলো পলাশ তার পরিবারকে জানালে, সেও তার পরিবারকে জানাবে। যেহেতু সেটা হচ্ছে না। বয়সও বেড়ে যাচ্ছে। সেহেতু এখন খোঁজা উচিত। মৌয়ের কথা অনুযায়ী তার বাবা এক লোকের মাধ্যমে একজন পাত্রের সন্ধ্যান পায়।

পাত্রপক্ষ এসে মৌকে দেখে যায়। তাদের অবশ্য পছন্দ হয়। তবে পাকা কথা বলার আগে মৌ ছেলের সঙ্গে আলাদা কথা বলার ইচ্ছা প্রকাশ করে। তেমন সুযোগই করে দেওয়া হয়। বাড়ির ছাদে মৌ এবং ছেলেটি গিয়ে বসে। সেখানে গিয়ে সজলই প্রথমে বলে,“আপনার আমাকে ভালো লেগেছে?”

মৌ ছেলেটি অর্থাৎ সজলের দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলে,“একবার দেখায় ভালো লাগা হয় বুঝি?”

“হয় না?
আমার তো আপনাকে ভালো লেগেছে।”
এটা শুনে মৌ ম্লান হাসে। অতঃপর বলে,“আচ্ছা। তো বিয়ের পর আপনি আমাকে চাকরি করতে দিবেন?”

“হ্যাঁ। চাকরি করবেন না কেন?
এত ভালো চাকরি ছেড়ে দিবেন।আমার এসবে অসুবিধা নেই।”
মৌয়ের কথাটি ভালো লাগে। তবে পরক্ষণে সজল যা বলে সেটা শোনার জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। সজল বলে,“বউ চাকরি করলে ভালো তো। মাথার উপর বাড়তি চাপ পড়ে না। সংসার চালানো সহজ হয়ে যায়। সংসার সামলে বউ চাকরি করতে পারলে অসুবিধা কোথায় আর? চাকরি করে তো টাকা স্বামীর হাতেই তুলে দিবে।”

“আচ্ছা।
আর যদি তুলে না দেয়?”
মৌয়ের এই কথা শুনে সজল অবাক হয়। সে বিষ্ময় নিয়ে বলে,“মানে? আপনি টাকা তুলে দিবেন না? টাকা দিয়ে আপনি কী করবেন? মেয়ে মানুষের এত টাকা লাগে নাকি?”

“কেন মেয়েদের খরচ নেই বুঝি?”
মৌয়ের এই কথায় সজল ভাবহীন ভাবে জবাব দেয়,“মেয়েদের আবার খরচ কিসের? বছরে দুটো জামা, আর তিনবেলা খাবার। এটা তো আমিই দিবো। এছাড়া তো তেমন খরচ নেই। হ্যাঁ যাতায়াত ভাড়া। যেহেতু চাকরি করেন লাগবে। কিন্তু আর তো কিছু নেই। আমাদের মতো তো বন্ধুবান্ধব নেই যে দোকানে গিয়ে বসলেই পাঁচশো এক হাজার টাকা চলে যাবে।”

“আচ্ছা আপনি আসতে পারেন।”
মৌয়ের কথা বুঝতে পারে না সজল। সে বোকার মতো তার দিকে তাকিয়ে বলে,“হ্যাঁ?”

”আমি বললাম, আপনি এবার আসতে পারেন।
আমি আসলে আপনার মতো মানুষকে চাচ্ছিলাম না জীবনে।”
এই কথা শুনে সজল হতবাক হয়ে বলে,“মানে? আমি ভুল বললাম কিছু? সব তো ঠিকই বললাম। তাহলে আপনি এমন করছেন কেন?”

“না আপনি ঠিক বলেননি।”
এটা বলে মৌ শান্ত চোখে সজলের দিকে তাকায়। সজল বুঝতে না পেরে তাকিয়ে থাকে। মৌ শান্ত গলায় বলে,“স্ত্রী হিসাবে অবশ্যই আমার দায়িত্ব স্বামীর পাশে থাকা। তার সংসার স্যরি তার নয় আমার সংসার। যেহেতু সেটা আমার সংসার তাই সেটার ভালো মন্দ দেখার দায়িত্ব আমার। কিন্তু তাই বলে এমন নয় যে আমি চাকরি করি বলে কোন ছেলে সেই টাকার আশায় আমাকে বিয়ে করবে। একজন পুরুষ মানুষের তার স্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়া জরুরি। সেখানে দাঁড়িয়ে স্ত্রী চাকরি করে বলে সব দায়িত্ব শেষ। তার দায়িত্ব নেই। সেই টাকায় উল্টো সংসার ভালো চলবে। এই আশা করা ছেলে দায়িত্ববান হবে বলে আমার মনে হয় না। আমি আসলে দায়িত্বহীন ছেলে চাচ্ছি না জীবনে৷ এটাই কারণ আপনাকে পছন্দ না হওয়ার। আশা করি বুঝতে পেরেছেন।”

“এটা কেমন কথা হলো?
আমি তো আপনার চাকরি করার বিপক্ষে নই। আপনার তাহলে সমস্যা কোথায়? স্ত্রী চাকরি করলে সে দায়িত্ব নিবে না?”

“হ্যাঁ অবশ্যই নিবে।
কিন্তু সেটা নিজের ইচ্ছায়। বিয়ে করার আগেই স্ত্রী সংসার টানবে বা তার টাকায় নিজের শতভাগ দাবি আছে ভেবে বসা ছেলের ইচ্ছায় নয়। আমি স্পষ্টভাবে কথা বলতে ভালোবাসি তাই স্পষ্টভাবে বলছি, আপনার কথা শুনে আমার মনে হচ্ছে আপনার আমাকে নয় আমার চাকরিটাকে বেশি পছন্দ হয়েছে। এটা লোভ। যদি এটা লোভ না হতো তাহলে অবশ্যই আমি মেনে নিতাম। আশা করি বুঝেছেন।”
মৌয়ের কথা শুনে সজল প্রচন্ড রেগে যায়। সে রাগান্বিত গলায় বলে,“আপনি দেখছি নারীবাদী। মানে নিজের বেলায় ষোলোআনা কিন্তু পরেরবেলায় নাই। এজন্যই মানুষ চাকরিজীবি মেয়েদের পছন্দ করে না। এরা একেকটা….।”

“থামুন।
আপনার মুখ থেকে আমি আর একটাও শব্দ শুনতে চাই না। আমি নারীবাদী হলে তাই। নিজের ভালোটা ভাবা যদি অন্যায় হয় তবে অন্যায় করছি। আমার এই অন্যায়টা যে মেনে নিতে পারবে আমি তাকেই বিয়ে করবো। আপনার মতো কাউকে নয় যে আমার চিন্তাকে সম্মান জানাতে পারবে না। আমাকে সম্মান জানাতে পারবে না।”
এটা শুনে সজল আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলো তবে মৌ বলার সুযোগ দেয় না। সে তাকে চলে যেতে বলে। মৌয়ের কঠিন গলায় বলা কথা শুনে সজল বের হয়। তবে যাবার আগে বলে যায়,“আপনার মতো উগ্র মেয়েদের কখনো বিয়ে হবে না। ঘরে আইবুড়ো হয়ে থাকতে হবে। জেনেশুনে তো কেউ বে…. ঘরে তুলবে না।”

“আপনার এখনের কথা শুনে আমি বুঝতে পারলাম আসলেই আমি সঠিক। আমি আপনাকে ঠিক চিনেছি। তাই রিজেক্ট করে ভুল করছি না।”
এটা বলে মৌ নিজে ছাদ থেকে নেমে যায়। সজল রাগে ফুসতে থাকে। এক কথায় বলা যায় একটি মেয়ে সজলকে রিজেক্ট করেছে এটা সে মেনে নিতে পারছে না। তার পুরুষত্বে লাগছে। যেই বিষয়টা মৌও বুঝতে পারে।

এভাবে সজলের মতো তিন চারজনের সঙ্গে দেখা হয় মৌয়ের। সবগুলো প্রস্তাব তার পক্ষ থেকেই রিজেক্ট করা হয়। এসবে মৌয়ের বাবা বিরক্ত নাহলেও তার সৎ মা বিরক্ত হয়। মেয়েদের এত যাচাই বাছাই কি? তার এসব পছন্দ হচ্ছে না। তবে এসবে মৌ গুরুত্ব দেয় না। সে তো এখানে থাকেই না। যখন পাত্রপক্ষের সঙ্গে কথা হয় তখন নিজের ছুটির দিনে এসে দেখা করে। এসব দেখে অবশ্য সবাই বলতো, মৌয়ের কপালে স্বামী জুটবে না। এভাবে সামান্য কারণে যদি সব ছেলে রিজেক্ট করে এমন খারাপ মেয়েকে কে বিয়ে করবে? মৌ তাদের সবার কথায় স্পষ্টভাবে জবাব দিয়ে বলতো,“আমার মতো খারাপ মেয়ের এসব খারাপ চিন্তায় যে সমর্থন জানাবে তার সঙ্গেই বিয়ে করবে।”

এসবে অবশ্য সবাই ভেবে নিয়েছিলো এমন মানুষ নেই। কখনো আসবে না। মৌয়ের মনেও কোথাও গিয়ে দ্বিধা ছিলো। তবে না। সবার কথা সত্যি হয়নি। একদিন সবাইকে মিথ্যা করে দিয়ে মৌয়ের পছন্দের এক পাত্রের সঙ্গে তার দেখা হয়। পড়ন্ত বিকালে ছাদে বসে দু’জন কথা বলছিলো। শুরুতেই লোকটি অর্থাৎ পিয়াস বলে,“আমি আপনাকে আগেও দেখেছি। আমার আপনাকে আগে থেকেই পছন্দ। শুনলাম আপনার বিয়ের জন্য পাত্র খোঁজা হচ্ছে তাই প্রস্তাব নিয়ে চলে আসলাম।”
একটু থেমে আবার বলে,”আমার যেহেতু আপনাকে পছন্দ সেহেতু আমার কিছু জানার বা বলার নেই।তাই আপনি যা জানতে চান সেটা জিজ্ঞেস করুন। আমি জবাব দিচ্ছি।”

“আচ্ছা।”
এটা বলে মৌ একে একে তার কিছু প্রশ্ন করে। পিয়াস সব প্রশ্নের জবাবই খুব সুন্দর দিচ্ছিলো। সবগুলো মৌয়ের পছন্দ হয়। তবুও সে বলে,“আপনাকে আমার পছন্দ হয়নি।”
কথাটি শুনে পিয়াসের মন খারাপ হয়ে যায়। সে কিছুটা সংকোচ নিয়ে বলে,“আমি কম বেতনের চাকরি করি বলেই বুঝি আপনার এই সিদ্ধান্ত। যদিও আমি জানতাম, আমাকে আপনার পছন্দ হবে না। সামান্য ঔষধ কোম্পানির খুব ছোট পোস্টে চাকরি করি। আপনার মতো সুন্দর এবং শিক্ষিত স্বাবলম্বী মেয়ের পছন্দ না হওয়ারই কথা। এসব জেনেও আমি আসছিলাম। কারণ আপনাকে আমার ভালো লেগেছে।”

একটু থেমে আবার বলে,“স্যরি আমার এসব বলা উচিত হয়নি। আসলে মনের কথা জমিয়ে রাখতে পারলাম না তাই বললাম। যাই হোক এবার উঠি।”
এটা বলে পিয়াস উঠতে নিলে মৌ বলে,“আপনার রাগ হচ্ছে না?”

”রাগ কেন হবে?”
পিয়াস অবাক হয়ে প্রশ্ন করে। মৌ শান্ত গলায় বলে,“একটি মেয়ে আপনাকে রিজেক্ট করলো। এটায় রাগ হচ্ছে না?”

“স্যরি। এখানে রাগ হওয়ার কী আছে? আপনি মেয়ে বলে আপনার নিজস্ব পছন্দ থাকতে পারে না? আমি একজনকে পছন্দ করেছি বলে যে তাকে আমাকে পছন্দ করতে হবে এমন তো কথা নেই। উল্টো দিকের মানুষটি আমায় প্রত্যাখান করতেই পারে। হ্যাঁ একটু মন খারাপ হচ্ছে। সমস্যা নেই। ভবিষ্যত হয়তো আমার জন্য ভালো কিছু আছে। তাই এই সম্পর্ক এগিয়ে যাচ্ছে না।”
পিয়াসের মুখে এই কথা শুনে মৌ মুচকি হাসি দেয়। সে মুচকি হাসি দিয়ে পিয়াসের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। পিয়াস তার হাসির অর্থ বুঝতে পারে না।


চলবে,