মৌরিফুল পর্ব-০৩

0
16

#মৌরিফুল [৩]
প্রভা আফরিন

পার্লারে বউ সাজতে গিয়ে আপু আর ফেরেনি। সকলের মুখে মুখে বাতাসের বেগে প্রবাহিত হলো আপু পালিয়েছে। কিন্তু আমি এ বিষয়টি কিছুতেই হজম করতে পারছি না। কার সঙ্গে পালাবে? কেন-ই বা পালাবে? আহসান তো আপুর পছন্দের মানুষ। সমীকরণ মিলছে না। তবে আপু যে আমার ভাগের সুখটুকু নিয়ে পালিয়েছে তা নিয়ে কোনো সন্দেহ রইল না। কেননা পাত্রীর খোঁজে যখন সকলেই দিশেহারা তখন স্বয়ং পাত্র মহাশয় সকলের খোঁজাখুঁজি স্থগিত করার নির্দেশ দিলো। সঙ্গে আরো বলল,

“বিয়ে না করে এই আসর থেকে উঠব না আমি।”

আমি অবাক হয়ে সরাসরি তার চোখের দিকে তাকাতেই দেখলাম এতসব চিন্তিত মুখের মাঝে আহসান চিন্তাহীন মুখে বসে আছে। ফুপি বললেন, “পাত্রী না পেলে বিয়ে করবি কীভাবে?”

আহসানের মা গর্জে উঠে বললেন, “ওই মেয়েকে আমি আর ছেলের বউ করব না।”

এমন সময় সুর বদলালেন আমার ফুপা। আমার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে চেয়ে বললেন, “দেশে কি মেয়ের অভাব যে তরীর জন্য আমাদের ছেলে বসে থাকবে? পাত্রী তো চোখের সামনেই আছে।”

সেই ইঙ্গিত বুঝতে উপস্থিত কারোই অসুবিধা হয়নি। বর বিয়ে করতে এসে অপমানিত হয়ে ফিরে যাবে তা বরপক্ষের সহ্য হবে না। তারচেয়ে এক মেয়ের বিয়ের সভায় আরেক মেয়ের বলিদান হওয়াটাকে তারা সহজতর পন্থা মনে করে। সেখানে মেয়েটির অপমান কতটুকু তা নিয়ে ভাবার অবকাশ ওদের নেই। এক মেয়ের অপমানের শোধ আরেক মেয়েকে দিয়ে পূরণ করবে তারা। অতঃপর বড় বোনের জায়গায় ধরেবেধে কবুল বলানো হলো ছোটো বোনকে। আমি সেদিন খুব কাঁদলাম। বিয়ে না করার বাহানায় সকলের সঙ্গে বেয়াদবি করলাম। কিন্তু আমার জেদকে কেউ আমলে নিল না। উলটে বুঝ দেওয়া হলো,

“হুট করে বিয়ে! যেহেতু মানিয়ে নিতে সময় লাগবে, মৌরি নাহয় বাপের বাড়িতেই থাকবে আপাতত।”

আমার সেই মুহূর্তে সবাইকে চোখের বিষ মনে হলো। কারো কথাই সহ্য হচ্ছিল না। এক প্রতারককে বিয়ে করার বেদনায় নিজেকে চূড়ান্ত ব্যর্থ মানুষ মনে হচ্ছিল। তারচেয়ে আপুই ভালো কাজ করেছে। পালিয়ে বেঁচেছে।

ফুপিরা চেয়েছিল আমাকে আজ সঙ্গে নিয়ে যাবে। কিন্তু বিয়ের কার্যাদি শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে আমি ঘরে এসে দরজায় খিল দিয়েছিলাম। অগত্যা আমাকে ছাড়াই বরযাত্রী ফিরে গেছে। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী বাসররাত যাপনের জন্য আহসান আমাদের বাড়িতে থেকে গেছে। ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে দেওয়ায় বাবা-মা কেউই আমাকে কিছু বলতে পারছেন না। অবশ্য এখানে বাবা-মায়ের কিছু করারও ছিল না। আমার সব আত্মীয় মানসম্মানের ভয় দেখিয়ে তাদের কাবু করে ফেলেছিল। বুঝিয়েছিল এখন আহসানের মতো ভালো পাত্র হাতছাড়া করলে পরে আমার বিয়ে দিতে বাবা-মাকে বেগ পেতে হবে। বড় বোন পালিয়ে গেছে এটার দুর্নাম আমার জীবনটাকেও ভোগাবে। সবদিক থেকে দিশেহারা বাবা-মা তাই অসহায়ের মতো ওদের কথা মেনে নিয়েছে।

বাড়ি ফাঁকা হয়ে যাবার পর মা বেশ কয়েকবার এসে দরজা ধাক্কাল। যা কিছু ঘটে গেল তা নিয়ে আমাকে বুঝ দিতে চাইছিল বেশ বুঝতে পারলাম। তবুও দরজা খুললাম না। একা একা মাঝরাত অবধি কান্নাকাটি করলাম। এরপর সিদ্ধান্ত নিলাম জীবনটা নষ্ট হতে দেব না। বিয়ে হয়েছে মানে আর কোনো গতি নেই এমনটা ভাবছি কেন? সঙ্গে সঙ্গে মনের দুর্বলতা কেটে গেল। দরজা খুলে বাইরে আসতেই দেখলাম আহসান আমার দরজার দিকে চেয়ে স্থির হয়ে বসে আছে। যেন আমারই অপেক্ষায় আছে সে।

বসার ঘরে আহসান একা। বাবা-মা আশেপাশে নেই। আমি দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে আহসানের মুখোমুখি হলাম। পাতলা দাড়ি-গোঁফ গজানো সেই কিশোর আহসান এখন ক্লিন শেভ করা সুদর্শন পুরুষ। আগে তার চোখে যে নিষ্পাপ চাহনি দেখতে পেতাম এখন আর সেটা নেই। দুর্বোধ্য দৃষ্টি। অবশ্য হবেই তো। যার মনে মনে শয়তানি তার চোখের ভাষা নিষ্পাপ হবে আশা করাও বোকামি। আমি আগে-পিছে বাক্যব্যয় না করে সরাসরি বললাম,

“দেখুন, যা কিছু হয়ে গেছে তার একটা সুস্থ সমাধানে আসতে চাই আমি। এভাবে আসলে হয় না।”

আহসান আমার কথার পিঠে জবাব দিলো, “এভাবে হয় না বলেই তো সঠিক পন্থায় সমাধান করে ফেললাম।”

“তার মানে?”

“মানে আরো পাঁচটি বছর আগে যে গোপনে আমার বউ হয়েছিল, আজ তাকে সামাজিকভাবে বউয়ের স্বীকৃতি দিলাম।”

আমি হতবুদ্ধি হলাম ক্ষণিকের জন্য। হায়! এই কথায় হয়তো আমি সুখের সাগরে ভাসতাম, যদি সে প্রতারক না হতো, যদি আজকের বরযাত্রী আমার জন্যই আসতো, যদি আহসানের সঙ্গে সেই পুরোনো সুতোটা আজও রঙিনভাবে জুড়ে থাকতো। তার কিছুই হয়নি। ফলে কথাটা আমার কাছে প্রহসন বৈ আর কিছুই মনে হলো না। তার চরম নির্লজ্জতায় অন্তরের তিক্ততা আরো খানিকটা বাড়ল। ব্যঙ্গ করে বললাম,

“যাক, আপনার তাহলে মনে আছে সেই বিয়ের কথা! আমি তো ভেবেছিলাম আপনার স্মৃতিশক্তি দুর্বল।”

আহসান গম্ভীর গলায় বলল, “দুর্বলতা স্মৃতিশক্তির ছিল না। দুর্বলতা ছিল পরিস্থিতির। যাক, বাইরে দাঁড়িয়ে এসব আলোচনা করা শোভনীয় নয়। ভেতরে চলো, কথা আছে।”

আহসানের স্বাভাবিকতা আমার গায়ে আগুন ধরালো। চিবিয়ে চিবিয়ে বললাম, “কেন? বাসর করার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে?”

“সে তো অবশ্যই যাচ্ছে। তবে তুমি ভয় পেয়ো না। পাঁচ বছর ধরে যেহেতু ধৈর্য ধরতে পেরেছি, আরেকটু সময়ও পারব।”

বলেই আহসান ঠোঁট টিপে হাসল। ওর কথাগুলো আমার কাছে স্বস্তা রসিকতা মনে হলো। আহসান আমার জবাবের অপেক্ষা না করে ঘরে ঢুকে গেল। আমিও পিছু পিছু এসে বললাম, “গিরগিটিও আপনাকে দেখে লজ্জা পাবে। এতদিন ধরে রাত-দিন আমার বোনের সঙ্গে প্রেম করে এখন আবার আমার সঙ্গে চেষ্টা করছেন?”

আহসান খাটে হাত ছড়িয়ে বসল। চোখে চোখ রেখে বলল, “ওর সঙ্গে যদি প্রেমই করতাম তবে তোমায় বিয়ে করতে এত নাটক করতাম?”

আমি ভ্রু কুচকে ফেললাম, “নাটক! আবার কীসের গল্প ফাঁদছেন?”

আহসান উঠে এসে মুখোমুখি দাঁড়াল। আমার একটা হাত ধরে বলল, “নাটক করার মানুষ আমি নই, মৌরি।”

হাত সরিয়ে ধমকে উঠলাম আমি, “আরে চিনি চিনি। কে কতটা নাটক করতে পারে সব চেনা হয়ে গেছে আমার।”

“তুমি কিচ্ছু চেনো না, জানো না, মৌরি। তোমাকে বোঝাতে পারব না বলেই আগে দেখা করার রিস্ক নিতে চাইনি।”

“ও আচ্ছা! তাই বুঝি আমাকে পাওয়ার শখে আমার বোনকে বিয়ে করতে গেছিলেন? ভেবেছিলেন বড় মেয়েটাকে পেলে ছোটোটাকে ফ্রিতে মিলবে?”

আমার উত্তেজিত স্বরের বিপরীতে আহসান শান্ত গলায় বলল, “আমি তরীর জন্য প্রস্তাব পাঠাইনি। দেশে ফেরার আগেই তোমার কথা বলে রেখেছিলাম। কিন্তু আমার পরিবার ব্যাপারটা গোলমাল করে ফেলেছে। তোমার জায়গায় তরীকে ভেবে নিয়েছে। অবশ্য এখানে দোষটা আমার পরিবারেরও না। তাদের ভুলটা বোঝানো হয়েছে।”

আমি কিছুতেই আহসানের কথা মানতে চাইলাম না। একের পর এক প্রশ্ন ছুড়তে লাগলাম, “এখন এটা নিশ্চয়ই বলবেন না যে বিয়ের একদিন আগেও জানতে পারেননি পাত্রীটা তরী আপু। তখন কেন প্রতিবাদ করেননি। আর ধরে নিলাম জানতেনই না। তবুও আপনি ভাবলেন কি করে পাঁচ বছর পর এসে উদয় হলেই আমি আপনাকে মেনে নেব?”

আহসান গভীর চোখে চেয়ে বলল, “তার জন্য তোমাকে শুরু থেকেই সবটা জানতে হবে। শুনবে?”

এরপর আমার সামনে উন্মোচিত হলো এক অজানা গল্প। যা আমার কল্পনারও বাইরে ছিল…

“আমি যেদিন আবেগের বশবর্তী হয়ে তোমায় বিয়ে করতে চাইলাম, সেদিনের মতো ভয় আর কোনোদিন পাইনি। হুট করে সিদ্ধান্তটা নিয়েই মনে হয়েছিল কাজটা ঠিক হচ্ছে না। আমাদের বয়সটাও পরিণত না। আর না তোমাকে আগলে রাখার যোগ্যতাটুকু হয়েছে। সদ্য এইচএসসি পাশ করে বাইরে পড়তে যাওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া ছেলের বিচক্ষণতা আর কতটুকুই বা মজবুত? একবার ভাবলাম কথা ফিরিয়ে নেই। তারপর আবার তোমাকে হারানোর ভয়, আর তোমার সামনে নিজেকে ভীতু প্রমাণ করতে চাইনি বলে দুঃসাহসটা করেই বসলাম। অল্পবয়সের আবেগ বলো আর ভালোবাসা বলো, আমি সত্যিই তোমায় সারাজীবনের জন্য নিজের করে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমার জন্য আরো বড় একটা ধাক্কা তখন অপেক্ষা করছিল বুঝতে পারিনি। কাজিকে ঘুষ দিয়ে বিয়ে সেরে ফেলার পর পরই জানতে পারলাম মা স্ট্রোক করেছে। স্ট্রোক করার কারণ আমার বাবা। অফিসের এক কলিগের সঙ্গে উনার ঘনিষ্ঠতার প্রমাণ এসেছে মায়ের কাছে। যা তিনি সহ্য করতে পারেননি। ছেলে হিসেবে আমিও পারিনি। একদিকে বাবার অধঃপতন অন্যদিকে মায়ের মুমূর্ষু অবস্থা, আমার মাথা কাজ করছিল না। তাই তোমাকে রেখেই হাসপাতালে চলে যাই। বন্ধুকে বলেছিলাম তোমায় বাড়ি পৌঁছে দিতে। কিন্তু তুমি আমায় ভুল বুঝে একাই চলে গেছিলে। মায়ের একমাত্র সন্তান আমি। বাবার প্রতারণার পর আমাকেই অবলম্বন করেছিল মা। তখন যদি তোমার সঙ্গে আমার গোপন বিয়ের খবর প্রকাশ্যে আসত তাহলে হয়তো আরেকটা ধাক্কায় উনাকে আমি বাঁচাতে পারতাম না। তাই ভয়েই কিছুদিন তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করিনি। পাছে মা সন্দেহ করে, পাছে কিছু প্রকাশ পেয়ে যায়! তাছাড়া তখন মাকে নিয়ে ছোটাছুটি ও বাবার সঙ্গে সমঝোতায় আমার মানসিক পরিস্থিতিও ছিল না তোমার সঙ্গে দুটো কথা বলে নিজের মনের অবস্থা জানাই। আমার সেটুকু বোধও ছিল না। তারওপর এক সপ্তাহ বাদে আমার ফ্লাইট। সবদিক থেকে কোনঠাসা হয়ে পড়েছিলাম। বাবার গোপন অন্যায়টি আমি আর মা গোপনই রেখেছিলাম। এমনকি একই বাড়িতে থাকা বাকি সদস্যরাও বুঝতে পারেনি। ভেবেছে আমি চলে যাব বলে মা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে। বাবা আমাদের কাছে ক্ষমা চেয়েছিল। নিজেকে শুধরেও নিয়েছিল। তবে আগের সেই সম্মানটা আর ফেরত দিতে পারিনি। বিদেশের মাটিতে পা রেখেই আমি একটু স্বস্তি পেয়েছিলাম। অবকাশ পেয়েছিলাম তোমায় নিয়ে ভাবার। তোমার কাছে ফোন ছিল না, ছিল না সোশ্যাল একাউন্ট। কাকিকে ফোন দিয়ে মাঝে মাঝে ইনিয়েবিনিয়ে তোমার কথা জানতে চাইতাম। কাকি বলত তুমি নাকি অনেকটা বদলে গেছো। বদলটা কেমন তা বলতো না। এরপর বহু প্রচেষ্টার পর তোমার বড় বোন অর্থাৎ তরীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারলাম। সোশ্যাল মিডিয়ায় আমাদের প্রায়ই কথা হতো। আমি তরীকে জানিয়েছিলাম তোমায় ভালোবাসি। তুমিও আমায় বাসো৷ কিন্তু তরী সেটা ভালোভাবে নেয়নি। তোমার সঙ্গে কথা বলার জন্য অনেক রিকুয়েস্ট করতাম। তরী শুরুতে শুরুতে বলতো তুমি ব্যস্ত, তুমি ঘুমিয়েছো। এরপর থেকে বলতে লাগল তুমি নাকি আমার সঙ্গে কথা বলতে চাও না। আমাকে ভুলে যেতে চাও। আমি নাকি তোমার করা আবেগের ভুল। এমনকি একটি ছেলের সঙ্গে তোমার ছবি দেখিয়ে বলেছিল তুমি মুভ-অন করেছো। ছেলেটি তোমার সহপাঠী বন্ধু ছিল। আমি শুরুতে বিশ্বাস করতে চাইতাম না। কিন্তু অন্য ছেলের সঙ্গে দেখলে মাথা ঠিক থাকতো না। রেগেমেগে আর তোমার খোঁজ নিতাম না। নিজেকে বোঝাতাম ওটা আমারও আবেগের ভুল ছিল। সময় যেতে লাগল, কিন্তু তোমাকে আমি ভুলতে পারতাম না। দূর দেশে একাকী তোমায় ভাবতে ভাবতে দিন দিন যেন অনুভূতি আরো তীব্রতর হয়। তরী কিন্তু আমাকে নিয়মিত ম্যাসেজ করত। আমার প্রতি ওর আকর্ষণ ছিল সেটা বেশ বুঝতে পারতাম। পাত্তা দিতাম না। আমার আগ্রহ ছিল তুমি কি করছো না করছো সেসবের প্রতি। একসময় সত্যিই আবিষ্কার করলাম আমার প্রতি তোমার কোনো আগ্রহ নেই। খুব জেদ হতো তখন। দূর দেশে আমি একা পড়ে পড়ে তোমার জন্য তরপাচ্ছি আর তুমি আমায় ভুলে বিন্দাস উড়ছো। এদিকে আমার মা কাজিন রোজার সঙ্গে আমার একটা স্থায়ী সম্পর্ক তৈরির প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছিল। তোমার প্রতি জেদ ধরে সেটাতে রাজিও হলাম। শেষে দেখা গেল রোজা তার ব্রিটিশ বয়ফ্রেন্ডের সাথে লিভ-ইন রিলেশনশিপে আছে। আমাদের সংস্কারবদ্ধ মন পাশ্চাত্যের এই সংস্কৃতিকে গ্রহণ করতে ব্যর্থ। সুতরাং পাত্রী বাতিল। আবারো আমার মন মস্তিষ্কে তুমিই গেঁথে রইলে। কিন্তু সেটা জেদ হয়ে। তোমায় আমি স্টক করতাম নিয়মিত। জেদটা বাড়তো বৈ কমতো না। কী করে আমায় ভুলে যেতে পারলে তুমি? মা বিয়ের জন্য এবার জোরাজুরি শুরু করলে আমি নিজের ইগোটা সাইডে রেখে তোমার সম্পর্কে আরেকটু স্টাডি করলাম। জানতে পারলাম তুমি কোনো রিলেশনশিপে নেই৷ নিজেকে বোঝালাম আমায় হয়তো ভুলে গেছো, কিন্তু অন্যের তো হওনি। আমিই নাহয় দেখি শেষ চেষ্টা করে। তখনই তোমার ফুপি অর্থাৎ আমার কাকিকে জানালাম তার ভাইয়ের ছোটো মেয়েকে বিয়ে করব। কিন্তু এখানে কাকিকে ভুল বোঝাল তরী। কাকি যখন বলল ভাইয়ের মেয়ে বউ করবে তখন তরীই নাকি আগ বাড়িয়ে বলেছে তার সঙ্গে আমার পাঁচ বছর ধরে নিয়মিত যোগাযোগ। আমি ওর খোঁজখবর নেই। মৌরির সম্বন্ধে নাকি আগ্রহই নেই আমার। তখন কাকি ধরে নিল তরীকেই আমি চেয়েছি, হয়তো বলতে বা শুনতে ভুল হয়েছে।

বিয়েটা অল্প সময়ে সারতে চেয়েছিলাম এবং তোমার সঙ্গে আগেভাগে দেখা করতে চাইনি কারণ আমার ইচ্ছে ছিল সামাজিক স্বীকৃতি দেওয়ার পরই তোমার কাছে অতীত নিয়ে কৈফিয়ত চাইব বা নিজের দিক থেকেও দেব। যেন তুমি খোঁটা দিয়ে আগের সম্পর্কটা অস্বীকার করতে না পারো। এদিকে আমার অনুপস্থিতিতে বিয়ে ঠিক হয়ে গেল তরীর সঙ্গে। সেদিনই আমি জানতে পারি সবটা। প্রথমে তরীকেই ফোন করেছিলাম এই কাজটা কেন করল জানতে। তরী ইনিয়েবিনিয়ে বলতে লাগল সে আমায় পছন্দ করে। আর মৌরির চরিত্রে সমস্যা আছে ইত্যাদি। আমার খটকা লাগে তখন। তরী যে চালাকি করেছে সেটা বুঝতে পেরে ওর ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি ওর একাধিক ছেলের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক। আমি প্রমাণ জোগাড় করলাম আগে। সাথে এ-ও শতভাগ নিশ্চিত হলাম অতীতে তোমার সম্বন্ধে তরী আমাকে সব মিথ্যাই বলে গেছে। এখন এক মেয়ের সঙ্গে বিয়ে ভেঙে আরেক মেয়েকে চাওয়াটা দুই পরিবারে জটিলতা সৃষ্টি করবে জেনেই আমি তরীকে বোঝাচ্ছিলাম বিয়েটা ভাঙতে এবং দুজনে একসাথে বসে পরিবারকে বোঝাতে। তরী রাজি হচ্ছিল না। উলটে থ্রেট দিচ্ছিল বিয়ে না করলে আমায় দোষারোপ করে নোট লিখে সু’ইসা’ইড করবে। শেষমেষ কাল রাতে ওকে আমি হু’ম’কি দেই। বলি আজ বিয়ের আসরে যদি ওকে বউ সাজে দেখি তবে সবার সামনে ওর চরিত্রের কদর্যতা ফাঁস করে দেব। তখন বিয়ে তো হবেই না, কাউকে মুখও দেখাতে পারবে না। তরী ভয় পেয়ে রাজি হয়ে যায়। বিনিময়ে মোটা একটা এমাউন্টও দাবী করে। আমি তোমার বাড়িতে আসার আগেই ওকে এমাউন্টটা দিয়ে এসেছি৷ কাকাকে আগেভাগে সব জানিয়েছিলাম যেন তরী পালিয়েছে শুনে উনি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেন। আর আমি জানতাম আজ রাতে এই মুহূর্তটা আমার জীবনে আসবে। সমস্ত ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটবে।”

সবটা শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। তৎক্ষনাৎ কোনো প্রতিক্রিয়া খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আহসান কথা শেষ করে হাঁপিয়ে উঠল। আমার হাতটা পরম আদরে টেনে নিয়ে বলল, “তোমাকে আমি আজও ভালোবাসি, মৌরিফুল।”

তখনই দরজায় সজোরে করাঘাত পড়তে লাগল। ছুটে গিয়ে দরজা খুলতেই মা বললেন পাশের অঞ্চলের ব্রিজের নিচে এক নারীর মৃ’তদেহ পাওয়া গেছে৷ ম’র’দেহের সঙ্গে থাকা ফোন থেকে মাত্রই কল করে সে খবর জানানো হয়েছে। কথাটা বলেই মা তরী আপুর নাম করতে করতে জ্ঞান হারালেন।

চলবে…