যাতনা আমার পর্ব-৩২

0
1418

#যাতনা_আমার
#সানজিদা_ইসলাম_সূচনা
#পর্ব : ৩২

নিধির গৃহ প্রবেশ ফাহাদের কোলে চড়েই হয়েছিলো ঘুমন্ত অবস্থায়। মিনারা বেগম তখনকার শকেই আছেন। ফাহাদের কোলে নিধি কে দেখে কোনো বিষ্ময় হলেন না মিনারা বেগম। নড়লেন ও না। এক জায়গায় স্থির হয়ে বসে ছিলো। মিজানুল করিম দুএকবার চোরা চেখে তাকিয়েছিলেন মিনারা বেগম এর দিকে। অতঃপর চোখের ইশারায় ছেলেকে উপরের রাস্তা দেখিয়ে দিয়েছিলেন। সকাল সকাল ঘুম ভাঙ্গে নিধির। আড়মোড়া ভেঙে আসেপাশে তাকাতেই হালকা বোঝা চোখ পুরাপুরি খুলে যায় তার। এ কোথায় আছে সে? পুরো মাস্টার বেডরুমে একনজর চোখ বুলিয়ে তার পাশে শোয়া ফাহাদের দিকে তাকায় নিধি। তখনই মনে পরে কালকের ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো। ফাহাদ কি তবে তাকে বাড়িতে নিয়ে এসেছে? নিধি বেড থেকে নেমে ফাহাদের পাশটায় এসে দাঁড়ায়। ফাহাদ উপর হয়ে শান্তি মতো ঘুমাচ্ছে। নিধির সেটা সহ্য হলো না। পাশ থেকে এক জগ পানি ফাহাদের উপর ঢেলে দেয়। হাঠাৎ শরীরে পানি পরায় ঘুম থেকে চমকে উঠে ফাহাদ। ভালো করে চোখ খুলে সামনে তাকাতেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফাহাদ। ঠোঁট উলটে বলে ওঠে,

-” বউ আসতেই ঘুমের তেরোটা বেজে গেলো? থাক ব্যাপার টা মন্দ নয়। তুমি এভাবেই আমার ঘুম ভাঙাবে, কেমন? ”

রাগটা দ্বিগুণ হলো নিধির। কিড়মিড়িয়ে বলে ওঠে,

-” আমাকে এখানে কেনো নিয়ে এসেছেন? ”

-” তুমি বোধহয় ভুলে গেছো। কাল আমরা দুজন দুজনকে তিন কবুল বলে স্বীকার করেছি। তো সেই হিসেবে তুমি এখন থেকে আমার ঘরের ঘরণী হয়ে থাকবে। ”

ফাহাদ সতেজ একটা হাসি দিয়ে এই কথাটা বলে ওঠে। নিধির রাগ যেন তরতর করে বাড়ছে। ফাহাদ চটজলদি বিছানা থেকে উঠে নিধির সামনে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। ফাহাদের শরীরে কাপড় বলতে শুধু মাত্র একটা কালো টাওজার প্যান্ট। সুদর্শন সুবিশাল দেহেতে কিছু পুরোনো কাটা ছেঁড়ার দাগ বহমান। নিধির চোখে সামান্য কিছুক্ষণের জন্য পরে সেটা। তৎক্ষনাৎ সে চোখ সড়িয়ে ফাহাদের দিকে তাকায়। তারপর কাটকাট গলায় বলে ওঠে,

-” মিথ্যা কথা বলেছেন আপনারা সবাই। আমি এক্ষুনি আমার বাড়ি যাবো। যেতেদিন আমাকে। আমার বাড়িতে দিয়ে আসুন।

-” এটাই তো তোমার বাড়ি। বারবার বাবার বাড়িকে নিজের বাড়ি দাবী করছো? সেটা আমার কাছে যুক্তিসঙ্গত মনে হচ্ছে না। ”

ফাহাদ এবার একটু গম্ভীর গলায় বললো কথাটা।
নিধি হালকা তাচ্ছিল্য হেসে বলে উঠে,

-” আপনার কি মনে হয়, আমি আপনার সাথে সংসার করবো? মোটেও না। আমাকে কতোদিন এভাবে আটকে রাখতে পারবেন আপনি? আমি ঠিক চলে যাবো। ”

-” তাহলে আর কি, শিকল বেঁধে তোমাকে এই রুমে বেধে রাখবো। ”

নিধি রেগে গিয়ে ফাহাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কিছু বলতে যাবে, তার আগেই ফাহাদ তাকে দু’হাতে বুকে জড়িয়ে নেয়। নিধি প্রথমে একটু শান্ত থাকলেও মোচড়ামুচড়ি শুরু কে দেয় ফাহাদের থেকে ছোটার জন্য। কিন্তু ফাহাদ আরো টাইট করে ধরে রাখে নিধি কে। ফাহাদের উদোম শরীরে পুরুষালী গন্ধে নিধি সম্মোহনীর ন্যায় বুক থেকে মাথা উঠিয়ে ফাহাদের চোখের দিকে তাকালো।এমন একটা সুযোগের সন্ধানে হয়তো ছিলো ফাহাদ। ঘাড় নামিয়ে মিলিতো করলো দুইজোড়া ওষ্ঠদ্বয়। চমকিত নয়ন জোড়া আরো চমকে গেলো নিধির। হঠাৎ করে তার শরীর কাঁপতে শুরু করে। যে কম্পনের অস্তিত্ব ফাহাদও খুজে নেয়। সে তড়িৎ গতিতে নিধিকে ছেড়ে দেয়। ফাহাদ বুঝলো সে এটা ভুল করে ফেলেছে। নিধিকে নরমাল করতে হালকা হেসে বলে উঠে,

-” সব দোষ তোমার ঘরনি। আদর পাওয়ার জন্য আমার কাছে চলে এসেছো। পরের বার নিজেকে কন্ট্রোল করো। ”

এটা বলে ফাহাদ কোনো রকম নিধির সামনে থেকে কেটে ওয়াশরুমে ঢুকলো। দরজা লাগিয়ে কিছুক্ষণ পরেই শুনতে পেলো রুমে ভাংচুরের আওয়াজ। ফাহাদ সেটাতে মন না দিয়ে ফ্রেশ হয়ে ৩০ মিনিট পরে আসে। যা ভেবেছে তাই। রুমের দফা রফা করে ফেলেছে নিধি। এই মেয়ের রাগ হলে জিনিসপত্রের উপর ঝাল মেটায়? ফাহাদ অসহায় মুখে নিধির দিকে তাকালো। তার এতো সুন্দর ডেকোরেশন করা রুমের এ কি হাল করেছে নিধি? নিধি রাগে ফোঁস ফোঁস করে ফাহাদের দিকে এগিয়ে যায়।

-” আমাকে যেতে না দিলে, আপনার পুরো বাড়িকে রণক্ষেত্র বানিয়ে ফেলবো। ”

ফাহাদ টাওয়াল দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বলে ওঠে,

-” তাই করো, ভেঙে ফেলো সব। জিনিসপত্র গুলো পুরোনো ছিলো বটে। ভাবছি যৌতুক হিসেবে তোমার বাবার থেকে এই পুরো বাড়ির ফার্নিচার নিয়ে আসবো। কি বলো? ”

নিধি উত্তর দিলো না। ফাহাদ সাবধানে পা ফেলে আলমারির ড্রয়ার থেকে একট কাপড়ের ব্যাগ এনে দেয় নিধি কে। নিধি কোনো কথা না বলে সেটা নিয়ে ওয়াশরুম ঢুকে যায়। কারণ গতদুই দিনে এখনো একি কাপড় পরনে তার। ফাহাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোন হাতে তুলে নেয়। রুমটাকে ঠিক করার দরকার।

,

,

,

,

ইনায়া ক্লাস কমপ্লিট না করেই ভার্সিটি থেকে বেড়িয়ে এসেছে। তিথি কারণ জিজ্ঞেস করলে বলে এসেছে, তার ভালো লাগছে না। হোস্টেলেও সে ফিরেনি। রাস্তা দিয়ে একমনে সামনে হেটে যাচ্ছে। মন খারাপ টা অনেক তার। গতকাল শেষরাতের দিকে একটু বৃষ্টি হওয়ার দারুণ পিচঢালা রাস্তা সামান্য ভিজে রয়েছে। এখনো প্রচুর বাতা বইছে চারদিকে। রাস্তার দুই পাশে সারিবদ্ধ ভিজে গাছ গুলো যেন সতেজতা বজায় রেখে চলেছে। মাঝেমধ্যে দু এক ফোটা পানি ইনায়ার ওড়না ঢাকা মাথায় পড়ছে। এমন দৃশ্যে মন ভালো হলো না ইনায়ার। বাস স্টপ থেকে বাসে উঠে পরে সে। গন্তব্য তার পুরান ঢাকার দিকে। বাবা-মার মৃত্যুর আজ এক বছর পূর্ন হয়েছে। আজ যেনো একটু বেশিই তাদের কথা মনে পড়ছে ইনায়ার। তাদের পারিবারিক কবরস্থানেই ইনায়ার বাবা-মা কে দাফন করা হয়েছে। আজ উদ্দেশ্য বাবা-মায়ের কবর জিয়ারত করা। বাসের জানালা দিয়ে বাইরে তাকায় ইনায়া। গুড়িগুড়ি বৃষ্টি আবার শুরু হয়েছে। তার ছিটেফোঁটা ইনায়ার মুখে এসে লাগছে। কিন্তু জানালাটা বন্ধ করেনা সে। চোখ বন্ধ করে থাকে ইনায়া।

-” আমি বিশাল আকাশের জমে থাকা,
ঘন কালো আঁধারের মেঘ।
তুমি সেই মেঘের এক ফোটা বৃষ্টি,
সে তুমি আমি হতেই সৃষ্টি।
তবুও কতো দুরত্ব তোমার আমার,
সেটা কি ভাগ্য? না-কি তোমার জন্য?

হঠাৎ এমতা কথা শুনে চোখ মেলে তাকালো ইনায়া। বাসের পাশেই জায়ানের কালো মার্সিডিজ। জায়ান ড্রাইভিং সিটে বসা। চোখ তার ইনায়ার দিকে। মুখে দুষ্টু হাসি। ইনায়ার মুখে হালকা বৃষ্টির পানি গুলো সে মুছে নেয়। ইনায়া গম্ভীর চোখে জায়ানের দিকে তাকায়। জ্যামে পরে এই লোকের এখন ছন্দ বলতে মন চায়ছে? ইনায়া মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করে উঠে,

-” কি চাই? আমাকে ফলো করছেন না তো? ”

জায়ান বাঁকা হাসে। সুরু দৃষ্টি দিয়ে আবার জিজ্ঞেস করে,

-” কই বললে নাতো? দুরত্ব কি ভাগ্য, না তোমার জন্য?

ইনায়া কোনো উত্তর দেয় না। যানবাহনের হন মানুষের কোলাহল আপাতত যেন তার কাছে সব মিউট হয়ে আছে। এমনকি জায়ানের কথাও। জায়ান সীটে হেলান দিয়ে শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করে,

-” তা আমার থেকে পালানোর জন্য শহর ছাড়ছো না তো? ”

ইনায়া ভ্রুকুটি কুঞ্চিত করে আশেপাশে তাকায়, আবার ঘাড় নিচু করে জায়ানের পানে তাকিয়ে হালকা স্বরে বললো।

-” আমি আপনাকে এতোটাও ভয় পাইনা। যে আমাকে শহর ছাড়তে হবে। আমি পুরান ঢাকায় যাচ্ছি। ”

-” সাহস তো মন্দ নয়। তুমি একা কেনো যাচ্ছো? তিথিকে তো নিয়ে যেতে পারতে। ”

থেমে গিয়ে মনটা নরম করে ফেললো ইনায়া। তারপর মৃদু কম্পিত স্বরে বলে উঠে,

-” আজ বাবা-মায়ের মৃত্যুবার্ষিকী। তাদের কথা একটু বেশি মনে পরছে। ”

জায়ান আর কিছু বললো না। সুন্দর মলিন মুখটার দিকে তাকিয়ে গলা উচিয়ে বলে ওঠে,

-” জলদি ফিরে এসো। আজ দরকারী কাজে পরে গেছি। না হলে সঙ্গে যেতাম। ”

ইনায়া হালকা ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকাতেই দেখতে পায়। জায়ানের গাড়ির পিছনে জিপে করে বসে আছে তার ছেলেপুলেরা। ইনায়া তাকাতেই বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে সবকটা সালাম দিয়ে উঠে। এহেন কান্ডে ইনায়া হকচকিয়ে যায় হঠাৎ। কিছু মানুষ ও লক্ষ্য করছে সেগুলো। পাবলিক প্লেসে আসলেই এটা অসহ্য কর। ইনায়া দেখে সবকটার হাতে হকিস্টিক। ইনায়া নাক ফুলিয়ে জিজ্ঞেস করে,

-” গুন্ডামী অব্যাহত রয়েছে এখনোও? ”

-” তা আমি আবার কবে ভালো ছিলাম? তুমি কি ইদানীং আমাকে ভালো মানুষ ভেবেছো? প্রেমে পড়ে যাওনি তো আবার? ”

ইনায়া হতভম্ব হয়ে গেছে এমন কথায়। মুখ ভেঙিয়ে সামনে তাকায় সে। আর কোনো কথা বলবে না। বাসের কিছু লোক তাকিয়ে আছে ইনায়ার দিকে। ইনায়ার আর সেদিকে ফিরেনা। জ্যাম ছাড়তেই দু’জন দু’জনের গন্তব্যে যেতে শুরু করে।

,

,

,

,

মির্জা বাড়ির পরিবেশ কিছুটা শান্ত আছে আপাতত। গতকাল নাভান আর ইশানকে খুব বকেছিলো বাড়ির সবাই। সোহানা মির্জা হতবাক ছেলের কান্ডে। অতঃপর নাভান ভোঝানোর পর কিছুটা স্থির হয়েছে তিনি। আয়েশা মির্জা একটু খুশি হলেও টেনশনে আছেন। পরের বাড়িতে তার নাতনির কি না কি হাল হবে কে জানে? তারপরও নাভানের কথায় অনেক বিশ্বাস রেখেছেন তিনি। আজ তারা সবাই করিম ভিলায় যাবেন। নিধির সাথে এতোকিছু ঘটে গেছে। হঠাৎ করে এখন সে এই পরিস্থিতি কিভাবে নিজেকে ঠিক রাখবে? সকাল সকাল বাড়ির সবাইকে একসাথে বের হতে দেখে নাভান আর ইশান একে অপরের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ইশান কিছু বলবে না বলে পন করেছে। কালকে তার বাবা নাওয়াজ মির্জা সবার সনে কান মলে দিয়েছিল। নিপা তাদের সামনে এসে তাড়াহুড়ো করে বললেন,

-” তোরা উঠছিস না কেনো? তাড়াতাড়ি চল। ”

-” আচ্ছা মা? কি দরকারি এভাবে এখন তাদের বাড়িতে গিয়ে হামলা দেবার। যদি তোমাদের অপমান হতে হয়। ”

ইশানের বোকা কথায় নিপা যেন রেগে গেলো ভিষণ। সে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে উঠলেন,

-” অপমান করবে মানে? সাথে যে পুলিশ নিয়ে যাবো সেটা কি তোরা জানিস না? ”

-” কিহ্, পুলিশ? ”

দুজনের মাথায় যেন বাড়ি পড়ে। নাভান নাহিদ মির্জার দিকে অসহায় মুখে বলল,

-” এসব কি বাবা? এটা করলে কিন্তু আমরাও ফেঁসে যাবো। ”

নাহিদ মির্জা একটু হেঁসে বলে উঠে,

-” দেখো,যদি ভালোই ভালোই নিধিকে ছেড়ে দেয় তো ভালো। নাহলে আমার আর কিছু করার নেই। ”

নাভান সোহানা মির্জার দিকে তাকিয়ে অবিশ্বাস দৃষ্টি নিয়ে বলে,

-” তোমাকে বলেছিলাম, ফাহাদ নিধির জন্য পারফেক্ট। ”

সোহানা মির্জা নিজের মতো কাজ কে যাচ্ছেন। নাভানের কথার উত্তর দেন না। নাভান রেগে নিজের রুমে চলে আসে। ভেবেছিলো এইভাবে বিয়ে হলে পরিবার মেনে নিবে নিধির ও আপত্তি থাকবে না। কিন্তু সব গোলমেলে হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ হোয়াটসঅ্যাপে নোটিফিকেশন বেজে উঠায় নাভান ফোন বের করে। মেসেজে টা দেখেই নাভানের কুঁচকানো কপাল সরু হয়ে যায়। স্ফুট গলায় শুধু উচ্চারণ করে ” ইনায়া “।

চলবে……………….
,

( ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)