#যদি_নির্বাসন_দাও (পর্ব ৩)
১.
বাসায় ফিরতে সন্ধ্যা পেরিয়ে যায়। গাড়িটা পার্ক করে ভেতরে ঢুকতেই মা উৎকন্ঠা নিয়ে দরজা খোলেন।
‘কী রে, বললি সন্ধ্যার আগেই চলে আসবি। এত দেরি করলি?’
মেহুলি মায়ের দিকে তাকায়। মা এখানে এসেছে আজ দুদিন হলো। ছোট ভাই হিমেল দিয়ে গিয়েছে। কদিন নাকি থাকবে ওর সঙ্গে। নিশ্চয়ই এমনি এমনি আসেনি। সেই পুরনো কথাই বলবে।
মেহুলি পরনের ওভারকোট খুলতে খুলতে বলে, ‘আসার সময় এখানকার সুন্দর একটা রিসোর্টে গিয়েছলাম। তাই দেরি হয়ে গেল।’
জাহানারা দরজা লাগিয়ে সামনে এসে বলেন, ‘আচ্ছা, তুই ফ্রেশ হয়ে আয়৷ আমি নাস্তা বানিয়েছি। চা করব?’
মেহুলি মাথা নেড়ে ভেতরে চলে যায়।
হাত মুখ ধুয়ে জামা কাপড় সব চেঞ্জ করে। ফুলহাতা একটা ফতুয়া আর বাসায় পরার একটা ট্রাউজার পরে বসবার ঘরে আসতেই দেখে মা নুডুলস বেড়ে বসে আছেন। ক্ষিধে পেয়েছে খুব। নুডুলসের বাটি হাতে নিয়ে বলে, ‘হিমেলের বাচ্চাটা এখন কেমন আছে? মাঝে শুনেছিলাম অসুখ করেছিল?’
জাহানারা খেতে খেতে বলেন, ‘এখন ভালো আছে। আসার সময় আমার পিছু নিয়েছিল। অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে রেখে এসেছি।’
মেহুলি আগ্রহের গলায় বলে, ‘তা নিয়ে আসতে। পিচ্চিটা এলে ভালোই লাগে।’
জাহানারা সুযোগটা নেয়। গলাখাঁকারি দিয়ে বলেন, ‘আমিও তো সে কথাই বলতে এলাম। এবার বিয়েটা কর মেহুলি। তোর ছোট ভাইয়ের পাঁচ বছরের একটা বাচ্চা হয়ে গেল। অথচ তুই এখনও বিয়েই করলি না। ঠিক সময়ে বিয়ে করলে এতদিনে অমন দু দুটো বাচ্চা থাকত।’
মেহুলি খাওয়া থামিয়ে খর চোখে তাকায়, তারপর গম্ভীরমুখে বলে, ‘তুমি আবার সেই পুরনো কথাই বলতে এসেছ? আমি তো বলেছি বিয়ে করব না।’
জাহানারা উষ্ণ গলায় বলেন, ‘কেন করবি না? এতদিন বললি যে তোর এম ডি ডিগ্রি না হলে বিয়ে করবি না। সেটা হয়েছে তাও দু’বছর পেরোল। অথচ তোর বয়সী সবাই কত আগেই বিয়ে করে ফেলেছে।’
মেহুলি উঠে গিয়ে হাত ধুয়ে এসে বলে, ‘সবার জীবন কি একরকম হয়? এই যে আমাদের সুস্থ বাবাটা হঠাৎ একদিন পঙ্গু হয়ে বাসায় ফিরল, এমন কি সবার হয়?’
জাহানারা থমকে যান। মেহুলির বাবার নরসিংদীতে মুদির দোকান ছিল। খুব বেশি রোজগার না থাকলেও চলে যেত। মেহুলি যেদিন ঢাকা মেডিকেলে চান্স পেল সেদিনই আজাহার এক্সিডেন্ট করে পা হারাল। মেহুলির ছোট ভাই হিমেল তখন ক্লাশ এইটে। আর ছোট বোন তুলি তখন ক্লাশ থ্রিতে। জাহানারা যেন অকুল সাগরে পড়লেন। তখন মেহুলিই সংসারের হাল ধরল। ঢাকা মেডিকেলের ছাত্রী হওয়াতে খুব সহজেই ভালো ভালো কিছু টিউশন পেয়েছিল। রাত দিন পরিশ্রম করে টাকা পাঠাত। হিমেল ইউনিভার্সিটি শেষ করা পর্যন্ত মেহুলিই সংসার চালিয়েছে। সে সময়টা বার বার মনে হতো মেয়েটা বিয়ে করে ফেললে তো ওরা না খেয়ে মরবে৷ তাই মেহুলি যখন এমবিবিএস পাস করে বেরোল তখনও জাহানারা মেয়ের বিয়ে নিয়ে উচ্চবাচ্য করেনি। হিমেল বের হলো আরও চার বছর পর। এখন ভালো একটা বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি হয়েছে। ছোট মেয়েটাও পড়াশোনা শেষ করে সবে চাকরিতে ঢুকল। সংসারে আর আগের সেই টানাটানি নেই। কিন্তু জাহানারার মনের ভেতর গোপন একটা অপরাধবোধ আছে। মেহুলি যে ভাই বোনদের মানুষ করতে গিয়েই আর বিয়েটা করল না।
জাহানারা মন খারাপ গলায় বলে, ‘আমি স্বার্থপর মা। তাই তোর যখন বিয়ের বয়স হয়েছিল তখন জোর করিনি। নিজেরা না খেয়ে থাকব এই ভয়ে চুপ থাকতাম। আমাকে ক্ষমা করে দে।’
মেহুলি ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘মা, কিছু হলেই এই এক কথা বলো। আমি তো বলেছি এ নিয়ে আমার মনে কোন খেদ নেই। আমার জায়গায় হিমেল থাকলেও তাই করত। সে সময় বাবার দায়িত্ব কাঁধে নিতে হয়েছিল এটা নিয়ে আমার মনে কোনো খেদ নেই। বরং গর্ব হয়। তোমাদের ওপর আমার কোনো রাগ নেই। সত্যি বলছি মা। সবার জীবন যে গল্পের মতো গোছানো হবে তা হয় না। আমারটা না হয় এলোমেলো হয়েছে। হিমেল, তুলি ওদেরটা গোছানো হচ্ছে। তাতেই আমি সুখী।’
জাহানারা ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে বলেন, ‘তুলির বিয়ের সমন্ধ আসছে। একটা জায়গায় কথাও হয়েছে। কিন্তু তুলি কিছুতেই তোর বিয়ে না হলে বিয়ে করবে না।’
মেহুলি হাসে। কদিন আগেই তুলি ফোন দিয়েছিল। অনেক ঝোলাঝুলি করল ওর বিয়ের জন্য। মা নাকি একটা পাত্রও দেখে রেখেছে ওর জন্য। তারপর তুলি অনেকক্ষণ ওর হবু বরের গল্প করল। কবে ওরা বিয়ে করবে, বিয়ে করেই বিদেশে পাড়ি জমাবে সেই প্ল্যানও করেছে। সেজন্য কদিন আগে নাকি পাসপোর্টও করেছে। আর মা বলছে তুলি নাকি ওর বিয়ে না হলে বিয়ে করবে না। মা কি বোকা? নাকি এমনিতেই বলার জন্য বলছে?
মেহুলি চোখা গলায় বলে, ‘তুলি তো ইতোমধ্যে বিয়ের তারিখ ঠিক করে ফেলেছে। আর তুমি বলছ বিয়ে করবে না।’
জাহানারা তোতলানো গলায় বলেন, ‘বিয়ের তারিখ ঠিক করলেই সব হলো? ছেলের বাড়ির কত কত খরচ।’
এবার ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়। আর তাতে করে মনের ভেতর একটা কষ্ট টের পায়। মেহুলি ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে বলে, ‘তুলির বিয়ের ব্যবস্থা করো। যা খরচ হয় আমি দেব।’
জাহানারার চোখ চকচক করে উঠে। উজ্জ্বল মুখে বলে, ‘তুই তো দিবিই। আমি হিমেলকেও বলেছি, মেহুলি আর কত করবে। এবার তুলির দায়িত্বটা ও নিক। বিয়ের খাওয়ার খরচ দিতে রাজি হয়েছে হিমেল। তুই ওর গহনার দায়িত্বটা নে। এটাই শেষ। এরপর আর কারও দায়িত্ব নিতে হবে না।’
মেহুলি ম্লান হাসে, ‘হ্যাঁ মা। আমার দায়িত্ব ফুরোল। এবার আরাম করে পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে ঘুমাব।’
কথাটা বলে মেহুলি উঠে পড়ে। জাহানারা ফ্যালফ্যাল চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে।
রাতে ঘুমানোর সময় জাহানারা মেয়ের রুমে আসে। মেহুলি বিছানায় আধশোয়া হয়ে শীর্ষেন্দুর ‘যাও পাখি’ গল্পটা পড়ছিল।
জাহানারা মেয়ের গা ঘেঁষে বসে। তারপর চুলে হাত বোলাতে বোলাতে বলে, ‘মেহুলি, তুলি কিন্তু সত্যিই তোর বিয়ে নিয়ে মন খারাপ করছিল। বড়ো বোনকে রেখে নিজে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে ওর আসলেই মন খারাপ হচ্ছে৷ তুই মা এবার না করিস না। আমি একটা ছেলে দেখেছি। হিমেলের অফিসে চাকরি করে। মস্ত ইঞ্জিনিয়ার। তোর বয়সীই হবে। তোর ছবি দেখে ওরা খুব পছন্দ করেছে।’
মেহুলি ঝট করে উঠে বসে। তারপর রাগত গলায় বলে, ‘মা, কতবার বললে আমার কথা তোমরা বিশ্বাস করবে? আমি বিয়ে করব না সেটা আর কতবার বলতে হবে? আমার জন্য দয়া করে এই করুণা করা কথাগুলো বন্ধ করো।’
জাহানারা আহত চোখে তাকায়। মেয়েটা কিছুতেই ওদের আর ক্ষমা করবে না। বড্ড স্বার্থপর হয়ে যেতে হয়েছিল। কেন যে অমন করে আজাহারের দুর্ঘটনাটা ঘটল।
জাহানারা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। উঠে যেতেই মেহুলি এবার নরম গলায় ডাক দেয়, ‘মা, বোসো।’
কেন যেন মায়ের জন্য মায়া হচ্ছে। আসলে মায়ের তো দোষ নেই। সত্যি বলতে কারও দোষ নেই। নিয়তি যা ছিল তাই হয়েছে।
মেহুলি মাকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘মা, আমার মনে কোনো দুঃখ নেই। আসলে বিয়ে করার জন্য একটা সুন্দর মনের দরকার হয়। নতুন জীবন নিয়ে আগ্রহ। নতুন একটা মানুষের সান্নিধ্য। এগুলোর কোনো কিছুই আর আমার নেই। তাই আমাকে অমন করে আর জোর করো না। তুলি বিয়ে করে ফেলুক। ওর মনটা এখনও রঙিন প্রজাপতির মতো। সেটা নষ্ট হয়ে যাবার আগেই ওর বিয়েটা দাও।’
জাহানারা ওর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলে, ‘আচ্ছা তাই হবে। তুলি আসতে চেয়েছিল কদিন পর। এখানে নাকি সুন্দর সুন্দর রিসোর্ট আছে? সেখানে একটা দিন থাকতে চায়।’
মেহুলি আগ্রহের গলায় বলে, ‘তাই? আসুক না তাহলে। খুব ভালো হবে। ওর বিয়ের আগে তুমি, আমি আর তুলি না হয় একটা রাত থাকব একসঙ্গে। কাছেই একটা সুন্দর রিসোর্ট আছে। আমি বুকিং দিয়ে দেব। ওখানকার ম্যানেজার সাহেব আমার পরিচিত। আজ তো ওখান থেকেই ঘুরে এলাম।’
জাহানারা আলতো গলায় বলে, ‘নাম কী রিসোর্টের?’
মেহুলি বলে, ‘এসেন্স রিসোর্ট। তুমি তুলিকে জিজ্ঞেস করো ও কবে আসতে পারবে। আমি বুকিং দিয়ে রাখব।’
জাহানারা একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। আর মেহুলি মনে মনে ভাবতে থাকে কী কাকতালীয় ব্যাপার। আজই ফয়সাল সাহেব ওনার রিসোর্টে থাকার কথা বলছিলেন। আর সেটা এমন করে সত্যি হয়ে যাবে ভাবতে পারেনি ও।
২.
লাল গাড়িটা পার্কিংয়ে এসে থামতেই আজ ফয়সাল নিজেই এগিয়ে যায়। পলিন কাকুও ছুটে আসে। আগেই বলা ছিল ডাক্তার আপা আসবেন। ফয়সাল ওদের জন্য সবচেয়ে ভালো বাংলোটাই দিয়েছে।
ওরা তিনজন গাড়ি থেকে নামে। ঠিক তিনজন না, কুটুসও আছে। মেহুলি আজ লাল রঙের একটা ফতুয়া সঙ্গে কালো জিন্স পরেছে। খুব সুন্দর লাগছে ডাক্তার সাহেবকে আজ।
ফয়সাল এগিয়ে যেতেই মেহুলি পরিচয় করিয়ে দেবার ভঙ্গিতে বলে, ‘মা, উনি ফয়সাল সাহেব। এই রিসোর্টের ম্যানেজার। আমার প্যাশেন্ট ছিলেন। এখন অবশ্য সুস্থ। আর ফয়সাল সাহেব, আমার মা, আর ছোট বোন তুলি।’
ফয়সাল সালাম দেয়। জাহানারা একবার আপাদমস্তক দেখেন। তুলিও কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে থাকে।
ইতোমধ্যে উইলিয়াম আর পলিন কাকু মিলে ওদের লাগেজ নামিয়ে রেখেছে। একজন একটা ট্রেতে ছোট ছোট গ্লাসে জুস নিয়ে আসে।
রিসেপশনের ফর্মালিটি শেষ করে ওদের বাংলোটা দেখিয়ে দেয়। তারপর বলে, ‘কিছু লাগলে ফোন দিয়ে বললেই হবে। আর আমাদের এখানকার কুক খুব ভালো। যা খেতে মন চায় শুধু বলবেন।’
মেহুলি হাসে, ‘হ্যাঁ, অবশ্যই বলব। রাতে ব্যাম্বু চিকেন খাব এটা এখুনি বলে দিলাম।’
ফয়সাল হাসে। ওরা বাংলোর দিকে এগোয়।
তুলি একবার পেছন ফিরে ফয়সালকে দেখে। তারপর মেহুলির কানের কাছে মুখ রেখে বলে, ‘আপু, ম্যানেজার সাহেব তো হেভি হ্যান্ডসাম।’
তুলি লম্বায় প্রায় মেহুলির সমান। ওর মতো গায়ের রঙ ফর্সা না হলেও উজ্জ্বল শ্যামলা। চোখে কাজল দেওয়াতে মায়াবী লাগে। কম বয়েসী সব আবেগ, কৌতূহল এখনও বিদ্যমান।
মেহুলি মজা করে বলে, ‘তোর পছন্দ? বলব ওনাকে?’
জাহানারা ধমক দেয়, ‘কী শুরু করলি তোরা? একটা হোটেলের সাধারণ ম্যানেজার নিয়ে এমন কথা বলিস কী করে? নজর উঁচু কর।’
মেহুলি থমকায়। কিছু বলতে গিয়েও বলে না।
কাঠের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই তুলি আনন্দে চিৎকার করে উঠে, ‘ওয়াও, এত্ত সুন্দর!’
জাহানারাও প্রশংসার গলায় বলে, ‘বাহ! ভেতরটা তো খুব সুন্দর।’
মেহুলি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। মেঝেতে পাটি বিছানো। ওপরে বাঁশ আর শনের ছাদ। একপাশে আলাদা করে দুটো সোফাতে বসার ব্যবস্থা।
ইতোমধ্যে তুলি ব্যালকনির দরজা খুলে বাইরে গিয়েই চিৎকার করে, ‘আপু, আম্মুউউ। তাড়াতাড়ি এসো এদিকে, দেখে যাও।’
ওর অমন ডাকে ওরা ছুটে ব্যালকনিতে আসতেই থমকে যায়। সামনেই পাহাড়, তার গায়ে সবুজ সব গাছ। ওপরে ঝকঝকে নীল আকাশ। দূরে যতদূর তাকিয়ে থাকা যায় নয়ন জুড়ানো পাহাড়ের সারি। এক মুহূর্তে মন ভালো হয়ে যায়।
জাহানারা মুগ্ধ গলায় বলে, ‘বাহ, এই হোটেলটা তো আসলেই খুব সুন্দর।’
তুলি ধমক দেয়, ‘কী হোটেল হোটেল করছ। এটা রিসোর্ট। আপু আমাকে কয়টা ছবি তুলে দে তো।’
মেহুলি হেসে ওর অনেকগুলো ছবি তোলে। তারপর মোবাইলটা দিতেই তুলি মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। নিশ্চয়ই ওর হবু বরকে পাঠাবে। মেহুলি ওর উজ্জ্বল মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকে। আনন্দিত একটা মুখ। এই বয়সটা ও-ও পার করে এসেছে কিন্তু ততটাই নিরানন্দ নিয়ে।
বিকেল হতেই সবাই রুম থেকে বেরিয়ে ওপরের সেই সমতল ভূমিতে চলে আসে। তুলি ইতোমধ্যেই দোলনাটা দখল করে নিয়েছে। চার পাঁচটা ইজিচেয়ার ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা। মেহুলি মাকে নিয়ে চেয়ারে বসে। বিকেলের নাস্তার কথা বলা হয়েছে – মমো, চিকেন উইং, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই আর মালাই চা।
মেহুলি মায়ের সঙ্গে গল্প করছিল। ঠিক তখুনি একজন বয়স্ক মহিলা সঙ্গে একজন ভদ্রলোক ওদের সামনে এসে দাঁড়ায়। মহিলাটা পরিচিত মানুষের গলায় বলেন, ‘আরে আপা, আপনি এখানে?’
জাহানারা ঘুরে তাকায়, তারপর অবাক গলায় বলে, ‘আরে সুফিয়া আপা, আপনি এখানে বেড়াতে এসেছেন বুঝি?’
সুফিয়া আপা মাথা নেড়ে বলেন, ‘ছেলের জোরাজুরিতেই আসা। কোথাও নাকি আমি বের হই না, তাই এবার বান্দরবানে মেঘ দেখতে এলাম। এই বুঝি আপনার মেয়ে?’
জাহানারা একবার মেহুলির দিকে তাকায়, তারপর বলে, ‘হ্যাঁ, আমার বড়ো মেয়ে, ডাক্তার মেহুলি। খুব বড়ো হার্টের ডাক্তার। আর ওই যে, ও হলো তুলি। আমার ছোট মেয়ে। মেহুলি, এটা তোর এক আন্টি।’
মেহুলি ভ্রু কুঁচকে এতক্ষণ এদের কথা শুনছিল। সুফিয়া নামে মায়ের পরিচিত কেউ আছে ওর জানা নেই। মেহুলি সালাম দেয়।
সুফিয়া সালাম নিয়ে বলে, ‘কী মিষ্টি আপনার মেয়ে! এই আমার ছেলে, বাপ্পী। একটা কোম্পানিতে আছে। ইঞ্জিনিয়ার।’
মেহুলি এবার ভালো করে লোকটাকে দেখে। মাঝারি উচ্চতা, চৌকো মুখ, চোখে সানগ্লাস, গায়ের রঙ কালো। একটা নীল স্যুট পরা। মানুষ বেড়াতে এসে এমন স্যুট পরে থাকে? আর এই ভদ্রলোক মাকে নিয়ে এসেছে বেড়াতে? এর বউ বাচ্চা কই? নাকি ওর মতোই বিয়ে করেনি?
মেহুলির হঠাৎ করে মায়ের কথা মনে পড়ে যায়। সেদিন রাতে কী যেন এক ইঞ্জিনিয়ার পাত্রের কথা বলছিল? ওর সঙ্গে কথা বলতে চায় পাত্র পক্ষ। এই লোক সেই পাত্র না তো? তাহলে কি তুলি আর আম্মা মিলে ইচ্ছে করেই একটা রিসোর্টে থাকার বাহানা করেছিল?
এর মাঝ ওদের নাস্তা চলে আসে। জাহানারা আন্তরিক গলায় বলে, ‘বাপ্পী, আমাদের সঙ্গে এসে বোসো। একসঙ্গে নাস্তা করি।’
রিসোর্টের দুটো ছেলে টেবিল আর চেয়ার টেনে ঠিক করে দেয়। লম্বা একটা টেবিলের দুপাশে ওরা বসে। মেহুলির মুখ গম্ভীর। তুলি কেমন ছটফট করছে। আর মা অকারণেই বেশি কথা বলছে।
মেহুলি একবার এদিক-ওদিক তাকায়। নাহ, ফয়সাল সাহেবকে আশেপাশে দেখা যাচ্ছে না।
খাওয়ার এক পর্যায়ে তুলি উঠে গিয়ে আবার দোলনায় গিয়ে বসে। আর মা আর সুফিয়া আন্টি উঠে দাঁড়ান। গল্প করতে করতে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ান। মেহুলির হুট করেই মনে হয় ওর সন্দেহটা সত্যি। এরা পাত্রী দেখতে এসেছে।
বাপ্পী গলাখাঁকারি দিয়ে বলে, ‘আপনি বুঝি কার্ডিওলজিস্ট?’
মেহুলি গম্ভীরমুখে বলে, ‘শুনলেনই তো একটু আগে।’
বাপ্পী একটু থতমত খেয়ে যায়। তারপর হেসে বলে, ‘খুব ভালো লাগল আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে। চেনাজানার মধ্যে হার্টের একজন ডাক্তার আছে ভাবতেই ভালো লাগে।’
মেহুলির বলতে ইচ্ছে করে, আপনার ভালোলাগাটুকু ভাবনাতেই সীমাবদ্ধ রাখুন। এই সময় ফয়সালকে আসতে দেখা যায়। মেহুলি হাঁপ ছাড়ে।
ফয়সাল কাছে আসতেই মেহুলি আদুরে গলায় জিজ্ঞেস করে, ‘কী ব্যাপার, অতিথিদের রেখে আপনি কোথায় ছিলেন এতক্ষণ?’
ফয়সাল থমকায়। মেহুলি তো কখনও ওর সঙ্গে এমন গলায় কথা বলেনি।
সামলে নিয়ে বলে, ‘ওই আপনার কুটুস আর আমার টমকে খাবার দিচ্ছিলাম।’
মেহুলি এবার উঠে দাঁড়ায়, ‘দেখেছেন আমি নিজেই একদম ভুলে গিয়েছিলাম। চলুন তো দুষ্টু দুটোকে দেখে আসি।’
মেহুলি উঠে দাঁড়ায়, তারপর আর একটা কথা না বলে ফয়সালের সঙ্গে মাঠটা পেরিয়ে পাহাড়ি পথ বেয়ে নিচের দিকে নামতে থাকে।
বাপ্পী সেই সঙ্গে জাহানারা আর সুফিয়া ভুরু কুঁচকে ওদের চলে যাবার পথের দিকে তাকিয়ে থাকে।
(চলবে)
মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর
১৭/০১/২০২৫