#যদি_দেখার_ইচ্ছে_হয়
#আফসানা_মিমি
|পর্ব: বাইশ|
ভীষণ জ্বরে ভুগছে অন্তিক। একশত দুই ডিগ্রী পর্যন্ত তাপমাত্রা বেড়েছে। চিন্তায় মিষ্টির নাজুক হাল। কেঁদেকুটে একাকার সে। এই সময়ে কান্নাও ঠিক না তার জন্য। কিন্তু মেয়েটাকে কে বুঝাবে? রুমাল ভিজিয়ে অন্তিকের কপালের উপর রেখে নাক টেনে কাঁদছে সে। কায়েস চিন্তিত হয়ে ছেলের পাশে বসে আছেন। শাওনের কাছে যাওয়ার আগে তাকে ফোন করেছিল সে বলেছিল, নাজিমউদ্দীন মৃত্যু স্বাভাবিক মৃত্যু নয়! তাকে নাকি খু’ন করা হয়েছে বলে ধারণা করছে অন্তিক। কায়েস বলেছিল, যেন তাকে সবটা জানায় অন্তিক। পিয়াস যখন গতকাল রুনার কথা জানায় তখন তিনি পাগলপ্রায় হয়ে যান। ছেলের কথা ভুলেই বসেন তিনি। রুনাকে এক পলক দেখার জন্য উতলা হয়ে যান। রুনা ফিরে এসেছে ভেবে খুশি হলেও পরমুহূর্তে ছেলে অবচেতন অবস্থা শুনে দৌড়ে আসেন।
” তুমি ঘরে যাও বাবা, আমি অন্তুর পাশে আছি।”
বিছানায় বসারত কায়েসের উদ্দেশ্যে কথা বলে মিষ্টি থামে। এতটুকু সময়ে মেয়েটার মুখখানা শুঁকিয়ে গেছে। কায়েস মমতায় হাত বুলায় মিষ্টির মাথায়।
” যাচ্ছি মা, কোনো সমস্যা হলে আওয়াজ দিস!”
কায়েস চলে যেতেই মিষ্টি দরজা আটকে দেয়। অন্তিকের উদ্দেশ্যে বলে,” বাবা চলে গেছে। কী বলবে, বলো।”
অন্তিক চোখ খুলে সতর্ক দৃষ্টি ফেলে দরজার দিকে। মিষ্টির হাত ধরে কাছে টেনে বলতে শুরু করে,” দাদার মৃত্যুর পিছনে চাচার হাত রেয়েছে, মিষ্টি!”
মিষ্টি নির্বিকার, নিস্তব্ধ হয়ে আছে যেন তার চারপাশ। অন্তিকের বলা কথাগুলো মস্তিষ্কে ঘুরছে। অবিশ্বাস্যের দৃষ্টিতে অন্তিকের দিকে ফিরে প্রশ্ন ছুঁড়ে, ” ফিরোজ চাচা?”
অন্তিক মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ বলে চোখ বন্ধ করে নেয়। মনে মনে কথা সাজিয়ে বলতে শুরু করে,” রুস্তম ধরা পড়েছে মিষ্টি। সে চাচার দোকানের কর্মচারী। আমার বন্ধু শাওনকে বলেছিলাম দাদার মৃত্যুর ব্যাপারে সেই তদন্ত করছিল। গত সপ্তাহে মোল্লা বাড়িতে ঢুকে দাদার ঘর থেকে ফিঙ্গারপ্রিন্টস সংগ্রহ করেছিল। আমাদের সকলের উপরই সে নজর রেখেছিল। চাচা নাকি কিছুদিন যাবত কাজ থেকে ফিরেইনি। রুস্তমকে ময়মনসিংহ থেকে অন্য কারণে গ্রেফতার করা হয়। বেচারা না বুঝে, ভয়ে চাচার নাম বলে দেয়। শাওন তৎক্ষনাৎ আমাকে ডাকে। রুস্তমের কাছে যেতেই চাচার কথাই মাথায় আসে। আমার তখন কী হলো জানি না কিন্তু শরীর কাঁপছিল,মস্তিষ্ক কাজ করছিলা না। এত বছর, এত বছর যাদের মাঝে থেকে বড়ো হয়েছি তারাই আমার শত্রু! নিজের বাবাকে আঘাত করতে তাদের অন্তর কাঁপলো না? হাত অবশ হয়ে গেলো না? আমি তখন আর কিছুই ভাবতে পারিনি।শরীর ক্রমশই খারাপ হচ্ছিল তাই শাওন তার কর্মচারীর সাহায্যে পাঠিয়ে দেয়।”
” আমরা খালি চোখে যা দেখি তা সত্য নাও হতে পারে, অন্তু! চাচা যে দাদাকে হ’ত্যা করেছে তার যথাযথ প্রমাণ আমাদের হাতে নেই। তাছাড়া চাচা সেদিন বাসায়ও ছিল না। আমরা কীসের উপর ভিত্তি করে চাচাকে দোষারোপ করব? দাদার যদি খু’নই হয় তাহলে মোল্লা বাড়িতে সেদিন যারা উপস্থিত ছিল তাদের উপর সন্দেহের তীর যাবে। সবচেয়ে বড়ো কথা, চাচীকে আমার সুবিধাজনক মনে হয় না। উনি নিজের কার্যসিদ্ধি হাসিল করার জন্য জঘন্য থেকে জঘন্য অপরাধ করতে পিছুপা হন না।”
মিষ্টির গোছানো কথাগুলো মুগ্ধ হয়ে অন্তু শুনে। তার মতো অন্তু ভাবেনি। মিষ্টির কথা ম্যাজিকের মতো কাজ করেছে অন্তরের মনে। বাহ্যিকরূপে সে সম্পূর্ণ সুস্থ অনুভব করছে। তার জীবনে শক্তি হয়ে ফিরে এসেছে মিষ্টি। যখনই সে ভেঙে যেতে নেয় মিষ্টি ঢালস্বরূপ তাকে গুছিয়ে দেয়। অন্তিক বলল, ” হতেও পারে। কিন্তু এতকিছু জানার জন্য আমাদের মোল্লা বাড়িতে থাকতে হবে যে!”
মিষ্টি অন্তিকের কথায় একদম বিচলিত হয়নি। বরঞ্চ রহস্যময়ী হেসে জবাবে বলে, ” তবে অপেক্ষা কীসের। চলো মোল্লা বাড়িতে আস্তানা গড়ি!”
———————————–
সন্ধ্যালগ্ন তখন। ফিরোজ যখন কাজের জায়গায় ফিরে। ঘামার্ত শরীরে একটুকরো কাপড় জড়িয়ে গামছায় মুখ মুছে নিচ্ছে সে। রুস্তম আটক হয়েছে খবরটাও তার কানে এসেছে। এমনটি নয় যে সে ভয় পায়নি, সে ভয় পেয়েছে। জায়গা বদল করার চিন্তাভাবনাও করছে। প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র নেওয়ার জন্যই মূলত এখানে আসা। ধার্য্যকৃত কামড়া খুলতেই তার চোখজোড়া কোটর থেকে বেড়িয়ে আসার উপক্রম হয়। ভয়ে রীতিমত কাঁপছে সে। মাথায় হাত রেখে অস্পষ্ট স্বরে শুধায়, ” কে করলো এসব?”
বিছানার উপর অর্ধ-উলঙ্গ নারীমূর্তি শায়িত। র’ক্তে রঞ্জিত বিছানার চারপাশ। কেমন ভোঁটকা গন্ধ বের হচ্ছে তা থেকে। কতদিনের লাশ এটা? কে করেছে নারীর খু’ন? ফিরোজের কাছে তো এই নারীমূর্তি অপরিচিত। ঘরের লাইট জ্বালিয়ে কাঁপা শরীরে এগোয় ফিরোজ উদ্যেশ্য নারীমূর্তির পরিচয় জানা। কয়েক কদম এগিয়ে নারীমূর্তির চেহারা দেখে ঘাবড়ে যায় ফিরোজ। ধাক্কা খায় অন্তরে কিছুটা পিছনে হেলিয়ে পড়ে সে। বিড়বিড় করে বলে, ” রুস্তমের বউকে খু’ন করবে কে! রুস্তমরে আমি কী জবাব দিমু?”
————————————–
অন্তিক আর মিষ্টি যখন মোল্লা বাড়িতে প্রবেশ করে তখন দিবারাত্রি। মিষ্টি ইচ্ছে করেই এই সময়টা বেছে নিয়েছে মোল্লা বাড়িতে আসার জন্য। অন্তিক ভেবে পায় না, মেয়েটার হুটহাট কী হয়? মাথায় কী চলে,অবশ্যই ভালো কিছু চলবে না! জ্বর পালালেও শরীরের দুর্বলতা চেপে ধরেছে, ছাড়ছেই না। দুই হাতে ব্যাগ নিয়ে মোল্লা বাড়ির প্রধান ফটকে বউয়ের পাগলামি সহ্য করা ছাড়া আর কোনো উপায়ও নেই তার।
ঘুমঘুম চোখে লায়লা বেগম এসে দরজা খুলে দেয়, ” কে রে! এতো রাতে ঘুম ভাঙতে এসেছিস, কেউ মা’রা গেছে নাকি?”
” এতো সহজেই মৃত্যুর কামনা করছেন, লায়লা কাঠ পোড়া কয়লা চাচী আম্মা!”
প্রায় একমাস, একমাস পর মিষ্টির কণ্ঠস্বর শুনে দাঁড়ানো থেকে জমিনে আছড়ে পড়ে লায়লা। মনের ভুল ভেবে চোখ কচলে পুনরায় তাকাতেই মিষ্টির হাস্যজ্বল মুখশ্রী দেখতে পায়। লায়লার মনে তৎক্ষনাৎ প্রশ্ন জন্মে, এই অলক্ষ্যি আবার কোন মতলবে ফিরে এসেছে। এত অপদস্ত হয়েও বেহায়ামি কেন করছে? খুব তো আরামে ছিল এতদিন। তার সাম্রাজ্যের রাজাও ছিল সে রাণীও ছিল সে। তবে কেন তার সুখ নষ্ট করতে আবারও চলে এসেছে?
লায়লা বেগমের ভাবনার মাঝেই বিনা আমন্ত্রণে মোল্লা বাড়িতে প্রবেশ করতে নেয় মিষ্টি। এতে লায়লা বেগম ক্ষিপ্ত হয়ে দাঁড়ায়। দুই হাত প্রসস্থ করে বলে,” এক পাও এগোবে না,অলক্ষ্যি মেয়ে! তোর মতো নষ্টা, বে’শ্যাবাড়ির মেয়েকে আমার বাড়িতে জায়গা দিব না।”
লায়লা বেগমের কথায় মিষ্টি হাসলেও অন্তিকের মুখশ্রী লাল বর্ণ ধারণ করে। সে এগিয়ে এসে বলতে শুরু করে, ” আমার স্ত্রীর নামে আরেকটা বাজে কথা বললে, আপনাকে মোল্লা বাড়ি থেকে বের করে দিব। তখন আপনি আমার গুরুজন না আপনজন তা দেখব না।”
লায়লা বেগম গা কাঁপিয়ে হাসতে শুরু করে যেন অন্তিক কোনো মজার কথা বলেছে। একপর্যায়ে সে উত্তর দেয়,” তোর থেকে সম্মান কে চাইছে শুনি? আর রইলো বাড়ি থেকে বের করে দেয়ার কথা! এই বাড়ি আমার স্বামীর। ফিরোজ মোল্লার। তোদের কোনো অধিকার নেই এই বাড়ির উপর। তবে কীসের ভিত্তিতে তুই মোল্লা বাড়িতে অধিকার ফলাতে এসেছিস?”
লায়লা বেগমের কথায় অন্তিক বাঁকা হেসে বলে, ” আপনি তো খাতা কলমে বিশ্বাসী তাই না চাচী?”
মিষ্টির কাছ থেকে কিছু কাগজপত্র লায়লা বেগমের দিকে এগিয়ে দিয়ে পুনরায় বলে,” এই নিন,মোল্লা বাড়ির দলীল। যার মধ্যে স্পষ্টত লেখা আছে, দাদা আমার নামে পুরো বাড়ি লিখে দিয়েছে। সাথে আরেকটা কাগজ আছে, পিতৃবংশ আমার দ্বারা অব্যাহত থাকবে তার কাগজ। আপনার জন্য আরো একটি কাগজ আছে, আমার স্ত্রীর উপর মিথ্যা অভিযোগ করা এবং একজন অন্তঃসত্ত্বা মেয়েকে হেনস্তা করার অপরাধে থানায় জিডি করার প্রমাণস্বরূপ কাগজ। ভালো করে পড়ে নিন চাচী, যেন বারবার মনে করিয়ে দিতে না হয়।”
লায়লা কাগজগুলো না দেখেই ছিঁড়ে ফেলতে চাইলে অন্তিক বাঁধা প্রদান করে বলে,” এই ভুল করবেন না চাচী। আপনার হাতে যেই কাগজ আছে সেটা দলীলের ফটোকপি মাত্র। মেইন কপি তো সেফ জায়গায় আছে।”
লায়লা বেগম বিমূর্ত আলোচনায় স্তব্ধ। হাতের কাগজ উলট পালট করে কিছু বুঝতে পারছেন কি না সন্দেহ।
অন্তিক মিষ্টিকে ধরে সাবধানে বাড়িতে প্রবেশ করে। এতরাত করে কে এসেছে দেখার জন্য কলিও চলে আসে মায়ের পিছু পিছু। অন্তিককে ফিরে আসতে দেখে আবেগপ্রবণ হয়ে দৌড়ে আসে কলি। উদ্দেশ্য ছিল, অন্তুককে জড়িয়ে ধরার। মিষ্টি সবটাই লক্ষ্য করছিল। কলি অন্তিকের কাছাকাছি আসতেই অন্তিককে সরিয়ে নেয়। এতটুকু করেই মিষ্টি ক্ষান্ত হয়নি, অন্তিককে জড়িয়ে ধরে তার বুকের বাম পাশটায় মাথা রাখে। চোখের ইশারায় কলিকে বুঝায় যে, “আমার বর, আমার সম্পত্তি। তুই কেরে কলি বাঁশের ফলি!”
কলি রাগে ফুসফুস করছে। যদি তার হাতে ক্ষমতা থাকতো তবে মিষ্টিকে আজ শেষ করে ফেলতো। মিষ্টিকে শায়েস্তা করার ইচ্ছে মনে পোষণ করে হাসিমুখে বলে,” তুমি ফিরে এসেছো অন্তিক ভাই!”
অন্তিক খানিকটা বিরক্ত হয়। এতো মানুষের প্রশ্নের জবাব সে দিতে আসেনি। অন্তিককে চুপ থাকতে দেখে মিষ্টিকে শুনিয়ে শুনিয়ে পুনরায় বলতে শুরু করে, ” বাড়ির ছেলে ফিরে এসেছো সাথে এই মেয়েকে কেন আনতে গেলে! তুমি কী ভুলে গেছো, এই মেয়েই মোল্লা বাড়ির নাম, গৌরব ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে!”
প্রথমে লায়লা বেগম এরপর তার মেয়ে। অন্তিকের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে একই প্রশ্নের উত্তর বার বার দিতে ইচ্ছে করছে না। তাই কলির কথা গ্রাহ্য না করে সিঁড়ি ডিঙিয়ে উপরে উঠতে নিতেই কলি তাচ্ছিল্যের সাথে বলতে শুরু করে,” কার পাপের ফলকে নিজের বলে চালাতে চাইছো, অন্তিক ভাই! আমি তোমাকে সত্যিই ভালোবাসতাম। তোমায় পেলে এই মেয়ের মতো নষ্টামি করে বেড়াতাম না!”
অন্তিকের কী যে হলো! দুর্বল শরীরে গরম র’ক্ত প্রবাহিত হতে শুরু করল। ফলস্বরূপ কলির নরম তুলতুলে গালে অন্তিকের পাঁচ আঙুলের ছাপও পড়ে গেলো। কলি গালে হাত দিয়ে চিৎকার করে বলে,” অন্তিক ভাই?”
লায়লা বেগম সব ছেড়ে ছুঁড়ে মেয়েকে আগলে নেন। অনুনয়ের সাথে বলেন, “ছেড়ে দাও বাবা, ও কিছু বুঝে না।”
মিষ্টি অট্টহাসি হাসে। উপহাস করে জোরে বলে, ” অন্তু আবার কবে থেকে আপনার বাবা হলো, লায়লা কাঁঠ পোড়া কয়লা চাচী আম্মা!”
চলবে…………….
#যদি_দেখার_ইচ্ছে_হয়
#আফসানা_মিমি
|পর্ব: তেইশ|
লায়লা বেগমের অপকর্মের জন্য আদৌও অনুতপ্ত কী না তা দেখার বিষয়। মধ্যরাত, পুরো পৃথিবী শান্ত। শান্ত দিবালোকের কিচিরমিচির শব্দ করা পাখিরাও। সারাদিনের এপাড় থেকে ঐপাড়ে ঘুরেফিরে শান্তিতে ঘুমাচ্ছে। শুধু ঘুম নেই মোল্লা বাড়ির মানুষদের। লায়লা বেগম কোমড়ে হাত রেখে বুকে নিঃশ্বাস আটকে হাত চালাচ্ছেন। আজ রসাইঘর তারই রাজত্ব কিন্তু সেটা কাজের লোক হিসাবে না সম্রাজ্ঞী হিসেবে সেটাই ভাববার বিষয়। লায়লা বেগম ঘোরের মধ্যে বসবাস করছে। ভাবনায় বিভোর হয়ে আলুর পরিবর্তে নিজের হাতখানা রাখে ব’টির উপরে। ফিনকি দিয়ে র’ক্ত বের হচ্ছে সেদিকে তার খবর নেই। কলি মায়ের খোঁজ নিতে রন্ধনশালায় আসলে লায়লা বেগমকে দেখে চিৎকার দেয়। গায়ের ওড়না খুলে হাতে প্যাঁচিয়ে বলে,” কি করছো, মা! হাত কে’টে র’ক্ত ঝড়ছে সেই খবর আছে?”
” বাহিরের র’ক্ত মুছে ফেললেই পরিষ্কার হয়ে যায় কিন্তু অন্তরে যেই র’ক্ত বছরের পর বছর ঝড়ছে সেই র’ক্ত কীভাবে মুছবি,কলি?”
মায়ের কথার মর্মার্থ বুঝতে পারছে না কলি। তার সমস্ত মন কা’টা স্থানে। ছোটকাল থেকে কলি দেখে এসেছে তার মা পাপী রকমের মানুষ। প্রথম প্রথম সেও মায়ের উপর বিরক্ত হতো কিন্তু এই নশ্বর পৃথিবীতে নিজের শক্তস্থান বানাতে পাপী হতে হয় সবাইকে। লায়লা বেগমও তাদের মধ্যে একজন।
” কি গো কলি বাঁশের ফলি, মা মেয়ে মিলে কি ফন্দী আটছো শুনি? নাকি আমাকে কীভাবে বাড়ি থেকে বের করবে তা ভাবছো। এদিকে ক্ষুধার্ত আমি এবং আমার বাচ্চা পাগল হয়ে যাচ্ছি।”
” মায়ের হাত কে’টে গেছে, অসভ্য মেয়ে। তোমার পেটে যে আছে রাক্ষস নাকি? এতটুকু সময় সহ্য হচ্ছে না?”
অল্পতে ভেঙে পড়ার মেয়ে মিষ্টি নয়। সে অবাক হয়ে যাওয়ার ভান ধরে বলে,” ইশ কী বলছো গো ননদিনী! দেখি দেখি! কোথায়, কতটুকু কে’টে’ছে? আহারে, লায়লা কাঠ পোড়া কয়লা চাচী আম্মা কলিজা পোড়া শুরু হতে না হতেই হাত কে’টে ফেললেন? নট ব্যাড! দাঁড়ান আমি মলম আনছি, দুই একদিনে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ভাববেন না অন্তরের দোহন এতো জলদি নিভে যাবে। সবাই অপরাধের প্রতিফল পাবে।”
প্রথমে কথাগুলো রসে সয়ে বললেও শেষ কথা যে লায়লা বেগমকে খোঁচা দিয়ে বলেছে তা ঠিকই বুঝতে পারছে লায়লা বেগম। সে কটমট চোখে হাত ছাড়িয়ে নেয়। এবং বলে, ” এক মাঘে শীত যায় না, মেয়ে! আমারও দিন আসবে সেদিন একদম জানে শেষ করে ফেলব।”
” নারীকে অগ্নিও বলা যায়, আপনি আগুন হলে অপরপক্ষে পানি মনে করো খুশি হবেন না লায়লা কাঠ পোড়া কয়লা চাচী আম্মা! আগুন যেমন সব জ্বালিয়ে দেয় পানি তেমন ভাসিয়ে নেয়!”
লায়লা বেগম কথা বাড়ায় না। হাত ঝাড়তে ঝাড়তে নিজের ঘরে চলে যায়।
———————————-
ভোরে পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ ভেসে আসছে। জানিয়ে দিচ্ছে তারা সকাল হয়েছে। সকালের নাশতা মিষ্টি বানিয়ে ফেলেছে। লায়লা বেগম যে আজ সকালে উঠবেন না তা মিষ্টির জানা। সে এবং অন্তিক এই বাড়িতে লায়লা বেগমকে শায়েস্তা করতে নয় বরং নাজিমউদ্দীনের মৃত্যুর রহস্য উদঘাটন করতে এসেছে। কিন্তু মিষ্টির দুষ্ট মাথায় লায়লা বেগমকে মাঝে মাঝে জ্বালাতন করার বুদ্ধি ঘুরঘুর করে। লায়লা বেগমের মুখে মিষ্টি কোন ভয়ভীতি উপলব্ধি করতে পারেনি। কাউকে খু’ন করার পর একজন মানুষ কখনোই স্বাভাবিক থাকতে পারে না। তার আচরণে পরিবর্তন আসবেই।মিষ্টি বিশেষ কিছু দেখতে পায়নি লায়লা বেগমের মধ্যে। ও যতটুকু বুঝেছে, লায়লা বেগম প্রচন্ড লোভী। সংসারের চাবিকাঠি তার হওয়ার লোভ প্রচুর। মিষ্টি ভাবে, নাজিমউদ্দীনের মৃত্যুর রহস্য উদঘাটন হলে সে লায়লা বেগমকে এই বাড়ি উপহার দিবে। কিছু মানুষ আছে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ভালো হয় না। লায়লা বেগম হয়তো তেমন!
অন্তিক নাজিমউদ্দীনের বিছানার উপর শক্ত হয়ে বসে আছে। নাজিমউদ্দীনের মৃত্যুর পর আজই তার এই ঘরে আসা। এলোমেলো ঘরে প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। শাওন তাদের সাথে, আইনের লোক ছাড়া বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করার শাস্তি পেতে হবে। শাওন এসেই পুনরায় তদারকি শুরু করে দেয়। কিন্তু পূর্বের মতোই সে বিশেষ কিছু খুঁজে পায় না। মিষ্টি দরজায় দাঁড়িয়ে দেখছে অন্তিককে। শুকনো মুখশ্রী দেখে মিষ্টির অন্তর ধক করে উঠে। অন্তিক মিষ্টির দিকে তাকায় ফলস্বরূপ দুজনের চোখাচোখি হয়ে যায়। মিষ্টি হাসলে অন্তিকও সৌজন্য হাসে। ইশারায় জিজ্ঞেস করে, তুমি ঠিক আছো?”
মিষ্টিও ওর মতো ইশারায় জবাব দেয়, ” আমি ঠিক আছি, কিন্তু বাবু ঠিক নেই।”
অন্তিক উদ্বিগ্ন হয়ে মিষ্টির কাছে এসে পেটে হাত রেখে প্রশ্ন করে, ” খারাপ লাগছে? পেট ব্যাথা করছে? ডাক্তার ডাকবো?”
” ডাক্তার চলে আসতেই রোগী সুস্থ হয়ে গেছে।”
অন্তরা মিটিমিটি হাসছে। অন্তিক বউয়ের দুষ্ট বুদ্ধি দেখে মাথা চুলকে বলে, ” দুষ্ট মেয়ে।”
মিষ্টি খিলখিল করে হেসে ফেলে। অন্তিকের হাত পেটে চেপে বলে,” আমরা দুষ্ট নই, আমাদের দুইজনের ভালোবাসার মানুষটা দুষ্ট।”
মিষ্টি কী অন্তিককে দুষ্ট বলল? প্রশ্নটা মস্তিষ্কে আসতেই চমকে তাকায় সে। মিষ্টি ততক্ষণে পালিয়েছে। দূরে দাঁড়িয়ে হেসে বলে, ” আমরা আপনার হাসিকে ভালোবাসি, আমরা আপনার দুঃখে ভালোবাসি, আমরা আপনার সুসময়ে থাকতে স্বাচ্ছন্দবোধ করি, আমরা আপনার অসময়ে পাশে থাকতে শক্তিশালী হই।”
অন্তিক প্রসস্থ হাসে। মেয়েটা বুঝে না সে কাছে থাকলেই সে স্বস্তি পায়। মিষ্টির কথার প্রত্ত্যুত্তরে অন্তিক ঠোঁট নাড়ায়,” ভালোবাসি প্রাণ, ভালোবাসি জান।”
——————
মধ্যাহ্নের ভোজনে সকলেই একসাথে খাবার খাচ্ছে। অন্তিকের আদেশমতে লায়লা বেগম ও কলি সেখানে উপস্থিত হয়েছে। কলি নিরসমুখে ভাত চিবুচ্ছে। তার দৃষ্টি মিষ্টি ও অন্তিকের দিকে নিবদ্ধ। স্বামী স্ত্রীর ন্যাকামি কার্যকলাপ দেখে পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে তার।অন্তিক যত্ন সহকারে মিষ্টিকে খাইয়ে দিচ্ছে। সেখানে কলির থাকার কথা ছিল কিন্তু ভাগ্যের উত্থানে কোথায় এসে পড়েছে সে। শাওন খাবারের এক পর্যায়ে বলল,” রুস্তম একা ছিল না।অন্য কেউ ছিল কিন্তু সে স্বীকার করতে নারাজ।”
” রিমান্ডের আবেদন মঞ্জুর হয়নি?”
” হয়েছে তো,চারদিনের।এমন কোনো টর্চার নেই যে করা হয়নি। কোনোভাবেই স্বীকার করছে না। চারদিন পর জেলে আনলে স্ত্রীর সাথে দেখা করতে চাইছে। সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে, গতকাল রাতেই আমরা বাজারের ডোবা থেকে একজন মেয়ের লা’শ পাই। শরীর ফুলে ফেঁপে গেলেও মুখের অবয়ব দেখে আশেপাশের লোকজন বলাবলি করছে মেয়েটা রুস্তমের বউ। আমরা বডি মর্গে নেওয়ার পূর্বে রুস্তমকে দেখাতেই ব্যাটা পাগলামি শুরু করে। নিজের শরীর কতবার আঘাত করেছে হিসাব নেই। অফিসাররা উপায় না পেয়ে হাত পা শেকল দিয়ে বেঁধে রেখেছে।”
অন্তিক কথাগুলো শুনে গভীর ভাবনায় পড়ে। অপরাধী নিজেই যদি অসুস্থ হয়ে যায় তবে আসল রহস্য উন্মোচন হবে কীভাবে? অন্তিক কিছু একটা ভেবে প্রশ্ন করে,
” আর ফিরোজ চাচা?”
” এখনো নিখোঁজ।
অন্তিকের কথা শেষ হতেই চমকপ্রদ লায়লা বেগম চকিতে তাকায়। চিৎকার সুরে বলে,” একদম আমার স্বামীকে খারাপের খাতায় নাম লেখাবে না। আমার স্বামীর মতো কেউ নেই দুইজাহানে।”
অন্তিক তরকারি নিচ্ছিল। লায়লা বেগমের কথা শেষ হতেই চামচ মেঝেতে ছুড়ে ফেলে চিৎকার করে বলতে শুরু করে, ” কাকে ভালো বলছো চাচী? যে মাঝরাতে মাতাল অবস্থায় স্ত্রীর উপর অমানুষিক নির্যাতন করে তাকে? কাকে ভাল বলছেন, যার ভালোমানুষির আড়ালে নারী লালসা রাক্ষস। তাকে তুমি ভালো বলছো? কেন? এতো ভালোবাসা কেন দেখাও। মানুষটার আগা গোড়া সম্পর্কে সব জেনেও কেন অন্ধ সেজে থাকো? তোমার মতো মহিলাদের উপর আমার ঘিন্না হয়। চাচার সাথে তুমিও সমান অপরাধী। চাচার খোঁজ আমি বের করবোই। অনেক প্রশ্নের উত্তর জানা প্রয়োজন!”
লায়লা বেগম থরথর করে কাঁপছে। ভয়ে নাকি রাগে তা অজানা। খাবারের ঘরে সকলেই নিশ্চুপ, মিষ্টি অন্তুিকের হাতে হাত রাখে। তার হাতও কাঁপছে। মানুষটার উত্তেজিত কণ্ঠ ভয় পাইয়ে দিয়েছে। লায়লা বেগম থমথমে সুরে বলতে শুরু করে, ” বড়ো হয়েছিস, নিজেই উত্তর খুঁজে নে। কিন্তু মনে রাখিস আমি তোকে কখনো সহ্য করিনি, ভবিষ্যতে করবও না। তুই আসেপাশে থাকলে তোর আপনজনদেরও নিঃস্ব করে দিব। আমি তোর সম্পৃক্ত সকল কিছু ঘৃণা করি।”
কথার পিঠের মিষ্টি এবার বলে ওঠে, ” ঘৃণা একমাত্র তার মনে জন্ম নেয় যার কাছে পুরো পৃথিবীই ঘৃণিত। মনি মা আপনার জন্যই এ বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে তাই না? সব কিছুর পেছনে আপনিই দায়ী, তাই না!”
” হ্যাঁ হ্যাঁ আমি দায়ী। আমিই ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলাম তোর মনি মাকে। একজন সাধুবেশী বোকা, সরল নারী ছিল তোর মনি মা। যে নিজের সম্মান নিজের রক্ষা করতে পারেনি। আমার স্বামীকে বশ করেছে শরীরের আকর্ষণ দিয়ে। আমি সব বুঝি, গ্রামের মেয়ে বলে আমি কী এমনি এমনিই ছেড়ে দিতাম? কখনোই না। বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছি তাও জানিস কী অবস্থায়! যে অবস্থায় থাকলে একজন নারীর জীবনে কলঙ্ক লাগে। মানুষ থু থু করে। আমার তো এখন মনে হয়, মেয়েটা মনে হয়তো আমাকে এখনো ধন্যবাদ জানাচ্ছে এই নরকের জীবন থেকে মেয়েটাকে মুক্তি পেয়ে।”
” মনি মা খারাপ নয়! আপনারাই তাকে ছারখার করে দিয়েছিলেন।”
মায়ের সম্পর্কিত অসংলগ্ন কথাবার্তা অন্তিক সহ্য করতে পারে না। তার চোখ জোড়া লাল বর্ণ ধারণ করে। শাওন বাজপাখির ন্যায় তাকিয়ে সব শুনছে। আজ হয়তে কিছু কালো অতীত পরিষ্কার হয়ে যাবে। অন্তিক পুরো কথা কিছুতেই শুনতে পারবেনা সে এঁটো হাতেই খাবার রেখে চলে যায়। মিষ্টি ও শাওন খুব মনোযোগ সহকারে শুনছে তাদের কাছে মনে হচ্ছে লায়লা বেগমের আজকের স্বীকারোক্তিতে মোল্লাবাড়ির অজানা কিছু অতীতের খোলাসা হবে।
————–
গভীর রাত। নির্ঘুম অবস্থায় অন্তিক বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। মিষ্টি তখন গভীর ঘুমে নিমগ্ন। সে চাইছে না এ অবস্থায় মিষ্টিকে চিন্তায় ফেলতে। লায়লা বেগমকে নির্দোষ বলবে না সে। এবাড়ির প্রতিটা সদস্যের দিকে সন্দেহের তীর যায়। সকলেই অতীতের বিষয়ে জানে শুধু বাচ্চারাই ছিল অজ্ঞ। বড়োদের মাঝে সব রহস্যের লুকায়িত। লায়লা বেগম অর্ধেক ঘটনা শুনিয়ে থেমে যায়। শাওনকে না বলেই বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। এখনো ফেরেনি সে কলিও তার মায়ের অবস্থান সম্পর্কে অজ্ঞ। বিলাপের সুরে কাঁদছে। লায়লা বেগম কোথায় গিয়েছে কেমন আছে কি অবস্থায় আছে জানা যায়নি। শাওন এখনো খুঁজে চলছে।
মধ্যরাতে পরিচিত নাম্বার থেকে কল আসায় অন্তিক ভ্রু যুগল কুঁচকে নেয়। আফিয়া ফোন করেছে, রিসিভ করতেই অপরপাশ থেকে চিন্তিত সুর শুনতে পায় অন্তিক। আফিয়া বলতে শুরু করে, ” সন্ধ্যা থেকে ছোট চাচি এবং ছোট চাচার গায়েব। তাদের ফোনও বন্ধ।”
অন্তিকের বিচলিত স্বর, ” বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় কিছু বলে যায়নি?”
” বলেছিল তো! রেস্টুরেন্টে তারা খেতে যাচ্ছে। আমিও কিছু বলেনি। ভেবেছি, অনেকদিন পর দুজনে দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে একটু একাকী সময় কাটাক। কিন্তু রাত আটটা নাগাত ফিরে না আসায় চিন্তা হচ্ছে।”
অন্তিক তিক্ত হৃদয়ে ফোনের লাইন কেটে দেয় এবং বিড়বিড় করে বলে,” বাবা মাকে কে কিডন্যাপ করবে? ফিরোজ চাচা নাকি অন্য কেউ?”
চলবে……………….