যাতনা আমার পর্ব-২৫+২৬

0
1739

#যাতনা_আমার
#সানজিদা_ইসলাম_সূচনা
#পর্ব : ২৫

সেদিনের ফোনকলের পর কেটেছে পাঁচ দিন। সময় চলছে নিজস্ব মতো। সেই ফোন কলের পরের সেই রাতের মুহূর্ত টাকে ইনায়া এখনো মনে ভাবতে থাকে। সেকি তবে ঠিক করেছিলো? নাকি না। ভেবেও কোনো ফুরসত পায়না ইনায়া। তবুও মনে একটা শান্তি বিরাজ করে তার জীবনে কেউ না জড়ালেই ভালো। সে একাই নিজের জন্য লড়তে পারবে। লাগবে না আর কাউ কে। খুকখুক কাশির শব্দে সামনে তাকায় ইনায়া। আর তার ভাবনারা গত হয়। নিধির দিকে তাকিয়ে ইনায়া ম্লান হাসলো। তার কষ্ট হয় মেয়েটাকে এমন দেখে। হাসি খুশি চঞ্চল মেয়েটা একেবারে মিশে গেছে কোনো শান্ত নদীর জ্বলে। কলেজ কেন্টিনে বসা দুজনেই। ইনায়া জোর করে নিধিকে নিয়ে এসেছে। কদিন যাবত ধরে যে ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া নেই তা নিধির মুখ দেখলেই বোঝা যায়। ইনায়া শরবতের গ্লাস টা সড়িয়ে। স্যুপের বাটিটা নিধির দিকে এগিয়ে দিয়ে শান্ত স্বরে বলে,

-” ঠান্ডা হয়ে আসছে খেয়ে নাও। ”

নিধি মলিন হেসে মাথা নাড়ায়। যার অর্থ হলো সে খাবেনা। ইনায়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

-” ভালোই তো ঠান্ডা জ্বর বাঁধিয়েছ। সামনে যে পরিক্ষা তার খবর রাখো? ”

নিধি ক্লান্ত ভঙ্গিতে চেয়ারের গায়ে গা এলিয়ে দেয়। তারপর হতাশ কন্ঠে বলে ওঠে,

-” জীবনের মূল্যবান পরিক্ষাতেই ফেল হয়ে বসে আছি। আর অন্য পরিক্ষা দিয়ে কি করবো আমি? জানো? আমি কখনো ভাবিনি ইশান ভাইয়ের মনে অন্য কেউ আছে। তাকে দেখেও কেউ ধরতে পারেনি। আর ভাইয়া আমার সাথে এমন বাজে ব্যবহার করবে? তাও ধারনার বাইরে ছিলো। ”

-” তোমার ভাগ্য ভালো নয় কি? বিয়ের আগেই মুক্তি হলে। না হলে আমার মতো ঝুলে থাকতে হতো। ”

ইনায়ার কথায় আর কোনো কথা বলে না নিধি। সব বুঝেও মনকে মানাতে পারছে না সে। তার এই সব অনুভূতি তো সব বেহুদা। যার জন্য এসব ব্যক্ত করবে সেই অন্যজনের অনুভুতির জোয়ারে ভাসছে।
ইনায়া শরবতের গ্লাসটায় শেষ চুমুক দিয়ে নিধির দিকে শান্ত নজরে তাকায়। মেয়েটা উদাসীন চোখে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। ইনায়া প্রসঙ্গ বদলাতে হালকা হেসে বলে ওঠে,

-” তা বাঁদর মেয়ে? ঠিকই তো ফাহাদ ভাইকে নাকানিচুবানি খাওয়ালে? তবে যাই বলো কাজটা ঠিক করোনি তুমি। বিষয়টা ওনার প্রফেশনাল দিক দিয়ে আঘাত হেনেছে। ”

চমকে উঠে নিধি। তার জীবনের যাতাকলে পরে ফাহাদের যে বারোটা বাজিয়ে ছিলো, তা ভুলেই গেছিলো। সে এবার সোজা হয়ে বসে চমকিত নয়নে ইনায়ার দিকে তাকায়।

-” তুমি কি করে জানলে? হ্যাঁ? ”

-” ফাহাদ ভাইয়ের থেকে শুনেছি। তিনি খুব চিপায় ছিলো এতোদিন। প্রেস মিটিং করে বিষয়টা হ্যান্ডেল করেছে। ”

ইনায়ার কথায় মুখ বাকায় নিধি।

-” ভালোই হয়েছে। যে লোক মাসে মাসে দুই তিনটা গার্লফ্রেন্ড নিয়ে ডেট করে, তাদের এই ভাবেই সবার কাছে ভাইরাল করা দরকার। ইশ্ আমার দুঃখে আমি বিষাদিনী হয়ে, ওর দুঃখ টা উপভোগ করতে পারলাম না। ”

-” কিন্তু যতোটুকু জানলাম। মেয়েটা ভাইয়ের স্কুল ফ্রেন্ড ছিলো। একটা ঝামেলার জন্য মেয়েটা ভাইয়ার সাথে মিট করেছে। ”

বলেই ইনায়া ফোন থেকে একটা ভিডিও ক্লিপ বের করে নিধির হাতে দেয়। ভিডিওটা মূলত নাভান আর তিলকের প্রেস মিটিং। তিলকের বাবা আসাদ তালুকদার ও মা দিয়া সাহা। তারা সেপারেশনে আছে। আসাদ তালুকদার হিন্দুধর্মাবলম্বী দিয়া সাহা কে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু বারো বছরের সংসার ভেঙে দু’জনেই সেপারেশন নিয়েছিল। তিলক মূলত বাবার সাথেই ছিলো। মায়ের সাথে খুব কম সময় দেখা হতো তার। দিয়া সাহা এখন প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে হসপিটালে আছেন। তিলক বাবার কাছে চিকিৎসার টাকা চাইলে,তিনি সোজা নাকচ করেন। তাই তিলক বাধ্য হয়ে সেদিন ফাহাদকে ডেকেছিলো। তার থেকে টাকা ধার নেওয়ার জন্য। পুরো ঘটনা শুনে নিধি ‘থ’ হয়ে যায়। সেদিন তিলকের ফাহাদের সাথে আচরণ দেখে সে নিশ্চিত ছিলো। তারা রিলেশনে আছে। কিন্তু হলো তো উলটো। সে ফাহাদ কে খারাপ বানাতে গিয়ে আরো ফেমাস করে দিয়েছে। মুখটা অন্ধকার করে ইনায়া কে ফোন ফেরত দেয় নিধি। তারপর কিছুটা ভয় নিয়ে বলে,

-” এখন কি হবে বলতো ভাবি? মেয়র তো আমাকে চিনে ফেলেছে। এবার নির্ঘাত আমাকে জেলে ঢুকাবে। ”

ইনায়া হাসলো। নিধির চিন্তিত মুখের দিকে তাকিয়ে শব্দ করে হেঁসে বলে ওঠে,

-” চিন্তা করোনা। ভাইয়ার সামনে পরলে একটু করে বকা ঠিক দিবেন। কিন্তু বেশি কিছু করবেনা। ”

নিধি মুখ মলিন করে মনেমনে পন করে। সে আর মেয়র ফাহাদ করিমের সামনে ভুলেও পরবে না। ইনায়া এবার তড়িঘড়ি করে বলে ওঠে,

-” আমার টিউশনে যেতে হবে। কালও যেতে পারিনি। তুমি বাড়ি চলে যাও। ”

নিধি এবার একটু ভেবে হাই তুলে বলে ওঠে,

-” আমার ফ্রেন্ড আশার বার্থডে ছিলো কাল। আমি অ্যাটেন্ড করতে পারিনি। আজ যাবার আগে ওর বাসা হয়ে যাবো। গিফট এনেছিলাম একটা। দেখি এখানে সেখানে গিয়ে মনটা শান্ত করতে পারি নাকি? বাড়িতে ফিরলেই ইশান আর তিথির বিয়ে। এইসব শুনতে আমার আর ভালো লাগেনা। ”

আশা নিধির মুটামুটি ভালো বন্ধু। তারা এক সাথে ইন্টার শেষ করেছে। ইনায়া কিছুক্ষন ভেবে বলে ওঠে,

-” আজ তো গাড়িও আনলে না? ”

-” সমস্যা নেই আমি ঠিক চলে যাবো। ”

ইনায়া আর দ্বিমত প্রকাশ করেনা। দুজনেই কলেজ থেকে বেড়িয়ে যার যার রাস্তায় হাঁটতে থাকে।

,

,

তিথি আজ বাড়িতে এসেছে তিনদিন হবে। আগামীকাল ইশানদের বাড়ি থেকে মানুষ আসবে ঘরোয়া ভাবে আংটি পড়াতে। সব কিছু ভাবতেই ভিষণ খুশি লাগছে তিথির। ক’জন ভাগ্যবতী পারে? নিজের মানুষকে আপন করতে? বাড়িতে এসে প্রথম জায়ান আর ফাহাদের সাথে তিথি সমস্ত কথা শেয়ার করে। দু’ভাই মিলে মিজানুল করিম আর মিনারা বেগম কে রাজি করায়। বিকালের দিকে তিথি ফাহাদ আর মিনারা বেগমের সাথে টিভি দেখায় ব্যস্ত ছিলো। ফাহাদ আজ বাড়ি থেকে বেরোয় নি। যেখানে, তার বা হাত জায়ান আছে। সেখানে কিসের টেনশন? তখন মিজানুল করিম তার পাশে এসে বসে। অতঃপর মিনারা বেগমের দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বলে ওঠে,

-” আমার জন্য আদা চা আনো। মাথাটা কেমন যেনো ধরে আছে। ”

তিথি পাশের কেটলি থেকে আদা চা ঢেলে মিজানুল করিমের দিকে এগিয়ে দেয়।

-” নাও আদা চা। আজ আমি চা বানিয়েছি। হালকা ঠান্ডা লেগেছে। ”

-” বলিস কি? কাল অনুষ্ঠান, আজকেই অসুস্থ হয়ে পড়লি? তাড়াতাড়ি ডাক্তারের পরামর্শে ঔষধ খা। ”

মিজানুল করিম অস্থির হয়ে বললেন। তিথি বাবার কথায় পাত্তা দেয়না। সামান্য সর্দি, কেটে যাবে। মিনারা বেগম চিন্তিত মুখে মিজানুল করিমের দিকে পাকোড়ার বাটিটা এগিয়ে দেয়। ফাহাদ সেটা লক্ষ্য করে শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করে,

-” কি ব্যাপার মা? কাল থেকেই তুমি কি কোনো কারনে আপসেট? ”

সবার চোখ মিনারা বেগমের দিকে পরে। তিনি মলিন মুখে বলে ওঠে,

-” ভাবছি, মির্জাদের সাথে সম্পর্ক করা কি ভালো হবে? ”

মিনারার কথায় অবাক হয় সবাই। তিথি একটু ভয়ে থাকে। তার মা প্রথম থেকেই কেমন জানি বিয়ের ব্যাপারে নাখোশ। সে কিছু বলতে যাবে, তার আগেই ফাহাদ তাকে ইশারায় চুপ করায়।

-” তুমি কি নাভানের জন্য এমনটা ভাবছো? শোনো মা। নাভান এমনিতে ভালো ছেলে। মির্জা বাড়ির সবাই খুব ভালো। শুধু ইনায়ার বিষয়টা কে কেন্দ্র করে তাদের কে তুমি জার্জ করতে পারো না। ”

মিনারা বেগম চুপ হয়ে যান। মিজানুল করিম এবার গর্জে উঠে বলে উঠেন,

-” ইশানও খুব ভালো ছেলে। তরুন বিজনেস ম্যান। আমার মেয়ের জামাই তো এমনই হওয়া চাই। অন্তত এবার নিজের মতো কাউকে পাবো। সবাইকে বলতে পারবো আমার জামাই আমার মতো তুখোড় বিজনেস ম্যান। ছেলে গুলো তো এর যোগ্যও না। এই প্রথম বার আমার মেয়ে কোনো ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ”

নিজের উপর কথা আসায় ক্ষিপ্ত হয় ফাহাদ। তার বাবা তাদেরকে খোঁচা ছাড়া কোনো কথাই বলেনা।
তিথি এবার মিনারা বেগমের দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বলে,

-” ইশানের বিয়ে নিধির সাথে ঠিক করছিলো তার পরিবারের সবাই। কিন্তু আমার কথা বলাতে তারা সবাই রাজি হয়েছে মা। আর কোনো কনফিউশান না রাখাই ভালো। ”

মিনারা বেগম কিছু না বলে সেখান থেকে চলে যায়। মিজানুল করিমও অর্ধেক চা রেখে স্ত্রীয়ের পিছনে যায়। কথাবার্তা এখনই সব খোলাসা করা দরকার। নিধির ইশানের বিয়ের কথা বলা হয়েছিলো শুনে ফাহাদ চমকে উঠে। তিথিকে বাজখাঁই গলায় জিজ্ঞেস করে,

-” মাথা ঠিক আছে? নিধির আর ইশানের বিয়ে ঠিক করা হয়েছিলো? নিধি রাজি ছিলো বিয়েতে? ”

তিথি মাথা ঝাকিয়ে সায় জানায়। ফাহাদের মুখ রক্তিম হয়। আজ যদি তিথির সাথে ইশানের সম্পর্ক না থাকতো, তাহলে কি হতো? ফাহাদের ভাবনার মাঝেই জায়ান বাড়িতে ঢুকে। মুখ তার গম্ভীর। ফাহাদের পাশে বসে ঘন স্বরে বলে ওঠে,

-” এনগেজমেন্টের জন্য ছোটখাটো করে স্টেজ করবো বাইরে। হোক না দু বাড়ির লোক। মানুষ কম হলেও আয়োজনের ত্রুটি রাখা যাবেনা। ”

জায়ানের কথার সাথে মিল দেয় ফাহাদ ও। সে তিথির দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,

-” তোর ফ্রেন্ড’দেরও ডাকিস কিন্তু। আর ইনায়াকে বল আজকেই চলে আসতে। ”

তিথি এবার দুই ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রয়েসয়ে বসে। তারপর মলিন কন্ঠে বলে ওঠে,

-” আমি ওকে আমার সাথেই আসতে বলেছিলাম। ও সাফ সাফ জানিয়েছে আসবেনা। এমনকি কালকেও না। ”

-” কেন আসবেনা? ওকে জোর করবি আসার জন্য। নাহলে খারাপ হবে। ”

বাজখাঁই গলায় জিজ্ঞেস করে ফাহাদ। তিথি কোনো উত্তর দেয় না। জায়ান হালকা বিরক্ত হয়ে বলে ওঠে,

-” কি দরকার, অযথা ওকে তেল মারার? যে যেমন থাকতে চায় তাকে তেমনি রাখতে দেওয়া উচিত। ”

ফাহাদ আর তিথি ভুত দেখার মতো জায়ানের পানে তাকায়। অতঃপর বিস্ময় নিয়ে ফাহাদ ব’লে,

-” তুই বলছিস এই কথা? ঝগড়া করেছিস নাকি দু’জনে? ”

-” ওর সাথে আমার কি? যে ঝগড়া করবো? আমার মতো গুন্ডা বদমাশের ওর সাথে না জরানোয় অনেক ভালো। ”

কথাটা বলে জায়ান লম্বা লম্বা কদম ফেলে উপরে চলে যায়। ফাহাদ আর তিথি আশ্চর্য হয়ে একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকে। জায়ানের এমন কথা তাদেরকে ভাবাচ্ছে প্রচুর। জায়ান রুমে এসে বাঁকা হাসে। তারপর মুচকি হেসে বিরবির করে বলে,

-” তুমি নামক ঘুড়ি টা কে উড়িয়ে দিলাম আকাশে। চিন্তা করোনা, তোমার শেকড় নামক লাটাই থাকবে আমার হাতে ততক্ষণ। যতোক্ষণ না সুতো কেটে উড়ে না যাও তুমি। ”

,

,

শুদ্ধ আর সচ্ছ কে পড়িয়ে ফেরার জন্য অটো গাড়িতে উঠে বসে ইনায়া। মোবাইল হাতে নিতেই দেখতে পায় আনোন নাম্বার থেকে দশটা কল তার ফোনে। ইনায়া অবাক হয় নাম্বার টা তার জানা নেই। সাথে সোহানা মির্জার ও কল পায় সে। ফোন সাইলেন্ট থাকা বিধায় কোনো খবর পায়নি সে। ইনায়া ভাবে হোস্টেলে ফিরে ফোন দেওয়া যাবে। তাই ইনায়া অপেক্ষা করে ফেরার। মোরে আসতেই অটোর ভাড়া মিটিয়ে দেয় ইনায়া। তারপর ধির সুস্থে হাটতে থাকে। হোস্টেলের সামনে আসতেই চমকে উঠে ইনায়া। সামনে দাঁড়ানো নাভান আর সোহানা মির্জা। ইনায়াকে দেখতেই সোহানা মির্জা দৌড়ে তার কাছে আসেন। চিন্তিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন,

-” কই ছিলি? ফোন ধরিসনি কেন? নিধি কোথায়? ”

ইনায়া চমকে যায়। নিধি কোথায় মানে? নাভানের মুখে তাকিয়েও তাকে প্রচন্ড বিচলিত দেখায়। ইনায়া ধীরেসুস্থে জবাব দেয়,

-” টিউশনে ছিলাম, তাই ফোন সাইলেন্ট ছিলো। নিধি কি এখনো বাড়ি যায়নি? ”

সোহানা মির্জা এবার যেন ভেঙে পড়লেন। তিনি শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করে,

-” নিধি কলেজ থেকে কখন বেড়িয়েছিলো। ”

ইনায়া নিধির সাথে সকল কথা আশার বাড়িতে যাওয়ার কথা সবই বলে। প্রায় সন্ধে ঘনিয়ে আসছে এতোক্ষণে তো নিধির বাড়িতে চলে যাওয়ার কথা। ভাবছে ইনায়া। নাভান এবার ধির পায়ে তাদের সামনে আসে সোহানা মির্জার দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলে,

-” হয়তো নিধি ফ্রেন্ডের বাড়িতে আছে। তুমি বাড়ি যাও মা। আমি গিয়ে দেখছি। ”

বিচলিত মন যেন শান্ত হয় সোহানার। মেয়েটা কোনোদিন এতো দেরি করে বাড়ি ফিরেনা। তাই সে এমন চিন্তায় পড়ে ছিলো। সোহানা গাড়িতে উঠার আগে ইনায়া কে বলে আশার বাড়ির এড্রেস দিতে। ইনায়া সায় জানায়। গাড়ি চলে যেতেই নাভান ইনায়ার পানে তাকায়। ইনায়া ফোন হাতে অন্য কারো সাথে কথা বলছে। লাল চুড়িদার পরনে ইনায়া, কোমড় পর্যন্ত লম্বা চুল গুলো বাঁধন হারা। নাভানের মস্তিষ্ক তখন একটা কথাই বলে। সামনে দাঁড়ানো মেয়েটা তার বউ। ইনায়া কথা শেষ কে নাভানের দিকে ফিরে। কালো শার্ট পরহিত নাভানের ফর্সা তক উজ্জ্বল মান। সন্ধের আধারেও তা ঝলকাচ্ছে। ইনায়া ধির পায়ে এগিয়ে স্ফুট কন্ঠে বলে উঠে,

-” চলুন। ঠিকানা পেয়েছি। ”

গাড়িতে উঠে বসে দুজনেই। কেউ কোনো কথা আর বলে না। অন্য একজনের থেকে এড্রেস জোগাড় করেছে ইনায়া। সেই ডিরেকশন অনুযায়ী গাড়ি চালাচ্ছে নাভান। চোখেমুখে চিন্তার আভাস। চারদিকে আধার বাড়ছে। নিধির নাম্বার টাও বন্ধ। অজানা আশংকায় দুজনের মন আনচান করে উঠে। শুধু মনেমনে দোয়া করে নিধি যেন সুস্থ থাকে।
দীর্ঘ চল্লিশ মিনিটের রাস্তা অতিক্রম করে আশাদের বাড়িতে এলেএ নিরাশ হয় তারা। আশা জানায় নিধি তাদের বাড়ি থেকে বিকালের পরপরই চলে গেছে। সব শুনে মাথায় বাজ যেন পরে নাভান আর ইনায়ার। দুজনে আশাদের বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গাড়ির কাছে আসে।

-” মনে করো ইনায়া নিধির আর কোনো ফ্রেন্ড আছে? যেখানে ও যেত পারে। ”

নাভানের কথায় ইনায়া না সূচক মাথা নাড়ায়। নাভান যেন এবার ভিতর থেকে ভেঙে পরেছে। রাতও বাড়ছে। নাভান ফোন বের করে নাহিদ মির্জা কে কল দেয়।

-” কিরে নিধির কোনো খোঁজ পেলি? ”

ফোন রিসিভ করে অপর পাশ থেকে বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেস করে নাহিদ মির্জা। নাভান তার কথার প্রেক্ষিতে শান্ত স্বরে বলে,

-” এখান থেকে নাকি আগেই বেড়িয়ে গেছে। তুমি আর চাচু পুলিশ স্টেশনে যাও। আমি আসছি। ”

নাহিদ মির্জা কে আর কিছু না বলে ফট করে ফোন কেটে দেয় নাভান। বাড়িটা আজ নিস্তব্ধ হয়ে আছে। একটু আগেও ইশানের এনগেজমেন্ট উপলক্ষে কতো শপিং করে এনেছে নিপা আর ইশান। হালকা খুশির আমেজ পরিবেশটা মুহূর্তেই অশান্ত হয়ে গেছে শক্ত চরিত্রের সোহানা আজকে ভেঙে পরেছে অনেকটা। মেয়ের চিন্তায় তার মাথা ধরে আসছে। নাহিদ মির্জার চোখের দিকে তাকিয়ে তিনি পুরো ঘটনা বুঝতে পারলেন। নওয়াজ মির্জা নাহিদ মির্জা কে নিয়ে ছুটলেন পুলিশ স্টেশনের উদ্দেশ্যে। সোহানা ক্লান্ত ভঙ্গিতে নিজের রুমে চলে যায়। আয়েশা মির্জা হু হতাশ করতে করতে বলে উঠে,

-” মেয়েটা তো কোনো দিন এমন করে নাই। কি জানি কি হইলো? কোনো বিপদ আপদ যেন না হয়। ”

আয়েশা মির্জার সাথে বসে আছে ইশান আর নিপা। নিপাও শাশুড়ীর সাথে বিলাপ করতে থাকে। ইশান এসব দেখে বিরক্ত হয়ে বলে ওঠে,

-” কি শুরু করলে তোমরা? কিচ্ছু হয়নি ওর। সব নাটক। কি করলে আমার আর তিথির অনুষ্ঠান খারাপ হবে, তার প্লানিং করছে এই মেয়ে। ”

ইশানের কথায় হতবাক দু’জনেই। এই ছেলের মাথা ঠিক আছে তো? নিপা খেঁকিয়ে উঠে ইমানের প্রতি।

-” এই ছেলে? কি সব উলটা পালটা বিক্ষোভ করছিস? ও কেনো তোদের দিন খারাপ করার জন্য এমন করবে? ”

আয়েশা মির্জা এবার ইশানের দিকে রক্তিম চোখে তাকিয়ে বলে,

-” ওই স্টাইলিশ মেয়ে এখনি মাথা খেয়ে নিয়েছে তাইতো? বুঝলে নিপা এই বাড়িতে আর থাকা যাবে না। কার বউ কখন জানি ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়। ”

ইশান শান্ত চোখে দাদির দিকে তাকায়। তারপর গম্ভীর মুখে বলে ওঠে,

-” যাকে জানো না তাকে নিয়ে বাজে কথা বলো না তো গিন্নী। ”

-” তুই তো নিধিকে জানিস। তাকে নিয়ে তুই উলটা পালটা কথা বললে, আমরা তোর হানি কে নিয়ে বলতে পারবোনা কেন? ”

ইশান মুখ আগের মতোই গম্ভীর স্বরে জবাব দেয়।

-” বলার কারণ তো আছে, নাকি? যেই মেয়ে গাড়ি ড্রাইভার ছারা চলা ফেরা করে না, তার আজকে হঠাৎ একা একা বের হওয়ার কারণ কি? আর গুনে গুনে আমার অনুষ্ঠানের সময়? তুমি যাই বলো, ওর কিচ্ছু হয়নি। বাড়িতে আসলেই বুঝতে পারবে। ”

ইশানের সাথে তারা আর কেউ তর্কে জড়ায় না। শুধু মনে মনে দোয়া করে নিধি যেন ফিরে আসে।

চলবে..……………

#যাতনা_আমার
#সানজিদা_ইসলাম_সূচনা
#পর্ব : ২৬

সেদিন নিধিকে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিলো ভোর রাতের দিকে। দিকশূন্য হাড়িয়ে পুলিশের শরণাপন্ন হয়েছিলো মির্জা বাড়ির লোকেরা। নাভান ইশান সবাই পুলিশের সাথে মিলে নিধির নাম্বার ট্রেক করে তাকে খুজে পেয়েছিলো শহর থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে একটা পরিত্যক্ত বাড়িতে। গ্যাং রেপ হয়েছে নিধি। একেবারে বিধ্বস্ত অসংখ্য কামড়ের দাগ সহ মুমূর্ষু অবস্থায় অর্ধ উলঙ্গ ছিলো নিধি। সেদিন ইশান আর নাভানের সাথে থাকা ইনায়া, নিজের গায়ের ওড়না দিয়ে ঢেকে দিয়েছিলো নিধির পুরো শরীর। আজ পাঁচ দিন হয়েছে সেই ঘটনার। নিধি এখনো হসপিটালে ভর্তি রয়েছে। পুরো মির্জা বাড়ি যেন পাতালপুরীতে ডুবে গেছে। একদম নিস্তব্ধ হয়ে গেছে সব। মিষ্টি একটা মেয়ের সাথে এমন কেন হলো? উত্তর জানা নেই কারোই। আয়েশা মির্জা ক্ষণে ক্ষণে আওয়াজ ভেঙে কাঁদছেন। সোহানা আর নাহিদ মির্জা নিশ্চল। পাথর বনে গেছে দু’জনেই। তাদের মনে শুধু একটাই চিন্তা। তাদের সামনের পথ কঠিন হবে। মেয়ের পাশে থেকে এই কটু সমাজ থেকে তাকে বাঁচাতে হবে। তার নিজের মধ্যে বাঁচার প্রেরণা জোগাতে হবে। না হলে এই দৃষ্টি কটু সমাজ তাকে বাঁচতে দেবে না। হসপিটালের দ্বিতীয় তালার শেষের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ইশান আর নাভান। শেষদিকে বিশাল বড়ো বারান্দা। রেলিঙের উপর হাত দিয়ে নিচে রাস্তায় তাকিয়ে আছে নাভান। তাদের দুজনের মন প্রচুর থমথমে। আসন্ন পরিস্থিতি যে অনেক খারাপ হতে চলেছে তাদের পরিবারের জন্যে। হঠাৎ সেখানে উপস্থিত হয় ফাহাদ আর জায়ান। দুজনের মুখ অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে আছে। নাভান একবার পিছুফিরে তাদেরকে দেখে। অতঃপর আবার চোখ যায় সামনে রাস্তায়। জায়ান ইশানের হাতে ধরা একটা ফাইল বিনা বাক্যে নিয়ে দেখতে থাকে। ফাহাদ নিশ্চুপ হয়ে আছে। নিরবতা ভেঙে ইশান বলতে থাকে।

-” মেডিকেল রিপোর্ট বলছে ওরা সাতজন ছিলো। ”

এইটুকু শুনেই ফাহাদের চোখ ভিষন লাল হয়ে যায়। ইশানেরও কন্ঠ রুখে যায়। ভেতরটা কেঁপে উঠে তার। জায়ান ইশানের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।

-” সাথে অনেক ড্রাগস পুস করা হয়েছে নিধিকে। এরজন্য দুইদিন অচেতন ছিলো। সাথে অনেক পাশবিক নির্যাতনের শিকারও হয়েছে। ”

ফাহাদ গম্ভীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,

-” জানতে পারলে কিছু ওর থেকে? ”

-” জ্ঞান ফিরার পর থেকে কান্নাকাটি করছে। কারো কোনো কথাই শুনছেনা। ডাক্তার নিষেধ করেছে, আপাতত সেসব বিষয় নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস না করতে। আসলে, আমি ভেবেছি নিধি ইচ্ছে করে হয়তো এমন করছে। কারণ? ওর মধ্যে বয়সের থেকেও ম্যাচুরিটি কম। কখন কি করে চলে নিজেই বুঝে না। সত্যিটা দেখার পর আমার সত্যিই ভালো লাগছে না। অসহ্য লাগছে সব কিছু। ”

পুরো করিডরে চারজন প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষের দীর্ঘশ্বাস ছেয়ে গেলো। নাভান এবার জায়গা ত্যাগ করে ফাহাদের কাছে আসে।

-” আমাকে জানোয়ার গুলোকে খুজতে হেল্প কর প্লিজ। ওই পিশাচ গুলো কে যতক্ষণ না মারতে পারবো, আমার শান্তি নেই। আমি এখনো ভাবতে পারছি না আমার মিষ্টি বোনটার সাথে এমনটা হয়ে গেছে। ”

রক্তচক্ষু নিয়ে নাভান কথা বললো। ফাহাদ আশ্বাস দেয় তাকে। নাভান এবার ডাক্তারের সাথে কথা বলতে তার চেম্বারে যায়। ইশানও তার পিছু নেয়। ফাহাদ এবার জায়ানের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর মুখে জিজ্ঞেস করে,

-” আস্তানাটা কার খোঁজ পেলি? কাদের সেখানে আসা যাওয়া? ”

জায়ান এবার চুল গুলো হাত দিয়ে পিছনে ঠেলে শান্ত স্বরে জবাব দেয়,

-” তোর কি মনে হয়? এতো বড়ো ক্রাইম করে ওরা এখন ডেরার দিকে ফিরবে? হয়তো খুব কম সময় তারা সেখানে যেতো। এবার নিশ্চিন্তে ওরা এই ডেরা বাদ দিয়ে দিবে। এ কয়দিনে লোক লাগিয়েও কোনো খবর পেলাম না। কে বা কারা সেখানে যাতায়াত করে। এমনকি এখানে আগেও এমন হয়েছে বলে শুনিনি। ওরা রেপ করে মেরে ফেলেনি। যেখানে নিধির ফোন সারা বিকাল বন্ধ ছিলো। সেখানে, ওরা যাবার আগে ফোনটা অন করে রেখে গেছে। স্ট্রেঞ্জ? আমার কেন যানি মনে হচ্ছে এটা কোনো প্ল্যান করে করা হয়েছে। ”

ফাহাদ ভ্রু কুঁচকায়। অতঃপর চিন্তিত মুখ করে বলে ওঠে,

-” মির্জাদের সাথে কাদের শত্রুতা থাকতে পারে? মাথায় ঢুকছে না। ”

হঠাৎ করে কেবিন থেকে নিধির চিৎকার শুনে দুই ভাইয়ের ভাবনার গত হয়। ভেসে আসছে কেউ ক্ষনে ক্ষনে শান্ত স্বরে নিধিকে বুঝিয়ে যাওয়ায় প্রয়াস চালাচ্ছে। ফাহাদ আর জায়ান দুজনেই কেবিনে ঢুকলো। কেবিনে ঢুকেই নিধিকে দেখে ফাহাদের বুকটা মুচড়ে উঠলো। বিধ্বস্ত মুখ নিধির। ফর্সা ত্বক গলায়, গালে কালসিটে কামড়ের দাগগুলি জ্বল জ্বল করছে। ভেতরে সিংহের মতো গর্জে উঠে ফাহাদ। জানোয়ার গুলো এই সুন্দর মুখটাকেও বাদ রাখেনি। জায়ান আড়চোখে খেয়াল করে নিধির পাশে বসা ইনায়া কে। যে অস্থির হয়ে নিধিকে সামলাতে ব্যস্ত। নিধি ফাহাদ আর জায়ানের দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে শুয়ে পরে ইনায়ার কোলে মুখ গুঁজে শান্ত হয়ে যায়। ইনায়া তাদের দিকে তাকাতেই ফাহাদ তাকে ইশারা করে সেখান থেকে উঠে যেতে। ইনায়া করলোও তাই। নিধি এবার বালিশ আঁকড়ে শুয়ে রইলো। ইনায়া মাথায় কাপড় টেনে রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। ফাহাদ এবার আলতো হেটে নিধির পাশের চেয়ারটায় বসে। জায়ানও বিনা বাক্যে রুমের বাইরে চলে যায়। ফাহাদ আলতো স্বরে দুইবার ডেকে উঠে নিধিকে।
কোনো উত্তর করে না নিধি। আলতো হাতে নিধির হাত স্পর্শ করে ফাহাদ। নিধি কেঁপে ওঠে মুখ তুলে সামনে তাকায়। কাছ থেকে নিধির মুখটা দেখে রাগ আরো বেড়ে যায় ফাহাদের। তবুও শান্ত গলায় বললো,

-” জানি যেটা হয়েছে খারাপ হয়েছে। তবুও বলছি নিজেকে মানাও। মেনে নাও। নিজেকে শক্ত করে নাও প্লিজ। কি থেকে কি হলো, আমাকে না বললে কিছুই করতে পারবোনা। তোমার স্টেটমেন্ট প্রচুর দরকার। ”

-” আমার সাথে যেটা হয়েছে, তা কি করে মেনে নেবো মেয়র সাহেব? আমার তো নিজের শরীরের প্রতি ঘিন্না লাগছে। মন চায়ছে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেই। ”

বলেই ডুকরে কেঁদে উঠে নিধি। ফাহাদের কলিজাটা ছিন্ন হয়ে যায় যেন। সবকিছু ভুলে নিধিকে এক ঝটকায় তুলে বুকের মধ্যে জড়িয়ে নেয় ফাহাদ। আদুরে বিড়ালের মতো ফাহাদের সাথে মিশে যায় নিধি। নিধির ক্ষত গুলো চোখে পরতেই ফাহাদের মাথার শীড়া গুলো দপ করে জ্বলে উঠে।

-” প্রমিজ করছি নিধি। একটা কেও ছাড় দিবো না। একটা কেও নাহহ। ”

কান্নারা বাঁধ ভেঙে আসে। ফাহাদের বুকে মুখ মিশিয়ে কান্না মেশানো কন্ঠে বারবার একই কথা আওড়াতে থাকে।

-” আমি অপবিত্র হয়ে গেছি ফাহাদ। অনেকগুলো অপবিত্র স্পর্শ আমার গায়ে লেগে আছে। যে গুলো আমি চাইলেও ভুলতে পারবোনা। আমি নষ্ট। ”

ফাহাদ আরো জোরে জড়িয়ে ধরে থাকে নিধিকে। পেশিবহুল হাতে রগ গুলো ফুলে ফেঁপে উঠছে যেন। কিন্তু সে নিশ্চল, অবিচল। এখন সে চাইলেই কিছু করতে পারছে না। সময় লাগবে প্রচুর।

খালি করিডোরের দুই পাশের দুই দেয়াল ঠেসে দাড়িয়ে আছে ইনায়া আর জায়ান। বলা বাহুল্য, এতোক্ষণ পর্যন্ত জায়ান নিজ থেকে ইনায়াকে কোনো প্রশ্ন করেনি। একেবারে শান্ত প্রকৃতি যেন। ইনায়ার একটু অবাক লাগলো এই ছেলের তো চুপ থাকার কথা না? পরক্ষণেই আবার ভেবে নেয় সেই রাতের কথা। যাক, এই যাত্রায় হয়তো জায়ান বুঝেছে? ইনায়া ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। জায়ান চোরা চোখে ইনায়াকে লক্ষ্য করছে। মুখটা খুব মলিন হয়ে গেছে। নিধির সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনায় তার উপর প্রচুর প্রভাব ফেলেছে। জায়ান দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আজ যদি ইনায়া তার জায়গায় থাকতো? কথা ভাবতেই ভয় পেয়ে উঠে জায়ান। এই মেয়ের একা একা চলাফেরা, হলেও হতে পারতো। তবুও তো একবার বেঁচে গেছিলো। তারপরও ইনায়ার শিক্ষা হয়নি। সেই দিন শেষে টিউশনি করে সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরা। জায়ানের ভাবনারা গত হয় হঠাৎ ইনায়া কথা বলায়।

-” পুরুষ মানুষ এমন কেন বলেন তো? তাদের কাছে শুধু চাহিদাটাই বড়ো। একটা কোমল মেয়ের মন বোঝার সময় তাদের নেই। শুধু একটা জলজ্যান্ত শরীর পেলেই হলো। ”

ইনায়ার দৃষ্টি বারান্দা পেড়িয়ে মেঘলা আকাশে দিকে। যার মনটাও তার মতন ভিষণ ভারি। উপর পাশের দেয়াল ঘেঁষে জায়ান শান্ত চোখে বিপরীত পাশের ইনায়ার দিকে তাকায়। অন্য দিকে তাকিয়েই এতোক্ষণ কথা বলছিল ইনায়া। জায়ান গম্ভীর ঘন স্বরে বলে,

-” সব পুরুষ শরীর না, মনও খুঁজে বেড়ায়। তেমন, সব মেয়েই পুরুষের ভালোবাসা খুঁজে নিতে পারে না। ”

ইনায়া জায়ানের পানে ফিরে। মুখের ভাব গতি সেই আগের মতোই।

-” তাহলে, এই সমাজে দু’ জাতিই সমান দোষী? ”

-” একজনের দোষ কি করে বলবো বলো? সমাজ টাকে তিন ভাগ করোনা। একটা পুরুষ খারাপ হওয়ার মূল চাবিকাঠি নারী। আবার একটা নারী কলঙ্কিত হয় পুরুষ জাতিই দারা। আর মাঝখানে পরে থাকি আমরা। ”

ইনায়া দৃষ্টি আবার আগের জায়গায় নিবদ্ধ করে। ছলছল হয়ে ওঠে চোখ জোড়া। পৃথিবীটা বড্ড নিষ্ঠুরতম। এখানে শান্তি কই? নেই যেনো কোনো কিছুই। আছে শুধু গোলকধাঁধা। নেই কোনো উত্তর কারো কাছে। কারণ তারা নিজেরাই এই নিষ্ঠুরতম পৃথিবী সৃষ্টি করেছে। শুধু যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলে মানুষ। জায়ান ইনায়ার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ব’লে,

-” তুমি আর আকাশটা যেন এখন একই, গুমোট অশান্ত প্রবল জড়ো হাওয়া। তোমার কাজল কালো চোখ দিয়ে অশ্রু আর তার কালো মেঘ গুলো বৃষ্টি হয়ে নামার পালা। ”

ইনায়া আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো স্থির চোখে। আসলেই, আকাশ টা আজ তার মনের মতোই কালো মেঘে ভিড় করেছে। পরিবেশটাও প্রবল বাতাসের তীব্র বেগ। হঠাৎ করেই ইনায়ার চোখ দিয়ে অশ্রুকনা গুলো ঝরতে লাগলো। তখনই ধরনীর বুকে বৃষ্টি হয়ে নামে, আকাশের কালো মেঘ গুলো। ইনায়া সেখানে তাকিয়ে ম্লান হাসে। আসলেই, আকাশটা আজ তার মতোই।

,

,

,

,

,

সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। কিন্তু আকাশের বুক চিরে বেরুনো কান্নারা আজ থেমে নেই। অঝোরে পরছেই শুধু। জায়ান চলে গেছে অনেক্ক্ষণ আগে। ইনায়া গেইটের দারপ্রান্তে দাড়িয়ে আছে। অপেক্ষা একটা সিএনজি অটোরিকশা পেলেই হবে। গায়ের শুভ্র রাঙা ওড়না টা ভালো করে জড়িয়ে নেয় সে। হঠাৎ সেখানে নাভানের আগমন। ইনায়া একপলক সামনে তাকিয়ে দেখে শুধু, খুব সুদর্শন, তার নাম মাত্র স্বামী কে।

-” তোমাকে ড্রপ করবো ইনায়া? যেতে পারো আমার সাথে। ”

নাভানের এমন কথায় ইনায়া শান্ত চোখে তার দিকে তাকায়। বৃষ্টিটা বাড়ছে আবার। দুজনের গায়ে ছিটাফোঁটা পরে হালকা ভিজিয়ে দিচ্ছে। ইনায়া চুপ থেকে বলে ওঠে,

-” তার দরকার নেই। আমি একাই যেতে পারবো। আপনার কষ্ট করতে হবেনা। ”

নাভান আর কোনো কথা বলতে পারলো না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো ইনায়ার পাশে। কয়েক মুহূর্ত কেটে যাওয়ায় পর হঠাৎ ইনায়া বলল,

-” আপনার সিদ্ধান্ত নেওয়া বিষয়টা সিদ্ধান্তে বাস্তবায়ন করতে যে এতো সময় হবে, তা আমি জানতাম না। ”

নাভান প্রশ্নবিদ্ধ চোখে ইনায়ার দিকে তাকায়। সন্ধ্যার এই বৃষ্টির রাতে। দুজনেই আলতো হাওয়ায় কেঁপে উঠলো। সোডিয়ামের মৃদু আলোয় দুজনের ভেজা মুখ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ইনায়া ঠোঁট নাড়িয়ে আবার বলে ওঠে,

-” আমাদের ডিভোর্সের বিষয়টার কথা বলছিলাম। মনে হয় মামুনি আপনাকে পেপারটা দিয়েছেন। আমি কোনো কন্ডিশন রাখিনি। আপনি ভালো করে পেপার টা পড়ে সিগনেচার করবেন। ”

-” খুব তাড়া তোমার, তাইতো? ”

ঘন স্বরে বলে ওঠে নাভান। ইনায়া ম্লান হাসে। তারপর কঠিন চোখ করে এর উত্তরে বলে,

-” আসলে কি বলেন তো? যেই সম্পর্কে প্রাণ নেই। তাকে শুধু নাম মাত্র বাচিয়ে রাখার মানে কি? আপনার কথাটা শুনে আমার হাসি পাচ্ছে মিস্টার। এই সম্পর্কের পরিস্থিতি আপনিই তৈরি করছিলেন। এর শেষ পরিনতি না হয় আমারা দু’জনে শেষ করবো। ”

নাভানের মুখে এবারও কথা নেই। বড়ো লোকদের যে কথার মাধ্যমে ঘায়েল করতে পারে। সে নাভান শাহরিয়ার মির্জা আজ নিশ্চুপ। একটা ছোট মেয়ের সাথে কথা বলতে গিয়ে সে গুলিয়ে ফেলছে। ইনায়া এবার একটা অটো দার করায়। ঝটপট পায়ে উঠে পরে সে। অতঃপর সামান্য মুখটা বের করে শান্ত গলায় নাভান কে বলে,

-” কলেজের পাশের কফিশপে দেখা করবেন কাল। সম্পর্কের সমঝোতা সেখানেই হোক। ”

নাভান হাসে। ঠোঁট কামড়ে মিষ্টি হেসে বলে ওঠে,

-” খুব গুছিয়ে কথা বলতে পারো তুমি। ”

-” কি করবো বলেন? ক্ষণে ক্ষণে পরিস্থিতি তা শিখিয়ে দিয়েছে। তাহলে, সেই কথাই রইলো। আর ডিভোর্স পেপারটা আনতে ভুল করবেন না। ”

কথা বলে ইনায়া সোজা হয়ে বসে। অটো টা ধিরে সুস্থে চলতে শুরু করে। নাভান চুপচাপ তাকিয়ে রইলো সেখানে। কেমন অসহ্য যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। মনে মনে একটা কথা ভাবতে থাকে। আসলেই কালকে শেষ সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

চলবে…………….

( ভুল ত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন। )