যাতনা আমার পর্ব-১৭+১৮

0
1878

#যাতনা_আমার
#সানজিদা_ইসলাম_সূচনা
#পর্ব: ১৭

( কপি করা সম্পুর্ন নিষিদ্ধ।)

শপিং করতে এসেছে নিধি। ঘড়িতে সময় বিকাল পাঁচটা। ইনায়াকে সে জোর করলেও আসেনি। তার টিউশন আছে। একা একা বোরিং লাগছে নিধির। কিছু কেনাকাটা করে থার্ড ফ্লোরে কফি শপে আসে। কিছুক্ষণ বসে থেকে যেই না উঠবে, তখনই তার চোখ পরে সামনে বসা ফাহাদের উপর। তার সাথে বসা অত্যন্ত সুন্দরি শাড়ি পরা একটা রমনী। তারা কিছু একটা বিষয় নিয়ে গভীর আলোচনা করছে। নিধি ব্যাগ থেকে ফোন নিয়ে কয়েকটা ছবি তুললো।

-” গার্লফ্রেন্ড নিয়ে কফি শপে ঘুরে বেড়ায়। আর মেয়ে দেখলেই ফ্লার্ট করে। দেখাবো মজা এই মেয়র কে। ”

নিধি কথাটা বলে ফোনটা আবার ব্যাগে ঢুকিয়ে নেয়। আচমকা ফাহাদের চোখ পরে নিধির দিকে। সে বসা থেকে উঠে। নিধি তা লক্ষ্য করতেই ঝটপট উঠে পরে। নিধি ফাহাদ কে ফেস করতে চায়না। ফাহাদও কম যায়না নিধির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পরে।

-” কেমন আছো নিধি? শপিং করতে এসেছিলে বুঝি? ”

-” দেখতেই তো পারছেন। আবার জিজ্ঞেস করছেন কেনো? ”

ফাহাদের প্রশ্নের প্রেক্ষিতে নিধি তেতে গিয়ে জবাব দেয়। ফাহাদ বিরক্ত হয় প্রচুর। এই মেয়ে তাকে চার আনার দামও দেয়না। অবশ্য এর দায় ফাহাদের। সে নিজেই নিধিকে এমন হতে বাধ্য করেছে। ফাহাদের সাথের মেয়েটা এতোক্ষণে তাদের কাছে চলে আসে। ফাহাদ নিধিকে দেখিয়ে আলতো হেসে বলে,

-” লুক তিলক, সি ইজ নিধি! নাভানের বোন। ”

-” সত্যিই ”

তিলক অবাক হয়। সে খুশি মনে নিধির দিকে হাত বাড়ায়। নিধি আপাদমস্তক তিলক কে দেখে নেয়। স্লিভলেস ব্লাউজের সাথে পাতলা ফিনফিনে শাড়ি পরে আছে মেয়েটি। নিধির কিছুটা রাগ হয়। সে গম্ভীর মুখে তিলকের সাথে হাত মিলায়। অতঃপর গম্ভীর স্বরে বলে,

-” আমি আসছি ফাহাদ ভাইয়া। গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে একটা। ”

কথাটা বলে আর কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বেড়িয়ে যায় নিধি। হাতে তার ভ্যানিলা ফ্লেভারের কুন আইসক্রিম। আজকে গাড়ি আনেনি নিধি। প্রায় সময়ই সে একা একা রিকশা করে ঘুরে। নিধি একটা রিকশায় বসে। ইনায়ার জন্য কিছু কাপড় কিনেছে সে। সেগুলো দিয়ে বাড়িতে যাবে নিধি। কিছুদূর যেতেই নিধি খেয়াল করে একটা গাড়ি তাদের পেছন পেছন আসছে। নিধি খেয়াল করতেই দেখতে পায় গাড়িটা ফাহাদের। নাক মুখ কুঁচকালো সে। এই লোক আবার তাকে ভাউ দেবার চেষ্টা করছে? নিধি এবার তাকে সহজে পাত্তা দিলে তো? গলির মোড়ে রিকশা থামতেই ভাড়া মিটিয়ে নিধি সামনে এগোয়। বাকি রাস্তা হেঁটেই যাবে সে। কিছু দূর যেতেই নিধি দেখে ফাহাদ তার পেছন পেছন আসছে। নিধি উলটো ঘুরেই ফাহাদের দিকে এগিয়ে যায়।

-” কোনো ম্যানার নেই নাকি মেয়র সাহেব? এই ভাবে একটা সাধারন মেয়ের পিছু করছেন? বিষয়টা দৃষ্টি কটু লাগছে আমার কাছে। ”

হাতে হাত রেখে শক্ত স্বরে বলে ওঠে নিধি। ফাহাদ আমতা আমতা করে বলে,

-” মানে, দেখলাম গাড়ি আনোনি। তাই ভাবলাম একটু খেয়াল রাখি। এই আর কি। ”

নিধি এবার তেতে উঠে। আর এক কদম এগিয়ে বাজখাঁই গলায় বলে,

-” খেয়াল রাখার জন্য আমার ফ্যামেলি আছে। আপনার এতো টেনশন করতে হবে না। ”

ফাহাদ অন্য দিকে তাকিয়ে ‘চ’ উচ্চারণ করে উঠলো। অতঃপর নিধির দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করে,

-” তুমি কি আমার সাথে একটু ভাল করে কথা বলতে পারো না? সবার সাথে তো ঠিকই থাকো। আমি সামনে এলেই মেজাজ দেখাও। ”

-” কারণ টা আপনি নিজেই তৈরি করে দিয়েছেন। ”

নিধির কথায় ফাহাদ স্মৃতিচারণ করে দুই বছর আগের। তখন নিধির সাথে ফাহাদের টুকটাক এফবি মেসেঞ্জারে কথা হতো। নিধি বড় ভাইয়ের মতোই ফাহাদ কে সম্মান করতো। বিপত্তি সৃষ্টি হয় হঠাৎ করেই ফাহাদ নিধির সাথে ফ্লার্ট শুরু করে। নিধি প্রচুর বিরক্ত হয় এতে। ফাহাদ কে বুঝিয়েও কেনো লাভ হয় না। ঝামেলা তখন আরো জোরালো হয়। যখন ফাহাদ নিধিকে তার সাথে রিলেশনে যাবার অফার করে। নিজের থেকেও ১৩ বছরের বড় ফাহাদের এমন সাহস দেখে ১৭ বছর বয়সী নিধি তখন তেতে উঠেছিল। ইচ্ছে মত ঝেড়েছিল ফাহাদ কে। সে তো বড় ভাইয়ের জায়গায় বসিয়েছিল ফাহাদ কে। সেই থেকেই নিধি ফাহাদ কে দেখলেই রেগে উঠে। সব কথা মনে করে ফাহাদ নিধির দিকে চোরা চোখে তাকায়।

-” আপনি কি আসলেই মেয়র? আমার তা মনে হচ্ছে না। কাজকর্ম ফেলে এভাব রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছেন। তা তো ঘুরবেন। ডান হাত ছোট ভাই আছে যে। লজ্জা করে না? অসুস্থ ছোট ভাইটাকে কালও মারামারি করতে পাঠিয়েছিলেন? আপনি একটা কাজ চোর। আপনাকে দিয়ে এলাকার কোনো উন্নয়ন হবেনা দেখছি। ”

কর্কশ কন্ঠে বলে ওঠে নিধি। ফাহাদ প্রতিবাদের স্বরে বলল,

-” মোটেই না। জায়ানকে করা পাহারায় রেখেছিলাম কাল। তারপরও যানি কেমন করে বেড়িয়ে গেল। আর আমি ভুলেও কাজ নিয়ে হেলাফেলা করিনা। একটু আগেই তো মিটিং সেরে এলাম। ”

-” হা, কি মিটিং করেছেন, তা আমি নিজের চোখেই দেখেছি। ”

-” আসলে তুমি ভুল…..

ফাহাদ কে কথা শেষ করতে দেয় না নিধি। সামনে ফিরে হাটতে শুরু করে। ফাহাদও তাল মেলায়। কিছুক্ষন হাটতেই তাদের পিছনে একটা কুকুর আসে। সেও ওদের সাথেই চলছে। নিধি এবার ভয় পেলে পেছন ফিরে খেঁকিয়ে উঠে,

-” আপনার এলাকার কুত্তাটাও দেখছি আপনার শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছে। ”

ফাহাদ কুকুর টা কে দেখে একটু দূরে সরে দাড়ায়। তারপর নিধির দিকে তাকিয়ে রাগী গলায় বলে,

-” তুমি আমাকে কুকুর বলে মিন করছো? ”

-” আরেহ বাহ্, এতো তারাতাড়ি বোঝার জন্য ধন্যবাদ। বলবো না তো কি করবো? দুজনেই তো পেছনে লেগেছেন। ”

ফাহাদ রেগে কিছু বলতে যাবে তার আগেই, সে লক্ষ্য করে কুকুরটা নিধির হাতের আইসক্রিমের দিকে তাকিয়ে আছে।

-” এক্ষুনি আইসক্রিমটা ফেলো বলছি। ”

-” মানে আইসক্রিম ফেলবো কেনো? জীবনেও ফেলবো না। ”

-” তাহলে কুকুরের কামড় খাও। ”

ফাহাদের কথায় নিধি লক্ষ্য করে আসলেই কুকুরটা তার আইসক্রিমের দিকে তাকিয়ে আছে। নিধি একটা ঢুক গিলে ফাহাদ কে বলে,

-” এটাকে এক্ষুনি তাড়ান বলছি। ”

ফাহাদ ভয়ে ভয়ে বলে ওঠে,

-” আমি কুকুর ভয় পাই। ”

হাসতে গিয়েও হাসেনা নিধি। কারণ সেও তো একই পথের পথিক। তবুও ছেলে হয়ে ফাহাদ ভয় পাবে কেন? মানতে পারেনা নিধি।

-” মেয়র হয়ে কুত্তাকে ভয় পাচ্ছেন? দাঁড়ান আমার থেকে শিখে সাহসী হয়ে নিন। ”

নিধির কথায় ফাহাদ চমকায়। এই মেয়ে কি করবে এখন? নিধি আশেপাশে তাকিয়ে একটা ইটের কনা এনে কুকুরটা কে ঢিল ছুড়ে। ব্যাস্ মুহূর্তেই কুকুরটা তেতে নিধির দিকে তাকিয়ে খেঁকিয়ে উঠে। নিধি ভয় পেয়ে দিকশূন্য হাড়িয়ে দৌড় লাগায়। ফাহাদ হতভম্ব হয়ে সে নিজেও একই কাজ করে। কুকুরটাও তাদের পিছনে ক্ষেপে যায়। নিধি আইসক্রিম খাচ্ছে আর দৌড়চ্ছে। পাশে তাকিয়ে ফাহাদ কে দেখে ব্যঙ্গ করে বলে,

-” এই নাকি এলাকার মেয়র? আমাকে নিজের এলাকার কুত্তা দিয়ে ধাওয়া করিয়েছেন তো? এর হিসাব আমি পরে করবো। ”

ফাহাদ হুংকার দিয়ে বলে,

-” আগে এর থেকে ছাড়া পাই। তারপর তোমার সাথে হিসাব করবো আমি। ফাজিল কোথাকার। ”

নিধি আর কিছু বলতে গিয়েও বলেনা। লক্ষ্য করে দৌড় প্রতিযোগিতায়।

দুইটা বাচ্চা ছেলেকে আজ পড়াতে এসেছে ইনায়া। দুজনেই যমজ ভাই। একটা একটু গম্ভীর অন্য ছেলেটা প্রচুর দুষ্টু। এক ঘন্টা কি করে একে সামাল দিবে ভাবছে ইনায়া। কখোনো ভাইয়ের খাতা টেনে নিচ্ছে তো কখনো নিজের টা ফেলে দিচ্ছে। একজন মহিলা নাস্তা দিয়ে গেছে ইনায়াকে। সেগুলোও এক প্লেটে জমাচ্ছে ছেলেটা। ইনায়া বিশেষ ভাবে ছেলেটা কে কিছু বললেও মানছে না। হঠাৎ সেখানে বাচ্চাদের মা রিমা আসে। তাকে দেখে ছেলেটা শান্ত হয়ে বসে। রিমা ইনায়ার পাশে বসে ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলে,

-” আসলে আমার এই ছেলেটা প্রচুর দুষ্টুমি করে। আশা করি মানিয়ে নিবেন। কথা না শুনলে বেত মারার ভয় দেখাবেন। আমি এটাই করি। ”

-” সমস্যা নেই বাচ্চারা দুষ্টুমি করবে এটাই স্বাভাবিক। ”

ইনায়া হেসে জবাব দেয়। রিমা প্রশান্তি হেঁসে জায়গা ত্যাগ করে। ইনায়া এবার ছেলে দুটোর গাল টিপে দেয়। বাচ্চা গুলো দেখতে খুব কিউট।

-” নাম কি তোমাদের? ”

ইনায়া মুচকি হেঁসে জিজ্ঞেস করে। এতোক্ষণ যে লাফালাফি করছিল সে এবার চটপট করে বলে,

-” আমি শুদ্ধ। ক্লাস থ্রি তে পড়ি। আর তুমি? তোমাকে আমরা কি ডাকবো? ”

-” আমি ইনায়া। অনার্স ১ম বর্ষ। তোমরা আমাকে আপু বলে ডাকতে পারো। ”

শুদ্ধ মুচকি একটা হাসি দেয়। ইনায়া পাশের বাচ্চাটির দিকে তাকায়। সে গম্ভীর মুখে এতোক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে ছিল। ইনায়া তাকাতেই সে নড়েচড়ে বসে।

-” আমার নাম সচ্ছ। আমি বড়ো হয়ে ডাক্তার হতে চাই। ”

-” আর তুমি শুদ্ধ? ”

ইনায়া জিজ্ঞেস করে শুদ্ধকে। সে আগ্রহ নিয়ে বলে ওঠে,

-” আমি কিছুই হতে চাইনা। কারণ আমি বাবার ব্যবসা সামলাবো। ”

-” জীবনে বড় হতে হলে সবারই একটা নিজস্ব স্বপ্নের গতিতে এগিয়ে যেতে হয়। আর বাকিটা নিয়তি। তোমার বাবা যে ব্যবসায়ী, সেও নিজের স্বপ্ন পূরণে হয়েছে। ”

শুদ্ধ কিছুক্ষণ ভাবলো। তারপর চমক হেঁসে ওঠে জবাব দেয়,

-” সচ্ছ ডাক্তার হবে। আর আমিও যদি অন্য কিছু হই। বাবার ব্যবসা সামলাবে কে? তাই আমি বড় হয়ে বাবার হাতে হাত মেলাব। আর আম্মুর মতো দেখতে লাল টুকটুকে একটা বউ আনবো। ”

শুদ্ধের কথায় ইনায়ার চোখ বড়সড় হয়ে যায়। এতো ছোট বাচ্চার এমন পাকা কথা? সে আর শুদ্ধ কে ঘাটে না। বই খুলে পড়ানোতে মনোযোগ দেয়।

সন্ধ্যা হয়ে আসছে প্রায়। প্রথম দিন দেখে বাচ্চাদের একটু বেশীই সময় দিয়েছে ইনায়া৷ বিকাল থেকে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে আছে। বছরের প্রথম বৃষ্টির আগমন বুঝি হতে চলল। ইনায়া জলদি বাচ্চাদের থেকে বিদায় নিয়ে বেড়িয়ে আসে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকায় ইনায়া। আকাশটাও আজ তার মনের মত রং ধরেছে। কালো কালো মেঘ গুলো জমেছে একত্রে। তা শুধু এখন বৃষ্টি হয়ে ঝরে পরার অপেক্ষা। বৃষ্টি ইনায়ার ছোট বেলা থেকেই খুব পছন্দের। ইনায়ার পড়নে শুভ্র রাঙা সাদা সেলোয়ার স্যুট। সে মাথায় ভালো মতো কাপড় দিয়ে হাটতে থাকে একটা রিকশা পাবার আশায়। ক্ষানিকখন বাদে রিকশা পেলেও, অতিরিক্ত ভাড়ার কারনে ইনায়া ছেড়ে দেয় সেটা। ব্যাগে টাকার পরিমাণও খুব কম। সোহানা মির্জা খরচের জন্য যা টাকা দিয়েছিল সব প্রায় শেষের পথে। রাস্তার সাইডে দাড়িয়ে ইনায়া। ল্যাম্পপোস্টের বাতি গুলো মিটিমিটি জলে উঠেছে তৎক্ষনাৎ। হঠাৎ করেই বাতাস বয়ে ঝুম বৃষ্টি নামতে শুরু করে। ইনায়া এবার বেকায়দায় পরে। এখন আফসোস হচ্ছে রিকশাটা তখন ছেড়ে দেবার জন্য। সামনে একটা দোকান দেখে সেখানে গিয়ে দাঁড়ায় ইনায়া। অনেক্ক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেও বৃষ্টি আর থামে না। এদিকে ধরণীতে সন্ধ্যার আধার নেমে আসে। ইনায়া হঠাৎ লক্ষ্য করে দোকানে বসা দুটো লোক তার দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সাদা জামা ভিজে যাওয়ায় শরীরের কিছু অংশ দেখা যাচ্ছে। ইনায়া এবার ভয় পেয়ে দোকান থেকে বেড়িয়ে বৃষ্টির মধ্যেই হাটা শুরু করে। কিছু দুর যেতেই লোকগুলো ইনায়ার সামনে এসে দাঁড়ায়।

-” আমগোরে দেইখা পাইলাইতাছোস মাইয়া? চল টাকা দিমুনি বাড়াইয়া। ”

ইনায়ার ভেরটা ঘিনঘিন করে উঠে যেন। সে ঠোঁট কামড়ে নিজের ভিতর আসা কান্না গিলে নেয়। ভয়ার্ত মুখটাকে কিছুটা কঠিন করে বলে ওঠে,

-” দেখুন আপনারা আমাকে যেমন মেয়ে ভাবছেন আমি তেমন না। রাস্তা ছাড়েন আমার। ”

-” এতো বৃষ্টির মাঝে কই যাইবা মাইয়া। এহন আমগোরে খুশি কইরা দেও। ”

কথাটা বলে লোকটা ইনায়ার হাতটা ধরতে এলেই, ইনায়া লোকটার পশ্চাৎদেশে একটা জোরে লাথি দিয়ে দৌড় দেয়। লোকটা লাথি খেয়ে রাস্তায় বসে পরে। অন্যজন ইনায়ার পিছু করে। সন্ধ্যার নির্জন বৃষ্টির রাস্তায় ইনায়া প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে, নিজের সম্ভ্রম হারানোর ভয়ে। কিছু দূর যেতেই গাড়ির হেডলাইটের আলো চোখে আসতেই ইনায়া দাঁড়িয়ে পরে। মূহুর্তেই গাড়িটা বিশাল বড় ব্রেক কষে ইনায়াকে ধাক্কা দিয়ে দেয়। ইনায়া মৃদুভাবে ধাক্কা খেয়ে রাস্তায় পরে। এতোক্ষণ ইনায়ার পিছনে আসা লোকটা দৌড়ে পালায়। ইনায়া হাঁটু ধরে বসে থাকে। তখনই হুড়মুড় করে গাড়ি থেকে একজন নেমে ইনায়ার পাশে এসে বসে।

-” আপনি ঠিক আছেন তো? এইভাবে রাস্তায় দৌড়াচ্ছেন কেন? ঠিক মতো ব্রেক না করলে তো মরতে বসতেন। ”

হঠাৎ এক পুরুষ ভরাট কন্ঠের কথা শুনে থমকায় ইনায়া। ভিতরে কিছুটা অস্থির অনুভব করে। আকাশে প্রচুর বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সেই সাথে অবিরাম ধারায় বৃষ্টি তো আছেই। ইনায়া মুখ তুলে সামনে তাকায় পুরুষ অভয়টির দিকে। মুহূর্তেই তার হৃদয়টা ছলাৎ করে উঠে। ভুল দেখছে না তো ইনায়া? ভেজা নেত্রপল্লব ঝাপটায় বারংবার। বিদ্যুৎ চমকানোতে সামনের অভয়ের মুখশ্রী প্রকাশ হয়। না ভুল দেখছে না। এই তো সে পুরুষ। যার জন্য ইনায়ার অনেক রাত ঘুম বিহীন কেটেছে। ইনায়া নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থাকে নাভানের দিকে। যে এখন ইনায়া দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। বৃষ্টিতে ভিজে দু’জনেরই জুবুথুবু অবস্থা হয়ে আছে। বৃষ্টির পানি মুক্তোদানার মতো ইনায়ার মুখ বেয়ে গলদেশে আছরে পরছে। চোখ দিয়ে অঝোরে নোনা পানি পরছে ইনায়ার। যা বৃষ্টির ফোটা আড়াল করে রেখেছে।

-” আপনি ঠিক আছেন তো। ”

নাভান সহসাই জিজ্ঞেস করে। ইনায়া নিশ্চুপ কোনো উত্তর দিতে পারে না। কেউ যেন তার গলা চিপে ধরে আছে। নাভান বিরক্ত হয়ে যায় প্রচুর। এয়ারপোর্ট থেকে আসতে আসতে জ্যাম, বৃষ্টি আবার এই মেয়ে। বাংলাদেশে পা রেখে সিম ভড়তেই সাফরানের হাজার টা ফোন। অফিসের ঝামেলা যেন শেষ হবার নয়। তার জন্যই আসতে এতো দেড়ি। কতো কাঠখড় পুড়িয়ে বাংলাদেশে এসেও শান্তি নেই। নাভান একপলক সামনের মেয়েটির দিকে তাকায়।

-” আমি অল মোস্ট ভিজে গেছি। মাত্রই দেশে ফিরলাম। এই ওয়েদার আমি মানানসই নই। আপনি যদি কাইন্ডলি আপনার ঠিকানাটা বলতেন? ”

ইনায়া এবার বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। পায়ে সামান্য মোচড় লেগেছে। হাটলেই ঠিক হয়ে যাবে। নাভানের শরীরে ছাই রঙের শার্ট। যেটা শরীরে এটে আছে। সামনের দুইটা বাটন খোলা। তাতে লোম হিন বুকের অংশ দেখা যাচ্ছে। চুলগুলো বৃষ্টির পানিতে কপালে আছরে পরেছে। ইনায়া উল্টো ঘুরে ব্যাগ হাতে নিয়ে চলে যেতেই নাভান বলে,

-” দেখুন, আমি যদি ভুল না হই কেউ একজন আপনাকে ধাওয়া করছিল। এই রাতে গাড়িও পাবেন না। আপনি আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন। ”

ইনায়া তাচ্ছিল্যের সাথে হাসে। যেটা নাভানের অজানায় থেকে যায়। এতক্ষণে ইনায়া মুখ খুলে,

-” দেখুন বৃষ্টি কমে এসেছে। আমি ঠিক যেতে পারবো। আপনাকে ধন্যবাদ। ”

নাভানের ইনায়ার কথাটা পছন্দ হয় না। সে বিরক্তের স্বরে বলে,

-” লিসেন! আপনি এখনো সেভ না। ওই লোকটা যদি আবার এটাক করে। আপনি আমাকে বিশ্বাস করে গাড়িতে বসুন। আমি সেভলি পৌঁছে দেব। ”

ইনায়ার এবার বুক চিড়ে কান্না আসে। সামনের লোকটা তার স্বামী। আর কিছুক্ষণ সে এখানে থাকলেই কেঁদে ফেলবে। কিন্তু সে নাভানের সামনে নরম হতে চায় না। লোকটা এসেছে তাকে জীবন থেকে সরাতে। ইনায়াও সেটা সাদরে গ্রহণ করবে। কেঁদেকেটে নাভানের সামনে নিজেকে অসহায় দাবি করতে চায় না ইনায়া।

-” প্লিজ চলুন। ”

ইনায়া আর রা করে না। নাভান গাড়ির দরজা মেলতেই ইনায়া উঠে বসে। নাভান গাড়িতে বসে স্টিয়ারিং ঘোরাতে ঘোরাতে ইনায়ার দিকে এক পলক তাকায়। ইনায়া মাথা নুইয়ে বসে আছে। ব্যাগ থেকে একটা কাগজ বের করে নাভানের দিকে এগিয়ে দেয়। নাভান ঠিকানাটা দেখে একটু সস্থি পায়। একই রাস্তা হলের। বাকিটা পথ নাভান ইনায়াকে জিজ্ঞেস করে গাড়ি চালায়। পথে কেউ কোনো কথা বলে না। ইনায়ার বেহায়া চোখ বার বার নাভানেই নিবদ্ধ ছিল। লোকটা তো তার, সে যতই অস্বীকার করুক। কিন্তু পরিস্থিতি কি নির্মম অবিচল। নাভান ইনায়াকে বার কয়েক বার লক্ষ্য করে। মেয়েটার মায়াবী চোখজোড়া যেন কিছু বলছে তাকে। দীর্ঘ একঘন্টার জার্নি শেষে হলের কিছুটা সামনে দুই রাস্তার মোড়ে আসতেই ইনায়া বলে ওঠে,

-” এখানেই রাখুন, নাহলে আপনার আবার গাড়ি বেক করতে হবে। ”

-” আপনি কি করে যানলেন?

অবাক হয়ে প্রশ্ন করে নাভান। ইনায়া হকচকিয়ে যায়। তারপর কথা কাটানোর চেষ্টা করে বলে,

-” আসলে আমার মনে হয়েছে এমনটা। ”

-” আসলেই ”

নাভান ঠোঁট ছড়িয়ে হাসল। ইনায়া নাভানকে ধন্যবাদ জানিয়ে উল্টো ঘুরে হাটা শুরু করে।

-” আপনার নামটা তো বললেন না মিস? ”

নাভান জিজ্ঞেস করে। ইনায়া পিছন ফিরে মুচকি হেসে জবাব দেয়,

-” ইনায়া! আমি ইনায়া। ”

কথাটা বলে আগের ন্যায় ইনায়া চলতে থাকে। নাভান ইনায়ার নাম শুনে হতবাক হয়। মনের মধ্যে ভেসে উঠে দশ মাস আগের বিয়ে করা সেই মেয়েটির নাম। ইনায়া? এতোটা মিল নামের? নামটা বিহীন আর কিছুই তো ইনায়ার জানে না নাভান। নাভানের চোখে ভেসে উঠে ইনায়ার মুচকি হেঁসে উঠাটা। কি নিষ্পাপ লাগছিল তখন।

কান্নারা বাঁধ ভেঙে গড়িয়ে পরে অশ্রু হয়ে। ইনায়া অনেক কষ্টে নিজেকে সামাল দেয়। নাভান কে দেখে পুরোনো স্মৃতি যেন মাথা চেপে ধরে তার। এই ভাবে হুট করে সামনে আসাতে ইনায়া কি প্রতিক্রিয়া দিবে? নিজেই ভুলে গেছে। চোখের সামনে ভেষে উঠে নাভান আর অদিতির অজস্র অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি। যা এতোদিন অদিতি তাকে একের পর এক দিয়ে এসেছে। চার মাস আগেও অদিতি তাকে মেসেজে বলে ছিল। যেটা তার সেটা আগেই ছুয়ে দিয়েছে অদিতি। ইনায়া ব্লক করে দিয়েছিল তখন অদিতিকে। তারপরও বিভিন্ন নাম্বার দিয়ে ইনায়াকে জালায় অদিতি। মাঝে মধ্যে ইনায়ার অবাক লাগে এতোটা নির্লজ্জ কোনো মেয়ে হয় কি করে। কোনোদিন এই দুটো মানুষ কে সে ক্ষমা করতে পারবে না। হলের গেইটের সামনে আসতেই থমকায় ইনায়া। চোখ পরে সামনের কালো গাড়িতে আধ শোয়া হয়ে থাকা জায়ানের পানে। যে এক পায়ের উপর আরেক পা রেখে এই বৃষ্টিতে ভিজে বিয়ার গিলছে। চোখ তার ইনায়া তেই নিবদ্ধ। ইনায়া দু কদম আগে বাড়াতে, জায়ান গলা ছেড়ে গেয়ে উঠলো,

-” বান্ধবী তোর ব্যবহার টা আজও বুঝিনি। জানতাম না তোর ভেতরে এতো শয়তানি। ”

ইনায়া চোখমুখ কুঁচকায়। তারপর শীতল কন্ঠে বলে,

-‘ বাজে ‘
-‘ কি?’
– ” আপনার গান আর গানের গলা। দুটোই বাজে। ”

জায়ান মুচকি হেসে বলে উঠে,

-” বোকা হরিণ, সাহসী হয়ে উঠছো? মন্দ নয় বটে। কিন্তু এই নির্জন রাতে কতোটুকু সেভে থাকতে পারবে? ”

ইনায়া নিষ্প্রাণ হেঁসে উত্তর দেয়, ” যতক্ষণ দেহে প্রান থাকবে। ”

জায়ান ঘাড় নামিয়ে হেঁসে উঠে। গাড়ি থেকে নেমে ইনায়ার সামনে এসে দাঁড়ায়। সাদা টিশার্ট কালো জিন্স। ইনায়ার দিকে তাকিয়ে হাতের বোতলে মুখ লাগায় জায়ান। ইনায়া লক্ষ্য করে জায়ানের কপাল হাতে ব্যান্ডেজ করা নিশ্চয়ই কালকের মারামারি করতে গিয়ে লাগিয়েছে।

-” এই অসুস্থ শরীর নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজছেন কেন? আপনার যে অনেক শক্তি তা বোঝাতে? ”

জায়ান উত্তর দেয় না। নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থাকে ইনায়ার দিকে। ইনায়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে গেইটের দিকে অগ্রসর হয়। পেছেন থেকে হেঁসে বলে,

-” আজকেও ড্রেস কোড মিল খেয়াল করেছেন হরিণী? ”

ইনায়া দাড়ায় কিন্তু পিছন ফিরে না। জায়ান হাঁসে। বোতল হাতে ঘাড় কাত করে ইনায়াকে দেখতে থাকে। আবারও মেঘের গুড়ুম গুড়ুম আওয়াজ আকাশে ভেসে উঠে। জায়ান এবার হালকা উচ্চ স্বরে বলে ওঠে,

-‘ এই বৃষ্টিটা ঠিক তোমারই মতো! যতক্ষণ না মেঘ ডাকে আসেই না! ”

ইনায়া এবার ঘুরে, মুখ কিঞ্চিত বাঁকা করে শান্ত কন্ঠে শুধাল,

-” রাজনীতি ছেড়ে দিয়ে মুভিতে কাজ করেন। ভালো ফেন ফলোয়ার বাড়াতে পারবেন। কপি বাজ একটা। ”

জায়ান ঠোঁট উলটোয়। হতাশ হয়ে বলে যায়,

-” হাজারো বৃষ্টিসিক্ত রোমান্টিক ছেলেদের মনের কথা নিয়ে যদি, ডিরেক্টর ছবি বানায়? এতে আমার কি অপরাধ? ”

ইনায়া হেঁসে ওঠে। নির্মল মুক্তোঝরানো হাঁসি তার।

-” বাড়িতে যান। বিপক্ষের কেউ দেখলে কিমা বানাবে। ”

কথাটা বলে ইনায়া গেইটের ভিতর ঢুকে পরে। জায়ান গাড়ির সামনে গিয়ে বিরবির করে বলে,

-” এই স্নিগ্ধ বৃষ্টির ধারাতে, কাটুক রাত তোমারই মায়াতে। জানতে পারবে কি কোনোদিন? হয়েছি প্রনয়ে দগ্ধ এই রাতে, তোমার ওই মায়া ঝরা হাঁসিতে।

চলবে……………….

#যাতনা_আমার
#সানজিদা_ইসলাম_সূচনা
#পর্ব : ১৮

( কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ)

ইশানের ঘরে উকি দিচ্ছে নিধি। দরজাটা হালকা ভিড়ানো ছিল। শূন্য ঘর দেখে পা টিপে রুমে ঢুকে নিধি। ইশান নিশ্চয়ই ওয়াশরুমে। নিধি ঘরময় কিছুক্ষন ঘুুরে কাবার্ট থেকে ইশানের একটা টিশার্ট নিয়ে নেয়। প্রায় সময় সে ইশানের পছন্দের কাপড় নিজের কাছে রেখে দেয়। নিধি এবার ওয়াশরুমের দরজা হালকা ধাক্কা দিতেই, দেখে সেটা খুলা। নিধি ভ্রু কুঁচকায়। এতো রাতে কই যাবে ইশান নিচেও তো নেই। নিধি ভাবলো আয়েশা মির্জার রুমে আছে নিশ্চয়ই। সেটা ভেবে নিধি দাদির রুমের দিকে অগ্রসর হয়। দরজার কাছে আসতেই থমকায় সে। ভালো করে খেয়াল করে দেখতে পায়। তার বাব-মা, চাচা-চাচি আয়েশা মির্জার শিয়রে বসে রয়েছেন। আয়েশা মির্জা পান চিবুচ্ছেন। আর তিরিক্ষ দৃষ্টিতে দুই ছেলে আর ছেলের বউদের পরিক্ষা করছেন। আয়েশা মির্জা বাদে বাকি চার জনের মুখ থমথমে। আয়েশা মির্জা এবার সুর টেনে বলে উঠেন,

-” তা আমার এক কথা শুনেই তোমারা এমন ছইলেন্ট হয়ে আছো কেন? ”

নাওয়াজ মির্জা এবার মুখ খুললেন। তিনি শান্ত স্বরে বলে ওঠে,

-” মা সাইলেন্ট হবে। ছইলেন্ট নয়। ”

আয়েশা মির্জা এবার মুখ কুঁচকালেন। তিনি অত্যন্ত বিরক্তি সহিত বললেন,

-” তোকে এখানে আমার ভুল ধরতে বলি নাই। ডিটিশন নিতে বলেছি। ”

-” মা ওটা ডিসিশন হবে। ”

আয়েশা মির্জা এবার রক্ত চোখে নাওয়াজ মির্জার দিকে তাকায়। চুপ হয়ে যান তিনি। অতঃপর সোহানা এবার গম্ভীর মুখে বলেন,

-” মা আপনি যেটা বলছেন সেটা কি আদেও সম্ভব? ”

-” সম্ভব কেনো নয় বড় বউমা। ব্যপারটা তাদের আমরা আগে থেকেই জানিয়ে দিবো ওদের। ”

নিধি ভ্রু কুঁচকায়। কি বিষয়ে তারা এমন করে কথা বলছেন? তা বোধগম্য হচ্ছে না তার। তবু আড়ি পেতে রইল বাকিটা শুনতে।

নিপা এবার কাচুমচু করে মিনমিনে স্বরে বলে ওঠে,

-” ওদের ও তো নিজস্ব মতামত, পছন্দ থাকতেই পারে। ”

-” না নেই। থাকলে দুজনেই আমাকে আরো আগেই বলে ফেলতো। ”

বাজখাঁই গলায় বলে ওঠে আয়েশা মির্জা। নিপা চুপসে যায়। নাহিদ মির্জা এবার মুখ খোলেন,

-” এটা কেমন দেখাবে না মা? পাড়াপ্রতিবেশি কি বলবে? ”

-” পাড়াপ্রতিবেশি কি আমাদের খাওয়াই না পড়ায়? যে তাদের কথা এতো ক্ষনে ক্ষনে চিন্তা করতে হবে। আমরা তো কোনো অবৈধ কাজ করবো না নাকি? এখন তোরা বল? তোদের নিধি আর ইশানের বিয়েতে কোনো আপত্তি আছে নাকি? ”

কথাটা শ্রবণ হতেই নিধি থমকে যায়। ভেতরে যেন ড্রাম বেজে চলছে। তরতর করে ঘেমে একার হয়ে যাচ্ছে নিধি। না সে তো কোনো ভুল শুনছে না। আসলেই দাদি তার আর ইশানের কথা বলেছেন। খুশীতে নাচতে মনে চায়ছে নিধির। এতো সহজে মানুষটাকে পেয়ে যাবে ভাবতে পারেনি সে। ইশান কে তো কবেই মন দিয়ে বসে আছে। শুধু ভয়ে ছিল ফ্যামিলি আর ইশান কি ভাবে নেবে। খন আয়েশা মির্জাকে দৌড়ে একটা শক্ত হাগ দিতে মন চাইছে তার। এখন ভালোই ভালোই বাবা-মা মেনে নিলেই হয়।

নাহিদ মির্জা এবার নাওয়াজ মির্জার দিকে তাকায়। দুজনেই আবার চোখ রাখেন সহধর্মিণীর দিকে। নিপা একবার সোহানার দিকে তাকিয়ে খুশি মনে বলে,

-” আমাদের নিধির আর ইশানের বিয়ে নিয়ে কোনো আপত্তি নেই। ইশান আর নিধি রাজি হলেই হবে। ”

সবাই যেন একটু প্রসন্ন বোধ করে। আয়েশা মির্জা এবার হেঁসে বলে ওঠেন,

-” তোমরা চিন্তা করো না। ওদের আমি রাজি করাবো। ”

-” আমার একটা শর্ত আছে। ”

সহসাই বললেন সোহানা মির্জা। নিধি এবার ভয় পায়। মা জানি কি বলে? সবাই প্রশ্নবিদ্ধ মুখে তাকায় সোহানার দিকে।

-” যতদিন না নাভান আর ইনায়ার ডিভোর্স হচ্ছে। ততদিন এই বিষয়টা আমাদের মধ্যেই থাক। ”

সবাই সহমত প্রকাশ করে। নিধি এবার দৌড়ে নিজের রুমে যায়। চোখ বেয়ে সুখের অশ্রু বয়। ইশানের টিশার্ট টা গায়ে জড়িয়ে। নিচের দিকটা গিট দিয়ে ছাদে যায় নিধি। ইশান ছাদের রেলিঙে বসে এতোক্ষণ তিথির সাথে কথা বলছিল। বৃষ্টিটা কিছু কমে শীতল বাতাস বইছে। হটাৎ ছাদে কারো আগমনে পিছন ফিরে ইশান। চটজলদি ফোন কেটে দেয় তার। হাসিমুখে নিধি এবার ইশানের সামনে দাড়ায়। ইশান নিধিকে আপাদমস্তক দেখে তেতে উঠে।

-” এটা কি করলি গাধি? আমার ফেবারিট টিশার্ট ছিল এটা। খোল এটা। নষ্ট করে দিলিতো একেবারে। ”

নিধি এবার মুখ বাঁকায়। কয়দিন পরে তো নিধি পুরো মানুষটাকেই নিজের করে ফেলবে। তখন কি রিয়াকশন দেবে ইশান? আচমকা হেঁসে উঠল নিধি। ইশান অবাক হলো। এই মেয়ে আজকে বকা খেয়ে হাসছে? আর সময় তো বকা খেয়ে মুখ আধার করে ফেলে।

-” ঠিক আছিস তো গাধি? নাকি তোর উপর কোনো ভুতে ভর করেছে? ”

নিধি শান্ত চোখে তাকায় ইশানের পানে। অবাক চোখে আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে আছে ইশান। হঠাৎ গাড়ির হন বেজে উঠায় দুজনেরই ধ্যান ভাঙে। একযোগে নিচে তাকাতে উভয়ই চিৎকার দিয়ে উঠে,

-” ভাইয়া এসেছে? ”

মুখটা মলিন করে ইনায়া বসে আছে। তিথি তখন থেকে এটাসেটা জিজ্ঞেস করলেও উত্তর পাচ্ছে না। খাবার সামনে তিথি অনেক্ক্ষণ পায়চারি করে রেখে দেয়। অনেকগুলো ব্যাগ সামনে এনে রাখে তিথি। ইনায়া জিজ্ঞেস সুত্রে তাকালেই তিথি বলে,

-” নিধি এসেছিল আজ। এইগুলো নাকি তোমার জন্য কিনেছে। বলেছে সব গুলো ট্রাই করতে। ”

ইনায়া বিশেষ কিছু গুরুত্ব দেয় না। আবারও উদাসীন হয়ে রয়।

-” কি হয়েছে তোমার? কোনো সমস্যা? বলতে পারো। ”

ইনায়া ম্লান হাসে। তিথি হতাশ হয়ে ফোন নিয়ে বসে পরে। ইনায়া কাপড়ের ব্যাগ গুলো সড়িয়ে জানলার পাশে এসে দাঁড়ায়। বৃষ্টি এখন নেই। বাইরে পুরো নিশি রাতের আধারে ঢেকে রয়েছে। মাঝেমধ্যে শুনা যাচ্ছে ব্যাঙসহ কোনো এক নাম না জানা প্রাণীর ডাক। হঠাৎ তিথি ডাকতেই ইনায়া পিছন ফিরে। তিথি ফোন হাতে আতংক নিয়ে ইনায়াকে দেখিয়ে বলে,

-” দেখো না ইনায়া। এফবি তে এই ছবিটা ভাইরাল হয়েছে। কে জানি এই দুটো লোক কে পিটিয়ে, উলঙ্গ করে গাছের সাথে ঝুলিয়ে রেখেছে। স্থানীয়দের চোখে পড়তেই, কয়েকজন মিলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছে। কি একটা অবস্থা দেশের। মধ্যবয়সী বাপদেরও ছাড়ে না। ”

ছবি দেখে ইনায়ার চোখ উলটে যাবার উপক্রম। কারণ ছবিতে সন্ধ্যার সে দুই লোককে দেখা যাচ্ছে। ইনায়া ভীতি হয় প্রচুর। কে করতে পারে এদের এমন অবস্থা? ইনায়া মনে মনে একটু শান্তি পায়। হঠাৎ ইনায়ানর ফোনের নোটিফিকেশন আসে। অচেনা নাম্বার সেটা। ‘ এইবার খুশি তো বোকা হরিণী? ‘ মেসেজ টা দেখে ইনায়া অবাক হয়। এটা কার নাম্বার? এই নামে তো জায়ান তাকে ডাকে। ইনায়া কিছুক্ষণ নিরবে ভাবে। তৎক্ষনাৎ তার টনক নড়ে এই কাজ ওই গুন্ডাটাই করেছে। কিন্তু জায়ান কি করে জানলো? রাগতেই নাকের পাতি গুলো ফুলেফেঁপে উঠে ইনায়ার। তিথি ফোন থেকে চোখ সড়িয়ে ইনায়ার দিকে তাকিয়ে অবাক স্বরে বলে,

-” তুমি এইভাবে ফুঁসছো কেন? আবার কি হলো? ”

-” কিছুনা ”

তিথি ঠোঁট উলটে ফোন রেখে ওয়াশরুমে যায়। ইনায়া জায়ানের নাম্বার ঠুকে ফোন করে। কিছুক্ষণ যেতেই ফোন রিসিভ করে জায়ান। ইনায়া রেগে বলে,

-” ওই লোকগুলোকে আপনি মেরেছেন? ”

-” ওয়েট হরিণী! জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকাও তো। ”

ইনায়া তাকায়। জায়ান মুচকি হেসে উঠে বলে,

-” দেখতো তোমার আকাশে ক’টা চাঁদ উঠেছে? ”

এমন প্রশ্নে রেগে যায় ইনায়া। চাঁদ আবার ক’টা উঠবে। চাঁদ তো একটাই। একটাই উঠবে? ইনায়া রাগে দাঁতেদাঁত চেপে বলে,

-” বৃষ্টি রাতের আকাশে আমি চাঁদ খুঁজে পাইনি। আপনি বলুন আপনার আকাশের খবর? ”

-” আমার আকাশে এতোক্ষণ একটাই ছিল। আপনি স্বরণ করে দুটোই করে দিলেন। ”

জায়ান বলতেই ইনায়া তেতে উঠে।

-” ফালতু কথা রাখুন। ওই লোক গুলো কে আপনি মেরেছেন? ”

-” এটা কোনো কথা? আমি ওই লম্পটদের মেরে হাত নোংরা কেন করবো? আমি মারিনি। তবে? আমার লোকজনদের দিয়ে মার খাইয়েছি এন্ড ঝুলিয়ে দিয়েছি। ”

কি দারুণ স্বীকারোক্তি? ইনায়া অবাক হয়ে বলে,

-” আপনি আমার পেছনে স্পাই লাগিয়ে ছিলেন? ”

জায়ান উচ্চ স্বরে হেঁসে ওঠে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে শান্ত স্বরে বলে,

-” আপনার দিকে কোনো পিঁপড়ার চোখ পরলেও আমার কষ্ট হয়। সেখানে আস্ত দু’জন মানুষকে আমি কি করে সহ্য করবো? বলেন তো হরিণী। কি নিদারুন যাতনায় আমি প্রতিদিন ডুবছি। কেন যানি হাড়িয়ে যাচ্ছি মায়ার অতল গহ্বরে। এর উত্তর কি আপনার কাছে আছে হরিণী? ”

ইনায়া চমকায়, হতবিহ্বল হয়ে যায়। ঠোঁট দুটো আচমকা কেঁপে উঠে। জায়ানের কথার মানে কি?
ইনায়া যেন ঘামছে এবার। ঠোঁট নাড়িয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করে,

-” কি বলতে চাইছেন আপনি? কি চাই আপনার? ”

জায়ান এবার জোরে হেসে উঠে। তারপর অন্য প্রাসঙ্গিক টেনে বলে,

-” তোমার জন্য বাবা একটা গিফট পাঠিয়ে ছিল। পেয়েছো তো? ”

হঠাৎ করেই কথা বদলানো তে ইনায়া আর জায়ান কে আর ঘাটে না। সে নিরুত্তর রইল জায়ানের কথায়। জায়ান ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলে ওঠে,

-” তোমার টেবিলে একটা খাম আছে। খামটা খুলে হলের বেলকনিতে চলে আসো। ”

বলেই ফোনটা রেখে দেয় জায়ান। ইনায়া টেবিলে তাকাতে দেখতে পায়। সত্যিই একটা খাম রাখা সেখানে। ইনায়া সেটা নিয়ে খুলতেই স্তব্ধ হয়ে রইলো। চোখগুলো পানিতে টইটম্বুর হলো। যা গড়িয়ে পরে গলদেশ ভিজিয়ে দিচ্ছে। একটা মেয়ের জন্য এমন পরিস্থিতি খুবই জঘন্যের। কোনো মেয়ে এমন পরিস্থিতিতে না পরুক। তিথি বের হয়ে ইনায়ার কাছে এসে দাঁড়ায়। ইনায়ার হাতে ডিভোর্স লেটার দেখে মুখ মলিন করে। সন্ধেবেলায় জায়ান এটা নিয়ে এসেছিল। তিথি চুপটি করে বিছানায় শুয়ে পরে। ইনায়া শান্তনা দেবার মতো কোনো ভাষা নেই তার কাছে। ইনায়া ভাবে, সে কেনো সুখি হতে পারল না। তার কি কোনো অধিকার নেই স্বামির সাথে সুখে থাকার। তার এই ছোট্ট জীবনে কোনো অন্যায় করেনি। তাহলে কেন তার এতো কষ্ট? বাবা মায়ের কথা আজ বেশি করে মনে পরছে ইনায়ার। ফোনে মেসেজ আসায় ইনায়া উঠে দাঁড়ায়। ডিভোর্স পেপার টা হাতে নিয়ে দরজা খুলে বের হয়। গন্তব্য হলের বেলকনিতে। হলের প্রত্যেক তলায় দুপাশে রুম মাঝ দিয়ে সুরু রাস্তা বয়ে বিশাল বেলকনিতে গিয়ে ঠেকেছে। ইনায়া বেলকনিতে দাঁড়াতেই দেখে, ল্যাম্পপোস্টের হলদে নিয়ন বাতির আলোয় দেখা যাচ্ছে জায়ান কে। হাতে কালো একটা ছাতা ধরানো। পিছনে কালো মার্সিডিজ। ইনায়া কে দেখে মুচকি হেঁসে ওঠে জায়ান। ইনায়া জায়ান কে কল দেয়। জায়ান ফোন রিসিভ করে ইনায়ার দিকে তাকিয়ে হেঁসে বলে ওঠে,

-” কি ব্যাপার? গিফট পেয়ে তো মানুষ খুশি হয়। তুমি কাঁদছ কেন? ”

ইনায়া ম্লান হাসে। কম্পিত ধরা কণ্ঠে বলে,

-” এই উপহার নিদারুণ নিষ্ঠুর এক কষ্টের সমাহার। এর চেয়ে মৃত্যুই বুঝি খুব সুখকর। ”

জায়ান ইনায়ার পানে গভীর দৃষ্টিতে তাকায়। ঠোঁট নাড়িয়ে আস্তে করে বলে,

-” এতো যাতনা পেয়েও তার প্রতি এতো টান? ইশ্ কি নিষ্ঠুর ভাগ্য তার। পেয়েও হারাতে হয়েছে। এখনো ফিরে পেতে চাও তাকে? ”

ইনায়া জায়ানের দিকে তাকিয়ে আকাশের দিকে মুখ করে। অতঃপর বিরবির করে বলে ওঠে,

‘ ও নিকষ কালো রাতের আধার, বলে দিও ওরে!
ছেড়েছি তারে, চিরতরে!
নেই কোনো অধিকার, তার প্রতি আর।
যেটুকু আছে, সেটুকু হয়ে থাক যাতনা আমার! ‘

ইনায়ার বেদনাসিক্ত কথার সাক্ষী শুধু এই আধার নয়। হয় জায়ানও। যে মনেপ্রাণে সপে যায় এই মেয়ে যেন আর দুঃখ না পায়।

চলবে…………