মৌরিফুল পর্ব-০৫ এবং শেষ পর্ব

0
19

#মৌরিফুল [শেষপর্ব]
প্রভা আফরিন

“ভালোবাসা যদি ফুল হয় সেই ফুলটি আমার জীবনে প্রথম ফুটিয়েছিলে তুমি। পরিস্থিতির পরিতাপে একসময় ফুলটা শুকিয়ে ম’রে গেছিল। কিন্তু গাছটা তো ম’রেনি। সে আবারো নির্দিষ্ট মৌসুমে যৌবনরস ফিরে পেয়েছে৷ প্রকৃতির নিয়মে হয়তো সেই গাছে ফুল আবার ফুটতই। ভাগ্যের মহিমান্বিত পালাবদলে এবারও ফুল হয়ে এলে তুমি। আমার মৌরিফুল। আমি মালি হয়ে আজীবন এই ফুলটির পরিচর্যা করে যেতে চাই। অধিকার দেবে না আমায়?”

আহসান দিন দিন আমার কাছে তীব্র থেকেও তীব্রতর আকর্ষণ হয়ে উঠছে। কৈশোরে সে ছিল শুধুই সুদর্শন, মনে লাগা এক পুরুষ। যৌবনের এই পুরুষটি দায়িত্বশীল, কর্তৃত্বপরায়ণ, শীতল। অবশ্য আরো একটা রূপ প্রকট–প্রেমিক রূপ। এই যে পাশে বসে আমার একটা হাত মুঠোয় পুড়ে সস্নেহে আবদার রাখল, তা ফেরানোর মতো পাষণ্ড আমি হতে পারিনি। ওর হাত ধরে শ্বশুর বাড়ি এসেছি। তবুও আমাদের মাঝে কিছু জড়তা ছিল। বহুদিন ফেলে রাখলে দেয়ালেও শ্যাওলা জমে, লোহাতেও জং ধরে। আমাদের মনেও অস্বস্তির কিছু ধুলো পড়ে ছিল। আমাদের না বলে আমার বললে বোধহয় বেশিই ভালো হয়। কেননা আহসানের দিক থেকে আমি সব সময় একটা নীরব আশকারা পেতাম। এক বিছানায় শুলেও শুরুতে এক কম্বলের নিচে আসতে চাইতাম না। কিন্তু সকালে উঠে দেখতাম দুজনে একই কম্বলের নিচে গুটিসুটি হয়ে ঘুমাচ্ছি। আমি প্রশ্ন করার আগেই সে ঘুম থেকে উঠতে উঠতে গম্ভীর গলায় বলে,

“জেগে থাকা অবস্থায় কম্বল চাই না। অথচ ঘুমালে পুরো কম্বল একা দখল করে নাও। বেচারা আমি শীতে কাতরাতে কাতরাতে টানাটানি করে অল্প একটু উষ্ণতা পাই।”

আমি লজ্জা পেয়ে যাই। সত্যিই কি ঘুমের মাঝে কম্বল নিয়ে টানাটানি করি আমি! কে জানে! তবে এর ফলেই একে অপরের সংস্পর্শে আসা হতো আমাদের।

এরই মাঝে আমার কিছু সমস্যা প্রকট হচ্ছিল। এমনিতেই তরী আপুর একের পর এক অপকর্ম আমার মানসিক শান্তি কেড়ে নিয়েছিল। সেই খু’নের ঘটনার পর প্রধান আসামী কায়সারকে পুলিশ ধরতে পারলেও সহযোগী তরী আপুর নাগাল পুলিশ পায়নি৷ আমার অতি চালাক আপু তাদের চোখে ধুলো দিয়ে নিরাপদে পালিয়ে যেতে পেরেছিল। সাথে নিয়ে গেছিল আমার মানসিক শান্তি। সমস্যার উৎপত্তি হয়েছিল আপুর অপকর্ম জানার পর থেকে। প্রায়ই ঘুমের মাঝে দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠতাম। স্বপ্নে দেখতাম চাঁপার ঝ’ল’সানো লা’শ আমার কাছে আপুর খোঁজ চাইতে আসতো। সেইসব বিভৎস স্বপ্ন যেদিন দেখতাম, ভয়ে কেঁদে উঠতাম আমি। ঘুমাতে চাইতাম না। অবস্থার দিন দিন অবনতি হতে হতে একসময় আমি অন্ধকারকেই ভয় পেতাম। একা ঘরে থাকতাম না। সেই সময়টায় আহসানের যত্ন, আদর, ভালোবাসাগুলো আমি মন দিয়ে উপলব্ধি করতাম। ও আমাকে মানসিকভাবে অনেক বেশি আশ্বাস দিতো। আমার ভয় কাটাতে অনেক রাত অবধি গল্প করত। ওর কথায় মজে গেলে আমি বাকিসব ভুলে যেতাম। কিন্তু ঘুমালে আবারো আমি সেই আতঙ্কে ডুবে যাই। এমনই এক তীব্র আতঙ্কের রাতে ঘুম ভেঙে লাফিয়ে উঠলাম আমি। ঘামে জামা ভিজে গেছে। আহসানের ঘুম বেশ পাতলা। আমার লাফিয়ে ওঠাতেই ওর ঘুম ভেঙে গেছে। আমার মাথাটা বুকে টেনে নিয়ে ও ঘুম ভাঙা ফিসফিস শব্দে বলল,
“আবার ভয় পেয়েছো?”

“হু…চাঁপা…তরী আপু…”

“চুপ। আর বলতে হবে না। ওসব নিয়ে না ভেবে একটা রাত তো আমাকে নিয়েও ভাবতে পারো।”

আহসানের স্পর্শে আহ্বান ছিল। আমার দুর্বল চিত্তে লেপ্টে ছিল সমর্পণের গূঢ় ইঙ্গিত। সেই রাত আমায় ভয়ের থাবা থেকে অনেক দূরের এক সুখদিঘিতে নিয়ে গেছিল। যেখানে গা ভিজিয়ে আমি ও আহসান একে অপরকে আরো গভীরভাবে জানতে পারি।

মাস দুয়েক বাদে টের পেলাম আমার গর্ভে নতুন প্রাণের অস্তিত্ব। দুঃস্বপ্ন দেখার রোগটা এবার নতুন মাত্রা পেল। আগে চাঁপার ঝ’ল’সানো লা’শ আসতো আপুর খোঁজ করতে। এখন চাঁপার গর্ভে বিলীন হওয়া সেই বাচ্চাটাও আসে আপুর খোঁজে। গর্ভকালীন সময়কার অনেক স্মৃতিই আমার স্পষ্ট মনে নেই। আহসান আমাকে এসব মনে করাতে চাইত না দেখে বলত না। তবে ফুপির কাছে শুনেছি আমি তখন অস্বাভাবিক হয়ে গেছিলাম। উগ্র আচরণ করতাম। সবসময় মনে হতো কেউ আমার বাচ্চাকে কেড়ে নেবে। সম্পূর্ণ গর্ভাবস্থা আমি চিকিৎসার ওপরে ছিলাম। আমার মেয়ে তাহিন জন্মানোর পর অবশ্য আমি অনেকটাই স্বাভাবিক হয়েছিলাম। এরপর আহসান আর দেশে থাকতে চাইল না। যে প্রতিষ্ঠানে ও পড়াশোনা করেছে সেখানেই রিসার্চ করার অফার লেটার পেয়ে আমাকে আর তাহিনকে সঙ্গে নিয়ে উড়াল দিলো।
____________

সকাল সকাল তাহিনকে স্কুলে পাঠানো আমার কাছে একটা যু’দ্ধের সমান। শীতের সকালে মেয়েটার ঘুম ভাঙতে চায় না। যাও আদরে-আহ্লাদে ঘুম ভাঙাই দেখা যায় নাশতাটা করতে অনীহা। হাজারটা আদুরে বাক্যে ভুলিয়ে মুখে দুই গ্রাস খাবার দিয়ে টিফিন প্যাক করে বাসের কাছে ছেড়ে দিয়ে আসি। এরপর আমার এক টুকরো অবসর। আজ অবশ্য অবসরের একজন সঙ্গী আছেন। ভদ্রলোকের আজ অফিস নেই। তাই নাকি বউকে ঘরের কাজে সাহায্য করবেন। সাহায্যের নমুনাস্বরূপ এখনো নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন। সব কাজ শেষ করে কফি কাপটা হাতে নিয়ে রুমে ঢুকে দেখি আহসান তখনো ঘুমাচ্ছে। পাশে বসে গরম কাপটা ওর নাকের ওপর ধরলাম। আহসান চোখ মেলল সঙ্গে সঙ্গে। জড়ানো সুরে বলল,

“জন্মসূত্রে প্রাপ্ত নাকটা এমনিতেই বোচা। তুমি আরো চ্যাপ্টা করার বাহানায় আছো নাকি?”

হেসে বললাম, “হলে ক্ষতি কী?”

“লোকে বলবে বোচার বউ।”

“উঁহু, লোকে বলবে সুন্দরীর বর।”

আমার গর্বিত স্বরে আহসান ভ্রু বাঁকাল, “আচ্ছা! আমাকে অসুন্দর বানিয়ে নিজের সুন্দরতার প্রশংসা পাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে?”

বললাম, “এখন ফ্রেশ না হলে লোকে বলবে কর্মঠ বউয়ের অলস বর।”

আহসানকে জোর করে বাথরুমে পাঠালাম আমি। এরপর লেগে পড়লাম বিছানা গুছাতে। বালিশের নিচ থেকে আহসানের ফোনটা বের করতেই দেখলাম স্ক্রিনে একটা নতুন ম্যাসেজ। নামটা দেখে বুকটা ধক করে উঠল। কাঁপাকাঁপা হাতে ম্যাসেজটা ওপেন করতেই দেখলাম তাতে লেখা,

“তুমি আসছো তো?”

প্রেরকের নাম তরী মাহমুদ। আমি তীব্র বিস্ময়ে কিছুক্ষণ থম ধরে রইলাম। এরপর ওপরের ম্যাসেজ চেক করতেই দেখলাম গতকাল রাতের দুটো কথোপকথন।

“কাল দুপুরে দেখা করতে এসো। আমি অপেক্ষায় থাকব।”

“আসব।” আহসানের ছোট্ট জবাব।

বাথরুমের ছিটকিনি খোলার আওয়াজে ফোনটা রেখে দিলাম। ও গোসল সেরে বেরিয়েছে। বললাম,
“আজ দুপুরে আমাদের বাইরে খেতে যাওয়ার কথা।”

আহসান আমার গালে একটা চুমু খেয়ে বলল, “আজ সম্ভব হচ্ছে না, সোনা। আর্জেন্ট কাজ পড়ে গেছে। তবে সন্ধ্যায় মাস্ট। তাহিনকে নিয়ে একসঙ্গে বের হবো।”

আমার মুখ দিয়ে আর জবাব এলো না। আহসান ব্যস্ত হাতে পোশাক পরে বাইরে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নিল। বের হওয়ার আগে আবারো আমার গালে একটা চুমু খেয়ে বলল,
“খুব বেশি দরকার না হলে যেতাম না। মন খারাপ কোরো না। ফিরব শীঘ্রই।”

আহসান বেরিয়ে গেল। পাঁচ মিনিটের ব্যবধানে আমিও বের হলাম। আহসানের ফোন থেকেই দেখা করার লোকেশন জেনেছি। সেটা একটা হাসপাতাল। আপু আর আহসান হাসপাতালে কেন দেখা করছে তা নিয়ে মনে সংশয় জমেছে। তারচেয়েও বেশি উত্তেজনা কাজ করছে এটা জানতে যে এতদিন বাদে তরী আপু কোথা থেকে এলো। আর আহসানের সঙ্গেই বা তার যোগাযোগ কী করে হলো।

হাসপাতালে ঢুকে একটু থতমত খেয়ে গেলাম। এখানে ওদের কোথায় খুঁজব! রিসেপশনিস্ট মেয়েটির কাছে জানতে চাইলাম তরী মাহমুদ নামে কোনো পেশেন্ট ভর্তি আছে কিনা। মেয়েটি উত্তর দিলো,
“আছেন, আপনি পেশেন্টের কে হন?”

“আমি মৌরি মাহমুদ। তরী মাহমুদের বোন।”

রিসেপশনিস্ট আমাকে কেবিন নম্বর জানিয়ে দিলো। চারতলার সর্ব দক্ষিণের কেবিনে ঢুকে আমি থম ধরে গেলাম। এ কাকে দেখছি! আমার সেই সুন্দরী তরী আপু? নাকি শুকিয়ে হাড়ের সঙ্গে চামড়া বসে যাওয়া এক কঙ্কাল। আহসান আমার দিকে পিঠ দিয়ে বসে ছিল। তরী আপুর হতভম্ব দৃষ্টি অনুসরণ করে আমায় দেখতে পেয়ে অপ্রস্তুত হয়ে গেল। আমি কেবিনে ঢুকে সবার আগে জিজ্ঞেস করলাম,
“আপুর কী হয়েছে?”

তরী আপু মুখ ঢেকে কেঁদে উঠল। আহসান রাখঢাক করার অবকাশ না পেয়ে সত্যিটা জানাতে বাধ্য হলো। সপ্তাহখানেক আগেই তরী আপুর সঙ্গে যোগাযোগ হয় ওর। আপু নিজেই যোগাযোগ করে। জানায় ছয় বছর পালিয়ে বেড়িয়ে অবশেষে আপুর পালানোর সময় ফুরিয়েছে। উদ্দাম জীবনের ফলস্বরূপ পাঁচ বছর ধরে আপুর দেহে এইচআইভি ভাইরাস বাসা বেঁধেছিল৷ এতগুলো বছর ধুকে ধুকে অবশেষে ডাক্তার জানিয়েছে আপুর সময়কাল ক্ষীণ। বিদেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য যাওয়ার অবস্থা ছিল না। কেননা পুলিশের খাতায় আপুর নাম আছে। লুকিয়ে যেটুকু সম্ভব চিকিৎসা করতে পেরেছে। এখন সেটাও অকার্যকর হওয়ায় আপু দিশেহারা হয়ে গেছে। কায়সারের কাছ থেকে পালিয়ে আপু নিজের অনন্য সৌন্দর্য দিয়ে একজন কুখ্যাত স’ন্ত্রা’সীর গার্লফ্রেন্ড হয়ে ছিল এতদিন। লোকটির রাজনৈতিক প্রভাব থাকায় আপুকে ঝামেলায় পড়তে হয়নি। আপু লোকটির কাছে নিজের অসুখের ব্যাপার লুকিয়েছিল। কিন্তু এক বছর আগে সেই লোক এই অনিরাময়যোগ্য রোগের কথা জানতে পেরে আপুকে তাড়িয়ে দিয়েছে। এখন আপুর সবকূল হারিয়ে দিশেহারা অবস্থা। বাবা-মায়ের কাছে ফিরে যাওয়ার মুখ নেই, আমার সামনে দাঁড়ানোর মুখ নেই। তাই আহসানকেই ডেকেছিল সাহায্যের জন্য। কিন্তু আহসান নিজের অপারগতা জানিয়ে দিয়েছে। আপু তবুও মানতে চাইছিল না বলেই আহসান আজ দেখা করতে এসেছে। আমি আহসানকে নিজের চেয়েও বেশি বিশ্বাস করি। তাই অতীতের মতো চোখে না দেখে, কানে না শুনে নিজের মতো কিছু ভেবে নেইনি বা মনের মাঝে কোনো হীন চিন্তা ঠাঁই দেইনি।

আমি দুর্বল পায়ে হেঁটে আপুর পাশে বসলাম। ঝাপসা চোখে দেখলাম আপুর বেঁচে থাকার আহাজারি।
“মৌরি, মৌরি রে, আমি বাঁচতে চাই। আমাকে তোরা বাঁচা।”

হুট করে চোখের সামনে ভেসে উঠল চাঁপার সেই ঝ’ল’সানো দেহটি। ভেজা গলায় ফিসফিস করে বললাম, “চাঁপাকে মনে আছে আপু? সেও এভাবেই আমার স্বপ্নে এসে বেঁচে থাকার আকুলতা প্রকাশ করত।”

আপুর অনুতপ্ত কান্নার বেগ বেড়ে গেল। আমি যেন ওর মাঝে চাঁপাকেই দেখতে পেলাম। মনে হলো সেই দুঃস্বপ্নগুলো আজ আমায় হালকা করে দূর হয়ে যাচ্ছে।

(সমাপ্ত)