#মৌরিফুল [পর্ব-১]
প্রভা আফরিন
আমরা যেদিন পালিয়ে বিয়ে করলাম সেদিনই আমার সদ্য হওয়া শাশুড়ি স্ট্রোক করলেন। খবর পেয়ে আমার ভীতু বর আমাকে মাঝরাস্তায় একা ফেলে মায়ের কাছে চলে গেল। সেদিনই আমি জীবনের প্রথমবার বাস্তবতার ধাক্কাটা খেয়েছিলাম।
কৈশোর বয়সে আহসানের সঙ্গে আমার প্রেমটা হয়েছিল আত্মীয়তার সূত্রে। আহসান আমার ফুপাতো বোনের চাচাতো ভাই। আমার ফুপুর ছোটো ছেলে জন্মানোর পর এক সপ্তাহের জন্য ফুপুর বাড়িতে থেকেছিলাম। সেখানেই আহসানের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। আমি তখন দশম শ্রেণিতে উঠেছি সবে। আহসান এইচএসসি শেষ করে টইটই করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বলাবাহুল্য আহসানের সৌন্দর্য নজরকাঁড়া। আমার কিশোরী চোখে অনায়াসেই গেঁথে গেছিল সে। তবে আমি ছিলাম চূড়ান্ত আত্মকেন্দ্রিক ধরনের মেয়ে। তাই কিছুতেই আহসানের সঙ্গে সখ্য গড়তে পারছিলাম না। সুযোগটা করে দিলো আহসানই। সে অত্যন্ত মিশুক স্বভাবের হওয়ায় আমার স্বভাবের জড়তা কাটতে দুদিনের বেশি সময় লাগেনি। তবে না, ওই সাতদিনে আমাদের প্রেম হয়নি। শুধু সাত দিনের মাথায় যখন বিদায় নিতে গেলাম বুকের ভেতরে কিছু একটা ঝনঝন করে বাজছিল। বাবা গাড়ি রিজার্ভ করে এনেছেন বাড়ি ফেরার জন্য। আমি ব্যাগপত্র নিয়ে বেরিয়ে এলাম। আহসানকে আশেপাশে কোথাও দেখলাম না। কিছু একটা ফেলে এসেছি এই বাহানায় ছুটে গিয়েছিলাম ভেতরে। আহসানের ঘরে উঁকি দিয়ে দেখি সে জানালার কাছে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। কোনোকিছু না ভেবেই বলে বসেছিলাম,
“আহসান ভাই, তোমাকে ভীষণ মিস করব।”
এরপর আর পিছু ফিরে তাকাইনি। এক ছুটে এসে গাড়িতে চড়ে বসেছিলাম। সারাটি রাস্তা চোখের পানি লুকিয়েছিলাম কৌশলে। আমার বড় বোনটার গোয়েন্দা স্বভাব আছে। সে বোধহয় কিছু সন্দেহ করেছিল। বারবার খুঁচিয়ে বলছিল,
“বাব্বাহ মৌরি, তুই তো ফুপির বাড়ি আসতেই চাইতি না। এবার হঠাৎ ছেড়ে আসতেই চাইছিস না! ঘটনা কি? হু?”
“কোনো ঘটনা নেই, তরী আপু। টুবাইয়ের জন্য মন কেমন করছে।”
টুবাই আবার ফুপির ছেলের নাম। আমিই নামটা রেখেছি। নাম সিলেকশনের সময় যখন হুট করে নামটা বলেছিলাম সবাই খুব হাসাহাসি করেছিল। একমাত্র আহসান বলেছিল নামটা তার পছন্দ হয়েছে। এভাবেই ছোটো ছোটো ব্যবহার দিয়ে আহসান আমার বোকা মনটাতে বসত গেড়েছিল।
দ্বিতীয়বার আমাদের দেখা হলো প্রায় পাঁচ মাস পরে। এই পাঁচটি মাসের একটি রাতও এমন ছিল না যে আমি আহসানকে মনে করে ছটফট করিনি। এসএসসির আগে ফোন ব্যবহারের পারমিশন ছিল না আমার। তারচেয়েও বড় কথা আহসানের কোনো কন্টাক্ট আমার কাছে ছিল না। ফুপির কাছে মা যখন ফোন করত তখন উৎকর্ণ হয়ে থাকতাম আহসানের কণ্ঠ শুনতে। প্রতিবারই হতাশ হতাম। এরমাঝে আহসানের রেজাল্ট হলো। তাকে দেশে রাখবে না তার বাবা মা। আহসান বাইরে পড়তে যাওয়ার প্রস্তুতি আগে থেকেই নিচ্ছিল। কিছুদিন বাদে খবর পেলাম সে কানাডায় পড়তে যাবে। সেখানকার একটি স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়ার খুশিতে আমাদের দাওয়াত পড়ল ফুপির বাড়ি। আমার ফুপির জা অর্থাৎ আহসানের মা ভীষণ অহংকারী ও চতুর মানুষ। শো অফ করার অভ্যাস উনার রন্ধ্রে রন্ধ্রে। আহসানের ভালো ফলাফল ও বাইরে পড়তে যাওয়াটাকে তিনি চাঁদে যাওয়ার সঙ্গে তুলনা করে বসেছেন।
আহসানের সঙ্গে দেখা করার জন্য প্রতিনিয়ত ছটফট করেছি ঠিক কিন্তু যখন শুনলাম তার দেশে থাকার সময় কম এর পর থেকে কেন জানি একটা শূন্যতা আমায় ঘিরে রাখল। যেই আমি ফুপির বাড়ির নাম উঠলে সবচেয়ে বেশি আগ্রহ দেখাতাম সেই আমিই এবার ওদের নিমন্ত্রণে গেলাম সবচেয়ে গোমড়া মুখ নিয়ে। আহসানের সঙ্গে দেখা হলো একেবারে খাবার টেবিলে। তাকে দেখেই বিষম খেলাম। পাঁচ মাসের ব্যবধানে কি অপূর্বই না হয়েছে সে। মনে মনে কেন জানি ভয় কাজ করতে লাগল। আচ্ছা! আহসান যদি আর না ফেরে! সেই দেশেই প্রেম-বিয়ে সেরে ফেলে! করলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। কিন্তু গোপনে একটা হৃদয় ভাঙার যন্ত্রণা তো থাকবেই। যা সম্পর্কে সকলেই অজ্ঞাত। এসব ভাবতে ভাবতে পোলাওয়ের লোকমাটা মুখে তুলে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললাম আমি। সকলে আমার কান্না দেখে হকচকিয়ে গেল। একমাত্র আহসানকে দেখলাম আমার দিকে তাকিয়ে আলতো করে হাসল। আমি বোধহয় সেই মুহূর্তে খু’ন হয়ে গেছিলাম।
আহসানের সঙ্গে আমার একান্তে কথা হয়েছিল সন্ধ্যায়। আহসান তার খয়েরি ঠোঁটে দুষ্টু হাসি ঝুলিয়ে বলেছিল,
“মৌরি, তুমি তখন কেঁদেছিলে কেন?”
আমি অপ্রস্তুত মুখে বলেছিলাম, “কাঁদিনি তো। ঝালে চোখে পানি এসে পড়েছিল।”
আহসান ঝুঁকে এসে কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলে, “ঝাল কোথায় লেগেছিল? মনে?”
আমি চোখ বুজে নিয়েছিলাম। চোখে পানি এসেছিল পুনরায়। এরপর অনুভূতি নিয়ে আর কোনো রাখঢাক ছিল না। সেই ক্ষণকে আমি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় ভেবে নিয়েছিলাম। আর ধরে নিয়েছিলাম ওর থেকে দূরে থাকলে বোধহয় মরেই যাব। হায় ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! এরপর কতগুলো বছর ওকে ছাড়া দিব্বি বেঁচে আছি।
আহসানের সঙ্গে আমার প্রেমের স্থায়িত্ব ছিল মাত্র এক সপ্তাহ। ওর ফ্লাইটের আগে একটা সপ্তাহ আমি বহু কায়দাকানুন করে ফুপির বাড়িতে রয়ে গেছিলাম। অপক্ববুদ্ধি, অপক্ব অনুভূতির জোয়ারে উথাল-পাতাল মন আমার। আহসানকে হারানোর ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকতাম। যেন কত যুগ পুরোনো প্রেম আমাদের, এমন সুরে বলতাম,
“তুমি তো ও দেশে গেলে আমায় ভুলেই যাবে।”
আহসান আমার হাত ধরে বলত, “তুমি আমার মনের মাঝেই থাকবে। ভোলার তো প্রশ্নই আসে না।”
আমার কেন জানি আহসানের কথা বিশ্বাস হতো না। কারণ ওর মেধা, যোগ্যতা ও রূপের প্রতি মেয়েদের দৃষ্টি সদা তীক্ষ্ণ থাকত। একদিন বড়দের আড্ডায় কথা উঠেছে। ফুপি বললেন,
“ছেলে দূরে পাঠাচ্ছেন ভাবি, যদি আর না ফেরে? সাদা চামড়া বিয়ে করে বসত গাড়ে ও দেশে!”
আহসানের মা তখন আত্মবিশ্বাসের সাথে বললেন, “আমার ভাইয়ের মেয়েটা আরেকটু বড় হলে ধরে পান-চিনি করিয়ে ফেলব। রোজা তো পরের বছরই কানাডায় যাবে। দুটিতে কাছাকাছি থাকলে আমার আর চিন্তা নেই।”
রোজা আপু আমার চেয়ে দুই বছরের বড়। আহসান ভাইয়ার কাজিন। এই মেয়েটির প্রতি আহসান ও তার পরিবারের স্নেহ আমার মনে হুল ফুটাতো। সে দেখতে সুন্দরী, উচ্চবিত্ত পরিবারের মেধাবী মেয়ে। সেই থেকে আমার মাঝে অনিশ্চয়তা কাজ করতে থাকে। নিজেকে অযোগ্য ভেবে আহসানের থেকে অভিমানে সরে যেতে চেষ্টা করি। আহসান আমার অবহেলা সহ্য করতে পারল না। সে যে আমার প্রতি লয়াল তা প্রমাণ করতে হুট করেই দুজনে সিদ্ধান্ত নিলাম গোপনে সম্পর্কের স্বীকৃতি দেব। যেন দূরে গেলেও একজন আরেকজনের থাকি। প্রসঙ্গত আমার বয়স তখন ষোলো এবং আহসানের ঊনিশ। আহসানের ফ্লাইটের সাত দিন আগে আমরা লুকিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলাম। বিয়ের ব্যবস্থা আহসানই করেছিল। আমি তখন আতঙ্ক ও উত্তেজনার ঘোরের মাঝে ছিলাম। বিয়েটা কীভাবে হয়েছিল কিংবা আদৌ হয়েছিল কিনা ঠিক মনে করতে পারি না। শুধু মনে আছে আহসান যখন বলল ‘আমাদের কেউ আলাদা করতে পারবে না’ তখনই বাড়ি থেকে ফোন আসে। আর আহসান আমাকে একা ফেলে চলে যায়। এরপর ওর সঙ্গে আমার আর দেখা হয়নি, কথাও না। সেদিন লুকিয়ে বাড়ি থেকে বের হবার ঘটনাও কেউ জানত না। তবে সেই ঘটনার প্রভাব আমার ওপর কতটা পড়েছিল তা যদি এক বাক্যে বলি, আমি এসএসসিতে ভয়ানকভাবে খারাপ ফলাফল করেছিলাম। আমার বান্ধবীরা যখন গোল্ডেন নিয়ে লাফালাফি করছে তখন আমি ঘরের কোণে মুখ লুকিয়ে কেঁদেছি। বাবা-মায়ের বকা শুনেছি। সেই ধাক্কার পর থেকেই নিজেকে পরিবর্তনের তাগিদ অনুভব করি। আবেগের পায়ে বেড়ি পরিয়ে দেই। তারপর…
তারপর পেরিয়ে গেল পাঁচটি বছর। কলেজ জীবন পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষপ্রান্তে পৌঁছে গেছি। জীবন নিয়ে অনেক বেশিই সিরিয়াস, আত্মবিশ্বাসী, যোগ্যতাসম্পন্ন একজন নারী। রূপের দিক থেকেও নেহাৎ তুচ্ছ কেউ নই। স্বপ্ন জয়ের পথে এগিয়ে চলেছি দুর্বার গতিতে। আমার জীবনের কোথাও যখন অতীতেত বিন্দুমাত্র ছায়া নেই, ঠিক তখনই পুনরায় একটা ঝড় উঠল। ঝড়টা উঠল আমার মাঝে। বহুদিন বাদে আবারো সেই নাম আমায় ধাক্কা দিলো। ‘আহসান মুকিত!’
‘আর পাঁচটা দিনের মতো ভার্সিটি থেকে ফিরে দেখতে পেলাম তরী আপু ভীষণ যত্ন নিয়ে সাজছে। তরী আপুর সাজ দেখে অবাক হওয়ার কিছুই নেই। আমার আপুটা ভীষণ সুন্দরী। নিজেকে সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখতে পছন্দ করে। তাই প্রথমে সেভাবে পাত্তা দেইনি। কিন্তু রান্নাঘর থেকে খাবারের সুঘ্রাণ পেয়ে কৌতুহলে প্রশ্ন করলাম,
“আজ বিশেষ কিছু আছে নাকি?”
মা তখন ব্যস্ত সুরে বলল, ” তরীকে দেখতে আসবে। সকালে তোর ফুপু হঠাৎ ফোন দিয়ে জানালো। অল্প সময়ে যা পারছি তাই ব্যবস্থা করছি।”
“কোত্থেকে আসবে? ছেলে কি করে?”
“তোর ফুপুর ঘরের মানুষ। আহসানকে মনে আছে? সে এবার দেশে এসেছে বিয়ে করতে। তার জন্যই তরীকে চেয়েছে ওরা।”
জবাবে আমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আহসান মুকিত, এতকিছুর পরে কোন মুখে আমার বোনের দিকে নজর গেল তোমার!
চলবে…