ময়ূখ পর্ব-১৯

0
600

#ময়ূখ
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
#পর্ব-১৯

৫৫.
হঠাৎ পরিচিত কন্ঠে সেদিকে ছুটে গেলো মৌন। ঝড় শুরু হয়েছে। বাতাস বইছে ক্রমশ। বৃষ্টির বেগ বেশি। পিছন থেকে নিভৃতকে ঝাপটে ধরলো মৌন। শরীর তার ঠকঠক করে কাঁপছে।

হঠাৎ মেয়েটার ঝাপটে ধরায় থমকে যায় নিভৃত। অশান্ত বুকটা শান্ত হয় তার। পিছু ফিরে মৌনকে জড়িয়ে ধরে সে। মৌন ফুপিয়ে কাঁদছে। মৌনর চোখের পানি মুছে নিজের সাথে জড়িয়ে রাখে অনেকটা সময়।

‘বাবু, আপনার বিবিরে লয়ে চলেন। আবহাওয়ার অবস্থা ভালোনা।’

বোটের তত্ত্বাবধানে থাকা লোকটার ডাকে মৌনকে ছেড়ে দেয় নিভৃত। লজ্জাও পায় খানিকটা। অতঃপর একপ্রকার যুদ্ধ করে তারা ফিরে আসে লালা খালের ঘাটে। এই লালা খালের সবুজ পানিগুলো বিকেলেও ছিল কতটা শান্ত, নির্মল। অথচ এখন হাওয়ার তোপে তার রূপ ভয়ংকর। লালা খালের ঘাটে রিসোর্ট কর্তৃপক্ষের লোকজন দাঁড়িয়ে। তারা মৌন, নিভৃতকে সাহায্যের জন্যই এসেছিলো। কারণ তাদের রিসোর্টে ফিরে যাওয়ার কথা ছিল বিকেল পাঁচটায়। আর এখন বাজে আটটা। উদ্ধার কর্মীরা হাওয়ার তোপে এগোতে পারছিলোনা। লালা খালের ভয়ংকরী তান্ডবে ভিত সবাই।

__________________

ভিজে জুবুথুবু হয়ে রিসোর্টে ফিরেছে মৌন, নিভৃত। মৌন যেন একেবারে চুপসে গেছে। তার হাসোজ্জল মুখটা পাণ্ডুর হয়ে আছে। আজ মৃত্যুর অনেকটা কাছ থেকে বেঁচে ফিরেছে সে। নিভৃত পুরোটা সময় আগলে রেখেছিলো মৌনকে। যেন ছেড়ে দিলে পাখি নীড় ছাড়া হয়ে উড়ে যাবে দূর। বহুদূরে।

এতোটা শক্ত ছিল তার হাতের বাঁধন। মৌন কেবল হাতের বন্ধনের দিকে একধ্যানে তাকিয়ে ছিলো। এটা কি নিভৃত নাকি অন্যকেউ?

রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে নিয়েছে দুজনে। খাবারও অর্ডার করে খেয়েছে রুমে এনেই। কারো মুখে কোনো কথা নেই। এই নিস্তব্ধতা যেন বলে দেয় প্রগাঢ়তা। কখনো কখনো স্তব্ধতার ভিতরেও লুকিয়ে থাকে হাজার হাজার কথামালা। নিভৃতের মাথা ব্যথা করছে প্রচন্ড। বিছানায় আধশোয়া হয়ে শুয়ে মাথা চেপে ধরলো সে।
‘কি হয়েছে আপনার?’

কোনো কথা বললোনা নিভৃত। কেবল মাথা চেপে ধরে বসে রইলো। এই মাথা ব্যথা তার জ্বর আসার পূর্বাভাস। নিভৃত বিষয়টা জানে। রুমে রাখা ফার্স্ট এইড বক্স হাতড়ে একটা প্যারাসিটামল ট্যাবলেট খেয়ে শুয়ে পড়লো সে।

৫৬.

মৌন নিভৃতের কাজ দেখছে। বারবার প্রশ্ন করছে। নিভৃত তাকে ফিরিয়ে দিচ্ছে উপেক্ষা। অবহেলার অপমানে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে মৌন। চোখের কোণা বেয়ে জলগুলো গড়িয়ে পড়ে তার। এমন করছে কেন নিভৃত?

মাঝামাঝি রাতে মৌনকে জড়িয়ে ধরে নিভৃত। মৌন যদিও রাগ করে ছিলো তবে নিভৃতের কপালে হাত দিয়ে বুঝতে পারে প্রচুর জ্বর। ঘাবড়ে যায় মৌন। নিভৃত আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তাকে। বিড়বিড় করে,
‘আমার তোমাকে চাই। যেকোনো মূল্যে চাই।’
‘কাকে চাই?’
‘তোমাকে। প্লিজ আমাকে ছেড়ে যেওনা।’

মৌন ভাবে হয়তো রুহানির কথা বলছে। তবে একটু কি গভীর চিন্তা করতে পারতোনা মৌন? নিভৃত যে কারো নাম উল্লেখ করেনি!

জ্বরের ঘোরে নিভৃত দ্বিতীয়বার চায় মৌনকে। মৌনও নিজেকে সঁপে দেয়। এই লোকটার ডাকে সে সাড়া দিতে বাধ্য। আজকের ভালোবাসায় অন্যরকম ছোঁয়া ছিল। মৌনর মনে হলো এটা শুধু তার ভাগের ভালোবাসা। এখানে রুহানির ভাগের ভালোবাসা নেই।

________________

সকালের আবহাওয়াটা অসম্ভব সুন্দর। গতরাতে ঝড় বৃষ্টির ফলে ধরণী হয়ে উঠেছে স্বচ্ছ। ভেজা মাটির স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধ। স্বচ্ছ, স্নিগ্ধ হাওয়া। পরিষ্কার আকাশে মেঘেদের দল ছুটাছুটি করছে। মৌন ভিজা চুলগুলো ছেড়ে আকাশে মেঘেদের খেলা দেখছে। কখনো তারা ছুটছে আবার কখনো স্থির হয়ে থাকছে। কি স্বাধীন, মুক্ত তাদের জীবন! সকালে নিভৃতের কপালে হাত দিয়ে দেখেছিলো মৌন জ্বর অনেকটাই কমে গেছে।

‘এই মেয়ে?’

নিভৃতের ডাকে মৌন সামনে তাকিয়েই বললো,
‘হুম।’
‘আই এম সরি। আমাকে প্লিজ ক্ষমা করে দিও। আসলে কি থেকে কি হয়ে গেলো। কালরাতের জন্য আমি ক্ষমা চাচ্ছি।’

তাচ্ছিল্যের হাসি দেয় মৌন। সে হয়তো জানতো এমন কিছুই হবে। নিভৃত আর নিভৃতের ভালোবাসা উভয়েই গভীর কুহক। তাদের মায়াজাল বুঝা বড্ড দায়। কখনো মনে হয় মন প্রাণ উজাড় করে ভালোবাসছে। কখনোবা মনে হয় ভাবনা ভুল। মৌন মনে মনে বলে,
‘আমি আপনাকে কবে বুঝতে পারবো নিভৃত? এমন কিছু করবেন না যেন আমি আপনার ভালোবাসা বুঝা সত্ত্বেও আপনাকে দূরে ছেড়ে চলে যাই। আপনিও জ্বলবেন আর আমিও জ্বলবো নিভৃত।’

মুখে বলে,
‘আপনি মানেন আর না মানেন আমি আপনার স্ত্রী। তিন কবুল পড়েই আপনার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে। আমার উপর আপনার সম্পূর্ণ অধিকার রয়েছে। এভাবে বলে দয়াকরে আমাকে ছোট করবেন না।’

নিভৃত আমতা আমতা করে কথা খুঁজে পায়না। তার নিজের জালে সে নিজেই জড়িয়ে। কি করছে, কি ভাবছে, কি বলছে সে জানেনা। দ্বিধাদ্বন্ধের সাগরে পড়ে আছে সে। নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করে। রুহানির সাথে কি সে অন্যায় করে ফেললো?

_________________

ব্রেকফাস্টে রুটি, চিকেন চাইনিজ সিজলিং আর ক্যাশনাট স্যালাড খেয়েছে দুজনে। আগামীকাল ফিরে যাওয়ার কথা। আজই এখানে শেষদিন।

‘চলো ঘুরে আসি। যাবে? নাকি এখনো ভয় লাগছে?’

নিভৃতের নরম গলায় মৌন থমকে যায়। এতটা রূপ দেখালে মৌন কিভাবে আসল রূপ বুঝবে।

‘আমি ভয় পাইনা।’
‘তাই! তা কে যেন কালকে আমাকে ঝাপটে ধরে ছিচঁকাদুনেদের মতো নাকের পানি আর চোখের পানি এক করেছে? এই মেয়ে সত্যি করে বলোতো আমার প্রিয় খয়েরী টি-শার্টে তুমি নাক মুছোনি তো!’
‘দেখুন! একদম উল্টাপাল্টা কথা বলবেন না। আমি মোটেও নাক মুছিনি।’

৫৭.
নিভৃত পাশে তাকিয়ে হাসে। রাগলে মেয়েটার নাকটা লাল হয়ে যায় কেন!

‘তুমি একটা টমেটো!’
‘কি! এটা আবার কেমন কথা!’
‘টমেটো বললাম ভালোলাগে নাই? আচ্ছা যাও তুমি একটা বোম্বাই মরিচ। খুশি?’

মৌন দাঁত কিড়িমিড়িয়ে তাকিয়ে আছে। এই লোকটা তো আচ্ছা বদ!

কতক্ষণ রিসোর্টটা ঘুরে দেখলো তারা। রিসোর্টের বারান্দা দিয়ে হাঁটতে বেশ লাগে। চারদিকে কেবল সবুজ আর সবুজ। রিসোর্টটা খুবই সুন্দর, পরিপাটি।
অতঃপর নিভৃতের সাথে গ্যারেজের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে মৌন। মুখটা কিঞ্চিৎ ফুলানো। এই তো দশমিনিট আগে,
‘এই মেয়ে!’
‘কি?’
‘তোমাকে লাল,কালো ড্রেসে পুরো মুরগীর মতো লাগছে। ঐ যে থাকেনা দেশি মুরগীগুলো। সারাদিন গলা ছেড়ে ডেকে বেড়ায় যে ঠিক ঐরকম।’
‘আর আপনাকে? আপনাকে পুরো এনাকন্ডার মতো লাগছে।’
‘স্টুপিড!’

মৌনর মনটা খারাপ। এতো সুন্দর লাল, কালো মিশেলে থ্রি-পিস পরেছে, সেজেছে আর তাকে নাকি মুরগীর মতো লাগছে! তাঁর ছিঁড়া কোথাকার!

গ্যারেজ থেকে টয়োটা গাড়িটা বের করলো নিভৃত। দরজা খুলে ভিতরে গিয়ে বসেছে সে। মৌন বাইরে মুখ ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

‘এই মেয়ে গাড়িতে উঠবে নাকি রেখেই চলে যাবো?’
‘কোথায় যাচ্ছি আমরা?’
‘জাফলং যাবো। দেখি ডাউকি নদীতে চুবিয়ে তোমাকে মুরগি থেকে মানুষ করা যায় কিনা।’

বলেই গা জ্বালানো হাসি দিলো নিভৃত। মৌন রেগে গলা উঁচিয়ে বললো,
‘দেখুন। আপনি কিন্তু বেশি বেশি করছেন। যাবোনা আমি আপনার সাথে।’
‘না গেলে কি করা আমি একলাই ঘুরে আসি।’

গাড়ি নিয়ে সামনে চলে যাচ্ছে নিভৃত। মৌন হা করে তাকিয়ে আছে। এ কার পাল্লায় পড়লো সে। কিছুদূর যাওয়ার পর গাড়ি থামালো নিভৃত। দরজা খুলে মাথা বের করে বললো,
‘কেউ চাইলে আসতে পারে।’

মৌন দৌড়ে গিয়ে গাড়িতে উঠে। হাঁপিয়ে গেছে বেচারি। এদিকে নিভৃত মিটিমিটি হাসছে।
‘আপনি একটা অসহ্যকর লোক।’
‘আমি জানি। নতুন কিছু বলুন।’

মৌন হা করে তাকিয়ে থাকে। এমন অদ্ভুত লোক সে জীবনে দুটো দেখেনি। গাড়ি চলছে সাই সাই করে। পাশে সারি নদী। নির্মল বাতাসে ছন্দে ছন্দে মাতোয়ারা হচ্ছে দুটো মন।

(চলবে)…….