#যাতনা_আমার
#সানজিদা_ইসলাম_সূচনা
#পর্ব : ২১
( কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)
রাত বাজে আটটা, নাভান ছাদে বেতের সোফায় বসে আছে। হাতে হুইস্কির বোতল। মাথাটা ধরে এসেছে কিছুটা। চোখ বন্ধ করে ভাবে বিকালের কথা। নাভান বাড়িতে ঢুকতেই সবার থমথমে চেহারা লক্ষ্য করেছিল। কেউ কোনো টু শব্দও করেনি। নাভান পরিস্থিতি বুঝতে পেরেছিল। সে নিঃশব্দে নিজের ঘরে চলে গিয়েছিল। কোনো কিছুই যেন ঠিক হচ্ছে না। এতো কিছুর মধ্যে হঠাৎ জায়ানের কথা মনে পরে নাভানের। তার ব্যবহার মোটেও ভালো লাগেনি নাভানের কাছে। প্রথম বার দেখায় জায়ানকে নাভানের কাছে খুবই সন্দেহ হচ্ছে। কিসের প্রতিদ্বন্দ্বীর কথা বলছিল জায়ান? কিছু তো একটা আছেই। ব্যস্ত হাতে ফোন টিপে নাভান। কানে ধরে শান্ত গলায় বলে,
-” হোয়াটসঅ্যাপে সমস্ত ডিটেইলস পাঠিয়েছি। আমার সাথে কিসের দ্বন্দ্ব তা খুঁজে বের করো এক্ষুনি। ”
অপর পাশের ব্যাক্তির কথা বুঝা গেলো না। নাভান কথায় থাকতেই লক্ষ্য করে তার পাশে এসে কেউ দাঁড়িয়েছে। নাভান ফোন রেখে দেখে নিধি।
-” কিরে কিছু বলবি? ”
-” হুম, বাবা মা তোমাকে নিচে যেতে বলেছে। ”
নাভান চুপ করে থেকে শান্ত স্বরে বলে,
-” যা তুই আসছি আমি। ”
নিধি নড়ে না আমতা আমতা করতে থাকে। নাভান ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
-” যাচ্ছিস না যে? বলবি কিছু? ”
নিধি মাধা ঝাকিয়ে ঝটপট নাভানের পাশে বসে পরে। তারপর মিনমিন কন্ঠে নাভান কে সুধায়,
-” তুমি কি সারাজীবন এমনই থাকবে ভাইয়া? ”
-” কেমন? ”
নাভান গম্ভীর গলায় বলে। নিধি মুখটা করুন করে ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বলে,
-” মানুষ কতোদিনই আর বাঁচে বলো। এই ষাট নাহয় সত্তর বছর। হয়তো আরো কম। তাইতো? ”
-” মূল কথায় আয়। ”
হুইস্কির বোতলে মুখ লাগিয়ে ঝিম ধরা গলায় বলে নাভান। নিধি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
-” তুমি আর কতো একাকিত্ব জীবন কাটাবে? কি চাইছো তুমি। মায়ের উপর রাগ করে নিজেই তো অনেক শাস্তি উপভোগ করলে। এখন তো এইসব থেকে বের হও। মানুষ কতোদিন একই জিনিস মাথায় রাখে? ”
নাভান ম্লান হাসলো। তার ভেতরের দহনটা বোধহয় নিধি বুঝলো না। সে মলিন চোখে তার এই রহস্যময় ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে।
-” একটা কথা কি জানিস? আমি সারাজীবন আপন মানুষের কোলাহল, আদর ভালোবাসায় সিক্ত হতে চেয়েছিলাম। সবাই আমাকে অসম্ভব ভালোবাসতো। মায়ের মৃত্যুর পর যেন সেটা অধিক হয়ে গেছিল। সবার চোখের মনি ছিলাম। আমি নিজেও এই আদর ভালোবাসায় এতো সিক্ত হয়েছিলাম যে, কে আজকে কতোবার আমায় ডেকেছে তাও কাউন্ট করতাম। ”
কথাটা বলে নাভান নিজেই হেঁসে ওঠে। তারপর নিধির দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বলে,
-” মা-ই আমাকে এমন বানাতে চেয়েছিল। আমি তা হয়েছি। আর দেখ, আমিই এখন তার দুঃখের মূল কারণ। ”
কথাটা বলে নিশ্চুপ হয়ে যায় নাভান। নিধি তার ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। হয়তো এই নিঝুম রাতের মতোই, নাভানের ভিতরটা সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত হয়ে এসেছে। যা একদিনে হয়নি। নিধি নাভানের কাছে গিয়ে হাত ধরে মিষ্টি হেসে বলে,
-” তুমি আর মা একই রকম। জানোতো? তোমরা অতিত ঘেটে বর্তমান নষ্ট করার জন্য ওস্তাদ। সব ভুলে যাও। নতুন করে জীবনটা কে ভালোবাসো। মেনে না ও ভাবি কে। ”
নাভানের মুখটা রাতের আঁধারের মতোই অন্ধকার করে নেয়। ইনায়ার কথা মাথায় আসতেই, ঘাড় বাঁকা করে নিধির দিকে তাকায়।
-” জানো ভাইয়া, ভাবি বড্ড ভালো। ও সবসময় একবুক যাতনা নিয়েও হাসতে পারে। এতটুকু জীবনে তার কষ্ট নেহাত কম নয়। তারপরও তোমার যাতনা নিয়ে সে দিব্যি চলে যাচ্ছে। মায়ের সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে তুমি এক নিষ্পাপ মেয়েকে অনেক কষ্ট দিয়েছ। যেটা তুমি মোটেও ভালো করোনি। নয়টা মাস লেগেছিল ভাবির ঠিক হতে। সে কয়েকবার সুইসাইড করতে গিয়েও নিজেকে দমিয়েছে। তোমার ভাবি কে পছন্দ না হলেও তো মাকে বলতে পারতে। বিয়ে করে চলে যাওয়াটা কি খুব দরকার ছিল? ”
নিশ্চুপ নাভান শাহরিয়ারের মুখ যেন অতল গহ্বরে হারিয়েছে। কোনো জবাব সে তৎক্ষনাৎ মুখ ফুটে দিতে পারলো না। নিধির থেকে চোখ সড়িয়ে ছাঁদের নীলচে আলোক শিখাতে তা নিবন্ধ করে। নিধি নাভানের হাত ছেড়ে দাঁড়িয়ে থাকে কয়েক মুহূর্ত নিরবতায় কেটে যায়। আর কোনো কথাই কেউ বলে না। হঠাৎ সেই নিরবতা কাটিয়ে নাভান বলে উঠলো,
-” প্রথমবার কানাডায় নিজের জীবনের প্রতি তিক্ততা এসেগেছিল আমার। আমার মন তখনই অনেক অসুস্থ হয়ে পরেছিল। আমি চাইতাম স্কুলে যাওয়ার আগে মায়ের হাতের ব্রেকফাস্ট। দুপুরের টিফিন। সন্ধার স্ন্যাকস রাতের ডিনারটাও। চাইতাম স্কুল থেকে ফিরে পরিবারের সাথে আড্ডা দিতে। কিন্তু আমার স্বপ্নগুলোর থেকে তখন বাস্তবতাটা খুব নিষ্ঠুরতম হয়েছিল। যান্ত্রিক রোবটের মতো রুটিনমাফিক জীবন হয়েছিল আমার। একা একা যখন থাকতাম। মাকেই বেশী দোষারোপ করতাম। তখন নিজেকে মায়ের কাছে রিমোট কন্ট্রোল মেশিন মনে হতো। খুব রাগ হতো। সে বাংলাদেশে থেকেও আমাকে উপদেশ দিতো। এভাবে চলো না ওটা করো না। সব মিলিয়ে আমার জীবনের সুখটাই আমি খুজে পাইনি। অনেক বছর পর যখন অদিতি আমার জীবনে এসেছিল তখন নিজেকে অনেক রিলাক্স মুডে ফিল করেছিলাম। আমি ভেবে নিয়েছিলাম এটাই হয়তো আমার হ্যাপিনেস হবে। তাতেও মায়ের অনিচ্ছায় আমার ভালো লাগেনি। মাকে বুঝিয়ে কোনো লাভ হয়নি। সে অদিতি কে মানবে না। আমার তখন মনে হয়েছে মা আবার আমার জীবন টা অন্ধকার করে দিবে। কিন্তু মাতৃত্বের দোহাই দিয়ে যখন ইনায়া কে মা বিয়ে করতে বলে। তখন আমি আর নিজের মধ্যে ছিলাম না। নিজের পছন্দ মতো কি আমি লাইফ পার্টনারও সিলেক্ট করতে পারবোনা? মা তো ছেলের বউ চেয়েছে? তাই পরের কাজ গুলো মায়ের সাথে রাগ দেখিয়ে করা। এর মাঝে আমি যে ইনায়ার সাথে ভুল করছি? তা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম। ”
নাভান নিশ্চুপ হয়ে যায়। নিধিও চুপ করে থাকে। খানিকক্ষণ বাদে পিঠে কারো হাত পরতে চমকে উঠে পিছনে ফিরে নাভান। সোহানা কে দেখতে পেয়ে চোখ দুটো শীতল হয়ে আসে নাভানের। পিছনে তার পুরো পরিবার দাঁড়িয়ে আছে। সোহানা নাভানের হাত নিজের হাতের মুঠোয় পুরে তার পাশে বসে। তারপর নরম গলায় বলে ওঠে,
-” আমি আসলেই তোমার সৎ মা। আমি তোমার মা হতে পারিনি। পারলে বোধহয় তোমার চোখের ভাষা বুঝতে পারতাম। কিন্তু? ট্রাস্ট মি বেটা! আমি তোমার জীবনে কখনো দুঃখ দেখতে চাইনি। আমার সবসময় মনে হয়েছে তুমি আমার কাছে সেই ছোট নাবালক নাভান রয়েছো। যে পৃথিবীর গোলকধাঁধা পার করতে পারবে না। তোমাকে আমি স্ট্রং সুশিক্ষিত করতে চেয়েছিলাম। ভেঙে দিতে চাইনি। কিন্তু নিজের অজান্তেই আমি তা করে ফেলেছি। তার জন্য স্যরি। কিন্তু নাভান তুমি যতই বড় হওনা কেনো। যতই নিজের বুঝকে বাহবা দাওনা কেনো। আমি একটা কথাই বলবো, অদিতি তোমার যোগ্য ছিলো না কখনো। সে তোমাকে কখনোই বুঝতে চেষ্টা করতো না। তাই তোমার ভালোর জন্যই আমি ইনায়া কে তোমার জীবনে এনেছিলাম। যে তোমাকে ভালো রাখবে এবং ভালোবাসবে। ”
কথাগুলো বলে দম ফেলে সোহানা। বাড়ির প্রতিটি সদস্যের চোখে পানি। নাহিদ মির্জার ভেতরে একটু ভালো লাগছে। হয়তো মা ছেলের ভুল-বোঝাবুঝি ভেঙে সব কিছু ঠিক হবে। আয়েশা মির্জার এবার যেন চিন্তা কমলো। তার পরিবারের সুখ হয়তো আসবে সামনে। নওয়াজ মির্জা আর নিপারও তাই। তারাও যানে নাভানকে কতো ভালোবাসে সোহানা। নাভানের কঠিন পাথরের পুরুষ হৃদয় টা, মায়ের সামনে গলে পানি হয়ে গিয়েছে। তার চোখেও পানি চিকচিক করছে। তার মা ঠিক! অদিতি তার জন্য ভালো হতে পারতো না। সোহানা এইবার ডিভোর্স পেপারটা নাভানের হাতে দিয়ে মলিন কন্ঠে বলে,
-” আমি তোমার জীবন অশান্তিতে ভরিয়ে দিয়েছিলাম? এই নাও সুখের চাবিকাঠি। এটা দিয়েই প্রথম সুখ খুজে নাও। আমি আর তোমার জীবনে কোনো কিছুতে ইন্টারফেয়ার করবো না। ”
নাভান ভেজা নেত্রপল্লব ঝাপটায়। ভেজা সিক্ত চোখে তাকিয়ে থাকে ডিভোর্স পেপারের দিকে। এটার মাধ্যমেই সে ইনায়া কে মুক্তি দিতে পারবে। মায়ের পানে এক নজর তাকিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে নাভান। অতঃপর বিড়বিড় করে একবার নয় অসংখ্য বার বলে ওঠে,
-” ভুল হয়েছে মা। আমি বড়ো একটা ভুল করেছি। আমাকে তোমরা মাফ করে দাও। ”
সোহানা ছেলেকে বুকে নিয়ে কেঁদে উঠলেন। বহুবছর পর এমন হয়েছে। যে, নাভান তাকে মা বলে বুকে ঝাপিয়ে পরেছে। তার জন্য দায়ী সে নিজেই। সোহানার মনে পরছে না কবে নাভান তাকে এইভাবে জড়িয়ে ধরেছিল। সবকিছু ভুলে মায়ের স্নেহময় হাত পড়ে নাভানের মাথায়। যে তার অবুঝ সন্তানকে বোঝানোর জন্য তড়িঘড়ি করে বুলি আওরায়,
-” সব ঠিক হবে বেটা! সব ঠিক হবে। তুমি তা ঠিক করে নিও। ”
বাড়ির প্রতিটি সদস্য প্রশান্তির দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকায়। এইতো, এইতো যেন শান্তি নীড়ের শান্তি ফিরে এসেছে। তার বাহক যেন মির্জারা সবাই।
প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসের জন্য মার্কেটে এসেছে ইনায়া। তিথিকে বললেও আসেনি। কি জানি হঠাৎ করে কি হলো। রাত হলেও প্রচুর ভিড় এখানে। মহিলারাই বেশি ভিড় করে আছে। ইনায়া ভেবে পায়না। বাচ্চা কাচ্চা ফেলে এরা রাতে কেনো শপিং করতে আসে। কাপড়ের দোকান ডিঙিয়ে সামনে হাটতে থাকে ইনায়া। হটাৎ একটা চুড়ির দোকানে চোখ যায় ইনায়ার। সে সেদিকেই যায়। নানা রঙের চুড়ি সেখানে আছে। পাথরের, কাচের ভিন্ন ভিন্ন রং। ছোট থেকেই ইনায়ার চুড়ি পরার শখ। ছোট বেলায় বাবা যখন নানা রকমের কাচের চুড়ি আনতো, তখন ইনায়ার দাদি রসিকতা করে বলতো,’ এখন চুড়ি পরে কি করবি? বিয়ে হলে স্বামীর জন্য পরিস। ‘ স্বামী তো হলো। কিন্তু তার জন্য চুরি পরা আর হলো না। ইনায়া সাজানো চুড়ি গুলোতে আলতো ভাবে হাত বুলালো। সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো ঝনঝন শব্দে মুখরিত হলো। ফিক করে হেঁসে দেয় ইনায়া। দোকানে ছোট একটা ছেলে বসা। বয়স দশ এগারো হবে। সে ইনায়ার কাছে এসে মিষ্টি হেঁসে বলে,
-” কোনগুলো পছন্দ হয়েছে আপু? ”
ইনায়া ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রসিকতা করে বলে,
-” তোমার দোকানের সবগুলোই! দাম কতো দেবো বলতো? ”
ছেলেটা হতভম্ব হয় ইনায়ার কথায়। সবগুলোই নেবে নাকি? অবাক হয়ে ইনায়ার দিকে তাকিয়ে থাকে ছেলেটা। ইনায়া মুচকি হেঁসে সামনে ফিরতেই চমকে উঠে। কারণ সামনে তার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে জায়ান। ইনায়া হকচকায়। এই লোক কখন কোথা থেকে টপকায়? তা বোঝা মুশকিল।
-” তোমার কাজ কি এটাই বোকা হরিণী? সবাই কে কনফিউজড করার? ”
গম্ভীর মুখে প্রশ্ন করে জায়ান। ইনায়া পিছনে তাকিয়ে দেখে, নিত্যদিনের মতো জায়ানের ছেলেপুলে দাঁড়িয়ে আছে। ইনায়া আওয়াজ করে নিচু মিনমিনে স্বরে জিজ্ঞেস করে,
-” আর আপনার কাজ কি এটাই? সবসময় সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে আমার সামনে উদয় হন। ”
জায়ান বাঁকা হেঁসে চুড়ি গুলো দেখতে থাকে। তারপর ইনায়ার দিকে এক সেকেন্ড তাকিয়ে শান্ত স্বরে বলে,
-” আমি যে কেনো এমন করি, তা তোমার বোঝার ক্ষমতা বোধহয় আর হবেনা বোকা হরিণী। বড্ড অবুঝ তুমি। ”
ইনায়া শান্ত চোখে জায়ানের দিকে তাকায়। সে এতোটাও অবুঝ নয়। যে জায়ানের কথার মিনিং বুঝতে পারবে না। তবুও সে বরাবর বুঝেও না বুঝার ভান করবেই। ইনায়া কিছু না বলে সামনে হাটে। মার্কেট পেরিয়ে রাস্তায় ল্যাম্পপোস্টের নিয়ন বাতির নিচে দাঁড়াতেই আবার জায়ান এসে সামনে দাঁড়ায়। কান খাড়া করে তাড়াতাড়ি করে জায়ান বলে,
-” শুনছো? শুনছো তো মেঘের গুড়ুম গুড়ুম ডাক? এক্ষুনি আমার গাড়িতে গিয়ে বসো। তোমাকে ড্রপ করে দিচ্ছি। না হলে বৃষ্টিতে ভেজার সম্ভাবনা রয়েছে তোমার। ”
ইনায়া লক্ষ্য করে, সত্যিই হিম শীতল বাতাস আর মেঘেদের গর্জন শোনা যাচ্ছে। আসেপাশে লোকজন গুলো কিছুটা তাড়াহুড়ো করছে এখন। ইনায়া কাজল যুগোল আখি দিয়ে, সামনে দাঁড়ানো কালো পাঞ্জাবী পরা জায়ান কে পরোক্ষ করে। তারপর বাঁকা হেঁসে বলে ওঠে,
-” বন্যা কে বৃষ্টির পানির ভয় দেখাচ্ছেন? সে তো কবেই বন্যার পানিতে ভাসতে ভাসতে নিজেকে সয়ে নিয়েছে। বৃষ্টিতে এখন তার কোনো ভয় হয়না।”
জায়ান গভীর দৃষ্টিতে ইনায়ার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে মিটিমিটি হেসে বলে,
– ” খুব কঠিন করে কথা বলতে শিখেছো হরিণী? কিন্তু আমার সহজ মনের ভাষা তোমার অগোচরে? তা মানতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে যে। ”
ইনায়া কিছু বলে না। কিছু সময় অতিবাহিত হয় এমনিতেই। দুজন দিজনের দিকে তাকিয়ে থাকলেও কথার বিনিময় আর হয় না। চারপাশের হিম শীতল বাতাসের বেগ যেন বাড়ছে। রাস্তার পাশেই কতোগুলো ফার্মেসির দোকান। ইনায়া মাথায় ভালো করে ওড়না দিয়ে এক পা সামনে এগুতে এগুতে ব’লে,
-” আপনার সাঙ্গপাঙ্গদের তো দেখা যাচ্ছে না। এক্ষুনি বাড়ি যান তাদের সাথে। নাহলে বিরোধী দলের লোকের হাতে আবার গুলি খেতে হবে। তখন কিন্তু আমি আর হেল্প করবো না। ”
জায়ান ঠোঁট কামড়ে হেঁসে উঠলো। অতঃপর আবার ইনায়ার সামনে দাঁড়িয়ে শান্ত স্বরে বলে,
-” আমাকে নিয়ে ভেবেছো, এতেই আমি বিন্দাস থাকবো। এখন তুমি আমার সাথে চলো। কোনো ঘাউড়ামি চলবে না এখন। ”
-” আমার প্রয়োজনীয় জিনিস কেনা বাকি আছে। আপনি যান আমি পরে ঠিক চলে যাব। ”
-” লিস্ট দাও আমি এনে দিচ্ছি। ”
ইনায়া বিরক্ত হয়ে জায়ানের পানে তাকায়। তারপর গমগমে গলায় বলল,
-” আমিই পারবো, আপনার আনতে হবে না। ”
-” তাহলে কালকে কিনো। এখন চলো। ”
এতো নাছোড়বান্দা। ইনায়ার বিরক্তি এখন রাগে প্রকাশ পায়। সে কিড়মিড় করে বলে ওঠে,
-” আমার আজকেই লাগবে। বুঝেছেন? যান এখন সামনে থেকে। ”
জায়ান এবার ডানে-বামে তাকিয়ে ইনায়ার হাত শক্ত করে ধরে। ইনায়া হকচকিয়ে যায়। এই লোক পাবলিক প্লেসে কি করছে? জায়ান ইনায়ার হাত ধরে টেনে তার গাড়ির ভেতরে নিয়ে বসায়। ইনায়া জোড়াজুড়ি করলেও কোনো কাজ হয় না। ইনায়াকে সিটে বসিয়ে, সিট বেল লাগিয়ে গাড়ি লক করে জায়ান কোথায় যেন যায়। ইনায়ার রাগে কান্না পায়। এই লোকের কবলে কেনো তাকে আজকে পরতে হলো? আদেও জায়ান যেটা চাইছে সেটা কি সম্ভব? ভাবে ইনায়া। একটু পরেই জায়ান এসে গাড়িতে বসে হাতে একটা প্যাকেট। স্টিয়ারিং ঘোরাতে ঘোরাতে ইনায়ার দিকে তাকিয়ে প্যাকেটটা বাড়িয়ে দেয় জায়ান। ইনায়া আমতা আমতা করে সেটা হাতে নিয়ে সুধায়,
-” কি এটা? ”
-” তোমার প্রয়োজনীয় জিনিস। ”
গমগমে গলায় বলে উঠে জায়ান।
কিছুদূর গাড়ি চলতেই ইনায়া প্যাকেটের ভেতরের জিনিসটা একটু বের করে। জিনিসটা দেখেই ইনায়ার মুখ থ হয়ে যায়। লজ্জায় চোখ বুজে নেয়।
স্যানিটারি ন্যাপকিন? এই লোক বুঝলো কি করে? ইনায়া আর জায়ানের পানে তাকায় না। লজ্জায় জমে বরফ হয়ে রয়েছে সে। জায়ান কি করে বুঝলো মাথায় আসেনা তার। ইনায়া চোরা চোখে জায়ান কে দেখতেই বুঝে সে নির্বিকারে গাড়ি চালানো তে ব্যস্ত। বিরবির করে বকে জায়ান কে সে। এই লোক শুধু গুন্ডা নাহ, নির্লজ্জ ও বটে।
চলবে…………………
#যাতনা_আমার
#সানজিদা_ইসলাম_সূচনা
#পর্ব : ২২
আজ মির্জা বাড়িতে যেন একটা খুশির আমেজ বিরাজ করছে। পরিবারের সবাই খুব হাসিখুশি। এতোদিনে সুখ যেন পা রাখলো এই বাড়িতে। আয়েশা মির্জা মন ভরে দোয়া করে নাভান কে। ঠিক মায়ের সাথে সব ঠিক হতেই ছেলেটা প্রায় আহ্লাদী হয়ে গিয়েছে। সোহানা আজ নিজ হাতে সব রান্না করেছে। নিপা খাবার টেবিলে সুন্দর করে তা পরিবেশন করছে। নওয়াজ আর নাহিদ মির্জা অফিসের একটা বিষয় নিয়ে ব্যস্ত। আয়েশা মির্জা তার ডানে তাকিয়ে দেখে। নিধি ঝিমানো মুরগীর মতো ঝিমাচ্ছে। অনেক রুষ্ট হয়ে যায় তিনি। এই মেয়ের ঘুম কই থেকে আসে? তিনি বুঝে পাননা। ভার্সিটির জন্য রেডি হয়েও এমন? সকাল নয়টা বেজেছে। তারপরও এ ঝিমাচ্ছে? আয়েশা মির্জা এবার বাজখাঁই গলায় বলে ওঠে,
-” এই মেয়ে? সারারাত কি করেছিস? এখনো ঝিমতে হবে? যা ভাইদের গিয়ে ডেকে আন। নাস্তা করতে হবে। ”
আয়েশা মির্জার কথায় নিধির ঝিমানো বন্ধ হয়। চোখ খুলে তাকায় তার পানে। তারপর গাল ফুলিয়ে গম্ভীর মুখে বলে,
-” আজকের কথাটা ভুল বললে দাদি। ”
আয়েশা মির্জা পান চিবানো বাদ দিয়ে নিধির দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। নিধি তার দিকে বিজ্ঞ মানুষের মতো তাকিয়ে রয়েছে। তিনি বিরক্তি নিয়ে নিধিকে বলে,
-” ভুল বললাম মানে? ঘুমের জন্য কি উলটা পালটা বিক্ষোভ করছিস আমার প্রতি? ”
নিধি এবার মুচকি হেসে উঠে। তারপর বাবা চাচা আর মা চাচি কে লক্ষ্য করে মিনমিনে স্বরে বলে,
-” একজন তো ভাইয়া! আর অন্যজন হলো সাইয়া।”
বলেই লজ্জা পাওয়ার ভান করে নিধি। আয়েশা মির্জা চোখ গোলগোল করে নিধি দিকে তাকায়। তিনি অবাক স্বরে জিজ্ঞেস করে,
-” ওমা! তুই কি করে জানলি? এটাতো আমাদের সিক্রেট মিটিং ছিল। এর ডিল তো গোপনে করেছি। তোর তো জানার কথা না? ”
নিধি মুখ ভেঙচিয়ে উঠলো। তারপর আয়েশা মির্জার কানে কানে মৃদু স্বরে বলে ওঠে,
-” সিক্রেট মিটিং যে ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে করতে হয়, তা কি তুমি জানো না। ”
-” তারমানে চুরি করে শুনেছিস? ”
নিধি ডানে-বামে মাথা নাড়িয়ে, উঁচু গলায় জবাব দেয়,
-” চুরি করে শুনিনি! তোমার রুমে ঢুকতে গিয়ে শুনে ফেলেছি। ”
আয়াশে মির্জা ভাবে দু’টোর মধ্যে পার্থক্য কি? তিনি নিধিকে তিক্ত গলায় বলে,
-” যা বলেছি তা এক্ষুনি কর। না হলে ডিল ক্যান্সেল করে দিবো। ”
নিধি মুখ বাঁকায়। নিপা এসে সবাইকে খাবার টেবিলে ডাকে। নিধি উপরে উঠতে গেলে সোহানা বলে ওঠে,
-” নাভান নেই। সকালেই বেরিয়ে গেছে। কি যেন একটা জরুরি কাজ আছে। ”
আয়েশা মির্জা পান চিবোতে চিবোতে বললেন,
-” তাই বলো, এজন্যই তো ছেলেটার কোনো হদিস পাইনি সকালে। ”
নিধি এবার ইশানের রুমে যায় ডাকতে। নিধির পরনে ইশানের কালো একটা টিশার্ট আর কালো জিন্স। কোমড়ের কাছে টিশার্টে একটা গিট দেওয়া। দুইবার নক করার পর ঘুমন্ত চোখমুখ নিয়ে দরজা খুলে ইশান। নিধি চমৎকার একটা হাসি দিয়ে বলে ওঠে,
-” নিচে নাস্তার টেবিলে ডাকছে তোমাকে। জলদি চলে এসো। ”
আজ আর নিধির কথার প্রেক্ষিতে হাসলো না ইশান। উলটো চোখ-মুখ বিরক্তি ভাব করে ইশান। নিধি কিছুটা অবাক হয় ইশানের মুখের এমন অভিব্যক্তি দেখে। সে কিছু বলতে যাবে তার আগেই খেঁকিয়ে উঠে ইশান।
-” তুই আবার আমার টিশার্ট পরেছিস? খোল বলছি এখনি খোল। ”
চমকে উঠে নিধি। ইশানের এমন কর্কশ কন্ঠ শুনে চমকে যায় পুরো। চোখের কোনে পানি ভিড় করে। সবসময় আহ্লাদী করে কথা বলা ইশানের হঠাৎ এমন রুড বিহেভ সহ্য হচ্ছে না নিধির। কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করে,
-” কেনো? আমি তো প্রায়ই পড়ি। তখন তো কিছুই বলোনি? ”
ইশানের রাগ যেন আরো বৃদ্ধি পায়। হুংকার ছেড়ে দিয়ে আবার বলে ওঠে,
-” তুই কি এখনো ছোট আছিস? সবসময় আমার জিনিস তোর নিতে হবে? এক্ষুনি গিয়ে খোল এটা। ”
ইশানের চিৎকারে নিপা দৌড়ে আসেন। নিধি ঠোঁট উলটে কেঁদে দিয়েছে। তিনি এসে দেখেন নিধি কাঁদছে। আর ইশান রাগান্বিত হয়ে তাকিয়ে আছে নিধির পানে। নিপা অবাকের সুরে বলে উঠেন,
-” কিরে? সকাল সকাল কি শুরু করলি? মেয়টাকে বকছিস কেনো? ”
-” তোমাদের আহ্লাদী মেনার বুঝে না। আর যেনো ও আমার জিনিসে হাত না দেয়। আমি যাকে তাকে আমার জিনিস ধরার অধিকার দেই না। ”
নিপার মুখে বিস্ময়। তিনি আজ পর্যন্ত ইশান কে নিধির সাথে এমন স্বরে কথা বলতে দেখেনি। তিনি ধমক দিয়ে ইশানকে বললেন,
-” মারব একটা! তারাতাড়ি নিচে আয়। আর নিধি চল আমার সাথে। ”
নিধি অশ্রুসিক্ত চোখে ইশানকে একবার দেখে নিপার সাথে চলে যায়। আজ সে প্রচুর শকে আছে। খাবার টেবিলে ইশানের মুখ থমথমে ছিল। আগের মতো কোনো কিছুই বলল না। নিধিও চুপচাপ হয়ে গেছে। খাবার পর নিধি উঠতে নিলেই ইশান সবার উদ্দেশ্য ব’লে,
-” তোমরা নাকি আমার আর নিধির বিয়ে ঠিক করেছো? ”
সবাই হতভম্ব হয়ে যায়। একে অন্যের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। আয়েশা মির্জা শান্ত স্বরে জবাব দেয়,
-” হুম, আমিই ঠিক করেছি। কিন্তু তুই কি করে জানলি। ”
-” সত্য কতোদিন লুকানো থাকে বলো? আর আমি একটা জিনিস ভেবে পাচ্ছি না। তোমরা কি করে এই চিন্তাভাবনা মাথায় আনতে পারো? যেখানে আমি নিধি কে নিজের বোনের মতো দেখি। সেখানে বিয়ে? ভাবতেই পারছিনা আমি। ”
রাগী গলায় বলে ইশান। নিধির বুকটা ধক করে উঠলো। নেত্রপল্লব ঝাপটিয়ে ইশানের দিকে দৃষ্টি স্থির করে রাখলো। আয়েশা মির্জা রুষ্ট হয়ে নিধির দিকে তাকায়। তিনি ভাবে,নিধিই হয়তো ইশানকে জানিয়েছে। নওয়াজ মির্জা ইশানের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করে,
-” আমরা বড়রা মিলে চিন্তাভাবনা করেই এই ডিসিশন নিয়েছি। আমাদের মনে হয়েছে তোমরা ভালো থাকবে। এতে আমাদের সবারই মত আছে। ”
-” আমার মত নেই। তোমাদের উচিত ছিল আমাকে এই বিষয়ে জানানোর। তোমরা কাজটা ঠিক করোনি। ”
ঠাস ঠাস করে বলে উঠে ইশান। বাড়ির সবাই আরোও অবাক হয়। সবসময় শান্তশিষ্ট থাকা ইশানের এরূপ ব্যবহার তাদের বোধগম্য হচ্ছে না। নাহিদ মির্জা এবার নিরবতা থেকে বেরিয়ে এসে ইশান কে জিজ্ঞেস করে,
-” আসলেই বিষয়টা তোমাকে জানানোর দরকার ছিল। তুমি শান্ত হও ইশান। তোমার মতের বিরুদ্ধে কিছুই করবো না। ”
নাহিদ মির্জার কথাটা আয়েশা মির্জার পছন্দ হয় না। তিনি গম্ভীর গলায় ইশান কে বলে উঠলেন,
-” আমি যা বলেছি তাই হবে। বিয়ে তোর নিধির সাথেই হবে। বাড়ির মেয়ে বাড়ি থাকবে, এটা ভালো নয় কি? ”
তার সাথে তাল মেলায় নিপাও। তিনি ইশানের কাধে হাত বুলাতে বুলাতে বলে,
-” মেয়েতো খুঁজতেই হবে। তাহলে ঘরের মেয়ে কেনো নয়? তুই একবার ভেবে দেখনা। ”
ইশান কোনো উত্তর দেয়না। চুপ করে থাকে। এদিকে নিধি যেনো নিজের মধ্যে নেই। সুখ সুখ অনুভব হওয়া মনটা আচমকাই কষ্টে ভরে যাচ্ছে। সোহানা এতোক্ষণ চুপ করে থাকলেও, দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইশান কে জিজ্ঞেস করে উঠে,
-” তুমি কি কাউকে ভালোবাসো ইশান? বলতে পারো। ”
সোহানার কথায় সবাই এবার চুপ হয়ে যায়। এটা কারো মাথায় আসেইনি। সকলেই ইশানের দিকে জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে তাকায়। ইশান চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। কলকেই সে বাড়িতে এসে ভেবেছিল বিষয় টা নিয়ে কথা বলবে। কিন্তু রাতে নাভানের সাথে পুরো পরিবারের হাসিখুশি মুহূর্ত নষ্ট করার মন চাইছিল না তার। এদিকে নিধির মন টা বিষাদে ছেয়ে যায়। সে প্রাণ পনে দোয়া করে। ইশানের জীবনে যেন কেউ না থাকে। নিরবতা কাটিয়ে ইশান গমগমে গলায় বলল,
-” আমি তিথিকে ভালোবাসি। ”
কথাটা প্রতিধ্বনি হতেই নিধির কানটা ঝা ঝা করে উঠলো। সে কি ভুল শুনছে? নাতো? হলরুমে পিনপিনে নিরবতা চলছে। সবার মনে একই প্রশ্ন তিথি কে? নাহিদ মির্জা কিছুটা ভেবে বলে উঠলেন,
-” মিজানুল করিমের মেয়ে তিথি?
ইশান মাথা ঝাকায়। আয়েশা মির্জার মুখ কালো মেঘে ঢেকে যায়। নিধির থেকে শুনেছিলেন। ইনায়া যার সাথে থাকে তার নাম তিথি। ইনায়ার মামাতো বোন। সে নাকি প্রচুর ঝাঁজালো। সহজেই মানুষকে নাকানিচোবানি খাওয়াতে পারবে এই মেয়ে। নাহিদ মির্জার কথায় তিনি বুঝতে পেরেছেন। এটা সে মেয়ে। না কখনো নাহ। তিনি অত্যন্ত বেচে থাকতে ওই মেয়েকে বাড়ির বউ বানাবেন না। তিনি নিপার দিকে চোখ রাঙিয়ে কিছু একটা বলতে বলে।
ইশান নাহিদ মির্জার দিকে তাকিয়ে শান্ত কন্ঠে বলে,
-” আমি তিথিকে আমার অর্ধাঙ্গিনী করতে চাই। ”
-” পাগল হয়েছিস নাকি তুই। কিছুতেই মানবো না আমি। ”
রাগ দেখিয়ে বললেন নিপা। নাহিদ মির্জা নিপাকে থামিয়ে শান্ত স্বরে বললেন,
-” দেখো ইশান যা চাইবে, তাই হবে। কেউ আর কোনো কথা বলবেনা। ”
সবাই দমে যায়।।সোহানা আর নওয়াজ মির্জা ও নাহিদ মির্জার হ্যা তে হ্যা মেলায়। শুধু মুখ গম্ভীর করে রাখে নিপা আর আয়েশা। ধীর গতিতে নিজের রুমে এগিয়ে যায় নিধি। পা যেন চলছে না। ঘরে এসে কোনোরকমে দরজা লাগিয়ে খাটে শুয়ে পরে সে। অতঃপর চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠে নিধি। কি করবে এখন সে। বুকটা জ্বলে যাচ্ছে তার। সে তো ইনায়ার মতো, এতো যাতনা সহ্য করে বাচতে পারবেনা। কি করবে এখন নিধি। একপাক্ষিক প্রেমে কাঁদলেও তো বোকামি। নিধি এবার চোখ বুঝে আল্লাহ কে ডাকে। তাতে যদি একটু শান্ত হয় মন।
দোকানে বিকাশ থেকে টাকা তুলতে এসেছে ইনায়া। মিজানুল করিম পাঠিয়েছেন। সামনে প্রথম সেমিস্টারের পরিক্ষা। কলেজ ফি বাবদ অনেক টাকা জমেছে। মিজানুল করিম নিজে থেকেই টাকা পাঠিয়েছেন। ইনায়া প্রথমে না করলেও পরে মেনে নেয়। টিউশনি করছে একমাসও হয়নি। এখন টাকা পাবে কোথায় সে? টাকা তুলে ফুটপাতের রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকে। সামনে আইসক্রিম ভ্যান দেখে সেখানে এগিয়ে যায়। একটা আইসক্রিম কিনে পিছনে ফিরতেই কারো সাথে ধাক্কা লেগে সেটা পরে যায়। হাহ্ কপাল, মুখেও লাগাতে পারলো না? কিঞ্চিৎ বিরক্তি নিয়ে সামনে তাকাতেই চমকে উঠে ইনায়া। কারণ তার সামনে সয়ং নাভান দাঁড়ানো। যে ইনায়া দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। ইনায়ার চোখ জোরা বেহায়ার মতো নাভান দিকে তাকিয়ে থাকে। লোকটা তার স্বামী? সবচেয়ে আপন তার পরও কতো পর। হঠাৎ অদিতির কথা মাথায় আসতেই ইনায়া মুখ কঠিন করে। ইনায়া খেয়াল করে নাভানের হাতে একটু আইসক্রিম লেগে গেছে। ইনায়া মিনমিন করে বলে ওঠে,
-” স্যরি আমি খেয়াল করিনি। ”
নাভান রা করে না। তার দৃষ্টি আগের মতোই ইনায়ার পানে পরে আছে। সামনে দাঁড়ানো লোকটা ইনায়ার স্বামী। যাকে এই নিয়ে দুবার সামনাসামনি দেখেছে ইনায়া। মুখটা কঠিন করে, সামনের দিকে ইনায়া পা চালিয়ে কিছু দূর যেতেই, হাঁক ছেড়ে ডাকে নাভান।
-” দাঁড়ান ইনায়া। ”
পা দুটো আটকে যায় ইনায়ার। কিন্তু পিছনে ফিরে না। নাভান ধির পায়ে ইনায়ার সামনে এসে দাঁড়ায়। থমথমে চেহারা দু’জনেরই। ইনায়া প্রচুর অসস্থি ভোগ করে। নাভান গম্ভীর শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করে,
-” কেমন আছেন? ”
-” জি ভালো। ”
মৃদু স্বরে জবাব দেয় ইনায়া। নাভান দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঠান্ডা স্বরে সুধায়,
-” আমাকে দেখে পালাচ্ছিলেন মনে হয়? ”
ইনায়া শান্ত চোখে তাকায়। কালো শার্ট আর জিন্স পরহিত নাভান। চুল গুলো ব্যাক ব্রাশ করা। শীতল শান্ত কুটকুটে কালো চোখের মনি জোড়া দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে নিষ্পলকে। ইনায়া চোখ নামিয়ে নেয়। অতঃপর বলে ওঠে,
-” আপনাকে দেখে অযথা পালাবো কেনো? আপনার সাথে তো একদিনের দেখা মাত্র। আমার একটু তারাহুরো ছিল। ”
নাভান তাকিয়ে থাকে মিষ্টি মুখখানার পানে। গাঢ় কালো চোখ জোড়ায় কিছু লুকানোর প্রয়াস। নাভান এসেছিল তার একটা ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে। জায়ানের বিষয়ে কথা বলছিল তারা। রেস্টুরেন্টে থেকে বেরিয়েই ইনায়া কে দেখেছিল নাভান। তখনই তার পিছু নেয় সে। গাড়ির হন মানুষের কোলাহলে বিরক্ত বোধ করে নাভান।
-” চলুন আমি ড্রপ করে দিচ্ছি। ”
-” দরকার নেই আমি নিজেই যেতে পারবো। ”
বলেই ইনায়া নাভান কে ডিঙিয়ে সামনের দিকে যায়। নাভান বাঁকা হাসে। পিছন না ফিরেই জোরে বলে ওঠে,
-” অন্য কেউ এসে নিয়ে যাবে নাকি মিসেস ইনায়া? আমার সাহায্য ভালো লাগেনি? ”
থমকায় ইনায়া। মুখটাকে শক্ত করে তৎক্ষনাৎ। নাভান কি তাকে চিনতে পেরেছে? হবে হয়তো। সে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকায়। নাভান উলটো পিঠ করেই দাঁড়িয়ে আছে। ইনায়া সহসাই জোরে বলে ওঠে,
-” এতিম, অনাথ ডিভোর্সি যে কেউ হোক। আমাদের অন্য কারো দরকার নিতেই হয়। আসলে জানেন কি? কেউ মুখ থুবড়ে ফেলে দিলে অন্য জন হাত বাড়িয়ে ঠিকই তুলে নেয়। তাই অনুদান সাহায্য যেটাই বলেন। আমাদের তা নিতেই হবে। ওইযে, কিছু একটায় ভর করে সিধে হয়ে দাঁড়ানোর জন্য। ”
নাভান পিছন ফিরে ইনায়ার দিকে তাকিয়ে হাসলো। ধক কে উঠলো ইনায়ার বুকটা। হাসিটা যেন কলিজায় বিধে। ঘুরেফিরে একটা কথা মাথায় আসে লোকটা তার স্বামী। যাকে ফিরে পাবার জন্য নামাজে বসে কতো মোনাজাতে কেঁদে ছিলো ইনায়া। নয়টা মাস যেনো নিঃশ্বাস ফেললেও কষ্ট হতো। তার এই যাতনা বাড়িয়ে দিতো অদিতির মেসেজ। নাভান আস্তে করে হেটে ইনায়ার সামনে আসে। মুখটা খুবই শান্ত নিশ্চল হয়ে আছে। ইনায়া চোখ হালকা ভিজে আসে। নাভান আলতো হাতে ইনায়ার গালে হাত রাখে। চোখ বন্ধ করেও চমকে উঠে ইনায়া। আলতো হাতেই হাতটা সরিয়ে দেয়। নাভান মুচকি হেসে বলে,
-” ভালোই তো মেয়ে, দরকার ছিল এই রাগটা আমার প্রতি। ”
ইনায়া নাভানের দিকে ভেঁজা সিক্ত চোখে তাকিয়ে, ঘুরে চলতে থাকে আর পিছন ফিরে না। নাভানের চোখ জোড়া এবার অশান্ত হয়। ইনায়া ফুটপাতের রাস্তা ধরে শেষ মাথায় আসতেই আবার ধাক্কা খায় একজনের সাথে। কান্নারত হিচকি খাওয়া মুখটা আলতো হাতে তুলে একজন। ইনায়া ঝাপসা চোখের পলক ফেলে তাকায় মানুষটার দিকে। যে নিষ্পাপ হাসি দিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। কালো পাঞ্জাবি পরহিত সুঠাম দেহের লোকটা এবার উচ্চ হেসে বলে ওঠে,
-” ধোঁকা, ধোঁকা। সব ধোঁকা। তারপরও মন তাদের দিকে টানে কেনো হরিণী? বলতে পারবে তুমি? কি এক নিদারুণ যন্ত্রণা, বলোতো? ”
চলবে……………
( ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)