যদি দেখার ইচ্ছে হয় পর্ব-১২+১৩

0
440

#যদি_দেখার_ইচ্ছে_হয়
#আফসানা_মিমি
|পর্ব: বারো|

মোল্লা বাড়িতে বিচার বসেছে। নাজিমউদ্দীন গম্ভীরমুখে বসার ঘরে বসে আছেন। দুই পাশে তার দুই ছেলে ফিরোজ এবং কায়েস। ফিরোজের কপাল কুঁচকে আছে যেন জরুরি কোনো কাজ থেকে তাকে তুলে নিয়ে আসা হয়েছে। কায়েস নির্বিকার, সমস্ত ঘটনা তার সামনেই ঘটেছে। এমনকি সে পূর্ব থেকেই অবগত যে লায়লা বেগম নিজের দোষ ঢাকতে এবারও কোনো অসহায়ের উপর দোষ চাপিয়ে দিবে। মিষ্টিকে দেখে বুঝা যাচ্ছে সে খুব কান্না করেছে। পিয়াস বিরক্তিকর দৃষ্টিতে মাকে দেখছে। সেও জানে, আজকের দুর্ঘনার কারণ! অভ্যন্তরীণ দিক দিয়ে মোল্লা বাড়ির প্রতিটা সদস্যদের সম্পর্কে সকলেই অবগত কিন্তু কেউ প্রকাশ করে না। নাজিমউদ্দীন গম্ভীরস্বরে বলতে শুরু করেন, ” নাত বউয়ের উপর কী অভিযোগ বউমা। কী করছে সে, তোমার মুখ থেকেই প্রথমে শুনি।”

লায়লা বেগম এই সময়টারই অপেক্ষা করছিলেন। তিনি তিনার অভিযোগ ব্যক্ত করতে শুরু করেন, ” আমি খারাপ আব্বা, খুব খারাপ। অন্তিক আমার পেটের সন্তান না হলেও তাকে ছেলে ভাবি তো! বউমাকেও আপন ভাবতাম। আব্বা, আমার আপন ভাবাটা বউমা সহ্য করতে পারেনি। বউ হয়েছে, সংসার তার, তারই তো সব দেখে শুনে গোছগাছ করে রাখতে হবে তাই বলেছিলাম ধুয়া কাপড়গুলো কলির সাথে রোদে শুকিয়ে দিয়ে আসতে। কিন্তু বউমা কি করল, আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে বলল, তুই কাজ কর বুড়ি। আব্বা আপনিই বলেন, আমি খারাপ কিছু বলেছিলাম?”

নাজিমউদ্দীন নিরুত্তর। মিষ্টির দিকে তাকিয়ে বলেন,” তুমি কিছু বলবে, নাত বউ?”

মিষ্টি দুর্বল হেসে বলে, “ সত্য বললে কী বিশ্বাস করবেন দাদা? কেননা এখানে সত্যের চেয়ে মিথ্যার পাল্লা ভারী। সত্য বললেও মিথ্যার জয় হবে, যা পূর্ব থেকেই হয়ে এসেছে।”

কিছুক্ষণের জন্য নাজিমউদ্দীন ও অন্তিক ব্যতীত মোল্লা বাড়ির সকলের চোখ চড়কগাছ হয়ে যায়। সবচেয়ে বেশি অবাক হয় লায়লা বেগম সে ভীতু চোখে স্বামীর দিকে তাকায়। ফিরোজ তখন রাগান্বিত দৃষ্টিতে স্ত্রীকে দেখছে। লায়লা বেগম তুতলিয়ে ধমক দেন মিষ্টিকে, ” মাথা ঠিক আছে? আমরা মিথ্যা বলব কীসের ফায়দায়? তুমিই তো ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলে।”

লায়লা বেগম কিছুদূরেই দাড়িয়ে ছিল। মিষ্টির কী হলো জানে না। লায়লা বেগমের কাছে এসে বলল, ” চাচী হাতটা এগিয়ে দিন তো?”

লায়লা বেগম সকলের দিকে নজর ঘুরিয়ে ইতঃস্তত হয়ে হাত বাড়িয়ে দেয়। মিষ্টির মুখে হাসি ফিরে আসে। সে এবার দুষ্ট স্বরে বলে, ” আপনার হাতটা তো খুব শক্ত চাচী!”
এরপর কলির দিকে ফিরে তার উদ্দেশ্যে বলে, ” এই কলি বাঁশের ফলি, এদিকে আসো। চাচীর শরীর কেমন যেন কাঁপছে ধরো তো?”

বোকা কলি তাই করল। লায়লা বেগমের পিছনে এসে দাঁড়িয়ে তাকে ধরল। মিষ্টি এবার লায়লা বেগমকে ধাক্কা দেওয়ার বৃথা চেষ্টা করে। লায়লা বেগম জায়গা পড়ে যাওয়া তো দূরের কথা এক বিন্দু পরিমাণ নড়নি।
মিষ্টি মুখে হাত চেপে হেসে বলে, ” আমি প্র্যাক্টিক্যালি দেখালাম দাদা। এবার বুঝে নিন।”

নাজিমউদ্দীন সহ সকলেই লায়লা বেগম ও কলির দিকে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকায়। লায়লা বেগম বুঝতে পেরে বলতে শুরু করে, ” এখানে পানি কোথায়। বাথরুমে পানি, সাবান ছিল বলেই অল্প ধাক্কাতে পড়ে গেছি। এই মেয়ে আপনাদের মিথ্যা গোল খাওয়াচ্ছে।”

” কিন্তু তুমিই তো বললে মা যে, মিষ্টিকে কাপড় রোদে শুকিয়ে আনতে পাঠানোর জন্য বলেছিলে। তোমার কথা অনুযায়ী বাথরুমের কাপড় ততক্ষণে ধুয়া শেষ। আর আমরা সাধারণত কাপড় ধুয়া হলে সাথে সাথে বাথরুমেও পানি ঢেলে দেই।”

পিয়াসের যুক্তির উপরে লায়লা বেগম আর কথা বলতে পারেনি। ছেলের দিকে কটমট দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মনে মনে বলে, ” এ কেমন ছেলে পেটে ধরেছিলাম আমি। যে কি না আমারই বিরুদ্ধে শত্রুতা করে বেড়াচ্ছে !”

মিষ্টির হাসি আরো দীর্ঘ হয়। সে কটাক্ষ করে বলে, ” ঘুমন্ত ব্যাক্তিকে জাগ্রত করা যায়, কিন্তু কোনো জাগ্রত ব্যাক্তিকে জাগ্রত করা কারো পক্ষে সম্ভব হয় না। আপনার থেকে দুর্বল কেউ আপনাকে ধাক্কা দিয়ে বড়োজোর জায়গা থেকে নাড়াতে পারবে কিন্তু আপনাকে ফেলে দিতে পারবে না যদি আপনি ইচ্ছেকৃতভাবে না পড়েন।”

এতক্ষণ অন্তিক চুপ ছিল। মিষ্টির বুদ্ধিমত্তা দেখে মুগ্ধ সে। তার স্ত্রী নিজেকে নির্দোষ সাব্যস্ত করেছে তার বুদ্ধিতে। অন্তিক মুখ খুলে। সে লায়লা বেগমের উদ্দেশ্যে বলে, ” এই বাড়ি তোমার স্বামীর সাথে আমার বাবারও। তোমার যেমন এই বাড়িতে বউয়ের অধিকার দেওয়া হয়েছে, আমার স্ত্রীও তেমন অধিকার প্রাপ্য। এ বাড়ি থেকে রুনা চলে গেছে কিন্তু মিষ্টি যাবে না। জীবনের শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত এ বাড়িতে বউ হয়েই থাকবে। আজই শেষবারের মতো বলে দিলাম, আমার এবং আমার স্ত্রীর উপরে তোমার খারাপ নজর যেন না পড়ে। নয়তো আমার ক্ষমতা দেখিয়ে দিব।”

অন্তিক কথা বলে থামেনি। মিষ্টির হাত ধরে বসার ঘর থেকে বের হয়ে যায়। পিয়াস মায়ের দিকে ফিরে থুতু ফেলে বলে, ” তোমাকে মা ডাকতেও আমার খারাপ লাগছে।তোমার জন্যই আমি বাড়ি ফিরে আসি না।”

পিয়াসও প্রস্থান নেয়। নাজিমউদ্দীন ফিরোজের উদ্দ্যেশ্যে বলে ওঠেন, ” তোমার বউকে সাবধান করে দাও। রুনার সাথে যেই অন্যায় হয়েছে সেই অন্যায় নাত বউয়ের সাথে হতে দিব না।”

নাজিমউদ্দীন প্রস্থান নিতেই ফিরোজ উঠে দাঁড়ায়। স্বামীকে এগিয়ে আসতে দেখে লায়লা বেগম ভীত পায়ে পিছিয়ে যেতে থাকে তার সাথে কলিও ভয়ে মায়ের আড়ালে গিয়ে পেছাতে থাকে। ফিরোজের চক্ষুদ্বয়ে লালচে হয়ে আসে। নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে লায়লা বেগমের গালে থাপ্পড় দিয়ে বসে। এরপর লায়লা বেগমের হাত ধরে টেনে হিঁচড়ে নিজের ঘরের দিকে আগাতে থাকে। কলি বার বার বাবার হাতে পায়ে ধরে ধরছে যেন এই যাত্রায় মাকে ছেড়ে দেয়া হয়। ফিরোজ কলিকে লাথি দিয়ে ফেলে ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়। কলি বারকয়েক বার দরজায় কড়াঘাত করে মা মা বলে চিৎকার করে কিন্তু লাভ হয় না। ঘরের ভেতর থেকে লায়লা বেগমের আর্তচিৎকারের কাছে কলির আওয়াজ কিছুই না। বসার ঘরে কায়েস তখনো বসা অবস্থায়। সে চুপ করে চেয়ারে বসে জীবনের হতে সাব মিলাচ্ছে। কলিকে আসতে দেখে ভরাট কণ্ঠস্বরে সে বলে, ” পাপ বাপকেও ছাড়ে না। অন্যায় করলে দুনিয়াতে অর্ধেক ফল ভোগ করতে হবে। এটাই নিয়ম।”

কলি কিছু বুঝলো কী না কায়েস তা জানে না। মুখে তৃপ্তির হাসি, চোখে জল নিয়ে নিজের ঘরে প্রবেশ করে।

———————————–

জমিনে ওড়নার আঁচল ছড়িয়ে মিষ্টির উরুতে অন্তিক শুয়ে আছে। অন্তিক ঘরে প্রবেশ করার পর থেকেই নিশ্চুপ। মিষ্টিকে জমিনে বসিয়ে নিজেই চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়ে। শত ডাকার পরও চোখও খুলেনি,কথাও বলেনি। মিষ্টি মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে শুরু করে, ” আপনার জীবনের গল্প শুনবো,জনাব। শুনাবেন?”

অন্তিক উপুড় হয়ে শুয়ে দুই হাতে মিষ্টির পেটে মুখ গুঁজে দিয়ে অস্পষ্ট স্বরে বলে, ” কতটুকু শুনবে?”
” পুরোটা।”
“ পুরো জীবন শেষ হোক, পরে বলব।”

মিষ্টি দুম করে অন্তিকের পিঠে আঘাত করে বলে, ” জীবন এতো সস্তা নাকি যে এতো তাড়াতাড়ি মুক্তি পেতে চাও!”

” তুমি জীবনে আসার পর ধূসর রং ভুলে গেছি। প্রতিদিন রংধনুর সাত রঙের মতো রঙিন লাগে। প্রতিদিন নতুন রূপে নিজেকে আবিস্কার করি। প্রতিদিন এক মিষ্টি চন্দ্রিমাকে ভালোবাসি। আমার জীবনে এতটুকু পেয়েই শান্তি। তোমাকে পেয়ে সুখী, আমার মিষ্টি চন্দ্রিমা!”

মিষ্টি লাজরাঙা অঙ্গে সর্বাঙ্গে। অন্তিকের পিঠে আঁকিবুঁকি করে কিছু একটা লেখে অন্তিককে বলে,” বলো তো,কী লেখেছি?”
অন্তিক মিষ্টির নাভিতে গভীর চুমু খেয়ে বলে, ” ভালোবাসি।”
মিষ্টি খিলখিল করে হাসতে থাকে। অন্তিক আবার বলে ওঠে, ” উত্তর দাও?”
” লিখিত জবানবন্দি ভেবে নাও, প্রিয়!”

অন্তিক মিষ্টির কোমর আরেকটু চেপে ধরে। পর পর কয়েকবার উদরে ঠোঁট ছুঁয়ে বলে, ” তোমাকে কিছু বলতে চাই, চন্দ্রিমা!”

মিষ্টি চোখ বন্ধ অবস্থায় ছিল।অন্তিকের ছোঁয়ায় সে অন্য জগতে চলে যায়। যেখানে সে এবং তার ভালোবাসার মানুষ বাস করে। অস্পষ্ট স্বরে উত্তর দেয়, ” অনুমতি তার থেকেই নিতে হয় যার কাছে তুমি অপরিচিত বা যারা গুণিজন তাদের থেকে। অথচ আমি তাদের একজনও নয়! প্রত্যেক স্ত্রীর কাছে স্বামীরা বুঝি অনুমতি নিয়েই কথা বলে?”

কথা শেষ হতেই মিষ্টি পেটের মধ্যে ব্যথা অনুভব করে। সে সাথে সাথে অন্তিকের চুল ধরে নিজের দিকে ফিরায়। অন্তিকের চোখে মুখে অন্যরকম নেশা। মাতাল চোখে হাসছে সে। চোখগুলো লাল টকটকে। মিষ্টি বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেস করে, ” কী হলো! আমি কী ভুল বলেছি?”

অন্তিক উঁচু হয়ে মিষ্টির নাকে কামড় বসিয়ে উত্তর দেয়, ” অনেক বরো ভুল করেছো,চন্দ্রিমা! আমার বুকে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছো। সেই আগুনে দগ্ধ হয়ে আমি জ্বলে পুড়ে ভস্ম হয়ে যাচ্ছি।”

” পানি নিয়ে আসবো?”
হাতের কাছেই পানির জগ ছিল। মিষ্টি সেটা হাতে নিয়ে বলে, ” ঢেলে দেই?”

” এ আগুন পানি দিয়ে নিভবে না পাগলী! এর ঔষধী শুধু তোমার কাছেই আছে।”

মিষ্টি লজ্জায় রাঙা হয়ে হাত দ্বারা মুখ ঢেকে নেয়। অন্তিক জীবনের এই মুহূর্তটাকে স্পেশাল করতে মিষ্টির মাথায় ঘোমটা টেনে দেয়। প্যান্টের পকেট থেকে সোনার একটি আংটি বের করে বলে, ” আমার জীবনে আগমনের জন্য তোমার প্রথম উপহার,চন্দ্রিমা।”

মিষ্টি অন্তিককে জড়িয়ে ধরে। মুখে তার হাসি।অন্তিকের কাঁধে চুমু খেয়ে বলে, ” হয়তো তোমার জীবন রাঙাতেই আমার ভাগ্য এখানে নিয়ে এসেছে। আজকের মুহূর্তটা থেমে থাকুক, অন্তু! আমার শুধু অন্তু চাই, আর কিছুই না।”

মিষ্টিকে পাঁজা কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয় অন্তিক। দিবালোকের আলোয় মন ভরে দেখে নেয় নব বঁধুর মিষ্টি হাসি। সর্বাঙ্গে লাজের অধিকারী মিষ্টির ঠোঁট জোড়া আয়ত্ত করে নেয়। এরপর! এরপর নব বঁধুর লাজরাঙা মুখশ্রীতে দৃষ্টি রেখে বলে, ” আমার ধ্যান মন প্রাণ সব উজাড় করে দিলাম, চন্দ্রিমা! আজকের দিবালোক শুধুই তোমার আমার।”

চলবে……………..
#যদি_দেখার_ইচ্ছে_হয়
#আফসানা_মিমি
|পর্ব: তেরো|

সন্ধ্যা লগনে লাজরাঙা নব বঁধু চা হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। পৃথিবীর সমস্ত লাজ তার বদনে। রাঙা মুখশ্রীতে কৃত্রিম আলো ছড়াচ্ছে দেখতে অনেকটা মোহনীয় লাগছে। অন্তিক নব বঁধুর দিকে মায়াবী মুখশ্রী দেখছে। ভেজা চুল থেকে টুপটুপ পানি ঝড়ছে। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে অন্তিক চোখ বন্ধ করে নেয়। সেদিন বাবার কাছে থেকে শুনেছে তার মায়ের হাতের স্বাদও প্রায় এমন হতো। চোখ বন্ধ করে সে রুনা উপস্থিতি অনুভব করতে চেষ্টা করে। মায়ের শরীরের ঘ্রাণ কেমন ভুলেই বসেছে সে। মিষ্টি অন্তিকের অবস্থা বুঝতে পারে। চঞ্চল বঁধু কৌশলে অন্তিকের পাশে আবদার রাখে, ” ঘুরতে নিয়ে যাবে, অন্তু?”

মিষ্টিকে আগকে ধরে অন্তিক হাসে। চায়ের কাপে পরবর্তী চুমুক দিয়ে বলে, ” এখনই যেতে হবে?”

” বেশ বড়ো আবদার করে ফেলেছি বুঝি?”

অন্তিক চায়ের কাপ ফিরিয়ে প্রসস্থ হেসে উত্তর দেয়, ” তিন কবুল করার মাধ্যমেই তোমার আবদার, অভিমান, হাসি দুঃখ সব আমার নামে করে দিয়েছো চন্দ্রিমা! তোমার কাছে এই অন্তিক স্বপ্নের রাজকুমার হতে না পারলেও মাতাল প্রেমিক হয়ে দেখাবে।”

” বাহ, বেশ কাব্যিক কথা বলতে শিখেছো দেখছি, অন্তু। তা গুরুটা কে শুনি?”

অন্তিক ঘর থেকে বের হতে হতে বলে, ” সঙ্গ দোষ বুঝলে! আমার চন্দ্রিমার মুখের প্রতিটা শব্দ শুধু আমার জন্য। তার নিঃশ্বাসও বলে দেয় আমার জন্য ব্যাকুলতা। আমি চন্দ্রিমার থেকেই শিখেছি।”

মিষ্টি লজ্জায় লাল হয়ে হাসে। অন্তিকের চলে যাওয়ার আভাস পেয়ে লজ্জায় মুখ ঢেকে নেয়। অন্তিক চলে গিয়েও ফিরে এসে পুনরায় শুধায়, ” ওহে মোর কলঙ্কতিলক প্রেয়সীনি। একটি আর্জি শুনবে?”

অন্তিকের মাতাল কণ্ঠে মিষ্টি মোহিত হয়ে উত্তর দেয়,” এই মানবী কলঙ্কিত পুরুষের সব আর্জি শুনতে প্রস্তুত।”
” আজকে শাড়ি পরবে? সাথে কাঁচের চুড়ি, মোটা করে কাজল, আর!”
” আর কী?”
” ফিরে বলব।”

মিষ্টি পাগল বলে নীল রঙের শাড়ি নিয়ে বাথরুমে প্রবেশ করে।

অন্তিক হাসিমুখে বাগানের দিকে যাচ্ছিল তখনই কলি পথ আগলে দাঁড়ায়। কলির চোখে তখন জলের স্রোত বইছে। নাক টেনে বলে,” আমায় ক্ষমা করো,অন্তিক ভাই। মায়ের কথায় ভাবীর পিছনে লেগেছিলাম। আজ তুমি আমার চোখ খুলে দিলে। আমি আর কোনদিন তোমার আর ভাবীর পিছনে লাগবো না। কালই হোস্টেলে চলে যাব।”

অন্তিক তীর্যক দৃষ্টিতে কলিকে দেখে। মেয়েটা আদৌও সত্যি বলছে নাকি মিথ্যা বুঝার উপায় নেই।
” ঘরে যা।”
” আব্বা মাকে মে’রে ফেলবে। মাকে বাঁচাও অন্তিক ভাই!

অন্তিক চলে যাচ্ছিল। কলির কথা শুনে থেমে হাঁটার গতি থামিয়ে পথ পাল্টে নেয়। লায়লা বেগমের ঘরের সামনে এসে দরজায় চার পাঁচবারের মতো কড়াঘাত করে।

” দরজা খুলো, চাচা।”

ভেতর থেকে ফিরোজের কণ্ঠস্বর শোনা যায়, ” শু’য়ো’রে’র বাচ্চা, যা এখান থেকে।”

অন্তিক চোখ বন্ধ করে রাগ সংবরণের চেষ্টা করে। মুষ্টিবদ্ধ হাত পুনরায় দরজায় রেখে কড়াঘাত করে বলে,” দরজা খুলবে, নাকি পুলিশ ডেকে আনবো। জীবনের প্রথম মোল্লা বাড়ির চৌকাঠে পুলিশের পা মাড়াবে। সম্মান কী থাকবে?”

খটাখট দরজা খুলে পুরুষালি হস্ত এগিয়ে আসে অন্তিকের মুখ বরাবর। যথা সময় অন্তিক সেই হস্ত আটকে নেয়। লাল বর্ণ চোখে দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ” দ্বিতীয়বার এই ভুল করলে হাত কে’টে ফেলব। শান্ত বলে অবজ্ঞা করেছো কিছু বলিনি কিন্তু অন্যায়ভাবে আমাকে হরণ করবে তা হতে দিব না। মোল্লা বাড়ির প্রত্যেকটা দেয়াল সাক্ষী, একজন ছেলেকে দিনের পর দিন যা সইতে হয়েছে তা যেন অন্যকাউকে সইতে না হয়।”

অন্তিক হাত ঝাড়া দিয়ে ফেলে ফিরোজকে চলে যাওয়ার পথ দেখিয়ে দেয়। ছোট থেকে সবাই তার শান্ত দিক দেখেছে কিন্তু আজ! অন্তিকের এই রূপ সকলের মনে ভীতি সৃষ্টি করে দিয়েছে। ফিরোজ রক্তিম চোখে অন্তিককে দেখে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। কলি দৌড়ে ঘরে পৌছে লায়লা বেগমকে আঁকড়ে ধরে। অন্তিক ঘরে আর প্রবেশ করে না। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তাচ্ছিল্য করে হেসে বলে,” কারো খারাপ চাইতে গেলে নিজেরই খারাপ হয়। বদ দোয়া মুখে বলতে হয় না নিশ্বাসের সাথেই বের হয়ে যায়, চাচী।”
—————–

” হ্যালো গোলাপি, বরের সাথে ঘুরতে গেলে কোন পাশে হাঁটতে হয়?”

অন্তিকের ফিরতে বেশ দেরী হচ্ছে। মিষ্টি ভাবলো, এই সুযোগে বন্ধুদের খোঁজ খবর নেওয়া যাক। বহুদিন পর প্রিয় বান্ধবীকে ভালো মন্দ জিজ্ঞেস না করে অদ্ভুত প্রশ্ন করে বসে। অপর প্রান্ত থেকে গোলাপি নামক মানবী বলে ওঠে, ” আগে আমার নাম ঠিক করে বল, তারপর বুদ্ধি দিব।”
” গোলাপি রাণী! বল না?”

অপর প্রান্ত থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ” প্রথমে বলি, আমার নাম পিংকি। পিংকও যদি নাম হতো তাহলে মনকে আশ্বাস দিতে পারতাম। কিন্তু তুই পিংকি থেকে কেন গোলাপি বানালি আজও বুঝতে পারলাম না।”

মিষ্টি খিলখিল করে হেসে শুধায়, ” তোর গাল শীত নাই, গরম নাই; প্রেমিক নাই, জামাই নাই; লজ্জা নাই, শরমও নই বারো মাসে গোলাপি থাকে তাই গোলাপি ডাকি। এবার বল না!”
পিংকি হতাশ হয়ে উত্তর দেয়, ” বরের ডানেও না, বামেও না একদম বুকের সাথে মিশে থাকবি।”

মিষ্টি চিন্তায় পড়ে যায়। তার বান্ধবী দিনে দিনে তাকে ছাড়াই পেকে যাচ্ছে এটা সে মানতে পারছে না। মিষ্টি দুঃখ ভরা কণ্ঠে বলে, ” তুই একা একাই দুষ্ট হয়ে যাচ্ছিস রে, গোলাপি। আর পাকিস না দোস্ত! আমি আসলে একসাথে পেকে টসটসে হবো। এখন রাখি রে!”

পিংকিকে কথা বলার সুযোগ না দিয়েই মিষ্টি ফোন কে’টে দেয়। এবার সে আরেক বন্ধুকে কল লাগায়, ” হ্যালো মিঠাইওয়ালা, জামাইকে বশ করার কবিরাজের সন্ধান কর তো! আগামীমাসে বাড়ি ফিরলে বিনিময়ে তোকে লজেন্স খাওয়াব।”
” আমার চেয়ে বড়ো কবিরাজ দুনিয়াতে পাবি না রে, মিষ্টি। বাড়ি ফির, পানি পড়া, তেল পড়া জানাই পড়া দিয়ে তোর জামাইকে বশ করব।”

মিষ্টির হাসিমাখা মুখটা তেঁতো হয়ে যায়। রাগে ফুসফুস করে অপর প্রান্তের মানুষটাকে বলে, ” তোর দশ নাম্বার প্রেমিক বিরিয়ানির বদলে তোকে গোবর খাওয়ায় যেন হারামি।”

কথা শেষ করে মিষ্টি বিছানায় ফোন ছুড়ে মারে। পিংকি ও মাধবী তার প্রাণের বন্ধু। তাদের সাথে কথা বললে মুখের ভাষা সংযত করা তার জন্য দায় হয়ে যায়। সে জানে তার দুই বান্ধবী এখন কাঁদছে। মিষ্টিকে কল করার তাদের অনুমতি নেই। পড়াশোনা বাদ দিয়ে অচেনা, অদেখা মানুষের প্রতি ভালোবাসা দেখে দুজনেই তাকে বেশ বুঝিয়েছে। কিন্তু মিষ্টি তাদের পাত্তা দেয়নি। তার লক্ষ্যে এগিয়ে আসে। আর আজ সে অন্তিকের বউ রূপে অবস্থান করছে।

ঘরে ফিরে অন্তিকের অশান্ত মনে শীতল হাওয়া ছুঁয়ে যায়। অন্তিকের বর্ণনানুযায়ী মিষ্টি সেজেছে। নীল শাড়ির সাথে কাজল কালো চোখ, দুই হাতে শোভা পাচ্ছে রেশমি নীল চুড়ি। মাথার অবাধ্য কেশবহুল এলোমেলো হয়ে আছে। অন্তিক এগিয়ে এসে মিষ্টির কোমড় চেপে ধরে। মিষ্টি অন্তিকের আগমন ঠাহর করতে পারেনি খানিকটা চমকে তাকাতেই অন্তিক মিষ্টির অধর যুগল আয়ত্ত করে নেয়। দীর্ঘসময় রসালো ঠোঁটের স্বাদ পরখ করে বলে ওঠে, “বলেছিলাম না, ফিরে এসে কিছু বলব! কৃত্রিম সাজসজ্জায় নয় তোমার ঠোঁট রঙিন করতে আমার স্পর্শই যথেষ্ট। দেখো শুষ্ক ঠোঁট জোড়া গোলাপি হয়ে আছে। তাঁর সাথে লজ্জায় রাঙা হওয়া গালদুটো গোলাপি হয়ে আছে। তোমার এরূপ সৌন্দর্যের কাছে কৃত্রিম সাজসজ্জা ফিকে, চন্দ্রিমা!”

মিষ্টি হতভম্ব হয়ে আছে। অন্তিকের রোমান্টিকের চক্করে তার মাথা দুলছে। সে অন্তিকের বুকে কয়েকটা ঘা বসিয়ে বলে, ” বাহিরে বের হতে হবে না, অন্তু। এখানেই থেকে যাই!”

” মন্দ বলোনি। আচ্ছা, ভিটামিন-এ কী ছেলেরাই আদায় করে নেয়! নাকি তোমার মতো মেয়েরাও আদায় করে!”

মিষ্টি হতবাক। মনে মনে আফসোস করে তার পুরোনো অন্তুর জন্য। ভদ্র অন্তুকে অভদ্র বানিয়ে সে খুব ভুল করেছে। যার মাশুল সে প্রতিদিনই দিচ্ছে।

—————

সময় বাধাবন্ধহীন। মিষ্টির আগমনের আজ চার মাস পাড় হয়েছে। কলি বাঁশের ফলির ছায়া সেদিনের পরেই সরে গেছে। হোস্টেলে চলে যাওয়ার পর লায়লা বেগম আরো পাগলাটে হয়ে গেছে। দিনরাত মিষ্টিকে অপদস্ত করার প্রচেষ্টায় থাকে। মিষ্টি খুবই বুদ্ধিমত্তার সাথে লায়লা বেগমের সব পরিকল্পনা থেকে মুক্ত হয়ে নাকের ডগায় তেল লাগিয়ে চলে ফিরে। বাদ জুম্মায় মিষ্টি রান্না করছিল। আজ খাবার তৈরী হতে দেরী হয়ে গেছে। ইদানীং তার শরীর বেশ খারাপ লাগে। অল্পতেই হাঁপিয়ে ওঠে, মেজাজ খিটখিটে থাকে। লায়লা বেগম লাগতে আসলে মুখে যা আসে তাই বলে বকতে থাকে। আজকেও তার মন মেজাজ খারাপ। বাসায় কেউ নেই তার উপর কাজ এখনো বাকী। এমন সময় মোল্লা বাড়ির কলিং বেল বেজে ওঠে। একবার নয় দুইবার নয় একসাথে বেজেই চলছে তো বেজেই চলছে। মিষ্টির মেজাজ আরো খারাপ হয়ে যায়। সে ধুপধাপ পা ফেলে দরজা খুলে দেয়। বাহিরে অন্তিক দাড়িয়ে আছে। পরিধানে সাদা পায়জামা পাঞ্জাবী ও মাথায় সাদা টুপি। অন্তিকের পাশেই একজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। মহিলাটির কোলে ফুটফুটে একটি কন্যা সন্তান। বয়স তিন চার বছর হবে। মিষ্টি একবার অন্তিক তো একবার বাচ্চাসহ মহিলার দিকে তাকিয়ে বলে, ” আমি কী তবে তোমার দ্বিতীয়া ছিলাম!”

মিষ্টি কথাটা বলে স্থির থাকতে পারেনি। সঙ্গে সঙ্গেই জ্ঞান হারিয়ে জমিনে লুটিয়ে পড়ে।

চলবে……………….