যদি নির্বাসন দাও পর্ব-১০ এবং শেষ পর্ব

0
757

#যদি_নির্বাসন_দাও (পর্ব ১০) – শেষ পর্ব

১.
আজ সকালে রোগীর ভিড় অনেক বেশি ছিল। দেখে শেষ করতে দুপুর দুটো বেজে যায়। মেহুলি টের পায় ক্ষুধা পেয়েছে। নাহ, এবার উঠতেই হয়। ব্যাগ গুছিয়ে বাইরে আসতেই দেখে ফয়সাল বসে আছে। গত কয়েকদিন ধরে প্রায়ই এসে বসে থাকে। মেহুলি ব্যথিত চোখে তাকায়। ফয়সাল উঠে কাছে আসে। আন্তরিক গলায় বলে, ‘আজ অনেক রোগী দেখলেন। নিশ্চয়ই ক্ষুধা পেয়েছে। চলুন, কলাপাতা রেস্টুরেন্টে খেয়ে আসি।’

কলাপাতা রেস্টুরেন্টটা শহরের মাঝখানে। ইতোমধ্যে এদের সুনাম ছড়িয়েছে। পর্যটকরা একবার হলেও খেতে এখানে ঢুঁ মারেন।

মেহুলি মাথা নাড়ে, ‘না, এখন আর ওদিকটায় যাব না। আপনি বরং বাসায় চলুন। খাবেন আমার সঙ্গে।’

ফয়সাল মাথা নেড়ে ওর সঙ্গে হাঁটতে থাকে। মনের ভেতর একটা তীব্র টানাপোড়েন টের পায় মেহুলি। সেদিনের পর থেকে ব্যাপারটা বেড়েছে। মাঝে মাঝে মনে হয় অতীতটা ভুলে গিয়ে ফয়সালের হাতটা ধরে নীলাচলের পাহাড়ের কাছে বসে থাকে। কিন্তু পরক্ষণেই কেমন গুটিয়ে যায় নিজের ভেতরে।

হাঁটতে হাঁটতে ফয়সাল আলতো করে বলে, ‘আপনি ভালো আছেন তো?’

মেহুলি ছোট্ট করে বলে, ‘হ্যাঁ, ভালো আছি। আপনার রিসোর্টে সব ঠিকঠাক? কোনো ঝামেলা হয়নি তো?’

ফয়সাল মাথা নাড়ে, ‘না, কোনো ঝামেলা হয়নি।’

বাসায় এসে ওকে বসতে বলে ভেতরে চলে যায় মেহুলি। একটা রান্নার মেয়ে আছে। তাকে খাবার বেড়ে দিতে বলে। মেহুলি চট করে পরনের জামা চেঞ্জ করে নেয়। হাতমুখ ধুয়ে এসে টেবিলে বসে। আজ কোরাল মাছের ঝোল সঙ্গে থানকুনি পাতা ভর্তা আর ডাল। মেয়েটা আদিবাসী, রান্নার হাত চমৎকার।

ফয়সালের বুঝি অনেক ক্ষুধা পেয়েছিল। দু’প্লেট ভাত খায়। মেহুলি খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে উঠিয়ে দিচ্ছিল। ফয়সালের মনে হচ্ছিল ও যেন অনেক দিন ধরে মেহুলির সঙ্গে সংসার করছে। এই সুখটা পেতেই হবে। মেহুলি কেন যে দেরি করছে। এখন পর্যন্ত ওকে সেই কথাটা বলেনি।

খাওয়া শেষে রান্নার মেয়েটাকে খাবার বুঝিয়ে দিয়ে বিদায় দেয়৷ তারপর ফয়সালের মুখোমুখি বসে নরম গলায় বলে, ‘আপনার সঙ্গে আমার জরুরি কথা ছিল। সেজন্য এখানে ডেকে নিয়ে এলাম।’

ফয়সালে বুক চলকে উঠে। লম্বা একটা নিশ্বাস নিয়ে বলে, ‘প্লিজ, বলুন।’

মেহুলি সরাসরি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আপনি যদি এমন করে প্রায় প্রতিদিন আমার হাসপাতালের চেম্বারের সামনে এসে বসে থাকেন তাহলে আমি এখানে চাকরি করি কী করে, বলুন তো? আমাকে যে আবার পালাতে হবে। একবার পালিয়ে এখানে এসেছিলাম, কিন্তু আপনি এমন করলে যে আবার পালাতে হবে।’

ফয়সাল একটা ধাক্কা খায়। মেহুলি এমন কথা বলতে পারল! টের পায় বুকের ভেতর রক্তক্ষরণ হচ্ছে।

নিচের ঠোঁট কামড়ে বলে, ‘আমার জন্য আপনি পালাবেন! আমি আপনাকে কষ্ট দিচ্ছি!’

মেহুলি আকুল গলায় বলে, ‘না, না। আমিই যে কষ্ট পাচ্ছি। আপনি যে ওই জঘন্য লোকটাকে মেরেছেন তাতে করে আমার চোট পাওয়া মনে কী নরম একটা প্রলেপ পড়েছে সেটা বুঝিয়ে বলতে পারব না। আমি যদি অমন করে লোকটাকে মারতে পারতাম!’

মেহুলির চোখ ভিজে আসে। ফয়সাল ওর হাত ধরে, ‘আমি আর আপনি কি আলাদা? আপনি প্লিজ আর অমন দূরে দূরে থাকবেন না। আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে এমন দূরে থাকতে। আপনি বলেছিলেন ভেবে আসতে। আমি অনেকবার ভেবেছি, আর প্রতিবার একই উত্তর এসেছে। মেহুলি, আপনাকে আমার ভীষণ দরকার। আমার জীবনে আপনাকে চাই।’

মেহুলি কেঁপে ওঠে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, ‘কিন্তু আমি অনেকবার ভেবেও নিজের কাছে উত্তর পাইনি। আমার এখনও মনে হয়, আমি যদি আপনাকে বিয়ে করি তাহলে আপনাকে শুধু ঠকানোই হবে। আপনি হয়তো সত্যিকারের ভালবাসবেন কিন্তু আমার মনে হবে করুণা করছেন। তাই এটাই ভালো আমি দূরে সরে যাব। এখান থেকে আমি হয়তো চলে যাব অন্য কোথাও।’

ফয়সাল বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকে, ‘আপনি চলে যাবেন! আমি এত করে বলার পরেও আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না? আমি মরে গেলে আপনি বিশ্বাস করবেন তাই না?’

মেহুলি আর্তনাদ করে উঠে, ‘ছি! এমন কথা বলবেন না। আপনি মরে গেলে যে আমি একা হয়ে যাব।’

ফয়সাল উঠে দাঁড়ায়, ‘না৷ আপনি একা হয়ে যাবেন না৷ কারণ আপনি আমাকে কখনোই কাছের মানুষ মনে করেননি। আমি হৃদয় দিয়ে আপনাকে চেয়েছি। কিন্তু কাছে আসতে পারিনি। আপনার কষ্টের কারণ হয়ে আর কোনদিন সামনে এসে দাঁড়াব না। আমার জন্য আপনাকে কোথাও পালাতে হবে না।’

কথাটা বলে ফয়সাল আর দাঁড়ায় না। ধুপধাপ করে সশব্দে গেট খুলে বেরিয়ে যায়। মেহুলি পিছু ডাকে। কিন্তু কে শুনে কার কথা।

ফয়সাল ততক্ষণে কালো জিপ গাড়িটা স্টার্ট দিয়ে ফেলেছে। মেহুলি দরজার কাছে এসে দাঁড়াতেই তীব্র একটা শব্দ শুনতে পায়। আতঙ্কিত চোখে দেখে ফয়সালের গাড়িটা একটা গাছের সঙ্গে লেগে গেছে। ইশ, এক্সিডেন্ট করবে তো! এদিকে ফয়সাল তীব্র বেগে গাড়িটা ব্যাক গিয়ারে দিয়ে গাছে লেগে থাকা গাড়িটা সরায়। তারপর গিয়ার চেঞ্জ করে টায়ারের তীক্ষ্ণ শব্দ তুলে বেরিয়ে যায়। মেহুলি টের পায় ভয়ে ওর বুক ধুকপুক করছে। ফয়সালের আজ মাথা ঠিক নেই। ইশ কেন যে অমন করে বলতে গেল! কী করবে?

হঠাৎ করে পলিন কাকুর কথা মনে হয়। মোবাইল বের করে দ্রুত ফোন দেয়। ফোন ধরতেই মেহুলি আকুল গলায় বলে, ‘কাকু, ফয়সাল আমার এখান থেকে একটু আগেই বেরোল। রিসোর্টে পৌঁছানো মাত্রই আমাকে ফোন দেবেন। আর আজকের দিনটা ওর সাথেই থাকবেন, চোখে চোখে রাখবেন প্লিজ।’

পলিন কোনো প্রশ্ন করে না। উত্তর দেয়, ‘আচ্ছা ম্যাডাম।’

মেহুলি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অস্থিরভাবে পায়চারি করতে থাকে। পাঁচ মিনিট পার হয়। তারপর দশ মিনিট পার হয়। আচ্ছা, এখান থেকে কতক্ষণ লাগে? দশ মিনিটের বেশি তো লাগার কথা না। পনের মিনিট পর মেহুলি আবার ফোন দেয়। নাহ, ফয়সাল নাকি এখনও পৌঁছায়নি। মেহুলি টের পায় ওর মাথা ঘুরছে। নিজের হাত কামড়াতে ইচ্ছে করছে এখন। আর বসে থাকা যায় না। দ্রুত গাড়ির চাবি নিয়ে বের হয়।

দশ মিনিটের মাথায় এসেন্স রিসোর্টে এসে উপস্থিত হয়। পলিন কাকু দৌড়ে কাছে আসেন, ‘ফয়সালের মোবাইলটা বন্ধ পাচ্ছি। ও তো এখনও এসে পৌঁছায়নি।’

মেহুলির মনে হয় ও জ্ঞান হারাবে। কান্না গলায় বলে, ‘পলিন কাকু, আপনি একটু আমার সঙ্গে আসবেন। ও ভীষণ রাগ করে আমার বাসা থেকে বেরিয়েছে। আমার মনে হয় ও নীলাচলে আছে।’

পলিন মাথা নেড়ে দ্রুত গাড়িতে উঠে। পুরোটা পথ ভালো করে নজর বোলাতে বোলাতে আসে। নাহ, রাস্তায় তো সব কিছুই স্বাভাবিক। কোথাও কোন অ্যাক্সিডেন্ট হয়নি। যদিও এই বাজে ভাবনাটা একদমই ভাবতে চাচ্ছে না।

পাঁচ মিনিটের মধ্যে ওরা নীলাচল স্পটে এসে পৌঁছে যায়। গাড়ি পার্ক করে মেহুলি লাফিয়ে নামে। নাহ, এখানে তো ফয়সালের গাড়িটা নেই। তাহলে কি এখানে আসেনি? ওরা দ্রুত পায়ে ভেতরের ঢুকে পুরোটা খুঁজে দেখে। না ফয়সাল এখানে আসেনি। তাহলে গেল কোথায়?

মেহুলি আকুল গলায় বলে, ‘পলিন কাকু, ফয়সাল কোথায় যেতে পারে বলেন তো?’

পলিন মাথা চুলকে ভাবে। তারপর হঠাৎ করেই একটা কথা মনে হয়। সেটাই বলে, ‘একটা জায়গা আছে। গেলে সেখানেই যেতে পারে।’

মেহুলি তাড়া দিয়ে বলে, ‘প্লিজ, আমাকে সেখানেই নিয়ে চলুন।’

আধা ঘণ্টা চলার পর একটা পাহাড়ি গ্রামের কাছে গাড়িটা এসে থামে। পলিন গাড়িটা পার্ক করতে বলে। তারপর গাড়ি থেকে নামে। এদিক ওদিক তাকাতেই ফয়সালের গাড়িটা দেখতে পায়। পেছনের দিকটা দেবে যাওয়া। মেহুলির চোখে পানি চলে আসে। ফয়সাল তাহলে এখানেই আছে!

গ্রামের একপাশ জুড়ে পাহাড়ের সারি। পাহাড়ের গায়ে এখন জুম চাষের সবুজ ফসল। কোথাও ভুট্টা লাগানো হয়েছে, কোথাও ধান, তুলা, আদা, হলুদ। পুরো পাহাড় সবুজ। বর্ষায় যেন আরও বেশি সতেজ।

ওই সবুজ পাহাড়ের দিকে ইশারা করে বলে, ‘ওখানেই আছে। ওই যে বাঁশের ছোট ছোট ঘর দেখছেন তার কোন একটাতেই হয়তো আছে। এগুলোকে জুমঘর বলে। পাহাড়ের গায়ে চাষ করা ফসল বানর আর ভালুকের হাত থেকে রক্ষা করতেই পাহারা দেবার জন্য এই ঘরগুলো বানানো হয়। ফয়সালকে দেখেছি মন বেশি খারাপ হলে এখানে এসে জুম ঘরে বসে থাকে। আপনি একা একা যেতে পারবেন? আচ্ছা থাক, চলুন আমিও যাচ্ছি আপনার সঙ্গে।’

এবার পলিন কাকু আগে আগে মেহুলি ওর পিছু পিছু হাঁটতে থাকে। যত এগোতে থাকে পাহাড়ি পথটা দুর্গম হতে থাকে। আর তার সঙ্গে সবুজের সমারোহ যেন পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে।

প্রথম জুম ঘরটাতেই ফয়সালকে পাওয়া যায়। পলিন ইশারা করে বলে, ‘আমি তাহলে গাড়ির কাছে গিয়ে দাঁড়াই।’

মেহুলি মাথা নাড়ে। তারপর লম্বা একটা নিশ্বাস নিয়ে জুমঘরের দিকে এগোয়। কাছে আসতেই দেখে বাঁশের মাচার ওপর পা ঝুলিয়ে ফয়সাল বসে আছে। সামনের সবুজ পাহাড়ের দিকে উদাস চোখে তাকিয়ে আছে।

মেহুলি গলাখাঁকারি দিয়ে বলে, ‘আমাকে রেখে এমন একা একা চলে আসতে পারলেন?’

ফয়সাল চমকে তাকায়। তাকিয়েই থাকে। ধীরে ধীরে চোখে জল জমে। বুকের ভেতর অভিমানের বাষ্প জমা হয়।

মেহুলি নরম গলায় বলে, ‘কি, আমাকে আপনার পাশে বসতে বলবেন না?’

ফয়সাল চোখ মুছে বলে, ‘হ্যাঁ তো।’

তারপর উঠে এসে হাত ধরে নিয়ে ওকে পাশে বসায়। মেহুলি ওর গা ঘেঁষেই বসে আজ। প্রথমবারের মতো এতটা কাছে। ফয়সাল হঠাৎ করে এক হাতে জড়িয়ে ধরে ওকে নিজের কাছে টেনে নেয়। মেহুলি আজ বাধা দেয় না। ফয়সালের গায়ের সঙ্গে একদম যেন মিশে যায়। ফয়সাল টের পায় মেহুলির শরীর কাঁপছে। ফয়সাল আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ওকে। আর মেহুলি ছোট্ট একটা পাখির ছানার মতো ওর বুকের ওম চুরি করে নেয়।

কোথা থেকে যেন মন জুড়ানো ঠান্ডা একটা বাতাস আসছে। ওরা দুজন পাহাড়ের কাছে নিজেদের দুঃখ, কষ্টগুলো জমা রাখে। তারপর গভীর আবেগে দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে রাখে।

একটা সময় আবেগের ঢেউটা শান্ত হয়। ফয়সাল নরম গলায় বলে, ‘মাকে তাহলে ফোন দেবেন আজ?’

মেহুলি একটু ভাবে, তারপর গম্ভীরমুখে বলে, ‘না, দেব না।’

ফয়সাল চমকে যায়। ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘কেন? আপনি কি এখনও দ্বিধায় ভুগছেন?’

মেহুলি এবার মাথা নাড়ে, দৃঢ় গলায় বলে, ‘আমার মনে আর কোনো দ্বিধা নেই। আমি বুঝে গেছি, আপনাকে ছাড়া একটা মুহূর্ত চলবে না আমার।’

ফয়সাল ওর হাত ধরে আদুরে গলায় বলে, ‘তাহলে মাকে জানাতে দেরি কোথায়? আমার যে এখুনি বিয়ে করতে ইচ্ছে করছে।’

মেহুলির পুরো শরীর কেঁপে ওঠে। ইশ, কী ভীষণ সুন্দর একটা কথা। ছোট্ট একটা নিশ্বাস নিয়ে বলে, ‘বিয়ের ব্যাপারটা আমি কাউকেই জানাব না। আমি, আপনি, আপনার ছোট বোন ওনার হাসব্যান্ড। এছাড়া কুটুস, টম, পলিন কাকু, এখানকার পরিচিত কয়েকজন থাকবে শুধু।’

ফয়সাল বিস্মিত গলায় বলে, ‘সে কী! আপনার মাকে জানাবেন না? আপনার ছোট বোন, তুলি, আর ভাইকে?’

মেহুলি কঠিন গলায় বলে, ‘ওদের কাছে আমার প্রয়োজন অনেক আগেই ফুরিয়েছে। আমি শুধু ওদের প্রয়োজন মেটানোর নিমিত্ত ছিলাম মাত্র। প্লিজ, আপনি এই ব্যাপারটা নিয়ে অযথা আমাকে আর অনুরোধ করবেন না।’

ফয়সাল মাথা নাড়ে। তারপর নরম গলায় বলে, ‘আচ্ছা, জোর করব না।’

২.
আজ এসেন্স রিসোর্ট রঙিন সাজে সেজেছে। স্টাফদের মধ্যে একটা অন্য রকমের চাঞ্চল্য। রিসোর্টের মাঠে একটা গায়ে হলুদের প্যান্ডেল করা হয়েছে। ছেলেমেয়ের দুজনের একসঙ্গেই হলুদ হবে। পরদিন বিয়ে। খুব বেশি মানুষ আসেনি। ফয়সালের ছোট বোন সীমা আর ওর হাসব্যান্ড, আর ওদের ক্লাশ থ্রিতে পড়া ছেলে, রাজু। ওহ, অতিথিদের মাঝে আরও দুজন গুরুত্বপূর্ণ অতিথি আছে – টম আর কুটুস। এরাও যেন বুঝেছে আজ উৎসব। তাই সেই সকাল থেকেই হুটোপুটি করছে।

সন্ধ্যেবেলা হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যায়। মেহুলি আজ হলুদ শাড়ি পরেছে। মাথায় গাঁদা ফুলের মালা। দেখে মনে হয় যেন হলুদ পরী। ফয়সাল পাশেই সাদা পাঞ্জাবি পরে বসে এদিকেই মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে ছিল। তাই দেখে ফয়সালের বোন সীমা দুষ্টুমি করে বলে, ‘ভাইয়া, এবার চোখ ফেরা। নজর লেগে যাবে তো।’

ফয়সাল লজ্জা পায়। মেহুলি নরম চোখে তাকিয়ে থাকে। একটা মানুষ ওর অপমানের কিছুটা হলেও প্রতিশোধ নিয়েছিল। বলেছিল, ওকে নিয়ে কেউ বিন্দুমাত্র বাজে কথা বললেও তা সহ্য করবে না। সেটা যদি সত্যি হয় তাও। এমন করে ওকে এই পৃথিবীতে আর কেউ ভালবাসবে? জীবনে আর কোন অতৃপ্তি রইল না। শুধু মনের ভেতর একটাই অতৃপ্তি, মা নেই। এই যে এখন হলুদ শুরু হবে, কেন যেন ওর বুক খালি লাগছে। মন দুর্বল হয়ে পড়ছে। বার বার মনে হচ্ছে মা-ও যে তখন অসহায় ছিলেন।

মেহুলি মুখ নিচু করে বসেছিল। হলুদের ডালা সুন্দর করে সামনেই সাজিয়ে রাখা। কেউ একজন বলে, ‘সীমা, আপনি প্রথমে শুরু করেন।’

মেহুলির বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস পড়ে। তুলি, ছোট ভাইটা – সবার কথা মনে পড়ে। টের পায় চোখ ভিজে আসছে। মুখটা নিচু করে কান্না লুকাতে।

এমন সময় কেউ একজন ওর সামনে এসে বসে। তারপর কপালে হলুদ লাগিয়ে দিতেই মেহুলি মুখ তোলে। বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে কাঁপা গলায় বলে, ‘মা, তুমি!!’

জাহানারা কেঁদে ফেলেন, ‘তুই আমাদের রেখে এমন করে একা একা বিয়ে করতে যাচ্ছিলি! একটাবার মায়ের কথা মনে হলো না।’

ততক্ষণে তুলি আর হিমেল পায়ে পায়ে কাছে চলে এসেছে। তুলি অভিমানী গলায় বলে, ‘আপু, আমাদের এমন করে ভুলে গেলি? আমরা না হয় অপরাধ করেছি। কিন্তু তুই তো আমাদের কাছে বাবার মতো। তুই রাগ করে থাকলে আমরা কার কাছে যাই, বল তো? আমরা যে এতিম।’

তুলির চোখ উপচে জল গড়ায়। পাশে ছোট ভাই হিমেল ঠোঁট কামড়ে কান্না সামলাচ্ছে। এত অসহায় লাগছে দুজনকে!

মেহুলির বুক হাহাকার করে উঠে। পুরনো একটা ছবি ভেসে উঠে। বাবা যেদিন এক্সিডেন্ট করে সেদিন ওরা দুজন ঠিক এমন করেই অসহায় হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। সেদিন মেহুলিই ছিল ওদের একমাত্র ভরসা। সংসারের হাল ধরতে গিয়ে ধীরে ধীরে কবে যে ও বাবার জায়গাটুকু নিয়ে নিয়েছিল সেটা বুঝতে পারেনি।

মেহুলি উঠে দাঁড়ায়। তারপর কাছে এসে তুলি আর হিমেলকে কাছে টেনে নিতেই ওরা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। মেহুলিও কাঁদে, ফিসফিস করে বলে, ‘আমি থাকতে তোরা এতিম হবি কেন? এই তো আমি আছি।’

জাহানারা চোখ মোছেন। সারাজীবন একটা আত্মগ্লানি বয়ে বেড়িয়েছেন। মেহুলি বুঝি আজ মন থেকে সব ক্ষমা করে দিল।

ফয়সালের চোখেমুখে একটা আত্মতৃপ্তি আজ। মেহুলিকে না জানিয়েই ওদের নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেছিল। ঠিক জানত, মেহুলির বুকের ভেতর একটা হাহাকার থেকেই যাবে। হাজার হলেও তো মা!

এক ফাঁকে মেহুলি ওর কাছে সরে এসে নিচু গলায় বলে, ‘থ্যাংকিউ ফয়সাল। আপনি এমন করে আমার অনুচ্চারিত কথাগুলো বুঝতে পারেন?’

ফয়সাল গভীর গলায় বলে, ‘হ্যাঁ তো।’

পৃথিবীর সব মালিন্য আজ উধাও। সেখানে আজ শুধুই শুদ্ধ ভালোবাসা। নিজেকে কেন যেন খুব ধনী মনে হয় মেহুলির।

সেদিন রাতে জাহানারা মেয়েকে শক্ত করে ধরে শুয়ে থাকেন। মেহুলি সব খুলে বলেছে। কাঁদতে কাঁদতে জাহানারার চোখ শুকিয়ে গেছে। বুকের ভেতর ভেঙেচুরে গেছে। কিছুটা হয়তো অনুমান করতে পারতেন, কিন্তু তাই বলে অমানুষটা ওর মেয়ের সঙ্গে….। ইচ্ছে করছে এখুনি ওই হারামজাদার গলা চেপে ধরে। নিজেকে ভীষণ অপরাধী লাগছে আজ নতুন করে।

জাহানারা ফিসফিস করে বলেন, ‘মেহুলি, আমাকে ক্ষমা করেছিস তো?’

মেহুলি নিচু গলায় বলে, ‘মা, তোমার তো দোষ নেই। জীবনের পথ সবার জন্য মসৃণ হয় না। এবার দোয়া করো, আমি যেন সুখী হই।’

জাহানারা ওকে জড়িয়ে ধরেন, ‘আমার দোয়া রইল মা। তোর বাবাও নিশ্চয়ই ওই দূর আকাশ থেকে তোকে দোয়া করছে আজ।’

মেহুলি জানালা দিয়ে বাইরে আকাশের দিকে তাকায়। একটা দুটো করে তারা ফুটতে শুরু করেছে। আচ্ছা, এর মাঝে বাবা কোনটা?

পরদিন দুপুরে বিয়ে হয়ে যায়। সবাই পেটপুরে খায়, আনন্দ করে। ফয়সাল আর মেহুলিকে পাশাপাশি বসিয়ে অনেক অনেক দুষ্টুমি করে সবাই। আজ যেন সবার আনন্দ বাঁধ ভেঙেছে।

বিকেলবেলা দুজন মিলে নীলাচলে যায় যেখানে বসে ওরা পাহাড়ের কাছে দুঃখ জমা রাখত। সবার আগে এখানেই যে আসতে হতো। আজ পাহাড়ের গায়ে ঝলমলে রোদ। কোথাও মন খারাপের কুয়াশা নেই। মাঝে মাঝে সাদা সাদা মেঘের ভেলা ভেসে বেড়াচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে ফয়সাল হঠাৎ করেই সুনীলের কবিতা আবৃত্তি করে –

যদি নির্বাসন দাও, আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরী ছোঁয়াবো
আমি বিষপান করে মরে যাবো!
বিষণ্ণ আলোয় এই বাংলাদেশ
নদীর শিয়রে ঝুঁকে পড়া মেঘ
প্রান্তরে দিগন্ত নির্নিমেষ-
এ আমারই সাড়ে তিন হাত ভূম।

আবৃত্তি শেষে ফয়সাল গভীর গলায় বলে, ‘আমাকে আর কোনোদিন নির্বাসন দেবে না তো?’

মেহুলি ওর হাতটা কাছে টেনে নেয়, তারপর নরম গলায় বলে, ‘তাই কি কখনও হয়? তুমি যে আমার কাছে ধ্যানী পাহাড়ের মতো। যার কাছে আমি আমার সব দুঃখ কষ্টগুলো জমা রেখে নিশ্চিন্ত মনে সাদা মেঘের মতো হেলান দিয়ে ঘুমোব।’

ফয়সাল ওকে কাছে টেনে নেয়। আর মেহুলি ওর কাঁধে মাথা রেখে সামনের পাহাড়ের সারির দিকে তাকিয়ে থাকে যেখানে সাদা মেঘগুলো পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে ঘুমুচ্ছে।

(সমাপ্ত)

মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর
২৫/০১/২০২৫