#যদি_নির্বাসন_দাও (পর্ব ৬)
১.
সন্ধ্যার পর পরই রিসোর্টের ছোট মাঠটার এক পাশে বারবিকিউ স্টেশন বসানো হয়। চারপাশে বাতিগুলো নিভিয়ে মশাল জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। সাউন্ড বক্সে হালকা ভলিউমে গান বাজছে। একটা উৎসব উৎসব ভাব চলে এসেছে। এখানে বারবিকিউ পার্টিগুলো এমন করেই করা হয়।
লিডিয়া, আহনাফ চৌধুরী বসে বসে দেখছিল। আহনাফ চৌধুরী একটা ফতুয়া আর জিন্স পরে বসে আছেন। তার গা ঘেঁষে লিডিয়া। লিডিয়া আজ সাদা গাউনের মতো একটা ড্রেস পরেছে। অন্ধকারে জ্বলজ্বল করছে যেন। রেস্টুরেন্টের বাবুর্চি ইতোমধ্যে কয়লাতে আগুন ধরিয়ে ফেলেছে। মসলা মাখানো মুরগীগুলো ঝলসানোর জন্য প্রস্তুত।
আহনাফ এবার গলা বাড়িয়ে বলে, ‘এই, তোমাদের ম্যানেজার সাহেব কই? ওনাকে একটু আসতে বলো।’
পলিন কাকু পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। আজ ফয়সাল আশেপাশে নেই। সেই বিকেল থেকে নিজের রুমে শুয়ে আছে। সাধারণত এমন হয় না। বারবিকিউ পার্টি থাকলে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সব তদারকি করে। আজ কী হলো ছেলেটার?
পলিন কাকু একজনকে পাঠান ডেকে আনতে।
একটু পর ফয়সাল আসে৷ ওর পায়ে পায়ে টমও আসে। ফয়সালের চুলগুলো এলোমেলো। মুখটা অসম্ভব গম্ভীর। পলিন কাকু কাছে এসে বলেন, ‘কী, শরীর খারাপ?’
ফয়সাল মাথা নাড়ে, ‘না কাকু। ডেকেছ কেন?’
পলিন ইশারা করে আহনাফকে দেখিয়ে দেয়। ফয়সাল কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই আহনাফ মৃদু হেসে বলে, ‘ম্যানেজার সাহেব, আপনাকে না দাওয়াত দিলাম? আপনি দূরে দূরে থাকলে পার্টি জমে? আচ্ছা, আপনাকে একটা কাজে খুঁজছিলাম। একটু ড্রিংক্সের ব্যবস্থা করা যাবে?’
ফয়সাল একবার লিডিয়ার দিকে তাকায়। কেমন বেহায়ার মতো এই বুড়োটার গলা ধরে ঝুলে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। ফয়সাল চোখ ফিরিয়ে বলে, ‘সরি স্যার, আমাদের রিসোর্টে এসব এলাউ না।’
আহনাফ ব্যথিত চোখে তাকান, তারপর বলেন, ‘আহা! এটা কোনো কথা হলো। এলকোহল ছাড়া পার্টি জমে? আচ্ছা, কোনো অসুবিধা নেই। লিডিয়া একাই সব জমিয়ে দিতে পারে৷ আপনি গান গাইবার জন্য একটা মাইক্রোফোন দিন। তাতেই হবে।’
গান গাইবার সব ব্যবস্থাই এখানে আছে৷ অতিথিরা এসব পার্টিতে নিজেরা গান গায়, মজা করে। ফয়সাল উইলিয়ামকে ডেকে ব্যবস্থা করতে বলে। তারপর বিদায় নেবার গলায় বলে, ‘আপনারা এনজয় করুন, আমি যাই। আমার শরীরটা ভালো না।’
লিডিয়া এবার আহ্লাদী গলায় বলে, ‘আরে থাকুন না ম্যানেজার সাহেব। আমার গান শুনে যান একটু।’
আহনাফও এবার জোর করে, ‘ভাই, একটু বসুন। একা একা কি আর বারবিকিউ পার্টি জমে?’
ফয়সাল অনিচ্ছাসত্ত্বেও দূরে একটা চেয়ারে বসে। উইলিয়াম গানের যন্ত্রপাতিগুলো ঠিকঠাক করে একবার ভয়েস টেস্ট করে নিতেই আহনাফ আবদারের গলায় বলে, ‘লিডিয়া, গান শুরু করো।’
লিডিয়া শরীর মুচড়ে উঠে দাঁড়ায়। আলো আঁধারিতে রহস্যময় লাগছে। একবার ফয়সালের দিকে তাকায়, তারপর মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে মিউজিকের সঙ্গে গান ধরে –
I’m never gonna dance again
Guilty feet have got no rhythm
Though it’s easy to pretend
I know you’re not a fool
জর্জ মাইকেলের গান। কতদিন পর গানটা শুনল! ফয়সাল এক ঝটকায় আট বছর আগে ফিরে যায়। লাল, নীল আলোর ঝলকানি, আধো অন্ধকারে একটা বাইশ বছরের উচ্ছল তরুণী দারুণ স্টাইলে গান গাইছে। আর শ্রোতারা সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো ওর গান শুনছে। কেউ কেউ উঠে এসে ওর গায়ের ওপর হাজার টাকার নোট ছুড়ে দিচ্ছে।
ফয়সাল আর পারে না, উঠে দাঁড়ায়। তারপর এলোমেলো পা ফেলে ছুটে বেরিয়ে আসে। ছোট্ট টম পেছন ফিরে দু তিনবার ‘ঘেউ’ ‘ঘেউ’ করে। তারপর দৌড়ে ফয়সালের পিছু নেয়। লিডিয়া ততক্ষণে নাচতে শুরু করেছে। আধো অন্ধকারে ওর সাদা গাউন পরা অবয়বটা কেমন অপার্থিব একটা অনুভূতি দেয়।
রিসোর্টের পশ্চিম পাশে একটা পাহাড় আছে। যেখানে রিসোর্টের স্টাফ আর অতিথিদের ড্রাইভারদের থাকার জায়গা। মূল রিসোর্ট থেকে ওই পাহাড়ে যাবার জন্য প্রায় চারশ ফুট লম্বা একটা ঝুলন্ত বাঁশের সেতু আছে। অনেকটা বাঁশের মাচার মতো। প্রশস্ত এই সেতুটাতে দাঁড়ালে সামনের সবুজ প্রকৃতি যেন জড়িয়ে ধরে৷
ফয়সাল টলতে টলতে ঝুলন্ত ব্রিজটার মাঝখানে গিয়ে বসে। টম কী বোঝে কে জানে। ওর গা ঘেঁষে বসে গায়ে মুখ ঘষতে থাকে। যেন বা ওকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। ফয়সাল একটা হাত রাখে ওর মাথায়।
চারপাশে আধো অন্ধকার। আকাশে একটা দুটো করে তারা ফুটতে শুরু করেছে। লিডিয়ার গান শোনা যাচ্ছে। আজ সব পুরনো গানগুলো গাচ্ছে। ইচ্ছে করেই হয়তো এমন করছে।
একটা সময় গান থামে। তারপর আরও অনেকটা সময় পেরিয়ে যায়। ফয়সাল বসেই থাকে। একটা সময় পলিন কাকু আসেন। কাঁধে হাত রাখতেই ও কেঁপে ওঠে।।
পলিন কাকু নরম গলায় বলেন, ‘রাতের খাবার খেয়ে রুমে যাও।’
ফয়সাল মাথা নাড়ে। পলিন কাকু কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন। কিছু একটা আঁচ করতে পারেন বুঝি।
ওর হাত ধরে টান দেন, ‘আচ্ছা না খেলে। রুমে যাও। এত রাতে একা একা এখানে বসে থেকো না।’
ফয়সাল উঠে পড়ে। টম এতক্ষণ আশেপাশেই ঘুর ঘুর করছিল। বেচারা ওকে ছেড়ে এক মুহূর্ত কোথাও যায়নি। টমকে নিয়ে ফয়সাল হাঁটতে হাঁটতে নিজের রুমের দিকে এগোয়। পলিন কাকু ব্যথিত চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকেন।
সেদিন অনেক রাত পর্যন্ত ফয়সালের ঘুম আসে না। শেষ রাতে যখন ক্লান্ত শরীর-মন ঘুমোতে যায় ঠিক তখন পলিন কাকুর আতংকিত গলা পাওয়া যায়, ‘ফয়সাল, শীগগির তোমার গাড়িটা বের করো। সেই বুড়ো লোকটা মনে হয় হার্ট অ্যাটাক করেছে। হাসপাতালে নিতে হবে।’
ফয়সালের মনে হয় ও স্বপ্ন দেখছে। ঘোর কাটতে সময় নেয়। ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘কোন বুড়ো লোক?’
পলিন কাকু জোরে নিশ্বাস নিতে নিতে বলেন, ‘গতকাল যে নতুন গেস্ট আসল। কাল রাতে বারবিকিউ পার্টি করে এরা রুমে অনেক রাত অবধি হই হুল্লোড় করেছে। তারপর একটু আগে সেই মেয়েটা দৌড়ে আসল। বলল, একটা গাড়ি দরকার। বুড়োটার নাকি বুকে ভীষণ ব্যথা হচ্ছে।’
ফয়সাল তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে পড়ে। তারপর একটা চাদর জড়িয়ে নিয়ে তাড়াহুড়ো করে বের হয়৷
তাড়া দেবার গলায় বলে, ‘ওদের নিয়ে পার্কিং-এ চলে আসুন। আমি গাড়ি স্টার্ট দিচ্ছি।’
কথা শেষ করে ফয়সাল পকেট থেকে মোবাইল বের করে। তারপর একটু দ্বিধা করে মেহুলিকে ফোন দেয়। রিং-টা কেটে যাবার আগ মুহূর্তে ফোনটা ধরে। ওপাশ থেকে উদবিগ্ন গলা পাওয়া যায়, ‘আপনি ঠিক আছেন তো? এত ভোরে ফোন দিয়েছেন?’
ফয়সালের মন ভালো হয়ে যায়। একটা মানুষ তার জন্য একটু হলেও চিন্তা করে।
‘হ্যাঁ, আমি ভালো আছি। আমার রিসোর্ট এর একজন বয়স্ক মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। বলছেন বুকে তীব্র ব্যথা, আপনার ওখানে নিয়ে আসছি এখনই।’
মেহুলি দ্রুত উত্তর দেয়, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ আপনি নিয়ে আসুন, আমি এখনি বের হচ্ছি।’
রিসোর্টের কয়েকজন মিলে আহনাফকে কোলে করে গাড়ির পেছনে উঠায়। লিডিয়াকে কেমন আতংকিত লাগছে। চুলগুলো এলোমেলো, চোখ ফোলা ফোলা। পেছনে উঠে আহনাফকে ধরে বসে।
পলিন কাকু সামনের সিটে বসতেই ফয়সাল গাড়ি ছেড়ে দেয়।
দশ মিনিটের মাথায় ওরা কার্ডিয়াক সেন্টারে পৌঁছে যায়। হাসপাতালের লোকজন প্রস্তুত ছিল। ওরা এসে আহনাফকে নামিয়ে ইমার্জেন্সি রুমের দিকে ছোটে। লিডিয়া পিছু পিছু যায়৷
ফয়সাল গাড়ি পার্ক করে মেহুলির রুমের দিকে এগোয়। কাছে যেতেই দেখে মেহুলি বের হচ্ছে।
‘আপনি আমার রুমে বসুন, আমি রোগীকে দেখে আসছি। ভাববেন না, আমার আয়ত্বে থাকলে ভালো হয়ে যাবে।’
কথাটা বলেই মেহুলি ছোটে।
ঘন্টাখানেক পর মেহুলি ফিরে আসে। সঙ্গে লিডিয়া, পলিন কাকু।
লিডিয়া চিন্তিত গলায় বলে, ‘ম্যাডাম, ওর কি বড়ো কোন সমস্যা?’
মেহুলি একবার ফয়সালের দিকে তাকায়। তারপর লিডিয়ার দিকে ফিরে বলে, ‘রোগী আপনার কী হয়? হাসব্যান্ড?’
লিডিয়া এবার মুখ নিচু করে। তারপর গম্ভীরমুখে বলে, ‘না। আমার বন্ধু।’
ফয়সাল ছিটকে উঠে। তার মানে হাসব্যান্ড না! তীব্র দৃষ্টিতে লিডিয়ার দিকে তাকায়। লিডিয়াও কেমন ধারালো চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে।
মেহুলি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর গম্ভীরমুখে বলে, ‘ওনার স্ত্রী থাকলে তাকে খবর দিতে হবে। ওনাকে দ্রুত চট্টগ্রাম পাঠাতে হবে। এনজিওগ্রাম করতে হবে৷ আমার ধারণা হার্টে রিং পরাতে হতে পারে। আমার এখানে সেসব ব্যবস্থা নেই। রোগীকে যত দ্রুত সম্ভব চট্টগ্রামে ইম্পেরিয়াল হাসপাতালে নিয়ে যান। ওখানে ভালো চিকিৎসা পাবেন।’
লিডিয়া লাফ দিয়ে উঠে পড়ে, তারপর চোখা গলায় বলে, ‘ফয়সাল, দয়া করে এসব ঝামেলায় আমাকে জড়াবে না। আমি একটা গাড়ি ঠিক করে ঢাকায় চলে যাব এখন। আহনাফকে জিজ্ঞেস করলেই ওর স্ত্রীর ফোন নাম্বার পাওয়া যাবে। তারাই এর দায়িত্ব নিক। আমি এসব ঝামেলায় নাই।’
ফয়সাল কঠোর গলায় বলে, ‘কিন্তু আপনাকে থাকতে হবে যে। কারণ রোগীর কিছু হয়ে গেলে তখন আমাকে জেরা করবে। আমাদের রিসোর্টে রোগীর সঙ্গে যে আপনি ছিলেন সেটা আমাকে বলতেই হবে।’
লিডিয়া এবার ভয় পায়, তারপর আকুল গলায় বলে, ‘আমাকে এই বিপদ থেকে রক্ষা করো।’
মেহুলি অবাক হয়ে ওদের দুজনের কথা শুনছিল।
ফয়সাল এবার পলিন কাকুকে বলে, ‘একটা এম্বুলেন্স ডেকে আনুন। ওনাকে নিয়ে চট্টগ্রাম চলে যান।’
তারপর লিডিয়ার দিকে ফিরে বলে, ‘চট্টগ্রাম পর্যন্ত আপনাকে থাকতে হবে। হাসপাতালে ভর্তি হবার পর আপনি ওখান থেকে ঢাকা চলে যাবেন। এর আগে যদি পালাবার চেষ্টা করেন আমি তাহলে পুলিশ ডাকব।’
লিডিয়া তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। আর মেহুলির মনে তখন হাজারো প্রশ্নের ভীড়।
২.
বাতাসে বসন্তের ছোঁয়া। নীলাচলের ভেতর দিয়ে হাঁটতে গেলে বুনো ফুলের ঘ্রাণ পাওয়া যায়। মেহুলি পাহাড়ি পথ বেয়ে হাঁটছিল। একদম উঁচুতে উঠতে হাঁপ ধরে যায়৷ এখানটায় বসার জন্য অনেকগুলো বেঞ্চি আছে। তার একটায় ধপ করে বসে পড়ে। বিকেলের এই সময়টায় পর্যটকদের ভীড় থাকে। আজ অবশ্য ভীড় কম।
হঠাৎ পেছন থেকে পরিচিত গলা পাওয়া যায়, ‘বাহ, আপনি এখানে?’
মেহুলি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে ফয়সাল দাঁড়িয়ে আছে৷ মুখে সেই পরিচিত খোঁচা খোঁচা দাড়ি। কেন যেন এভাবেই লোকটাকে দেখতে ভালো লাগে। সেদিন যে ঝক্কি গেল। সেই বুড়ো লোকটার নাকি দুটো রিং পরাতে হয়েছে৷ ওনার স্ত্রী ঢাকা থেকে এসেছিল। আর সেই অদ্ভুত মেয়েটা চট্টগ্রাম থেকেই চলে গিয়েছিল। কিন্তু অনেকগুলো প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল যার উত্তর একমাত্র ফয়সালই দিতে পারেন।
মেহুলি হেসে বলে, ‘আমি তো এখানে প্রায়ই আসি। বরং আমার প্রশ্ন, কাজ ফেলে আপনি এখানে কেন?’
ফয়সাল সামনের বেঞ্চিতে বসতে বসতে বলে, ‘ভাবলাম, পাহাড়ের কাছে কেমন করে দুঃখ জমা রাখা যায় সেটা দেখে আসি।’
মেহুলি থমকায়। গলায় বিষাদের সুর। ও উঠে পাশে গিয়ে বসে৷ তারপর আন্তরিক গলায় বলে, ‘কী হয়েছে, বলুন তো?’
ফয়সাল মাথা নাড়ে, ‘নাহ, কিছু না।’
মেহুলি ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে। এই ‘কিছু না’ কথাটা ওকেও অনেকবার অনেক মানুষকে বলতে হয়েছে। এই ছোট্ট কথাটার ভেতরে কত গভীর বেদনা যে লুকিয়ে থাকে তা ওর চেয়ে আর কে ভালো জানে।
মেহুলি হঠাৎ মনে পড়ে গেছে এমন ভঙ্গিতে বলে, ‘আচ্ছা, আমাকে একটা কথা বলুন তো। সেদিন সেই বুড়ো লোকটা সঙ্গে যে মেয়েটা এসেছিল, সে আপনাকে তুমি তুমি করে বলছিল কেন? যেন অনেক দিনের পরিচিত কেউ। কী যেন নাম মেয়েটার? হ্যাঁ মনে পড়েছে লিডিয়া। কে ছিল ও?’
ফয়সাল এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘লিডিয়া আমার স্ত্রী ছিল।’
মেহুলি চমকে উঠে। ওহ, এজন্যই বুঝি লোকটা সেদিন অমন করছিল। আহা রে! প্রাক্তন স্ত্রী বুড়ো একটা লোকের সঙ্গে ওর রিসোর্টেই ঘুরতে এসেছিল। প্রকৃতির কী নির্মম রসিকতা!
ফয়সাল নিশ্চয়ই ভীষণ কষ্ট পেয়েছেন!
মেহুলি নরম গলায় বলে, ‘আচ্ছা, এবার বুঝতে পেরেছি। আমি সরি ফয়সাল সাহেব।’
ফয়সাল ম্লান হাসে, ‘যার সরি হবার কথা সে-ই যখন হয়নি আপনি কেন শুধু শুধু সরি হবেন। মানুষ আসলে এমনই। যারা অন্যায় করবে তারা সবসময় বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াবে। আর আমাদের মতো মানুষজন পালিয়ে বেড়াবে।’
মেহুলির কেন যেন খুব খারাপ লাগছিল। যার জন্য ফয়সাল এই নিভৃতে এসে একটু স্বস্তি খুঁজেছিল সেই কষ্ট দেবার মানুষ এখানে এসে হাজির হয়েছে। ও নিজেও যে এমন পলাতক মানুষ।
মেহুলি মন খারাপ গলায় বলে, ‘হ্যাঁ, একদম ঠিক বলেছেন। পৃথিবী বড্ড পালটে গেছে৷’
ওরা চুপচাপ বসে থাকে। বিকেলের রোদ পড়ে আলো কমে আসে। মেহুলি হঠাৎ বলে, ‘আপনাদের বিয়েটা ভাঙল কেন?’
ফয়সাল চুপ করে থাকে। কেন যেন আজ নিজের কষ্টের কথাগুলো বলতে ইচ্ছে করছে৷ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘আমি ঢাকায় একটা পাঁচ তারকা হোটেলের ম্যানেজার ছিলাম। লিডিয়া সেই হোটেলের বারে সপ্তাহে দু’দিন গান গাইত। তখন ওর বয়স কত? বাইশ হবে৷ আমি ত্রিশ। চাকরির খাতিরেই আমার সঙ্গে ওর কথা হতো। ওদের পরিবারে টানাটানি ছিল। গানের গলা ভালো হওয়াতে এখানে এসেছিল। আর চেহারাটাও বেশ ছিল। ধীরে ধীরে আমাদের মাঝে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। একটা সময় অনেক কাছাকাছি চলে আসি আমরা। বিয়ে করি। একটা বছর ভালোই কাটছিল। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল ও যখন আবার ওর পুরনো পেশায় ফিরে যেতে চাইল। আমি বললাম, তখন তো তুমি বাধ্য হয়ে বারে গান গাইতে। এখন তো সেই আর্থিক কষ্টটা নেই। কিন্তু ও আমার কথা শুনল না। বলল, তোমার হোটেলে আমি না গাইলেই তো হয়।
এরপর প্রায়ই দেখতাম রাত করে ফিরত। অনেকে এসে ড্রপ করে দিয়ে যেত। যেমন হয় আর কী এসব ক্ষেত্রে। কিছু বখে যাওয়া বড়োলোকের ছেলে জুটে গেল। একটা সময় আমি আবিষ্কার করলাম লিডিয়া আর আমার নেই। আর সে কথা ও অকপটেই স্বীকার করল। শহরের একজন অবিবাহিত শিল্পপতির সঙ্গে নাকি ওর ভাব হয়েছে। তাকেই বিয়ে করবে। একদিন ওদের একসঙ্গে দেখে আমার মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল। লোকটার ওপর ঝাপিয়ে পড়েছিলাম। এটা নিয়ে পরে পুলিশি ঝামেলা হয়েছিল। যাই হোক, এরপর আর লিডিয়া থাকেনি। চলে গিয়েছিল। পরে বুঝতে পেরেছিলাম ও আসলে আমাকে ভালোবাসেনি কখনোই। অর্থনৈতিক মুক্তি পেতেই ও আমাকে তখন আঁকড়ে ধরেছিল। এবং সেদিন সেই আহনাফ চৌধুরীকে দেখে মনে হলো এখনও ও আগেরমতোই আছে।’
কথা শেষ হয়। ওরা দুজন চুপ করে বসে থাকে।
মেহুলি নরম গলায় বলে, ‘এমন একটা মানুষের জন্য আপনি কেন কষ্ট পাবেন? যে মানুষ টাকা ভালোবেসেছিল তাকে তো ভুলে যাওয়াই উচিত। আর ওই মেয়েটার দিকটাও ভাবুন। আর্থিক দুর্দশা মানুষকে খাদের কিনারায় নিয়ে যায়। অনেকেই সেই খাদের কিনারা থেকে উঠে আসতে পারে না। ওকে আপনি ক্ষমা করে দিন। এভাবে জীবন নষ্ট করার মানে নেই।’
ফয়সাল ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে বলে, ‘সবাই তো একরকম না। আমি আসলে ক্ষমা করতে পারিনি। তাই ওই বৃত্ত থেকে বের হয়ে আসতে পারিনি।’
ফয়সাল উঠে দাঁড়িয়ে সামনে যায়। এদিকটায় কাঠের রেলিং দেওয়া। রেলিঙয়ে হেলান দিয়ে ও উদাস চোখে সামনের বিস্তৃত পাহাড়ের সারির দিকে তাকিয়ে থাকে। সেখানে এখন হালকা কুয়াশা পড়েছে। একটু আগের ঝলমলে পাহাড়গুলো এখন কেমন বিষণ্ণ।
মেহুলির মনে হয় মানুষের কত গোপন দুঃখ আছে। কত গোপন ঠকে যাবার গল্প আছে। সত্যি সত্যি যদি ওই পাহাড়ের কাছে সবার সব গোপন দুঃখ জমা করে রাখা যেত!
(চলবে)
মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর
২২/০১/২০২৫