#মৌরিফুল [পর্ব-৪]
প্রভা আফরিন
চাঞ্চল্যের ঝড়ো হাওয়ায় বিধ্বস্ত আমরা রাত তিনটায় পৌঁছেছিলাম সেই ব্রিজের কাছে। কিন্তু গিয়ে কাউকে পাইনি। যে লোক ফোন করেছিল তাকে পুনরায় কল করা হলে জানালো পুলিশ এসে লা’শ নিয়ে ম’র্গে গেছে। বাবা-মায়ের শক্তি কিংবা মনোবল ছিল না ছোটাছুটি করার। তাদের বাড়িতে রেখে আমি আর আহসান বেরিয়ে যাই ম’র্গের উদ্দেশ্যে। যাওয়ার পথে বারবার বলছিলাম,
“আমার বোনের কিছু হলে সেই দায় আপনি এড়াতে পারবেন না, আহসান।”
আহসান আমার অভিযোগের বিপরীতে কিছু বলতে পারেনি। আমরা ম’র্গে গেলাম পৌনে চারটার দিকে৷ আহসান কার কার সঙ্গে যেন যোগাযোগ করল। এরপর একজন দায়িত্বরত পুলিশের উপস্থিতিতে আমরা ম’র্গে প্রবেশ করলাম। গা গোলানো গন্ধ ও স্বল্প আলোয় ম’র্গে তিনটে লা’শ দেখতে পেলাম। এক ঘণ্টা আগে আনা লা’শটার সাদা কাপড়টা সরাতেই ভয়ে চিৎকার করে উঠলাম আমি। কি বিভৎস করে মে’রে’ছে! মুখটা পর্যন্ত চেনা যাচ্ছে না। মুখ চেপে বাইরে এসে বমি করে ফেললাম। আহসান আমার মাথা চেপে ধরেছিল তখন। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ এনে দায়িত্বরত পুলিশের এসআইকে জানালাম,
“উনি আমার আপু নন।”
“আর ইউ শিওর?”
“হ্যাঁ। কারণ গতকাল বিয়ে উপলক্ষে আপু দুই হাত ভরে মেহেদি পরেছিল। এই লাশের হাতে কোনো মেহেদি নেই।”
আমার কথায় আহসানও যেন অভিযোগের দায় থেকে সাময়িক মুক্তি পেয়ে হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিল। এসআইকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“উনি কীভাবে মা’রা গেছেন কিছু জানা গেছে?”
এসআই বললেন, “অবস্থা তো দেখলেনই। মুখটাকে এসিডে ঝ’ল’সে দেওয়া হয়েছে। বাকিটা ময়নাতদন্তের পর জানা যাবে।”
আহসান জোর দিয়ে বলল, “আপনারা এই বেওয়ারিশ লা’শটার ব্যাপারে তদন্ত করুন। লাশের সঙ্গে যেহেতু তরীর ফোন পাওয়া গেছে, তারমানে মেয়েটির সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে তরীর যোগসূত্র আছে।”
আহসানের কথায় আমি চমকে উঠলাম৷ সবকিছু ধাঁধা লাগছিল। আহসান আমার হাতটা ধরে বলল, “তরীর খোঁজ বের করা যাবে। এখন বাড়ি গিয়ে বাবা-মাকে খবরটা জানাতে হবে। উনারা হয়তো অতিরিক্ত চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।”
তরী আপুর লাপাত্তা হওয়ায় পৃথিবীর কোথাও কিছু থেমে থাকেনি। সব রোজকার নিয়মে চলছে। শুধু থমকে গেছে বাবা-মায়ের হাসি এবং আমার আর আহসানের সম্পর্কটা। আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আহসান সকালেই নিজের বাড়ি চলে গেছিল। এরপর প্রতিদিনই একবার করে আসে। আমাদের খোঁজ নেয়, বাবা-মাকে আশ্বাস দিয়ে বলে তরীর খবর জোগাড় করে আনবে। কিন্তু রাতে এখানে থাকে না। আমিও থাকতে বলি না। ফুপি বারবার আমাকে শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার জন্য বললেও আহসান এ নিয়ে কিছু বলে না। বাবা-মা আমার ওপর মহা বিরক্ত, কিন্তু জোর করে বিয়ে দিয়েছেন মনে করে কিছুই বলতে পারেন না। আহসান যে প্রতিদিন এসে শুধু খোঁজখবর নিয়ে চলে যায় তা নয়। আজ বিকেলের কথাই বলা যাক। দুপুরে খেয়ে-দেয়ে ভাতঘুম দিয়েছি। ঘুম ভাঙতেই দেখি আহসান আমার পায়ের কাছে বসা। ওর একটা হাত আমার পায়ের আঙুল ধরে আস্তে আস্তে টানছে। আমি ঘুম ভেঙে লাফিয়ে উঠতেই সে হেসে বলল,
“পাঁচ বছরে তোমার ঘুমের ধরন একটুও বদলায়নি দেখছি। এখনো হা করে ঘুমাও!”
লজ্জা পেলাম কিছুটা তেঁতে উঠে বললাম, “কারো ঘরে ঢুকতে নক করতে হয় জানেন না?”
“যে কেউ আর বউ তো এক না। তোমার হাত-পায়ের গড়ন কিন্তু একই আছে। চিকন ও লম্বা আঙুল। উজ্জ্বল ত্বকে বড় বড় পশমগুলো আরো সুন্দর দেখাচ্ছে।”
আমি তড়িঘড়ি হাঁটুর কাছে উঠে আসা পায়জামাটা নামিয়ে নিলাম। এই লোক কি আমার ঘুমের সুযোগে এভাবে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখেছে! আড়ষ্টতায় জড়িয়ে গেল সত্তা। গম্ভীর গলায় বললাম,
“নজর হেফাজত করুন।”
“করব, অন্য মেয়েদের বেলায়।”
উত্তর দিয়ে আহসান উঠে দাঁড়াল। আমাকে তাড়া দিয়ে বলল, “হাত-মুখ ধুয়ে এসো। চিকেন তন্দুরি ও নানরুটি এনেছি, গরম গরম খেয়ে নাও। এরপর এক জায়গায় নিয়ে যাব।”
“কোথায়?”
“গুরুত্বপূর্ণ। গেলেই জানতে পারবে।”
আহসান আমায় নিয়ে গেল থানায়। এসআই এর থেকে জানতে পারলাম সেই বেওয়ারিশ লা’শের খবর। মেয়েটির নাম চাঁপা। বাড়ি লালমনিরহাট। ঢাকায় থেকে মেয়েটি পড়াশোনা করত। পাশাপাশি পার্ট টাইম জব করে বাড়িতে ভালো এমাউন্টের টাকা পাঠাত। কিন্তু পার্ট টাইম জব করে নিজের খরচ সামলে বাড়িতে এত টাকা কী করে দেয় সেখানেই খটকা লাগে। চাঁপার লা’শ শনাক্ত করেছিল তার ক্লাসমেটরা। ওদের কাছে চাঁপার সম্পর্কে ব্যক্তিগত তথ্য পাওয়া না গেলেও এটুকু জানা যায় চাঁপা একটি কসমেটিকস ব্র্যান্ডের ডিলার হিসেবে কাজ করত। মেয়েদেরকে সেই ব্র্যান্ডের প্রোডাক্ট কেনার জন্য বিভিন্নভাবে আকর্ষণ ও প্রচারণা করত। এছাড়া মেয়েটি কারো সঙ্গে বিশেষ মিশতো না। চাঁপার সহপাঠীদের কাছ থেকে পাওয়া ফোন নম্বরটি নিয়ে অনুসন্ধান চালিয়ে মৃ’ত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগে যে ফোন নম্বরটির সঙ্গে কথোপকথন হয় সেটা শনাক্ত করা হয়। কাকতালীয়ভাবে তরীর ফোন থেকেও সেই নম্বরেই শেষবার যোগাযোগ করা হয়েছে। অর্থাৎ দুটি মেয়ের সঙ্গেই লোকটির যোগসূত্র আছে। অনুসন্ধান করে জানা যায় সেই নম্বরটি কসমেটিকস ব্র্যান্ডের মালিক কায়সারের। মালিকের সঙ্গে চাঁপার বেশ সখ্য ছিল। সখ্যতা এমন পর্যায়েই গেছিল যে প্রায়ই কায়সারের বাগান বাড়িতে দেখা যেত চাঁপাকে। পরবর্তীতে মেয়েটি অন্তঃসত্ত্বা হলে সন্তানের অধিকার দাবি করে। স্বাভাবিকভাবেই তথাকথিত প্রেমিক তা দিতে অস্বীকার করে। চাঁপাও সবাইকে জানিয়ে দেওয়ার হু’মকি দিতে থাকে।
এদিকে কায়সারের প্রেমিকা ছিল তরী। কথা ছিল খুব শীঘ্রই তরীকে বিয়ে করবে কায়সার। প্রায়শই গভীর ভালোবাসা-বাসিও হতো তাদের। চাঁপা মেয়েটার চাকরিতে আসার পর কায়সারের সঙ্গে সখ্য নিয়ে সন্দেহও হতো। এক পর্যায়ে সন্দেহ সত্যি প্রমাণিত হলে কায়সারের ওপর থেকে তরীর বিশ্বাস টলে যায়।
এমন সময় আহসান নামটা কানে আসে তরীর। আহসানের সুদর্শনতায় ও যোগ্যতায় সদা প্রলুব্ধ তরী ভাবে কায়সারের চেয়ে আহসান বেটার অপশন হতে পারে। তখন সে বোনকে সরিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। কিন্তু আহসানের বিচক্ষণতার কাছে সহজেই ধরা পড়ে যায়। তরী সবকূল হারিয়ে যখন ডুবে যাওয়ার পথে তখন কায়সারকেই পুনরায় অবলম্বন করতে চাইল। কেননা কায়সারের সঙ্গে তার সম্পর্ক মাত্রাধিক গভীর ছিল, পাশাপাশি কায়সারের বিত্তশালী জীবনযাপনের প্রতি লা’লসাও ছিল। কায়সারও তরীর লাস্যময়তায় হাবুডুবু খেতো সর্বদা। সে কায়সারকে চাপ দিতে লাগল চাঁপার ঝামেলা উপরে ফেলে বিয়ে করে নিতে। কায়সার তরীর ওপর দুর্বল ছিল। বিয়ে করার ইচ্ছেও রেখেছিল বলে এক কথায় রাজি হয়ে যায়। এদিকে তরীও সুযোগ বুঝে আহসানের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়। এরপর তরী ও কায়সার মিলে বুদ্ধি করে কীভাবে চাঁপা নামক কাঁটাকে উপরে ফেলবে। আপোষে মানতে রাজি ছিল না চাঁপা। টাকার লোভে গর্ভপাত করতে চায়নি। তাই সর্বশেষ পন্থা হিসেবে এসিডে পু’ড়িয়ে মে’রে ফেলতে চায় কায়সার। চাঁপা বাঁচতে চেয়েছিল। হ’ত্যা’কারীর সঙ্গে ধ’স্তাধ’স্তির আলামত পাওয়া গেছে। গর্ভের সন্তানের প্রমাণও মিলেছে। কায়সারকে গ্রে’ফ’তার করার পর সে সবটা স্বীকার করে নিয়েছে। তরীকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। চূড়ান্ত ধুরন্ধর মেয়েটি কী করে যেন পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে গেছে।
আহসান জিজ্ঞেস করল, “তরীর ফোনটা? ওটা লা’শের কাছে কী করে মিলল?”
“লা’শ ফেলে যাওয়ার সময় হয়তো কোনোভাবে পড়ে গেছিল। তরী সরাসরি এই হ’ত্যা’কাণ্ডে জড়িত ছিল।”
এসআইয়ের কাছে সব শুনে নির্বাক হয়ে রইলাম আমি। আমার তরী আপু একটা হ’ত্যা’কাণ্ডের সঙ্গে জড়িত! শুধু নিজের স্বার্থের জন্য! আচমকা সেই রাতে ম’র্গে ঝ’ল’সানো দেহটির চেহারা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল। প্রেশার লো হয়ে জ্ঞান হারালাম। এরপর থেকে বহুরাত সেই ঝ’ল’সানো নারীটি আমাকে রাতে ঘুমাতে দেয়নি। আপুর নি’র্ম’মতার চিহ্ন আমার শান্তি কেড়ে নিয়েছিল। আর অন্যদিকে শান্তি ফিরিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব আহসান নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছিল।
চলবে…