যাতনা আমার পর্ব-৩১

0
1607

#যাতনা_আমার
#সানজিদা_ইসলাম_সূচনা
#পার্ট: ৩১ (ক)

শপিং শেষে একটা পার্কে এসেছে ইশান, তিথি, ইনায়া আর নিধি। খুব শান্ত পরিবেশ, নিরিবিলি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা এই জায়গাটি। দুপুর হওয়ার দারুণ এখানে প্রায় জনমানসের দেখা নেই আপাতত। তিথি কিছু ছবি ক্লিক করে ইনায়ার দিকে ক্যামেরা ধরে। যে এখন ফুচকা স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে। তিথি এবার তার ডানপাশে বসে থাকা নিধির দিকে তাকালো। মলিন মুখে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে সে। তিথি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। নিধিকে অনেক কষ্টে ইশান মানিয়ে নিয়ে এসেছে। শপিং করার পুরোটা সময় নিধি চুপচাপ ছিলো। কোনো কথাই তেমন ভাবে বলেনি। ইশান আর তিথি মিলেই নিধির শপিং কমপ্লিট করেছিলো। এক পর্যায়ে নিধির কিছু অস্বাভাবিক দিক লক্ষ্য করে ইনায়া। পুরুষ মানুষ দেখলেই তিথি কেমন ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছিলো। তাই তারা সবাই শপিং বাদ দিয়ে এখানে এসেছে। বাকিটা পড়ে করে নেবে। তিথি নিধির শুষ্ক মুখটার দিকে তাকিয়ে হাসলো কিছুটা। মেয়েটা চমৎকার, ভাইয়ের বউ হলে মন্দ হবে না। তিথির ভাবনার মাঝেই ইনায়া এসে পাশে বসে। সাথে একটা লোক তিন প্লেট ফুচকা আর সমুচা সিংগারা নিয়ে এসেছে। লোকটা খাবার গুলো রেখে চলে যেই ইনায়া শান্ত গলায় নিধি কে বলে,

-” তোমার প্রিয় ফুচকা নিধি, খেয়ে নাও ঝটপট। ”

-” আমি খাবোনা ভাবি। ”

ইনায়ার কথার জবাবে এতটুকু বলে নিধি আবার সামনে দৃষ্টি দেয়। ইনায়া কিছুটা শাসনের স্বরে বলে উঠে,

-” কোনো কথা শুনছি না। ”

নিধি ঠোঁট উলটে তিথি আর ইনায়ার দিকে তাকায়। তারপর ফুচকার প্লেট তুলে নেয়। ইনায়া তিথি খেতে খেতে নিজেদের মধ্যে কথা শুরু করে দেয়। কিছুসময় পর ইশান এসে তাদের জলদি তাড়া দেয়,

-” এখনো তোমাদের এই স্পেশাল ডিস খাওয়া শেষ হয়নি? জলদি করো। ”

বলেই তিথির পাশে বসে পরে ইশান। পাশ থেকে পানি বোতল তুলে মুখ লাগিয়ে অর্ধেক টা শেষ করে দেয়। তিথি তা দেখে অনেকটা তেতে উঠে।

-” ইয়াক, কি করলে এটা তুমি? মুখ লাগিয়ে খাওয়ার কি দরকার ছিলো? ”

ইশান একটু অদ্ভুত ভাবে তিথির দিকে তাকিয়ে আচমকা হেসে বলে ওঠে,

-” লোকজনের পা দিয়ে গোলানো ময়দার ফুচকা খেতে পারো। আবার অন্য লোকের অদ্ভুত ভাবে মাখিয়ে পরিবেশন ও পছন্দ করো। বাড়িতে কি করে বানিয়ে নিয়ে আসে তা আর নাই বলি। আর আমি সামান্য বোতলে মুখ লাগিয়েছি বলে ইয়াক্ হয়ে গেলো? আশ্চর্য! ”

-” কে বলেছে এই মিথ্যা কথা? ”

-” ইউটিউব ঘেঁটে দেখো গিয়ে। ”

তিথি আর ইশানের কথা লেগে যায় এখোনি। ইনায়া আর নিধি অবাক হয়ে এদের ঝগড়া দেখছে। এরা নাকি বিয়ে করবে? সমান্য বিষয় নিয়ে কথা কাটাকাটি। শেষ মুহূর্তে ইশানের সাথে কথায় না পেরে তিথি ফুচকার প্লেট ইশানের গায়ের উপর ঢেলে গাড়ির দিকে চলে যায়। ইশান হা হয়ে যায় তিথির এহেন কান্ডে। ইনায়া আর আর নিধি একটু পরেই একযোগে হেসে উঠে। ইশান পানি দিয়ে শার্ট ক্লিন করতে করতে বলে ওঠে,

-” জানো ইনায়া, কিছু মেয়েদের এটা জন্মগত স্বভাব যুক্তিতে না পারলে জিনিসপত্র গায়ে ফেলা। ”

ইনায়া আর নিধি হাসি থামিয়ে তিথির কাছে যায়। ইশান বিল দিয়ে একটু পরেই চলে আসে। তিথি এখনও ভিষণ রাগ নিয়ে দাড়িয়ে আছে। ইনায়া হালকা স্বরে জিজ্ঞেস করে,

-” সামন্য কথা নিয়ে এতো ঝগড়া? তোমারা সংসার কি করে করবে? হুম? ”

তিথি নাকমুখ ফুলিয়ে বলে ওঠে,

-” সেটাইতো, ওকে বলে দাও শুধরে যেতে। না হলে তার রুমের একটা জিনিসও আমি আস্ত রাখবো না বলে দিলাম। ”

ইশান তিথির কথাকে অতোটা গুরুত্ব না দিয়ে গম্ভীর গলায় বলে ওঠে,

-” আমি নিধিকে নিয়ে যাচ্ছি। তোমরাও যাও। ”

তিথি মুখ বাকিয়ে নিজের গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে পরে। ইনায়া ও তিথির পাশে বসতে যাবে তখনই সেখানে আরো একটা গাড়ি এসে ব্রেক কষে। তারা সবাই সেদিকে লক্ষ্য করে দেখতে পায় সেটা ফাহাদের গাড়ি। গাড়ি থেকে তখন নেমে আসে ফাহাদ। আজকে তার বেস ভুস একটু অন্যরকম। হোয়াইট ডেমিন প্যান্ট আর স্কাই ব্লু শার্ট ফাহাদের। খুব কম সময় ফাহাদ পাঞ্জাবি বাদে অন্য কিছু গায়ে জড়ায়। তিথি ভাইকে হাসলো একটু। ঝটপট গাড়ি থেকে নেমে ভাইয়ের কাছে এগিয়ে যায় সে।

-” সবকিছু ঠিকঠাক আছে তো ভাইয়া। ”

ফাহাদ সামনে এগোতে এগোতে শান্ত স্বরে বলে উঠে,

-” আপাতত সব ঠিকই আছে। ”

ইশান ফাহাদ কে দেখে দৌড়ে তার কাছে আসে অতঃপর মিনমিন করে বলে ওঠে,

-” আমার কিন্তু ভয় লাগছে ভাইয়া। কালকের ঘটনা বড়মা সবাইকে জানিয়েছে। ইনফেক্ট নিধিও জানে। প্লিজ ভেবে দেখো আরো একবার। ”

ফাহাদ ইশানের কথায় কোনো উত্তর দিলো না। ইনায়া আর নিধি অবাক হয়ে দেখছে এদের কান্ড। ফাহাদ কে দেখে নিধির মুখ টোটালি অন্ধকারে ছেয়ে গেছে। কালকের সব কথা মায়ের মুখে শুনে তার ভিষণ রাগ হয়েছিলো। এই মেয়র কি টাইমপাস করার জন্য আর কোনো মেয়ে খুঁজে পাচ্ছে না নাকি? ফাহাদ নিধির দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে ইশানকে বলে উঠে,

-” চলো এবার যাওয়া যাক। ”

,

,

,

,

,

এখন সময় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। চারদিকে ভেসে আসছে আযানের সুর। পাখিরা ফিরে যাচ্ছে নিজেদের নীড়ে। একটু গুমোট পরিবেশ। রাজকীয় করিম ভিলাও সন্ধায় কৃত্রিম লাল আলোতে জ্বলজ্বল করছে। বাড়িটির বাহিক অপার সৌন্দর্য তুলে না ধরলেই হয়। কারণ, এর ভিতরে বাসকৃত মানুষগুলো এখন হাজার চিন্তায় আর কান্নায় ভেঙ্গে গেছে। বাড়ির বিশাল বড়ো হলরুমে মাথায় আইস ব্যাগ ধরে পায়চারি করছেন মিজানুল করিম। কিছুটা দুরে বসে কান্না করছেন মিনারা বেগম। কান্না টা মূলত ভিষণ রাগে চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। কতো করে বোঝানোর পরও ছেলে এই কাজ করতে পারলো? মিজানুল করিম আইস ব্যাগটা ছুড়ে ফেলে চলতে থাকা টিভির সামনে এসে আবার বসলেন। যেখানে স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমে সংবাদ পাঠিকা সুন্দর করে বলেছেন, ব্রেকিং নিউজ: বিয়ে করেছেন মেয়র ফাহাদ করিম। বিশিষ্ট শিল্পপতি নাহিদ মির্জার মেয়ে নিধি তাসনীম কে নিজের সহধর্মিণী হিসেবে কবুল করেছেন তিনি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, নিজের ফেসবুক পেজে একটা পোস্টের মাধ্যমে এই কথা জানান মেয়র ফাহাদ করিম। শোনা যাচ্ছে কিছুদিন আগে গনধর্ষন করা হয়েছিলো নিধি তাসনীম কে। মিজানুল করিম আর কিছু দেখলেন না। টিভি অফ করে দিয়ে মিনারা বেগমের পাশে বসলেন। এরমধ্যেই সোহানা আর নাহিদ মির্জা বার কয়েকবার ফোন দিয়ে বলছেন, ফাহাদ নিধি কে জোর করে বিয়ে করেছে। মিনারা বেগম এবার রেগে সামনে থাকা ফ্লাওয়ারভাস ছুড়ে মারেন। মিজানুল করিম খেঁকিয়ে উঠলেন প্রায়।

-” এই খবরদার, বাড়ির জিনিসপত্র ভাঙচুর করবেনা একদম। যাও মাথায় পানি ঢেলে ঠান্ডা হও। ছেলের বউ আসবে বরন করতে হবে। ”

-” এমন পরিস্থিতিতে আপনি আমার সাথে মজা করছেন? বাড়ি থেকেই বেড়িয়ে যাবো আমি। ”

তাদের কথার মধ্যেই জায়ান উপর থেকে নিচে নেমে আসে। দুপুরে অফিস থেকে এসে এতোক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলো জায়ান। ঘুম ঘুম চোখে মিনারা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,

-” কি হলো তোমাদের? ঝগড়া করছো কেনো। ”

মিজানুল করিম টিভি অন করে দেয় জায়ানের উদ্দেশ্য। একই নিউজ বারবার দেখানো হচ্ছে। জায়ান কোনো রিয়াকশন না দিয়ে সোফার উপর আরাম করে বসে। মিনারা বেগম হতবাক হয়ে বললেন,

-” কিছুই বলবি না? ”

জায়ান ফুস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলে ওঠে,

-” কি বলবো মা? ভালোবাসে, জোর করে বিয়ে করেছে। এতে আর কি বলার থাকে। তোমরা পারিবারিক ভাবে মেনে নিলেই পারতে। ”

মিজানুল করিম ভ্র কুঁচকালেন। তিনি গম্ভীর গলায় বলে ওঠে,

-” তাই? তা দু’জন দু’জনকে পছন্দ করলে মেনে নিতাম। তোমার ভাইয়ের ভালোবাসা তো এক পাক্ষিক। সবুর করো এই ভেবে,যে এখনো যেনো মির্জা বাড়ির লোকেরা কেস ঠুকে দেয়নি। ”

জায়ান বাবার সাথে আর তর্কে জড়ায় না। মিনারা বেগম রাগে গজগজ করতে করতে বলে,

-” আমি নিধিকে কোনোদিন মেনে নেবো না। কিছুতেই না। ”

-” কেনো মানবে না মা? সমস্যা টা কই। ”

জায়ানের কথায় মিনারা বেগম দ্বিগুণ রাগান্বিত হয়ে উত্তর দেয়,

-” তুমি জানো না জায়ান সমস্যা টা কোথায়? ওই ধর্ষিতা মেয়ে কি করে করিম ভিলার বউ হতে পারে? কিছুতেই না। ”

জায়ান মায়ের প্রতি রুষ্ট হয়ে যায় অনেক। সে বোঝানো সুরে বলে,

-” তোমার কি হলো মা? তুমি তো এমন ছিলেনা। এতো গুড মম তুমি বউ আসার আগেই টিপিক্যাল শাশুড়ী হয়ে গেলে? একবার ভাবো তো নিধির জায়গায় তিথি থাকলে কি হতো? ”

-” বাস্তবতায় মায়া দেখানো যায় না জায়ান। সবশেষে আমারা সামাজিক মানুষ। সমাজে বাস করি আমরা। ”

মিজানুল করিম এবার শান্ত ভাবে বসে মিনারা বেগম কে বোঝাতে শুরু করলেন,

-” মেনে নাওতো মিনা। ছেলেটা চৌত্রিশ বছরে একটা মাত্র বিয়ে করলো। তাও আবার জোর করে। মেয়ে যে সহজে তোমার ছেলের সাথে সংসার করবেনা তা নব্বই ভাগ সত্যি। আমাদের এখন ফাহাদে পক্ষে থাকা দরকার। আর জায়ান তো আছেই তাকে তুমি নিজের মনের মতো বউ এনে দিয়ো। আর মেয়ের তো সামনেই বিয়ে। ”

এসব ভুলানো কথায় দমলেন না মিনারা বেগম। তার উপর আরো ক্ষেপে গিয়ে বললেন, তিথির বিয়েও তিনি আটকে দিবেন। মিজানুল করিম পড়লেন মহা বিপদে। জায়ান কে মিনমিনিয়ে বললেন,

-” নিজের বিয়ের কথা বলে আপাতত সান্তনা দে বাপ। নাহলে আজ ভাই ভাবিকে বাড়িতে ঢুকাতে পারবিনা। ”

জায়ান দীর্ঘশ্বাস ফেলে উপরে চলে যায়। ডার্ক নেভি ভ্লু কালারের একটা শার্ট জড়িয়ে নিচে নেমে আসে সে। অতঃপর মায়ের দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বলে উঠে,

-” তোমার ছেলে আর ছেলের বউকে আনতে যাচ্ছি মা। বরন করে নেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নাও। আর নিজের মনে কে শক্ত করে গড়ে নাও কারণ, আমি কিছুদিন পরে ইনায়া কে বিয়ে করছি। ”

কথাটা বলে জায়ান গাড়ির চাবিটা নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে। বিস্ফোরন ঘটিয়ে যায় করিম ভিলায়। মিনারা বেগম স্তম্ভিত হয়ে যায় কিছুক্ষণের জন্য। জায়ান আবার এটা কি শুনালো? মিনারা বেগমের মাথা প্রায় ঘুরছে। তিনি পিছন ফিরে মিজানুল করিমের দিকে তাকালেন। মিজানুল করিম ইতিমধ্যে আবার আইস ব্যাগ মাথায় চেপে ধরেছেন। ছেলের প্রথম কথায় খুশি হতে গিয়েও যে এতো বড়ো ধাক্কা খাবেন সেটা তার জানা ছিলো। তিনি ভয়ার্ত চোখে মিনারা বেগমের দিকে তাকান। ছেলে তো আগুন নেভানোর বদলে তার উপর এক বস্তা তুস ফেলে গেছে। এবার জাপানের সুনামি চলে এলেও এই আগুন থামবে বলে মনে হচ্ছে না।

চলবে………………….

#যাতনা_আমার
#সানজিদা_ইসলাম_সূচনা
#পর্ব: ৩১ (খ)

বাড়িটা কাঠের বাংলো বাড়ি। শহরের থেকে বেশ কিছুটা দুরেই। সন্ধ্যার পরেই নির্জন হয়ে আছে চারপাশ। বাড়ি টা ফাহাদ কে তার দাদু ছোট বেলায় কিনে দিয়েছিলেন। ফাহাদের জন্য এটা নিরিবিলি প্রাকৃতিক দৃশ্যের সাথে মিলে যাওয়ার বেস্ট একটা জোন।পুড়ো বাড়িটা জুড়েই সাদা বাতি চারপাশ আলোকিত করে রেখেছে। গোল আকৃতির কাঠের বাড়িটির একপাশে বড় লিভিং রুম। সেখানের কাঠের কারুকার্যের সোফা রাখা। লিভিং রুমের বিশালতার মাঝে এখন শুধু সোফা গুলোই ঠিক আছে। বাকিসব ধ্বংস স্তুপে পরিনত হয়ে আছে। আর সেগুলো করছে নিধি। তখন রাস্তা থেকে সবাই ফাহাদের এই বাংলো বাড়িতে এসেছিলো। এখানে কি ঘটবে? তা নিধি আর ইনায়া ছাড়া সবাই অবগত ছিলো। মাঝরাস্তায় ইশানকে অবশ্য নিধি জিজ্ঞেস করে ছিলো। কোথায় যাচ্ছে তারা? ইশানের একটাই ছোট উত্তর ছিলো। তারা ঘুড়তে যাচ্ছে। বাংলোতে এসে কাজি, রেজিস্ট্রার দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিলো নিধি। তার হঠাৎ মনে পড়ে গিয়েছিলো ফাহাদ সোহানা মির্জাকে কি বলেছিলো। দুইয়ে দুইয়ে চার মিলালো ইনায়াও। তাদের ভাবনা সত্য হয় যখন, সত্যিই ফাহাদ বলে, সে নিধিকে এক্ষুনি বিয়ে করবে। দ্বিমত পোষণ করা নিধি অনেক চেষ্টা করেছিলো বিয়ে টা আটকাতে। সাথে ইনায়া ও। তার কাছে সবটাই এখন বাড়াবাড়ি মনে হয়েছিল। সে ফাহাদ কে বোঝাতে চেয়েছিলো, ফাহাদ নিধির জন্য ঠিক হলেও এখন বিয়ের সঠিক সময় নয়। কিন্তু কি আর করার তিথি আর ইশানও ফাহাদের সাথেই ছিলো।
শেষ মুহূর্তে নিধি কবুল বলেছিলো ফাহাদের কথায়। নাভানের একটা ভিডিও দেখায় ফাহাদ নিধি কে। তার কথছিলো, জায়ান নাভান কে আটকে রেখেছে। নিধি যদি কবুল না বলে তাহলে খারাপ হয়ে যাবে।
এযাবৎ ইনায়া ও দমে যায়। রাজনৈতিক নেতাদের আর বিশ্বাস কি? জায়ান গুন্ডা সব করতে পারে। কিন্তু, আসল ফোকাস আসে বিয়ের পর নাভানকে সুস্থ সবল দেখে। নাভানের কাহিনী তাদের প্লেন অনুযায়ী ছিলো। তৎক্ষনাৎ নিধি ভিষন রেগে যায়। অতঃপর এই কান্ড ঘটায় বাংলোতে। অতিরিক্ত ডেসপায়ার হয়ে যাওয়ায় নিধিকে এখন ইঞ্জেক্ট করে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। তিথি সোফায় বসে ফেক নেইল ঠিক করছে। নিধিকে থামাতে গিয়ে তার অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে। ইনায়া তার পাশে চুপচাপ বসে আছে। ইশান নাভান দাঁড়িয়ে কথা বলছে। ইশান ভয়ে ভয়ে নাভান কে বলে,

-” যাই বলো ভাইয়া আমি বাড়িতে যেতে পারবোনা। বড়মা নিশ্চয়ই রণমুর্তি ধারন করে আছে। ”

-” কাজটা ঘটানোর আগে কই ছিলো আপনার ভয়? এটাকি আদেও ঠিক করেছেন আপনারা? ”

নাভান কিছু বলার আগেই দুজন কে জিজ্ঞেস করে ইনায়া। দু’জনেই চুপচাপ হয়ে থাকে। তিথি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইনায়ার উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,

-” তুমি একটু বেশিই টেনশন করছো ইনায়া। সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবে। ”

তিথি রিলাক্স মুডে বাড়ির বাইরে চলে যায়। ইশানও তার পিছু নিল। ফাহাদ আপাতত নিধির কাছে আছে। জলদি বাড়ি যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইনায়া হলরুমে দাঁড়ানো নাভানের দিকে দৃষ্টিপাত করেছে। এ-ই কদিনে চেহারার হাল খুবই করুন হয়েছে নাভানের। চোখের নিচের কালো দাগ ফর্সা মুখটায় জ্বলজ্বল করছে। নাভান শান্ত পায়ে হেঁটে ইনায়ার সম্মুখীন হয়। জিভ দিয়ে নিচের ঠোঁট ভিজিয়ে হালকা হেসে বলে,

-” আই নো ইনায়া তুমি আজকের বিষয়টা স্বাভাবিক ভাবে নিচ্ছো না। কিন্তু ফাহাদ নিধির জন্য পারফেক্ট। কলুষিত এই সমাজে নিধি পারফেক্ট জীবন সঙ্গী ছাড়া চলতে পারবেনা। পদে পদে তার অতীতের সেই দিন তাকে লোকজন মনে করিয়ে দেবে। ”

ইনায়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে। অতঃপর নাভানের প্রায় বিধে যাওয়া চোখের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করে,

-” তা আপনি জানেন না? নিধি ফাহাদ ভাইকে পছন্দ করে না। কি করে এতো কিছুর পর সে স্বাভাবিক হতে পারবে নাভান? একটু সময় দিতেন। জোর করে কিছুই ভালো হয় না। ”

নাভান ম্লান হাসলো। তারপর মিনমিন গলায় বলে ওঠে,

-” আসলেই, জোড় করে কিছুই ভালো হয় না। যেমন তুমি আর আমি। আবার কিছু ক্ষেত্রে হয়। আমি অধম আমার ভালোটা বুঝতে পারিনি। আশা করি নিধি আমার মতো ভুল করবে না। সে মেনে নিবে সবটা। ”

-” বিয়েতে রাজি ছিলেন না আমাকে বলতে পারতেন। আমি পিছু হাটতাম নাভান। কিন্তু বাবা-মা এর রাগ আপনি আমি অবুঝের প্রতি ঝেড়েছেন। তারপর বউ থাকতেও অন্য নাড়ীর সংস্পর্শে ছিলেন আপনি। যা আমাকে খুব পুড়িয়েছে নাভান। যদি বাবা-মা থাকতো, আপনার যাওয়ার পরেরদিনই মির্জা বাড়ি থেকে নিয়ে আসতো। সেখানেই আপনার আর আমার সম্পর্কের ইতি ঘটতো। আর না আপনি নয় মাস পর ফিরে এসে আমার কাছে মাফ চাইতেন। সবটা হয়েছে আমার কপালের জন্য। সেই জন্যই নিজের আত্মসম্মান গুলিয়ে আপনার বাড়িতে থাকতে হয়েছে আমাকে৷ যাইহোক সবশেষে ডিভোর্স তো হয়ে গেছে আমাদের। ”

নাভান নিশ্চুপ হয়ে থাকলো। কথাগুলো চরম সত্য। নাভান ভাবলো আসলেই, সে কানাডায় থাকা দিন গুলোতে একদিনও ইনায়ার কথা মনে করেনি। অদিতির সত্য জানার পরেও না। অদিতি না গেলে সে বাড়ির দিকে আসতো না। ইনফেক্ট, সে এসেছিল ইনায়া কে মুক্ত করতে।

নাভান কিছু বলার আগেই সেখানে আগমন ঘটে জায়ানের। ইনায়া তার দিকেও ক্ষেপা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। জায়ান তা দেখে চমৎকার হাসলো। ইনায়া রেগে গিয়ে জায়ানের সামনে দাঁড়ায়।

-” এইসব কিছু আপনার প্লেন তাই না? আপনিই ফাহাদ ভাইকে উসকিয়েছন। ”

জায়ান মাথায় বাজ পরার মতো রিয়াকশন দিলো। অসহায় মুখ করে বলে ওঠে,

-” ট্রাস্ট মি হরিণী, আমি দুপুর থেকে সন্ধ্যা অবদি ঘুমিয়ে ছিলাম। খবর পেয়ে মাত্রই আসলাম। তুমি আমাকে মিথ্যা দোষারোপ করেছো? ”

-” আপনাদের বিশ্বাস নেই। ”

কথাটা বলে ইনায়া নিধিকে যে রুমে রাখা হয়েছে সেখানে যায়। জায়ান দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইনায়ার যাওয়ায় দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বলে ওঠে,

-” তুমি আমাকে আজোও ঠিকঠাক বুঝতে পারলে না হরিণী? ”

নাভান এতোক্ষণ ইনায়া আর জায়ানের দিকে তাকিয়ে ছিলো। তার মস্তিষ্কে শুধু ইনায়ার কথাই বাজছে। জায়ান ডানপাশে নাভানের দিকে লক্ষ্য করে। তারপর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে অদিতির বিষয়ে জানতে চায়। নাভান জানায় অদিতি এখোনও ভিডিও ফুটেজ দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করছে। জায়ান আর নাভান ও সেই রুমের দিকে অগ্রসর হয়। ইনায়া রুমে ঢুকতেই দেখতে পায় ফাহাদ নিধির শিয়রে বসে আছে। নিধি এখনো ঘুমে। ফাহাদ ইনায়া কে দেখে ম্লান হাসলো। অতঃপর বলতে শুরু করলো,

-” এইছাড়া আমার কাছে আর কোনো রাস্তা ছিলো না ইনায়া। বাবা-মা ও আমার পক্ষে ছিলো না। এদিকে নাভানের বাড়ির লোকজনও বেঁকে বসেছিল। তারপর আবার অদিতি, সেই নিধিকে লোক দিয়ে গ্যাং রেপ করিয়েছে। আবার সেটার ফুটেজ দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করছে নাভান কে। অদিতি আমাদের হাতে ছোয়ার বাইরে। সে যদি একবার ভিডিও লিংক শেয়ার করে দেয়, বুঝতে পারছো কি হবে? নিধি কে পাওয়ার আকাঙ্খা আমার শেষ হয়ে যেতো। তাই এই পদক্ষেপ। ”

সব শুনে ইনায়া বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে। অদিতি কে আর কতো ভাবে ঘৃণা করা যায়? তার সেটা জানা নেই। একটা বাচ্চা মেয়েকে তার আর নাভানের মাঝে এনে সে ভুল করেছে। পরক্ষনেই ইনায়ার মনে হলো এইসবের জন্য নাভান দায়ী। তার ভুলের মাশুল নিধিকে গুনতে হচ্ছে। নাভান কে তার পরিবার অনেক সুযোগ দিয়েছিলো অদিতি কে ছাড়তে। শেষ সুযোগ টা ছিলো ইনায়া। সেটাতেও নাভান ব্যর্থ। কখনো কখনো কিছু ভুলের মাশুল অনেক কষ্টে দিতে হয়। আবারো কিছু ভুল নতুন ভোরের সন্ধান দেখায়। নাভান সে ভোর দেখতে পারেনি। ইনায়া মলিন মুকের নিধির দিকে তাকালো। এই মেয়েটা কেনো এতোকিছু সাফার করবে? ইনায়া ভাবনায় মশুল হতেই সেখানে নাভান জায়ানের আগমন। জায়ান ফাহাদের পাশে এসে দাঁড়াতেই সে বলে ওঠে,

-” কি ব্যাপার? বাড়িতে সবকিছু ঠিকঠাক আছে তো? মাকে বুঝিয়েছিস তো? ”

জায়ানের মনে পরে বাড়ির কথা। সে তো মাকে বুঝাতে গিয়ে আরও আগুন জ্বালিয়ে এসেছে। তার হঠাৎ মিজানুল করিমের জন্য খুব মায়া হলো। না জানি তার বাবা কি সহ্য করছে। জায়ান ফাহাদের দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে বলে ওঠে,

-” সেসব বাদ দে। একটুতো ঝামেলা বাড়বেই। তুমি একটা কাজ করো, নিধি কে এখুনি বাড়িতে নিয়ে চলো। ডোজ শেষ হবার আগেই। মায়ের বরন বাদ। সে জেগে গেলে তোমার বাড়ি যেতে চাইবে কিনা সন্দেহ। ”

ফাহাদ মাথা ঝাকায়। আসলেই জায়ানের বুদ্ধি উত্তম। সে নাভান কে বললো গাড়ি বের করতে। নাভান যেতেই ফাহাদ নিধিকে কোলে তুলে নিলো। তারপর অগ্রসর হয় বাইরে। জায়ান যেতে নিলেই ইনায়া তার সামনে এসে দাড়ায়।

-” আপনি কি করে জানলেন? নিধিকে ঘুমের ঔষধ ইঞ্জেক্ট করা হয়েছে? ”

জায়ান উত্তর দিলো না। ইনায়ার দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগলো। ইনায়া রেগে গিয়ে বলে ওঠে,

-” কারণ টা আমিই বলছি। এইসব প্লেন আপনার করা ছিলো। ”

এবারও কিচ্ছু বললোনা জায়ান। ইনায়া শাসানোর ভঙ্গিতে বলে ওঠে,

-” নিধির জ্ঞান ফিরলে আপনার নামটাই প্রথম বলবো। তারপর, এই বাড়ির জিনিসপত্রের মতো আপনার অবস্থা হবে। ”

জায়ানের হাসি আরো চওড়া হলো। ইনায়া বিরক্ত হয়ে বলে উঠলো,

-” আপনি একটা হিংস্র বাঘ। ”

কথাটা দরজার দিকে এগিয়ে গিয়েও থেমে যায় ইনায়া। আবার পিছু ফিরতে গেলেই জায়ান চওড়া গলায় বলে,

-” ঘাড় ঘুরিয়ে পিছু ফিরো না নিরীহ হরিণী। এই বাঘ কিন্তু নিমিষেই বগল দাবা করে ফেলবে। ”

ইনায়া আর ফিরলো না। রাগ দেখিয়ে হনহন করে বেড়িয়ে গেলো। জায়ান এবার মুচকি হেসে ইনায়ার পথ অনুসরণ করে।
,

চলবে…………..

( ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)