ময়ূখ পর্ব-২৭+২৮

0
802

#ময়ূখ
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
#পর্ব-২৭

৭৯.
‘মোল্লা ভাই, গাড়ি ঘুরান। ফরিদপুর জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে চলেন।’

চিৎকারে করে বলেন মিরা। নাজমুল আতঙ্কিত গলায় জিজ্ঞেস করেন,
‘কি হয়েছে মিরা? হাসপাতালে কেন?’
‘আমার বাবুই এক্সিডেন্ট করেছে নাজমুল। আমার বাবুইয়ের কিছু হলে আমি মরে যাবো নাজমুল। একদম মরে যাবো।’

স্বামীর বুকে আছড়ে পড়েন মিরা। নাজমুলের চোখের কোণ ঘেষে বেয়ে পড়ে নোনাজল।

ফরিদপুর জেনারেল হাসপাতালে নিভৃতকে রাখা হয়নি। মিরা, নাজমুল পাগলের মতো খুঁজে বের করেন নিভৃতকে। নিভৃতের ঘাড়ের একটা হাড় ভেঙে গেছে। মাথায়, হাত, পায়ে ভয়ানক জখম! তাকে তৎক্ষনাৎ এম্বুলেন্স করে পাঠানো হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। মিরা উদভ্রান্তের মতো কান্নাকাটি করছেন। নাজমুল স্ত্রীকে আগলিয়ে রেখেছেন সবটা দিয়ে। অপারেশন শুরু হয়ে গেছে। নিভৃত এখন ওটিতে।

_____________________

রিপ্তের হাতে ঠাস করে একটা থাপ্পড় পড়লো রথির গালে। বিকালে বাড়ি ফিরে সবটা সে পুষ্পের মুখে শুনেছে। রাগে কপালের রগগুলো প্রতিনিয়ত উঠানামা করছে তার। লালবর্ণ ধারণ করেছে তার মুখ। কেউ তাকে আটকিয়ে রাখতে পারছেনা। পাশ থেকে একটা ঝাড়ু তুলে নেয় সে রথিকে আঘাত করতে। রাগে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছে রিপ্ত। মর্জিনা এতক্ষণ আঁচলে মুখ ঢেকে কাঁদছিলেন। এবার তিনি দৌঁড়ে এসে রিপ্তের হাত ধরলেন।
‘মাফ কইরা দে রিপ্ত৷ এবারের মতো মাফ কইরা দে। তোর দুইডা পায়ে ধরি।’

বলে মর্জিনা রিপ্তের পায়ে ধরতে গেলে রিপ্ত পা সরিয়ে নেয়। রথি উঠানের মাটিতে পড়ে আছে৷ রিপ্ত শক্ত কন্ঠে বলে,
‘আর পাপ বাড়াইয়েন না চাচি। নিজে পাপি হইছেন। আমারে আর পাপি বানাইয়েন না।’

মর্জিনা পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদেন। আফসোস হয় তার। যদি মেয়েটাকে একটু বুঝতেন!
‘এহন আর কান্দেন কেরে। একটু আশ্রয়ের আশায় আসছিলো মেয়েটা আর আপনারা ছিঃ। এমন মা থাকনের চেয়ে না থাকা ভালো। ছিঃ চাচি ছিঃ।’
‘আর চাচা আপনে। আপনারে আমি কি কমু। যে লোক মাইয়া বেইচা খায় তারে আমি কি কমু চাচা।’

আলম মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন। ঘরে কি চলছিলো তিনি ঘুনাক্ষরেও টের পাননি। রিপ্ত আবার তেড়ে যেতে চায় রথির দিকে। তবে রিপ্তের বন্ধু মামুন তাকে ধরে ফেলে। রথি ভয়ে গুটিয়ে পাশে শসার টালের সাথে মিশে যাচ্ছে যেন। রিপ্ত চিৎকার করে,

‘মা* তোরে আমি তালাক দিতাম। খালি ওয়াদা বদ্ধ দেইখা। যার কারণে তোর লগে ঘর বাঁধলাম তারেই তুই কথা শুনাইলি। তোর মতন স্বার্থপর আর নাইরে রথি আর নাই। রথিরে আল্লাহর কসম তোরে আমি খুন করতাম একটা বাঁধা যদি না থাকতো।’
‘চাচি, খাইলে না হয় আমার টাকায় খাইতো। আমি আবার আনতাম। এমন না করলেও পারতেন চাচি। এতোটা স্বার্থপর কেমনে হইলেন চাচি।’

মামুনকে ছাড়িয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় রিপ্ত। যার সুখের জন্য সব করলো সেই নাকি অসুখী!

৮০.
নিভৃতের জ্ঞান ফিরলো আজ। প্রায় ৪৮ ঘন্টা অচেতন ছিলো সে। আইসিইউতে রাখা হয়েছিলো তাকে। ডাক্তার কেবিনে স্থানান্তরের নির্দেশ দেন। সাদা বেডটায় মুখে অক্সিজেন, হাতে স্যালাইন লাগানো অবস্থায় পড়ে আছে নিভৃতের নিথর দেহ। সাদাবর্ণের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে আছে। মাথায় সেলাই পড়েছে চারটা৷ একপাশ থেকে চুল কেটে ফেলা হয়েছে। শিয়রে বসে আছেন মিরা। চোখের অশ্রু ফুরিয়ে গেছে যেন। পাণ্ডুর মুখ। নাজমুলও পাশে বসে আছেন। মাঝে হাইপ্রেশারের কারণে একদিন বেড রেস্টে থাকতে হয়েছিলো তাকে।

নিভৃত হালকা করে ঠোঁট নাড়ায়। কিছুই বুঝা যাচ্ছেনা তার কথা। মিরা আলতো করে নিভৃতের মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
‘কি চাই বাবুই। মাকে বল।’

নিভৃত ঠোঁট নাড়ায় আবার। কিছুক্ষণ আগে ডাক্তার দেখে গেছেন তাকে। ডাক্তারের ভাষ্যমতে নিভৃত খানিকটা সুস্থ এখন। মিরা নিজের কানটা নিভৃতের ঠোঁটের কাছে নিয়ে যান। আস্তে করে আওয়াজ হয়। অক্সিজেন মাস্কটা খুলে দেন মিরা। নিভৃত বলছে,
‘মা, আ…….মা…….র। মো.…..ন। ক….ই?’

মিরা জবাব দিতে পারেন না। ছেলের মাথা, হাত, পায়ের ব্যান্ডিজে হাত বুলিয়ে অশ্রু ঝড়ান। মৌন নিখোঁজ আজ প্রায় দুইদিন। কোনো খবর পাওয়া যাচ্ছেনা। মিরা ইতিহাস বিভাগের প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থীকে ফোন করেছেন। তবে কোথাও নেই মৌন। মিরা পাগল হয়ে যাচ্ছেন। একদিকে তার বাবুই আরেকদিকে স্বামী। মৌনর কোনো খোঁজ নেই। মিরা যেন অতল গহ্বরে পড়লেন।

____________________

হাসপাতালে থাকা দশটাদিন নিভৃত ছটফট করেছে। ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে পাশে যা পেয়েছে। স্যালাইন খুলে হাত দিয়ে গড়গড় করে রক্ত ঝড়িয়েছে। তবে কাঙ্খিত মুখটাকে কেউ এনে দেয়নি কেন! সময় গেলে যে সাধন হয়না!

আজ বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে নিভৃতকে। সে এখন পাগলপ্রায়। রুহানির মৃত্যুর পরেও এতোটা পাগল সে হয়নি। হয়তো পেয়েও দ্বিতীয়বার হারিয়ে ফেলার শোকে। এ কেমন মায়া! এ কেমন বন্ধনের জোর!

খুঁড়িয়ে ঘরে ঢুকে নিভৃত। নরম গলায় ডাকে,
‘এই মৌন। তুমি কি বারান্দায়? এই মেয়ে আসো। দেখো আর মারবোনা তোমায়। আর বকবোনা।’

মৌন আসেনা। নিভৃত চিৎকার করে। চিৎকার করে বসে পড়ে ঘরের মেঝেতে। চোয়াল ঝুলে পড়েছে তার। দাঁড়িগুলো বড় হয়েছে অনেকটা। মিরা পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদেন। আল্লাহ এ কেমন পরীক্ষা নিচ্ছে? নিভৃতের আওয়াজে মিটি উড়ে আসে নিভৃতের ঘরে। অনেকটা শুকিয়ে গিয়েছে সে। বাড়ির সবাইকেই অচেনা লাগে তার। নিভৃতের কাঁধে বসার সাহস পায়না মিটি। উড়ে চুপটি করে বসে থাকে টি-টেবিলে। মিরা ছেলের কান্না সহ্য করতে না পেরে জড়িয়ে ধরেন নিভৃতকে। নিভৃত বাচ্চাদের মতো কেঁদে বলে,
‘আমি ওকে ভালোবাসি মা। আমি ওকে ভালোবাসি।’

মিরা বলার মতো কোনো ভাষাই খুঁজে পাননা। পারলে এখনি মৌনকে ধরে নিয়ে আসতেন তিনি। ঘর থেকে বেরিয়ে যান মিরা।

৮১.
মিটিকে দেখে তার কাছে এগোয় নিভৃত। মিটি ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে আছে। নিভৃত তাকে আলতো করে ধরে চুমু খায়। মলিন হেসে বলে,
‘তোমার বুবু বড্ড পঁচা মিটি। দেখোনা আমাকে ফাঁকি দিয়ে কোথায় যেন চলে গেছে। আমি কি অনেক খারাপ মিটি?’

মিটি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। সত্যিই তো তার বুবু কই?

নিভৃত খুড়িয়ে খুড়িয়ে রুহানির ছবির সামনে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে। মাথা নিচু করেই বিরবির করে,
‘আমাকে ক্ষমা করো রুহানি। আমি মৌনকে বড্ড ভালোবাসি রুহানি। হলদেটে মুখের মায়াবী গড়নটাকে বড্ড ভালোবাসি।’

হঠাৎ কে যেন কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলে,
‘তুমি সুখী থাকলে আমিও সুখী বাবুইপাখি। বুকের বাঁ পাশটায় জায়গা দিও তাকে।’

নিভৃত অবাক হয়। আশেপাশে তাকিয়ে খুঁজে বেড়ায় ছোটবেলার প্রেয়সীকে। স্পষ্ট সেই সুর!

নিভৃত ধপাস করে খাটে বসে পড়ে। জীবন নামক যুদ্ধে সে অনেক ক্লান্ত। হঠাৎ করে নিভৃত উঠে দাঁড়ায়। পা খুঁড়িয়ে বাইরে বেরিয়ে পড়ে সে। মৌন নামের মেয়েটাকে তার বড্ড প্রয়োজন। প্রাণভরে শ্বাস নেওয়ার জন্য প্রয়োজন। নিভৃতকে বাইরে বেরোতে দেখে বাঁধা দেন মিরা। মায়ের বাঁধা মানেনা নিভৃত। এশার আজানের ধ্বনি চারপাশে। কি মায়াবী সে ধ্বনি। নিভৃত গাড়ি থামিয়ে মসজিদে ঢুকে পড়ে। নামাজে বসে দুহাত তুলে আল্লাহর কাছে প্রিয় মানুষটাকে চায় নিভৃত। মাথার কাঁচা সেলাইয়ে টান পড়ায় রক্ত ঝড়ে পড়ছে। মোনাজাতরত অবস্থায় জ্ঞান হারায় নিভৃত।

_______________

বিশাল বড় পূর্নিমার চাঁদ আকাশে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ। মৃদু বাতাস বইছে। চাঁদের দিকে তাকিয়ে মেয়েটা বলে,
‘রাজপুত্র। ও রাজপুত্র। তোমায় ভালোবাসি। খুব ভালোবাসি। তোমার উপর রাগ করে, ঘৃণা করে যে থাকতে পারিনা আমি! পুঁচকোটা তোমায় খুঁজে রাজপুত্র। কেন আমাকে ভালোবাসলে না রাজপুত্র? আমি মেয়েটা কি খুব খারাপ? তোমার বুকে একটু জায়গায়ই তো চেয়েছিলাম কেবল!’

কথাটা বলে মেয়েটা পেটে হাত বুলায়। কিছুক্ষণ আগের বলা কথায় নিজের উপর রাগ হয় তার। পেটে হাত রেখে মেয়েটা আবার বলে,
‘তোমার বাবা তো তোমায় চায়না সোনা। কেন এতো চাচ্ছো তাকে? আমি তোমার বাবা আর আমিই তোমার মা।’

আদোও কি তাই? আড়াইমাসের বাচ্চাটা কি পেটে থেকে এসব বুঝে? নাকি মেয়েটার মনের কোণে ঘুরে বেড়ানো সুপ্ত ইচ্ছে ; প্রিয় মানুষটাকে কাছে পাওয়ার?

(চলবে)…….

#ময়ূখ
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
#পর্ব-২৮

৮২.
রিপ্ত শাপলাবিলের পাশে বসে একটানা সিগারেট টানছে। একটার পর একটা। চোখ দুটো লালবর্ণ তার। আজ প্রায় পনেরো দিন মৌন নিখোঁজ। কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি তাকে। রিপ্ত সামনে তাকিয়ে আছে। কালচে সবুজ পানির রং। রিপ্তের চোখ দুটো হঠাৎ অশ্রুতে ভরে গেছে। নীল শার্টের হাতায় চোখ মুছে রিপ্ত।
‘মৌনিরে তুই কই গেলি মৌনি।’

______________________

কাঁচের ল্যাম্পটা নিচে পড়ে ভেঙে গেলো। একে একে আসবাবপত্র সব ফ্লোরে ছুঁড়ছে নিভৃত। গত দুইদিন যাবত তাকে ঘরে আটকে রাখা হয়েছে। নিভৃত দরজার কাছে এগিয়ে গিয়ে জোরে জোরে দরজায় আঘাত করে।
‘আম্মু, দরজাটা খুলে দেও। প্লিজ আম্মু আল্লাহর দোহায় লাগে আম্মু।’

মিরা বাইরে বসে আছেন। দেয়ালে মাথা দিয়ে চোখ বন্ধ করেন তিনি। ছেলের এমন দশায় তিনি বড্ড ভেঙে পড়েছেন।
‘ও আম্মু, আম্মুগো। আমি শ্বাস নিতে পারছিনা তো! একটাবার খালি একটাবার আমার মৌনটাকে এনে দাওনা আম্মু।’

কোনো জবাব না পেয়ে নিভৃত ধপাস করে বসে পড়ে। বুকটা জ্বালা করছে। ভিষণ জ্বালা করছে। নিভৃত হঠাৎ অনুধাবন করলো তার এখন মেয়েটার শরীরের গন্ধ নিতে হবে। নয়তো সে মরে যাবে। তার শ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে। নিভৃত দৌঁড়ে আলমারির কাছে যায়। পায়ে ভাঙা ল্যাম্পের কাঁচ ফুটেছে। সেসব খেয়াল নেই তার।

আলমারিতে মৌনের কাভার্ডে হাত বাড়ায়। একটা শাড়ি যদি পাওয়া যায়! একটু ঘ্রাণ যদি নেওয়া যায়! হঠাৎ শাড়ি টান দিতে গিয়ে একটা কালো ডায়েরি নিচে নিভৃতের পায়ের কাছটায় পড়লো। নিভৃত অবাক হয় খানিকটা। এটা কি মৌনর ডায়েরি? নিভৃত ডায়েরিটা উঠিয়ে খাটে নিয়ে বসে। অনেকটা পুরানো ডায়েরি। মাঝারি আকৃতির। কালো রঙের কভার। উপরে গুটি গুটি অক্ষরে লেখা ‘মৌন’। নিভৃত বিছানায় হেলান দিয়ে ডায়েরিটা খুলে। প্রথম পৃষ্ঠায় লেখা,
‘আমি এবং আমার প্রিয়।’

নিভৃত অনুধাবন করলো সে ঘামছে। বড্ড ঘামছে৷ তবে কি মৌনর মনে অন্য কারো বসবাস।

নিভৃত মনের কোণে প্রশ্ন জাগে। কে মৌনর প্রিয়?
নিভৃত ডায়েরিটা ফেলে দেয়। মাথা চেপে ধরে বসে থাকে অনেকটা সময়। তার মনটা যে বড়ই দুর্বল। অন্যকারো সাথে মৌনর সম্পৃক্ততা নিভৃত একদম মেনে নিতে পারবেনা। নিভৃতের শরীর শুকিয়ে গেছে। সারামুখে দাঁড়ি ভর্তি। চোখের নিচে কালো দাগ। কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থেকে উঠে দাঁড়ায় নিভৃত। ডায়েরিটা উঠায় পাশ থেকে। তাকে যে জানতে হবেই!

৮৩.
দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় কিছুই লেখা নেই। আবার পৃষ্ঠা উল্টালো নিভৃত। তার কপালের পাশ দিয়ে সূক্ষ্ণ একটা ঘামের রেখা দেখা যাচ্ছে।

প্রিয়,
কি নামে ডাকবো তোমায়? রাজপুত্র বলে ডাকি? এই তুমি কি রাগ করবে? জানো আগামীকাল আমার দশম শ্রেণীর টেস্ট পরীক্ষা আর আমি তোমাকে নিয়ে লিখছি। আমি কি বড্ড পাগল? আজ থেকে দুইবছর আগে ব্যারিষ্টার বাড়ি গিয়েছিলাম। আরু, নিরু বললো তাদের নাকি কোন ভাই আসবে। আমি কোনো প্রতিক্রিয়াই দেখাইনি। আসলে আসুক আমার কি? কে জানতো সে ভাই আমাকে পাগল করে দিবে?

সবুজ রঙের টি-শার্ট পরনে একটা রাজপুত্র এলো ব্যারিষ্টার বাড়ি। আমি বড় জামগাছটার পিছনে লুকিয়ে কেবল একটা নজর দেখেছিলাম। বিশ্বাস করো, আমার বেহায়া চোখ আটকে গেলো তোমাতে। আমার হৃদপিণ্ডটা ধুকপুক ধুকপুক আওয়াজ করতে লাগলো। আমি চেপে ধরলাম বাঁ পাশটা। লোকে আওয়াজ শুনে ফেললে কি লজ্জা! কি লজ্জা!

নিভৃত হঠাৎই মুচকি হাসে। মৌন এত ছেলেমানুষ! পড়ায় মনোযোগ দেয় সে।

কতবার চেষ্টা করলাম। তোমার সামনে যাবো তোমাকে প্রাণভরে দেখবো। আমি পারিনি। কেনো পারিনি কে জানে? তারপর তুমি চলে গেলে। কেনো চলে গেলে? আমার ভিতরটা যে খা খা করে রাজপুত্র!

আর কিছু লেখা নেই। নিভৃত পৃষ্ঠা উল্টায়। কেবল লেখা রাজপুত্র ভালোবাসি। আমার স্বপ্নে রোজ এসে জ্বালানোটা কি খুব প্রয়োজন? পঁচা রাজপুত্র।

প্রিয়,
জানো আজ প্রায় দুইটা বছর তোমায় দেখিনা। এ কেমন জ্বালা দিয়ে গেলে আমায়। আমার কিশোরী মনে একোন আবেগ! আমি যে কইতেও পারিনা আর সইতেও পারিনা। তুমি আসোনা। আজ ভর পুর্নিমা। আকাশে কত তারা! তোমার সাথে আমি পূর্নিমার আকাশ দেখবো। কোনো এক বিস্তর মাঠে পাশাপাশি শুয়ে আকাশে ভরা জোৎস্না দেখবো। তোমাকে নাকি তোমার প্রিয় মানুষটা বাবুই পাখি ডাকে? আমি ডাকি। বেশি না একটু। একটু।

বাবুইপাখি, বাবুইপাখি, বাবুইপাখি পরের পাঁচটা পৃষ্ঠা কেবল এটাই লিখা। নিভৃত অবাক হয়। সে ঘুনাক্ষরেও জানতোনা তার একটা এমন পাগলাটে প্রেমিকা ছিল!

নিরুর মুখে শুনলাম তুমি নাকি আগামীকাল আসবে? আমি ঠিক কতটা খুশি আমি তোমায় কি করে বোঝাই? আচ্ছা, একটা উদাহরণ দেই? বিকালে কলেজ থেকে ফিরে উঠানে দাঁড়িয়ে কতক্ষণ একলা লাফিয়েছি। মা, ঝাড়ু নিয়ে ছুটে এসেছিলেন। আশেপাশে লোকজন জমা হয়ে গিয়েছিলো আমার লাফানো দেখে। জানো মা,বাবা মিলে রাতে হুজুর পর্যন্ত নিয়ে এসেছে! তাদের কি করে বোঝাই এই পাগলামী জ্বীনে ধরার পাগলামি না। এই পাগলামি আমার নিভৃতের জন্য করা পাগলামি। নিভৃত রহমান। দেখো তোমার নাম আর আমার নামে কতো মিল! নিভৃত, মৌন। দুজনের নামের অর্থই নিরবতা।

আজ পহেলা বৈশাখ। জানো, আজ আমি লাল পাড়ে সাদা শাড়ি পরেছি, পায়ে আলতা দিয়েছি। হাতে কাঁচের চুরি পরেছি। তুমি আজ আসবে। তোমায় আমি মনের কথা বলবো। খুব করে বলবো। এই যে দেখেন, মিঃ নিভৃত আমি কিন্তু আপনার পাগলাটে প্রেমিকা। আচ্ছা, আমি কি খুব বেহায়া? তোমার ভালোবাসার মানুষ আছে শুনেও আমি এতোটা বেহায়া কি করে হতে পারি। থাক। থাকনা কিছু অজানা। যা কেবল আমি জানবো। মিরা আন্টি কি কিছু বুঝে গেলো? আমি বারেবারে তোমার ঘরে উঁকি দেই। একদিন তো হাতেনাতে ধরেও ফেলেছিলো আমি দৌঁড়ে প্রাণ বাঁচিয়েছি।

পরের পৃষ্ঠাগুলো ফাঁকা। নিভৃত আরো পৃষ্ঠা উল্টায়।

তোমার নাকি বিয়ে হয়ে গেছে? রুহানি আপু খুব সুন্দরী। বেশ মানিয়েছে তোমাদের। সেদিন তোমাদের বাড়ি ছুঁটে গিয়েছিলাম। মিরা আন্টিকে সামনে পেয়ে লাজ লজ্জার মাথা খেয়ে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম তুমি কই। আন্টি বললো তুমি নাকি ব্রক্ষপুত্রের পাড় গেছো। আমাকে আর পায়কে। আমিও দৌঁড়ে গেলাম সেখানে। তুমি যখন রুহানি আপুর হাতে হাত রেখে পাড় ঘেঁষে হাঁটছিলে কি সুন্দর লাগছিলো! আমি কিন্তু দেখে ফেলেছি। তুমি যে রুহানি আপুর কপালের মাঝখানটায় চুমো খেয়েছো। আমি দেখেছি। হি হি হি।
ফিরে আসার সময় দেখলাম আমি হাঁটছি আর মাটি লাল হচ্ছে। আমার পায়ের ছাপ বসছে মাটিতে। জুতা খুলে দেখি একটা বড় কাটা ফুটেছে। গলগল করে রক্ত পড়ছে। এই রক্তক্ষরণ আমি বন্ধ করলাম। তবে আমার হৃদয়ের রক্তক্ষরণ?

৮৪.

তোমার সাথে নাকি আমার বিয়ে! আমি এমনটা কখনো চায়নি। বিশ্বাস করো রাজপুত্র। আমি এটা চাইনি।

পরের পৃষ্ঠা গুলো সাদা। নিভৃত উদভ্রান্তের মতো পৃষ্ঠা উল্টায়।

আমার খুব কষ্ট হয় নিভৃত। আমার সাথে কেন এমন করো তুমি?

রাজপুত্র, ও রাজপুত্র ভালোবাসি তোমায়।

আমাকে কি খুব ঝগড়াটে ভাবো তুমি? এই যে রাজপুত্র আমি কিন্তু মোটেও ঝগড়াটে নই।

আজ আমরা প্রথম মিলিত হয়েছি। আমার শত চিৎকার আর্তনাদ শুনোনি তুমি। আর দোষটা তুমি আমার দিলে নিভৃত?

তোমার সাথে ঘুরে বেড়ানো প্রতিটা মুহূর্ত আমার হৃদয়ের গহীনে স্বর্ণাক্ষরে লিখে রেখেছি। সিলেটে তোমার সাথে কাটানো প্রতিটা সময় আমি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মনে রাখবো রাজপুত্র। আমার জন্য তোমার উদ্বিগ্নতা আমায় লজ্জা দিচ্ছে তো!

সিলেটে আমরা দ্বিতীয়বার মিলিত হয়েছি। তুমি আমার কাছে ক্ষমা চাচ্ছো কেন? আমি তো তোমার স্ত্রী!

তুমি বড্ড জটিল নিভৃত। তুমি একটা মায়াজাল।

তোমার বুকে একটু ঠাঁই কি আমি পাবোনা?

আমি একটা ভেসে বেড়ানো কচুরিপানা।

পরের পৃষ্ঠাগুলোতে কেবল এসবই লেখা।

বড় স্বাদ ছিলো তোমায় নিয়ে বাঁধবো ঘর।
তুমি বন্ধু আমায় করে দিলে পর!

আর কিছু লেখা নেই। নিভৃত পৃষ্ঠাগুলো উল্টায়। দুয়েকটা কবিতা, ছন্দ তাকে ঘিরে।

তবে শেষের পাতায় এসে হাত থমকে যায় তার। এটা কি? নিভৃত মনোযোগ দিয়ে দেখে। এটাতো একটা আল্ট্রাসনোগ্রাফির রিপোর্ট! নিভৃতের মনে হচ্ছে তার হৃৎস্পন্দনের হার বেড়ে যাচ্ছে। শ্বাস আটকে আসছে। তাহলে মৌন!

নিভৃত চোখ বুলায় নিচের লেখাগুলোতে।

তোমার বাবা তোমায় চায়না সোনা। তুমি যে তার ভালোবাসার ফল না। তুমি তার চাহিদার ফল। তোমাকে কখনো কষ্ট পেতে দিবোনা আমি। তোমার বাবাকে ছেড়ে আমরা চলে যাবো দূরে। তোমার বাবা তার রুহানিকে নিয়ে থাকুক। ভালো থাকুক। আমি তোমাকে নিয়ে চলে যাবো। তোমার বাবা খুব পঁচা। খুব খুব খুব।

আপনি কি পুরো ডায়েরিটা পড়েছেন নিভৃত? আমি জানতাম আপনি হয়তো কোনোদিন পড়বেন। যেদিন আমি আপনার থেকে বহুদূরে চলে যাবো। শুনোন, আপনি আমার কিশোরী বয়সের আবেগ, ভালোবাসা। দীর্ঘ সাড়ে পাঁচটা বছর আপনার জন্য জ্বলেছি। বিয়ের পর তা বেড়েছে দ্বিগুণ হারে। আপনি একটা স্বার্থপর নিভৃত। আপনাকে আমি ভালোবাসি। তাই হয়তো ঘৃণা করতে পারবোনা। নয়তো আমি আপনাকে ঘৃণা করতাম নিভৃত। অনেক ঘৃণা করতাম।

নিভৃতের হাত থেকে ডায়েরিটা খসে পড়ে। বাইরে ঝড় শুরু হয়েছে। এতো তীব্র ঝড়! আমগাছের মগডালটা ভেঙে ধরণী কাঁপানো আওয়াজ হলো। নিভৃতের সেদিকে খেয়াল নেই। সে স্তব্ধ, হতভম্ব, নিথর, নিশ্চল।

(চলবে)…..