#যতনে_রাখিবো
৩৫
সকলের দৃষ্টি তাদের উপরে। চোখ বড়ো বড়ো করে একেকজন তাদের দেখছে। কেউ কেউ তো হৈহৈ করে উঠেছে। তাথৈয়ের এবার সত্যিই লজ্জা লাগছে। নিচু গলায় ফিসফিস করে বলল,
-এবার নামিয়ে দিন প্লিজ।
-কেন?
-সবাই দেখছে।
-দেখুক।
-আমার লজ্জা লাগছে।
তাথৈয়ের চেহারা সত্যিই লজ্জায় রাঙা হয়ে গেছে। অভয় তা দেখে মুচকি হেসে বলল,
-মিসেস অভয় খান লজ্জাও পায়!
লোপাই ওদের কাছে সবার আগে এগিয়ে এলো। চিন্তিত কন্ঠে বলল,
-তোমরা এভাবে এসেছ কেন? না মানে, তাথৈয়ের কিছু হয়েছে?
-পায়ে সামান্য ব্যথা পেয়েছে। ওকে একটু বসার জায়গা দাও।
-হ্যাঁ হ্যাঁ, আমার সাথে আসো। এখানে অনেক ভীড়। ওদিকটায় চলো।
অভয় তাথৈকে সোফার উপর বসিয়ে দিয়ে নিজে নিচে বসে ওর পা দেখতে লাগল। পা সামান্য ফোলে গেছে। মচকে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। ব্যথা কেমন পরীক্ষা করার জন্য পা ধরতেই তাথৈ কাতর শব্দ করল। অভয় ওর মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
-বেশি ব্যথা লাগছে?
-উঁহু। অল্প।
লোপাও এতক্ষণ এখানেই দাঁড়িয়ে ছিল। অভয় উঠে দাঁড়িয়ে লোপাকে বলল,
-আমরা বেশিক্ষণ থাকতে পারব না লোপা। তাথৈকে নিয়ে হসপিটালে যেতে হবে।
-ঠিক আছে। তোমরা এসেছ আমি এতেই খুশি। আমি এক্ষুনি কেক কাটার কথা এনাউন্স করে দিই। তাহলে একটু পরেই তোমরা বেরোতে পারবে।
লোপার কাজিন রিয়া লোপাকেই খুঁজছে। অভয়কে ওর বউয়ের সাথে দেখে নিশ্চয় তার বোনের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। অভয়ের জন্য লোপার পাগলামির কোন সীমা নেই। আজকের এই পার্টি রাখার পেছনেও লোপার বিশেষ একটা উদ্দেশ্য আছে। চারদিকে চোখ ঘোরাতে ঘোরাতে রিয়া বলল,
-সাইকোটা কি অভয়ের বউয়ের মার্ডার করে ফেলেছে! কোথাও দেখছি না কেন?
ঝড়ের গতিতে লোপা এসে রিয়ার হাত থেকে ড্রিঙ্কটা নিয়ে নিজে এক ঢোকে খেয়ে ফেলল। ওকে এমন ভয়ঙ্কর রুপে দেখে রিয়া রয়েসয়ে বলল,
-কুল ব্রো। তোমাকে দেখে কিন্তু আমার ভয় লাগছে।
-ওই মেয়েটাকে আমি ছাড়ব না। ওর মধ্যে এমন কী আছে যা আমার মধ্যে নেই? আমার থেকে বেশি সুন্দরী ও? আমার থেকে বেশি হট নাকি ফিগার ভালো? অভয় কেন ওই বস্তির মেয়েটাকে মাথায় তুলে রাখবে?
রিয়া লোপার হাত চেপে ধরে বলল,
-ধীরে বলো। এখানে অনেক মিডিয়ার লোক আছে।
-আমি কাউকে ভয় পাই না।
-সেটা আমি জানি। কিন্তু এখনই মাথা গরম করে ফেললে তোমার মাস্টার প্ল্যানের কী হবে?
লোপা মাথা ঠান্ডা রাখতে পারছে না। অভয়কে ভালোবাসতে সে কোন কমতি রাখেনি। তবুও কেন অভয় তাকে গ্রহণ করলো না? নিজের অপমান লোপা কখনোই ভুলে যায় না।
-প্রতিশোধ তো আমি নেবো। আর এমন প্রতিশোধ নেবো যা অভয় চাইলেও ভুলতে পারবে না।
-হুম। তার জন্য আগে কী করতে হবে?
-মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে।
—-
অভয় তাথৈয়ের কাছ থেকে এক সেকেন্ডের জন্যেও সরছে না। তাথৈ বিরক্তি দেখিয়ে বলল,
-আপনি কি আমাকে পাহারা দিচ্ছেন? আমি ছোট বাচ্চা যে হারিয়ে যাব?
-ছোট বাচ্চারাও ঠিকঠাক হাঁটতে পারে। তোমার মতো যেখানে সেখানে পড়ে যায় না।
তাথৈ মুখ মোচড়াল। কেক কাটার জন্য সবাই একসাথে হলেও অভয় যায়নি। তাথৈ বলল,
-আপনার এক্স কেক কাটবে। ওখানে যাচ্ছেন না কেন? খামোখা উনি ভাববেন আমি আপনাকে যেতে দিচ্ছি না।
তাথৈয়ের কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই লোপা এসে ওদের সামনে দাঁড়াল। মুখ গোমড়া করে বলল,
-আমি কেক কাটার সময় তোমরা কি থাকবে না?
-তাথৈ যেতে পারবে না।
-তুমি এসো।
অভয় না করার আগেই লোপা তাথৈকে বলল,
-অভয় আমার সাথে গেলে তুমি কি মাইন্ড করবে তাথৈ?
কালনাগিনীটাকে তাথৈ দু’চোখে দেখতে না পরলেও মুখের উপর তো বলা যায় না। তাই আপত্তি থাকা স্বত্বেও তাথৈ হেসে বলল,
-না না। মাইন্ড করবো কেন?
অভয় কঠিন চোখে তাথৈয়ের দিকে তাকাল। তাথৈয়ের সত্যিই কি কোন আপত্তি নেই? লোপা তাথৈয়ের সামনে থেকে অভয়ের হাত ধরে নিয়ে চলে গেল। ওরা যাওয়ার পর তাথৈ নিজেকে গালি দিল।
-তুই স্ত্রী নামের কলঙ্ক তাথৈ। নিজের বরকে অন্য একটা মেয়ের হাতে তুলে দিলি! বুক কাঁপলো না তোর?
কেক কাটা শেষ হতেই অভয় তাথৈয়ের কাছে চলে আসতে চাচ্ছিল। কিন্তু সাংবাদিকেরা ঘিরে ধরলে তা সম্ভব হলো না। বাধ্য হয়ে লোপার সাথে পোজ দিতে হলো। লোপার পরে দেখা গেল আরও অনেকের সাথেই ছবি তুলতে হয়েছে। অভয়কে যখন রিপোর্টাররা ঘিরে রেখেছে এই ফাঁকে লোপা ভীড় কেটে বেরিয়ে এলো। তার প্ল্যান অনুযায়ী রিয়া আগে থেকেই তৈরি হয়ে ছিল। লোপা এসে তাড়াহুড়ো চালিয়ে দিয়ে বলল,
-যেমনটা বলেছিলাম করেছিস তো?
-সব রেডি। তুমি চিল মুডে থাকতে পারো।
ব্যস্ত হাতে একটা জুসের গ্লাসে লোপা কিছু মিশিয়ে দিল। জিনিসটার পরিমাণ বেশি হয়ে গেছে দেখে রিয়া বলল,
-এত দিলে কেন? সেন্স লেস হয়ে গেলে পুরো প্ল্যানটাই বরবাদ হয়ে যাবে।
-আজকের দিনটা অভয়ের জন্য বরবাদি ডেকে আনবে।
রিপোর্টারদের থেকে ছাড়া পেয়ে অভয় স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল। তাথৈ নিশ্চয় এতক্ষণে রেগে আগুন হয়ে আছে। অনেকটা সময় ধরে একা আছে। অভয় তাথৈয়ের কাছে যাবে তার আগে আবার লোপা এসে বাধা সৃষ্টি করল।
-অভয় তোমার জন্য ফ্রেশ অরেঞ্জ জুস এনেছি। তুমি তো কিছুই খাওনি। জুসটা প্লিজ খেয়ে নাও।
-এখন ইচ্ছে করছে না লোপা।
-ইচ্ছে না করলেও খেতে হবে। তোমাকে এরকম শুধু মুখে আমি যেতে দিব নাকি?
তাথৈ একা আছে। অভয় আর তর্ক করলো না। লোপার হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে সবটুকু জুস খেয়ে ফেলল। এটা দেখে লোপা মনে মনে উল্লাসে ফেটে পড়ল। জুসটা খাওয়ার সাথে সাথেই অভয়ের মাথা হালকা চক্কর দিয়ে উঠল। চোখের সামনের সবকিছু কেমন ঝাপসা লাগতে শুরু করেছে। অভয় টলে উঠলে লোপা ওকে ধরে ফেলে বলল,
-কী হয়েছে অভয়?
-বুঝতে পারছি না লোপা। মনে হলো মাথাটা যেন ঘুরে উঠল।
লোপা মনে মনে বলল,
-এখন তো শুধু মাথা ঘুরছে একটু পরে তোমার সাথে আরও কী কী হবে তা তুমি কল্পনাও করতে পারছো না।
অভয় নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। লোপা ওকে ধরে ভীড় থেকে আড়ালে নিয়ে চলে গেল।
এদিকে অভয়ের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে তাথৈ অধৈর্য হয়ে পড়েছে।
-অসহ্য! উনি এখনও আসছেন না কেন? নাকি এক্সকে পেয়ে বউকে ভুলে গেছে? ভুল আমারই। কেন উনাকে যেতে দিলাম।
পায়ে ব্যথা নিয়েই তাথৈ উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। আশেপাশে চেনাজানা কাউকেই দেখতে পেলো না। হাঁটতে সমস্যা হলেও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কষ্ট করে চলতে হচ্ছে। তার বরটা যে এমন দায়িত্ব জ্ঞানহীন হবে কল্পনাও করেনি।
-যদি খালি ওই কালনাগিনীর সাথে আপনাকে পেয়ে যাই, তাহলে আজ এমন ঝগড়া করবো! আপনি জানবেন ঝগড়া কাকে বলে। কত প্রকার ও কী কী।
হাঁটতে গেলে পায়ে ভালোই ব্যথা লাগছে। তবুও দশ মিনিট ঘুরে অভয়কে খুঁজল। এই লোক গেল কোথায়? হাওয়া হয়ে গেল না তো? পার্টি যেহেতু লোপার ফার্ম হাউসে হচ্ছে তাই লনে না খুঁজে ভেতরে গিয়ে খুঁজবে কি? হতে পারে ওয়াশরুমে গেছে। তাথৈয়ের হঠাৎ খেয়াল হলো সে অভয়কে খুঁজছে কেন? কল করে জিজ্ঞেস করে নিলেই তো পারে অভয় কোথায় আছে।
-তুই একটা গাধার বাচ্চা তাথৈ। মোবাইল ফোনের যুগে তুই গাধামি কেন করছিস?
পার্স থেকে ফোনের বের করে অভয়ের নাম্বারে ট্রাই করলে রিং হয়ে কেটে গেল।
-এই লোকের কপালে আজকে শনি টেনেছে। পৃথিবীতে বউ যে কী জিনিস উনি এখনও জানেননি। তাই তো কল না তোলার সাহস করছেন।
—–
লোপা অভয়কে তার বেডরুমে নিয়ে এসেছে। ওদের সাথে রিয়াও আছে। অভয় এখন নিজের হুঁশে নেই। লোপা অভয়কে বেডের উপর ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো। রিয়াকে বলল,
-ফোন বের কর। সবকিছু ভিডিও করবি। শেষে কিছু পিকও নিস।
-হুম। তুমি তোমার পজিশনে চলে যাও বাকিটা আমার উপর ছেড়ে দাও।
মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি নিয়ে লোপা বেহুশ হয়ে পড়ে থাকা অভয়ের দিকে তাকাল। মনে মনে বলল,
-তুমি আমাকে নিজের কাছে ঘেঁষতে দিতে না। আজ কী হলো অভয়? এখন আমি তোমার সাথে যা যা করবো তুমি এর প্রতিবাদ করবে না? তোমার সাথে কী হয়েছে তোমার বউ জানবে না। কিন্তু তোমার বউ আমার সাথে তোমার সুখকর মুহূর্তের ভিডিও ছবিগুলো দেখে তোমার সাথে থাকবে তো? তোমার বউ ধরলাম তোমাকে ক্ষমা করে দিবে। কিন্তু তোমার ফ্যানস? কতজন তোমাকে বিশ্বাস করবে? আমাকে রিজেক্ট করে তুমি জীবনের সবথেকে বড় ভুলটা করেছ অভয়।
চলবে
Jerin Akter Nipa
#যতনে_রাখিবো
৩৬
অভয়ের ফোন বেজে উঠলে রিয়া ঘাবড়ে গিয়েছিল। অভয় যদি জেগে যায়! তখন তাদের জীবনে কেয়ামত নামিয়ে আনবে।
-ফোনটা সাইলেন্ট করো তাড়াতাড়ি। অভয় যদি উঠে যায়!
রিয়াকে ভয় পেতে দেখে লোপা ফিচেল হাসল। অভয়ের প্যান্টের পকেট থেকে ফোন বের করে স্ক্রিনে তাথৈয়ের নাম দেখে বলল,
-হিরোর বউ! কী করা যায় একে?
-কিছু করতে হবে না। ফোন অফ করে রাখো।
-তুই কি আমার বোন! এত ভয় পাচ্ছিস কেন? আমি সাথে থাকতেও তোর ভয় পাওয়ার কারণ কী?
-অভয় সেন্সে এসে গেলে আমাদের খবর আছে।
-তোর মনে হয় কাল সকালের আগে অভয়ের ঘুম ভাঙবে?
-তাথৈ এখানে চলে এলে?
-আসবে না। তাথৈ জানবেই না অভয় এখানে আছে।
লোকটাকে সামনে পেলে ফোনটা উনার নাকেই ছুঁড়ে মারবে তাথৈ। এতবার কল করছে তুলছে না কেন? কার সাথে এত ব্যস্ত!
লোপা এক এক করে অভয়ের শার্টের বোতাম খুলতে লাগলে রিয়া বলল,
-কী করছো তুমি!
-ছবিগুলো রিয়েলিস্টিক বানাতে হলে এটা করা জরুরি। তাছাড়া অভয়ের শার্ট লেস সিন থাকা মানেই পিকচার হিট।
-আগে জানতাম ছেলেরা মেয়েদের ইজ্জতে হাত দেয়। তোমাকে দেখে পুরোটাই উল্টো লাগছে। তুমি ভীষণ ডেঞ্জারাস মেয়ে মানুষ। মুভিতে তুমি হিরোইনের রোল প্লে করলেও বাস্তবে পুরোই ভিলেন।
-প্রশংসা করলি নাকি অপমান?
-তোমাকে অপমান করার দুঃসাহস আমার নেই বোন।
-ঠিক আছে৷ এখন পকপক বন্ধ করে ছবি তোল। ছবির কোয়ালিটি যেন ভালো আসে। অভয় যে ঘুমিয়ে আছে এটা যেন বোঝা না যায়। এমন বোঝাবি ও নিজে আমাকে আদর করছে।
পায়ে ব্যথা নিয়ে তাথৈ আর হাঁটতে পারছে না। অভয়কে খোঁজা বন্ধ করে সে কি গাড়িতে গিয়ে বসে থাকবে? লোকটার সময় হলে নিজেই আসবে। কিন্তু তাথৈয়ের মন মানছে না। অভয় এতটা দায়িত্বজ্ঞানহীন কখনোই ছিল না। সে পার্টিতে একা আছে জেনেও অভয় কারো সাথে চলে যাবে না। তাথৈয়ের এখন টেনশন হচ্ছে। মানুষটা কোথায় গেল। রুম গুলোতে খুঁজে দেখবে?
-না, উনি রুমে এসে কী করবেন? পার্টি তো বাহিরে হচ্ছে। উনি নিশ্চয় পার্টিতেই আছেন। আমাকে না পেয়ে হয়তো খুঁজছেন।
রিয়া এক এক করে অনেক ছবিই তুলেছে। ছবি গুলো সে এমন কায়দায় তুলেছে যাতে মানুষের আঙুল অভয়ের দিকে আগে উঠে। লোপা বলল,
-ভালো করে তুলেছিস তো?
-এই ছবিগুলো দেখে তুমি আমাকে বেস্ট ফটোগ্রাফারের পুরষ্কার দিতে চাইবে।
লোপা অভয়ের বুকে মাথা রেখে শুয়ে আঙুল দিয়ে আঁকিবুঁকি করতে করতে বলল,
-তোমার বুকে মাথা রেখে কী যে প্রশান্তি লাগছে বলে বোঝাতে পারবো না। কী করবো বলো? তুমি তো আমার জন্য আর কোন পথ খোলা রাখোনি। তুমি আমাকে তোমায় ভালোবাসার সুযোগ দাওনি। তাই তো আমাকে এসব করতে হয়েছে।
লোপার এই রুপ রিয়ার কাছেও অজানা ছিল। লোপাকে যত দেখছে ততই রিয়ার ভীতি বেড়ে যাচ্ছে। লোপা স্বাভাবিক না। অভয়কে নিয়ে ওর সব কাজই অস্বাভাবিক মনে হয়। বিড়বিড় করে রিয়া বলল,
-শালি সত্যিই একটা সাইকো। কেউ কাউকে পাওয়ার জন্য এতটা বেপরোয়া হতে পারে? অভয়ের ক্যারিয়ার নষ্ট হলে ওর ক্যারিয়ারও যে ঠিক থাকবে না এটা কি বুঝতে পারছে না।
হঠাৎ করে দরজা খুলে কেউ রুমে ঢুকে পড়লে রিয়া আঁতকে উঠে মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইল। বাইরের ঝলমলে আলো থেকে এসে সহজেই রুমের ভেতরটা দেখতে পারল না তাথৈ। ড্রিম লাইটের ফ্যাকাসে আলোয় তার কাছে সবটা অন্ধকারই মনে হচ্ছে। তাথৈ এখানে চলে আসবে লোপা কল্পনাও করেনি। আস্তে আস্তে অন্ধকার চোখ সয়ে এলে সবার আগে সামনে দাঁড়ানো রিয়াকে দেখতে পেলো। রিয়া এঘরে থাকবে নাকি দৌড়ে পালিয়ে যাবে বুঝে উঠতে না পেরে ঠাঁই দাঁড়িয়েই রইল। তাথৈ তখনও বেডের দিকে খেয়াল করেনি।
-সরি। ভুল করে চলে এসেছি।
রিয়া স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো। এই মেয়ে কি অন্ধ? নাকি রাত কানা? অন্ধ হোক আর রাত কানা তারা তো বেঁচে গেলো। তাথৈ ভুলে এখানে চলে এসেছে বুঝতে পেরে সরি বলে চলে যেতে নিচ্ছিল। এমনিতে তো পা অচল তার উপর কোনকিছুর সাথে ধাক্কা খেলে মরেই যাবে। তাই ফোনের ফ্ল্যাশ লাইট অন করে ভুলবশত রিয়ার মুখের দিকে ধরে ফেলেছিল। কিন্তু রিয়াকে ঘামতে দেখে সন্দেহ হলো। এই মেয়ে অন্ধকারে একা এই রুমে কী করছে? এখানে কি আরও কেউ আছে? তাথৈ রুমটা দেখার জন্য আলো ফেললে বেডের উপর চোখ যেতে সে স্থির হয়ে গেল। অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে দৃশ্যটা দেখছে। মুহূর্তেই চোখ ভরে জল এসে গাল বেয়ে পড়তে লাগল। হাত-পা কাঁপছে তার। কম্পিত কন্ঠেই অভয়ের নাম ধরে ডাকল।
-অভয়! আ-আপনি…
কিছুই বলতে পারল না তাথৈ। মনে হচ্ছে তার পৃথিবীটাই মিথ্যা হয়ে গেছে। লোপা অভয়ের বুকের উপর থেকে মাথা তুলে তাথৈকে দেখল। তাথৈ কি সবটা বুঝে গেছে?
-তাথৈ! তুমি এখানে?
ঘৃণায় তাথৈ লোপার দিকে তাকাচ্ছেও না। চিৎকার করে অভয়কে ডাকতে লাগল। লোপা বুঝতে পারল তাথৈ পুরো ঘটনাই ভুল বুঝেছে।
-অভয় তোমাকে ভালোবাসে না তাথৈ। ও সবসময় আমাকেই ভালোবাসতো। তোমাকে তো ও বাধ্য হয়ে বিয়ে করেছে।
রিয়া অবিশ্বাস্য চোখে নিজের বোনকে দেখে যাচ্ছে। কত বড় ক্রিমিনাল হলে এরকম একটা সিচুয়েশনেও এত সহজ ভাবে মিথ্যা বলতে পারে! তাথৈ চিল্লিয়ে বলে উঠল,
-আপনি চুপ করুন। আমি এই কথাটা উনার মুখ থেকে শুনতে চাই। উনি আমাকে চলে যেতে বললে বিনা বাক্য ব্যয়ে আমি এখান থেকে চলে যাব।
-অভয় তোমাকে কিছুই বলবে না।
-কেন বলবে না?
-কারণ তোমার প্রতি অভয়ের দয়া জন্মেছে। তাই তো তোমাকে ছাড়তে পারছে না।
রিয়ার হাত তালি দিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে, বাহ বোন বাহ! তোর কাছে পৃথিবীর সব মেয়ে দুধের শিশু। কী সুন্দর নাটক চালিয়ে যাচ্ছিল। তাথৈ কাঁদতে কাঁদতে নিচে বসে পড়ল। অভয় কেন তার সাথে এমন করলো? তাথৈকে এত সহজে বোকা বানাতে পেরে লোপা শয়তানি হাসি দিচ্ছে। মেয়েটা এত বোকা! কান্না থামিয়ে তাথৈ রিয়ার দিকে তাকালো। এক সেকেন্ড। অভয় যদি লোপার সাথে থাকতো তাহলে নিশ্চয় এই মেয়েটাকেও রুমের ভেতর রাখত না। দু’জনের প্রাইভেট মুহূর্তে তৃতীয় জনকে কেন রাখবে। তাথৈ উঠে দাঁড়াল। রিয়াকে দেখে প্রশ্ন করল,
-এই মেয়ে, তুমি কে? তুমি এখানে কী করছো?
রিয়া লোপার মতো সাথে সাথেই মিথ্যা কথা বানিয়ে বলতে পারল না। তাথৈয়ের কাছে এবার সবটা স্পষ্ট হয়ে গেছে। অভয় এতক্ষণে একবারও কিছু বলেনি। মানুষটা হয়তো নিজের সজ্ঞানেই নেই।
-মেনে নিচ্ছি আমার স্বামী লোপার সাথে শুয়েছে। কিন্তু ওদের প্রাইভেট মুহূর্তে তুমি কেন এই রুমে আছো?
তাথৈকে লোপা যতটা বোকা ভেবেছিল তাথৈ মোটেও এতটা বোকা না। মেয়েটার হাতে ফোন দেখে তাথৈ বুঝে গেল এরা দু’জন মিলে অভয়কে ফাঁসানোর প্ল্যান করেছে। রিয়া কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাথৈ রিয়ার হাত থেকে ফোনটা ছিনিয়ে নিল।
-তোমার ফোনে কী আছে? নিশ্চয় ভিডিও করেছ। তোমরা দু’জন মিলে আমার স্বামীকে ফাঁসাতে চেয়েছিলে? আমি এক্ষুনি তোমাদের দু’জনকেই পুলিশে দেব। প্রমাণ তো এই ফোনেই আছে।
পুলিশের কথা শুনে রিয়া দৌড়ে পালিয়ে যেতে নিচ্ছিল। সে দরজা পর্যন্ত যাওয়ার আগেই তাথৈ রিয়ার চুল টেনে ধরল। তাথৈ ভুলেই গেল তার পায়ে ব্যথা ছিল। সে এতক্ষণ হাঁটতে পারছিল না। ভয় পেয়ে রিয়া সব স্বীকার করে নিয়ে বলতে লাগল,
-আমাকে যেতে দাও। আমি কিছু করিনি। সবটা লোপার প্ল্যান ছিল। লোপা তোমার স্বামীকে ব্ল্যাকমেইল করার জন্য ভিডিও বানিয়েছে।
-আর তুমি লোপাকে এই জঘন্য কাজে সাহায্য করেছ। শাস্তি তো তোমারও প্রাপ্য।
রিয়া তাথৈকে ধাক্কা দিয়ে পালিয়ে যেতে চাইলে তাথৈ হাতের কাছে একটা ফুলদানি পেয়ে ওটাই রিয়ার দিকে ছুড়ে মারল। মাথায় আঘাত পেয়ে রিয়া সাথে সাথে মেঝেতে পড়ে জ্ঞান হারাল। এটা দেখে লোপাও ভয় পেয়ে গেছে। তাথৈ হাতাহাতি মারামারিতে নেমে আসবে বুঝতে পারেনি লোপা। রিয়ার দিকে তাকিয়ে তাথৈ ভাবল, মরে গেলে মরে যাক। আজ দু’একটাকে মেরে তবেই কলিজা ঠান্ডা হবে।
-তাথৈ! কী করেছ তুমি? এর জন্য তোমাকে আমি পুলিশে দিতে পারবো জানো?
-চুপ কর কালনাগিন। তুই আগে নিজের জীবন বাঁচা তারপর আমাকে পুলিশের ভয় দেখাস।
লোপা বেড ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। তাথৈ নিচু হয়ে ফুলদানিটা হাতে নিয়ে লোপার দিকে এগোতে লাগল। তাথৈয়ের মাথায় খুন চেপেছে এটা বুঝতে পেরে লোপা ধীরে ধীরে পেছনের দিকে যাচ্ছে।
-তুই যে একটা নাগিন এটা আমি আগেই জানতাম। কিন্তু তোর ভেতর যে এত বিষ আন্দাজ করিনি। উনি ঠিকই তোর পার্টিতে আসতে চাচ্ছিল না। আমিই অতি ভালো মানুষি দেখিয়ে উনাকে নিয়ে এসেছি। ভুল তো আমারই। ঠিক আছে, ব্যাপার না। আমি ভুল শুধরে নিতেও জানি। আজ আমি তোর বিষ দাঁত ভেঙে কীভাবে সব বিষ বের করে নিই দেখ শুধু। আমার জামাইয়ের উপর কুদৃষ্টি দিবি না! এত্ত সহজ। মহল্লার কাকীদের চুলোচুলি দেখে বড় হয়েছি। আমার থেকে তোকে কে বাঁচাবে আমিও দেখি।
তাথৈয়ের ভেতর কোন আত্মা ভর করেছে কিনা সে নিজেও বুঝতে পারছে না। আজ লোপাকে জন্মের শিক্ষা দিবে এটাই শুধু মাথায় ঘুরছে। পায়ের ব্যথা ভুলে গিয়ে তাথৈ স্বাভাবিক ভাবে হেঁটে লোপার দিকে এগোচ্ছে। আত্মরক্ষার জন্য লোপাও কিছু একটা খুঁজছে। কিন্তু হাতের কাছে কিছুই পেলো না। তাথৈ ততক্ষণে লোপার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। লোপার চুল টেনে মনের ঝাল মেটাচ্ছে।
-আমার জামাইয়ের দিয়ে খারাপ নজর দিয়েছিস না? আমি তোর চোখই তুলে ফেলব। তাথৈ কী তা এখনও চিনিস নি। চিনলে অন্তত আমার জামাইয়ের থেকে একশো হাত দূরে থাকতি।
তাথৈয়ের ভেতর এরকম পৈশাচিক শক্তি কোত্থেকে এলো কে জানে। লোপার চুল টেনে চড় থাপ্পড় দিয়েই ওকে কাবু করে ফেলেছে। নিচে পড়ে গেছে লোপা। ঠোঁট কেটে রক্ত বেরিয়ে এসেছে। তবুও তাথৈ থামছে না। শেষে লোপা জ্ঞান হারাবার আগে তাথৈ ওকে ছেড়ে দিলো। উঠে দাঁড়িয়ে নিজের পরনের শাড়ি, চুল ঠিক করতে করতে বলল,
-এবার যা করার পুলিশ করবে।
নিজের ফোন খুঁজে বের করে নোমানকে কল করলো। নোমানকে ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিলে নোমান দশ মিনিটের ভেতর চলে আসবে জানাল। হাঁপাতে হাঁপাতে লোপাকে ছেড়ে অভয়ের কাছে গেল তাথৈ। কত সুন্দর আরাম করে ঘুমাচ্ছে! লোকটার দিকে তাকিয়ে এত রাগ লাগছে। লোপার ভাগের কিছু মার উনারও প্রাপ্য।
-উনি বেহুশ হয়ে পড়ে আছেন। আর উনার ইজ্জত বাঁচাতে আমাকে মারামারি করতে হচ্ছে।
তাথৈ অভয়কে ডেকে তোলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। কে জানে কী খাইয়ে অজ্ঞান করেছে। এই ভুখা লোক কি জীবনে কিছু খায়নি? লোপা কিছু দিলেই ওটা খেতে হবে? বিশাল দেহি এই লোককে কীভাবে তুলে নিয়ে যাবে সে? উপায় নেই। নোমান না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। অভয়ের মাথা ধরে সামান্য তুলে তাথৈ ওকে শার্ট পরিয়ে দিল। নিজে নিজেই বলতে লাগল,
-আমি আরেকটু দেরি করে এলেই তো আপনার ইজ্জত লুট হয়ে যেত। মেয়ে মানুষও কত দুশ্চরিত্রা হয় দেখেছেন?
চলবে
Jerin Akter Nipa