#ম্লান_সন্ধ্যায় (১৯)
নাজমার সাথে সাফিয়ার উপস্থিতিতে ওদের ভেতরকার রাগ কর্পূরের ন্যায় উবে গেল ।সাফিয়া মাকে দেখতে পেয়ে দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলে,বিভা মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে কপালে চুমু খায়। সাফিয়া মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলে,
‘তোমাকে খুব মিস করছিলাম আম্মু।’
‘আমিও সোনা।’
বিভা অনিকের উদ্দেশ্যে বললো,
‘দেখলে তো আমি আমার মেয়েকে ভালোবাসি কিনা! দয়া করে আমাদের বিরক্ত না করলেই খুশি হবো।’
অনিক ওর কথার জবাব দিলো না।ও সাফিয়া কে জিজ্ঞেস করল,
‘তুমি আম্মুর সাথে যেতে চাও।’
সাফিয়া ডানে বামে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। অনিকের আর কিছু বলার থাকে না।ও চুপচাপ বসে পড়ে। মেয়েকে কাছে পেয়ে কতো কিছু ভেবে রেখেছিল,সব একনিমিষেই শেষ। ছোট্ট শিশুকে তার মনের বিপরীতে জোর করে রেখে দেবার মতো বাবা ও না।
বিভা বললো,
‘আমার সন্তানদের আমি খুব ভালোবাসি। বাকি দুজনের থেকে ইরাকে আরো বেশি কারণ সে আমার কাছে স্পেশাল। আমি মানুষ হিসেবে খারাপ হতে পারি,মা হিসেবে নয়।’
বিভা আর দাঁড়াল না। এতক্ষণ হয়তো রাগের মাথায় অনিককে খেয়াল করেনি। কিন্তু যখন থেকে শুনেছে অনিক বিয়ে করেছে, তখন থেকেই ওর ভেতরে কষ্টগুলো মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে।এই মানুষটার কথা মনে পড়লে সবসময় অনুশোচনার আগুনে দগ্ধ হয়। সেখানে তাঁর নতুন স্ত্রীকে দেখে ও আক্রোশটা চেপে রাখতে পারেনি।ওই সামনে দাঁড়ানো মেয়েটাকে ওর বড় ঈর্ষা হচ্ছে। ইচ্ছে করছে ওকে এখান থেকে দূরে কোথাও সরিয়ে দেয়। মেয়েরা বুঝি এমন?প্রাক্তন স্বামী হোক বা প্রেমিক তার সাথে অন্য কাওকে সহ্য করতে পারে না।এতকিছু হয়ে যাবার পরও বিভা আজও অনিকের ওপর দাবী করতে চায়। কিন্তু সেসব অনিককে বলা না বলা সমান। অতীতে অনিক ওকে বহুবার ফিরে আসতে অনুরোধ করেছে, কিন্তু তার পরিবর্তে ও অনিককে শুধু লাঞ্ছনা আর অপমান ই দিয়েছে।ডিভোর্সের পর ওদের ভেতর সব সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গেছে, এবং সেটা ও নিজেই করেছিল। এখন অনিকের জীবনে ওর কোন মূল্য নেই।অনিকের রাগ জেদ সম্পর্কে ও জানে।যে জিনিস থেকে একবার নিজেকে সরিয়ে নেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে,কোন মূল্যে সেদিকে হাত বাড়াবে না।এত বছরের ভালোবাসা,সুখ সব নিজের হাতে নষ্ট করে দিয়েও কিসের এতো অনুশোচনা? অনিকের ওপর অধিকার দেখানোর মতো কাজ কি ও করেছে?একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেয়ের হাত ধরে সদর দরজার বাইরে পা রাখে। একদিন এভাবেই মেয়েকে বুকে জড়িয়ে সবার অলক্ষ্যে বেরিয়ে গিয়েছিল। সেদিন দুচোখে ছিল রিফাতের দেখানো স্বপ্ন,আর আজ শুধুই দীর্ঘশ্বাস।হীরে ছেড়ে যে ও কাঁচের দিকে হাত বাড়িয়েছিল।
*
অনিকের থমথমে মুখের দিকে তাকিয়ে আফসার শিকদার ভাবনায় পড়লেন।ছেলেটা আজ কি যে করবে? ভদ্রলোকের কাছে এতদিন সবকিছু সোজা মনে হলেও এখন জটিল লাগছে। ছেলের ভালো হবার আশা তিনি আগেই ছেড়ে দিয়েছেন, এখন পুরোপুরি ছেড়ে দিলেন। কিন্তু ওর ভবিষ্যৎ ভেবে কিছু একটা করে রাখতে হবে। নয়তো ওকে মাঝ সমুদ্রে ছেড়ে দেওয়ার মতো ব্যাপার হবে।ও নিশ্চয়ই আজ বেশি করে খাবে।যেদিন ওকে বিমর্ষ দেখায়, সেদিন তালেবের কাজ বেড়ে যায়। মাঝেমাঝে ভাঙচুর পর্যন্ত করে। বড়লোকের বখে যাওয়া সন্তান কথাটা তার ছেলের সাথে একদম মিলে যায়।আর সবকিছুর যোগান দিতে ভদ্রলোককে বাধ্য হতে হয়। পরিবর্তে খারাপ কিছু ঘটে এবং যা পূর্বেও ঘটেছে।
অনিক একরকম চেঁচিয়ে বললো,
‘তোমরা আমাকে কি পেয়েছ? আমি কার কথা বিশ্বাস করবো?বলো?’
আফসার শিকদার ছেলের দিকে তাকায়। একজন প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে সময়ের বিবর্তনে এতটা বদলে গেছে ভেবে মাঝেমাঝে অবাক হন।সময়টা কিন্তু খুব বেশি নয়,বছর তিনেক হয়তো। তিনি বলেন,
‘আমি কখনো মিথ্যা বলিনা এটা তুমি খুব ভালো করে জানো।বিভা জানতো না এটা মিথ্যে নয়। কিন্তু রিফাত সত্যি আমাকে কল করেছিল।’
‘আমি আর এসব ঝামেলা চাচ্ছি না।আগের মতই আমার মেয়ের একাউন্টে টাকা দেবে।বিভার ইচ্ছে হলে আমার মেয়েকে পাঠাবে, নয়তো ও ওখানেই থাকুক। আমি এসব আর নিতে পারছি না, না পারছি নিজের জীবনকে গুছিয়ে নিতে। সবকিছু এখন আমার অসহ্য লাগছে।আমাকে প্লিজ আর বিরক্ত করবে না, আমার মতো থাকতে দাও।’
‘আর তোমার বর্তমান স্ত্রীর কি হবে?’
কোয়েলিয়া অদূরেই দাঁড়িয়ে ছিল।অনিক একবার সেদিকে তাকিয়ে বললো,
‘আমি এ ব্যাপারে ভেবে বলবো।’
অনিক উঠে গেল। কোয়েলিয়া ম্লান হেসে ওর যাওয়া দেখলো। সেদিন ওর জন্য পাগলামি করা মানুষটা আজ ভেবে দেখবে তার জীবনে ও থাকবে কি না!হয়তো তার প্রয়োজন নাও হতে পারে, কোয়েলিয়া নিজেই নিজের ভবিষ্যতের ব্যবস্থা করে চলে যাবে।
আফসার শিকদার অফিসের পোশাক এখনও ছাড়েননি।বিভার আসার খবর রুবিনা জানাতেই তড়িঘড়ি বেরিয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু ছোটখাটো জ্যাম ওনার তাড়াতাড়ি আসার বিঘ্ন ঘটিয়েছে।এসে বিভাকে না পেলেও, দুহাতে মাথা চেপে ধরে ছেলেকে বসে থাকতে দেখেছে।
ভদ্রলোক ওপরে যাওয়ার আগে কোয়েলিয়াকে বললো,
‘কিছুক্ষণ পর গিয়ে দেখে এসো। সেদিন শুনেছিলে তো,অ্যালকোহল ওর হেল্থে কতটা ইফেক্ট ফেলবে।’
কোয়েলিয়ার উত্তরের অপেক্ষা না করে গটগট করে চলে গেলেন। কেননা এটা তার আদেশ ছিল। নেহায়েৎ সেদিন ছেলের ভালোর জন্য নিজের মনের বিরূদ্ধে গিয়েছিল। কিন্তু এই ভদ্রলোকের ভেতরে এতটুকু পরিবর্তন হয়নি।আশাও করা যায় না।
*
কোয়েলিয়া প্রায় একঘন্টা পর অনিকের ঘরের দিকে পা বাড়ালো।আর যাই হোক লোকটার মন খারাপ দেখে ওর ভালো লাগে না। হয়তো সেও দূর্বল হয়ে গেছে। দরজায় কড়াঘাত করলো না, সোজা ভেতরে চলে গেল। অনিক মেঝেতে পা ছড়িয়ে ডিভানে হেলান দিয়ে চোখ বুঝে আছে। টেবিলের ওপর এলোমেলো প্লেট গ্লাস, মেঝেতে ভাঙা বোতলের টুকরো। কোয়েলিয়া অনিকের পাশে গিয়ে ওকে ডাকলে অনিক বিরক্তি নিয়ে তাকায়।
‘কি সমস্যা?’
অনিকের কন্ঠে বিরক্তি। কোয়েলিয়া বললো,
‘এভাবে আছেন কেন?ঘাড়ের যন্ত্রনা আবার বাড়বে।’
‘তাতে তোমার কি?’
‘আমার অনেক কিছু।’
‘অধিকার দেখাচ্ছো?’
‘দেখাতে সমস্যা কোথায়?’
অনিক কোয়েলিয়ার দিকে তাকালে কোয়েলিয়া কিছুটা ভয় পায়।পূর্বের ঘটনা ওর মাথায় আছে। কিন্তু অনিককে আজ নেশায় ধরতে পারেনি। রাগের মাথায় বোতল ছুঁড়ে ফেলায় বেশি খাওয়া হয়নি,তালেবকেও ডাকার ইচ্ছে হয়নি। অনিক কোয়েলিয়ার হাত দুটো চেপে ধরে বললো,
‘যদি এই আমিকে মেনে নিতে পারো,তো থেকে যাও। কিন্তু আমৃত্যু আমার সাথে থাকতে হবে। আপত্তি থাকলে যেতে পারো।’
‘সত্যি!কিন্তু বিকেলে তো কতকিছু বললেন। সেগুলোকে কি হিসেবে ধরে নেব?’
অনিক জবাব দিতে পারলো না। হঠাৎ ওর মনে হয়েছিল মেয়েটাকে মুক্ত করে দেবে,ওর একটা ভবিষ্যৎ গড়ে নিতে সাহায্য করবে। কিন্তু মেয়েটার প্রশ্নে ওর মনে আসলো,ও কোয়েলিয়াকে ছাড়া ভালো থাকতে পারবে না।তবে একথা ওর স্বীকার করতেও ওর বাঁধে। মেয়েটা কি একটু বুঝে নিতে পারে না?
ও নিজের কথা এড়াতে বললো,
‘এখন আমার ভালো লাগছে না, ঘুমাবো।’
‘সবেমাত্র দশটা বাজে।’
অনিক বিরক্ত হয়ে বললো,
‘সবকিছু কি তোমার কথামতো হবে।’
‘শুনুন, সবসময় আশি বছরের বুড়ির মতো খিটখিট করবেন না।ভুলে যাবেন না, আপনি একজন ছেলে এবং আপনার বয়স আশি নয়। ঘুমাবেন না মদ খাবেন,তা আপনার ব্যাপার। চললাম আমি।’
অনিক ভ্রু কুঁচকে কোয়েলিয়ার যাওয়া দেখলো।দিন দিন ওর রাগ বিরক্তি যেন মেয়েটার ভেতরে চলে যাচ্ছে।
*
আজ ওরা ঘুরতে বেরিয়েছে। সম্পূর্ণ পরিকল্পনাটা অবশ্য সারাহর। বিকেলের দিকে হঠাৎ এসে কোয়েলিয়াকে বললো,
‘ঘুরতে যাব, ভাইয়াকে বলেছি রাজী হচ্ছে না। তুমি একটু রাজী করাও না।’
অনিক যেতে চাইছিল না, কিন্তু কোয়েলিয়ার পীড়াপীড়িতে পূর্বের ন্যায় অমত করতে পারলো না। তবে ও বিমর্ষ হয়ে গাড়ি চালাচ্ছিল। একটা অচেনা মানুষ দুদিন থাকলেও তার প্রস্থান মনে ছাপ ফেলে, সেখানে সাফিয়া তার মেয়ে,তার ডিএনএ বহন করছে। এমতাবস্থায় মেয়েকে যেতে দেওয়ায়,ওর মনটা খারাপ হয়ে আছে।এমনিতেই ও মানুষটা বরাবরই কোমল, যেটুকু উগ্র মেজাজ তা ওর রাগেরই অংশ।রাগটা সরিয়ে নিলেই ও একজন গোবেচারা লোক।
সারাহ ওদেরকে একটা রেস্তোরাঁয় নিয়ে গেল। ভেতরে ঢুকেই অনিকের মন খারাপেরা উড়ে বহুদূরে গেল। কেননা সরফরাজ সাফিয়াকে নিয়ে আগে থেকেই ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল। সরফরাজের প্রতি গত দুদিন আগের রাগটা সাময়িক সময়ের জন্য ভুলে গেল, এমনকি এখানে ওর উপস্থিতি নিয়েও বিরক্ত হলো না।সারাহ হেসে বলল,
‘সারপ্রাইজটা কেমন লাগলো ভাইয়া।আগে তুমি আমাদের চমকে দিতে,আজ আমরা দিলাম।’
অনিক কিছু বলার মতো খুঁজে পেল না, কিন্তু কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে সারাহর দিকে তাকালো। সাফিয়া বাবাকে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা।বাকি তিনজন নিজেদের ভেতর কথা বলার ফাঁকে ওদের দিকে তাকালো।দেখা গেল সময়টা যতটা খারাপ কাটবে ভেবেছিল,তার থেকে ভালো কাটলো।
রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে ওরা একটা পার্কে গিয়ে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করলো। শহরজুড়ে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। সরফরাজ আগেই সারাহ কে নিয়ে চলে গেছে। এদিকে বিভা বারবার কল করে বলেছে সাফিয়াকে যেন ওর কাছে দিয়ে আসা হয়। আপাতত অনিকের ঝামেলা করার ইচ্ছে নেই। অগত্যা অনিচ্ছা সত্ত্বেও অনিককে ওদের ফ্লাটের দিকে যেতে হলো। কেননা সরফরাজকে বলে লাভ হয়নি,ওর গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে বলে আগেভাগেই চলে গেছে। ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে ও বিভার নাম্বার ডায়াল করলো। ওপাশ থেকে ধরতেই সাফিয়া ওকে নিতে আসতে বললো।
বিভা একা এলো না,ওর সাথে রিফাত এলো। মেয়েকে নিয়ে বিভা চলে গেলেও, রিফাত গেল না।অনিকের প্রচন্ড রাগ হলো। সরফরাজ নিশ্চয়ই ইচ্ছে করেই ওকে এখানে পাঠিয়েছে। রাগে ক্ষোভে ইচ্ছে হচ্ছিল, সরফরাজকে পেলে মেরে মনের সুখ মেটাতে।
রিফাত ওকে দেখে হাসলো। রাগে অনিকের গা জ্বলে গেল। কোয়েলিয়া বুঝলো এই সেই বন্ধু। দুজনের তুলনা করা হলে অনিক দেখতে বেশি সুন্দর। তবুও এমন একজনকে রেখে বিভা ওর সাথে কি কারণে গেল? নিশ্চয়ই কোন না কোন কারণ লুকিয়ে আছে।তবে এই মুহূর্তে এখানে খারাপ কিছু না ঘটলেই হয়।
‘আরে ব্রো,এতদিন বাদে দেখা হলো, কথা না বলেই চলে যাচ্ছিস?’
অনিক গাড়ির দিকে যাচ্ছিল,রিফাতের কথায় ঘুরে দাঁড়ালো। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
‘আসলেই তো! এতদিন বাদে দেখা হলো, এতদিনের জমাটা সুদে আসলে দিয়ে যাই।কি বলিস?’
‘আগের রাগ চেপে রেখে লাভ আছে।যা হবার হয়ে গেছে।কতো ভালোবাসা কতো প্রেম সবকিছু কি তুচ্ছ তাই না!’
রিফাত হতাশার ভঙ্গি করলো।অনিক কথা বললো না।এই মুহূর্তে রিফাতের চোয়ালটা এক ঘুষিতে ভেঙ্গে দিলে বোধহয় ওর শান্তি হতো।ও কোয়েলিয়াকে ধমকে উঠলো,
‘গাড়িতে ওঠো।বের হয়েছো কেন?’
‘বাহ্,ব্রো! শুনলাম আবার বিয়ে করেছিস।তোর ভাগ্যকে হিংসা করতেই হয়।তা তোর ওয়াইফের সাথে পরিচয় করিয়ে দিবি না?’
এবার অনিক সত্যি সত্যি ওর মুখ বরাবর ঘুষি মারলো। অনিকের বলিষ্ঠ হাতের আঘাতে রিফাতের ঠোঁটের কোণে রক্ত দেখা গেল।অনিক দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
‘ওর দিকে ভুলেও নজর দিবি না। তাহলে কিন্তু তোর পাওনা গুলো এড়াতে পারবি না।’
বিভা রিফাত কে লিফটে না পেয়ে, মেয়েকে রেখে আবার এসেছে।ও দৌড়ে এসে রিফাত কে আগলে ধরলো।ক্ষিপ্ত হয়ে বললো,
‘তোমার সাহস কি করে হয় ওর গায়ে হাত তোলার।’
‘আপনার স্বামীকে সতর্ক করবেন আমার স্ত্রীকে নিয়ে কোনোরূপ মন্তব্য যেন না করে।’
‘ওই কুৎসিত মেয়ের জন্য তুমি ওকে মারলে?’
‘ওর সৌন্দর্য নিয়ে প্রশ্ন তোলার অধিকার আমি কাওকে দিইনি। আমার রাগ বাড়ালে খুব খারাপ কিছু হবে।’
অনিকের কড়া দৃষ্টিতে কোয়েলিয়া তাড়াতাড়ি গাড়িতে বসলো। আরও কতকিছু দেখতে হবে,তা সৃষ্টিকর্তাই ভালো জানেন।
*
একদিন পর কোয়েলিয়া সবেমাত্র রান্নাঘর থেকে বেরিয়েছে।অনিক ওর পথ আগলে বললো,
‘ছাদে এসো।’
কোয়েলিয়া যদিও হঠাৎ এমন আহ্বানের কারণ বুঝলো না। তবুও ও কক্ষে গিয়ে শাড়ি বদলে ছাদে গেল। পৌষের কনকনে শীত, সেই সাথে রাতের হিম,ও শাল দিয়ে মাথা ঢেকে নিলো। এমন ঠান্ডায় কান বের করলেই গলাব্যথা নিশ্চিত। ছাদে পা রাখতেই রজনীগন্ধার মিষ্টি ঘ্রাণের সাথে অন্য একটি কৃত্রিম সুগন্ধি নাকে এসে ঠেকলো। তবে সেটা কোন ফুলের নয়।এটা অনিকের নিত্য ব্যবহার্য পারফিউমের ঘ্রাণ।অনিক প্রাচীরে হেলান দিয়ে দূরপানে তাকিয়ে ছিল। কোয়েলিয়ার উপস্থিতিতেও ওর দৃষ্টির নড়চড় হলো না। কোয়েলিয়া মৃদুস্বরে বললো,
‘জরুরী কিছু বলবেন?’
‘না,একটু সময় কাটাবো,এই আর কি!’
‘আমি অন্যকিছু ভেবেছিলাম।’
‘ কখনো কাউকে ভালোবেসেছো?’
‘এরকম প্রশ্নের মানে?’
‘যেটা জানতে চেয়েছি বলো। আমাদের বিয়ের আগে কাউকে ভালোবাসতে?’
‘না।’
‘তাহলে তোমার কোন পিছুটান নেই?’
‘না কিন্তু, হঠাৎ এসব কেন?’
অনিক জবাব দিলো না।ও ওভাবেই তাকিয়ে রইল।এই আবছায়াতে ও এতো গভীর দৃষ্টিতে কি দেখছে !অনিক ফের বলে,
‘শোনো কোয়েলিয়া তোমাকে কিছু বলার আছে। কথাগুলো গুরুত্ব দিয়ে শুনবে তো?’
‘বলুন।’
অনিক পরের কথাগুলো বলার আগেই ওর ফোন বাজলো।ওপাশের কথাগুলো শোনা গেল না।অনিক যাওয়ার আগে শুধু বললো,
‘আমি সাফিয়া কে আনতে যাচ্ছি। তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করবে তো?’
কোয়েলিয়া মৃদু হেসে মাথা নাড়ায়।
*
ড্রয়িং রুমে মুখে হাত দিয়ে বসে কোয়েলিয়া অনিকের অপেক্ষা করছিল।বেশ অনেকটা সময় অনিক বের হয়েছে, এখন ও ফিরে আসেনি।যদিও এটা স্বাভাবিক, কিন্তু ওর মনে আশঙ্কা জন্মালো।ওর দুশ্চিন্তার মাঝে সারাহর কল এলো। ওপাশ থেকে সারাহর উদ্বেগপূর্ণ কন্ঠ শোনা যায়।
‘রিফাত ভাইয়ার খু’ন হয়েছে। পুলিশ ভাইয়াকে অ্যারেস্ট করেছে।’
কোয়েলিয়ার মনে হলো ও ভুল শুনেছে।ও বললো,
‘সারাহ কি বলছো,ঠিক করে বলো।’
‘ভাবী,প্রথমে আমারও বিশ্বাস হয়নি।মামা এখন থানায় আছে, তুমি তাড়াতাড়ি আসো।’
কোয়েলিয়ার মাথায় চক্কর দিলো, কিন্তু ও অজ্ঞান হলো না। বজ্রাহতের ন্যায় বসে রইল।
চলবে..
®️ সুমি খানম
#ম্লান_সন্ধ্যায় (২০)
ইন্সপেক্টর তমাল পঁয়ত্রিশোর্ধ্ব।লোকটার শরীর পুরোপুরি ফিট থাকার পরিবর্তে অল্পস্বল্প মেদে পূর্ণ। সবকিছুতেই গা ছাড়া ভাব এবং ঘন ঘন চা পান তার চরিত্রের অনন্য বৈশিষ্ট্য। সামনে যে একজন প্রবীণ বয়সী মানুষ রয়েছে, সেদিকে ওর খেয়াল নেই। ভাবখানা এমন যে বিপদে পড়েছো তুমি, ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা তো তোমাকেই করতে হবে। তাইতো ও একমণে সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়েই চলেছে। এদের এমন সুখটান দেখে আমজনতা মেনে নিয়েছে পুলিশের সিগারেট ধরানোটা একটা ফ্যাশান। আফসার শিকদারের এই ছেলেটাকে অসহ্য লাগলেও বাধ্য হয়ে বসে থাকতে হচ্ছে। পুলিশ আর ডাক্তারের সামনে অধৈর্য প্রকাশ করা উচিত নয়, তাহলে এরা সুযোগ পেয়ে বসে।আর এরাও জানে সামনের বিপদগ্রস্ত ব্যক্তিটা এদের সাথে অকারণে রাগারাগী করবে না।
সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে গুঁজে তমাল হাঁক ছাড়ল,
‘হাবীব, দুটো চা।’
আফসার শিকদরের কপালে ভাঁজ পড়লো। তমাল সেটা খেয়াল করে বললো,
‘নাইট ডিউটিতে মাথাটা জ্যাম হয়ে গেছে। ঝরঝরে হয়ে আলোচনায় আসি?’
আফসার শিকদার দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
‘হাতি কাঁদায় পড়লে ইঁদুরেও লাথি মারে।’
‘ইদুরকে যতটাও সাধারণ মনে হয়,ততটাও সাধারণ কিন্তু সে নয়।লায়ন এন্ড মাউসের গল্প তো জানাই আছে।’
‘আপনার বকবক থামিয়ে মেইন পয়েন্টে আসুন।’
‘অধৈর্য হবেন না,স্যার। একজন ব্যবসায়ীর অধৈর্য হওয়া মানায় না।’
হাবীব ওদের সামনে চায়ের কাপ আর বিস্কিট রাখে। তমাল আফসারের শিকদারের দিকে কাপ এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘চা খেয়ে মাথা ঠান্ডা করুন। আপনার মাথাও গরম চা’টাও গরম।গরমে গরমে ঠান্ডা অনেকটা বিষে বিষে বিষক্ষয় এর মতো।’
আফসার শিকদার কাপে হাত দিলেন না। অপেক্ষাকৃত নিচুস্বরে বললেন,
‘আমার ছেলেকে ছাড়তে কত নেবে?’
তমাল চায়ের কাপ রেখে কৃত্রিম বিস্ময়ের ভান করে।ও ব্যাথিতের ভঙ্গিতে বলল,
‘এসব কি বলেন স্যার।ওসব অন্যায় কাজ আমি করিনা।তাও এটা একটা মা’র্ডার কেস।’
‘আমার সামনে ভালো সাজার চেষ্টা করবেন না।থানার ইন্সপেক্টর হয়ে শহরের ওপর জমি কিনেছেন,বাড়িও করবেন। সরকারি বেতনের ব্যাপারে একেবারে অজ্ঞাত নই। এখন বলুন ছাড়তে কত নেবেন?’
‘আপনার কি মনে হয়, মিস্টার অনিক সত্যিই খু’নটা করেছেন?নাকি ওনাকে ফাঁসানো হচ্ছে?’
‘অবশ্যই ফাঁসানো হচ্ছে।’
‘তাহলে আপনি ঘুষ দিয়ে ছাড়াতে চাচ্ছেন কেন?এর থেকে কি প্রমাণ হয়না, অনিক আহসান খু’নটা করেছেন?’
আফসার শিকদার থতমত খেলেন। তবে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন,
‘আমি চাই না, আমার ছেলে অন্ধকার গরাদে কাটাক।টাকা দিতে চাচ্ছি, এজন্য যে কেসের ইনভেস্টিগেশন চলুক কিন্তু ওকে ছেড়ে দেওয়া হোক। আমার ছেলে রিফাত কে মা’রেনি ।সে মোটেও খু’নি নয়।’
‘সব খু’নির পরিবার এটা বলে। আপনার ছেলের সম্পর্কে যা শুনলাম,তাতে তার পক্ষে এসব করা অসম্ভব নয়।’
‘সম্ভব অসম্ভব জানি না। আমার ছেলেকে জেলে দেখতে চাই না।’
‘এসব আমাকে বলে লাভ নেই। ফরেনসিক রিপোর্ট আগামীকাল পাবো।যা কথা বলার সকালে বলবেন। এখন আসতে পারেন।’
‘মানে,সারারাত আমার ছেলে জেলে থাকবে?একটা খু’নের জন্য?’
‘তারমানে আপনি জবানবন্দি দিচ্ছেন, আপনার ছেলে খু’ন করেছে।’
‘সেটা কখন বললাম?’
‘সেরকম ই মানে দাঁড়ায়। আপনি মনে মনে কিছুটা হলেও বিশ্বাস করছেন, আপনার ছেলে খু’ন করতে পারে। বলুন ঠিক বলছি কিনা?’
‘ফালতু কথা বলবেন না। আমি আমার ছেলের সমন্ধে এমন ভাববো কেন?’
‘কিন্তু আপনি তাই ই ভাবছেন।যাহোক,এখন অনেক রাত হয়ে গেছে,যা কথা বলার কালকে বলবেন।বাড়ি গিয়ে একটা লম্বা ঘুম দিন।এইসময় ঘুম জরুরী। কতদিন দৌড়াদৌড়ি করতে হবে তার ঠিক নেই। তবে জেলের জীবন এতটাও খারাপ না,পয়সা খরচ করলে আশা করছি আপনার ছেলের সময় ভালোই কাটবে।এমনিতেও মিস্টার অনিক মানুষের সান্নিধ্য অপছন্দ করেন।’
আফসার শিকদারের মাথায় রাগ চাপলেও নিজেকে শান্ত রাখলেন। তিনি জানেন, অহেতুক এই ছেলেটার সাথে এখন কথা বলে লাভ হবে না।বাড়ি গিয়ে ঠান্ডা মাথায় সবটা ভাবতে হবে।খু’ন করুক বা না করুক ছেলেকে তার জেলে রাখা চলবে না।
ইন্সপেক্টরের কেবিন থেকে বেরিয়ে বাইরে কোয়েলিয়াকে বসা দেখে আফসার শিকদার একটু বিস্মিত হলো। এখন রাত প্রায় তিনটে বাজে। মাঝে একবার কনস্টেবলের মাধ্যমে কোয়েলিয়ার আগমনের খবর পেলেও গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু এতক্ষন অপেক্ষা করবে তিনি ভাবতেও পারেননি। বললেন,
‘এত রাত অব্দি থাকার প্রয়োজন ছিল না।এখন বাড়িতে চলো। সকালে আসবো।’
কোয়েলিয়া আফসার শিকদারের পেছন পেছন থানা থেকে বের হলো।সবকিছু কেমন হুটহাট ঘটে যায়।এইযে সন্ধ্যায় ও কি ওরা ভেবেছিল, এরকম কিছু হবে! রিফাত কি ভেবেছিল ও কারোর হাতে খু’ন হবে। মানুষ সবসময় সামনের সময়টা নিয়ে যা ভাবে তা ঘটে না, বরঞ্চ এমন ঘটনার সম্মুখীন হয়,যা একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিলো।
আফসার শিকদার চালকের পাশে বসেছে, কোয়েলিয়া পিছনে।ওর মনটা উদগ্রীব হয়ে আছে, পুলিশের বক্তব্য শুনতে।যদিও আফসার শিকদারের সাথে এখনো মনোমালিন্য চলছে, তবুও নিজের জড়তা কাটিয়ে মৃদুস্বরে বললো,
‘পুলিশ কি বললো?’
আফসার শিকদারের কোন ইচ্ছে জাগলো না,এই মেয়ের সাথে পরামর্শ করতে। তবুও বিপদের সময় সবার কথাটা শোনাই সমুচিত। বললেন,
‘এত সহজে মনে হচ্ছে ছাড়বে না।রিফাতের ব্যাকগ্রাউন্ডে পলিটিক্যাল পাওয়ার আছে।’
‘আপনার কি মনে হয়,উনি সত্যিই অপরাধী?’
‘আমার মনে করা বা না করায় কিছু আসে যায় না।’
‘তবুও ইনভেস্টিগেশন হলে হয়তো সত্যিটা জানা যাবে।’
আফসার শিকদারের বিরক্ত লাগলো।তার হাটুর বয়সী মেয়ের থেকে এখন পরামর্শ নিতে হবে! কন্ঠে বিরক্তি নিয়ে বললো,
‘শোন মেয়ে, তুমি সারাজীবন নির্দিষ্ট গন্ডিতে কাটিয়েছো। বাইরের জগৎ সমন্ধে তোমার কোন ধারণা নেই।’
‘কিন্তু তবুও..’
‘আর একটা কথাও না।’
কোয়েলিয়া হতাশ হলো। ভেবেছিল আফসার শিকদার হয়তো জোরগলায় বলবে অনিক নির্দোষ। তাহলে ও নিজের মনকে অন্ততঃ শান্ত করতে পারতো। কিন্তু ভদ্রলোকের কথায় ওর চিন্তা আরো বেড়ে গেল।ও যে কোনোমতেই মানুষটাকে অপরাধী ভাবতে পারছে না।
*
বাইরে ঝকঝকে দিনের আলো থাকলেও সেলের ভেতরে গভীর অন্ধকারের বাসা।মনে হবে মরুভূমি থেকে হুট করে গুহায় প্রবেশ ঘটেছে।পরশু অনিককে কোর্টে চালান করা হবে।তার আগে পুলিশি দায়িত্ব হলো,কেসের তদন্ত করে আদালতে আসামীর জবানবন্দি এবং কেসের সমস্ত প্রমাণ জমা দেওয়া । অনিকের মুখোমুখি তমাল বসেছে।ওদের মাথার ওপর অন্ধকারের বুক চিরে হলদে টিমটিমে বাতি জ্বলছে। সেই আলোয় তমাল অনিককে পর্যবেক্ষণ করলো।জেলের পরিবেশে অনেকটা কৃশ দেখাচ্ছে, মুখ জুড়ে খোঁচা খোঁচা দাড়ি ।সকালে দেওয়া খাবারটা পর্যন্ত ছুঁয়েও দেখেনি।অবশ্য বড়লোকের ছেলেদের ব্যাপার-স্যাপার আলাদা।এত তাড়াতাড়ি জেলের পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে সাধারণ পরিবার থেকে আসা আসামীরা পর্যন্ত হিমসিম খায়।
তমাল সিগারেটের প্যাকেটটা অনিকের দিকে এগিয়ে দিলে,অনিক সেদিকে লক্ষ্য করেনা। নিজের পকেট থেকে প্যাকেট বের করে নিজে একটা নিয়ে তমালের দিকে এগিয়ে দিলো। তমাল সিগারেট ধরিয়ে বললো,
‘বেশ দামী সিগারেট দেখছি।’
অনিক কিছু বলার প্রয়োজন মনে করলো না।ও সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়লো।
তমাল বললো,
‘আপনার স্টাইলটা পছন্দ হয়েছে। কিন্তু এতো স্মার্ট একজন মানুষ হয়ে এতো সাধারণভাবে মা’র্ডার করাটা কি মানানসই?’
অনিক ভ্রু কুঁচকে তমালকে দেখলো।ধীরগলায় বললো,
‘আমি খু’ন করিনি।’
‘সব খু’নিরাই একই কথা বলে। এখন রিল্যাক্স হয়ে বলুন,ঠিক কোন কারণের ওপর ভিত্তি করে মা’র্ডারটা করলেন?যদিও আপনার কাছে অনেক কারণ ছিল।’
‘শুনুন অফিসার, ওকে আমি মারলে ছু’রি নয় রিভলবার ব্যবহার করতাম এবং বহু আগে ওর নামের আগে মৃ’ত শব্দটা যোগ হতো।’
‘দেখুন কথা বের করার অনেক উপায় আমরা জানি। এভাবে না বললে, আমরা বের করে নেব।’
অনিক চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলো।ওর ভেতরে একজন খু’নির যে ভয় কিংবা আতঙ্ক কোনোটাই দেখা যাচ্ছে না। বরঞ্চ মুখাবয়বে স্পষ্ট বিরক্তির ছাপ।ও বললো,
‘যা করার করুন। আমাকে অকারণে বিরক্ত করবেন না। এমনিতেই এখানে প্রচুর মশা।’
তমালের রাগ হলো না।এগারো বছরের চাকরি জীবনে সাব ইন্সপেক্টর থেকে ইন্সপেক্টর পদে উন্নীত হয়েছে। এমন আসামীর সাথে বহুবার সাক্ষাৎ হয়েছে।কেউ পেশাদার কিলার,কেউ বা রাগের মাথায় খু’ন করে পরে অনুতপ্ত হয়। এদের সবাই এককথায় স্বীকারোক্তি দিয়েছে এমন না,মাঝে মাঝে রিমান্ডের ভয়াবহতা সহ্য করতে না পেরে মুখ খুলেছে। অনেকে আবার এমন টর্চারের পরও মুখ খোলেনি। তাদের দায়িত্ব স্বয়ং এসপি নিয়েও কিছু বের করতে পারেননি।অনিক লোকটাকে ওর সেরকম কেউ মনে হয়নি। ভেবেছিল কথা সহজেই বের করতে পারবেন। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এভাবে হবে না।
তমাল সিগারেটের ফিল্টার ফেলে পা দিয়ে পিষে নেভালো।মুখ থেকে হাসি সরিয়ে অফিসারসুলভ কঠোরতা এনে বললেন,
‘মিস্টার অনিক, কয়েকদিন আগে আপনি সামান্য কারণে মিস্টার রিফাত কে মেরেছিলেন। কারণ আপনার এক্স ওয়াইফ তার হাত ধরে একসময় আপনাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল।ঠিক সে কারণেই তার প্রতি আপনার আক্রোশ ছিল। আপনার বাবা মিস্টার রিফাত কে হুমকি দিয়ে আপনার মেয়েকে নিয়ে আসেন,তাও মিসেস রিফাতের অজ্ঞাতে। মিসেস রিফাত এটা জানতে পারার পর তাড়াতাড়ি দেশে আসেন এবং মেয়েকে নিয়ে নেন আপনার থেকে। গতকাল রাতে আপনার মেয়েকে নিয়ে দুজনের ভেতর কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে আপনি মিস্টার রিফাতের বুকে ছু’রি বসান।মিসেস রিফাত নিজেই ছু’রি বসাতে দেখেছেন আপনাকে। এবং আপনি তাকে একবার নয় বেশ কয়েকবার জখম করে ক্ষ্যান্ত হন। এবং ফরেনসিক রিপোর্টে ছু’রির ওপর আপনার হাতের ছাপ স্পষ্ট।এর দ্বারা কি প্রমাণ হয় না,মা’র্ডারটা আপনি করেছেন?’
‘না হয়না।রিফাতের ওপর আমার রাগ ছিল এটা সত্যি। কিন্তু তাকে মারার হলে আরও আগে মারতাম।একটা কথা জানেন, আজকালকার পুলিশ অফিসাররা চোখে আবার কম দেখে। খুব সহজ কেস গুলোর তদন্ত করতে হিমশিম খায়।’
নিজের পেশা নিয়ে এমন মন্তব্য তমালের রাগ বাড়ালো।ও কড়া গলায় বলল,
‘একজন ক্রিমিনাল হয়ে আপনি অনেক কথা বলছেন।বাধ্য করবেন না, আপনাকে টর্চার সেলে পাঠাতে। আমি দুঘন্টা পর আবার আসবো,আশা করছি ততক্ষন নিজেকে সত্যিটা বলার জন্য প্রস্তুত রাখবেন।’
অনিক কিছু বললো না। চুপচাপ আরেকটা সিগারেট ধরালো।মাথাটা ওর খুব ধরেছে, ঘুম ও পাচ্ছে। সারারাত একরকম ওর ঘুম আসেনি।অবশ্য ওকে ঘুমাতে হলে টেবিলের ওপর মাথা দিয়ে ঘুমাতে হবে।
*
তমাল নিজের ডেস্কে এসে খবর পেল অনিকের বাবা আর স্ত্রী দেখা করতে এসেছে।ও আসার কথা বলে চেয়ারে হেলান দিলো। সারারাত ডিউটি করার পর সকালেও নিস্তার নেই। রিফাতের খু’নটা নিয়ে প্রেশারে আছে।ভিক্টিমের মামা একজন এমপি।বারবার কল আসছে কোনোভাবেই অনিককে যেন ছাড়া না হয়। এদিকে এই লোকটা ছেলেকে বাঁচাতে মরিয়া হয়ে আছেন।
আফসার শিকদার এবং কোয়েলিয়া একত্রে ভেতরে ঢুকলো।
সামনে রাখা দুটো চেয়ারে দুজনকে বসতে বলে, তমাল চায়ের অর্ডার দিলো।
আফসার শিকদার বললেন,
‘কি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন?’
‘এটা একরকম অসম্ভব। ওপরমহলের প্রেশার ও আছে। এছাড়া ফরেনসিক রিপোর্ট,সবার জবানবন্দি দ্বারা স্পষ্ট মিস্টার অনিক মার্ডা’র করেছেন।এই মা’র্ডারের পিছনে মিস্টার অনিকের হাতে অনেক কারণ আছে।তার পক্ষে এটা অসম্ভব নয়।’
‘তবুও আপনার সঠিক তদন্ত করা উচিত।এটা আপনার দায়িত্ব।’
তমাল চমকে কোয়েলিয়ার দিকে তাকালো। তারপর বললো,
‘ম্যাডাম আপনি কি আগেও এসব কেসের ব্যাপারে দৌড়াদৌড়ি করেছেন?’
‘না।’
‘তাহলে আপনি এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না।’
কোয়েলিয়া হাসলো।যদিও স্বামীর এমন পরিস্থিতিতে কোনোকিছুই ভালো লাগছে না। কিন্তু ওকে তমাল তুচ্ছ করে দেখছে, খেয়াল করে হাসি পেল।ও বললো,
‘আমি কিছুই জানি না বিধায় আপনাকে ঘুষ দেওয়ার কথা তুলিনি।তদন্ত করতে বলেছি। কারণ আমি আমার স্বামীকে যতটুকু জানি,তার পক্ষে খু’ন করা অসম্ভব।তাও ছু’রির মতো বস্তু দিয়ে।’
আফসার শিকদারের মনে হলো কথাগুলো মেয়েটা ওনাকে খোঁচা মেরে বললো। এমন পরিস্থিতিতে নিজেদের ভেতর ঝামেলা কোন বুদ্ধিমানের কাজ নয়।তাই তিনি চুপ করে থাকলেন।
হাবীব চা দিলে, তমাল ওদের নিতে বলে। কিন্তু ওরা এতে কোন আগ্রহ দেখায় না। তমাল চায়ের কাপে গভীর চুমুক দিয়ে বললো,
‘স্বামীর প্রতি বিশ্বাস থাকা ভালো, কিন্তু অন্ধবিশ্বাস নয়।সব প্রমাণ কিন্তু আপনার স্বামীর বিরুদ্ধে।এ ব্যাপারে আপনি কি বলবেন?’
‘শুনুন ইন্সপেক্টর,যা ঘটে তা আমরা দেখিনা।আর যা দেখি তা ঘটেনা। বুঝেছি আপনি মুখের কথায় কাজ করবেন না। এখন বলুন,আপনি এই কেসের তদন্ত করতে কত নেবেন?’
তমালের মুখে রাগের আভাস। একজন সাধারণ মহিলা ওকে ওর দায়িত্ব সমন্ধে পরামর্শ দিচ্ছে,এটা একজন পুরুষ এবং পুলিশ অফিসার হিসেবে মোটেও মেনে নেওয়া যায় না।ও আফসার শিকদারের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘আপনি কি বলেন?’
‘আমার ছেলের বৌ বলে দিয়েছে। আপনি যদি রাজি না হন, আমরা এসপির কাছে যাবো।তার অর্ডার লেটার কি লাগবে?’
তমাল এবার দমে যায়।বেতনে আর কত টাকাই বা আসে। ভালো জীবনযাপনের জন্য সবথেকে বড় প্রয়োজন টাকার।ও এতটাও বোকা নয় যে সুযোগ পেয়ে হাতছাড়া করবে।ও বললো,
‘কি যে বলেন স্যার,ধরে নিন ইনভেস্টিগেশন হয়ে যাবে। কিন্তু তদন্তের পর যদি প্রমাণ হয় মিস্টার অনিক দোষী।’
‘সেরকম কিছুই হবে না।’
‘আপনি এতো কনফিডেন্সের সাথে কিভাবে বলছেন ম্যাডাম।’
‘সেসব আপনি বুঝবেন না।কেসটা এতোটাও জটিল নয়।পরশু কোর্টে যাবার আগেই সবকিছুর সমাধান হবে আশা করছি।’
তমালের মাথায় ঢুকলো না,যেখানে সবাই জানে,অনিক দোষী, সেখানে এই মহিলা কিভাবে এমন বিশ্বাস করতে পারেন! মানুষ আসলেই স্রষ্টার এক বিস্ময়কর সৃষ্টি।
সবরকম কথাবার্তা সেরে অনিকের সাথে দেখা করে আফসার শিকদার অফিসের দিকে গেলেন।এত ঝামেলার ভেতরেও সবকিছুর দায়িত্ব কারোর ওপর দিতে ভরসা পাচ্ছেন না। ভদ্রলোক জানেন, ওনার সামান্য অবহেলা কোম্পানির বড় লস ডেকে আনবে।টাকা ছাড়া জীবন মূল্যহীন,এই শেষ বয়সে এসেও সেটা বেশ বুঝতে পারছেন।টাকা আছে বিধায় তমালের মতো পুলিশেরা কেসের তদন্তের ব্যাপারে আগ্রহ দেখায়, অনিককে টর্চার না করে ওর স্বীকারোক্তির অপেক্ষায় থাকে। ক্ষমতা এবং টাকার জোর না থাকলে, এতক্ষনে হয়তো অনিককে আধমরা করে ফেলতো। কয়েকটা কাগজের নোট নিমিষেই জীবন বদলে দিতে পারে।
*
কোয়েলিয়া আফসার শিকদারের সাথে যায়নি।ও অনিকের সাথে দেখা করার জন্য থেকে গেল। আফসার শিকদার অবশ্য দেখা করলেও অনিক ওনার সাথে কথাবার্তা বলেনি। চুপচাপ অন্যদিকে তাকিয়ে ছিলো।
একজন কনস্টেবল ওকে এসে বললো,
‘আপনার ওয়াইফ দেখা করতে এসেছেন।’
অনিকের চোখ থেকে ঘুম উড়ে যায়।ও নড়েচড়ে বসে। এখন ও ওকে সেলে চালান করা হয়নি। ঘুমাতে হলে টেবিলে মাথা রেখে ঘুমাতে হবে। এমন গুমোট পরিবেশ কারোরই ভালো লাগে না,ওর তো মোটেও না।
কোয়েলিয়া এসে ওর সামনে বসলে অনিক মাথা তুলে তাকায়। মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে, মেয়েটা রাতে ঘুমায় নি।ও নিজের হাতঘড়ির দিকে তাকালো, এগারোটা বাজে, হয়তো এত বেলা অব্দি মুখে কিছু নেয়নি। অনিকের মনটা দূর্বল হয়ে গেল। পৃথিবীতে কেউ ওর জন্য ভাবার মতো তাহলে আছে।
কোয়েলিয়া ওর সামনের চেয়ারে বসতে বসতে বললো,
‘শুনলাম কিছু খাননি। আমি খাবার আনতে দিয়েছি,খেয়ে নেবেন।’
‘কি দরকার বাইরের খাবারের।জেলেরটা খেয়ে অভ্যাস করতে হবে।’
‘আপনি সত্যিই মার্ডা’রটা করেছেন?’
‘তোমাকে কেন বলবো?’
অনিক দুহাতে ঘাড় চেপে চেয়ারে হেলান দেয়। এখানে আসার পর থেকে ঘাড়ের যন্ত্রণা একটু একটু করে বাড়ছে। কোয়েলিয়া লক্ষ্য করলো।বললো,
‘আপনার ব্যাথাটা আবার বেড়েছে?’
‘তোমার এতো শুনে কি দরকার।’
‘আপনি আমার সাথে এরকম করছেন কেন?’
‘কারণ আমি একজন খু’নি। অপরাধীরা ভালো করে কথা বলতে পারেনা।’
‘আপনি নিজেকে অপরাধী হিসেবে স্বীকার করে নিলেন?’
‘সব এভিডেন্স তো তাই বলছে।’
‘কিন্তু আমরা বিশ্বাস করিনা, আপনি এমনটা করেছেন।’
‘ভুল বললে। শোনো আমাকে সিমপ্যাথি দেখাতে হবে না।যেখানে আমার বাবা ই মনে করে খু’ন করাটা আমার পক্ষে অসম্ভব কিছু নয়।’
‘আপনি ভুল বুঝছেন ওনাকে।’
‘তুমি মানুষ চিনতে পারোনি।’
কোয়েলিয়া মনে মনে হাসলো।ও যে আফসার শিকদারকে বুঝতে পারেনি এমন না। গতরাতে আফসার শিকদারের সাথে অনেকক্ষণ কথা বলার পর কোয়েলিয়ার প্রস্তাব মেনে নিয়েছিল। কোয়েলিয়া বেশ অবাক হয়েছিল,জন্মদাতা হয়েও ছেলেকে পুরোপুরি চিনতে পারেনি।রাগী, বদমেজাজি বলেই কি ধরে নিতে হবে সে মানুষ খু’ন করার মতো অপরাধ করবে? এতটুকু বুঝলো না পুলিশকে ঘুষ দিতে চাওয়া মানে ছেলের বিরুদ্ধে একরকম সাক্ষী দেওয়া!
কোয়েলিয়া বললো,
‘শুনুন, হয়তো আর একটা দিন এখানে থাকতে হবে। খাবার আনলে খেয়ে নেবেন। আমি ঔষধ দিয়ে যাবো।’
‘তুমি কি অন্তর্যামী! এখানে আমি একদিন থাকবো এটা তোমাকে কে বলেছে?’
কোয়েলিয়া হেসে বলল,
‘আমি একেবারে যে মানুষকে চিনতে পারি না,তা নয়। নিজের খেয়াল রাখবেন।’
কোয়েলিয়া উঠে দাঁড়ালো। অনিকের হঠাৎ কি মনে হতেই বললো,
‘কার সাথে এসেছিলে?’
‘আপনার বাবার সাথে।’
‘যাবে কার সাথে?’
‘একা একাই।’
‘একা একা যেতে হবে না। সারাহ কে কল করে আসতে বলো।আর শোনো সরফরাজের সাথে কথা না বলাই ভালো।’
কোয়েলিয়ার চোখদুটো খুশিতে চিকচিক করলো।মানুষটা এমন খারাপ পরিস্থিতিতে থেকেও ওর জন্য ভাবছে।আসলে লোকটা এতটাও খেয়ালী না।
*
রিফাতের জানাজা আসরের নামাজ পর হবে।ওর লা’শ পৈতৃক বাড়িতে নেওয়া হয়েছে। পুরো বাড়ি জুড়ে শোকের ছায়া, থেকে থেকে রিফাতের জননী বিলাপ করছে।যদিও ওর লা’শ সকালে আনার পর ঘন্টা দুয়েক ধরে পুরো বাড়ি জুড়ে কান্নাকাটির ঝড় উঠেছিল।কয়েকঘণ্টা পর সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়লে, আত্মীয়দের কানাকানিতে এখন বাড়ি মুখরিত। হাফেজরা লাশের চারপাশে বসে কুরআন তেলাওয়াত করছে।আর রিফাতের বাবা,মামারা এবং ক্ষমতাসীন আত্মীয়রা অনিকের শাস্তি নিয়ে আলোচনা করছে। তাদের আলোচনা অনিকের থেকে সরে গিয়ে ভবিষ্যতে নির্বাচনের দিকে গড়ালো। এদের দেখে মনে হচ্ছে না,এরা কোন শোকসভায় আছে। তবে রিফাতের বাবা নীরব, চোখের সামনে সন্তানের মৃ’ত্যু কোন বাবা-মায়ের কাছে সহ্য করার মতো নয়।
এতকিছুর মাঝে বিভার দিকে কারো মনোযোগ নেই।ও সাফিয়াকে নিয়ে এককোণে বসে আছে।বাকি দুজন রিফাতের ছোট ভাইয়ের বৌয়ের কাছে। সাফিয়া কে কোনোমতেই ও কাছছাড়া করছে না।ওকে দেখেই রিফাতের মা তেড়ে এসেছিলেন।এমন ঘটনার জন্য সবার সামনে ওকেই দায়ী করে গালিগালাজ করেছেন। সেজন্য ও ওদের থেকে সরে গিয়ে এককোণে বসে আছে। ওকে অবশ্য এ বাড়ির কেউ পছন্দ করে না।রিফাতের সাথে বিয়ের পর এবাড়িতে ওকে কেউ জায়গা দেয়নি। তাইতো ও রিফাতের সাথে ভিনদেশে পাড়ি জমিয়েছিল।
রিফাতের জন্য ওর বুকটা ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে।তবুও ও এদের মতো বিলাপ করে কাঁদতে পারছে না,পারছে না নিজের কষ্টকে প্রকাশ করতে।ওর স্বামীর মৃত্যু হয়েছে, কিন্তু কেউ ওর সাথে একটি কথাও বলছে না। প্রয়োজন মনে করছে না সদ্য বিধবাকে সান্ত্বনা দেওয়ার। এমনকি রিফাত কে একনজর দেখতে চাইলেও ওকে দেখতে দেওয়া হয়নি।মৃত বাড়ি না হলে এতক্ষনে হয়তো ওকে এরা বাড়িছাড়া করেই ছাড়তো।
বিভার জানা নেই, এরপর ওর সাথে কি হবে। হয়তো পুনরায় ভিনদেশে চলে যেতে হবে। ছেলেমেয়েদের নিয়ে এদেশে ওকে শান্তিতে অন্ততঃ রিফাতের বাবা-মা থাকতে দেবে না।
*
যেকোন কেসের ইনভেস্টিগেশন শুরু হয় ক্রাইম সিন দিয়ে। তমাল সাথে দুজনকে নিয়ে রিফাতের ফ্লাটে চলে এলো।ফ্লাটে কেউ ছিল না, থাকার কথাও না। গতরাতেই ও এখানটা সিল করে দিয়েছিল।রিফাতের নিথর দে’হটা ওরা ড্রয়িংরুমে রাখা ডাইনিং টেবিলের পাশে পেয়েছিল। তমাল বেশ মনোযোগ দিয়ে পুনরায় সার্চ করা শুরু করলো। একপর্যায়ে কি মনে করে ও কিচেনে ঢুকলো।চারপাশটা ভালো করে দেখতেই ওর মুখটা উজ্জ্বল হলো। বিড়বিড় করে বললো,
‘আপনি ঠিক বলেছেন ম্যাডাম।যা ঘটে তা আমরা দেখিনা,যা দেখি তা ঘটেনা। কিন্তু কথা হচ্ছে, লোকটা অতি ধুরন্ধর।এর নিজের মুখে সবটা স্বীকার করাতে একটু কৌশল অবলম্বন করতে হবে।তবে এই লোকটা কে হতে পারে?’
তমালের সন্দেহের তালিকায় তিনজনের নাম উঠে এলো। অনেকসময় আসল ক্রিমিনাল ই সন্দেহের তালিকায় থাকে না। তবে তমাল নিশ্চিত এই তিনজনের যে কোন একজন ই হবে আসল অপরাধী।
চলবে…
®️ সুমি খানম