#যদি_নির্বাসন_দাও (পর্ব ৫)
১.
মাথার ওপর টি টি শব্দে একটা পাখি ডেকে যায়। ফয়সাল চমকে তাকায়, পাখিটাকে দেখা যায় না। অনেক আগেই উড়ে চলে গেছে দৃষ্টিসীমার বাইরে। কোনো গাছের ফাঁকে হয়তো লুকিয়েছে। গাছগুলোতে নতুন নতুন সবুজ কচি পাতা দেখা যাচ্ছে গত কয়েকদিন ধরে। এই একটা ব্যাপারে ফয়সালের দারুণ আগ্রহ। কাল দিনেও যে গাছটায় ছোট ছোট কুঁড়ির মতো ছিল সেখানটায় আচমকা সবুজ পাতা গজিয়ে যায়। প্রকৃতিতে বসন্ত এসেছে।
মেহুলিরা এখান থেকে চলে গেছে তাও প্রায় মাসখানেক। এরপর এক দু’বার দেখা হয়েছে মেহুলির সঙ্গে, এই নীলাচলেই। মেয়েটা অদ্ভুত, বসে বসে পাহাড় দেখে। মাঝে মাঝে মনে হয় হারিয়ে যাওয়া কাউকে বুঝি খোঁজে।
ভাবনার এই পর্যায়ে ফোন আসে। ফয়সাল তাকিয়ে দেখে অচেনা একটা নম্বর। ধরতেই ওপাশ থেকে একটা মেয়ের গলা পায়, ‘ভাইয়া, আসসালামু আলাইকুম। আমি তুলি, মেহুলি আপুর ছোট বোন।’
ফয়সাল মনে মনে অবাক হয়। মেহুলির ছোট বোন ওকে ফোন দিয়েছে? হঠাৎই মনে পড়ে যাবার দিন ওর মোবাইল নম্বর চেয়েছিল।
ফয়সাল আন্তরিক গলায় বলে, ‘হ্যাঁ তুলি, বলো। ভালো আছ তোমরা?’
ওপাশ থেকে তুলি বলে, ‘হ্যাঁ ভাইয়া, আমরা তো ভালো আছি। কিন্তু আপুর জন্য খুব চিন্তা হয়৷ হুট করেই বান্দরবান চলে গেল। আপনি তো দেখলেন, আমরা সবাই মিলে ওর জন্য বিয়ের চেষ্টা করছি। আপনি যদি ওকে একটু বুঝিয়ে বলতেন খুব উপকার হতো।’
ফয়সাল আকাশ থেকে পড়ে। বিস্মিত গলায় বলে, ‘আমি বুঝিয়ে বলব! কী বলছ? আমার কথা শুনবে কেন?’
ওপাশ থেকে তুলি হেসে বলে, ‘আমি যতটুকু বুঝেছি আপুর সঙ্গে আপনার একটা ভালো খাতির আছে। না হলে সেদিন সবার সামনে আপু অমন করে ব্যাগ থেকে মাফলার বের করে দিত না।’
হ্যাঁ, এটা একদম ঠিক কথা। এই ঘটনার কথা পরে যতবারই মনে হয়েছে ফয়সাল ততবারই অবাক হয়েছে। সেই সঙ্গে মনের কোণে একটা অজানা আনন্দও ছুঁয়ে গেছে৷
ফয়সাল খুক করে কেশে উঠে, তারপর বলে, ‘ওটা তো এমন কিছু না। ওনার কাছে বাড়তি একটা মাফলার ছিল তাই দিয়েছে।’
তুলি চটুল গলায় বলে, ‘আপনার সেসব বুঝে কাজ নেই, আপনি আপুর সঙ্গে আবার দেখা হলে একটু বুঝিয়ে বলবেন। মা ভীষণ চিন্তা করে।’
ফয়সাল ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে। মায়েরা তো চিন্তা করবেনই। ও গলাখাঁকারি দিয়ে বলে, ‘তুলি, আমি ঠিক কথা দিতে পারছি না। তবে কখনও সুযোগ হলে অবশ্যই বলব।’
তুলি ফোন রাখে। ফয়সাল চুপ করে বসে থাকে। এত সুন্দর একটা মেয়ে বিয়ে না করে থাকলে কাছের মানুষের দুশ্চিন্তা হয়। আচ্ছা, এই দুশ্চিন্তা কেন? সামাজিক নিরাপত্তা? নাকি সমাজ একা মানুষদের ভয় পায়?
সেদিন বিকেলেই মেহুলির ফোন আসে। ফোন দিয়েই অভিযোগের গলায় বলে, ‘কী ব্যাপার? আপনার যে আর খবরই নেই? নাকি মাফলার ফেরত দেবার ভয়ে আর আসেনই না?’
মেহুলির মাফলারটা ফেরত দেওয়া হয়নি। গাড়িতেই ছিল। পরে ড্রাইভার সিকান্দার এটা ওর কাছে দিয়ে গেছে। কেন যেন ইচ্ছে করেই আর ফেরত দেওয়া হয়নি।
ফয়সাল আমতাআমতা করে বলে, ‘ইয়ে মানে আমি চেয়েছিলাম মাফলারটা ভালো করে ধুয়ে, শুকিয়ে তারপর ফেরত দেব।’
মেহুলি পাত্তা না দেবার গলায় বলে, ‘আচ্ছা রেখে দিন আপনার কাছে। আমি আপনাকে একটা কাজে ফোন দিয়েছি। পাহাড়ি আনারস পাওয়া যাবে এখন?’
ফয়সাল চিন্তিত গলায় বলে, ‘আর কয়েকটা মাস পরে পাওয়া যাবে। কেন বলুন তো, খুব জরুরি দরকার?’
মেহুলি হাসে, ‘না, জরুরি কিছু না। আসলে অবসর সময়ে আমি নতুন নতুন রেসিপি ট্রাই করি। আনারস দিয়ে ডিমের কোরমা। ইউটিউবে দেখছিলাম। তাই মনে হলো। অদ্ভুত লেগেছে। মনে হচ্ছে ভালোই হবে। তাই ভাবলাম আপনাকে জিজ্ঞেস করি। আপনাদের রিসোর্টের রেস্টুরেন্টে তো কত কিছুই না থাকে।’
ফয়সাল হাসে, তারপর বলে, ‘আচ্ছা, আমি খুঁজে দেখব। পাহাড়ি কিছু এলাকায় আগাম আনারস উঠে। পেলে অবশ্যই নিয়ে আসব। আর আপনি ভালো আছেন তো?’
ইচ্ছে করে তুলির ফোন দেবার ব্যাপারটা বলে না।
ওপাশ থেকে মেহুলির উচ্ছ্বসিত গলা পাওয়া যায়, ‘খুব ভালো আছি। ওহ, আপনাকে আলাদা করে ধন্যবাদ জানানো হয়নি। সেদিন আমার সঙ্গে নীলগিরি যাওয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ। সেজন্য আপনার একদিন দাওয়াত পাওনা রইল।’
ফয়সাল হাসে, ‘কী খাওয়াবেন? আনারস দিয়ে ডিমের কোরমা?’
মেহুলি জোরে হেসে ফেলে, ‘শুনুন, আমি যেমন ভালো ডাক্তার, ঠিক তেমন ভালো রাঁধুনি। একদিন খেলেই বুঝতে পারবেন। আচ্ছা এখন রাখছি, প্যাশেন্ট আছে।’
মেহুলি ফোন রেখে দেয়। ফয়সাল টের পায় ভালো লাগছে ওর। নাহ, আনারস খুঁজে বের করতে হবে।
এর ঠিক কিছুদিন পর এক বিকেলে বেতের একটা বড়ো ঝুড়িতে ছয়টা পাহাড়ি আনারস নিয়ে ফয়সাল মেহুলির বাড়িতে উপস্থিত হয়। এই প্রথম এখানে আসা। হাসপাতালের পেছনে ছোট্ট সবুজ মাঠ। তার একপাশে একটা ইউরোপিয়ান স্টাইলের সাদা দোতলা বাড়ি। লম্বা কাঠের জানালায় সাদা পর্দা দিয়ে ঢাকা। একজন দারোয়ান গেট খুলে দেয়।
বেল বাজতেই মেহুলি দরজা খোলে। হালকা গোলাপি রঙের একটা ফ্রকের মতো জামা। চুলগুলো ছেড়ে দেওয়া। মনে হচ্ছে এখুনি বুঝি নেচে উঠবে।
ফয়সাল আনারসের ঝুড়িটা নিয়ে ভেতরে ঢুকতেই মেহুলি ফিক করে হেসে ফেলে। ফয়সাল থতমত খেয়ে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতেই মেহুলি হাতে মুখ চাপা দিয়ে বলে, ‘আপনি আনারসগুলো অমন উলটো করে বসিয়েছেন কেন?’
ফয়সাল এবার হাতে ধরা ঝুড়ির দিকে তাকায়। তারপর ব্যাখ্যা দেবার গলায় বলে, ‘আনারসের মাথায় এই যে সবুজ কাঁটাওয়ালা পাতা, এগুলো হাতে খোঁচা লাগে। তাই অমন উলটো করে রাখা। কিন্তু তাতে হাসির কী হলো?’
মেহুলি তখনও মুখ টিপে হাসছিল। এবার ও কাছে এসে বলে, ‘সেদিনই খবরে দেখছিলাম স্পেনে পাইনঅ্যাপেল ডেটিং নামে নতুন একটা ট্রেন্ড চালু হয়েছে। যারা আপনার মতো একা, তারা একটা ঝুড়িতে অমন করে আনারস উল্টো করে রাখে। এর মানে হলো আমি একা, জীবনসঙ্গী খুঁজছি।’
ফয়সাল কেন যেন লজ্জা পায়। তারপর নিজেকে সামলে হেসে বলে, ‘বাহ, ব্যাপারটা দারুণ তো। তাহলে আপনারও কাজে লাগবে এটা।’
মেহুলি ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘আমার কাজে লাগবে কেন? আমি তো জীবনসঙ্গী খুঁজছি না। আপনিই না আনারস উল্টো করে ঘুরছেন আর জীবনসঙ্গী খুঁজছেন।’
শেষ কথাটা হাসতে হাসতেই বলে।
ফয়সাল ঝুড়ি নামিয়ে রেখে বলে, ‘আপনাদের তো রাজকন্যা কপাল। জীবনসঙ্গীরা আপনাদের পিছু পিছু ঘুরতে থাকে। শুধু মুখ দিয়ে আপনি হ্যাঁ বললেই হয়।’
মেহুলি হতাশভাবে মাথা নাড়ে, তারপর বলে, ‘আর বলবেন না, মা এবার এমন পিছনে লেগেছে যে আমাকে বিয়ে দিয়েই ছাড়বে।’
সুযোগটা পেয়ে এবার আর হাতছাড়া করে না। ফয়সাল আলতো করে বলে, ‘বিয়েটা করে ফেললেই হয়। তাতে করে সবাই স্বস্তি পায়। আমার মা এমন করে বললে আমি ঠিক এতদিনে বিয়ে করে ফেলতাম।’
মেহুলি কোমরে হাত রেখে বলে, ‘তাই না? আচ্ছা, আপনার মায়ের ফোন নম্বর দিন। এখুনি বলে দিচ্ছি তার আদরের ছেলেকে কেন বিয়ের জন্য জোর করা হচ্ছে না। কই দিন ফোন নম্বর।’
ফয়সাল নিচু গলায় বলে, ‘মা নেই। বাবাও। আপনি ভাগ্যবান যে আপনার মা বেঁচে আছে।’
মেহুলির হঠাৎ করেই মন খারাপ হয়ে যায়। আলতো করে বলে, ‘সরি! না জেনে আপনাকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। আসুন, এখানটায় আরাম করে বসুন। আমি কাবাব ভেজেছি, একটু নুডুলস আর পায়েস।’
খেতে গিয়ে টের পায় প্রতিটি খাবার খুব মজা হয়েছে। সে কথা বলতেই মেহুলি বলে, ‘বুঝলেন তো তাহলে। আপনি তো সেদিন আমার আনারস ডিমের কোরমা শুনেই ভয় পেয়ে গেলেন।’
ফয়সাল পায়েশ শেষ করতেই মেহুলি খুব সুন্দর একটা টি-পট আর চায়ের কাপ নিয়ে আসে। তারপর টি-পট থেকে চা ঢেলে দিয়ে বলে, ‘আপনার ভাই বোন কেউ নেই?’
ফয়সাল চায়ে চুমুক দিয়ে বলে, ‘ছোট বোন আছে। ঢাকাতেই থাকে। ওর হাসব্যান্ড একটা ব্যাংকে চাকরি করে। আপনার মায়ের মতো ও-ই মাঝে মাঝে আমাকে ফোন দিয়ে জ্বালায়।’
মেহুলি হাসে, তারপর আনমনে বলে, ‘বিয়ে করে ফেললেই হয়।’
ফয়সাল চুপ থাকে কিছুক্ষণ। তারপর বলে, ‘জানেন তো, প্রতিটি জিনিসের একটা সময় থাকে। তার জন্য আলাদা মন থাকে। সেই মনটাই নেই এখন।’
মেহুলি থমকে তাকায়। এই লোকটা কী করে ওর মনের কথাটাই বলল! আসলেই তো, সেই মনটাই যে নষ্ট হয়ে গেছে।
২.
পলিন কাকু বসে বসে গরম সিঙারা খাচ্ছিলেন। রিসেপশপনের পাশেই বড়ো একটা বাঁশের মাচা, অনেকটা টেরেসের মতো। এক পাশে খাড়া পাহাড়, তার গায়ে সবুজ গাছের কার্পেট। ফেব্রুয়ারি শেষে মার্চের সবে শুরু। এসময়টায় পর্যটকদের আনাগোনা কমতে শুরু করে। সেজন্য কাজের চাপটাও কম থাকে।
পলিন সিঙারায় ছোট ছোট করে কামড় দিয়ে খাচ্ছিলেন। জীবনে বেঁচে থাকার একটা অপার আনন্দ আছে। শুধু মাঝে মাঝে মনে হয় একটা বিয়ে করলে বুঝি ভালোই হতো। বয়স ষাটের কোঠা পেরিয়েছে গতবছরই। সারাদিন এই রিসোর্ট নিয়েই পড়ে থাকেন। কিন্তু রাত হলেই নিঃসীম অন্ধকার। সেদিন ফয়সালকে অনেক বুঝিয়ে বলেছেন বিয়ে করার ব্যাপারে। ছেলেটা শুধু মাথা নাড়ে। জীবনে হয়তো কোনো বড়ো চোট পেয়েছিল কখনও। তেমন করে কাউকে সে কথা খুলে বলেনি। মানুষের কত কত কষ্ট আছে। আর সেসব কষ্ট বুকে পুষে জীবনটা পার করে দেয়।
ভাবনার এই পর্যায়ে বাইরে একটা গাড়ি থামার শব্দ পাওয়া যায়। একটা বুকিং ছিল। তারাই কি চলে এল?
পলিন টিস্যুতে হাত মুছে তড়িঘড়ি করে রিসেপশনে চলে আসে। গাড়ি থেকে একটা কম বয়েসী মেয়ে নামে। খয়েরী একটা হাতাকাটা জামার সঙ্গে নীল জিন্স, পায়ে বুট জুতোর মতো বাদামি এক জোড়া জুতো। ধারালো চেহারা, চোখে বড়ো একটা সানগ্লাস। দেখে মনে হয় টিভিতে দেখা কোনো মডেল। তা এখানে যারা ঘুরতে আসা তাদের অনেকেই এমন সাজপোশাকে আসে। এসব দেখে পলিন অভ্যস্ত।
গাড়ি থেকে আরেকজন নামেন। ইনি বয়স্ক। ওর বয়সেরই হবে। মাথার চুলগুলো সাদা কালো। গায়ে হালকা নীল রঙের ব্লেজার। চোখেমুখে আভিজাত্যের ছাপ স্পষ্ট। মেয়েটার বাবা বুঝি? কিন্তু এত বড়ো মেয়েকে নিয়ে এক রুমে থাকবে?
ওরা এগিয়ে আসতেই পলিন হেসে বলে, ‘ওয়েলকাম স্যার।’
লোকটা মাথা নেড়ে বলে, ‘আমাদের একটা বুকিং ছিল।’
পলিন এবার কম্পিউটারের মনিটরে বুকিং ফাইলটা খুলে দেখে। তারপর বলে, ‘আপনি তো আহনাফ সুমন? স্যার, এই ফরমটা একটু পূরণ করে দিন। আর আপনাদের এন আই ডি কার্ডের ছবি বা ফটোকপিটা।’
মেয়েটা আহ্লাদী গলায় বলে, ‘ডার্লিং, আমি একটু ওই দোলনাটায় গিয়ে বসি।’
পলিন ধাক্কা খায়। ডার্লিং!! তারমানে এরা স্বামী-স্ত্রী? নাহ, এবার বিয়েটা করেই ফেলতে হবে। আজকাল বুড়োদেরও দেখি ভালো বিয়ে হচ্ছে।
কাগুজে কাজগুলো শেষ করে একজনকে দিয়ে ওদের লাগেজ পাঠিয়ে দেয়। মেয়েটা এখনও দোলনায় দুলছে। হঠাৎ একটা কথা মনে হয়, এরা কি আসলেই স্বামী-স্ত্রী? বুকিং ফরমে তো স্পাউস লেখা। নাহ, ব্যাপারটা একটু ফয়সালকে জানিয়ে রাখতে হবে। সে আবার শহরে গেছে। কখন যে আসে কে জানে।
বিকেলের দিকে ফয়সাল যখন আসে তখন বিকেলের রোদ মরে গেছে। আজ অনেক খাটুনি গেল। সেই সকালে বেরিয়েছিল। রিসোর্টে ভালো সাদা বিছানার চাদরের খোঁজে। সাধারণত এসব চট্টগ্রাম থেকেই আনা হয়। এখানে নতুন একটা পাহাড়িদের দোকান হয়েছে। ওরা নিজেরাই বানায়। দামটাও একটু কমই পড়ে৷ ওদের কাজ দেখতেই যাওয়া।
ফয়সাল গাড়ি থেকে নেমে আড়মোড়া ভাঙে৷ রিসোর্টে এখন মানুষজন কমে গেছে একেবারে। গাড়ি লক করে রেস্টুরেন্টের দিকে পা বাড়াতেই থমকে যায়। একটা মেয়ে আপনমনে দোলনায় দুলছে। মুখটা ভালো করে দেখতেই ও থমকে দাঁড়ায়। টের পায় পা কেমন দুর্বল হয়ে আসছে। ও ঠিক দেখছে তো?
ততক্ষণে মেয়েটাও দোলনা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। সরাসরি ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। একটা সময় মেয়েটা এগিয়ে আসে। ফয়সাল টের পায় ওর বুকের ভেতর ড্রাম বাজছে। কেন যেন বিশ্বাস হতে চায় না।
কিন্তু মেয়েটা কাছে এসে দাঁড়াতেই ফয়সালের আর সন্দেহ থাকে না। মেয়েটা লিডিয়া। আগের চেয়েও সুন্দর লাগছে। পরনে ব্রান্ডের জামা, দামি সানগ্লাস।
মেয়েটা ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘তুমি এখানে?’
ফয়সাল গম্ভীরমুখে বলে, ‘এই রিসোর্টের ম্যানেজার আমি।’
লিডিয়া তাকিয়ে থাকে। তারপর ধীরে ধীরে মুখে একটা ব্যাঙ্গাত্মক হাসি ফুটে উঠে।
‘ঢাকা থেকে পালিয়ে এইখানে এসে লুকিয়েছ বুঝি? আর ঢাকায় থাকতেই বা কী করে? কেউ তো আর তোমাকে চাকরিতেই নিত না। এখনও মারমারি করো নাকি?’
ফয়সাল টের পায় মাথায় রক্ত উঠে যাচ্ছে। কড়া কিছু বলতে গিয়ে থেমে যায়। পেছন থেকে বুড়ো মতো একজন লোক এদিকেই এগিয়ে আসছে।
বুড়ো লোকটা কাছে এসেই উদবিগ্ন গলায় বলে, ‘ডার্লিং, কোনো সমস্যা?’
ফয়সাল চমকায়। এই বুড়ো ওকে ডার্লিং বলছে কেন?
লিডিয়া পেছন ফিরে ন্যাকা গলায় বলে, ‘না ডার্লিং। উনি এই রিসোর্টের ম্যানেজার। রাতে একটা বারবিকিউ পার্টির ব্যবস্থা করতে বলছিলাম।’
বুড়োটা এবার উৎসাহের গলায় বলে, ‘বাহ, তাহলে তো খুব ভালো হবে। লিডিয়া তুমি কিন্তু গান গাইবে, আর নাচবে।’
লিডিয়া হেসে গড়িয়ে পড়ে৷ তারপর বলে, ‘তুমি তো নাচতেই পারো না। একা একা নাচা যায়?’
তারপর ফয়সালের দিকে ফিরে কৌতুকের গলায় বলে, ‘আপনি নাচতে পারেন?’
ফয়সালের চোয়াল শক্ত হয়ে যায়, রুক্ষ গলায় বলে, ‘সরি, আমি নাচতে পারি না।’
বুড়োটা এবার সান্ত্বনা দেবার গলায় বলে, ‘ডার্লিং আমিই নাচব তোমার সাথে। আর ম্যানেজার সাহেব, আপনি বারবিকিউয়ের ব্যবস্থা করেন। আপনারও দাওয়াত রইল।’
ফয়সাল মাথা নাড়ে।
বুড়োটা এবার লিডিয়ার একটা বাহু জড়িয়ে ধরে বলে, ‘চলো, দোলনায় গিয়ে বসি।’
লিডিয়া একবার ফয়সালের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসি হাসে। তারপর দোলনার দিকে এগোয়।
ফয়সাল খর চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর হনহন করে রেস্টুরেন্টের দিকে এগোয়। মনের ভেতর একটা অশান্ত ঝড় উঠেছে। সবকিছু ভেঙ্গেচুরে ফেলতে ইচ্ছে করছে। কোথাও ছুটে চলে যেতে পারত। যে দুর্মর কষ্ট থেকে পালিয়ে থাকতে এখানে এসেছিল সেই কষ্টটা জলজ্যান্ত হয়ে আজ সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
(চলবে)
মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর
২০/০১/২০২৫