যাতনা আমার পর্ব-৪১

0
169

#যাতনা_আমার
#সানজিদা_ইসলাম_সূচনা
#পর্ব: ৪১

ঋতুর ঋতু পরিবর্তন হয়ে কাল পড়েছে গ্রীষ্মকালে। ক্যালেন্ডারের পাতায় বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস বৈশাখ, শেষ হবে বলে দিন গুনছে। সূর্যের প্রচন্ড তাপে উত্তাপ পিচ ঢালা রাস্তা। অসহ্য গরমে অতিষ্ঠ জনজীবন। রাস্তার দুপাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটি কৃষ্ণচূড়া গাছ। তার নিচে শেষ হয়ে বিছিয়ে পরে আছে কৃষ্ণচূড়ার লাল রাঙা ফুলের স্তুপ। তার উপরেই চরণ বিছিয়ে যাচ্ছে এক রমনী। এই উত্তাপে বিলীয়মান প্রখর জলন্ত রোদের মতোই দগদগ করছে তার মেজাজ। মুখখানা, পায়ের তলায় বিছিয়ে থাকা কৃষ্ণচূড়ার লাল রাঙা ফুলের মতোই, তপ্ত লাল হয়ে জ্বলজ্বল করছে। মুখ দ্বয় ঘেমে জবজবে অবস্থা। সাদা সেলোয়ার স্যুট পরা গায়ে। হাত ঘড়ি দেখে হন্তদন্ত হয়ে পা চালিয়ে সামনে এগিয়ে যায় সে। একটা গেইটের সামনে আসতেই স্পষ্ট হয় উপরের বিশাল বড়ো সাইনবোর্ড। ” প্রজ্ঞা আশার আলো ” দোতলার সিঁড়িতে বেয়ে ধপধপ করে পা ফেলে এগিয়ে যায় কাঙ্ক্ষিত রুমটির দিকে। পাশে কতো স্টুডেন্ট সালাম জানিয়ে যাচ্ছে, তাতে কোনো ধ্যান নেই। রুমে ঢুকেই চেয়ারে বসে পরে সে। সামনে রাখা পানির গ্লাসটা দেখেই, এক নিমিষেই শেষ করে দেয় সেটা। পাঁচ জোড়া উৎসুক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছে তার দিকে। বিষয়টা বুঝতে পেরেই সে চেচিয়ে উঠলো,

-” ব্যাপার কি রায়া? তোরা আমাকে চোখ দিয়ে গিলছিস কেনো? ”

ইনায়ার হঠাৎ চেঁচানো তে তাদের সবার মুখের আদল পরিবর্তন হয়ে যায়। সানিয়া বুকে হাত রেখে, ভয় পাবার মতো করে বলে ওঠে,

-” তা কি আদেও সম্ভব? তোকে ভালো করে দেখলেই মেয়র সাহেবের গুলি মারার কথা মনে হয়ে যায়। গেলার কথা তো মনের মধ্যে আনাও বারণ। কারণ তুই অলরেডি তার চোখের পর্দার উপর বসে আছিস। বুঝতে পারলি? ”

এমতাবস্থায় রায়া প্রথম মুখ টিপে হাসলেও, পরে সবাই উচ্চ স্বরে হেসে উঠে। ইনায়া বিরক্ত হলো খুব। বাকি তিনজনের পানে তাকালো। রিক্তা, অহি, রিমিশা ওরা তিনজন কোচিং সেন্টারে একবছর হলো জয়েন করেছে। ইনায়ার স্বপ্নের মতোই পুরো প্রজ্ঞা। তাতে অবশ্য জায়ানের অনেক অবদান ছিলো।

-” তোমাদের ক্লাসে যাও। স্টুডেন্টরা রুমের বাইরে এসে দাড়িয়ে আছে। ”

ইনায়ার কথায় তারা তিনজন উঠে চলে গেলো। ব্যাগ থেকে তিনটা টাকার বান্ডিল বের করে সানিয়ার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে ইনায়া শুধালো,

-” পিহু কেমন আছে? কালকে ভাইয়াকে বলিস নিয়ে আসতে। ”

সানিয়া সায় জানালো। ইনায়া ঝটপট ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বের হতে উদ্যোগ নিতেই রায়া অবাকের স্বরে জিজ্ঞেস করে,

-” চলে যাবি? ”

-” হুম, আজকাল ম্যানেজ করে নে। ”

বলেই ইনায়া তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে বেড়িয়ে আসে। গেইটের সামনে এসে ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে একটু ঝুঁকে চোখেমুখে পানি দিতে লাগলো। আচানক গাড়ির হর্ণ শুনে ইনায়া সামনে তাকালো।
চকচকে কালো রঙের মার্সিডিজ গাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসে জায়ান। পরনে কালো রঙের শার্ট, সাদা প্যান্ট। সবসময় পরিপাটি করা চুল গুলো কিছুটা কপালে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তাতে একবিন্দুও এই সুদর্শন পুরুষের ভয়ংকর সৌন্দর্য নেতিয়ে যায়নি। কপালের ডানদিকে ছোট একটা ব্যান্ডেজ লাগানো। ইনায়া মনে মনে অনেক পুলকিত হলো তার পুরুষটিকে দেখে। কিন্তু বাইরে তা প্রকাশ করলো না। জায়ান ক্লান্ত মুখে সুন্দর হেঁসে উঠলো। ইনায়া তা দেখে মুখ বাকিয়ে বোতলটা জায়ানের দিকে ছুড়ে মারলো। জায়ান মুচকি হেসে বলে উঠলো,

-” আপনার এই ভেঁজা স্নাত মুখটা পাবলিক প্লেসে সো করছেন কেনো হরিণী? এ কিন্তু ভাড়ি অন্যায়। ”

ইনায়ার রাগ যেন বৃদ্ধি পেলো। মুখ ঝামটি মেরে তপ্ত গম্ভীর কাটকাট গলায় উলটো জায়ান কে জিজ্ঞেস করে উঠে,

-” বাহ বাহ, আজকে দেখি মেয়র সাহেবের গেটআপ অন্য রকম। কপালে কি হয়েছে? শশুর বাড়ির লোকেরা আপ্যায়ন করেছে বুঝি? ভালো, খুব ভালো। আপনি এটারই যোগ্য। ”

কথাটা বলে ইনায়া আর দাঁড়ালো না। উলটো ঘুরে হাঁটতে গেলেই জায়ান ধপ করে তার হাত টেনে ধরে। ইনায়া বিরক্তিকর মুখের আদল করে রেগে গিয়ে শুধালো,

-” হাত ধরেছেন কেন? আমি আপনার কে? যান, আপনার পার্টির লোকদের সাথে ভাব জমান গিয়ে। আমি তো অহেতুক আপনার জীবনে। ”

-” চলো আমার সাথে। ”

-” আচমকা যাবো কোথায়? ”

জায়ান ফিচেল হাসি টেনে দিয়ে বিরবির করে বলে উঠলো,

-” শশুর বাড়ি, শশুর বাড়ির আপ্যায়ন খেতে মন চায়ছে। ”

ইনায়া ভ্রু কুঁচকালো। জায়ান কি আবার তাকে মজলিসে নিয়ে যাবে নাকি? হতেই পারে। এই লোকের বিশ্বাস নেই। বিয়ের পর একবার হুট করেই নিজের পার্টি অফিসে নিয়ে গিয়েছিল।

-” দরকার নেই আমার অকালে মরতে যাবার৷ ”

ইনায়ার কথা শুনলো না জায়ান, জোর করে গাড়ির প্যাসেঞ্জার সিটে বসিয়ে দিলো। নিজে ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দিলো। ইনায়া মুখ ফুলিয়ে রাখলো। চোখদুটো তার টলমল করছে। জায়ান কে খুবই ক্লান্ত দেখাচ্ছে। চোখমুখ দেখে সুস্থ মনে হচ্ছে না। গত দুইদিন আগে জায়ানের উপর হামলা হয়েছিলো। নির্বাচন সামনেই। প্রতিদ্বন্দ্বী ও বেড়ে গেছে। সিটিতে জায়ানের উপর সন্তুষ্ট সবাই। আসন্ন নির্বাচনে জায়ানের দল ভালো পজিশন নিয়েই নামবে। ইনায়ার ভেতরটা হাহাকার করে উঠলো। বিয়ের দেড় বছর পূর্ণ হয়েছে। এমন একটা দিন নেই, ইনায়া আতংকে পার করেনা। অশ্রুসিক্ত চোখেই সে আবারো জায়ানের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। যে মনোযোগ সহকারে ড্রাইভিং করছে। ইনায়ার নাক টানার আওয়াজে লুকিং গ্লাসে চোখ রাখে জায়ান। ঠোঁট ফুলিয়ে অভিমানী মুখে, নরম গলায় বলে ওঠে,

-” আমার জন্য এতো মন কাঁদে তোমার? হাস্যকর? আমার জন্য এতো চিন্তা হলে একা ফেলে রাখতে না। পরে আছো নিজের বন্ধুবান্ধব নিয়ে। ”

ইনায়া দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। বাইরে তাকিয়ে কাটকাট গলায় বলে উঠলো,

-” আমাদের মধ্যে সম্পর্কটা কে জটিল আপনি করে তুলছেন। আমার গুরুত্ব কই আপনার জীবনে? আছেন তো নিজের অহেতুক দায়িত্ব নিয়ে। ”

-” জনগণের সেবা করা কি অহেতুক হরিণী? ”

ইনায়া উওর দিলো না। মুখ নুইয়ে রাখলো শুধু। ক্ষানিকটা সময় পার হয়ে যায়। এরমধ্যে কোনো কথা বলেনা আর। নিস্তব্ধতায় মোড়া হয়ে যায় সময় টা। ইনায়া পলক ফেলে বাইরে তাকালো। জায়ানের রাজনীতির নেশা সেই ছোট থেকেই। তার লক্ষ্য অন্যরকম। পুরো দমে এতে মজে ছিলো সে। অন্যদিকে চোখ ঘোরানোর সময় ছিলো না তার। এরমাঝেই ইনায়া নামের নেশা মাথায় চড়ে বসে। যার কারণে একটু লক্ষ্যচ্যুত হলেও ফাহাদের নির্বাচন থেকে বসে যাওয়া ওকে আবার এ নেশায় মত্ত করেছে। ইনায়া এই দেড় বছরে বুঝিয়ে কোনো খেসারত পায়নি। উলটো ফাহাদের কথা বলে কাবু করতে গেলেই, জায়ানের রাগের তোপে পড়েছে সে। খুব কম সময় জায়ান ইনায়াকে দিতে পেরেছে। এই নিয়ে অনেক অভিমান ইনায়ার। বলতে বলতে গাড়ি মোড় নেয় ইনায়ার সে চিরচেনা পুরান ঢাকার গলিতে। আচমকা মানুষের সোরগোলে ইনায়ার ধ্যান ভেঙে যায়। পরিবেশ দেখে জিজ্ঞেসা দৃষ্টিতে তাকালো সে জায়ানের পানে। কিন্তু জায়ান সবসময়ের মতোই নির্বিকার। ডানে-বামে বেশ কিছুটা ব্রেক নিয়ে গাড়ি আসে ইনায়ার শৈশবের স্মৃতিময় সেই তিনতলা বাড়িটার সামনে। ইনায়ার মন পুলকিত হলো। জায়ান তড়িঘড়ি করে বের হয়ে ইনায়াকে বের হতে বললো। বের হতেই ইনায়ার হাত ধরে লম্বা কদম ফেলে ভেতরের দিকে অগ্রসর হয়। ইনায়ার জায়ানের সাথে তাল মেলাতে বেগ পোহাতে হয়েছে বেশ। ভেতরে গিয়ে ইনায়া অবাক হলো। পুরো বাড়িটাই নতুন করে সাজিয়েছে জায়ান। হল রুমে গিয়ে আরো অবাক হলো বাড়ির সবাইকে দেখে। মিজানুল করিম আর মিনারা বেগম বসে বসে কিছু একটা বিষয় নিয়ে কথা বলছে। ফাহাদ আর নিধি সেখানেই ছিলো। ইনায়া জায়ানের হাত ছেড়ে তাদের কাছে গেলো। নিধি ইনায়ার হাত ঝাকিয়ে সরু গলায় জিজ্ঞেস করে উঠলো,

-” আসতে এতো লেট করলে? রাস্তায় মারপিট করেছো নাকি দু’জনে মিলে? ”

-” তার সাথে মারপিট ও জমবে না ভালো করে। তো, ইশান ভাইয়া আর তিথি আসেনি? ”

-” তিথি আসতে চেয়েছিলো। কিন্তু বাঁধ সেধেছে ভাইয়া। প্রেগন্যান্সির সাত মাস চলছে, একটু তো সাবধানে থাকতেই হবে। ”

ইনায়া মাথা ঝাকালো। তিথির উপর খুব দায়িত্বশীল ইশান। মিনারা বেগম ইনায়া কে নিয়ে, তাদের বাড়ির বিশাল বড়ো রসুইঘরে গেলো। তারা যেতেই ফাহাদ নিধির হাত ধরে স্লো ভয়েসে জিজ্ঞেস করে,

-” আমাদের বেবি কবে হবে নিধি? আমি বাবা হতে চাই। ”

নিধি বিরক্তি মুখে বলে উঠলো,

-” এই না আমাকে সবসময় পিচ্চি বলে ডাকেন? আবার আমার কাছে বাচ্চা চাইছেন? লজ্জা করেনা? ”

ফাহাদের মুখ কালো হয়ে গেলো। নিধি লক্ষ্য করলো সেটা৷ ফাহাদ তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে বলে উঠলো,

-” বয়স তো বসে নেই নিধি। ”

-” আমার অক্ষমতা আপনাকে খুব পোড়ায়, তাই না ফাহাদ? ”

ফাহাদ শান্ত চোখে নিধির দিকে তাকালো। কালো চোখ জোড়ায় যেন ফাহাদের মরণ নিশ্চিত। কখন কিভাবে এতো ভালোবাসলো এই পাগল মেয়েকে? তার কোনো জানা নেই ফাহাদের। ফাহাদ নিধির হাত ধরে মুচকি হেসে বলে উঠে,

-” হেই, তুমি সবসময় কথায় ফোঁড়ন কাটো কেনো? ডাক্তার বলেছে শীগ্রই আমরা গুড নিউজ পেতে চলেছি। এই জন্যই খুব এক্সাইটেড। তুমি শুধু আমার সাথে ঝগড়া করার ফন্দি আঁটো কেনো? ”

নিধি এই কথার উত্তরে কিছুই বললো না। ফাহাদের সবসময় নিধিকে এভাবে আগলে রাখা, ভালোবাসা, সবকিছুই ভাবায়। সে কি আসলেই এতো ভালো লাইফ পার্টনারের যোগ্য? নিধির হরমোনের সমস্যা। ডাক্তার শরণাপন্ন হয়েছে সেই কবে। এখন ভালো কিছু শোনার অপেক্ষায়। এদিকে ইনায়া রান্নাঘরে গিয়ে অবাক। এতো এলাহি আয়োজন করা হয়েছে। জায়ান কয়েকজন লোকজনকে বলেছিলো। তারা সমস্ত কাজকর্ম করছে। বিশাল বড়ো ডাইনিং জুড়ে বিভিন্ন আইটেম। ইনায়া অবাক হয়ে মিনারা বেগম কে জিজ্ঞেস করে,

-” এতো কিছু কেনো মা? আমরা তো এইমাত্র কয়জন। ”

মিনারা সবকিছু সাজাতে সাজাতে বলে উঠলো,

-” জায়ানের পার্টির লোকজন আসবে। ”

-” সব জায়গায় এদের মাছির মতো ভনভন না করলে হয়না। আর আছে একজন, তার বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে সব জায়গায় ঘুরতে মন চায়। ”

কথাটা বলে তীক্ষ মেজাজ নিয়ে সামনে তাকালো ইনায়া। জায়ান শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে ইনায়ার দিকে। চোখ দুটি খুবই করুন দেখালো সেটা। সব ঝামেলা শেষ হয়েছে প্রায় সন্ধ্যার দিকে। সবাইকে বিদায় দিয়ে বাড়ির সবাই যখন বেরোবে বলে প্রস্তুত হচ্ছে এই সময় জায়ান বলে ওঠে,

-” আমি আর ইনায়া যাচ্ছি না। দরকার আছে, তোমরা যেতে পারো। ”

অযথা নেতা সাহেবের সাথে কথায় লাগতে গেলোনা কেউ। যার যার মতো চলে গেলো শুধু। হঠাৎ করেই নিস্তব্ধতায় মোড়া হয়ে যায় পুরান ঢাকার সেই তিন তলা ও আকৃতির বাড়িটা। দোতলার ডান দিকের বড়ো আয়তন জুড়ে করা রুমটা ছিলো ইনায়ার। সে এখানে আপাতত চুপটি করে বসে পায়ের উপর পা ঘসিয়ে যাচ্ছে। সামনে কাঠের চেয়ারে বসা জায়ান যার দৃষ্টি ইনায়াতে নিবদ্ধ। মুখটা গম্ভীর তবুও চোখ দুটি শান্ত অবিচল। বাইরে প্রচন্ড বাতাস বইছে। সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বলে ধুপ করেই নিভে, কাল বৈশাখ ঝরের আগমন হচ্ছে। হঠাৎ করেই জায়ান গম্ভীর গলায় ডেকে উঠে,

-” ইনায়া তাকাও আমার দিকে। ”

স্তম্ভিত হলো ইনায়া। আশ্চর্যান্বিত চোখে তাকালো জায়ানের পানে। চোখে ভিড় করছে পানিরা। মুখটা মলিন করে জায়ানকে কিছু বলতে গেলো। কিন্তু কান্না গিলে বলতে পারলো। জায়ান দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইনায়ার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। থুতনিতে হাত দিয়ে মুখটা নিজের কাছে এনে ফিসফিস করে বলে উঠলো,

-” এতো কেনো পোড়াও আমাকে? যাতনার আগুনে জ্বালিয়ে দিয়ে কি শান্তি পাও হরিণী? আমিতো সেই কবেই, তোমাতে পুড়ে কয়লা হয়ে বসে আছি। আরো দগ্ধ করতে চাও আমাকে? ”

ইনায়া নাক টানলো। উঠে জড়িয়ে ধরলো জায়ান কে। বুকের বা পাশটায় মুখ রেখে বিরবির করে বলে উঠলো,

-” আপনি আমাকে নাম ধরে কেনো ডেকেছেন? ”

জায়ান কিঞ্চিৎ পরিমাণ হাসলো। খুব করুন দেখালো সেটা। হাত উঠিয়ে জড়িয়ে ধরলো ইনায়াকে। বুক থেকে মাথা উঠিয়ে কানে কানে ফিসফিস করে বলে ওঠে,

-” শুধু নাম ধরে ডাকতেই চোখের পানির বন্যা? গত আট মাস আমাকে দেখা না দিয়ে কথা না বলে, যে পরিমাণের হৃদয়পটে তীব্র গতিতে আঘাত করেছেন। সে ব্যথা উপশম কি করে করবো আমি? ”

-” মাফ করেন না নেতা সাহেব। আমি সত্যিই বেশি বেশি করে ফেলেছি। ”

জায়ান দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ইনায়া চোখের পানি মুছে দিয়ে অতিব শান্ত গলায় বলল,

-” আমার জীবনে তুমি আর আমার পেশা দুটোই গুরুত্বপূর্ণ। ছোট থেকে এ নেশায় জড়িয়ে পরেছি। দাদুর থেকেই আমাদের দু’ভাইয়ের এ পেশায় জড়িয়ে যাওয়া। ভাই পেরেছে এসব থেকে বেড়িয়ে আসতে। কিন্তু আমি পারছি না। খুব ভাবে জরিয়ে গেছি রাজনীতিতে। আমি ভেবেছিলাম তুমি আমাকে বুঝবে। কিন্তু কই? সারাদিনের ক্লান্তি শেষে আমি তোমাকে পাচ্ছি না। হোয়াই? অভিযোগ থাকলে সম্মুখে করো। দূর গিয়ে কেনো? ”

-” এসব করে কি শান্তি তে থাকা যায় নেতা সাহেব? সবসময় হারানোর ভয় আমাকে জেঁকে বসে থাকে। জীবনে এতো কিছু হাড়িয়ে, আর নতুন করে হারাতে পারবো না। মানসিক শান্তিটা পাচ্ছি কই? মাঝেমধ্যে মনে হয় নিধি পারলে আমি কেনো পারছি না। আমার ভালোবাসা কি এতোটাই ঠুকনো? উওর মেলে না। ”

-” ভাইয়ের নিজেরও কিছু ইচ্ছে ছিলো। নিধির কথা রেখে পাকাপোক্ত ভাবে ভাই বেরিয়ে এসেছে এসব থেকে। বোরিং হয়েছিল মেবি। ”

কথাটা বলে জায়ান ইনায়ার চোখের পাতায় দীর্ঘ একটা চুমু টেনে তাকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে নিলো। হালকা কমলা রঙের নিয়ন বাতিতে, আধারময় ঘরটা একটু যেন দ্বীপ শিখার মতো জ্বলজ্বল করছে। ঠান্ডা মৃদু বাতাস দুজনের শরীরটা কেই শীতল করে দিচ্ছে। ইনায়ার কালো ভেজা চোখ জোড়া দেখে জায়ান হাসলো। রমনীর ভেতরের আত্মাটা বোঝার সাধ্য নাই এই নেতা সাহেবের?

-” আমার জন্য হৃদয় পুড়ে হরিণী? ”

-” খুউব, খুব করে পুড়ে। ”

নাক টেনে ইনায়া কাঁপা গলায় স্বীকার করলো। জায়ানের ভয়েজ আরো স্লো হলো,

-” তাহলে, হার শিকার করলে হরিণী?

ইনায়া কিছু বলবে কই। ঠোঁট গুলো ফাঁক করতেই জায়ান তার ওষ্ঠদ্বয় এগিয়ে দেয়। ইনায়াও সায় জানালো। অনুভূতির সাগরে ভাসছে যেন জায়ান। অভুক্ত হৃদয়টা তার ভালোবাসাকে পূর্ণতা দিতে ব্যস্ত শুধু। শীতল হাওয়ায় কম্পন বয়ে যাওয়া ইনায়ার পাতলা শরীরটা উষ্ণতার খোঁজে জায়ানের শরীরের প্রতিটি ভাঁজে লুকিয়ে যাচ্ছে যেন। ইনায়া মুঠোবন্দি করে রেখেছে জায়ানের মাথার পিছনের চুল গুলো। আকাশের চাঁদটা আজ নেই। জোর করে ভীড় করা ঘন কালো আঁধারের মেঘের তলায় লুকিয়ে রয়েছে। ওষ্ঠদ্বয়ের খেলায় হার মানতে হয় ইনায়ার। নিঃশ্বাস যেন বন্ধ হবার উপক্রম। মুঠোবন্দি চুল গুলো ছেড়ে দেয় তৎক্ষনাৎ। জায়ানের পিঠে হাত থাপড়িয়ে ছুটতে চায়। অভুক্ত পিপাসায় পানি পান করার মতো মত্ত জায়ানের হুঁশ কই তাতে? ইনায়ার কোমড় জড়িয়ে ধরে উপরে উঠিয়ে নেয় জায়ান। ইনায়ার হাত ছোঁয় জায়ানের গাল। ইনায়া আস্তে করে তার বন্ধ চোখজোড়া খোলে। জায়ান তার পানেই তাকিয়ে। ইনায়ার চোখে চোখ পড়তেই আচমকা ছেড়ে দেয় ওষ্ঠদ্বয়। কপালে কপাল ঠেকালো ইনায়া। জায়ানের ভেতরের তোলপাড়ের শব্দ যেন তার হৃদয় ছুঁয়ে যাচ্ছে। জায়ান বড়ো বড়ো করে নিঃশ্বাস ফেললো। ইনায়ার গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে ফিসফিস করে বলে উঠলো,

-” তুমি শুভ্রতার রঙে মোড়ানো নীল আকাশের সাদা মেঘ। আমি আঁধার রাতের গহীন কালো মেঘ। হুহ্, কতো অমিলের রাস্তা হবে পার। তারপরও তুমি আমি একাকার, এক মন এক হৃদয় একাকার। ”

জায়ান ইনায়াকে নামিয়ে দিয়ে আবারো ফিসফিস করে বলে উঠে,

-” তুমি আমার জীবন নামের বাগিচার, এক স্নিগ্ধ রঙিন প্রজাপতি। যার আলতো ছোঁয়া আমার কলুষিত মনটা, ভালোবাসার রঙিন অনুভূতিতে ছেয়ে গেছে। ”

ঘন নিঃশ্বাসে প্রখরময় হলো স্থানটি। দৃঢ় হলো উষ্ণ আলিঙ্গন। চিবুক ছোঁয় কাঁধ। প্রচন্ড বাতাস বইতে লাগলো। কাঠের পুরনো জানালা গুলো দেয়ালে শব্দ করে চলছে বারংবার। লাগোয়া পর্দা গুলো হাওয়ায় দুলছে ইচ্ছে মতো। মেঘেরা গর্জন দিয়ে জানান দিলো, সে ঝরে পরার পালা। তৎক্ষনাৎ ফিসফিস করে উঠলো একটা কাতর কন্ঠ স্বর,

-” আমার হবে কি? আমার হয়ে যাও হরিণী। ”

ইনায়া মানলো। রাত হলো খুব গভীর। ঠিক ওদের পরস্পরের আলিঙ্গনের মতোই।

,

,

,

বৃষ্টিস্নাত সকাল, বাইরে হালকা ঝিরিঝিরি বৃষ্টির ফোটা অব্যাহত। হাওয়াও শীতল প্রচুর। প্রকৃতির নতুন সতেজতা। জায়ানের ঘুম ভাঙলো একটু দেরি করে। আড়মোড়া ভেঙে ইনায়া কে পাশে পেলো না সে। ডানে-বামে তাকিয়ে পুরনো পালঙ থেকে নেমে দাঁড়ালো জায়ান। ঘরের দরজা খুলে বারান্দায় দাঁড়াতেই ইনায়া কে দেখতে পায় সে। নিচের উঠোনে খালি পায়ে হেঁটে চলছে। পরনে ল্যাভেন্ডার কালারের সেলোয়ার স্যুট। কোমড়ে ভেজা চুল গুলো দুলছে। জায়ান কাঠের রেলিঙের উপর হাত দিয়ে ইনায়াকে দেখতে লাগলো। আচমকা ইনায়ার চোখ গেলো উপরে। জায়ানকে দেখে ইনায়ার চোখ কপালে। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো জায়ানের বিশাল দেহের বন্দুকধারী বডিগার্ড গুলো কে। ইনায়া নিচে থেকে চোখ রাঙালো। পরনে কাপড় বলতে শুধু মাত্র ট্রাউজার। পুরো উদাম শরীর। এই লোকের কি লজ্জা নেই? ইনায়া হন্তদন্ত হয়ে উপরে উঠে আসে। জায়ানের নিকট এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে উঠলো,

-” লজ্জা সরম কি একেবারে ধুয়ে ফেলেছেন? এমন নেকেড হয়ে ঘুরছেন কেনো?

-” নট ফেয়ার, আমাকে নেকেড পেলে কই? ”

ইনায়া জায়ানের হাত ধরে টেনে রুমে নিয়ে আসলো। ওয়াশরুমের দরজা খুলে তাতে ঢুকিয়ে দিয়ে হুংকার ছেড়ে বলে উঠলো,

-” নেতাদের যে লজ্জা সরম নেই তার আবার প্রমাণ দিলেন। ”

জায়ান ওয়াশরুমের আয়নায় নিজের শরীর দেখে ঠোঁট উলটে বলে ওঠে,

-” বউয়ের ভালোবাসার চিহ্ন দেখাচ্ছিলাম। তাদের নেতা কোথায় কপোকাত? সেটা বুঝে নিক। ভালোই অস্ত রেখেছো হাতে? ”

-” মাত্র বিশ মিনিট সময় দিলাম। তাড়াতাড়ি সাওয়ার শেষ করে আসুন। আমাকে কোচিং যেতে হবে। ”

বলেই ইনায়া চলে গেলো। জায়ান ইনায়ার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে দরজা লাগিয়ে সাওয়ারে মনোযোগ দেয়। প্রায় অনেকক্ষণ সময় নিয়ে বেড়িয়ে আসে জায়ান। টাওয়াল দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে রুমে আসে। ড্রেসিং টেবিলে দাঁড়াতেই আচমকা নজর পড়ে একটা কাগজের দিকে। জায়ান ভ্রু কুঁচকালো। কাগজটা ধরতেই দেখতে পায় সেখানে লেখা। ” গেম অন জে ”

,

,

,

চলবে………

,

( ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)