#যাতনা_আমার
#সানজিদা_ইসলাম_সূচনা
#পর্ব : ২৩
হাইওয়ে রোড দিয়ে সাই সাই করে তীব্র গতিতে এগিয়ে চলছে জায়ানের কালো রঙের মার্সিডিজ বেঞ্জ। মধ্যাহ্ন দুপুরের সূর্যের তির্যক আলো যেন গাড়ির সাথে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে চলছে। ড্রাইভিং সীটে বসে খুব দক্ষ হাতে ড্রাইভ করছে জায়ান। পাশের সিটে চুপটি করে বসে আছে ইনায়া। তার মুখ খুব শান্ত হয়ে রয়েছে। জায়ানের ও তাই। তারা কোথায় যাবে জানা নেই ইনায়ার। সকালের সেই জায়ানের কোমল গলায় প্রশ্নের জবাব জানা ছিলো না ইনায়ার। চুপচাপ ছিলো দুজনেই। তাদের নিরবতা ভেঙে ছিলো ফোনের বিপ বিপ শব্দে। জায়ান আলতো হাত ফোন রিসিভ করে এগিয়ে দিয়েছিলো ইনায়ার দিকে। ফোন কানে ধরে অপর পাশের ফাহাদের কিছু কথা শুনলো ইনায়া। কথা ছিলো এতোটুকুই, ‘ আমি আর বাবা আছি। জায়ানের সাথে চলে এসো।’ অতঃপর জায়ান গাড়ির দরজা খুলতেই উঠে পরেছিলো সে। গন্তব্য জানার ইচ্ছে আর হয়নি। শহরের ব্যস্ত রাস্তা, যানবাহনে ব্যস্ত জনগণ, আধুনিক জীবন ও স্থান পেরিয়ে শৈশবের সেই প্রিয় চেনা রাস্তার গলিতে আসতেই চোখগুলো ধপ করে জ্বলে উঠে ইনায়ার। যেখানে রিকশার ক্রিংক্রিং শব্দ, গলির ছোট্ট দোকানে চায়ের আড্ডা। বড়ো বড়ো আড়তের দোকানে বিরিয়ানির ভোজন। বাবার হাত ধরে চিপা চিপা গলি পেড়িয়ে বাজারে যাওয়া। সবই যেন চোখে ভেসে উঠে ইনায়ার। সে জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে জায়ানের দিকে তাকায়। কিন্তু সে লোকের মুখ নিশ্চল অবিচল। একটু সামনে যেতেই বড়ো করে ব্রেক কষলো জায়ান। বিরক্তি নিয়ে গাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসে জায়ান। ইনায়া ও বেরুলো। জায়ান মুখ গম্ভীর করে ইনায়ার দিকে তাকায়। মেয়েটার মুখটা আচমকাই চঞ্চলতায় ভরে গেছে। ইনায়ার কাজল কালো আঁখি গুলোতে খুশির আভাস। সে শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করে,
-” আমরা পুরান ঢাকায়? ”
-” এতো খুশী হওয়ার কি আছে? দেখো তোমার শহরের অবস্থা। এ রাস্তায় তো রিকশা ছাড়া কিছুই চলে না মনে হচ্ছে। ”
ইনায়া দেখে সামনের রাস্তায় আসলেই গাড়ি ঢুকবেনা। সামনের দুইটা গুলির মোর নিলেই ইনায়াদের বাড়ি। অবশ্য অন্য রাস্তা ধরে গেলে ঠিকই গাড়ি ঢুকতো। কারণ গলির বড়ো রাস্তার পাশেই ইনায়াদের বাড়ি। ইনায়া সামান্য রাগ নিয়ে বলে,
-” আগে কেন বললেন না? যে বাড়িতে নিয়ে যাবেন? বললে আমি ঠিক রাস্তা দেখিয়ে দিতাম। ”
জায়ান ভ্রু কুঁচকে তাকায়। ফাহাদ জিপিএস অন করে রেখেছিলো। সে হিসেবেই তাড়াতাড়ি রাস্তা খুজতে গিয়ে জট পাকিয়ে ফেলেছে জায়ান। জায়ান ঘন স্বরে জিজ্ঞেস করে,
-” জানা থাকলে চলো। গাড়ি ঘোরাতে হবে আবার। ”
ইনায়া মাথা নাড়িয়ে তারাতাড়ি করে বলে ওঠে,
-” না, না, এখন ঘুরে যেতে হলে অনেক সময়। আমার সাথে আসুন। আমার এদিকের রাস্তা একেবারে মুখস্থ। ”
বলেই ইনায়া সামনে হাঁটতে শুরু করে। অগত্যা জায়ানও ইনায়ার পিছন হাঁটে। একতালা দুতালা প্রায় লাগানো লাগানো, শেওলা যুক্ত স্যাঁতস্যাঁতে সাদা রঙের দেয়ালের, লম্বা উন্মুক্ত করিডর। বড়সড় জানালা যুক্ত বাড়িগুলোকে জায়ানের কাছে নেহাৎ হরর ফিল্মের ভুতুড়ে বাড়ির মত লাগছে। গলির রাস্তা পেরুতেই সামনে চিকন সুরু রাস্তা পরে। জায়ান অবাক হয়। একজন কোনো রকম যেতে পারবে। অপর পাশ থেকে অন্য কেউ এলে রাস্তা কি করে পার হয় এরা? আর মাথা ঘামায় না জায়ান। আর কিছুক্ষণ হাটার পরে বড়ো রাস্তায় উঠে তারা। রাস্তার সাইডে দাঁড় করানো তিনটি গাড়ি। দুটি অবশ্য জায়ান ভালো করে চেনে। গাড়ি বরাবর বড়ো লোহার গেইট। কাঙ্ক্ষিত জায়গায় এতোক্ষণে এলো তারা। ইনায়া শান্ত নির্জীব হয়ে তাকিয়ে থাকে চিরচেনা সেই বাড়িটার দিকে। চোখের কোনে অশ্রুরা ভিড় করে। গুনে গুনে বারোটা মাস হতে চললো। ইনায়া সোহানার হাত ধরে এই বাড়ি ছেড়েছিলো। জায়ান বাড়িটা অবাক হয়ে দেখে। এল আকৃতির বিশাল বড়ো সাদা রঙের তিনতলা বাড়ি। যেখানে বড়ো করিডর পেরিয়ে রয়েছে একতলা থেকে অন্যতলায় যাবার বিশাল বড়ো সিড়ি। পুরনো হলেও আভিজাত্যপূর্ণ বাড়ি। আসেপাশের বাড়ি থেকে বিবেচনা করলে, এটা নির্ঘাত জমিদার বাড়ির খেতাব দেওয়া যাবে। জায়ান ইনায়ার পানে তাকাতেই গম্ভীর ঘন স্বরে বলে ওঠে,
-” চোখের পানি তোমার কাছে এতোই অমূল্য? যখন দেখি তখনই ঝরাতে থাকো। আগে নিজেকে সামলানো শিখে নাও। দেখবে, মূল্যবান প্রবাহিত পানির স্রোত বারবার তোমার ধারে আসবে না। ”
ইনায়া ম্লান হাসলো। জায়ানের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো,
-” শান্ত নদী বরাবরই শান্ত থাকে। একদম নির্জন নিস্তব্ধ স্রোতশূন্য। আর অশান্ত নদীর প্রবাহিত স্রোত ক্ষনে ক্ষনে গর্জন তুলে একের পর এক নতুন রুপে ফিরে আসে। আমার ভাগ্য নাহয় অশান্ত নদীর পাড়েই দাঁড়িয়ে থাকবে। ”
জায়ান আর কোনো কথা বলে না। তার সামনে দাঁড়ানো নারীটিকে সে আসলেই চিনতে পারে না। যখন মনে হয়, তাকে বুঝে গেছি। তখনই, তাকে টেনে বের করে এই নারী। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে লোহার বড়ো গেইট পেড়িয়ে বাড়িতে ঢোকে জায়ান। ইনায়া বাড়িতে ঢুকে আগে আগে পা ফেলে সামনে যায়। অনেক খুশি ভিড় করে মনে। এই বাড়িতেই তার শৈশব-কৈশোরের জড়ানো কাহিনি ডুবে আছে। চোখ বন্ধ করলেই সেগুলো ভেসে উঠে। বড়ো উঠোন পেরিয়েই বাড়িটি। জায়ান সামনে তাকিয়েই জিজ্ঞেস করে,
-” তোমাদের হলরুমে নিয়ে চলো। বাবা, ভাই ওখানেই আছে। ”
এতোক্ষণ খুশিতে ভাসতে থাকা ইনায়ার মুখ গম্ভীর হয়ে এলো। মনে ভিড় করলো অনেক প্রশ্ন।
-” সবাই এখানে কেন? কিছু হয়েছে কি? ”
-” গেলেই বুঝতে পারবে। ”
ইনায়া আর রা করে না। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে চলে বাড়ির আনাচে-কানাচে মুখস্থ করা রাস্তাতে। পেছনে জায়ান লক্ষ্য করে তার পায়ের পদক্ষেপ। হলরুমে ঢুকতেই ইনায়ার চোখ স্থির হয়ে যায়। বিশাল বড়ো হলরুমের পুরনো আমলের কাঠের খোদাই করা কারুকাজ সম্পূর্ণ সোফা গুলোতে বসে আছে ছয়জন। দুইটা মানুষ কে দেখে ইনায়া ভিষণ অবাক হলো। কারন সামনে তার ফুপু আনিলা ও তার হাসব্যান্ড ইয়াসিন চৌধুরী। যে তার ভাইয়ের মৃত্যুর পরেও একবারও আসলোনা। তার হঠাৎ পুরান ঢাকায় আসার কারণ ধরতে পারলো ইনায়া। আনিলা মুখ বাঁকা করে ইনায়া কে দেখে। ইনায়া মাঝেমধ্যে অবাক হয়। মাও বলতো আনিলা তাকে ছোট বেলায় অনেক আদর করতো। এমনকি ইনায়ার নামটাও তার রাখা। ফাহাদ হাত নাড়িয়ে জায়ান আর ইনায়াকে পাশে বসতে বলে। ইনায়া গুটি মেরে মিজানুল করিমের পাশে বসে পরে। মিজানুল করিম উকিলের সাথে কথা বলে আনিলা বেগমের দিকে তাকায়।
-” দেখুন বিষয়টা আমি সহজেই হ্যান্ডেল করতে চাইছি। ইনায়ার বাবা আশরাফ হোসেন আপনার কাছে ব্যবসার জন্য টাকা ধার করেছিলো বছর চার এক আগে। যেটা তিনি শোধ করেননি। এখন আপনি পৈতৃকসম্পত্তি ও ধারকর্জ টাকা সহ তার পুরো বাড়িটাই দাবি করছেন। তাইতো? ”
আনিলা বেগম গম্ভীর মুখে বললেন,
-” হ্যাঁ, ভাই আমার কোনো টাকাই শোধ করেননি। আর বাবার সম্পত্তির উপর আমারও অধিকার আছে। তাই আমি দাবি করতেই পারি। ”
ফাহাদ এবার উকিলের থেকে একটা ফাইল নিয়ে আনিলা বেগমের দিকে এগিয়ে দেয়। আনিলা ও তার হাসব্যান্ড ইয়াসিন চৌধুরী দুজনেই চমকে উঠে তাদের দিকে তাকায়। জায়ান বাঁকা হেঁসে বলে ওঠে,
-” আশরাফ হোসেন আপনার থেকে টাকা নিয়ে আড়ত আরো বড়ো করেছিলেন। বছর দুই যেতেই তিনি তিনটি আড়তের মালিক হন। তারপর আপনার টাকাসহ গোটা একটা আড়ত তিনি আপনার নামে দিয়েছিলো ওনার মৃত্যুর মাস তিন আগে। এই দলিল তার প্রমান। তাহলে আপনি টাকা দাবি কি করে করতে পারেন? ”
ইনায়ার এতোক্ষণে মনে পরে তার বাবা আনিলার নামে একটি আড়ত দিয়েছিলো। কিন্তু এর পেছনে এতো কাহিনি জানা ছিলোনা ইনায়ার। আনিলা বেগম চটে উঠেন।
-” মিথ্যা কথা ভাই আমাকে এমন কিছুই বলেনি। এবং দেননি। মিথ্যা রটাচ্ছেন আপনারা। ”
জায়ান গম্ভীরমুখে একটু হাসি ফোঁটায়। পাতলা ঠোঁট দুটি নাড়িয়ে ঘন স্বরে জিজ্ঞেস করে,
-” কিন্তু? এখানে তো আপনারও সিগনেচার আছে। আপনার পাসপোর্টের হিসাব ধরে দেখতে গেলে আপনি তখন বাংলাদেশেই ছিলেন। ”
মুখ ছোট হয় আনিলার। এই ছেলে তার ভিসা অবধি ঘেঁটে ফেলেছে? এই চুনোপুঁটি মেয়ে কি করে মেয়র উকিল নিয়ে আসলো? তা মাথায় ঢুকছেনা তার। ইয়াসিন চৌধুরী এবার রাগান্বিত হয়ে বলে ওঠে,
-” দুর্নীতি করছেন সবাই? এসব কি? ”
মিজানুল করিম এবার গম্ভীর স্বরে বলে উঠলো,
-” প্রমাণ সব আমাদের হাতেই। এখন যদি আপনারা না মানেন। তাহলে কঠোর আইনের ব্যবস্থায় আমাদের যেতে হবে। ”
-” যতো যাই হোক, আমি আমার বাড়ি থেকে এক পাও নড়বো না। ”
কঠিন গলায় জোর খাটিয়ে বললেন আনিলা। ফাহাদ এবার উকিলের কাছ থেকে একটা বার্থ সার্টিফিকেট এনে দু’জনের সামনে ধরে। অতঃপর দুজনের মুখ কালো আধারে ডুবে যায়। ফাহাদ বাঁকা
হেঁসে বলে উঠে,
-” এই কাগজ অনুযায়ী, আপনি এবাড়ির কেউ নন। আশরাফ হোসেনের বাবা তার প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পরে, আপনার মাকে বিয়ে করেছিলেন। আপনার মা ছিলেন বিধবা ও তার ছিলো তিন বছরের একটা মেয়ে। মানে আপনি। ”
এইটুকু শুনেই ইনায়া আশ্চর্য হয়ে যায়। আজ পর্যন্ত এই সত্য তার কাছে অজানা ছিলো। বাবা মা এবং কি ছোট বেলায় দাদা দাদির মুখেও কোনোদিন এসব কথা শুনেনি। আনিলা বেগমের মুখ রক্তশূণ্য ফ্যাকাসে হয়ে যায়। পুরোনো সত্য বেরিয়ে এলো বলে। ইয়াসিন চৌধুরী নিজেও এই ব্যাপারে অবগত ছিলেন না। তিনি অবাক হয়ে তাকায় আনিলার দিকে। ফাহাদ তাদের হতভম্ব মুখ দেখে মজা পেলো। সে কুটিল হেসে বাকি কথা শেষ করে।
-” আশরাফ হোসেনের বাবা, মানে আপনার সৎ বাবা আপনাকে মেনে নিয়েছিলো। নিজের পরিচয়ে আপনাকে বড়ো করে, তিনি সমান ভাবে আপনাকে এবং আশরাফ হোসেনকে সম্পত্তি ভাগ করে দিয়েছিলেন। তার মধ্যে এই বাড়ি আশরাফ হোসেনের ভাগে ছিলো। ইয়াসিন চৌধুরীর সাথে আপনার প্রনয়ের সম্পর্ক ছিলো। এর সাথে অবৈধ মেলামেশা। যার জন্য আপনি বিয়ের আগেই প্রেগন্যান্ট হয়ে গেছিলেন। সব শুনে আপনাকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিলো। অতঃপর আপনি ইয়াসিন চৌধুরীকে বিয়ে করেন এবং তার কিছুদিন পর আপনার সকল সম্পত্তি বিক্রি করে কানাডায় চলে যান। বাবা মায়ের মৃত্যুর কিছুদিন আগে আপনি আবার তাদের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলেন। কি তাইতো, মিসেস চৌধুরী? ”
পিনপিনে নিরবতা চলছে রুমটিতে। দুই গম্ভীর ব্যাক্তিত্বের পুরুষের মুখে কুটিল হাসি ফুটে উঠেছে। যে হাসি অপর পক্ষকে পরাজিত করার। ইনায়া চোখমুখ কুঁচকে রয়েছে। আনিলা এতো জঘন্য তার জানা ছিলো না। ইয়াসিন চৌধুরী আর কিছু না বলে গটগট পায়ে রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। মিজানুল করিম ও ফাহাদ বাকি দুই উকিল কে নিয়ে কথা বলতে বলতে বাইরে যায়। আনিলা বেগম চটে গিয়ে ইনায়ার সামনে দাঁড়ায়।
-” ভালোই তো রুপ দেখিয়ে খদ্দের জোগাড় করেছিস। তোর মতো মেয়েরা পারে আর কি। ”
-” তা তো বটেই, আপনার মেয়েও কিন্তু খদ্দের জোগাড় করাতে বেশ পটু। তাও আবার বিবাহিত। আপনার শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন বোঝাই যায়। কানাডার মোস্ট হট প্রস্টিটিউট বলে কথা। ”
ইনায়া কিছু বলার আগেই জায়ান পিছন থেকে কঠিন গলায় বলে ওঠে। আনিলা বেগম ক্ষেপে গিয়ে দাঁত কিড়মিড়িয়ে উঠে। জায়ান কে আঙুল শাসিয়ে কিছু বলতে যাবে, তার আগেই মুখের আদল ভয়ংকর লাল করে গর্জে উঠে জায়ান।
-” আবার গলা উঠালে, মেরে পুরান ঢাকার অলিতে-গলিতে দেহ ছিন্নভিন্ন করে রেখে দেবো। ”
আনিলা জায়ানের চোখের দিকে তাকিয়ে ভয় পেয়ে গেলেন। ইনায়াও হতভম্ব হয়। এই গুন্ডাটা হঠাৎ করেই মুখের আদল বদলে ফেলে। জায়ান লম্বা পায়ে হেঁটে আনিলার সামনে আসে। তারপর পাঞ্জাবির হাতা হালকা গুটাতে গুটাতে বলে,
-” এক্ষুনি বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যান। না হলে ঠ্যাং ভেঙে সারাজীবনের জন্য গলিতে ভিক্ষা করার ব্যবস্থা করে দিবো। কারণ জায়ান করিম কথা কম বলে, কাজে বেশি ফোকাস করে। ”
জায়ান নাম শুনতেই আনিলা থমকালো। বিডি তে এসেছে পনেরো দিন। এই দিনের মধ্যেই বাড়ির জন্য বিশাল ঝুটঝামেলা পোহাতে হয়েছে জায়ান করিমের সঙ্গে। সামনা সামনি দেখা না হলেও লোকজন দিয়ে ঠিকই শাসাতো। তাহলে এই সে ছেলে? আনিলা আর কথা বাড়ালো না। চলে গেলেন
সামনে থেকে। ইনায়া নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে। জায়ান সোফার মধ্যে ক্লান্ত ভঙ্গিতে গা এলিয়ে দেয়। টেবিলের উপর এক পা, আরেক পায়ের উপর ভাজ করে রাখে। অতঃপর হাই তুলে ইনায়ার উদ্দেশ্যে বলে,
-” এই তোমার বাড়ির মেহমানদারী? এক কাপ চাও খাওয়ালেনা? ত্রিশ মিনিটের মেহমান আমি। তোমার থেকে এতো কুঞ্জসি আসা করিনি হরিণী। ”
-” আব্বে হালা, খাইবার হইলে থাকতে হইবো। নাইলে আমডা কোনো মেমানি করিনা। বুঝে আইলে থাহো, না অইলে যাওগা। ”
জায়ান থ হয়ে রইলো। ইনায়া কথা গুলো মুচকি হেসে সরে যায়। জায়ান কিছুটা অবাকের রেশ ধরে বলে ওঠে,
-” এখন আবার সালা?এটাকি ঠিক করলে হরিণী? ”
কথাটা ইনায়া অগোচরে থেকে যায়। বাইরে এসে মিজানুল করিম আর ফাহাদকে অনেক ধন্যবাদ জানায় ইনায়া। তারা না থাকলে বাবা মায়ের নিজের শৈশবের স্মৃতিটাও হারাতে হতো। ফাহাদ ইনায়াকে মুচকি হেসে বলে ওঠে,
-” ধন্যবাদ টা আমাদের না জায়ানের পাওয়া দরকার। বাবা বলার পরে এই বিষয়টা আমি জায়ান কে দেখতে বলেছিলাম। সে অনেক কষ্টে তোমাদের বাড়ি আর তার হিস্টোরি বের করেছে। ”
ইনায়া অবাক হয় না। কারণ সে জানে। এই গুন্ডাটার ধারা সব সম্ভব। মিজানুল করিম এবার ফাহাদের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর মুখে বলে,
-” এই ঝামেলা তো শেষ হলো। এখন বলো তোমার কিচ্ছা কবে মিডিয়া থেকে ডিলিট করছো? আজকাল বিজনেস পার্টনার গুলোও তোমার নাম ভাঙিয়ে আমার সাথে মজা করে। ”
ফাহাদের মুখটা শুকিয়ে যায়। ঘটনাটা আসলেই দিনকে দিন বড়ো হচ্ছে। তার দলের লোক গুলো এই নিয়ে তাকে সন্দেহ শুরু করেছে। আপাতত ভাবনায় আছে সামনের সপ্তাহে তিলককে সাথে নিয়ে প্রেস মিটিং ডেকে বিষয়টা সেখানেই ক্লোজ করবে। এছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তার আগে সে নিধিকে চরম শিক্ষা দেবে। নিধি ফাহাদকে অপমান করলেও তার গায়ে লাগতো না। কিন্তু বিষয়টা এবার তার স্বপ্নের ক্যারিয়ারে পরেছে। এবার কোনো ছাড় সে দেবেনা।
-” সামনের দিনেই প্রেস মিটিং করবো। আসা করি ঠিক হবে। না হলে দলের লোক গুলো আমার শিরশ্ছেদ করে দিবে। সব দোষ নিধির। ওর কাছে মাথাটাই আছে। কোনো বুদ্ধি নেই। ওর তো খবর আমি নেবোই। ”
চিবিয়ে চিবিয়ে বলে উঠে ফাহাদ। ইনায়া ইন্টারনেটে ফাহাদের বিষয় দেখেছে। কিন্তু এর মধ্যে নিধি কি করে ইনভলভ হলো তা ভাবার বিষয়। মিজানুল করিম ফাহাদের কথার প্রেক্ষিতে খুশি হয়ে বললেন,
-” আলহামদুলিল্লাহ! এতোদিনে কাজের মতো কাজ হয়েছে। নিধিকে আমি দুইদিনের শপিং করার টাকা গিফট করবো। তুই যদি ওকে বকেছিস তো, আমি নিজেই তোর শিরশ্ছেদ করবো। ”
ফাহাদ আবার আহত হয়। পৃথিবীতে মনে হয় তার বাবাই একমাত্র মানুষ। যিনি নিজের ছেলেদের ক্যারিয়ার ভাঙার জন্য দিনরাত দোয়া করে। মিজানুল খুশি মনে হেঁটে হেটে বাইরে চলে যায়। তার তো অনেক আনন্দ লাগছে। ফাহাদের রাগ নিধির উপর আরো বৃদ্ধি পায়। সে ইনায়া দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলে,
-” তুমি জায়ানের সাথে চলে এসো। আমার জরুরি কাজ আছে। ”
ইনায়া হ্যা বা না বলার আগেই ফাহাদ একপ্রকার দৌড় লাগিয়ে গাড়ির দিকে অগ্রসর হয়।
– চলবে………………
#যাতনা_আমার
#সানজিদা_ইসলাম_সূচনা
#পর্ব :২৪
( কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)
নাভানের মনে যেন অশান্তিরা বাসা বেঁধেছে। নিজেকে কিছুতেই ঠিক রাখতে পারছেনা সে। সেদিন জায়ানের কথার মানে সে বুঝতে পেরেছে। তাহলে কি ইনায়াও কি তাকে পছন্দ করে? এইসব কথা ভেবে ভেবে কোনো রকম বাড়িতে এসে পৌছায় নাভান। হলরুমে আসতেই কিছুটা অবাক হয় নাভান। বাবা-মা চাচা সবাই বাড়িতে। হাতের ওয়াচের দিকে তাকিয়ে সময় দেখে নেয় নাভান। এতো তারাতাড়ি অফিস থেকে চলে এসেছে তারা? আয়েশা মির্জা গম্ভীর মুখে বসে আছেন। তার পাশেই কেঁদে চলছে নিপা। নিজের মনের অশান্তি দূরে রেখে সোহানার কাছে জানতে চায় নাভান। একে একে সব কথা নাভানকে বলেন সোহানা। সব শুনে নাভানের গম্ভীর মুখটা আরো গম্ভীর হয়ে যায়। সে তো জানে। ইশান কে নিধি কতোটা পছন্দ করে। এখন সামনে কি পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে তাদের জন্য? নিপার গুনগুন বেড়েই চলছে। নাভান দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিপা কে জিজ্ঞেস করে,
-” এমন বাচ্চাদের মতো কাঁদছো কেনো বলতো। ”
নিপা ভাঙা গলায় বললেন,
-” দেখনা বাবা, ঘরের মেয়ে। বাড়ির সবাই রাজি। এর মধ্যে তোর ভাইয়ের একার অমত কি সহ্য হয়? সে নিজেই তো এখনো নিজেকে বুঝতে শিখেনি। আর সেখানে, তার জীবনের এতো বড়ো একটা ডিসিশন। আমি বাপু বেঁচে থাকতে ওই মেয়েকে ঘরে তুলবো না। ”
নাভান হেসে উঠে। বিদ্রুপের হাসি সেটা। মুখটা শান্ত তারপরও অস্থির অবিচল। নিপার দিকে তাকিয়ে নাভান শান্ত স্বরে বলে,
-” ইশান ভালোবাসে তিথিকে। এই সত্য তুমি লুকাতে পারবেনা। সংসারটা ইশান করবে। তোমরা কতোদিন আর বাঁচবে বলো? যার যার লাইফের ডিসিশন তাকেই নিতে দাও। না হলে আমার আর ইনায়ার মতো সম্পর্ক টা ক্রিটিকেল হয়ে যাবে। হয়তো মানতে পারবেনা নিধিকে ইশান। ”
নিপা চোখমুখ মুছে শান্ত গলায় বলে,
-” তুই নিজেও তো ভুল ছিলি নাভান। অদিতি তোর জন্য সঠিক ছিলো কি? ইশানের বেলায়ও যে তা হবে না। তার গ্যারান্টি কি?
সোহানা এবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিপার পাশে গিয়ে বসে। তারপর ধির সুস্থে বোঝানোর স্বরে বলে,
-” যেখানে, ইশানের মনে অন্য কেউ। সেখানে, নিধি ভালো থাকতে পারবে না। সে নিধিকে হয়তো স্ত্রী হিসাবে প্রাপ্য সম্মান টুকুও দিতে পারবেনা। আজকে নিধির উপর ইশান যে ভাবে ক্ষেপেছিলো। তাতেই বিষয় টা আমি আরো ভলো ভাবে উপলব্ধি করেছি। নিধিতো এই ব্যপারে কিছু জানতো না। বিয়ের পর যে ইশান নিধিকে মেনে নিবে বা সংসার করবে তার গ্যারান্টি কি? আর তিথি যে ইশানের জন্য ভালো না, তার কোনো প্রমান আমরা কেউ দিতে পারবো না। আর নাভান ভুল ছিলো বলে, ইশানও ভুল। এটা নেহাৎ বাচ্চাদের মতো না-বুঝ কথা। ”
-” মা ঠিক বলছে ছোট মা। ইশান আর তিথি দুজনেই এডাল্ট ছেলেমেয়ে। তারা দুজনেই নিজেদের জীবনের ভালোমন্দ বুঝে। সেখানে তুমি জোর করে নিধিকে তাদের মাঝে ঢোকাবে। তা তো হবে না।তোমার কথা গুলো আসলেই বাচ্চাদের মতো লাগছে। ”
সোহানার সাথে তাল মিলিয়ে বলে নাভান। নিপা আর কোনো কথা বলে না। আসলেই জিনিসটা ভাবার বিষয়। আয়েশা মির্জা কোনো কথা আর বললেন না। নাভানের সাথে তর্কে তিনি পেরে উঠবেনা জানেন। সোহানা এবার আয়েশা মির্জার গম্ভীর মুখে তাকিয়ে করুন কন্ঠে বললেন,
-” মা আমি নিধিকে ইনায়ার জায়গায় দেখতে চাই না। জোর করে কারো মনে ঢুকা সম্ভব নয়। আমাদের এমন সিদ্ধান্তের রাগ ইশান নিধির উপর ঝাড়াবে। এমনটাই হবে? ইনায়ার বিষয় থেকে শিক্ষা হয়ে গেছে আমার। আপনি নিজেই তো ইনায়া কে এই বাড়ি সম্পর্ক থেকে বেরুনোর জন্য কতো বুদ্ধি
দিতেন। নিধির সাথে এমনটা হলে, আপনার জবান টাই থাকবে তো? থাকবেনা। তখন আপনি নিধি যেনো সংসার করতে পারে সেই চিন্তা করবেন। কারণ নিধির পরিবার আছে। তাকে নিয়ে তার পুরো পরিবার ভাববে। কিন্তু ইনায়ার সেটা ছিলো না। আর ইনায়ার জিবন দেখে আমি শিক্ষা পেয়েছে। নিজের মেয়েকেও আমি ওই জায়গায় দাঁড় করাতে চাই না। নাভান ভুল মানুষকে চেয়েছিল। তা বলে যে ইশানের মানুষটাও ভুল এমনটা নয়। আপনি কি চান নিধিও ডিভোর্সী হোক? ”
আয়েশা কোনো কথা বললেন না। চুপটি করে রইলেন। নিপারো একই অবস্থা। নাহিদ মির্জা এবার নওয়াজ মির্জার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
-” তাহলে সিদ্ধান্ত এটাই রইলো। সময় করে মিজানুল করিমের সাথে আমি ইশান আর তিথির বিয়ের কথা তুলবো। ”
নওয়াজ মির্জা সায় জানান। তার ছেলের যাকে পছন্দ তাকেই তিনি মেনে নিবেন। নাহিদ মির্জা আর নওয়াজ মির্জা এবার উঠে কথা বলতে বলতে নিজেদের ঘরের দিকে এগোলেন। বসে থাকা চারজনের মধ্যে তখনও পিনপিনে নিরবতা চলছে। নাভান সেখান থেকে উঠে সিড়ির কাছে আসতেই নিপা সোহানার উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
-” তুমি বলছো ইশানের পছন্দ মেনে নিতে। তিথি খারাপ না। নাভানও তো অদিতিকে পছন্দ করেছিলো। তুমি মেনে নাও নি। যদি অদিতি এখন নাভানের বউ হতো তাহলে? ”
সোহানা মুচকি হাসলো। নাভানের পা থেমে গেলো প্রথম সিড়ি তে। কিন্তু পিছন ফিরলো না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সোহানা বললো,
-” তখন হয়তো নাভানের একার অন্ধকার ভবিষ্যৎ হতো। একটা নরম নিষ্পাপ মেয়ের জীবন বেচে যেতো। কোনো পাপ না করেও তার জীবন এখন অন্ধকারে। সেখানে নিধিও একই পরিস্থিতিতে পরুক তাই আমি চাইবোনা আর। ”
নিপা আর কিছু বলে না। নাভার ধীরগতিতে হেটে উপরে চলে আসে। দোতলার করিডোর দাঁড়িয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তার মা আসলেই ঠিক বলেছে। আসলেই সে সুন্দর মেয়েটার জীবনটা নষ্ট করে ফেলেছে। মুহূর্তেই নাভানের সামনে ভেসে উঠে ইনায়া কান্নারত মুখটা। এটাই তার তিন কবুল করা বউ। যাকে সে মুখটা না দেখেই দেশ ছেড়েছিলো। পাষন্ড মনে তখনো কি একটু তার কথা ভেবেছিলো? নাহ্ , মায়ের প্রতি জেধ রাগ তখন তার মাথায় খারাপ ভালো ঢোকায়নি। যা এখন ভাবলে, বুকের পাঁজর থেকে দীর্ঘশ্বাস ব্যাতিত কিছুই মনে হয় না। ডিভোর্স পেপার তার হাতে। কি করবে এখন? অন্যথা মাথায় আর চাপ না দিয়ে নিধির রুমে ঢোকে নাভান। দরজা টা ভিড়ানো ছিলো। রুমের পর্দা গুলো সব টাঙানো। দিনের বেলায়ও ঘর অন্ধকার হয়ে আছে। নাভান দক্ষিণ দিকে জানালা টা গিয়ে খুলে দিলো। সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকার ঘর আলোকময় হয়ে যায়। নাভান লক্ষ্য করে নিধি কাউচে শুয়ে মুখটা কুশনে গুজে রয়েছে। নাভান আস্তে করে হেঁটে নিধির সামনে এসে বসে। তারপর দুই থেকে তিনবার নরম গলায় ডাকে। নিধি কোনো সাড়াশব্দ করে না। নাভান এবার হতাশ হয়ে বলে,
-” তোর থেকে এটা আশা করিনি নিধি। বোকার মতো অযথা কেঁদে যাচ্ছিস। যার মূল্য কারো কাছেই নেই। সবটাই বুঝিস, ভালোবাসা জোর করে পাওয়া সম্ভব না। ”
নিধি এবার মুখ তুলে তাকায়। পানপাতার মতো মুখ টা টুকটুকে লাল হয়ে আছে। চোখগুলোর একই অবস্থা। নাভানের বুকটা ধুক করে উঠে। নিধি তার বড্ড আদরের আহ্লাদী বোন।
-” ভাইয়া আমার বিবেক মানলেও মনের সাথে আমি পেরে উঠছি না। মানতে বড়ো কষ্ট হচ্ছে। যে মানুষ টা আমার ছিলো সে হুট করে অন্য কারোর হয়ে গেলো? দুদিন আগেও মনে হয়েছে, আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। যে না চাইতে মনের মানুষটাকে পেয়েগেছি। কিন্তু, আমার সুখে যে দহন পরবে তা আমার জানা ছিলো না। ”
নিধির কথায় নাভানের মুখটা ম্লান হয়। সে তো জানে নিধি কতোটা অবুঝ। সহ্য ক্ষমতা কতো কম। নাভান হাত বাড়িয়ে নিধিকে কাছে ডাকে। হামলে পড়ে ভাইয়ের বুকে চুপটি করে থাকে নিধি। ক্ষনে ক্ষনে কেঁপে উঠে বহুবার। নাভান নিধিকে জড়িয়ে ধরে শান্ত স্বরে বলে,
-” এই অনুভূতি গুলো এখনি মাটি চাপা দে। এ্যানি হাউ! আমি চাইনা তোর অনুভূতিটা ইশানের বা বাড়ির কারো কাছে সেটা প্রকাশ পাক। বাড়ির সবাই সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মধ্যে তোর বিষয়টা জানাজানি হলে তাদের সবার মন অশান্ত হবে নিশ্চিত। যা তিথি আর ইশানের বিয়ের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। তোর আর ইশানের মধ্যে কোনো কন্ট্রাডিক্টরি সম্পর্ক হোক সেটা আমি চাই না। ”
এই বলে থামে নাভান। নিধি এখনো নাভানের বুকের সাথে মিশে রইলো। নাভান খানিকক্ষণ চুপ আলতো করে সুধায়,
-” বুঝতে পেরেছিস? ”
– ” হুম ”
পোষ মানা পাখির মতো বলে উঠে নিধি। নাভান দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানলার সাথে লাগো বড়ো শিউলি ফুলের গাছটাকে দেখতে থাকে। যেটা নিধির খুব পছন্দের গাছ। গাছের ডালে নিধির একটা বড়ো ছবি ঝুলছে। তার নিচে লেখা ‘ এটা নিধির গাছ, কেউ যদি এর দিকে তাকায় বা ফুল কুড়িয়ে রাখে। তাঁদেরকে জেলে ভড়ে দিবো। ‘ নাভানের ভিতর থেকে আরো বড়ো দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে। তার বোন যেন একটু বেশীই বাচ্চা স্বভাবের। এর জন্য না জানি কতো বিপদে পরতে হয় ওকে। ফাহাদের ছবি ভাইরালের কথা জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করেনি নাভান। ফাহাদ জানিয়েছে বিষয়টা হ্যান্ডেল করে নিবে।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। এখন পাল্লা দিয়ে রাতের আধার ঘনিয়ে আসার পালা। একটু আগেই হোস্টেলে ফিরেছে ইনায়া। আজ আর টিউশনে যেতে পারেনি। নামাজ শেষে বই নিয়ে বসেছে। সামনেই সেমিস্টার ফাইনাল। পড়ায় মন দিলেও মন যেন বসছে না। এতো জটিল জীবনের সমীকরণ। সব যেনো ধোঁয়াশা। কেমন যেন হতাশ হতাশ লাগছে তার কাছে। ফোন হাতে নিয়ে নিধিকে কল লাগায় ইনায়া। কিন্তু কই? রিং হয়ে কেটে গেলো কয়েকবার। কিন্তু নিধির পিক করলো না। এই মেয়ের হুট করে কি হলো বুঝে না ইনায়া। তিথি উপর দিকে ফোনে ইশানের সাথে কথা বলছিলো। মির্জা বাড়ির সবাই যেহেতু মেনেছে বিষয়টা। তাই দ্রুত বাড়ির সবাইকে তার জানাতে হবে। তিথি ভাবে কালই বাড়িতে যাবে সে। ফোনটা কেটে একটা প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস ফেলে তিথি। গত দুইটা দিন তার অনেক কষ্টে কেটেছে। টেনশনে তার মাথা ঘেঁটে ফেলেছিলো প্রায়। তিথি অন্যমনষ্ক হয়ে থাকা ইনায়ার দিকে তাকায়। তারপর উঠে ইনায়ার পাশে বসে। ইনায়া সচকিত হয়ে তিথির দিকে তাকায়। তিথি মলিন মুখে জিজ্ঞেস করে,
-” মন খারাপ? কি হয়েছে? কখন থেকে থেকে অস্থির অস্থির লাগছে তোমাকে। ”
ইনায়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তার চিন্তিত মুখে বলে ওঠে,
-” দুটো দিন ধরে নিধির কোনো খোঁজ নেই। মেয়েটা কলও ধরছে না। কি জানি? কোনো সমস্যা হলো নাতো?
নাকি, ফাহাদের ভয়ে এমনটা করছে? মনেমনে ভাবে ইনায়া। তিথি এবার জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজায়। অতঃপর মিনমিন কন্ঠে বলে ওঠে,
-” তোমাকে কিছু বলার ছিলো ইনায়া। ”
তিথির দিকে পূর্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ইনায়া। মেয়েটা কেমন যেন উসখুস করছে। ইনায়া শান্ত স্বরে বলে,
-” কি বলবে? বলে ফেলো। ”
তিথি দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইনায়াকে সব কিছু বলতে শুরু করে। তার আর ইশানের সম্পর্কের শুরু থেকে বর্তমান পর্যন্ত। সব শুনে ইনায়া থ হয়ে রইলো। এরজন্য তিথি কথাটা শুনে এমন হকচকিয়ে গেছেলে? আর নিধি? এ কোন ত্রিকোণ প্রেম এসে মিলিত হয়েছে? তিথি ভেজা ভেজা গলায় বলে,
-” স্যরি ইনায়া তোমাকে সেদিন কিছুই জানাতে পারিনি। আসলে খবরটা শুনে আমার নিজেকে পাগল পাগল মনে হচ্ছিলো। কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। তাই বিষয়টা ইশান কে জানিয়ে ছিলাম। ইশান বাড়িতে সবটা মেনেজ করে নিয়েছে। তারা আমাদের বিয়ের কথা শীগ্রই পাকা করবেন। ”
নিধির হঠাৎ এমন নির্জীব হয়ে যাওয়ার কারণ টা মনে হয় বুঝতে পারলো ইনায়া। সেদিন নিধির মুখে খুশি উপচে পরছিলো। সে দেখতে পেয়েছিলো নিধির চোখে ইশানের জন্য প্রচুর ভালোবাসা। নিধি কি ইনায়াকে দোষারোপ করবে? তিথিকে বলেছে বলে। পরক্ষণেই নিজের মনকে বুঝ দেয় ইনায়া। সে না বললেও দুইদিন পর ঠিক বিষয়টা জানাজানি হতো। নিধির সাথে শীগ্রই দেখা করবে ইনায়া। তিথি এবার মলিন কন্ঠে সুধালো,
-” আমার জন্য মনে হয় নিধি ও তার পরিবার প্রচুর কষ্ট পেয়েছে। এতো গুলো মানুষের স্বপ্ন নষ্ট হলো। নিধি মনে হয় ইশান কে পছন্দ করতো। ”
ইনায়া মিষ্টি হেসে তিথির উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
-” আসলে একদিক দিয়ে এটাই ঠিক হয়েছে। পরিবারের লোকজন কয়দিন থাকবে বলো? তোমরা দুজন সারাজীবন সংসার করবে। সবচেয়ে বড়ো সত্যি তোমরা দুজন দুজনকে ভালোবাসো। এটাকে কেউ বদলাতে পারবে না। তোমাদের ভালোবাসা সত্য। নিধিরও ভালোবাসাটা পবিত্র কিন্তু একপাক্ষিক। সেটা মনে না রাখাই ভালো। নিধি শিক্ষিত মেয়ে। সে নিশ্চয়ই ভুঝবে সব। টেনশন করো না। ”
তিথি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। ইনায়াও মনে হাজার চিন্তা নিয়ে চুপ করে বসে থাকে। প্রহর কাটতে থাকে দুজনেই দুই ভাবনায় মগ্ন হয়ে। হঠাৎ ফোন বেজে উঠায় দুজনের ভাবনার সমাপ্তি ঘটে। ইনায়া তাকিয়ে দেখে তার ফোন বেজে চলছে। আনোন নাম্বার হলেও কেনো যানি ফোনের মালিকটা কে চিনে নেয় ইনায়া। তিথি সামান্য হেসে নিজের বিছানায় চলে যায়। ইনায়া ফোনটা রিসিভ করে শান্ত কন্ঠে বলে ওঠে,
-” বলুন ”
ফোনের অপর পাশে জায়ান গুমরে হেসে উঠে। সে যেন খুব আনন্দিত হয়েছে। ইনায়া চুপচাপ শুনে জায়ানের উচ্ছ্বসিত কন্ঠ।
-” কি ব্যাপার হরিণী? কন্ঠ শোনার আগেই ধরে ফেললে? মন দিয়ে দাওনি তো আমার প্রতি? ”
ইনায়া নিশ্চুপ থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। জায়ানের ছোট ছোট এই কথাগুলো প্রথমে বেশি পাত্তা না দিলেও, আজকাল তাকে অনেক ভাবায়। প্রথম প্রথম জায়ান কে তার ভিষন ভয় লাগলেও, জায়ানের তার প্রতি শান্ত ব্যবহারে ইনায়া ভয়টা ভুলেছে। যেটা হবার নয়, তা বাড়তে না দেওয়াই ভালো। অবশেষে মুখ খুলে ইনায়া। শান্ত মিষ্টি স্বরে বলে ওঠে,
-” মন কি এমনিই? সহজেই কাওকে বের করে আরেক জনকে ধরা যায়? আমার মনের উপর জোর আছে। এটা কখনো সম্ভব নয়। ”
-” হলে দোষ কি হরিণী? একজনের যাতনা নিয়ে সারা জীবন বাঁচতে পারবে কি? তাকে ভুলতে পাশে কাউকে দরকার। ”
মুহূর্তেই পিনপিন নিরবতা। উচ্ছ্বসিত কন্ঠের স্বর বদলে গেছে গম্ভীর স্বরে। ইনায়া সল্প হেসে মিনমিন করে বলে ওঠে,
-” আমি একা বাঁচতে চাই। নিজেকে নিজের জন্য গড়ে তুলতে চাই। সেখানে অন্য কেউ দখলনামা করুক সেটা আমি চাই না। ”
ফোনের অপর পাশে জায়ান উচ্চ স্বরে হেঁসে উঠলো। ইনায়া অবাক হয়। এইলোকের মুড যখন তখন চেঞ্জ হয়ে যায়। বহু কষ্টে জায়ান নিজের হাসি থামিয়ে বলে উঠে,
-” ডিভোর্স পেপারে এখনো সই করোনি? এতো কেন মনের সংকোচ হরিণী? তা এতই যখন পারবেনা, তাহলে তার মত থাকলে এক হয়ে যাও। ”
-” এতোই সহজ সব? আমার তো মনে হয় না। ”
দুজনেই চুপ হয়ে যায়। কথা নেই আর কারো মুখে। আসলেই কি সব ভুলে এক হওয়া যায়? হয়তো যায় আবার না। সব যেন মন আর বিধাতার খেলা। ভাবে ইনায়া। জায়ান হঠাৎ কোমল স্ফুট কন্ঠে বলে ওঠে,
-” দেখা করবে হরিণী? এমুহূর্তে একটা শেষ সিদ্ধান্ত বড্ড প্রয়োজন। ”
চলবে…………..