#যতনে_রাখিবো
২৩
কর্কশ গলায় তাথৈ জিজ্ঞেস করল,
-এখানে কেন এসেছেন?
অভয় এই প্রশ্নের জবাব কিছু বলার আগেই আশেপাশে কোথাও কতগুলো কুকুর একসাথে ঘেউঘেউ করে উঠল। মনে হচ্ছে কুকুর গুলো নিজেদের মধ্যে মারামারি লেগেছে। অভয় জানালার দিকে তাকিয়ে বলল,
-কুকুর ডাকছে।
তাথৈ তীক্ষ্ণ চোখে অভয়ের দিকে তাকাল। এই লোক তার সাথে রঙঢঙ করছে? তার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বাজে কথা বলছে। তাথৈ বলল,
-কুকুর ডাকুক মন চায় বাঘ ডাকুক। আপনাকে তো সেদিকে কান দিতে বলিনি। আপনি আগে এটা বলুন এখানে কেন এসেছেন?
-এটা কিরকম প্রশ্ন হলো তুমি নিজেই বলো। শ্বশুরবাড়িতে মানুষ কেন আসে তাথৈ?
-এটা আপনার শ্বশুরবাড়ি না।
-জানি। তবে তোমার বোনের বাড়ি তো।
সকালের অপমান তাথৈ ভুলে যায়নি। এতক্ষণ রাগটা চেপে রেখেছিল কিন্তু অভয়ের হেয়ালি কথাবার্তা শুনে চেপে রাখা রাগ প্রকাশ পেয়ে গেলো।
-আপনি কি ভুলে গেছেন সকালে আপনিই আমাকে চলে আসতে বলেছিলেন। তাহলে এখন কেন এসেছেন? আমি তো ভেবেছিলাম কালপরশুই ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দিবেন। আমিও সাইন করে দিতাম। মিথ্যা একটা সম্পর্কে থেকে বারবার অপমানিত হতে পারবো না। হতে পারেন আপনি অনেক বড় হিরো…
-আমি জানি তোমার কাছে আমি জিরো।
-হ্যাঁ জিরোই। অনেক বড় জিরো। আপনার পার্সোনালিটি মোটেও তেমন না যেমনটা মানুষ জানে। আপনি একজন স্বার্থপর। ভীষণ বাজে মানুষ।
-আমরা কিন্তু স্বামী স্ত্রীর মতো ঝগড়া করছি।
-আপনার সাথে ঝগড়া করে টাইম ওয়েস্ট করতে আমার বইয়েই গেছে। আপনি এখন যান তো।
তাথৈ যেতে বলে দিলেও অভয়ের মাঝে চলে যাওয়ার কোন ইচ্ছা প্রকাশ পেলো না। অভয় বুঝতে পারছে সোজা পথে আজ সারা রাতেও তাথৈয়ের রাগ কমানো যাবে না। তাই যে বাঁকা পথটাই ধরলো। তাথৈ কাকে সবচেয়ে বেশি ভয় পায় এটা অভয় ভালো করেই জানে। তাই বলল,
-ঠিক আছে।
অভয় এত সহজেই চলে যেতে রাজি হলে তাথৈয়ের রাগ আরও বেড়ে গেল। লোকটা শুধু ফর্মালিটি পূরণ করতে এসেছিল। তার রাগ ভাঙানো এই লোকের উদ্দেশ্য নয়। দরজা পর্যন্ত চলে গিয়েও অভয় দাঁড়াল। তাথৈ এখনও নিজে নিজেই ফুঁসতে ব্যস্ত। অভয় ফিরে তাকিয়ে বলল,
-আপু যদি জিজ্ঞেস করে এত রাতে কেন চলে যাচ্ছি, তাহলে বলবো তুমি যেতে বলেছ।
কথাটা শুনে তাথৈ আঁতকে উঠল। এই লোক পাগল নাকি? আপু তাহলে তাকেও বাড়ি থেকে বের করে দিবে। আপু তো আর তাদের বিয়ের সত্যতা জানে না। তাথৈ হুড়মুড়িয়ে বিছানা থেকে উঠে গিয়ে অভয়ের সামনে এসে দাঁড়াল। চোখ পাকিয়ে বলল,
-চলে যেতে মন চাইলে যাবেন। কিন্তু যেতে যেতে আবার আমাকে ফাঁসিয়ে দিবেন কেন?
-কারণ তুমিই তো যেতে বলছো।
-আপনি নিজেও তো আর এখানে থাকতে আসেননি। তাহলে আমি যেতে বললে দোষ কী হয়ে গেল?
-আমরা দু’জনই সেম ভুলটাই করছি।
তাথৈ হুট করে বুঝে উঠতে পারল না অভয় কোন ভুলের কথা বলছে। এই মিথ্যা বিয়েতে রাজি হওয়া ছাড়া সে আর কোন ভুল করেনি।
-আমি কোন ভুল করিনি। ভুল করলে আপনি করেছেন। শুধু শুধু আমাকে দুষবেন না।
অভয় মনে মনে স্বীকার করে নিল ভুল তারই ছিল। সে-ই ভেবে নিয়েছিল তাথৈ হয়তো এই বিয়েটা থেকে মুক্তি পেতে চাচ্ছে। তাথৈ হয়তো তার সাথে থাকতে চায় না। তাথৈ কী চায় এটা জানতে না চেয়ে অভয় নিজের দিক থেকেই সবকিছু ভেবে নিয়েছে। তবে তাথৈও এখন একই ভুল করছে। সে চলে যেতে আসেনি। তাথৈয়ের রাগ ভাঙিয়ে ওকে বাড়ি নিয়ে যেতে এসেছে।
-আমি কি আজ রাতটা থেকে যাবো?
-আপনাকে এক মিনিটও সহ্য করার ধৈর্য আমার নেই। তবুও উপায় নেই। কিন্তু রাতটাই শুধু। সকালে শ্যুটিং বা যেকোনো কাজের বাহানা দিয়ে চলে যাবেন। আপু যতই সাধাসাধি করুক থাকবেন না কিন্তু।
-হুম।
তাথৈয়ের বিছানাটা অনেক ছোট। একজন থাকা যাবে। এই বিছানায় কে ঘুমাবে এটা নিয়ে তাথৈ দ্বিধাদ্বন্দে আছে। একবার মন বলছিল, অভয়কে নিচে শোয়াবে। বেডার একটু শিক্ষা হোক। পরে আবার ভাবে, উনার বাড়িতে তো আমার কোন অনাদর হয়নি। তাহলে উনাকে কীভাবে মাটিতে শুতে বলি।
——
তানিয়া অভয়ের জামাই আদরে কোন কমতি রাখছে না। এই প্রথম অভয় তার বাড়িতে এসেছে। বাবা মা বেঁচে থাকলে শ্বশুরবাড়ি গেলে যে জামাই আদর পেতো। তা তানিয়া পূরণ করে দিচ্ছে। সব ঠিক থাকলেও সকাল থেকে একটা অচেনা নাম্বার থেকে ফোনকল আসা নিয়ে তাথৈয়ের মেজাজ গরম হয়ে আছে। কল রিসিভ করার আগেই কেটে দিচ্ছে। হ্যালো বলা তো দূর গালি দেওয়ার সময়টাও দিচ্ছে না শালা। রাগ করে নাম্বার ব্লক করে দিয়েছে। তখন আবার অন্য আরেকটা নাম্বার দিয়ে কল করছে। তাথৈয়ের ফোনের রিংটোন শুনতে শুনতে তানিয়াও বিরক্ত হয়ে গেছে।
-ছাতাটা বন্ধ করে রাখ। নয়তো ডাস্টবিনে ফেলে দে। এত কে কল করছে তোকে?
-আমি নিজেও জানি নাকি। রং নাম্বার মনে হয়।
-দুনিয়ার সব রং নাম্বার তোর ফোনেই কেন ডুকে?
-দূর আপু বিরক্ত কোরো না তো। এমনিতেই মাথা গরম হয়ে আছে।
-তোর মাথা আর তুই! দেখ অভয় কোথায়। রান্না হয়ে গেছে ডাক ওকে।
-এখন পারবো না।
তানিয়া কঠিন চোখে তাকালে তাথৈ দোনোমোনো করে উঠে গেল। অভয় রুমে ছিল না। তবে তাথৈ ডাকার আগেই বারান্দা থেকে বেরিয়ে এলো। ওকে দেখে তাথৈ বলল,
-বলেছিলাম সকালেই চলে যেতে। আপনি এখনও যাননি।
-তোমার বোন রান্না করছে। না খেয়ে চলে গেলে কষ্ট পাবে।
তাথৈ অবাক হওয়ার ভান করে বলল,
-আপনি খেয়ে যাওয়ার জন্য বসে আছেন! খান তো সব ঘাসপাতা। মানুষের খাবার আপনার গলা দিয়ে নামবে?
কথা বলার মাঝখানেই আবার তাথৈয়ের ফোন বেজে উঠল। আবার সেই নাম্বারটা দেখে তাথৈ রেগে গিয়ে বলল,
-এবার তোর খবর আছে। খুব জ্বলাচ্ছিস।
অভয় চিন্তিত মুখে বলল,
-কোন প্রবলেম? কে কল করছে?
-আপনার জেনে দরকার কী? আপুর রান্না শেষ। খেয়েদেয়ে বিদেয় হোন তো। আমার জীবনে আপনিও কোন প্রবলেমের থেকে কম না।
অভয়ের হাতে ফ্যাকচার আসায় শ্যুটিং এমনিতেই কতদিন বন্ধ ছিল। এখন স্যার আবার শ্বশুরবাড়ি গিয়ে বসে আছেন। এদিকে সব চাপ নোমানের উপর দিয়ে যাচ্ছে। অভয়কে কলে ধরতে না পেরে নোমান উপায় না পেয়ে তাথৈদের বাড়ি চলে এসেছে। তাথৈ নোমানকে দেখে বলল,
-এসেছেন ভালো করেছেন। এবার সময় নষ্ট না করে আপনার স্যারকে নিয়ে বিদেয় হোন।
-আপনি ফিরবেন না ভাবী?
-না।
নোমান মনে মনে ভাবল, স্যার দুইটা দিন ধরে কী করছে এখানে থেকে? এখনও বউয়ের রাগ ভাঙাতে পারল না। এই লোকের পর্দার রোমান্স দেখে মেয়েরা পাগল হয়। বাস্তব জীবনে যার কোন কাজেই লাগাতে পারলো না। নোমান স্যারকে বোঝাতে ব্যস্ত। কিন্তু অভয়ের ধ্যান ফোনে। এর আগে তো স্যার কোনদিনও ফোনে এত মনোযোগ দেয়নি।
-স্যার, ডিরেক্টর স্যার আপনার উপর ভীষণ বিরক্ত। কাজ কতটা পিছিয়ে গেছে জানেন আপনি? আগে কিন্তু আপনি কোনদিন এমন করেননি।
-আগে আমার বউ ছিল না নোমান।
-তার মানে সব দোষ আপনি ভাবীর উপর ফেলতে চাচ্ছেন?
অভয় কঠিন চোখে নোমানের দিকে তাকাল। তাথৈয়ের প্রভাব সবার উপর পড়তে শুরু করেছে নাকি। সে বলে একটা কিন্তু সবাই বুঝে আরেকটা।
অভয় নিজেও বুঝে একদিন শুটিং বন্ধ রাখা মানেই অনেকটা লস। তাথৈ কি তার সাথে ফিরে যেতে রাজি হবে?
অভয় আর নোমান গাড়িতে বসে আছে। তাথৈ ফিরতে রাজি হয়নি। অভয় তাথৈকে জোর করতে পারত না। তাই সে একাই ফিরে যাচ্ছে। অভয় চোখ বন্ধ করে সীট হেলান দিয়ে আছে। বেচারার দিকে তাকিয়ে নোমানের মায়া হলো। ভাবীর মন এত শক্ত না হলেও পারত। বিয়ের পর স্যারের মধ্যে অনেক পরিবর্তন লক্ষ্য করেছে। স্যার হয়তো ভাবীকে ভালোবাসতে শুরু করেছে।
-স্যার।
-বলো।
-ভাবী ফিরে আসবে। এ নিয়ে বেশি ভাববেন না।
-ভাবছি না।
—-
তানিয়া এতটা তো বুঝতে পেরেছে তাথৈ কোনকিছু নিয়ে রাগ করে এসেছে। তবুও সে না বোঝার ভান করে বোনের হ্যাঁ’তে হ্যাঁ মিলিয়ে গেছে। কিন্তু অভয় একা ফিরে যাওয়ার পর তানিয়া চুপ থাকতে পারল না।
-অভয়ের সাথে যাসনি কেন তুই?
-আমি তো বলেছি আরও কয়টা দিন তোমাদের সাথে থাকবো।
-কেন থাকবি?
-মানে? আমি কি এখন নিজের বাড়িতেই থাকতে পারবো না!
-স্বামী সংসার ছেড়ে এতদিন কেন থাকবি? আমাকে কোথাও গিয়ে দুই রাতের বেশি থাকতে দেখিস?
-আমি তোমার মতো না।
-হতে হবে। কারণ তুই আমার বোন। মেয়েদের কাছে নিজের সংসারের থেকে বেশি আর কিছু গুরুত্বপূর্ণ নয়। তুই যত তাড়াতাড়ি এটা বুঝে যাবি ততই তোর জন্য ভালো হবে। পুরুষদের মন ঘুরে যেতে বেশি সময় লাগে না। তুই এত অবহেলা দিয়ে ওপাশ থেকে ভালোবাসা আশা করতে পারবি না। সম্পর্ক দু’জনের যত্নে টিকিয়ে রাখতে হয়।
চলবে
Jerin Akter Nipa
#যতনে_রাখিবো
২৪
বোনের বলা কথাগুলো পুরোটা দিনই তাথৈয়ের মনে খচখচ করতে থাকল। সম্পর্কটাকে কি আরেকটা সুযোগ দিবে? কিন্তু সে সুযোগ দিলে কী হবে, অভয় তো এরকমটা চায় না। সবথেকে বড় কথা তাদের মধ্যে কোন ভালোবাসা নেই। ভালোবাসা ছাড়া সম্পর্ক বয়ে বেরিয়ে লাভ কী? একটা সময় তা শেষ হয়েই যাবে। লোকটার যদি তাকে ফিরিয়ে নেওয়ারই ইচ্ছে থাকত তাহলে পুরোটা দিনে একবারও কল করলো না কেন? সকালে যাওয়ার পর যেন তার কথা ভুলেই গেছে। তাথৈ পুরোটা বিকেল অপেক্ষা করে থেকেছে এই হয়তো অভয়ের কল আসবে। সন্ধ্যার পরে ধৈর্য হার মেনেছে। আপু তো কিছু জানে না। তাই ইমোশনাল কথাবার্তা বলে তার মন ঘোরাতে চেয়েছিল। রাত বারোটার সময় গাড়ির শব্দ পেয়ে তাথৈ হুড়মুড়িয়ে উঠে বসল। তার মন বলছে অভয়ই এসেছে। তাথৈ হয়তো এজন্যই জেগে ছিল। আপু বা দুলাভাইয়ের ঘুম ভাঙার আগে তাথৈ দরজা খুলে বেরিয়ে পড়লো। সত্যিই অভয়ই এসেছে। মুখের দিকে তাকিয়েই বোঝা যাচ্ছে বেচারার উপর দিয়ে পুরোটা দিন কত ধকল গেছে। তাথৈকে দেখে অজান্তেই অভয়ের মুখে হাসি ফুটে উঠল।
-স্যরি। যাওয়ার পর থেকে কল করতে পারিনি। শুটের মাঝে দম ফেলার সময় ছিল না বিশ্বাস করো।
-আপনি বাসায় যাননি?
-না। ভেবেছিলাম তোমাকে নিয়ে ফিরবো। যদিও জানি না তুমি যাবে কি-না।
-জানেন না তাহলে এসেছেন কেন?
অভয় প্রশ্নটা বুঝলো না। তাথৈ মনে মনে বলছে,
-আপনি শুধু অনুরোধই করতে পারবেন। অধিকার খাটাতে চাইবেন না। আমার বউকে আমি নিয়ে যাবোই। জোর গলায় এই কথাটা কেন বলতে পারেন না?
-তাথৈ প্লিজ ফিরে চলো। আমার ভুল হয়ে থাকলে আমি আবারও তোমার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি।
-আপু দুলাভাই ঘুমিয়ে আছে। এখন যেতে হলে সবার ঘুম ভাঙাতে হবে।
-কারো ঘুম ভাঙাতে হবে না। তোমাকে না পেয়ে সকালে এমনিতেই বুঝে যাবে।
অভয়ের এই আইডিয়াটা তাথৈয়ের পছন্দ হয়েছে। আপুকেও একটু টাইট দেওয়া যাবে। স্বামী সংসার নিয়ে অনেক জ্ঞান দিয়েছে।
-ঠিক আছে। একটু দাঁড়ান।
বলেই তাথৈ আবার দৌড়ে ভেতরে চলে গেল। একটা তালা হাতে ফিরে এসে বাইরে থেকে গেটে তালা লাগিয়ে দিল।
-এখন আর চোর ডাকাতের ভয় থাকবে না।
সারাদিনের ক্লান্তিতে গাড়িতে বসেই অভয়ের চোখ লেগে আসছিল। তাথৈ তা লক্ষ্য করেছে। বলবে না বলবে করেও বলে ফেলল,
-আপনার কি ঘুম পেয়েছে?
অভয় তাথৈয়ের দিকে তাকিয়ে সামান্য একটু হেসে জবাব দিল।
-হুম।
-তাহলে ঘুমিয়ে পড়ুন। বাসায় পৌঁছে গেলে ডেকে দিবো।
তাথৈ বলা শেষ হওয়া মাত্রই অভয় দুজনের মাঝের দূরত্ব কমিয়ে কাছে এসে তাথৈয়ের কাঁধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে নিল।।তাথৈ মোটেও এটা ভেবে বলেনি। সে ঘুমিয়ে পড়তে বলেছে ঠিক। কিন্তু তার কাঁধে না। তাথৈয়ের হতভম্ব ভাব কাটিয়ে উঠার আগেই অভয় বলল,
-গাড়ির স্পিডটা একটু কমিয়ে চালাতে বলো।
—-
দু’জনের সম্পর্ক এখন কোন মোড়ে আছে এটা তাথৈ জানে না। তবে আগের মতোও যে নেই এটা খুব করেই বুঝতে পারছে। অভয় যতটা সম্ভব তার খেয়াল রাখে। শুটিংয়ের ফাঁকে ফাঁকে কল করে খোঁজ খবর নেয়। তাথৈও অভয়ের জন্য রান্নাবান্নার কাজটা কিছুটা আয়ত্তে নিয়ে এসেছে। এখন সে মোটামুটি অনেককিছুই রাঁধতে পারে। শুধু দিনে কয়েকবার অচেনা নাম্বার থেকে কল আসা ছাড়া জীবনে কোন সমস্যাই ছিল না। এই কল করা লোকটাকে তাথৈ এখনও খুঁজে বের করতে পারেনি। অভয়ের কল ভেবে তাথৈ ছুটে এসে ফোন হাতে নিয়ে দেখল আজকেও একটা নতুন নাম্বার। মানুষের সহ্যের একটা সীমা থাকে। তার সহ্যের সীমা কবেই ভেঙে গেছে।
-আজ তোকে কী করি দেখ তুই।
কল রিসিভ করেই তাথৈ গালাগালির বন্যা বইয়ে দিচ্ছে। কথা না বল। কিন্তু গালি গুলো তো কানে ঢুকবে।
-অসভ্য জানোয়ার লুচ্চা। কল দিয়ে কথা বলিস না কেন? ওই শালার বাচ্চা, কথা বল। আজ তুই কথা না বললেও তোর মুখ থেকে কথা টেনে বের করে নিয়ে আসবো। সাতটা নাম্বার ব্লক করেছি। গালি শুনতে এত ভাল্লাগে তাহলে শোন গালি। কল কাটিস না।
-আপনার কন্ঠটা বেশ সুন্দর। সুন্দর কন্ঠে গালিও প্রশংসার মতোই লাগে।
তাথৈকে অবাক করে দিয়ে ফোনের ওপাশের লোকটা আজ প্রথম কথা বললো। এতগুলো গালি শুনেও কেমন করে কথা বলছে। কী পরিমাণ নির্লজ্জ লোক এটা!
-কী বেহায়ার বেহায়া রে তুই। তোকে আল্লাহ একফোঁটা শরমও দেয়নি?
-জানেন আগে আমি এতটা বেহায়া ছিলাম না। কিন্তু এখন আপনার জন্য হয়েছি।
ছেলে হোক বা লোক। তাথৈয়ের কিছু যায় আসে না। সে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বলল,
-তুই জন্ম থেকেই নির্লজ্জ বেহায়া। আমাকে কেন জ্বালাচ্ছিস? তোর নাম্বার ব্লক করতে করতে আমি ক্লান্ত। তুই সিম চেঞ্জ করে ক্লান্ত হোস না?
-আপনার কন্ঠ শুনলে আমার সব ক্লান্তি কেটে যায়।
-এই তুই কে রে? সাহস থাকলে সামনে এসে দেখা দে। দেখি তুই কোন বাপের বেটা।
-যেদিন আপনি মন থেকে আমাকে দেখতে চাইবেন সেদিন আমি আপনার সামনে আসবো।
এই বেহায়ার সাথে কথা বলে নিজের এনার্জি নষ্ট করছে বুঝতে পেরে তাথৈ কল কেটে দিয়ে নাম্বার ব্লক করে রাখল। সে আর এই সিমটাই চালাবে না। এই ফোন কলের চক্করে পড়ে তাথৈয়ের পুরোটা সন্ধ্যা খারাপ গেল। রাতে অভয় বাসায় ফিরে তাথৈয়ের মুখ থেকেই বুঝে ফেলল কোন কারণে হয়তো তাথৈয়ের মুড অফ। রুমে এসে শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে অভয় জিজ্ঞেস করল,
-কোন সমস্যা তাথৈ?
-না।
-বাসায় একা বোর হচ্ছিলে?
-কিছুটা।
-আমি বেরিয়ে যাওয়ার পর তুমি চাইলে আমার বোনদের ওখানে নইলে তোমার বোনের কাছেও যেতে পারো।
-হুম। আপনি কি এখন খাবেন? আমি আপনার ডায়েটিশিয়ানের থেকে জেনে সে অনুযায়ীই আপনার জন্য রান্না করেছি।
-তোমার এত কষ্ট করার দরকার ছিল না।
-আপনি না চাইলে আর রাঁধব না।
অভয় তাথৈয়ের কথা ভেবেই বলেছে। তাথৈ যে রান্না জানে না এটা অভয়ও জানে। শুধু শুধু তার জন্য কষ্ট করবে ভেবেই কথাটা বলা। কিন্তু তাথৈ তার এই কথাটাও ভুল ভাবে নিয়েছে। এই মেয়ের অভিমান এত বেশি কেন? ছোট ছোট কথাতেও অভিমানের পাল্লা আকাশ ছুঁয়ে যায়। তাথৈ রাগ করেছে বুঝতে পেরে অভয় মুচকি হেসে বলল,
-কেউ আমার জন্য রান্না করলে আমি বরং খুশিই হবো। কিন্তু সেই মানুষটার কষ্টের কথা ভেবেই না করেছিলাম।
-আপনাকে এত ভাবতে কে বলেছে?
অভয় খাওয়ার সময় তাথৈ প্রতি বেলা ওর সামনেই বসে থাকে। নিজে কখনও অভয়ের সাথে বসে খায় না। কিন্তু মনোযোগ দিয়ে অভয়কে খেতে দেখে। প্রথম কয়েকদিন অভয় একসাথে বসে খাওয়ার কথা বলেছিল। কিন্তু তাথৈয়ের নাকি কারো সামনে বসে খেতে লজ্জা লাগে। অভয় লক্ষ্য করেছে সে রান্নার সামান্য প্রশংসা করলেও তাথৈ কতটা খুশি হয়ে যায়।
-একটা বউ থাকার মনে হয় এটাই সুবিধা।
তাথৈ গালে হাত রেখেই জিজ্ঞেস করল,
-কেমন সুবিধা?
-বাড়ি ফিরে খাবার অর্ডার দিয়ে বসে অপেক্ষা করতে হয় না। চাওয়ার আগেই খাবার চোখের সামনে হাজির হয়ে যায়।
-তবুও তো পুরুষ মানুষ নারীদের এটা বলতে ভুলে না যে, সারাদিন বাড়িতে কী কাজ করো তুমি। কাজ তো আমরা পুরুষরা করি।
-এই কথা অন্তত আমি বলবো না। কারণ আমি জানি মহিলারা বাড়িতে যা যা কাজ করে তা আমরা পুরুষরা একদিনও ভালোভাবে করতে পারবো না।
-বাহ! তাহলে তো বলতে হবে আপনার বউয়ের কপাল ভালো।
কথাটা মুখ ফসকেই বলে ফেলেছে তাথৈ। অভয়ও এই কথা শুনে তাথৈয়ের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হাসল। তাথৈ জিভ কামড়ে মনে মনে বলল,
-তোর ঠোঁট সেলাই করবো আমি৷ লজ্জা পাইয়ে দিলি তো!
—-
প্রতিবার আউটডোরে শ্যুট থাকা নিয়ে অভয়ের কোন আপত্তি থাকে না। তার বরং ভালোই লাগে। প্রতিটা মুভির জন্য নতুন নতুন জায়গা বা দেশ ঘুরে আসে। অভয়ের অধিকাংশ মুভির প্লটই দেশের বাহিরের কাহিনি নিয়ে রচিত। এই মুভির দেশের অংশের শুটিং শেষ। এবারও তাকে কয়েক মাসের জন্য বাইরে যেতে হবে। কিন্তু প্রতিবারের মতো এবার তার মন টানছে না। তার দুই বোনই তাথৈকে নিজেদের কাছে নিয়ে রাখার জন্য এখন থেকেই তাড়া দিচ্ছে। মিম অধৈর্য বান্দা দুই ঘন্টা পরপর কল দিয়ে জিজ্ঞেস করবে,
-ভাইয়া কবে যাচ্ছ তুই? ভাবী কিন্তু আগে আমার এখানে আসবে তুমি এটা আপুকে বলে দিও।
অভয় মনে মনে ভাবছে,
-আমাকে তো আগে যেয়ে নিতে দে। দুইটা দিনই বাকি আছে। এই সময়টুকু বউয়ের সাথে কাটাতে দিবি তো নাকি?
অভয় চলে গেলে তাথৈয়ের যেন কোন অসুবিধা না হয় তাই সে তার ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড সব তাথৈয়ের হাতে তুলে দিল। তাথৈ চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করল,
-আমাকে এসব কেন দিচ্ছেন?
-আমি চলে গেলে তোমার প্রয়োজন পড়বে।
তাথৈ মজা করেই বলল,
-আমার হাতে যে মাতব্বরি দিয়ে যাচ্ছেন, আমি যদি আপনার সব টাকা খরচ করে ফেলে আপনাকে ফতুর বানিয়ে ফেলি!
-তুমি কেন, তোমার মতো চার পাঁচজন মিলেও শেষ করতে পারবে না। সো ডোন্ট ওয়ারি। যত খুশি খরচ কোরো।
তাথৈ মনে মনে গলে গিয়ে বলল,
-হায় ডায়লগ তো এমন মারছে ইচ্ছে করছে দু’হাতে সিটি মারি।
যাবার জন্য অভয়ের গোছগাছ খুবই কম। তবুও যতটুকু ছিল তাথৈ হাতে হাতে সাহায্য করেছে। তার বোনেরাও তাকে বিদায় দিতে চলে এসেছে। তাথৈয়ের পরিবারের সবাইও এসেছে।
অভয় গাড়িতে বসে আছে। নোমান স্যারের মুখ দেখেই বুঝতে পারছে বিয়ের পর সবার জীবনেই কিছুটা হলেও পরিবর্তন আসে। এই যেমন স্যারের এসেছে। নোমানের এখনও মনে আছে গতবার ব্যাংকক যাওয়ার সময় নোমানের মুখ অন্ধকার হয়ে ছিল। তার বড় বোনের মেয়ে হওয়ায় সে পরিবারের সাথেই থাকতে চেয়েছিল। অভয়ও তাকে থেকে যেতে বলেছিল। কিন্তু নিজের কাজ আর স্যারকে একা ছাড়া নোমানের পক্ষে সম্ভব না।
-স্যার, গতবার আপনি আমাকে থেকে যেতে বলেছিলেন। এবার কি আমি আপনাকে এই কথাটা বলবো?
-আমি থেকে গেলে মুভির ইন্টারভালের পরের অংশে কি দর্শক তোমাকে হিরো হিসেবে দেখবে?
-আমার কী মনে হচ্ছেন জানেন স্যার? এর পর আপনি যে মুভিগুলো করবেন সেসবের শুটিং দেশেই হবে।
-কেন?
-কারণ আপনি ভাবীকে ছাড়া বেশিদিন দূরে থাকতে পারবেন না। আমার মন বলছে এবারই আপনি যত দ্রুত সম্ভব কাজ শেষ ফিরে আসতে চাইবেন।
-নোমান তুমি কি ইনডিরেক্টলি এটা বলতে চাচ্ছো, তোমারও বিয়ের বয়স হয়েছে? দেশে এসেই তোমারও একটা ব্যবস্থা করতে হবে?
বিয়ের কথা শুনে নোমান দুই হাত জড়ো করে বলল,
-মাফ করেন স্যার। আমার জীবনের সুখের মেয়াদ এত তাড়াতাড়ি শেষ করতে চাইবেন না।
চলবে
Jerin Akter Nipa