মৌরিফুল পর্ব-০২

0
14

#মৌরিফুল [২]
প্রভা আফরিন

তরী আপু আমার চেয়ে দুই বছরের বড়। আমাদের স্বভাবের মিল খুব সামান্যই। তরী আপু চঞ্চল, আমি চঞ্চল না হলেও একেবারে ধীরস্থির নই। যাকে বলে প্রয়োজন বুঝে ব্যবহার করা। তরী আপু দেখতে অতিশয় সুন্দরী, মেধাবী, আধুনিকা। মাস্টার্স শেষ করে সরকারি চাকরির চেষ্টা করছে। আপুকে নিয়ে বাবা-মায়ের অনেক বেশি আকাঙ্ক্ষা। আমি গড়পড়তা সাদামাটা মেয়ে। আমাকে নিয়ে খুব বেশি আকাঙ্ক্ষা বাবা-মায়ের মাঝে দেখা যায় না। এসএসসিতে ভয়ানক বাজে ফলাফল করে আমি তাদের সকল আশাকে অঙ্কুরেই নৈরাশ্যে রূপান্তর করেছিলাম। এরপর যতই ভালো করার চেষ্টা করেছি, আমার চেষ্টাটা আপুকে ছাপিয়ে কারো নজর কাড়তে পারেনি। বিয়ের ক্ষেত্রে তরী আপুর চাহিদার লিস্ট ছিল রেলগাড়ির মতো। ফলে এর আগে বহু সম্বন্ধ আসলেও কোনোটাতেই তার মন বসেনি। এবার চিত্র ভিন্ন। আপুর হটপিংক লিপস্টিক মাখা ঠোঁটের হাসিটাই বলে দিচ্ছে পাত্রকে নিয়ে তার বেজায় আগ্রহ। কিন্তু আমার মনে যে বেজায় সংশয়। যে পুরুষের যোগ্যতার গুণে সকলে ধন্যি ধন্যি করছে তার মেরুদণ্ডহীন রূপটা তো অল্প বয়সেই দেখা হয়ে গেছে আমার। আমারই বোনের সঙ্গে তাকে আমি কীভাবে মেনে নেই?

তবুও বিবেকের তীব্র উপস্থিতির এক ফাঁকে যতক্ষণ পর্যন্ত সামান্য পরিমাণে আবেগ তাজা ছিল ততক্ষণ ভাবতাম, অল্পবয়সের খামখেয়ালিপনায় দুজনেই ভুল করেছি। আহসান হয়তো পর পর ঘটনার আকস্মিকতায় ভয় পেয়ে গেছিল। কিংবা বিয়ে করার সিদ্ধান্তটাই হঠকারিতার ছিল। পরবর্তীতে যখন ভয় কেটে যাবে অন্তত আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবে। ভুল শুধরে একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কের ইতি টানা কিংবা ভালোবাসার প্রতিশ্রুতি বজায় রাখা কিছু তো একটা করবেই। কিন্তু দিনের পর দিন কেটে গেল। বাস্তবের তীব্র পেষণে আমার মূর্খ আবেগটা মিলিয়ে গেল যেন।

আর আজ সেই আহসান কিনা চূড়ান্ত নির্লজ্জের মতো আমারই বড় বোনকে দেখতে আসে! একবার ভাবলাম আপুকে সব বলে দেই। কিন্তু আপু যদি বিশ্বাস না করে! প্রমাণ যে নেই। তাছাড়া আহসানও যে ঘটনা অস্বীকার করবে না তার কি নিশ্চয়তা! নিজেকে হেয় করার সাধ জাগল না মনে। কিন্তু এই বিয়ে হতে দেব না আমি। আহসানের মুখোমুখি হওয়ার প্রয়োজন অনুভব করলাম। দাঁতে দাঁত চিপে অপেক্ষায় থাকলাম আহসানের দেখা পেতে।

বিকেল চারটে বাজে তখন। আমি সদ্য গোসল করে মাথায় গামছা প্যাচিয়ে নিচতলায় হাঁটাহাঁটি করছি৷ মা বলেছে বসার ঘরটা পরিপাটি করে রাখতে। আমি নামমাত্র গোছানোর ভান করছিলাম। তখনই কলিংবেল বাজল। দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলতেই দেখলাম ফুপিরা এসে হাজির। এসেছে সব মেয়েমহল। আমাকে নিরাশ করে স্বয়ং পাত্রই অনুপস্থিত। ফুপি আমাকে জড়িয়ে ধরে আপ্লুত সুরে বলল,

“তোকে কতদিন বাদে দেখলাম রে, মৌরি! ছোটোবেলায় ফুপির বাড়ি ছাড়া কিছুই বুঝতি না। আর এখন তোর দেখাই পাওয়া যায় না? টুবাই কত কান্নাকাটি করে তোর জন্য। তাও যাস না। কীসের এত ব্যস্ততা তোর?”

আমি টুবাইকে আদর করার বাহানায় কথা এড়াবার চেষ্টা করলাম। তাতে পাত্তা না দিয়ে ফুপিই আবার বলল, “ফুপির প্রতি মায়া কম তাই যাস না। বোনের শ্বশুর বাড়ি হলে ঠিকই যাবি।”

“বিয়ে কী ঠিক করে ফেলেছ নাকি?” জিজ্ঞেস করলাম আমি।

ফুপি বলল, “দুই পক্ষে অপছন্দের কিছু আছে নাকি? পাত্র-পাত্রী দুটিকেই আমি চিনি। সুতরাং বিয়ে হবে নিশ্চিত থাক।”

“কিন্তু আমি তো শুনেছিলাম আহসান ভাইয়ার কাজিন রোজার সঙ্গে বিয়ে-টিয়ে হবে। হলো না কেন?”

প্রশ্ন করার সঙ্গে সঙ্গে খেয়াল করলাম আহসানের মায়ের মুখটা কালো হয়ে গেছে। তিনি এসে থেকেই আমাকে অদ্ভুত চোখে দেখছেন খেয়াল করেছি। ফুপিও দেখলাম কৌশলে প্রসঙ্গ এড়ালেন,
“ওসব ছোটোবেলায় বাবা-মায়েরা অনেক কিছুই ঠিক করে। সন্তান বড় হতে হতে পরিস্থিতিও বদলে যায়।”

কিন্তু আমি যে তাতে দমে যাওয়ার পাত্রী নই৷ আমার আপুর জীবন এখানে জড়িয়ে যাচ্ছে। তাও এমন ব্যক্তির সঙ্গে যার সাথে আমি অতীতে জড়িয়ে গেছি। আমি জানি না অতীতে আমাদের বিয়েটা আদৌ সঠিক পন্থায় হয়েছিল কিনা। যদি না-ও হয়ে থাকে এমন এক চিটারের সঙ্গে আপুর বিয়ে আমি কিছুতেই হতে দেব না। কিন্তু নাটের গুরু কই! জিজ্ঞেস করলাম, “তা আমার হবু দুলাভাই কোথায়?”

“আহসান সবে দেশে এসেছে তো। অফিশিয়াল কাজে একটু ব্যস্ত আছে। বিয়ের যাবতীয় সিদ্ধান্ত আমাদের ওপর ছেড়ে দিয়েছে।”

উত্তর আমার পছন্দ হলো না। আমার পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে কেউ বসেও রইল না। এক আসরেই পাত্রী দেখা থেকে শুরু করে বিয়ের কথাও ফাইনাল হয়ে গেল। ফুপিই ঘোষণা দিলেন সামনের শুক্রবার পারিবারিকভাবে তরী আপুর সাথে আহসানের আকদ হবে। বিয়ের আয়োজন হবে পরে। আহসানেরও নাকি এমনটাই মতামত। এত তাড়াহুড়ার কী আছে বুঝলাম না। আমার মা, বাবা, বোনকেও দেখা গেল সিদ্ধান্ত মেনে নিতে। অসহায়তায় চোখে পানি চলে এলো আমার। ঠিক করলাম নিজেই যাব আহসানের কাছে৷ কিন্তু যাব বললেই যাওয়া হলো না। আহসান আমার ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেল। আপুকে মাঝে মাঝেই দেখি কার সঙ্গে যেন ফিসফিস করে কথা বলে। অনেক রাত অবধি কথার আওয়াজ পাওয়া যায়৷ সকালে জিজ্ঞেস করতেই লাজুক হেসে বলল আহসানের সঙ্গে কথা বলে। শুনেই পায়ের র’ক্ত মাথায় উঠল। আহসানের মনে অতীত নিয়ে সামান্যতম অনুশোচনা বা আক্ষেপ নেই? কী করে আমার সঙ্গে মীমাংসায় না গিয়ে সে আপুর সঙ্গে রাত-ভর প্রেম করে বেড়ায়! এর মানে আমাকে পাত্তা দেওয়ার প্রয়োজনই নেই? এতটা বেপরোয়া হয়েছে আহসান! ওর প্রতারণার মাত্রা দেখে অসুস্থ বোধ করতে লাগলাম।

আপু ঘাবড়ে গিয়ে আমাকে ধরে ফেলল। চিন্তিত গলায় বলল, “এই মৌরি, তোর কী হয়েছে?”

“কিছু না আপু, সামান্য প্রেশার ফল করেছে।”

“এই বয়সে এমন প্রেশার ফল করবে কেন? ঘরে গিয়ে শুয়ে থাক।”

আপু চলে যাচ্ছিল। আমি ডেকে বললাম, “আপু, আহসান ভাইয়ার নম্বরটা আমায় দেওয়া যাবে?”

আপু ভ্রু কুচকে বলল, “তুই ওর নম্বর দিয়ে কী করবি?”

“এমনি হবু দুলাভাইয়ের সঙ্গে পরিচিত হবো। অনেক বছর হলো কথা হয় না তো, তাই।”

“ও ব্যস্ত মানুষ। ফোনে কথা বলার প্রয়োজন নেই। সামনাসামনি দেখা করিস।” আপু যেন এক প্রকার এড়িয়েই গেল বিষয়টা।

দেখতে দেখতে গায়ে হলুদের রাত চলে এলো। আহসানের ধারেকাছেও পৌঁছাতে পারলাম না আমি। কারো মাধ্যমেও যোগাযোগ সম্ভব হলো না। ধৈর্য্যের বাধ ভেঙে শেষমেষ আপুকেই সবটা খুলে বললাম।

ছোটোবেলা থেকে আপু আর আমার মাঝে হিংসাসুলভ সম্পর্ক থাকলেও বড় হওয়ার পর সেটা কমে গেছিল। কেননা ছোটোবেলায় আমি সবকিছুতে আপুকে সমানে সমানে টক্কর দিতাম। পাঁচ বছর আগে থেকে টক্কর দেওয়া ছেড়ে দিয়েছি। আপুই সবকিছুতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয় বলে আমাকে আর হিংসে করে না। তাই ভেবেছিলাম আপু অন্তত আমায় বিশ্বাস করবে। কিন্তু প্রতিক্রিয়া হলো বিপরীত। আপু তীব্র ক্ষোভে বলেই বসল,

“আমার এত ভালো একটা বর জুটছে সেটা তোর সহ্য হচ্ছে না তাই না? ছোটোবেলার মতো হিংসে করে কেড়ে নিতে চাইছিস? আবার মিথ্যা বিয়ের গল্পও ফাঁদছিস? তোর পেটে এত শয়তানি?”

“বিশ্বাস করো আপু, আহসান একটা প্রতারক, মেরুদন্ডহীন পুরুষ। আমি ওকে আমার জীবনে চাই না। ওর দ্বারা তোমার জীবন নষ্ট হোক সেটাও চাইছি না…”

“আমি তোর আর একটা কথাও শুনতে ইচ্ছুক নই। এক্ষুনি আমার ঘর থেকে বেরিয়ে যা নয়তো সবাইকে ডেকে ডেকে তোর কেচ্ছা শোনাব।”

কোনোদিকেই সুবিধা করতে না পেরে আমি হাল ছেড়ে দিলাম। পরদিন দুপুরে যথারীতি ফুপির বাড়ির সদস্যরা কাজি নিয়ে আমাদের বাড়িতে এলো। সাথে এলো সেই সুদর্শন প্রতারক, যাকে দেখে আমার শরীরের প্রতিটি লোমকূপ কাঁপছিল। কাল রাতেই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে ফেলেছি, আজ হাটে হাড়ি ভাঙব। দুই পরিবারের সামনে আহসানের মুখোশ টেনে ছিড়ব। এতে আমার সম্মান যায় যাক৷ তবুও ওকে ছাড়ব না। কিন্তু পরিস্থিতি বদলে গেল মুহূর্তেই। হঠাৎই সারা বাড়িতে খবর ছড়িয়ে পড়ল তরী আপু পালিয়ে গেছে।

চলবে…