#যাতনা_আমার
#সানজিদা_ইসলাম_সূচনা
#পর্ব: ৩৬ (ক)
তিথির আজ মেহেদী ও সংগীত। দুটো একসাথেই হবে। অপরদিকে ইশানেরও। সংগীত, মেহেদী যার যার বাড়িতে হবে। গায়ে হলুদ আর বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য আলাদা ভেন্যু নির্ধারণ করা হয়েছে। কিছু প্রতিবেশী আর আত্মীয় স্বজনরা মিলে মেহেদীর অনুষ্ঠানটা আয়োজন করা। পুরো করিম ভিলা অনেক সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। জমকালো আয়োজনে চারপাশে মুখরিত হয়ে আছে। রাজকীয় বাড়ির রুপ যেন, আর্টিফিশিয়াল চেরি ব্লসম ফুলের স্তুপে পরে গেছে। তিথির পছন্দ অনুযায়ী সম্পূর্ণ ডেকোরেশন করেছে জায়ান। ইনায়া হাতে মেহেদী ডালা নিয়ে মেহেদীর স্টেজে যাচ্ছে। একটু পরেই সমস্ত নিয়ম কানুন অনুযায়ী অনুষ্ঠান শুরু করা হবে। সাথে জায়ানের এক খালাতো বোন পিহু। মিনারা বেগমের আপন বলতে, এক ভাই আর বোন আছে। তাদের সামনে ইনায়া কে জায়ানের ফুপাতো বোন হিসেবে পরিচয় করে দেওয়া হয়েছে। সবাই নিধিকে নিয়ে কোনো কিছুই বলেনি। সবটা তাদের জানা। ইনায়া স্টেজে ডালাটা রেখে পিছনে ফিরতেই, জায়ানের দিকে চোখ গেলো। যে ম্যানেজমেন্টের লোকেদের সাথে কথা বলছে। ইনায়া অবাক হলো জায়ান কে দেখে। আজকের দিনেও এই লোক কালো পাঞ্জাবি পরে ঘুরছে? আজকের ড্রেস কোড সবুজের মধ্যে রাখা হয়েছে। সবাই কালার মিল রেখে ড্রেস পরেছে। কিন্তু এই লোক? ইনায়া পিহুকে সবটা বুঝিয়ে দিয়ে জায়ানের দিকে যায়। জায়ান লোকটা কে বিদায় দিয়ে পিছনে ফিরতেই, ইনায়া কে দেখলো। ইনায়ার পড়নে সবুজ সেলোয়ার কোড। জায়ান হাসলো,
-” কি অপরুপ সাজে সেজেছ তুমি অপরুপা।
-” ফ্লার্ট করা বাদ দেন।
জায়ানের হাসি আরো চওড়া হলো। ইনায়ার মুখে হালকা রাগের আভাস। ঝলমলে আলোর উজ্জ্বল পরিবেশে জায়ানের হাসি তার কাছে বিরক্ত ঠেকলো। সে গম্ভীর গলায় শুধালো,
-” আপনি কি শোক পালন করছেন? আজকের দিনেও কালো পড়তে হবে? ”
-” কেনো? কোথাও লেখা আছে, বোনের বিয়েতে কালো পড়তে নেই? ইনফেক্ট, সবার উচিত বিয়েতে আমার মত কালো পড়ে শোক পালন করা। ”
জায়ানের কথায় ইনায়া রাগলো বেশ। এটা কোনো কথা? ইনায়া শান্ত অথচ গম্ভীর গলায় বলে ওঠে,
-” বিয়ের দিনও যেন এইসব না দেখি। অসহ্য সন্ত্রাসী একটা। ”
জায়ান কোনো উত্তর দিলো না। যার মানে সে কালোই পড়বে। ইনায়া আর কিছু বললো না। এই লোকের সাথে কথা বলা পুরোটাই বেকার। সে পিছু ফিরে যেতে নিলো। জায়ান মুচকি হাসি দিয়ে বলে উঠলো,
-” তুমি আমি একই সুতোই বাঁধা। ডুর টানলে এক তো হবোই হরিণী। তোমার জীবন টা এই সন্ত্রাসীতেই বাঁধা। সহ্য না করে যাবে কোথায়?
ইনায়া জবাব না দিয়ে চলে গেলো। হন্তদন্ত পায়ে ছুটে বাড়িতে ঢুকে তিথির কাছে গেলো। জায়ান ইনায়ার যাওয়ায় দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসে। সামনে তাদের দিন গুলো হয়তো ভালো যাবে। আচমকা জায়ানের ফোন বেজে উঠায়, জায়ান সোরগোল থেকে দূরে গিয়ে দাঁড়ায়। ফোন বের করলেই দেখতে পায় জ্বলজ্বল করছে ফাহাদের নাম। জায়ান রিসিভ করে জিজ্ঞেস করে,
-” ওদিকের কি খবর? ”
-” খুবই ইন্টারেস্টিং ভাই। তুই ভাবতেও পারবি না এই মেয়ে কতো বড়ো ড্রামাবাজ। ”
-” মানে? জায়ান ভ্রুকুটি কুঞ্চিত করলো। ফাহাদ অপর পাশ থেকে হেসে বলে উঠলো,
-” তার মায়ের কাছ থেকে আমাদের কথা শুনে, খুঁজে খুঁজে আমাদের শত্রুর সাথে ভাব মিলিয়েছে। তুই তো জানিস খলিল কেমন? এই মেয়ের ফাঁদে পড়ে সব দিয়ে বসে আছে। খলিলের জোরেই বাংলাদেশে এসে এমন দাপট দেখিয়ে ছিলো। গতকাল জামিনে ছাড়া পেয়েছে অদিতি। এই থানা পাল্টিয়েও কোনো লাভ হলো না। তোর প্রতি অনেক ক্ষোভ মেয়েটার। এখন তার একটাই লক্ষ্য। সেটা হয়তো তুই। এখন কোথায় পালিয়েছে জানা নেই। ফোর্স দিয়ে খোঁজার চেষ্টায় আছি। তোকে সামনে পেলে জানে না মেরে দেয়। ”
জায়ান গা দুলিয়ে হেসে উঠে। কানে ফোন রেখেই, সিগারেটে ধরায় সে। দু এক টান দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে,
-” আমি মানুষটা এমনিতেই ভালো। কেউ যদি দুষ্টু বুদ্ধি দিয়ে আমাকে কাবু করতে আসে, তাহলে তার বুদ্ধি দিয়েই তাকে কাবু করবো আমি। হোক খারাপ বা ভালো৷ প্রথম এই রাস্তা তার দেখানোই। অদিতির বেলায়ও তাই ঘটেছে। আমার প্রাণভোমরায় হাত দিতে চেয়েছিলো সে।
জায়ানের হুংকার মেশানো কথায় ফাহাদ আর কিছু বলেনা। সে নিশ্চুপ রয়। খলিলের লোকদের সাথে বেশ ভালো ঝামেলায় পরেছে ফাহাদরা। সামনে বুঝেশুনে স্টেপ নিতে হবে তাদের। রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণে আসন্ন নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে এগুতে হবে। মাত্র আর তিন মাস। জায়ান আচমকা জিজ্ঞেস করে,
-” কিন্তু অদিতি খলিলের সন্ধান কি করে পেলো? ”
ফাহাদ চুপ রয়। উত্তর মিলে না কারো কাছে। এই মেয়েকে হালকা ভাবে ছাড়লে হবে না।
,
,
,
,
নিধি তিথির রুমে বসে আছে। তিথির সাজ প্রায় শেষ। নিধি মুখটা অত্যন্ত গোমড়া হয়ে আছে। সে আজকে বাড়ি যেতে চেয়েছিল। তাদের বাড়িতেও সে একটাই মেয়ে। কিন্তু মেয়র সাহেবের নিষেধ, কেউ অবজ্ঞা করতে পারছে না। ফাহাদ আজ চারদিন হলো, দুইদিনের নাম করে শহরের বাইরে আছে। ওখানে থেকেই নিধির উপর খবরদারী করে যাচ্ছে। তিথি সাজ শেষ করে নিধির পানে তাকালো। যে বিষন্ন মনে বসে আছে। তিথি শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করে উঠলো,
-” ভাইয়া কখন আসবে নিধি ভাবি? ”
নিধির ধ্যান ভেঙে তিথির দিকে ফিরলো। অসম্ভব সুন্দর লাগছে তিথিকে। নিধি মলিন কন্ঠে জবাব দেয়,
-” আমি কি করে জানবো? তাকে আমি কল দেইনি। আর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করছি না। ”
তিথি দীর্ঘশ্বাস ফেললো। নিধির কাছে গিয়ে বোঝানোর স্বরে বলে উঠলো,
-” সব মেনে নাও। দেখবে তুমি অনেক খুশি থাকবে সবসময়। আর তোমার বাড়ি যাওয়া নিয়ে মন খারাপ তো? আমি কালকে বাবাকে বলবো, তোমায় বাড়িতে দিয়ে আসতে। ”
নিধি চমকালো। হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করে,
-” সত্যিই? ”
-” হুম, তোমাকেও কথা দিতে হবে। বিয়ের দিন ভেন্যু থেকে সোজা বাড়িতে চলে আসবে। ”
-” ভেবে দেখবো। ”
নিধি চওড়া একটা হাসি দিয়ে বলে কথাটা। হঠাৎ ইনায়ার আগমনে, নিধি আর তিথি কথা বন্ধ করে। ইনায়া তিথি কে ধরে মিষ্টি স্বরে বলে ওঠে,
-” তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে তিথি। ”
তিথি খুশি হলো বেশ। ইনায়ার হাত ধরে উঠে দাঁড়ায় সে। তিনজনই অগ্রসর হয় মেহেদীর অনুষ্ঠানে।
”
,
বিয়ের আমেজ পূর্ণ বাড়ি করিম ভিলা হলেও, তার দারপ্রান্তে নেই বিশাল বড়ো মির্জা বাড়ি। আয়োজনে কেনো ত্রুটি নেই বাড়িতে। সবকিছু মনের মতো করেছে নাহিদ মির্জা। আত্নীয় স্বজনরা নিজ নিজ আনন্দে মেতে থাকলেও কোনো আমেজ নেই তাতে। তারপরও বাড়ির সবাই যথেষ্ট চেষ্টা করছে অনুষ্ঠান টা কমপ্লিট করতে। নিপা ও নওয়াজ মির্জা মেহমান আপ্যায়নে ব্যস্ত। নাহিদ মির্জাও তাই। আয়েশা মির্জা ব্যস্ত আছেন ইশানের সাথে খুনসুটি তে। বাড়ির বিশাল বড়ো জমকালো লাউঞ্জ এরিয়ার পাশে ছোট দুইটি টেবিল রাখা। একটাতে কিছু ফুলের স্তুপ। আর অন্যটি তে ভদকার গ্লাস। তার পাশের চেয়ারে নাভান বসে আছে। মেরুন রঙের পাঞ্জাবি তে দারুণ সুদর্শন পুরুষ ঠেকলো সে। হাতের গ্লাস থেকে মাঝেমধ্যে অল্প করে স্লিপ নিয়ে সামনে উদীয়মান থালার মতো চাঁদের পানে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সে। আজ আকাশে চাঁদের পাশে জ্বলজ্বল করছে অগুনিত তাঁরা। যাদের দৃষ্টি যেন নাভানের পানেই। নাভান হাসলো, চমৎকার দেখালো সেটা। কিন্তু ভিতরের দহন বাইরে বের হলো না। ভেতরের সাথে নাটকীয় খেলায় যেন জিতে রইলো নাভান। এ দহন দেখাবার মতো নয়। তাকে জিততে দেওয়া বড়ই মানা। নিশুতি এই রাতটা কষ্টের সমাহার যেন। পেছনে কারো আভাস পেয়ে নাভান নড়ে উঠলো। হাতের গ্লাসটা টেবিলে রেখে পিছন ফিরে তাকায়। সোহানা মির্জা দাড়িয়ে আছেন। মলিন মুখ কিছুটা। নাভান হাসলো। ইশারা করলো পাশের চেয়ারটাতে বসতে। সোহানা বসলো ছেলের পাশে। কিছুক্ষণ কাটলো এমনিতেই।
-” ইনায়ার কাছে গিয়েছিলে? ”
নাভানের আচমকা প্রশ্নে তার দিকে লক্ষ্য করে সোহানা। নাভানের দৃষ্টি তার দিকেই। সোহানা ঘাবড়ে গিয়েও নিজেকে সামলালেন। হ্যাঁ বোধক মাথা ঝাকায় ছেলের দিকে। নাভান গম্ভীর কন্ঠ স্থাপন করে,
– ” কেনো গিয়েছিলে? ”
সোহানা মির্জা থমকালেন। নাভানের মুখে চাপা রাগ। তিনি বোঝানোর জন্য বললেন,
-” আমি তোমার কথা চিন্তা ক… ”
সোহানা মির্জার কন্ঠ রুখে গেলো নাভানের হঠাৎ হাসিতে। মায়ের পানে তাকিয়ে জোরে হেসে বলে ওঠে,
-” কেনো মা? তুমি জানো তো, তাকে পাওয়ায় যোগ্যতা আমি হারিয়েছি। ”
-” কিন্তু নাভান? ”
-” তাকে পাওয়ার আর চাওয়ার অধিকার আমার নেই। আমি সেটা দেখাতে পারি না। কারণ আমি পাপী। ”
সোহানা মির্জা কিছু বলার মতো খুঁজে পেলেেন না। মায়ের মন, নিজের ছেলের জন্য তিনি বিষয় টা নিচে রাখতে চেয়েছিলেন কি? কিন্তু ইনায়ার সাথে কথা বলে তিনি যেন ধ্যান ফিরে পেয়েছেন আবার।
তাই ভুলটা বুঝতে পেরেছেন। আবারো নিস্তব্ধতায় মোড়া হয়ে যায় সময় টা। কেউ কোনো কথা বললেন না। নাভানের মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে সোহানার একটাই মিনতি। ছেলে যেন ঠিক থাকে। মানসিক ভাবে যেন ভেঙে না যায়। নাভান চাঁদটার দিকে তাকিয়ে হাসলো। ম্লান হাসি সেটা। ভাঙা গলায় বলে উঠলো,
-” কোর্টের দ্বিতীয় নোটিশ এসেছে সেই কবে। আর মাত্র কিছু দিন। তার আর আমার গল্পের শেষ সমাপ্তি। ”
সোহানা মির্জা অবাক হলেন। গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন,
-” তুমি সিগনেচার করেছিলে? কাগজ জমা দিলে কখন।?
চাঁদ থেকে চোখ সড়ালো না নাভান। মুচকি হেসে বিরবির করে বলে উঠলো,
-” যখন বুঝলাম সে আর আমার হবে না। ”
,
চলবে……………
#যাতনা_আমার
#সানজিদা_ইসলাম_সূচনা
#পর্ব: ৩৬ (খ)
পুরো চেরি ব্লসমের সাম্রাজ্য যেন এই বিয়ের ভেন্যু। সাদা, হালকা কৃত্রিম ফুল গুলো নিজেদের সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলেছে। আমেজ পূর্ণ পরিবেশ চারদিকে। শহরের নাম করা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট এটা। মেহমানদের বসার আসন থেকে বিয়ের পুরো স্টেজ চেরি ব্লসমের পরিপূর্ণ। সকাল থেকেই ফাহাদ আর জায়ানের উপর প্রচুর চাপ যাচ্ছে। মিজানুল করিম এযাত্রা নিজের মনের মতো মেহমান আপ্যায়নে ব্যস্ত রইলেন। ফাহাদ আজ ভোরে বাড়িতে ফিরেছে। তিথির রাগ ভাঙতে সঙ্গে নিয়ে এসেছিল অনেক রকম গিফট। বোনের রাগ ভাঙিয়ে উঠতেই আবার ধমকে উঠেছিলো ফাহাদ। কারণ সমূহ নিধিকে কেন মির্জা বাড়ি যেতে দিয়েছে তিথি? সেদিন অনুষ্ঠান শেষে ইশান এসে নিধিকে নিয়ে গেছিলো। যা, ফাহাদ কে জানায় নি কেউই। এই নিয়ে কিছুক্ষণ রাগারাগি করে শান্ত হয়েছিলো ফাহাদ। এরমধ্যেই অনেক বার ফাহাদ নিধিকে কল করলেও ফোন রিসিভ করে না নিধি। রাগের মাত্রা ছাড়িয়ে তার। তবু্ও চুপচাপ করে আছে ফাহাদ। জায়ান আজকেও কালো শেরওয়ানি কোট পরে দিব্যি কাজকর্ম করে বেড়াচ্ছে। ইনায়ার কথার দ্বারপ্রান্তে নেই সে। খাবারের মেন্যু গুলো আরো একবার পরোক্ষ করে জায়ান ছুটলো তিথিদের মেকআপ রুমে। বরযাত্রা এলো বলে, কিন্তু এদের আসার কোনো নাম গন্ধ নেই। জায়ান তাড়াহুড়ো করে দুতালার কর্নার রুমে নক করে। কিছুক্ষণ পরে দরজা খুলে বেরিয়ে আসে ইনায়া। জায়ানের চোখ যেন স্নিগ্ধ হলো। হিমালয়ের শীতল ধমকা হাওয়া বয়ে গেলো তার শরীর জুড়ে। জায়ান কাপছে কি? হয়তো। অত্যাধিক গরমে এ শীতল হাওয়া জরুরি ছিলো তার। স্নিগ্ধ, ততোটাই প্রশান্তিময় বর্তমান সময় টা ঠেকলো তার কাছে। অযাচিত ভাবে ঠোঁট নাড়িয়ে বলে উঠলো,
-” আমার স্নিগ্ধ হরিণী। ”
থমকে গেলো হৃদয় যেন। চারপাশ পরিনত হয়ে গেছে অবাধ্য মিউটে। মনে বেজে যায় অবাক করা মুগ্ধতায়। তার পাগল দৃষ্টি, হৃদয় এফোঁড়ওফোঁড় করার ক্ষমতা রাখে নিমিষেই।
-” আর আপনারা একটা পাগল। ”
জায়ানের হৃদয় নিংড়ানো মুগ্ধতা কাটে, ইনায়ার রুক্ষ মরুভূমি ন্যায় তপ্ত মুখ আর কন্ঠ শুনে। ল্যাভেন্ডার কালারের সুন্দর লেহেঙ্গা পরনে ইনায়ার। যতোটা স্নিগ্ধ ততোটাই মায়াবী লাগছে তাকে। এইরূপে যেকোনো পুরুষ কপোকাত হবে নিশ্চিত। কিন্তু এযাবৎ জায়ান আর দমলো না। কন্ঠে যথাযথ গম্ভীরতা টেনে জিজ্ঞেস করে,
-” কি বললে? ”
-” পাগল বলেছি। আপনি, আপনার বোন সব পাগল। বুঝলেন? ”
ইনায়ার বিরক্ত কন্ঠস্বরে তেজ নিয়ে বলে উঠলো কথাখানি। জায়ান তার যথাযথ কারণ খুঁজে পেলো না। আবারো গম্ভীর মুখে জিজ্ঞেসা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ইনায়ার তপ্ত মুখের দিকে। ইনায়া গলা নামিয়ে বলে ওঠে,
-” ভাই বিয়ের সব ফাংশনে কালো পড়ে ঘুরেছে। আর বোন? নিজের বিয়ের দিন কালো ভূতনী সেজে বসে আছে। এটা নাকি তার স্বপ্ন ছিলো। সে আর তার স্বামী বিয়ের দিন ভূত আর ভূতনী সাজবে। আশ্চর্য,। ”
জায়ান এবার বুঝলো ইনায়ার রাগের কারণ। কিছুটা স্মিথ হেসে তাকালো তার হরিণীর দিকে। মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করে উঠলো,
-” তোমার কালো এতোটা অপছন্দ কেনো হরিণী? আমি তো কালোতেই তৈরি। ”
ইনায়া বিদ্রুপ করে হেঁসে উঠলো। কাজল কালো জোড়া চোখ দুটিও হাসলো কষ্ট নিয়ে। তারপর বিড়বিড়িয়ে বলে ওঠে,
-” যার জীবনের আস্তরণ দুঃখের কালো রঙে রাঙানো, তার কালো রঙ কি করে সহ্য হবে বলুন? ”
-” হবে, সে সময় অতি সন্নিকটে। তুমি দেখে নিও। আমার নিঃশ্বাস যতোদিন থাকবে। ততোদিন তোমার, সব অশুভ কালোকে শুভ ভালো মনে হবে। ”
ইনায়া আর প্রতিত্তোর করলোনা। টলমলে চোখ জোড়া অশান্তের ন্যায় দিকবিদিকশুন্য হয়ে যেন ঘুরলো। যার স্থান সে নিজেই খুজতে অক্ষম। অনেকক্ষণ পরে জায়ান সেই অশান্ত চোখের মালিক কে এড়িয়ে যেতে-যেতে বলে উঠলো,
-” শীগ্রই চলে এসো। সময় খুব সন্নিকট। ”
– ” যদি এসময় আর না আসে? ”
-” তবে ভেবো আমি আর নেই। ”
ইনায়া চমকালো। সমুদ্রে উত্তাল জলোচ্ছ্বাসের ন্যায় তার ভেতর টা হুংকার দিয়ে উঠলো। কিন্তু, মুখের অভিব্যক্তি নরমাল। ভেতরের উচ্ছ্বসিত দহন টা বুঝতে দিলো না সামনের নেতা কে। নিজেকে দমিয়ে শুনলো আবারো তার কিছু কথা।
-” আমি বেঁচে থাকতে তোমার আমার ভিতরে দুঃখের ‘ দ ‘ ঢুকতে দেবো না। কারণ আমি তোমাতে পাগল হরিণী, ভিষণ ভাবে পাগল। ”
,
,
,
একভাবে ফুলে সজ্জিত, সারিবদ্ধভাবে এগিয়ে চলছে বরযাত্রীর গাড়ি গুলো। যেন পিপীলিকার দল সারিবদ্ধভাবে যাচ্ছে। আর মাত্র কয়েক মিনিট বিয়ের ভেন্যুতে পৌঁছাতে। প্রথম গাড়িতে বর বেশে ইশান। তার স্বপ্ন পুরোনে আর মাত্র কিছুক্ষণ। খুব হাসি মুখে বা পাশে দাদির দিকে তাকাতেই মুখ ভোঁতা হয়ে গেলো ইশানের। আয়েশা মির্জা চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে রয়েছেন তার দিকে। ইশান দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তিথির পাগলামি মানতে গিয়ে আরো কতো সমস্যা যে হবে তার গিন্নীর সাথে, তার কোনো হদিস নেই। সবেতো মাত্র শুরু। কালো পাঞ্জাবি পরায় বাধ সেধেছিলেন আয়েশা মির্জা। এমন শুভদিনে নাকি কালো? তিনি তো তিথিকে এই নিয়ে কথা শুনাবেন নিশ্চিত। নিধি ইশানের ডান পাশে বসা। সামনে নাভান। তারা আয়েশা মির্জার এমন ফেস বেশ এনজয় করছে। দুষ্টুমি হাসি ঠাট্টা সব মিলিয়ে শেষে সবাই বিয়ের ভেন্যুতে পৌছালো। ‘বর এসেছে বর এসেছে ‘ কথায় মুখরিত হলো চারপাশ। জায়ানের কাজিন মহল গেইট ধরার জন্য দাড়িয়ে আছে। নিধি আয়েশা মির্জা কে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। নাহিদ মির্জা আর নওয়াজ মির্জা মিজানুল করিমের সাথে কথায় ব্যস্ত। স্টেজে তিথি বসা পাশেই ইনায়া আর মিনারা বেগম। কালো লেহেঙ্গা আর গা ভর্তি ভারী স্বর্নের জুয়েলারি, ব্রাইডাল মেকআপে খুব সুন্দর লাগছে তিথিকে। আয়েশা মির্জা নিধির সাথে স্টেজে বসে আছে। তখন কোথা থেকে ফাহাদ আসে তাদের সামনে। আয়েশা মির্জার সাথে কুশল বিনিময় করে পাশে বসা নিধির দিকে চোখ গরম করে তাকালো। কিন্তু নিধি তাকে পাত্তা দিলো না।
-” তা নাত জামাই এমন শুকাইছো কেন? কাজের বুঝি খুব চাপ? ”
আয়েশা মির্জা পান চাবানো বাদ দিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে ফাহাদের দিকে। ফাহাদ কিছু বলবে, তার আগেই নিধি মুখ ভেঙচিয়ে বললো,
-” তাদের আবার কি কাজ? খুনখারাবি ছাড়া। ”
আয়েশা মির্জা আর ফাহাদ দুজনেই মুখ রাঙালেন। এই মেয়ের সোজা কথা কবে আসবে জানে না ফাহাদ। তার বেলায় শুধু এমন মুখ ঝামটি। ফাহাদ ফিচেক হেঁসে নিধিকে বলে উঠলো,
-” পার্ফেক্ট, একদম ঠিক আছো। ”
-” কি ঠিক আছি? ”
ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে নিধি। ফাহাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
-” আমার বাবার পুত্রবধূ হিসেবে একদম ঠিক আছো তুমি। বুঁজলে? ”
নিধি মুখ ভেঙালো। ফাহাদ আয়েশা মির্জার পাশে বসে মিনমিন করে বলে,
-” তা আমি যে বউয়ের অভাবে শুকনো ডাল হচ্ছি, তা কি আপনার চোখে পরে না দিদিশাশুড়ি মা? ”
আয়েশা মির্জা একগাল হেঁসে মাথার কাপড়টা একটু টেনে নিলেন। হাতে ব্যাগ নিয়ে উঠতে উঠতে বলে উঠলেন,
-” বউ নিয়ে যাবার দায়িত্ব তোমার। আমি সাথে সঙ্গ দিবো আর কি। ”
ফাহাদও হেঁসে সম্মতি দিলো। ইশানকে এনে তিথির পাশে বসানো হয়েছে। আয়েশা মির্জা সেদিকে গেলেন। ফাহাদ বসা থেকে উঠে নিধির একহাত চেপে ধরে। নিধি আঁতকে উঠে আসে পাশে গেস্টদের দিকে তাকালো। কারো কারো নজর তাদের দুজনের দিকে। নিধি চেয়েও ফাহাদ কে কিছু বলতে পারলো না। ফাহাদ নিধির হাত টেনে নিয়ে যায় তার সাথে। নিধিও তাল মিলিয়ে গমগমে গলায় বলে ওঠে,
-” করছেন কি? লোকজন দেখছে তো না কি? ”
-” দেখবেই তো? মেয়র ফাহাদ আর আর তার বউ এখানের সবচেয়ে সুন্দর সুশীল কাপল। ”
নিধি আর কিছু বলে না। ফাহাদ নিধিকে নিয়ে একটা রুমে ঢুকলো। বেডে বসিয়ে সে নিজে ফ্লোরে বসে নিধির কমোড় জড়িয়ে কোলে মাথা রেখে বসে রইলো। নিধি অবাক হলো ফাহাদের এহেন কর্মকান্ডে। শরীরে কাঁপন সৃষ্টি হলো প্রচুর। পা জোড়া নড়বড়ে হয়ে উঠলো কিছুটা। ফাহাদের তপ্ত নিঃশ্বাস জোড়া নিধির উন্মুক্ত উদরে গিয়ে ঠেকলো। নিধি কিছু বলতে পারেনা। কন্ঠরুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে যেন তাকে। নিধি কাপা হাতে ফাহাদের কাঁধ ঝাকিয়ে দিলো খানিকটা। সময় নিয়ে মাথা তুলে তাকালো নিধির পানে। নিধি থমকালো, ফাহাদের চোখ জোড়ায় তাকানোর সাহস পেলো না আর। সে যেন অতল গহ্বর। তাকালে নিজের প্রতিবিম্বিত হওয়া রুপ আর দেখা যাবেনা। নিধির মুখে তাকিয়ে নিরল গলায় জিজ্ঞেস করে,
-” কি আছে তোমার মাঝে? আমি কেন বারবার তোমার মাঝে হাড়িয়ে যাই। সেই দুবছর আগের মতোই। প্রথমবার নিজেকে বুঝিয়েছি। তুমি আমি দুই মেরুর। তোমাকে ভুলার জন্য কতো রিলেশনে গিয়েছি। কিন্তু আমার অবুঝ মন এই তোমার কাছেই থাকতো। আমার সাথে কেন এমন করো? বলতে পারবে? আমাকে কি একটুও ভালোবাসা যায় না? মেনে নেওয়া যায় না। সম্পর্কটা কে কি একটুও সুযোগ দেওয়া যায় না? আমি কি এতোটাই অযোগ্য? কি দোষ আমার? বলোনা, আমি তোমার জন্য নিজেকে বদলে দেবো কথা দিচ্ছি। সম্পর্কটা কে একটা সুযোগ দাও নিধি। ”
ফাহাদের এমন আকুতি হৃদয়ে বিধলো যেন নিধির। রাজনীতিতে জড়িত থাকায় ফাহাদকে তার পছন্দ হতোনা কোনো কালেই। তার মনে হতো, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে কেউই সাধু নয়। সামনে ভালো দেখালেও এদের হৃদয় কলুষিত থাকে। ক’জন নিজেকে ঠিক রাখতে পারে? আসলেই কেউ পারেনা। ক্ষমতা ক্ষমতাসীন দলের নেতারা কেউই ভালো নয়। নিধি ফাহাদের দিকে তাকিয়ে হাসলো,
-” হয়তো আমি আপনাকে বোঝার চেষ্টা করিনি। আপনার এ-ই পেশার কারণে। রাজনৈতিক কলাকৌশল শেখানো ভয়ংকর নেতাদের আমি বরাবরই ঘৃণা করে এসেছি। এরা কখনোই ভালো হতে পারেনা। হয়তো সেটা আপনার মাঝেই পেয়েছি আমি। আমার সাথে যা অন্যায় হয়েছে। তাদের ছায়া দিয়ে আসছে আপনাদের মতো কিছু ক্ষমতাসীন লোকেরা। আপনাদের জন্যই এদের জন্ম। যেখানে টাকা ছুড়ে সেখানেই কুত্তার মতো ঝাপিয়ে পড়ে। যেখানে তাদের প্রতি এতো ঘৃণা। সেটাই আমার সাথে ঘটেছে। আমি সেদিকে মন কি করে দেই বলেন? ”
ফাহাদ ফিচেল হাসলো। শুভ্ররাঙা পাঞ্জাবিতে পুরো শরীর দুলে উঠল। এগিয়ে এসে নিধির চিবুকে নিজের ওষ্ঠ ছোঁয়ায় ফাহাদ। নিধি খিঁচে চোখ বন্ধ করে ফেলে। ফাহাদ সরে এসে মুখ বাকিয়ে বললো,
-” ব্যাস্, এতোটুকুই? চলো বিয়ের ফাংশন কম্প্লিট করতে হবে। ”
নিধি অবাক চোখে তাকালো। এই লোকের হলো কি? ক্ষণে ক্ষণে মুড চেঞ্জ হয়ে যায়। ফাহাদ আগের মতোই তড়িঘড়ি করে নিধিকে নিয়ে বেরিয়ে যায়।
চলবে…………..