#যদি_দেখার_ইচ্ছে_হয়
#আফসানা_মিমি
|পর্ব: ছাব্বিশ|
মিষ্টির উন্মুক্ত কাঁধে ঠোঁট ছুঁয়ে অন্তিক জড়িয়ে ধরে তাকে। মিষ্টি অন্তিকের বুকের সাথে মিশে চোখ বন্ধ করে রেখেছে। অন্তিক তার বঁধুর চুলে বিলি কে’টে দিচ্ছে। মিষ্টি আরামবোধ করে স্বামীর শরীরের সাথে আরেকটু মিশে শোয়। এই মুহূর্তে তার এই শান্তি খুব প্রয়োজন। অন্তিকও বউয়ের স্বাচ্ছন্দ্য দেখে মুচকি হাসে। গুনগুন করে পছন্দের গান গেয়ে শোনায়। সময়ের খবর কারো জানা নেই। দরজায় করাঘাতের আওয়াজে চিন্তন ফিরে আসে।
” মা বাবাকে নিয়ে ফিরে এসেছে, অন্তিক ভাইয়া।”
কলির কথা শোনা মাত্রই দুজন ছিন্ন হয়ে যায়। অন্তিকের গম্ভীর স্বর ভেতর থেকে শোনা যায়, ” তোর মায়ের দ্বারা আমার মায়ের যেন কোন ক্ষতি না হয়, কলি।”
দুয়ার খুলে যায়। কলি থতমত খেয়ে অন্তিককে দেখে শুধায়, ” মা, বাবাকে নিয়ে বসার ঘরে। বাবা কথা বলছে না। তুমি দেখো না, বাবার কি হয়েছে। পিয়াস ভাইকে বলেও লাভ হয়নি, সে সাফ সাফ মানা করে দিয়েছে। বলে কি না, আমার মা বাবা কেউ নাই।”
রক্তচক্ষু নিয়ে অন্তিক ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়। তার দৃষ্টির ক্ষরণ সেই জানে আর কেউ না। কলি ঘরের ভেতরে উঁকি দিয়ে মিষ্টিকে দেখতে পায়, সে জামা কাপড় ঠিক করছে। কলির যা বুঝার হয়ে গেছে। মনের গুপ্ত দগ্ধান প্রকাশিত হয়ে আসে। ঘরের ভেতর প্রবেশ করে মনের ঝাল মেটাতে মিষ্টিকে ধাক্কা দেয় সে। আকস্মিক ধাক্কায় মিষ্টি তাল সামলাতে না পেরে বিছানায় পড়ে যায়। কলি তখন রাগে ফুসফুস করছে। দাঁতে দাঁত চেপে মিষ্টিকে বলে,” আমার অন্তিককে কেঁড়ে নিয়ে তুই শান্তিতে থাকবি, আর আমি আগুনে জ্বলে পুড়ে ছাই হবো! তুই এতো ছলনা করিস কীভাবে রে? আমার অন্তিককে ফিরিয়ে দে! তুই তো কয়েকমাস ধরে চিনিস, আর আমাকে দেখ! ছোট বেলা থেকে অন্তিককে মনে প্রাণে চাই।”
মিষ্টি বিহ্বল হয়ে গেছে। মূর্ছা যায়নি সে। তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে কলিকে দেখে এরপর বলতে শুরু করে, ” তুমি কী অন্তুকে না দেখে তার গল্প শুনে প্রেমে পড়েছো? নাকি তার কষ্টের খবর জেনে কেঁদেছ! দিনের পর দিন তোমার মা যখন অন্তুকে ঘরে বন্দী করে রাখতো তখন কী তোমার কষ্ট হতো? আমার হতো কলি, যখন দাদা চিঠি লেখে অন্তুর কষ্টের কথা জানাতো তখন অনেক কষ্ট হতো! খেতে ইচ্ছে করতো না, ঘুমাতে পারতাম না। তার কষ্টে মনের মধ্যে কষ্ট হতো। ইচ্ছে করতো, ছুটে এসে মানুষটাকে আগলে নেই। তোমার কী এমন লাগতো? তুমি অন্তুর কষ্টে কতো বেলা অনাহারে ছিলে? বলো!”
কলি নির্বাক, সত্যিই সে এমন কিছুই করেনি। ছোট বেলা থেকেই অন্তিকের সাথে মায়ের দুরদুর আচরণ দেখে সে অভ্যস্ত। তার কাছে অন্তিক মানেই মোমের পুতুল ছিল। সে ভেবেছিল অন্তিকের ব্যাপারে লায়লা বেগমকে বললেই সে রাজি হয়ে যাবে। কিন্তু হয়েছে তার উল্টো। কলি বুঝেও বুঝছে না, পাগলের মতো আচরণ করতে শুরু করে, ” আমার অন্তিক ভাইকে চাই, ঐসব হিসাব নিকাশ তুই কর।”
সাবলীলভাবে বুঝিয়েও মিষ্টি যখন দেখল কলি দ্যা বাঁশের ফলি সোজা হচ্ছে না তখনই সে তার দুষ্ট রূপে ফিরে আসে। কলির কাছে এসে গাল বরাবর দুইটা ঘা বসিয়ে বলে, ” তোর মতো গর্দভ, নির্লজ্জ মেয়ে এই জীবনে দেখিনি। এই তুই কী খেয়ে বড়ো হয়েছিস রে, কলি বাঁশের ফলি! আজ থেকে তোকে দেখলেই ঝাটা পিটা করব বুঝলি! এতোদিনে তুই যেহেতু ভালো হসনি, ভবিষ্যতেও হবি না। কান খুলে শুনে রাখ, অসুস্থ বলে দুর্বল ভাববি না।অন্তিকের দিকে নজর দিলে মেরে একদম ডাস্টবিনের ফেলে রেখে আসবো।”
কলিকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে মিষ্টি বাথরুমে চলে যায়। কলি দ্যা বাঁশের ফলি দাঁড়িয়েই কাঁদতে থাকে।
—————————-
সন্ধ্যালগ্নে লায়লা বেগমের ঘরের সামনে শাওন সহ কিছু পুলিশ অফিসার দাঁড়িয়ে আছে। সকলের হাতেই অস্ত্র। মোল্লা বাড়ির সকল সদস্য দূরে দাড়িয়ে রয়েছে। কলি কেঁদেকুটে একাকার। লায়লা বেগম বাড়ি প্রবেশ করে বসার ঘরে জায়গা নিলেও কিছুক্ষণ পর ফিরোজ চেয়ার ছেড়ে উঠে লায়লা বেগমের চুলের মুঠোয় ধরে টানতে টানতে ঘরে প্রবেশ করো দরজা আটকে দেয়। বাড়ির সকলের কর্ণধারে লায়লা বেগমের আর্তচিৎকার প্রবেশ করলেও কেউ নড়চড় করেনি। একমাত্র কলি চিৎকার করে দরজায় করাঘাত করে মাকে ছেড়ে দিতে বলেছিল। শাওনকে পিয়াস লায়লা বেগমের মোল্লা বাড়িতে আগমন ঘটার সংবাদ জানায়। শাওন আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। বর্তমানের পরিবেশ খুবই ভয়ঙ্কর। কেননা বিকাল নাগাদ প্রথমে লায়লা বেগমের আর্তচিৎকার শোনা গেলেও কিছুক্ষণ পর ফিরোজের আর্তচিৎকার শোনা যায়। সেই থেকে সকলেই আতঙ্কিত।
” পুলিশ আপনাদের ঘেরাও করে রেখেছে, দরজা খুলুন মিসেস লায়লা!”
শাওনের হুঙ্কারে সকলেই সটানভাবে দাঁড়িয়ে যায়। সহকারী অফিসাররা দরজা ভাঙার জন্য প্রস্তুত নিতেই লায়লা বেগম দরজা খুলে দেয়। তার গায়ে র’ক্তে মাখামাখি। কলি মা বলে আর্তনাদ করে ওঠে। শাওন কাল বিলম্ব না করে হাতকড়া লায়লা বেগমের হাতে পরিয়ে দেয়। বাকী অফিসাররা ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে। কলি দৌড়ে আসতে নিতেই পিয়াস বোনকে আটকায়, তার চোখ মুখ শক্ত। রুনা দুর্বল পায়ে সিঁড়ি ডিঙিয়ে নিচে নামছিল, লায়লা বেগমের র’ক্তা’ক্ত শরীর দেখে দ্রুত নেমে তার কাছে এসে বলতে শুরু করে, ” এ কি অবস্থা করেছেন, ভাবী? কি হয়েছে আপনার, শরীরে এত র’ক্ত কেন?”
লায়লা বেগম অদ্ভুত ভঙ্গিতে শুধায়,” তোর পাপীদের বিনাশ করেছি,রুনা। তাদের অপবিত্র র’ক্ত বয়ে বেড়াচ্ছি। তুই আজ থেকে শান্তিতে ঘুমাতে পারবি রে! পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিস! সাম্রাজ্যের লোভে পড়ে তোর ছেলের সাথে খুব অন্যায় করেছি। বাকী জীবন তোরা সুখে থাকিস।”
রুনা নির্লিপ্ত কণ্ঠে উত্তর দেয়, ” আমি তো সেই কবেই মরে গেছি, ভাবী! যেদিন অন্তিকের বাবা আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। ছেলেকে বুকে আগলিয়ে যখনই বাঁচতে চাচ্ছিলাম তখনই দ্বিতীয়বার ভুল করি। আর এই ভুলের মাশুল যেমনভাবে দিতে হয়েছে, তা যেন আর কাউকে দিতে না হয়।”
লায়লা বেগমের থমথমে দৃষ্টি যায় অন্তিকের উপর। সে বলে,” আমি মনে করতাম, রুনা ফিরোজকে ফাঁসিয়েছিল তাই সারাজীবন তোকে কষ্ট দিয়ে এসেছি। কেন যেন আজও তোকে আমি সহ্য করতে পারি না। এই দেখ না, স্বামীকে নিজ হাতে খু’ন করেছি তবুও শান্তি পাচ্ছি না। আমি কতো নির্দয় দেখলি তো!”
” কিন্তু আমি তোমাকে সারাজীবন সম্মান করে এসেছি,চাচী। কেন এমন করতে গেলে?”
” কায়েস ও ফিরোজ নামক জঘন্য মানুষদের এই দুনিয়াতে জায়গা নেই। এদের চৌদ্দ শিকলও আটকাতে পারবে না। আমার কাজ আমি করে গেলাম। কলিকে দেখে রাখিস। রাজপুত্র দেখে বিয়ে দিস। মেয়ে আমার তোর বড্ড পাগল।”
কলি লায়লা বেগমকে জড়িয়ে ধরে বলতে শুরু করে, ” মা, আমাকে ফেলে যেও না। ”
” অন্তিক ও মিষ্টির জীবনে আর ঝড় আনিস না। তারা এখন থেকে তোর অভিভাবক।”
পিয়াস মাথা নিচু করে সব শুনে। লায়লা বেগম ছেলের সামনে দাঁড়িয়ে বলে, ” ক্ষমা করে দিস বাবা। এবার বউমাকে ঘরে নিয়ে আয়! তোর খারাপ মা আজীবনের জন্য চলে যাচ্ছে।”
পিয়াস লায়লা বেগমকে জড়িয়ে ধরে বলে, ” আমি তোমার এই রূপ দেখতে চাইনি, মা! ”
” আমার কষ্ট আজ বুঝলি, তাতেই আমি খুশি।”
মিষ্টির উদ্দেশ্যে লায়লা বেগম পরিশেষে বলে যায়, ” এই সংসার আজ থেকে তোর, তোর রাজত্ব সবখানে। আজ তুই জিতে গেলি আর আমি হেরে গেলাম রে!”
স্ট্রেচারে করে ফিরোজের লাশ ঘর থেকে বের করা হচ্ছে। কলি আর কাঁদছে না। বাবাকে দেখতেও যাচ্ছে না। পিয়াসও নীরব, যেন সেও পূর্ব থেকে সব অবগত।
অন্তিক ঘোরের মধ্যে আছে। লায়লা বেগম ও রুনার বলা কথা শোনার পর ছটফট করছে সত্যি কথা জানার জন্য। রুনা বিষয়টি বুঝার পর বলে, ” তোর আসল বাবা কায়েস নয়।”
” তাহলে, আমার বাবা কে? তার নাম কী?”
প্রশ্ন রয়েই যায়! কে অন্তিকের বাবা! নাম কী তার?
চলবে…………….