যাতনা আমার পর্ব-৩৭+৩৮

0
209

#যাতনা_আমার
#সানজিদা_ইসলাম_সূচনা
#পর্ব: ৩৭

হাতে ময়ূরের পালকের কলম, যেটার পালক গুলো আপাতত ভেঙে আছে। ইনায়ার রাগ হলো, প্রচন্ড রাগ। টলমলে চোখের একফোঁটা পানি, গোলাপি আভার গাল স্পর্শ করলো। নাকের ডগা হলো টুকটুকে লাল। ঠোঁট উলটে এলো প্রায়। অসন্তুষ্ট হয়ে সামনে অতি সুদর্শন হোয়াইট ব্লেজার পরহিত নাভানের পানে তাকালো। নাভান ইনায়ার এমন বাচ্চাসুলভ কান্নায় হতবাক হলো। আর কতো নিজের ভিন্ন রুপ দেখাবে এই অপার সৌন্দর্যের নারী? বিয়ের কাবিননামায় বর কনে উভয় সাইন করবে এই কলমটা দিয়ে। যেটা নিধি গিফট করেছিলো ইশানকে বিয়ের দুইদিন আগে। গেস্ট রুমে ডালায় রাখা ছিলো সেটা। ইনায়ার দায়িত্ব ছিল সেটা স্টেজ পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া। কিন্তু? ডালা নিয়ে আসার পথে আচমকা নাভানের সাথে ধাকা খায় ইনায়া। তাতেও সমস্যা ছিলোনা। ডালা পড়ে কলমের স্থান হলো নাভানের পায়ের তলায়। যার দরুন পালক কিছুটা ভেঙে এবং বেকে আছে। এখন কি হবে? তাই ভেবে ইনায়ার এমন কান্না পেলো। সে গম্ভীর গলায় নাভানকে শুধালো,

-” দিলেন তো শেষ করে? এখন কি হবে? বিয়েতে এইটা দিয়েই সাইন করার কথা ছিলো। ”

নাভান জবাব দিলো না। গভীর চোখে পরক্ষ করলো ময়ূর পালকের কলমটা কে। চোখের সামনে ধরা দিলো কিছু আবছা স্মৃতি। যা মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষ গুলোতে এক কোনায় পরেছিলো। যেটা হয়তো স্মৃতি হয়ে থাকবে সারাজীবন। নাভান হাত বাড়িয়ে ইনায়ার থেকে কলমটা নেয়। শান্ত ম্লান গলায় বলে ওঠে,

-” আমি দেখছি কি করা যায়। ”

বলেই ফোন বের করে কাউকে মেসেজ করলো নাভান। ইনায়া রা করলো না। চুপচাপ দেখতে লাগলো নাভানের কর্মকান্ড। কিছুক্ষন বাদে একজন ছেলে নাভানকে একটা ব্যাগ দিয়ে গেলো। নাভান একপলক ইনায়ার দিকে তাকিয়ে, পাশের একটা টেবিলের পাশে চেয়ারে বসে পরে। ব্যাগ থেকে জিনিসপত্র বের করে নাভান নিজের কাজ শুরু করে দেয়। ইনায়া দাঁত দিয়ে নখ কাটছে। টেনশনে কপাল বেয়ে ঘাম ঝরছে তার। নাভান মাঝেমধ্যে ইনায়ার দিকে দৃষ্টিপাত করছে। সেইদিনের পর আজ প্রথম দেখা তাদের। কতো কথা জিজ্ঞেস করতে গিয়ও তা নাভানের জিভের গোড়ায় আটকে আসছে। সময় নিয়ে নাভান সবটা ঠিক করলো। ইনায়ার কাছে কলমটি ফেরত দিয়ে বলে উঠলো,

-” এবার ঠিক আছে তো? ”

ইনায়া কলমটা ফের পরোক্ষে করলো। নাহ, আগের থেকে এটাকে আরো সুন্দর করে দিয়েছে নাভান। ইনায়া কৃতজ্ঞতা স্বরে বলে উঠে,

-” ধন্যবাদ, আসলেই সুন্দর হয়েছে এটা। ”

নাভানের দৃষ্টি স্থির হলো তাতে। চোখের দৃশ্য পটে ভেসে উঠে আবারো প্রায় একবছর আগের স্মৃতি। বড়ো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নাভান। চোখ রাখে ইনায়ার পানে। মুখটা মলিন করে শুধালো,

-” কিছু মনে পরলো ইনায়া? ”

সাবলীল ভাবে জানতে চাইল নাভান। চোখে তার আকুল আগ্রহ। যে স্মৃতি তাকে এতো বিরল হয়ে যাতনায় বিদীর্ণ করে তুলেছে, সে স্মৃতি কি তাকে ও কিছু মনে করায়? জানতে চায়ছে তার ভেতরটা। ইনায়া কলমটায় চোখ স্থির করে। আগে ময়ুরের পালক থাকলেও, নাভান এখন তার সাথে জোড়া ময়ূরের স্টিক লাগিয়ে দিয়েছে একটা। যেমনটা তাদের বিয়ের কলমটায় ছিলো। যেটা নিধির বানানোই ছিলো। সেই বিভীষিকাময় রাতের কথা মস্তিষ্কে হাতছানি দিয়ে যাচ্ছে বারবার। ইনায়া পলক ঝাপটালো কয়েকবার। ঘুরিয়ে দেখলো ময়ূরাক্ষীর সেই প্রেমময় যুগলবন্দী। ইনায়া তাচ্ছিল্যের সুরে হেঁসে বলে উঠলো,

-” এতো সে-ই বিভীষিকাময় রাতে দুর্ধর্ষ মরিচীকা পত্রের লেখনী। যা দিয়ে শুধু আমি একা নাম লিখে অংশগ্রহণ করেছিলাম। ফের পথহারা পথিকের মতো একাই ছুটেছিলাম সেই মরিচীকার পেছনে। সেখানে আর কেউ ছিলোনা, কেউ না। শুধু আমার হৃদয় নিংড়ানো যাতনা ছাড়া। সে লেখনী কি করে ভুলবো বলুন? ”

নাভানের দৃষ্টি শীতল হয়। ইনায়া কলমটা ডালায় রেখে নিজের গন্তব্যের দিকে অগ্রসর হতেই, নাভান মলিন কন্ঠে বলে উঠে,

-” নেক্সট উইকে আমি কানাডায় ব্যাক করছি। হয়তো এটাই আপাতত শেষ দেখা। ”

ইনায়া ঘাড় ঘুরিয়ে পিছু ফিরে। মুখে ফিচেল হাসি টেনে এনে মৃদু স্বরে বলে উঠে,

-” অবশ্যই! কারণ আপনি যে কাজের জন্য এসেছিলেন, সেটাতো হয়েই গেছে। এখন তবে ফিরতে পারবেন। ”

ইনায়া কন্ঠে অভিমান নাকি উপহাস ছিলো, তা ঠাওর করতে পারলো না নাভান। শীতল চোখেই তাকিয়ে রইলো সামনের অদ্ভুত রমনীর দিকে। যাকে এক দেখায় ভাংচুর মনে হলেও পরক্ষনেই মনে হবে সে ইস্পাতের চেয়ে দৃঢ় কঠিন। ইনায়া যেতে-যেতে ফের একটা কথা বলে ওঠে,

-” আপনার জীবন টা কে ভালো রাখবেন। আজকে যা দেখছেন সবই মরিচীকা। এটাকে সঙ্গী করবেন না ভুলেও। ”

নাভান দীর্ঘশ্বাস ফেলে দেখলো তার শেষ যাওয়া অবধি। নেই, কেউ নেই। আসলেই সব মরিচীকা।

,

,

,

,

ইশান আর তিথির ফটোসেশান শুরু হয়েছে সেই কখন থেকেই। ক্যামেরার ফ্লাশ ও ক্লিকের শব্দ, এসব কিছুতে আয়েশা মির্জার মাথা ধরে গেছে। একে একে পরিবারের সবাই তাদের সাথে ফটো তুলা শেষ হলে, আয়েশা মির্জা ফটোগ্রাফারকে আপাতত স্থির থাকতে বললেন। তার মাথায় ধরে গেছে অনেকটা। কাজী আর রেজিস্ট্রার নিজেদের কাগজ পত্র গুছিয়ে নিয়েছেন। আয়েশা মির্জা আবার চোখ রাখে করিডোরে ইনায়ার খোঁজে। মেয়েটা যে এখনো এলোনা। এতোক্ষণ লাগে ডালাটা আনতে? নাওয়াজ মির্জা আর নাহিদ মির্জা মিজানুল করিমের সাথে আপাতত কাবিনের টাকা নিয়ে কথা বলছেন। আয়েশা মির্জা চোখ ঘুড়িয়ে ইশান আর তিথির দিকে তাকালো। তারা দুজনেই হাসি খুশিতে কথা বলায় মশগুল। আয়েশা মির্জা তেতলেন। মুখ বাকিয়ে বলে উঠেন,

-” তোদের কি লজ্জা সরম নাই? বিয়ের দিনে বর কনে এমন হাত ধরাধরি করে হাসে? বেসরম। আমাদের কালে জামাইর সাথে একমাসেও এতো ফ্রী হই নাই। আর তোরা? ”

আয়েশা বেগমের তিতা কথায় ইশানের দাত কেলানি হাসি বন্ধ হয়ে যায়। আজকে তার বিয়ে বলে গিন্নীর সাথে কোমড় বেধে লাগতে পারছে না। একবারই তো বিয়ে, তা আবার ভালোবাসার মানুষের সাথে। একটু তো আনন্দ করা যায়। কিন্তু তার গিন্নী সেটা হতে দিচ্ছে কই? এদিকে নিধিও ফাহাদের থেকে নিজের হাত ছোটাতে চেষ্টা করে। সেই যে ধরে আছে ছাড়ার আর নাম গন্ধ নেই। যেখানে যাচ্ছে তাকে টেনে বেধে নিয়ে ছুটছে। কখন না যানি দাদি তাদের ধমকে উঠে। কিন্তু ফাহাদের তাতে হুঁশ নেই। হাত ছোটাতে চেষ্টা করলে কাধ জরিয়ে ধরছে। আয়েশা মির্জার কথায় তিথির রাগ হলো একটু হাসলে ক্ষতি কি? সে তার কথার উত্তরে হেসে হেসে জবাব দেয়,

-” আসলে কি দাদি, আপনাদের সময় বাবা-মা বর কনে না দেখিয়ে বিয়ে করাতো। আমাদের সময় আমরা নিজেরাই দেখে শুনে বিয়ে করি। একটু তো ডিফারেন্স হবেই, তাইনা? ”

আয়েশা মির্জার চোখ কপালে। ইশানও ভীমড়ি খেলো। তার বউ আর গিন্নীর ঝগড়া এখান থেকেই শুরু হয়ে গেছে। তিথি হাসিমুখেই থাকলো। আয়েশা মির্জা চোখের চশমা টেনে ঠিক করে পান চিবুতে চিবুতে বলে ওঠে,

-” তোমারে তো আমি বাড়িতে নিয়ে ঠিক করবো বজ্জাত মাইয়া। আদব কায়দাও শেখানো দরকার। শাশুড়ী না বড় শাশুড়ীর কবলে পরবা তুমি। ”

-” ঠিক আছে। খুব মজা হবে বড় শাশুড়ী মা। ”

আয়েশা মির্জা মুখ বাঁকালেন। তিথি আর কিছু বললোনা। ইনায়া ডালা নিয়ে তখনই স্টেজে আসলো। আয়েশা মির্জা রাগান্বিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

-” এই মাইয়া, এতোক্ষণ লাগে সামান্য একটা জিনিস আনতে? ”

কথাটা বলেও শেষ করিডোরে নাভান কে দেখে তিনি রুখে গেলেন। ইনায়া কোনো উত্তর না দিয়ে ডালাটা রেখে নিধির পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। কিছুক্ষণের মাঝেই বিয়ে পরানোর কাজ শুরু হয়ে যায়। ইনায়া স্থির চোখে ক্ষানিকটা চেয়ে থেকে আশেপাশে তাকায় জায়ানের খোঁজে। বোনের বিয়ে, আর এই লোক গেলো কই? ইনায়া ভিড় ঠেলে বেড়িয়ে আসে মজলিস থেকে। ভেন্যুর একপাশে পুল সাইট। সেখানে এসে ইনায়া জায়ানের কোনো খোঁজ পেলো না। এই সন্ত্রাসীর কোনো বিশ্বাস নেই। ঠিকই গুন্ডামী করতে চলে গেছে বোধহয়। ইনায়া ঘাড় কাত করতেই উপরের টেরিসে চোখ যায় তার। হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ তাকালো সেখানে। দু’হাতে রেলিঙে ভর করে ঘাড় কাত করে পা ঝুলিয়ে বসে আছে জায়ান। দৃষ্টি ইনায়ার দিকেই নিবদ্ধ ছিলো এতোক্ষণ। ইনায়ার দৃষ্টিও গাঢ় হলো। আজকাল জায়ানের চোখে তাকাতে ভয় করে না তার। এই অবাধ্য মন কবেই তার ভয়কে জয় করে ফেলেছে নিমিষেই। নিচে থেকে জোর গলায় শুধালো,

-” এখানে বসে আছেন কেন? হাত পা ভাঙার খুব সখ হয়েছে? ”

ঘাড় কাত করেই গা দুলিয়ে হেসে উঠে জায়ান। ইশারায় ইনায়াকে ডাকে নিজের কাছে। ইনায়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে সময় নিয়ে জায়ানের কাছে যায়। মিনি টেরিসে উঠতে একটু সময় লেগেছিলো ইনায়ার। হাঁপিয়ে ওঠে ইনায়া জায়ানের পাশে বসে পরে।

-” বোনের বিয়ে, সেখানে না থেকে এখানে কেনো? ”

ইনায়া অনেক টা হাঁপানো গলায় জিজ্ঞেস করে। জায়ান মৃদু হেসে ইনায়ার চোখের পানে তাকায়। তারপর স্ফুট গলায় বলে ওঠে,

-” রাতের চাঁদ উপভোগ করতে, আমার চাঁদ টা খুব সুন্দর। তাই না হরিণী? ”

-” সত্যিই অনেকে সুন্দর। তাকিয়ে থাকতেই মন চায়। ”

-” হুম,শত জনম পাড় করে দেওয়া যাবে নিসন্দেহে।”

‘ হুম ‘ ইনায়া কিছুক্ষণ জায়ানের মুখের দিকে তাকিয়ে তার কথার ধরন খুঁজলো। নিমিষেই মুখ বাকিয়ে তাকালো অন্য দিকে। তার এইসব ফিল্মি কথায় চলবে না। জায়ান ইনায়ার হাত নিজের হাতের মুঠোয় পুরে নিলো। স্নিগ্ধ মধুময় ঠেকলো সময়টা। দৃষ্টিজোড়া দু’জনেরই মোহিত। আবারো যেন পরে গেল অবাধ্য মিউটেশন। ইনায়ার কালো কুচকুচে মনি জোড়া জায়ানের ধুসর বাদামী চোখেতে কিছু খোঁজার চেষ্টায়। সময়টা স্থির থাক। বক্ষস্থলের সেই অবাধ্য যাতনাকে লঘুচিত্তে বহন করা হৃদয় টা আজ মুগ্ধতায় থাক। কিছু না আসুক এই ক্ষনে। কিন্তু নিয়মের সেই দিন আসলো না। ছাদ কাপিয়ে বেজে উঠলো জায়ানের ফোনের রিংটোন। কল্পনারা গত হয় দুজনেরই। জায়ান ফোন রিসিভ করে কানে দিতেই ফাহাদ বলে ওঠে,

-” কই তুই? তিথির বিদায়ের সময় চলে এসেছে। এবার তো আয়। ”

-” আমি দেখছি তোমরা রিচুওয়াল ফিল আপ করো। ”

তিথির বিয়ে শেষে বিদায়ের পালা। জায়ান ইনায়া সেখানেই বসে থাকলো। অবাকের পাল্লা বাড়লো যেন। বেশিরভাগ মেয়ের বেলায় বিদায়ের ক্ষনে কান্নায় ভেঙে যায়। কিন্তু তিথি ঘটালো অন্য কান্ড। হাসিমুখে বাবা-মা ভাইয়ের থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠলো সে। আয়েশা মির্জা বিরবির করে গাড়িতে উঠলো। আজকালকার মেয়েরা একটু বেশিই ডিফারেন্স। ইশান তিথি আর আয়েশা মির্জার মাঝখানে বসলো। কোন সময় না জানি ঝগড়া বাধিয়ে দেয় এরা। নিধি গাড়ির দিকে এগিয়ে আসতে গেলেই ফাহাদ তার হাত ধরে দাড় করিয়ে দেয়। আর জোর গলায় বলে, এক পা ওদিকে যেতে পারবেনা নিধি। জায়ান যেন খুশি হলো এই কান্ডে।

-” এই না হলে আমার বোন আর ভাই। গুড, ভেরি গুড। ”

ইনায়া হাসলো জায়ানের কথায়। সবার কপালে কি এমন বিদায় জোটে। আস্তে করেই সব গাড়ি ছুটে চলে গন্তব্যের দিকে। তিথির হাতের মুঠোয় ইশানের হাত। ভালোবাসা পূর্ণতা পেলো আজ তাদের৷ খুব করে এমন মানুষ কমই হয়। যাদের ভালোবাসা পূর্ণতা পায়। আজকের রাতটা হয়তো মনে করার মতোই সবার কাছে। সবাই যেন নিজেদের জীবনের আসল গন্তব্য খুঁজে পেয়েছে। সাই-সাই করে তিব্র গতির বাতাস এসে নাভানের নাকে মুখে লাগছে। গাড়ির উইন্ডোর কাচ নামানো। এবেলাই ড্রাইভ করছে সে নিজেই। আজ যেন সকল সমীকরণ সমাধান করে গেছে সে। যাতনারা আড়ালে আবাডলেই থাকুক না। তাদের দেখানোর কোনো মানেই নেই। হঠাৎ সামনের বিকট শব্দে নাভান গাড়ি থামিয়ে দিলো। সামনের দুই গাড়ি আগে ইশানের গাড়ি। নাভান ও পেছনে বসা নাহিদ মির্জা ও নওয়াজ মির্জা সবাই বেড়িয়ে সেদিকে অগ্রসর হয়।ইশানরা কথার মাঝেই ছিলো। আচমকা বিপরীত পাশ থেকে ধেয়ে আসা লরির ধাক্কায় উলটে যায় বিয়ের গোলাপে আবৃত সাদা গাড়িটা। হঠাৎ কিছু চিৎকার। আর লোকজনের সোরগোলে মুখরিত হয় চারপাশ। ইশান চোখ মেলে কিঞ্চিৎ তাকালো। মাথা থেকে হাত সড়িয়ে মৃদু চোখে তাকালো পাশেবসা তিথির দিকে যার রক্তাক্ত হাত এখনো তার হাতের মাঝে। ইশান উঠালো তিথির মুখটা। রক্তে ভেজা নির্জীব চোখ জোড়া। কেঁপে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে। মুখে রক্ত। ভেতরে সত্তা টা যেন ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির লাভার মতো টগবগিয়ে উঠেছে। সক্রিয় হলো মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষ গুলো। ইশান মৃদু স্বরে ডেকে উঠে,

-” উঠো না আমার স্নো হোয়াইট। এখনই ঘুমিয়ে গেলে চলবে? আমাদের তো একসাথে শতপথ পাড়ি দেওয়া বাকি। কতো স্বপ্ন পূরণ করা বাকি। এখানেই শেষ হলে হবে না তো? ”

তিথি আস্তে আস্তে নিঃশ্বাস ফেলছে। ইশান ডানপাশে বসা আয়েশা মির্জার দিকে লক্ষ্য করলো। মাথা দিয়ে অনগল রক্ত গড়িয়ে পরছে তার। চোখ আধ বোঝা হয়ে আছে। ইশান ঝাকালো তাকে কিন্তু না। আয়েশা মির্জা নড়লেন না। ইশান কষ্ট করে বিরবিড়িয়ে বলে ওঠে,

-” তুমি না তিথিকে শিক্ষা দেবে গিন্নী? তাকে বাড়ি নিয়ে যাবার আগেই তুমি হার স্বীকার করছো? ভালো হলোনা গিন্নী, ভালো হলো না। ”

ইশান আর কথা বলতে পারলোনা চোখ বোঝার আগে অস্পষ্ট ভেসে উঠলো নাভানের মুখটা। আজকের রাতের শেষটা কেমন যেন ছিলো। কিছুক্ষণ আগের সুন্দর মুহূর্ত গুলো এখন কেবল যাতনার ধোয়াশার চাদরে ঢাকা পড়েছে। যা ডাকছে তা সবকিছুই হাতছানি।

চলবে………………

#যাতনা_আমার
#সানজিদা_ইসলাম_সূচনা
#পর্ব : ৩৮

রাত তিনটে, সচারাচর হসপিটালে এমন সময় টা একটু নির্জীব হয়ে থাকে। সুনশান-নিস্তব্ধ হয়ে থাকে প্রায় সময়। রাতে গার্ডে থাকা মানুষ গুলোও টের পায়না কোনো কাকপক্ষীরও। কিন্তু আজ সময়টা একটু ভিন্ন। হসপিটালের করিডরে চলছে কারো কারো হৃদয় বিদারক কান্নারার আর্তনাদ। শোকের কান্না সেটা। সোহানা মির্জার কাঁধে পরে সেই কখন থেকে কাঁদছে নিপা। মূলত এখন আর চিৎকার আসছেনা। ভেতর ফেটে যাচ্ছে তার। সোহানা মির্জা এবার তার পাশে বসা নিধির দিকে তাকালো। মেয়েটার মুখের অবস্থা বেহাল। তিনি নিধিকে ইশারায় নিপার পাশে বসতে বললেন। নিধিও তাই করলো। সোহানা মির্জা এবার করিডোরের শেষ প্রান্তে একটি রুমের সামনে গেলো। সেখানে নাহিদ মির্জা ও নওয়াজ মির্জা বসে কাঁদছেন। সোহানা বেডে শোয়ানো আয়েশা মির্জার মরদেহটির দিকে লক্ষ্য করলেন। তার পাশে বসা নাভান। তিনি নাভানের কাঁধে হাত রাখতেই পিছু ফিরে সে। ছেলের মুখ দেখে চমকালেন। এযাত্রা অনেক কষ্ট পেয়েছে নাভান। আয়েশা মির্জা ছিলো তার খুব কাছের। নাভান মাকে জড়িয়ে ধরে। অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠে,

-” এমনটা হলো কেন মা? আমি মেনে নিতে পারছি না কিছুতেই। ”

সোহানা ও ছেলেকে ধরে কেঁদে উঠেন। কেনো এতো বাঁধা এসে চলছে তাদের জীবনে। আজকের দিনটা কি একটু সুখের স্মৃতিময় হতে পারতো না? হয়তো, এমনটাই হওয়ার ছিলো। সোহানা তাদের কাউকে কোনো কিছু বলে শান্তনা দিতে পারলেন না। ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠছেন বারংবার। আয়েশা মির্জার এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারছে না কেউই। হৃদয়ের কোন জায়গাটা আসলে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে তা বুঝতে পারছে না মির্জা বাড়ির কেউই। আয়েশা মির্জা ছিলেন, বট বৃক্ষের মতন তাদের উপর ছায়া। যা এখন আর নেই। নাভান কে বুঝিয়ে নিয়ে কোনো রকম বাইরে এলেন তিনি। করিডোরে শোয়ানো আরো দু’টি মরদেহ। ইশানদের গাড়ির ড্রাইভার ও বিপরীত পাশের লরির ড্রাইভারের লাশ৷ দুজনেই স্পট ডেথ। মেডিকেল রিপোর্ট অনুযায়ী মদ খেয়ে গাড়ি চালাচ্ছিল লরির ড্রাইভার। ব্যালেন্স হাড়িয়ে এই কান্ড ঘটায়। সোহান মির্জা ও নাভান আইসিইউর সামনে যায়। সেখানে করিম পরিবারের সবাই রয়েছে। সাথে আছে ইনায়াও। সোহানা মির্জা মিনারা বেগমের পাশে বসলেন। তিনিও মেয়ের জন্য কেঁদে অস্থির তোলপাড় করে চলছেন। ইশান আর তিথি দুজনেই লাইফ রিস্কে আছে। ইশানের বা পায়ের প্রচুর ইনজুরি হয়েছে। স্বজন হারানো ভয় যেন, সবার ভিতরে ধেয়ে আসছে। কেন এমনটা হলো? মেয়ে বিদায় দেওয়ার ঘন্টা পেরোয়নি, তার মধ্যেই এমন সংবাদে নড়ে গেছে যেন পুরো করিম পরিবার। নাহিদ মির্জার ফোন কলের সঙ্গে সঙ্গে সবাই হসপিটালে এসে পৌছায়। ফাহাদ আর জায়ান নিজেদের গম্ভীরপ্রকৃতি মুখের আদল এখনো ধরে রেখেছে। তাদের দেখে বোঝার জো নেই। ভিতরে কি চলছে। আকস্মিক বিপর্যয় উতরিয়ে সাফল্য অর্জন করতে পারবে কি তারা? আজকের রাতটা যেন দীর্ঘ হতে চলেছে। শেষ যেন হচ্ছেই না। ফাহাদ পা চালিয়ে নিধির কাছে যায়। নিপা আপাতত সেখানে নেই। নিধি একাই আমাবস্যার ন্যায় মুখ করে বসে আছে। ফাহাদ নিধির পাশে বসলো। আদুরে ভঙ্গিতে নিধির মাথায় হাত বুলিয়ে বলে উঠল,

-” চোখে মুখে পানি দিয়ে আসো। ভালো লাগবে কিছুটা। ”

নিধি অসহায় মুখে তাকিয়ে রইলো ফাহাদের পানে। আদেও কি ভালো লাগাটা শরীরে স্থায়ী হবে? হবে না তো। প্রিয়জনের হঠাৎ এভাবে হাড়িয়ে যাওয়া হৃদয় কি করে মানবে। নিধি ফাহাদ কে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে উঠে। অস্থির তোলপাড় করে তুলে বক্ষস্থলের উত্তাল হৃদয়টাকে। ফাহাদ নিধির পিঠে হাত বোলায়। নিশ্চুপ হয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। নিধি কান্নাভেজা চোখে তাকিয়ে ফাহাদ কে বলে উঠে,

-” আমি নিজেকে সামলাতে পারছি না ফাহাদ। কেমন অস্থিরতা আমাকে ঘিরে ধরেছে। দাদির এমন মৃত্যুকে আমি মানতে পারছি না। কি হতো, আজকের দিনটা একটু সুখের হলে? একটা নরমাল দিন কেনো হতে পারলো না। এই মৃত্যুর মিছিল আমি মানতে পারছি না। ”

ফাহাদ নিধির কপালে অধর ঠেকালো। অতঃপর, ম্লান কন্ঠে বলে উঠলো,

-” জীবনটা ক্ষনস্থায়ী নিধি। কোনো কিছুর ভরসা নেই। আজ আছে কাল নেই। যুগযুগ এমন হয়ে আসছে। সামনে আরো হবে। জীবন টা অল্প সময়ের। তাই সবার উচিত বর্তমান টা মেনে নিয়ে ভবিষ্যতের জন্য নিজেকে তৈরি করা। আজকে আছি কাল নাও থাকতে পারি কেউ। মেনে নিতে হবে সবটা। ”

নিধি কিছু বলে না। জরিয়ে রাখে ফাহাদ কে। মিশে থাকে বক্ষপিঞ্জরে। সত্যিই তো, এই বিশাল পৃথিবীতে সবার মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। মেনে নিতে হবে ভবিতব। এই ছোট জীবন টা মাত্র কিছুদিনের। এতে কোনো অভিমান পুষে রাখা কি খুব জরুরি? হয়তো না। থাকুক না কিছু কিছু অভিমান অবহেলায়।

,

,

রক্তস্নাত সেই আমাবস্যার রাত পেড়িয়ে ভোরের আলো ফুটেছে ধরণীতে। পরিনত হয় এক স্নিগ্ধ মধুময় ভোরের সকাল। কিন্তু এই দিনটাই কারো কারো কাছে বিষাক্ততায় ঢেকে আছে। ইশানের অবস্থা আগে থেকে উন্নতি হয়েছে কিছুটা। সময় গড়ায়। সকাল দশটা নাগাদ হসপিটালের সম্পূর্ণ ফর্মালিটি শেষ করে আয়েশা মির্জা কে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। মির্জা বাড়ি এখনো কৃত্রিম আলো আর ফুলের স্তুপে ভরপুর। নতুন বউ বরনের ডালাটাও এখনো অযত্নে অবহেলায় পরে রয়েছে। সে গুলো পেরিয়ে বাদ আছর, তার জানাযা শেষ করে চির শয্যায়ীত করা হয়েছিলো। আয়েশা মির্জাকে খাটিয়া করে নিয়ে যাওয়ার সময় সবচেয়ে বেশি ভেঙে পরেছিল নাভান আর নিধি। ইশান থাকলে হয়তো তার গিন্নীর জন্য এমনই করতো। নিধি অতিরিক্ত কান্নায় জ্ঞান হারিয়েছিল। আর তাকে ধরে রেখেছিল ইনায়া। ইনায়ার ও আয়েশা মির্জার এমন দূর্ঘটনার মৃত্যুটা খুব কষ্ট দিয়েছে। আয়েশা মির্জার খুব ইচ্ছে ছিল দুইছেলে আর দুই নাতি তার খাটিয়া বহন করবে। ইশানের জায়গাটা পূর্ণ করেছিল ফাহাদ। নিজের হাতে গড়া শান্তি ভিলাকে বিদায় জানিয়ে আয়েশা মির্জা কে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তার শেষ এবং আসল ঠিকানায়।
দিন পেরিয়ে রাত ঘনিয়ে আসে। তার সাথে যেন প্রিয় জন হারানোর হাহাকার ঠেলে বেড়িয়ে আসে ভিতর থেকে। মিজানুল করিম আর মিনারা বেগম কে জোর করে বাড়িতে পাঠানো হয়েছে। তা সায়ং জায়ান করেছে। এখানে থেকে তাদের মানসিক অবস্থা আরও খারাপের পথে। নাভানের সাথে কথা বলে ফাহাদ, মির্জা বাড়ির সবাই কেও বাড়িতে ফিরতে বলে। নিধি আর নিপা প্রথমে জেদ ধরলেও নাভানের সামনে তা ফিকে রয়ে যায়। অন্যথায় তাদের এখানে থাকার কারণ দেখলো না নাভান। নিধি ফাহাদের দিকে অভিযোগের দৃষ্টিতে তাকালো। ফাহাদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিধি নিয়ে একটু দূরে যায়। অতঃপর গম্ভীর গলায় বলে ওঠে,

-” বোকামি কেনো করছো বলোতো? আমরা আছি তো এখানে। তুমি বাড়ি যাও। আর হ্যাঁ, সবাই কে বোঝানোর দায়িত্ব তোমার। আর কোনো কান্নাকাটি নয়। ”

নিধি প্রতিত্তোরে করতে পারলো না। সহসাই ফাহাদের উক্তি মেনে সবাই কে নিয়ে হসপিটাল ত্যাগ করলো।

সন্ধারাত পেরিয়ে গেছে। আকাশ নিঝুম কালো। কোথাও চাঁদের দেখা নেই। ঘনঘন মেঘ ডাকছে। তার সাথে বইছে হিম শীতল হওয়া প্রচন্ড বাতাস। হয়তো ভারী বর্ষনের আহ্বান জানিয়েছে প্রকৃতি। রাস্তার চলাচলকৃত মানুষের এখন ঢেরবেশি বাড়ি ফেরার তাড়া। দোকানীরা কেউ কেউ দোকানের স্যাটার বন্ধ করে ফেলেছে। রাস্তা আস্তে আস্তে হয়ে আসছে নির্জন। বাতাস ঝাপটিয়ে উড়িয়ে দিচ্ছে রাস্তার বালি। সেই বাতাসের গতির মতোই শাঁইশাঁই করে চলছে জায়ানের কালো মার্সিডিজ। খুব দক্ষ হাতে গাড়ি ড্রাইভ করছে সে। পাশে বসা ইনায়া। যে মলিন মুখে বাইরে দৃষ্টি স্থির করে আছে। প্রকৃতির হঠাৎ রঙ বদলের ধরন দেখে ইনায়া হাসলো।

-” আকাশ আজ কাঁদুক। আজ তার কান্নার দিন। কেননা, তার বুকেতে মেঘ নামক যাতনা বাসা বেধেছে। তা সে কেঁদে বৃষ্টি করে ঝরিয়ে দিক। আজ আকাশ কেঁদে নিক। ”

ইনায়ার বলা বিরবিড়ানো কথায় জায়ান ভ্রুকুটি কুঞ্চিত করে তাকালো তার দিকে। মুখটা গম্ভীর করে অস্ফুট স্বরে জিজ্ঞেস করে উঠলো,

-” আকাশের মন যখন খারাপ হয় তখনই কাঁদবে। কিন্তু তুমি বলো, আজকে ফ্ল্যাটে ফিরা কি খুব জরুরি? মায়ের সাথে করিম ভিলায় থাকতে পারতে। ”

-” আমার দিন ওই বিয়ে পর্যন্তই ছিলো। ”

জায়ানের দিকে তাকিয়ে দ্বিধাহীনভাবে উত্তর দিলো ইনায়া। জায়ান মুখে কিছু বললো না। গাড়িটা একটা ব্রীজের উপর আসতেই সেটা দার করালো জায়ান। গাড়ি থেকে নেমে পকেট থেকে বিফ বের করে টানতে লাগলো সেটা। মুহুর্তেই নাকে মুখে দিয়ে অনগল ধোঁয়া উড়িয়ে দিলো সে। ইনায়া গাড়ি থেকে নেমে জায়ানের পাশে এসে দাঁড়ায়। গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পরছে এখন। ইনায়া হাতের উপর হাত ভাজ করে কিছুক্ষণ দেখলো জায়ানের কান্ড। অতঃপর মুখ বিকৃত করে বলে ওঠে,

-” বাহ্, খুব ভালো। এই আপনি বলেছিলেন ধুমপান ছেড়ে দিয়েছেন? আপনাকে এখন এই আধার রাতের কুখ্যাত সন্ত্রাসী মনে হচ্ছে। ”

জায়ান ইনায়ার দিকে ফিরে মুখের অবশিষ্ট ধোঁয়া ছাড়লো। অধর টিপে হেসে উঠে তৎক্ষনাৎ। ইনায়ার পানপাতার মতো স্নিগ্ধ মুখপানে একবার তাকিয়ে, সামনে ফিরে ম্লান স্বরে বলে উঠে,

-” আজকাল ডেস্টিনি জিনিস টা আমায় খুব ভাবায়। আগে ভাবতাম যার যার কর্মভোগেই ভবিষ্যতের ভাগ্য। কিন্তু না এখন মনে হয়, কোথাও কোথাও কখনো কখনো আমাদের ওই ভবিতব্যর কাছেই হার মানতে হয়। ”

-” আপনার যা ভাবনায় ছিলো, তা মনে করে আমি হাসতাম। আর এখন যা মনে করেন, তা প্রতিনিয়ত আমার ভাবনায় ঘুরপাক খায়। আসলেই কিছুতে ডেস্টিনি। আর কিছুতে কর্মফলের হিসেব-নিকেশ। ”

জায়ানের অদূরে নিমজ্জিত চোখ জোড়া অজস্র মায়া নিয়ে ইনায়ার পানে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলে উঠে,

-” জানো কি? ভাগ্যে আমি তখনও বিশ্বাসী ছিলাম না। যখন তুমি আমার দৃষ্টির অগোচরে ছিলে। যখন ধরা দিলে, কি জানি প্রথম দেখায় আমার হৃদয় নাড়াতে সক্ষম হয়েছিলে। অনাকাঙ্ক্ষিত দাবানলে জলছিলাম আমি। ভাইয়ের অগুনিত প্রেম, আমাকে ভাবাতো। কি করে কাউকে হঠাৎ এতো চাওয়া যায়? আমি পণ করেছিলাম। কি করে কোন হৃদ হরিণী কোনো গম্ভীর হৃদয়কে নারাতে পারে? তা আমি দেখে নেবো। কিন্তু দেখো না, আমি নিজেই কখন আস্তে আস্তে তোমার বাধায় পা দিয়েছি। আমি নিজেই জানি না। ”

ইনায়ার চোখ জোড়া শীতল হয়। আজকে জায়ানকে খোলা বইয়ের মতন লাগছে। যেন নিমিষেই পড়ে ফেলতে পারবে সে। আসলেই কি তাই? জায়ানকে পড়ে নেওয়া এতোটা সোজা কি? ইনায়া মসৃণ হাসলো।

-” কি ব্যাপার? আজ আপনি এতো মেয়েদের মতো বেশি ভাবছেন কেনো? ”

-” তার মানে তুমি স্বীকার করছো, মেয়েরা বেশি বুঝে সবসময়? ”

দু’জনেই হেঁসে উঠলো। ইনায়া মৃদু স্বরে বলে উঠে,

-” তারা আবেগপ্রবণ হয়ে যায় বেশি। ভেতরের যা আসে তাই নিংড়ে দেয়। কিন্তু পুরুষ তো কঠিন পাথর। তাদের হৃদয়ের কথা ধরতে পারে কে? বিশেষ করে আপনি। কিন্তু আজ একটু বেশিই এই বিষয়ে এলোমেলো হয়ে আছেন। কেন? ”

জায়ান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিরবির করে বলে,

-” হারানোর ভয়, সেটাই আজ মনে জেঁকে বসে আছে। টেরিসে আমাদের সুন্দর সময় টা? যেখানে বসে দুজন নব দম্পতির সুখের যাত্রা দেখলাম। সেখানে বসা থাকতেই তাদের যাত্রার ইতির বাতাস শুনতে পেলাম। এর মানে কি হরিণী? কখন কি হয় কিছুই তো আমাদের হাতে নেই। জীবন নামের এই ট্রাজেডিতে আমরা কে কোথায় কিছু জানা নেই। ”

জায়ান থেমে আবার বলে উঠলো,

-” তিথি আমাদের দুই ভাইয়ের খুব আদরের বোন। ওর সুখের জন্য সব কিছু করতে পারি আমরা। দেখোনা, এই পরিস্থিতিতে এখনো পাথর বনে আছি। মুখ ফুটে কিছুই বলতে পারছিনা। আজ যদি ভাগ্য হয় সব কিছু। তবুও কিছু বলতে পারবো না। ”

ইনায়া জায়ান কে অন্যথায় তাগিদ দিলো,

-” চলুন জায়ান। গুড়িগুড়ি বৃষ্টিতে ভিজে আছি প্রায়। আমাকে নামিয়ে দিয়ে ফিরতে হবে তো না কি? ”

কথাটা বলে ইনায়া গাড়ির দিকে অগ্রসর হতেই, জায়ান পিছু হতে তার হাত টেনে ধরে। ইনায়া পিছু ফিরে তাকালো, থমকালো দৃষ্টি। ইনায়া জিজ্ঞেসা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে জায়ানের পানে।

-” যদি ভাগ্যে না থাকে, তাহলে কি আমার শূন্য খাতা পূর্ণ হবে না কোনোদিন? ”

-” এই মরিচীকার পৃথিবীতে কিছুই আমাদের হাতে নেই। শুধু চোখ রাখবো ভাগ্য নামের শেষ আশার দিকে। ”

ধীরে ধীরে গাড়ি আবার এগিয়ে চলছে। দুজনার কোনো কথা আর হলো না এবার। গন্তব্যে পৌঁছে ইনায়া জায়ান কে বিদায় জানিয়ে ইনায়া বাড়িতে ঢুকে গেলো। সানিয়া আর রায়া সেই কখন থেকে তার অপেক্ষায়। ইনায়া ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। নিচে তাকাতেই অবাক হয়ে গেলো। জায়ান এখনো দাঁড়িয়ে। ইশারায় জায়ান যেতে বলে এক্ষুনি। বৃষ্টির তেজ বেড়ে গেছে। ইনায়া মেসেজে খুদে বার্তা দিল জায়ান কে,

-” ইনশাআল্লাহ কালকে দেখা হচ্ছে। ”

চলবে………………