যাতনা আমার পর্ব-১৫+১৬

0
1900

#যাতনা_আমার
#সানজিদা_ইসলাম_সূচনা
#পর্ব: ১৫

( কপি করা সম্পুর্ন নিষিদ্ধ।)

পার্কের একটা বেঞ্চে বসে আছে ইশান। হাতে মোবাইল ফোন। বসে বসে গেমস খেলছে ইশান। আবার অপেক্ষা করছে একজনের জন্য। অফিস টাইমের আগেই এখানে এসেছে আজ। ফর্মাল পোশাকের বেশেই হাজির সে। ঘড়িতে সময় দেখে ইশান। কাঙ্ক্ষিত মানুষটির আসার অপেক্ষা যেন বাড়তে থাকে। হঠাৎ হাই হিলের আওয়াজে সামনে তাকায় ইশান। ঘাম যুক্ত মুখে মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তিথি। ইশান কোনো রা করেনা সে চুপচাপ গেমস খেলতে থাকে। তিথি এবার পাশে বসে ইশানের বাহু জড়িয়ে ধরে। তারপর জিজ্ঞেস করে,

-” রাগ হয়েছে সাহেব? স্যরি! আসতে লেট হয়ে গেল। ”

-” আমার রাগ করে কি লাভ? কেউকি তার ধার ধারে?

ইশানের মুখ গোমড়া কথা শুনে তিথি তেতে বলে ওঠে,

-” আমি কি এখন চলে যাব? ”

ইশান ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে তিথির দিকে তাকায়। সম্পর্কের দুই বছরে এমনো কখনো হয়নি ইশান রেগে আছে আর তিথি রাগ ভাঙিয়েছে। তিথি একবার স্যরি বলেই বিষয় খালাস করে দেয়। এরপরও ইশান রেগে থাকলে উলটো তিথিই তাকে ঘাটের জল খাওয়ায়।

-” এতো লেট কেন তিথি? তুমি যানো আমি কতোক্ষণব্যাপী তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম? আর একটু পরেই অফিসের জন্য বেরোতে হবে। সাপ্তাহে দুইবার দেখা করো। তাতেও লেট কেনো? ”

ইশানের এতো প্রশ্নের জবাব তিথি দিতে পারেনা। মুখটা মলিন করে ইশানের দিকে তাকিয়ে থাকে। ইশানের এবার মায়া হয়। কন্ঠ নিচে নামিয়ে শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করে,

-” কি হয়েছে আমার চিতা বাঘিনীর? মন ভালো নেই? ”

তিথি ডানে বায়ে মাথা নাড়িয়ে সহমত প্রকাশ করে। ইশান কিছু বলবে তার আগেই তিথি গতকাল ইনায়ার সাথে যা কিছু করেছে সব ইশানের সাথে প্রকাশ করে। ইশান সবকিছু শুনে নিরুত্তর রইল। তিথির কাজটা আসলেই ঠিক হয়নি। তবুও সে ভিতরে ভিতরে অনুতপ্ত হওয়াতে ইশান খুশী হয়।

-” আমার কিছুই ভালো লাগছে না ইশান। খুব খারাপ করেছি আমি ইনায়ার সাথে। ”

-” কি নাম বললে? ”

অকপটে জানতে চাইল ইশান। তিথি ইনায়ার নামটা বলল। ইশানের মাথায় হাত। দুইয়ে দুইয়ে চার মিলায় সে। সে অনেক আগেই তিথির মুখে শুনেছিল। জায়ান তাদের এক কাজিন কে তিথির সাথে রাখতে বলেছে। আবার ফাহাদ ও ইনায়া কে বলেছিল তার বোনের সাথে ইনায়া কে দেবে। এতোকিছু ইশান কেন খেয়াল করলো না। আবারও ইনায়ার জন্য মনটা খারাপ করে ইশানের। সে রাগান্বিত হয়ে তিথি কে জিজ্ঞেস করে,

-” তুমি যানো মেয়েটা কে? ”

‘ কে ‘ যানতে চায় তিথি। ইশান ঠোঁট নাড়িয়ে বলতে গেলেই তিথির ফোন বেজে উঠে। তিথি পার্স থেকে ফোন তুলে কানে দিতেই থমকে যায়। কাঁপা গলায় বলে,’ আমি আসছি। ‘ ফোনটা রেখে হন্তদন্ত হয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় তিথি।

-” কোনো সমস্যা? ”

-” ভাইয়া হসপিটালে। গুলি লেগেছে। এক্ষুনি যেতে হবে। ”

-” চলো আমি নিয়ে যাচ্ছি। ”

ইশান চটজলদি তিথিকে নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। যেতে যেতে তিথি কেদে ফেলে। ইশান নিরুত্তর চুপচাপ তা দেখে শুধু।

হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে ভর্তি করা হয়েছে জায়ানকে। অনেকটা রক্তক্ষরণে শেষ মুহূর্তে জ্ঞান হারিয়েছিল তার। ফোন দেবার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই তার দলের লোকগুলো এসে সেখানে উপস্থিত হয়েছিল। গাড়িতে জায়ানের পাশে বসে ইনায়া তখন ভাবছিল। কি বুঝে মানুষ রাজনীতি তে ঢুকে? শুধু একটা বুলেট তার পরেই জীবন শেষ। এই জন্যেই সে তার বাবাকে এইসব থেকে সরিয়ে এনেছিল। হাসপাতালের করিডোরে পায়চারি করছে ফাহাদ আর মিজানুল করিম। মিজানুল করিম ফাহাদ কে ইচ্ছে মতন ঝাড়ছে। মেয়র হয়ে যদি নিজের ভাইকে সে সেভে রাখতে না পারে, তাহলে জনগণের কি নিরাপত্তা দিবে ফাহাদ? অন্য সময় হলে বাবার সাথে ঝগড়া করতো ফাহাদ। কিন্তু আজ অনেকটা চুপসে রয়েছে। সেসময় নিধির সাথে ফাজলামো করে বাড়িতে না নিয়ে গেলে আজ এই পরিস্থিতি হতো না। মুহূর্তেই প্রেস মিডিয়ায় ভরে গেছে হাসপাতালে। অনেক মানুষের ভীড় জমেছে। ইনায়া অতিরিক্ত বিরক্ত হয় এইসবে। পাশেই মিনারা বেগম কাঁদছেন। নিজেকে এতো ভেঙে ফেলছেন না তিনি। খুব শক্ত হয়েই রয়েছেন। ইনায়া তাকে শান্তনা দেবার মতো কোনো কথা খুজে পায়না। কারণ রাজনৈতিক ফ্যামিলি থেকে বিলং করা মানুষ গুলোর কাছে এইসব দুধ ভাত। তারা নিজেকে সব সময় সামলাতে যানে। হঠাৎ নিধি তার হাত ধরে বস থেকে উঠিয়ে অন্য পাশে নিয়ে যায়। আচমকা ইনায়া ভয় পেলেও সামলে নেয়।

-” কই ছিলে নিধি? কতক্ষন খুজলাম তোমাকে? ”

-” আর বলোনা ভাবি। ওই বজ্জাত মেয়র আমাকে তার বাড়িতে নিয়ে গেছিল। জায়ান ভাইয়ের খবর পেতে, আমাকে ফেলেই চলে এসেছে। এখন বলো, জীবনের প্রথম গোলাগুলির সম্মুখে পরলে,ফিলিংস কেমন? ”

বিরক্তিতে মুখ কুঁচকালো ইনায়া। এমন আতংকের সময় ফিলিংস আবার কেমন হবে? সে মুখ গোমড়া করে বলে,

-” আর কি? কুকুর বিড়ালেরও দাম আছে রাজনৈতিক মানুষ গুলোর থেকে। একটা ট্রিগার চাপ লাইফ শেষ। ভাবা যায় এইসব? ”

নিধি এবার আপাদমস্তক ইনায়াকে দেখে নেয়। সারা গায়ে রক্তে মাখামাখি। কালোজামা দেখে বুঝা মুশকিল।

-” ভাবি হলে চলো। কাপড় বদলাবে। ”

ইনায়া সামনে তাকায়। ডাক্তার ওটি থেকে বেড়িয়ে এসেছে। ফাহাদ কথা বলছে তার সাথে। ইনায়া নিধি সেদিকে যেতেই শুনতে পায় ডাক্তার বলছে। জায়ান এখন বিপদমুক্ত। কয়েকদিন সম্পূর্ণ বেড রেস্ট থাকতে হবে। ওটি থেকে বের করে জায়ান কে কেবিনে শিফট করানো হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্ঞান ফিরবে। একজন একজন করে দেখতে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছে ডাক্তার। মিজানুল করিম আর মিনারা বেগম গেলেন জায়ান কে দেখতে। ফাহাদ পিছনে ফিরে ইনায়াদের দিকে তাকায়।

-” স্যরি ইনায়া। তুমি ঠিক আছো তো? ”

-” আমি একদম ঠিক আছি ভাইয়া। আর স্যরি কেনো বলছেন? এতে আপনার কোনো দোষ নেই। আপনার ভাই যদি নেতাগিরী করে শত্রুে কামাই করে, আপনার তো দোষের কিছু নয়। ”

ফাহাদ ইনায়ার কথায় ম্লান হাসলো। জায়ান গড়ার কারিগর তো সে নিজেই। আজকে কেন যানি বাবার কথা ফাহাদের সঠিক মনে হচ্ছে। ফাহাদ ইনায়ার পেছনে দাঁড়ানো নিধি কে দেখে ভ্রু কুঁচকালো। এই মেয়ের খপ্পরে পরে আজকে তার এই দশা। ফাহাদ ইনায়ার দিকে ফের তাকিয়ে শান্ত স্বরে বলে,

-” চলো জায়ান কে দেখবে। তুমি না থাকলে আজ কি হতো ভাবতেই শরীর কাটা দিয়ে উঠছে। ”

ইনায়া মনে মনে হাসে। উলটো জায়ানই তো তাকে প্রটেক্ট করেছে। সন্ত্রাসীটার রাগ, সাহস, ধৈর্য সবই আছে। না হলে গুলি খেয়েও মানুষ এতো শক্ত কথা বলে? ভাবছে ইনায়া। ইনায়া ফাহাদের সাথে যাবে, তখনই তিথি সেখানে দৌড়ে আসে। আর পেছনে ইশান। ইনায়া আর নিধি ইশান আর তিথি কে একসাথে দেখে বেশ অবাক হয়। সবচেয়ে বেশি অবাক হয় নিধি। সে তীক্ষ্ণ চোখে ইশানের দিকে তাকিয়ে থাকে। তিথি হাঁপাতে হাঁপাতে বলে ওঠে,

-” ছোট ভাইয়া ঠিক আছে তো? ”

-” হুম, আপাতত আউট অভ ডেঞ্জার। কেবিনে শিফট করানো হয়েছে। ”

তিথি একটা সস্থির নিঃশ্বাস ফেলে। ফাহাদের পাশে ইনায়া আর নিধি কে দেখে অবাক হয়৷ নিধি কে সে চেনে। ইশানের ফোনে নিধির অসংখ্য ছবি আছে। নিধির সাথে ইনায়ার কি সম্পর্ক? ভাবছে তিথি। ইশান মুচকি হেসে ইনায়া সামনে দাঁড়ায়।

-” কেমন আছো তুমি? ”

-” ভালো ভাইয়া। বাড়ির সবাই কেমন আছে? ”

অকপটে জানতে চাইল ইনায়া। ইশান ম্লান হাসলো। তার বাড়িতে ঝামেলা লেগেই রয়েছে। ইনায়ার চলে আসাতে যেন সবাই টুটে গেছে।

-” সবাই ভাল আছে ইনায়া। কিন্তু তোমাকে মিস করছে খুব৷ ”

-” আমি দুএকদিন পরে নিধির সাথে যাব বাড়ির সবাই কে দেখতে। ”

হাসি মুখে বলে ইনায়া। তিথি প্রশ্নবিদ্ধ মুখে ইশানের দিকে তাকিয়ে আছে। ফাহাদ তাড়া দেয় জায়ান কে দেখতে যাবার জন্য। ইনায়া ফাহাদ কে অনুসরণ করে। তিথি কিছু বলবে তার আগেই ইশান মুখটাকে গম্ভীর করে তিথিকে জানায়,

-” ইনায়া নাভান ভাইয়ের বউ। ”

তিথির চোখ বড়সড় হয়ে যায়। নাভানের কাহিনি তো সে ইশানের কাছ থেকে পুরোটাই শুনেছে। তখন ইনায়ার জন্য প্রচুর মায়া লেগেছিল। ইশান কে বলেও ছিল যাতে ইনায়ার সাথে দেখা করায়। আর সে না যেনেই ইনায়ার সাথে খারাপ ব্যবহার করলো। ভেতরে প্রচুর গ্লিটি ফিল করে তিথি। এদিকে ক্ষ্যাপা বাঘিনীর ন্যায় নিধি ইশানের হাত বগলদাবা করে অন্যদিকে নিয়ে যেতে লাগলো। ইশান কিছুতেই হাত ছাড়াতে পারল না। তিথি কিছুক্ষন বিষ্ময়কর দৃষ্টি দিয়ে তাদের দেখে। হঠাৎ জায়ানের কথ মনে হতেই, পিছন ফিরে দৌড় লাগায়।

কেবিনে ঢুকতেই ইনায়া দেখে মিনারা বেগম মুকে শাড়ির আচল চেপে ধরে কেঁদে যাচ্ছেন। বেডে জায়ানকে উপুড় করে শুয়ে রাখা হয়েছে। কাঁধের দিকে গুলি লাগায় এই ব্যবস্থা। জায়ানের মুখটা মলিন হয়ে রয়েছে। এখনো জ্ঞান ফিরেনি। হাতে ক্যানোলা স্যালাইন চলছে তাতে। মুখে নাকে একটা সাদা চিকন নল ঢোকানো। শক্তপোক্ত ছেলের এই দশায় মিনারা বেগম আর মিজানুল করিমের অবস্থা খুবই করুন। ইনায়ার বড্ড মায়া হলো। ফাহাদের চোখে পানি চিকচিক করছে। জায়ান কে এইভাবে দেখে তার ভাল লাগছেনা। অতঃপর তিথিও ঢুকলো সেখানে। এতো ভিড় দেখে নার্স এসে সবাইকে বেরোতে বলে। একে একে সবাই বের হতে মিজানুল করিম ইনায়া কে তার কাছে ডাকেন। ইনায়া ধির পায়ে সেখানে যেতেই তিনি শান্ত স্বরে বলেন,

-” তোর জন্য ছেলেটা আমার জীবন পেল। নাহলে আজ ছেলেহারা হতে হতো। ”

-” ইনায়া জায়ানের সাথে ছিল? ”

অবাক স্বরে জিজ্ঞেস করে মিনারা বেগম। ফাহাদ তাকে সবটাই বলে। মিনারার অভিব্যক্তি কি তা ঠাওর করতে পারেনি ইনায়া। তিনি ঠান্ডা চোখে ইনায়ার দিকে তাকিয়ে থাকেন। এদিকে তিথি তার মনে অনুশোচনায় ভুগছে। ইনায়া কাছে তাকে মাফ চাইতে হবে। মিজানুল করিম ইনায়া কে আবার বললেন,

-” তোকে বাড়িতে নিয়ে যেতে বলেছিলাম জায়ান কে। সেই দায়িত্ব নিয়ে সবটা৷ আমাকে করে দিয়েছিল। জায়ান বলল তোর নাভানের সাথে যত তাড়াতাড়ি ডিভোর্স হবে ততই ভাল। আজ গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল একটা। নাহিদ মির্জার সাথে বসে আমি ডিভোর্সের সব কিছু ঠিকঠাক করে নিয়েছি। দু একদিন বাদে কাগজ এসে যাবে। তুই সাইন করে তোর দিকটা ঠিক করে নিস। বাদবাকি নাভান এলেই হয়ে যাবে। ”

সব শুনে ইনায়ার ভিতর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে। জীবনের শেষ পরিস্থিতি কি হবে? কে জানে? তিথির ইনায়ার সুন্দর মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে বড্ড মায়া হয়। ফাহাদেরও তাই। ইনায়া মিজানুল করিমকে সায় জানিয়ে উল্টো ঘুরে হাটা শুরু করে। কেউ তাকে আটকায় না আর। মিনারা বেগম আবার অন্য কিছু ভাবতে থাকে। জায়ান কেন ইনায়ার ডিভোর্সের জন্য উতলা হয়ে উঠেছে?

এদিকে নিধি প্রচন্ড রাগ নিয়ে ইশানের দিকে তাকিয়ে আছে। পারলে সে মারতে পর্যন্ত পারতো। তখন ইশানকে ধরে সে বাগানের এদিকে নিয়ে আসে। ইশান আজ নিধির কান্ডে অবাক আর বিরক্ত দুটোই হয়েছে। নিধি কখনো তার সাথে এমন করেনি। ইশান বিরক্ত স্বরে বলে,

-” কিরে এখানে আনলি কেন? ”

-” কথা শুনে তো বুঝলাম, সে ফাহাদ ভাইয়ের বোন।”

‘ তো ‘ ভ্রু কুঁচকে তাকায় নিধির নিকট ইশান। নিধি শান্ত চোখে তাকায় ইশানর পানে। মায়াবি মুখখানা কিছুটা মূর্ছা গেছে। পাতলা ঠোঁট গুলো নাড়িয়ে সহসা জিজ্ঞেস করে,

-” তুমি ওর সাথে কি করছিলে? এক সাথেই তো দুজনে হাসপাতালে ঢুকলে। ব্যাপার কি? তুমি কি করে জানলে জায়ান ভাইয়ের খবর? ”

নিধির এতোগুলা প্রশ্নের চিপায় পরে ইশান। নিধি সন্দেহর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ইশান এবার খেঁকিয়ে উঠল,

-” কানের নিচে মারব একটা। তুই আমাকে এইসব কেন জিজ্ঞেস করছিস? তুই কি আমার বস? সর এখান থেকে। ”

-” বলো বলছি। না হলে খারাপ হয়ে যাবে। ”

আরও জোরে খেঁকিয়ে উঠে নিধি। ইশানের চোখ গুলো আরও বড় হয়।

-” তুই আমার সাথে এই ভাবে গলা উঁচিয়ে কথা বলছিস গাধি? ”

-” বলছি, দরকার পরলে আরও জোরে বলব। এখন বলো তুমি এখানের খোজ কি করে পেলে? ”

-” এফবি তে দেখেছি নিউজ। ”

গোমড়া মুখে বলে ইশান। নিধি এবার উত্তর শোনা মাত্রই ঘুরে হাসপাতালের ভিতরে চলে যায়। ইশান বোকার মতো নিধির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রয়।

চলবে……..

#যাতনা_আমার
#সানজিদা_ইসলাম_সূচনা
#পর্ব: ১৬

( কপি করা সম্পুর্ন নিষিদ্ধ।)

কেটে গেছে বেশ কিছুদিন। ইনায়ার জীবন স্বাভাবিক ভাবেই চলছে। তিথি ইনায়ার কাছে মাফ চেয়ে নিয়েছে সেদিনই। ইনায়া আর তিথি খুব মিলে মিশেই থাকছে। এইকয়দিনেই তিথি অনেকটা ফ্রেন্ডলি হয়ে উঠেছে ইনায়ার সাথে। সকাল হয়েছে অনেক আগেই। ইনায়া মাত্র ঘুম থেকে উঠে এক কাপ চা নিয়ে জানালার কাছে দাঁড়িয়েছে। আজ ভার্সিটিতে ক্লাস নেই। তাই ইনায়া ভেবেছে বাইরে বের হবে। দুটো টিউশনি নিয়েছে ইনায়া। মিজানুল আর সোহানার টাকা সে নিতে চায় না আর। নিজেকে গড়তে হবে আগে। তিথি সকাল সকাল গোসল শেষে ইনায়ার পাশে দাঁড়ায়।

-” আজকের দিনে প্ল্যান কি তোমার? ”

ইনায়া পাশে দাঁড়ানো তিথির দিকে তাকায়। মুচকি হেসে চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে ব’লে,

-” আজ একবার ওই বাড়িতে যাব। তারপর বিকালের দিকে টিউশন শেষে ফিরব। ”

-” টিউশনের কি দরকার? বাবা ভাইয়া শুনলে ভিষণ রাগ করবে। ”

ইনায়া হাসল তিথির কথায়। টেবিলের উপর কাপটা রেখে ঘুরে তিথির দিকে তাকিয়ে, আলতো হাসে।

-” কতকাল আর অন্যের ভরসায় থাকব? নিজেকে নিজের কাছেই ছোট মনে হয়। এবার নিজেকে নিয়ে ভাবতে হবে যে। ”

তিথির মন আবারও বিষাদে ছেয়ে যায় ইনায়ার জন্য। এই মেয়েটার জীবনটা আসলেই অস্থিরময়। কিন্তু ইনায়া বড্ড শান্ত নিরুত্তর। তিথি আর কিছু বলে না। তিথি আর ইনায়া রেডি হয়ে বের হয় নিজ নিজ গন্তব্যে।

আলিশান বেডে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে জায়ান। মেজাজ বিগড়ে রয়েছে তার। কাঁধের ঘা টা শুকানোর পথে। এইভাবে রোগী হয়ে বাড়িতে বসে থাকাটা তার মোটেও ভাল লাগছেনা। বাবার কড়া আদেশ বাড়ির বাইরে গেলে ঠ্যাং ভেঙে দিবে। যাতে করে আর রাজনীতির নাম মুখে যেন না আসে। ফাহাদের অভিব্যক্তি ও একই রকম। সাথে তো মিনারা বেগমের ফেচফেচ আছেই। সব মিলিয়ে অতিষ্ঠ হলেও মনের ভেতর আরও একটা জিনিস পোড়াচ্ছে তাকে। দরজায় নক হওয়ায় ধ্যান ভাঙে জায়ানের। একই ভাবে শুয়ে মানুষটিকে আসতে বলে। ফাহাদ ঘরে ঢুকে জায়ানের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। পরনে কমোড়ে সাদা টাওয়াল আর উদাম শরীর। কাঁধের ক্ষতটা ব্যান্ডেজ করা জায়ানের। ফাহাদ পাশে বসে শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করে,

-” এমন নেকেড হয়ে আছিস কেনো? বউ তো নাই যে সিডিউস করবি? ”

জায়ান শান্ত চোখে ফাহাদের দিকে তাকায়। শুয়া থেকে উঠে বসে। দু’হাতে খাটের কার্নিশে ভর করে ঘাড় বাঁকায়। অতঃপর গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করে,

-” খলিলের কি খবর? ”

-” আর বলিস না। শালা বড্ড বার বেড়েছে। আজ বিকালে সাইন রোডে সমাবেশ ডেকেছে। ইলেকশন ও সামনে আর মাত্র কিছুদিন। এবার আটঘাট বেঁধেই নেমেছে। আমাকে নাকি দাঁড়াতেই দেবেনা। আমাদের লোকগুলো কেও হায়ার করার চেষ্টা করছে। তোকে গুলি করে নাকি আমাদের শাসিয়ে তার পাওয়ার দেখিয়ে গেছে। ”

‘ শালা কুত্তা ‘ বিরবির করে বলে উঠে জায়ান। সেদিন ইনায়া পাশে থাকায় কিছু করতে পারেনি সে। না হলে বুঝিয়ে দিত জায়ান করিমকে এতো সহজে নেভানো যায়না। ফাহাদের দিকে তাকিয়ে সে কুটিল হেসে বলে,

-” ও আজ বিকালের সমাবেশে ঢুকতেই পারবেনা। তার আগেই ওর হাড় ভেঙ্গে আমি নল্লি বানাবো। আর ওর ছেলেগুলো কে নল্লি চিবাতে দিবো। ”

-” মানে তুই কি ওর সাথে মারামারি করতে যাবি? ”

আঁতকে উঠল ফাহাদ। জায়ান রহস্যময় একটা হাসি দেয়ে ফাহাদের দিকে তাকিয়ে থাকে।

-” শোন জায়ান একে-তো তুই অসুস্থ। তার উপর আবার বাবা। দাদা থাকতে আমাদের কি বলেছিল মনে নেই? বলেছিল, রাজনীতি ঢুকলে কতো কুত্তা এসে পায়ে কামড়ে ধরবে। আমরাও যদি উলটে সেই কুত্তার পায়ে কামড়ে ধরি, তাদের মধ্যে আর আমাদের মধ্যে পার্থক্য কি রইল। আমারা সবসময় শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করবো। সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন করবো। কোনো হাতাহাতি মারামারি তে যাব না ব্যাস। ”

ফাহাদের কথায় হাসি পায় জায়ানের। সে বিদ্রুপের হাসি দিয়ে বলে ওঠে,

-” এতোদিনে নিশ্চয়ই বুঝে গেছো? রাজনীতিতে রাজনৈতিক কৌশল অবলম্বন না করলে গদিতে টিকে থাকা অসম্ভব। আমি বাবা করো কাছে ঋণী হয়ে থাকতে চাই না। খলিলের পাওনা ওকে ঠিক বুঝিয়ে দেবো। সেদিন ইনায়া না থাকলে ওর বারোটা বাজাতাম। ”

ফাহাদ হতাশ হয়ে যায়। সমাবেশের খবরটা জায়ান কে দেওয়া তার উচিত হয়নি। কিছুতেই জায়ানকে বাড়ির বাইরে যেতে দেবে না ফাহাদ। তাকে দমাতে বিপক্ষের লোক তার ভাইকে টার্গেট করেছে। তার পরিবারকে সেভলি রাখতে হবে ভাবছে ফাহাদ। হুড়মুড়িয়ে হঠাৎ করে ঘরে ঢুকে পরে তিথি। ফাহাদ আর জায়ান এক যোগে সেদিকে তিথির দিকে তাকায়। তিথি জায়ানের পাশে বসে পরে।

-” আজকে ক্লাস নেই। তাই তোমাকে দেখতে চলে এলাম। ”

-” এমন হুটহাট রাস্তায় চলাচল কম করবি এখন থেকে। মিসু আর দিবার সাথে হুটহাট এখানে সেখানে চলে যাসনা। ”

ফাহাদের কথায় হাসে জায়ান। তিথি বোকার মতো ফাহাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। ‘ কেন ‘ অকপটে জানতে চাইল তিথি। ফাহাদ মিনমিনে স্বরে বলে,

-” আর বলিস না অপজিট পার্টি তেতে উঠেছে। না জানি কখন কি হয়। ”

তিথি একটু হাসে। মাথা নাড়িয়ে বলে ওঠে,

-” তুমি চিন্তা করোনা। আমি এখন ইনায়ার সাথে বেশীরভাগ হলের রুমেই থাকি। ”

ইনায়ার নাম শুনে জায়ান নড়েচড়ে বসে। মুখ গম্ভীর করে নিধি কে জিজ্ঞেস করে,

-” কেমন আছে সে? ”

-” আছে একরকম। বিষাদে দিনগুলো কাটাচ্ছে মেয়েটা। তারপরও মুখে হাসি বজায় রাখে। গত কয়দিন যাবত টিউশনিও করছে। নিজের পায়ে নাকি দাড়াতে হবে। তাই নিজ খরচটাও সে চালাতে চায়। ”

তিথির কথায় দুই ভাই নাখোশ হয়ে যায়। ইনায়া কেন টিউশন করবে? তাদের কি কম আছে নাকি? ফাহাদ উচ্চ স্বরে বলে,

-” এটা আবার কেমন বোকামি? আমরা আছি কি করতে? ইনায়া এখন পড়াশোনায় ফোকাস করুক না। চাকরি না হয় পড়াশোনা শেষ করে করবে। তুই ওকে নিষেধ করিস নি? ”

-“করেছি তো ভাইয়া। তার কথা ঘুরেফিরে একটাই।”

তিথি মলিন মুখে বলে। জায়ান বিরক্ত স্বরে বলে ওঠে,

– ” মেয়েটা অত্যন্ত ঘাড়ত্যাড়া। দেখনা আমাকে এই দশ দিনে এসে একবারও দেখে গেলো না। অন্যদিকে টিউশনি নিয়ে পরেছে। ”

জায়ানের কথায় তিথি আর ফাহাদ উভয় মাথা নাড়ায়। ফাহাদ মুচকি হেসে বলে ওঠে,

-” কেনো ভাই? তোকে দেখতে আসা কি তার দায়িত্ব ছিল না কর্তব্য ছিল? ”

জায়ান শান্ত গলায় বলল,

-” কোনোটাই না। মানবিক দিক থেকেও তো পারতো? যেখানে সে নিজেই আমাকে হসপিটাল অবধি নিয়ে গেছিল। ”

ফাহাদ তিথি কে চোখের ইশারায় কিছু বোঝাতেই সে হেসে উঠে। তারপর জায়ান কে ধরে জিজ্ঞেস করে,

-” তুমি ইনায়ার কথা একটু বেশী ভাবছো না ?”

জায়ান জবাব দেয় না। মুখটা গম্ভীর করে রেখে দেয়। ফাহাদ আর তিথি একটু বেশিই বুঝে সব বিষয়ে সেটা জায়ানের ধারণা।

-” তোরা আমার রুম থেকে বের হো। আমি কাপড় পরবো। ”

জায়ানের কথায় তারা উঠতে নিলেই মিনারা বেগম আসেন কফি নিয়ে। তিথি ঝটপট গরম কফি নিয়ে বসে পরে আবার ফাহাদও তাই। জায়ানের হাতে কফির কাপ দিতে দিতে মিনারা শান্ত গলায় বলে,

-” ইনায়া কে নিয়ে তার ডিভোর্স নিয়ে তোমার এতো ভাবতে হবে না। তার জন্য তোমার বাবা আর ভাই আছেন। তুমি নিজের কাজে ফোকাস করো ঠিক মতন। ”

কথাটা বলে মিনারা বেগম চলে গেলেন। তিন ভাই বোন তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। জায়ান মুচকি হেসে কফি থেকে স্লিপ নিয়ে বিরবির করে বলে,

-” আমি আমার নিজে কাজেই তো ফোকাস করছি মা। সেটা তুমি বুঝবে না। ”

মির্জা বাড়িতে ইনায়া এসেছে অনেক্ক্ষণ যাবত। সবার সাথেই কথা হয়েছে। কিন্তু একবারের জন্যও সোহানা মির্জার সাথে কথা হয়নি তার। নিপা গিয়ে দুবার ডেকেও এসেছেন। কিন্তু তিনি আসেনি। নিপার থেকে ইনায়া জানতে পারে, সোহানা আর নাহিদ মির্জার সম্পর্ক সেই আগের মতোই রয়েছে। ইনায়া আয়েশা মির্জা আর নিধির সঙ্গে কথা বলছিল। হঠাৎ সে উঠে দাঁড়িয়ে উপরের দিকে অগ্রসর হয়। সিড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ইনায়ার বুক ভেঙে আসে। এই বাড়িটাকে তো নিজের বাড়ি করে ফেলেছিল সে। এখন সে এখান কার কেউ নয়। সোহান রুমে ঢুকে ইনায়া। খাটে হেলান দিয়ে শুয়ে আছেন তিনি। ইনায়া তার পাশে বসে শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করে,

-” আমার সাথে কথা বলবেনা মামনি? ”

সোহানা মির্জা তাকায় ইনায়ার দিকে। মলিন মুখে হেসে উঠে তৎক্ষণাৎ। শরীরটা তার নেতিয়ে রয়েছে অনেকটা।

-” তোকে দেখলো যে অপরাধের বোঝাটা আরও বেড়ে যায় মা। ”

ইনায়া মলিন হাসে। সোহানা মির্জার হাতটা নিজের সাথে হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে,

-” বাবাইয়ের সাথে কেন সম্পর্ক খারাপ করছো তুমি। উনার একটা ভুলের জন্য দুজন দুজনকে ছাড়বে কেনো। ”

সোহানা শান্ত চোখগুলোতে অশ্রুপাত ঘটে।

-” যার জন্য নিজের জীবনে এতো কিছু ত্যাগ করলাম। নাভানের জন্য সুখ কুড়াতে গিয়ে আমি নিজেই তাকে অতল গহ্বরে তলিয়ে দিয়েছি। এই বোঝা নিয়ে আমি এই বাড়িতে থাকি কি করে? ”

-” নাভান ভুল মামনি। ছোট বেলার ক্ষোভটা কে বড় করে সে ভিষণ ভুল করেছে। তুমি তার ভালোর জন্যই তোমার থেকে পরিবার থেকে আলাদা করেছিলে। যেটা উনার বুঝতে ভুল হয়েছে। পশ্চিমা সংস্কৃতিতে নয় বরং তাকে তুমি স্মার্ট শিক্ষিত করতে চেয়েছিলে। বাবাইয়েরও বোঝার ভুল বাদ দাও। ”

ইনায়ার কথায় হাসে সোহানা। তখনই হঠাৎ নাহিদ মির্জা ঘরে ঢুকে। ইনায়ার সামনেই সোহানার হাত জড়িয়ে ধরে বলে উঠেন,

-” আমি না বুঝেই সেদিন এইসব বলেছিলাম। তাই বলে আমাকে ছেড়ে চলে যাবে। নাভানের এমন হওয়ার জন্য তুমি দায়ী নও। সে নিজেই পশ্চিমা সংস্কৃতি নিজের করে নিয়েছিল। আমার বুঝারই ভুল হয়েছে। ”

সোহানা নিরুত্তর রইল। যদি কিছু না করেও বুকের ভিতর কষ্টে দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া মন তার এতো হাহাকার করে? তাহলে দূরদেশে তার ছেলে কি করে আছে। কি হতো ছেলে শান্ত ভাবে আদুরে কথায় বুঝালে? একাকিত্ব তার ছেলেকে পশ্চিমা সংস্কৃতিতে ঢেকে ফেলেছে। আজ হয়তো সবই ঠিক থাকতো? যদি নাভান কে সে মাতৃত্বের আদরে মানাতো। নানা নানু মারা যাওয়ার পরে নাভান কে একা না রাখলেই আজ এতো কিছু হতো। সোহানার কেনো যানি মনে হচ্ছে সে আসলেই মা হতে পারেনি। নাহিদ মির্জার হাতটা শক্ত করে ধরে সোহানা। ইনায়ার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলে,

-” চল আজকে তোকে আমি নিজ হাতে রেঁধে খাওয়াবো। সময় দিতে পারবি তো? ”

ইনায়া মাথা নাড়িয়ে জবাব দেয়। সোহানাকে একটু হাসতে দেখে নাহিদ মির্জা আর ইনায়ার উভয়ের ভালো লাগে।

সাইন রোডের দিকেই ছিল খলিলের দলীয় সমাবেশ। বিকাল চারটা বাজতে শুরু হবে সেটা। মাঝখানে সড়ক দু’পাশে বিশাল ভূমি। তাতেই সমাবেশের আয়োজন করবে করে ভেবেছিল খলিল। গাড়ি তে করে দলবল নিয়ে সেদিকে যেতেই বাধে বিপত্তি। হঠাৎ করেই কালো রঙের চারটে গাড়ি এসে তাদের মাঝখানে ফেলে গোলগোল করে ঘুরতে থাকে। খলিল কিছুটা ঘাবড়ে যায়। গাড়ি থেকে নামতেই দেখতে পায়। তাদের সামনে রাখা বড় মার্সিডিজ বেঞ্জ ব্র্যান্ডের গাড়ীতে এক পা উপরে রেখে বসে আছে জায়ান। পরনে কালো প্যান্ট আর শরীরে এঁটে রয়েছে কালো শার্ট। শার্টের হাতার উপর দিয়ে বিশাল পেশি গুলো বিদ্যমান। একহাতে সিগারেট টানছে। এক হাত গাড়িতে উঠানো পায়ের হাঁটুর উপর। সেই হাতেই সিগারেট ধরা। খলিল কে বেরোতে দেখে দাঁত বার করে হাসে জায়ান। খলিল ভেতরে একটু ভয় পেলেও প্রকাশ করে না। ভয়ংকর ভাবে রেগে জায়ান কে জিজ্ঞেস করে,

-” এইসব কি জায়ান? অভদ্রের ন্যায় ছেলেপুলে নিয়ে রাস্তা কেনো আটকালে? ”

-” স্যরি কাকু, একটু সহ্য নিন। আপনার ভাতিজারা সভ্যের হতে পারেনি। কি আর করবেন?

ঘাড় বাকিয়ে বলে জায়ান। মধ্য বয়সী খলিল এবার চটলেন। ঠিক সময় বিয়ে করলে জায়ানের মতো ছেলে থাকত তার। আর সেই হাঁটু বয়সী ছেলেরা এখন তার সাথে লাগতে আসে? রাগে গজগজ করতে করতে শুধালেন,

-” বেয়াদব হয়েছ সবগুলো। সামনে থেকে সড়ে দাঁড়াও বলছি। ”

জায়ান এবার বসা থেকে নেমে দাড়ায়। সিধে হয়ে দাড়াতে পারেনা। তবুও মুখে হাসি বজায় রেখে খলিলের সামনে দাড়ায়।

-” এজন্যই আপনার সাথে আমার খেলা সব জায়গায় ভাল চলে। বুঝলেন কাকু? ”

জায়ানের ছেলে গুলো এবার হেসে উঠে। জায়ান ঘাড় বাঁকিয়ে সবকটাকে চুপ করায়।

-” তোরা কি অন্য কিছু মিন করেছিস? খবরদার এটা ভুলেও মনে আনিস না। আমি তো মাঠে ঘাটের খেলার কথা বলছি। ”

সবকটার হাসি আগের থেকে চওড়া হয়ে যায়। জায়ানও গা দুলিয়ে হেসে উঠে। ইগল চোখে খলিলের দিকে তাকিয়ে আছে জায়ান। খলিলের চোখেমুখে ভয়ের আভাস। বাজে ভাবেই আজকে সে জায়ানের হাতে পরেছে। তার সঙ্গে লোকজনও খুবই কম।

-” কি চাইছো তুমি? আমায় বিকাল চারটার আগে সমাবেশে যেতে হবে। তোমার সাথে হিসাব আমি পরে করবো। ”

জায়ান খলিলের কথা শুনে হাসি থামায়। পাশে তাকিয়ে তার দলের সোহেল নামের একটা ছেলেকে ডেকে ওঠে। সোহেল এগিয়ে আসতেই জায়ান মুখটা মলিন করে সুধায়,

-” কিরে? তোরা এমন জড়ো হয়ে কাকু কে যেতে বাধা দিচ্ছিস কেনো? আবদার আছে কোনো? ”

সোহেল খুশীতে গদগদ করে বলে উঠে,

-” আমরা কাকুর কোলে উঠতে চাই। ”

-” এতটুকুই? নে উঠে পর। ”

জায়ান কথাটা বলতেই আরো দুজন ছেলে এসে খলিল কে চেপে ধরে। আকস্মিক ঘটনায় খলিল বিষ্ময়কর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জায়ানের পানে।

-” এইসব কি হচ্ছে জায়ান? ”

জায়ান বাকা হাসে। খালিলের লোক গুলোকে জায়ানের লোকেরা ধরে রেখেছে। জায়ান একটা হকি স্টিক হাতে নিয়ে সেটা অন্য হাতে নাড়াতে নাড়াতে বলে,

-” ওদের আপনার কোলে উঠার সখ হয়েছে। কি করবো বলেন? মাঝেমধ্যে ছেলেপেলের আবদার মিটাতে হয়। আমি আপনার সাথে দশ দিন আগের হিসাব চুকাতে এসেছি কাকু। আপনি পরে হিসেব করলে তো আর আমার পুষবে না। আমি আবার কারো কাছে ধার রাখিনা। ”

কথাটা বলেই জায়ান খিলিল কে পেটাতে শুরু করে। মারতেই থাকে জায়ান ধামেনা আর। খলিলের লোক গুলোকে পিটিয়ে চলছে জায়ানের লোকেরা। খলিল মার খেয়ে আধমরা প্রায়। সে আবেগের বসে বিষাক্ত সাপের লেজে কোপ মেরেছে। এবার সাপের কামড় তো তার শরীরে পরবেই। খোলামেলা জায়গায় আশেপাশের মানুষ এসে ভিড় জমিয়েছে। পাশ দিয়ে দু’একটা গাড়ি যাতায়াত করছে তখনও। ইনায়া মির্জা বাড়ি থেকে ফিরে একটা বাচ্চাকে পড়াতে যাচ্ছিল। হঠাৎ রাস্তায় মানুষের ভীড় দেখে রিকশা থেমে যায়। ইনায়া ভাড়া মিটিয়ে ভীড় ঠেলে ভিতরে যেতেই তার চক্ষু কপালে। জায়ান বেদম ভাবে একটা লোককে মারছে। কয়দিনে আগেও তো মরার মতো অবস্থা হয়েছিল। এখন ঠিকই গায়ে জোর চলে এসেছে। এই সন্ত্রাসী আর ভাল হবে না। আগে তো নিজের বাগান ছিল। এবার জনসম্মুখে গুন্ডামী করছে? ভাবছে ইনায়া। জায়ানের চোখ হঠাৎ মানুষের ভীড়ের মধ্যে অচেনা মুখের পাশে চেনা মুখের দেখা পেলো। হাতের স্টিক টা ফেলে দেয় তৎক্ষনাৎ। ঘামে জবজবে অবস্থা জায়ানের। খানিকক্ষণ আগের পরিপাটি চুলগুলো কপালে বিছিয়ে পরে রয়েছে। একপা দু পা করে ইনায়ার দিকে এগোই জায়ান ইনায়া ও তাই। জায়ান ইনায়ার দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসি দেয়।

-” এখানে কি করো বোকা হরিণি? ”

-” আপনার গুন্ডামী দেখতে এসেছি। ”

-” ওফ্ফ, এতো গুলো দর্শকের মাঝে তুমিই একজন। যে আমাকে সার্থক করে দিয়েছে। ”

ইনায়া মুখ বাঁকায়। জায়ান হাসে গা দুলিয়ে। ইনায়া এবার আশেপাশে তাকিয়ে মুখ গম্ভীর করে ব’লে,

-” আপনি সন্ত্রাসী আর ভালো হলেন কই? ঠিক মতো সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছেন না। আর গুন্ডামী করতে রাস্তায় চলে এসেছেন? এক সাপ্তাহ আগেও তো বিছানায় উপুড় হয়ে পরে ছিলেন। এখন ঠিকই শরীরে জোর চলে এসেছে? ”

জায়ান হাসি থামিয়ে ইনায়ার দিকে তাকায়। শান্ত হয়ে জবাব দেয়,

-” আপনার মনে আছে আমি আহত হয়েছিলাম? ”

-” মনে থাকবে না কেন? সেদিনকার পরিস্থিতিতে আমারা দুজনেই ছিলাম। ”

-” এই জন্যই তো আমি আছি নাকি গেছি তা আপনি এবারো খোজ করেন নি। ”

ইনায়া থমকায়, আসলেই সে জায়ানের কোনো খোঁজ নেয়নি। আর নেবেই বা কেনো? জায়ান তার কে হয়? ইনায়ার মন আবার ঘুরে। মামাতো ভাই হিসাবেও খবর নিতে পারতো।

-” তা এই রাস্তা দিয়ে কোথায় যাচ্ছিলে। ”

জায়ানের গম্ভীর স্বরে তার দিকে তাকায় ইনায়া। নিজেকে ধাতস্থ করে অপকটে বলে,

-” টিউশনি ছিল একটা। সেখানেই যাচ্ছিলাম। কিন্তু আপনার মতো সন্ত্রাসী জন্য তা হলো না। এতো গুলো মানুষকে ছেলেপেলে নিয়ে পেটাচ্ছেন । ”

-” মানুষ পেটাতে ভাল লাগে আমার। তাই পেটাচ্ছি। আর ওই শেয়াল টাই আমাকে গুলি করে ছিল। আর এখন যদি আমি বাঘ হয়ে তার বিচার না করতে পারি, আমার বাঘ না হয়ে বিড়াল সেজে বসে থাকা দরকার। ”

জায়ান গম্ভীর স্বরে বলে ইনায়া কে। ইনায়া অবাক হয়। নিশ্চয়ই এই ছেলে গুলি খেয়ে পাগল হয়ে গেছ। চোখে মুখে হাসি তবুও কি ভয়ংকর অভিব্যক্তি জায়ানের। জায়ান পিছন ফরে সোহেল কে ডাকে। সোহেল আসতেই সে গম্ভীর গলায় বলে,

-” খলিলের লোক যেকোনো সময় এখানে আসতে পারে। তুই ইনায়াকে হলের গেইটে নামিয়ে দিয়ে আয়। আমি এই ফাকে একটু কাকুর খেদমত করি।”

এবার ইনায়ার দিকে তাকিয়ে জায়ান গম্ভীর স্বর আরো গম্ভীর করে,

-” আর লিসেন, তুমি এখন ঘাউড়ামি না করে সোহেলের সাথে যাও। আজ সাইন রোডে মারামারি হবে। পরে বাসায় ফিরতে পারবে না। ”

ইনায়া মাথা নাড়িয়ে সায় জানায়। সে এই ঝামেলায় থাকতে চায় না। জায়ান ঘুরে চলে যেতে নিলেই, ইনায়া পিছন থেকে ডেকে ওঠে। জায়ান ফিরে ইনায়ার দিকে তাকাতেই ইনায়া ঠোঁট নাড়িয়ে আস্তে করে বলে,

-” শেয়াল আর বাঘ যে মামা ভাগিনা তা জানেন নিশ্চয়ই? শেয়ালের বুদ্ধি কিন্তু বাঘের শক্তির চাইতেও বেশী। তাই বলছি, বেশী বল প্রয়োগ না করে বুদ্ধি দিয়ে ভাবুন। না হলে শেয়ালের চতুর বুদ্ধির কবলে পরবেন বাঘ মামা। ”

কথাটা বলে চোখের ইশারা করে ইনায়া চলে যায়। জায়ান বোকার মতো তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। ইনায়া শেষমেশ তাকে মামা উপাধি প্রদান করলো।

চলবে……