যাতনা আমার পর্ব-৪৩ এবং শেষ পর্ব

0
721

#যাতনা_আমার
#সানজিদা_ইসলাম_সূচনা
#অন্তিম_পর্ব

টরন্টোর ডাউনটাউনের দক্ষিণে অন্টারিও হ্রদ, উত্তরে ব্লুর স্ট্রিট পূর্বে ডন ভ্যালি এবং পশ্চিমে বাথার্স্ট স্ট্রিট দ্বারা আবদ্ধ। এটি টরন্টোর প্রাণ কেন্দ্র। ডাউনটাউনের অন্টারিও হ্রদের বেশ অনেক আগে জঙ্গল বুক নামক একটা স্থান। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তুলে ধরে এই স্থানটি। বিভিন্ন গাছপালা সমৃদ্ধ একটি জঙ্গলের অংশবিশেষ যেন। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অবলোকন করার জন্য হলেও, এই স্থানটিতে মানুষের আসাযাওয়া কমে এসেছে আরো অনেক আগে। বিভিন্ন সন্ত্রাসী হামলা ও নানান অপকর্মের সাক্ষী হয়ে রয়েছে এই জঙ্গল বুক। আগে পর্যটক ও স্থানীয় জনগণের আনাগোনা থাকলেও, গভমেন্ট কর্তৃক নির্দেশনার পরপর এর নাম এখন লোক মুখে ভুলো এক স্থান মাত্র। গভীর জঙ্গল বুকের একাংশ অন্টারিও হ্রদ মুখি। নামের মতোই এর আপাতত ইতিহাস, না পড়ে বুঝতে পারবে না কেউ। অন্ধকারে ছেয়ে গেছে পুরোটা জঙ্গল বুক। স্থানীয় সময় গোধূলির শেষ বিকেল। গাছের পাতার ফাঁকফোকর দিয়ে আবছা হালকা আলো এখনো বিদ্যমান। ধীর পায়ে সামনে যাচ্ছে তিনজন পুরুষ। শুকনো পাতার মড়মড়ে শব্দে কান সচকিত হয়ে গেছে যেন প্রতিটি কীটপতঙ্গ। আচমকা ফ্লাশ লাইট জ্বলে উঠলো চারদিকে। হৃদয় যেন একজনের থমকালো। সে উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলো,

-” আমরা কি এখানে এসে ভুল করলাম জায়ান? ওদের প্ল্যান মতোই যেন হচ্ছে সবকিছু। ”

জায়ান ভ্রুকুটি কুঞ্চিত করে লিও এর পানে তাকালো। এই মুহূর্তে ওর কথা নিজের কাছে বেশ বিরক্ত ঠেকলো। তপ্ত নিঃশ্বাসে আচমকাই মুখের আদল পরিবর্তন করে কাটকাট গলায় বলে ওঠে,

-” এই ছাড়া দ্বিতীয় কোনো অপশন নেই লিও। ”

ফাহাদ মোবাইলের গুগল ম্যাপে চোখ রেখে ফিসফিস গলায় লিও ও জায়ানের উদ্দেশ্যে বলে,

-” নাভানের ওয়াচের লোকেশন এখানেই দেখাচ্ছে। সতর্ক হও তোমরা। ”

কথাটা বলতেই সাদা পোশাকধারী রিভলবার হাতে, প্রায় পঞ্চাশের অধিক লোক তাদের ঘেরাও করে। মুহূর্তেই উদ্বাস্তু হয়ে যায় যেন সবগুলো। ফাহাদ লিও চমকিত নয়নে চারপাশে তাকিয়ে। কিন্তু জায়ানের অভিব্যক্তি নরমাল দেখালো। সে চুপচাপ হাত তুলে সারেন্ডার করে। ফাহাদ আর লিও বুঝলো না কিছু। তারাও জায়ান কে ফলো করলো। সন্ধ্যার প্রথম শুরুটাই যেন, জায়ানের অদ্ভুত পদক্ষেপ দিয়ে শুরু হলো। রেড ওয়াইন গ্লাসে রেখে একটু একটু স্লিপ নিচ্ছে আন্দ্রে। চোখ দুটি তার কুটিল হেসে উঠছে বারংবার। সামনেই হতভম্ব হয়ে বসে থাকা অদিতির দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলে ওঠে,

-” এখনো যাচ্ছো না কেন? তোমার সাথে ডিল এই পর্যন্তই ছিলো। ”

অদিতি থমকানো কন্ঠে চিবিয়ে চিবিয়ে আন্দ্রের উদ্দেশ্যে বলে,

-” মোটেই না, ওই জায়ান আর ইনায়ার শেষ বিচার দেখবো আমি। ”

আন্দ্রে অদিতির কথায় পাত্তা না দিয়ে পকেটে থেকে একটা সিরিজ বের করে। ওপর পকেট থেকে একটা ঔষধের কৌটা বের করে সিরিজে ভরতে থাকে। অদিতি চোরা চোখে পরখ করে স্থিতি জড়তার সাথে বলে ওঠে,

-” কি করবে ওদের সাথে? ”

-” নান অফ ইয়োর বিজনেস? তুমি ডিল মতো নাভান কে নিয়ে বিদায় হও। ”

অদিতি হাসলো। তড়িৎ গতিতে আন্দ্রের সামনে এসে হিসহিসিয়ে বলে ওঠে,

-” শুধু নাভান চাইলে এই কাজ আমি আরও আগেই সেড়ে ফেলতাম আন্দ্রে। কিন্তু, আমার জায়ানের সাথে বোঝাপড়া ঢেড় বাকি। এটা থেকে তুমি আমাকে হটাতে পারো না। ”

আন্দ্রে বিরক্ত হলো। কর্কশ গলায় অদিতিকে হুমকির স্বরে বললো,

-” বেশি বাড়লে, এই সিরিজ আমি তোমাকেই দিয়ে দেবো। ”

কথার ফাঁকেই আচমকা এক গার্ডের আগমন। সে অতি নিকট এসে কিছু বলতেই, আন্দ্রের মুখটা উজ্জ্বল হয়ে যায়। হাত দিয়ে ইশারা করতেই গার্ডটা হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে পরে। ক্ষানিকখন বাদে, জুতোর ধপধপ আওয়াজে পিছনে ফিরে আন্দ্রে। মুখে ঝুলে থাকা কুটিল হাসি আরো প্রসারিত হয়। ধুসর বাদামী আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত কিংবা তার চেয়ে ভয়ংকর এক জোড়া চোখের পানে। ক্ষানিকটা ঘাবড়ে গিয়েছিল আন্দ্রে। পরক্ষণেই নিজের মনকে কড়া একটা গালি দিয়ে শাসিয়ে যায়। পরিস্থিতি তার অনুকূলে আজ। মুখ বাকিয়ে হিসহিসিয়ে মুখ খুলে তার।

-” ওয়েলকাম জে, তোমাকে ওয়েলকাম করার জন্য সে কবে থেকেই অপেক্ষা করছি। কিন্তু, এতো সহজেই ঘাঁটি পর্যন্ত এসে যাবে? তা ভাবনায় ছিলো না সত্যিই। ”

জায়ান কথা বললো না। জহির চোখে পরখ করলো অদিতি আর আন্দ্রে কে। ফাহাদ অন্তত গম্ভীর মুখে আন্দ্রে কে জিজ্ঞেস করে উঠলো,

-” নিজেদের ভেতরকার নানান ঝামেলা কে কেন্দ্র করে, আমাদের পরিবার কেন টার্গেট করছো? তোমরা কি আদেও মানুষ? এতো শয়তানি বুদ্ধি নিয়ে শান্তিতে আছো কি করে? ”

আন্দ্রে গা দুলিয়ে হেসে উঠে। রেড ওয়াইনের গ্লাসটা আবার হাতে ধরে, সামনের সোফায় বসে পরে। পা দুটো মেলে দেয় শিশার টেবিলে। তারপর ব্যঙ্গ করে বলে উঠে,

-” প্রাক্তন মেয়র কি জানতেন না? আপনার ভাই, আপনার ও নিজের সময়ে ঠিক কি কি করেছে আমার সাথে? ”

-” তুমি যেটার যোগ্য সেটাই হয়েছে। তাই বলে তুমি পরিবার টানবে? তাও আবার এই ফাজিল মেয়েটার সাথে? রাস্কেল! ”

ফাহাদের রাগান্বিত অভিব্যক্তি বোঝার সময় আন্দ্রের হলো না। কারণ জায়ান তার বাংলাদেশে থাকা মূল ঘাঁটি গেড়ে দিয়েছে আরো আগেই। আন্দ্রের বিভিন্ন স্মাগলার, ড্রাগস, নারী ও অস্ত্র পাচার সহ সকল ব্যাবসাতে ঈগল থাবায় দুমড়ে দিয়েছে জায়ান। শেষমেশ জেলেও থাকতে হয়েছে তাকে। বাংলাদেশে ওয়ারেন্ট জারী করা তার নামে। যার আগুনের দাবানল আন্দ্রের ভেতরকার এখনো জ্বলছে। খলিল ও অদিতি কে ধরে জায়ানের প্রাণ ভোমরার খোঁজ করে ফেলেছে সে। আন্দ্রের মুখের হিংস্রতা প্রকাশ পেলো মুহূর্তেই। উঠে দাড়িয়ে হিসহিসিয়ে বলে ওঠে,

-” ভালোই করেছো জে, নিজের আর ওয়াইফের মৃত্যু দূত কে কাছ থেকেই বুঝে নিলে। গেলো দিন তোমার ছিলো। আজ দিন আমার হবে। ”

-” কোথায় ইনায়া? শীগ্রই আমার সামনে নিয়ে আসো আন্দ্রে। না হলে, বুঝতেই পারছো তোমার কি হতে চলেছে। ”

জায়ানের কথা শুনে মজা পেলো আন্দ্রে। মুখ বাকিয়ে টানটান গলায় ব’লে,

-” হাসালে জে! আমার দেশ আমার লোকালয়ে দাড়িয়ে এ-সব কথা তোমার মুখে আসছে কি করে? আদেও বুঝতে পারছো, তুমি আমার আওতায় আছো? ”

জায়ান আবারও ঠান্ডা দৃষ্টি স্থাপন করলো অদিতি আর আন্দ্রের প্রতি। মুখে বাকা হাসি ঝুলিয়ে রাখলো কিঞ্চিৎ পরিমাণ। লিও কখন থেকেই জায়ানের ভাব গতি বোঝার চেষ্টা করছে। আন্দ্রের লোকগুলোর সাথে তারা পারবে কি করে? জায়ান ডানে বামে তাদের দিকে বন্দুক তাক করা গার্ড গুলোর দিকে তাকালো। চোখের ইশারা করতেই, সমস্ত নিশানা হয় আন্দ্রে আর অদিতির পানে। হতবাক, হতবিহ্বল বর্তমান পরিস্থিতি। সবার মুখ আশ্চর্যান্বিত হয়ে রয়েছে। শুধু জায়ান বাদে। তার মুখে কুটিল রহস্যময় হাসি।

-” কি হচ্ছে এইসব? তোমাদের সাহস হলো কি করে আমার দিকে নিশানা করার? ”

অদিতি হিসহিসিয়ে আন্দ্রের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,

-” এ-সব কি হচ্ছে? আদেও বলতে পারো তুমি? ”

জায়ান স্তম্ভিত ফাহাদ আর লিও কে এড়িয়ে নিঃশব্দ পায়ে এগিয়ে যায় আন্দ্রের নিকট। হতবিহ্বল আন্দ্রেকে রাগাতে জায়ান তেরছা হাসি মুখে টানে।

-” সিরিয়াসলি আন্দ্রে! এই তোমার মাফিয়া গ্যাং এন্ড পাওয়ার? উফফ, হাসি পাচ্ছে আমার। নাহ, এতো বছরের কষ্টের জন্য একটু বিশ্বাসী লোক থাকা দরকার ছিলো তোমার। ”

আন্দ্রে মুখ ভয়ংকর ভাবে লাল হয়ে গেছে। এতোক্ষণে সবাই বুঝে গেছে এখানে হয়েছে টা কি। লিও আর ফাহাদের মুখে হাত। জায়ান যেন এভারেস্ট জয় করে ফেলেছে নিমিষেই। জায়ান ঘাড় ঘুরিয়ে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে অদিতির দিকে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পরখ করে, পাশের গার্ড গুলোকে আদেশ করে।

-” এই ঝামেলার গোডাউনটা কে নিয়ে, বাইরে গাড়িতে তুলে দাও। এর শেষ স্থান আমার অন্ধ কারাগারে শিফট করবো। ”

কথা মতো তাই হলো। অদিতি কে টেনেটুনে নিয়ে যেতে লাগলো গার্ডরা। অদিতি হুংকার মেশানো গলায় জায়ান কে বলে উঠে,

-” দেখো নেবো জায়ান তোকে। আমার হাতে তোর মৃত্যু হবে। দেখে নেবো তোকে। ”

জায়ানের মুখের হাসি আরো বৃদ্ধি পায়। শেষ বার অদিতিকে খুব হালকা ভাবেই ছেড়ে দিয়েছিলো সে। জায়ান অদিতির চিৎকারে কুটিল হাসে। সামনে ফিরে আন্দ্রের নিকট। ঘাড় ফুটিয়ে ক্লান্ত ভঙ্গিতে আন্দ্রের চেয়ারে পায়ের উপর পা তুলে বসে পরে সে। রাগান্বিত অভিব্যক্তি সম্পূর্ণ আন্দ্রের ঝাঁঝ বাড়াতে ব্যঙ্গ করে বলে উঠে,

-” তোর পার্টনার গুলো মনে রাখার মতো। ছ্যাহঃ, এবার আমার পার্টনারের সাথে মুলাকাত করাই তোকে। কি বল? ”

আন্দ্রের চোখ যেন জলন্ত অগ্নিকুণ্ড। হাতে থাকা রেড ওয়াইনের গ্লাস টা দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে দেয় নিমিষেই। হাত গড়িয়ে ঝরে পড়ে দুই রকমে তরল স্রোত। ভিষণ ক্রোধ নিয়ে জায়ানের দিকে এগোতেই, জায়ান উঠে জোরে ঘুসি দিয়ে ছিটকে ফেলে সামনে। আন্দ্রে মাটিতে উবুড় হয়ে পরে। হাত দিয়ে ঠোঁটের কোনায় বেড়িয়ে আসা তরল রক্ত মুছে নেয়। হঠাৎ করে বুট জুতোর গট গট আওয়াজে মাথা উঠিয়ে সামনে ঝাপসা দৃষ্টি স্থাপন করে আন্দ্রে। তার থেকে কিছুটা দুরে দাঁড়ানো ছ’ফুট সমান উঁচু তাঁর হুবহু অবয়ের দিকে। দাঁতে দাঁত পিষে ক্রোধ নিয়ে আন্দ্রে উঠে দাঁড়ায়। কয়েক কদম এগিয়ে গিয়ে হিসহিসিয়ে বলে ওঠে,

-” অ্যান্ডি? ইউ? আমার সাথে চালাকি করেছো সবাই? ”

সামনে দাড়ানো আন্দ্রের মতো হুবুহু একই চেহারার অ্যান্ডি নামের লোকটা। যে আন্দ্রের কথা শুনে ভ্রু গুটিয়ে কুটিল হেসে উঠলো। জায়ান চোখে ইশারা করে অ্যান্ডির সাথে। এখান পর্যন্ত আসতে অ্যান্ডিই তাকে সাহায্য করেছে। এমনকি, আন্দ্রের দলের লোক গুলোও অ্যান্ডির হয়ে কাজ করেছে। হুবহু যমজ দুই ভাই তারা। সম্পর্ক সাপ নেউলে। অ্যান্ডি আর আন্দ্রে দুজনেই আগে একই মাফিয়া গ্যাং এর ছিল। কিন্তু, দু’জনের এখন সাপ নেউলে সম্পর্কে বেঁধে আছে। জায়ান অ্যান্ডি পানে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ তাকিয়ে ভরাট গলায় বলে ওঠে,

-” থ্যাংকস অ্যান্ডি, তোমার জন্যই এতোটুকু পর্যন্ত আসা। ”

অ্যান্ডি আন্দ্রে দিকে একনজর তাকিয়ে জায়ানের উদ্দেশ্যে ঠান্ডা গলায় বলে উঠলো,

-” তুমি যেতে পারো জায়ান। ওর ব্যবস্থা আমি করছি। ”

জায়ান ফের কৃতজ্ঞতা স্বরূপ হাসি দিয়ে পিছু ফিরে সিড়ির দিকে অগ্রসর হয়। মাথায় শুধু একটা কথা-ই ঘুরছে। ইনায়া ঠিক আছে তো?

,

নাভান বাইরের দিকটা জানালা দিয়ে পরক্ষ করলো। গার্ডদের সংখ্যা কমে এসেছে হঠাৎ করে। ওরা এখানে আছে গত দুইদিন ধরে। লিও আর সাফরান কে সিগনাল পাঠিয়েছে তখনই। সাথে মেসেজ ছিলো জায়ান কে ইনায়ার বিষয়ে খবর দেওয়া। নাভান মুটামুটি ঠিক থাকলেও, ইনায়ার অবস্থা ভালো নয়। দিনে দুবার ইলেকট্রিক শক ও বিভিন্ন ড্রাগস দেওয়া হচ্ছে ইনায়াকে। নাভান চেয়েও কিছু করতে পারছে না। এতোটুকু বুঝে এসেছে যে, আন্দ্রে অহেতুক অদিতির সঙ্গে হাত মিলায়নি। এতে কিছু না কিছু কারণ আছে। নাভান ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসে। জহির চোখে আবারও পরক্ষ করলো ভেতর বাহিরে। সোরগোলের আওয়াজ ভেসে আসছে অনেকক্ষণ ধরে। নাভান ধাতস্থ হয়ে দরজার পাশে দাঁড়ালো। হালকা প্লাস্টার লাগানো। গার্ড সরে গেছে আরো অনেক আগে। নাভান কয়েকবার ধাক্কা দিতেই তড়াক করেই খুলে গেলো সেটা। পাশের রুমেই ইনায়া ছিলো। নাভান ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো তার নিকট। পুরো হাতে পায়ে লাল লাল রেশ দেখা যাচ্ছে। নাভান বুঝলো ইনায়াকে যে করেই হোক, এইখান থেকে বের করতে হবে। । অনেক গুলো বড়ো স্টিলের আসবাবপত্র রাখা। নাভান হন্তদন্ত পায়ে এগিয়ে গিয়ে একটা ড্রয়ার খুলতেই দেখতে পায় সেখানে অনেকগুলো রিভলবার রাখা। আশ্চর্যবোধক মুখ নিয়ে নাভান একটা রিভলবার লোড করে নিয়ে কোমরে গুঁজে। কোনো কিছু না ভেবেই ইনায়া কে কোলে তুলে নেয়। রুমটি থেকে সাবধানে বের হয়ে আসে। ধীর পায়ে সামনে অগ্রসর হতেই, সিড়িতে কারো পায়ের ধুপধাপ আওয়াজে কান সচকিত হয়ে যায় নাভানের। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সেদিকে লক্ষ্য করতেই দেখে,উন্মাদের ন্যায় সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে আসে জায়ান৷ একনজর তাকে দেখে কাতর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ইনায়ার মলিন মুখ পানে। জায়ান কতোক্ষণ নিস্তব্ধ হয়ে এগিয়ে যায় তার প্রাণভোমরার দিকে। হাত বাড়িয়ে ইনায়াকে নিয়ে নেয় নিজের কোলে। নাভানও আজ নিরদ্বিধায় দিলো। চারবছর আগের মতোই যেন হলো আজকের পরিস্থিতি। কিন্তু, আজ আর নাভানের সেই আগের মতে হৃদয় হুংকার তুলল না। জায়ান ইনায়া কে বুকে জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে ডাকলো,

-” ইনায়া, এ্যাই মেয়ে? চোখ খোলো? ”

জায়ানের কথা হয়তো ইনায়া শ্রবণশক্তিতে পৌঁছাতে পারলো না। একই রকম নিস্তব্ধ হয়ে রইল সে। জায়ানের চোখ ইনায়ার দৃশ্যমান শরীরের অংশে পরলো তৎক্ষনাৎ। ভেতরটা হাহাকার করে উঠলো তার। ঠিক নেই, কিছুই ঠিক নেই তার বোকা হরিণীটার।

,

,

,

জীবনটা যেন সেই রুটিন মাফিক তৈরি। না চাইতেও সেই ঔষধের তীব্র গন্ধ, মানুষের দুঃখ, কারো হাসি মুখ কারো স্বজন হারানো চিৎকার সমাহার হাসপাতালে ভীড় জমাতে হয়। চোখের সামনে প্রিয় মানুষের একটু একটু করে নিস্তেজ হয়ে যাওয়া, তীব্র ভয়ংকর উত্তাল হৃদয় জায়ানের। গত চার বছরে নানা হামলায়, নিজেকে নিয়ে বহুবার হসপিটালের এসেছে জায়ান। তখন ইনায়ার কান্নারত মুখ দেখে গলা উঁচু করে বলতো,

‘ অহেতুক চোখের পানি ফেলে লাভ কি? এটাই তোমার ভবিতব্য। চোখের পানির মূল্য দিতে শিখে রাখো। না হলে, আমি যতোদিন বাঁচব ততোদিন এই ভাবে কাঁদতে হবে। ‘

জায়ান মনে মনে নিজে আজ ইনায়ার জায়গায় এসে দাঁড়াল। হয়তো তার শরীরের ক্ষত দেখলে ইনায়ার মরন যন্ত্রণা হতো। যা এখন তার হচ্ছে। নিজের সখের নারীর এই পরিনতি শুধু তার জন্যই হয়েছে। হালকা ছিটেফোঁটা বৃষ্টির পানি শরীরে পড়তেই জায়ানের ভাবনার গত হয়। পিছন থেকে ফাহাদ ডেকে উঠে। বৃষ্টির পানির সাথে সাথে চোখের পানির গতি মিলে গেলো। অদৃশ্য হলো কান্নারত চোখদুটি। পিছন ফিরে ফাহাদের দিকে জিজ্ঞেস দৃষ্টিতে তাকালো জায়ান।

-” ডাক্তার চার্লস তলব করেছেন। ”

জায়ান দীর্ঘশ্বাস ফেলে। গতছয়দিন ধরে কানাডার একটা হসপিটালে এডমিট আছে ইনায়া। জায়ান ইনায়ার শরীরের হালকা লাল লাল রেশ গুলোকে দেখে। নাভানের সাহায্যে এখানের ভালো একটা প্রফেসরের কাছে টেস্ট করিয়েছে। চার্লসের সাথে নাভানের আগে থেকেই বন্ধুসুলভ সুসম্পর্ক। আজ রিপোর্ট আসবে বলে কথা। ইনায়ার শরীরের জ্বর প্রচুর। এ চারদিনে একটুও কমেনি। ইনজেকশন দেওয়া তে এখন একটু কম। ফাহাদের ফের তাড়ায় জায়ানের পা নড়ে উঠে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে অনেক্ক্ষণ। দ্রুত পা চালিয়ে প্রফেসর ডাঃ চার্লসের চেম্বারে দিকে এগিয়ে যায়। রুমে ঢুকে জায়ান দেখে, নাভান আর লিও আগে থেকেই বসা। ডাঃ চার্লস গৌড় বর্নের মুখটা বেশ চিন্তিত অবস্থায় আছে। হাতে তার কিছু কাগজ পত্র। জায়ান আর ফাহাদ বসতেই তিনি তাদের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। চোখের থেকে চশমাটা সড়িয়ে চারজনের দিকে গম্ভীর দৃষ্টি স্থাপন করে চার্লস জিজ্ঞেস করে উঠলো,

-” আসলে রোগীর সাথে ঘটনা কি হয়েছে? বলো আমাকে। ”

নাভান ঘটনা সংক্ষিপ্ত আকারে চার্লসকে বুঝিয়ে বলে। তিনি মাথা উঠিয়ে ঠান্ডা গলায় বলেন,

-” এটাতো পুলিশ কেস? ”

-” সমস্যা নেই ডঃ চার্লস। অপরাধী কে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ”

নাভানের কথার পর আবারও দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডাঃ চার্লস। জায়ান ছটফটিয়ে জিজ্ঞেস করে,

-” সব ঠিক আছে তো ডাঃ চার্লস ? ”

ডাঃ চার্লস জায়ান কে দেখে নীরব রইলেন কিছুসময়। গত ছয়দিনে জায়ানের জন্য ইনায়ার পাগলামি ভালোবাসা, কেয়ার সবই তার নজরে পড়েছে। ছেলেটার জন্য উনার আফসোস হচ্ছে। কিন্তু মন খারাপ টা পাশে রেখে, তিনি রিপোর্ট টা হাতে নিয়ে বলতে শুরু করলেন,

-” আমি জানিনা এইসব মাফিয়া লোকদের সাথে তোমারা জরিয়ে আছো কি ভাবে। মেডিসিন বিভাগের একজন প্রফেসর হওয়ায় আমার এসব বিষয়ে ধারণা একটু বেশিই। গত চারমাস আগে আমাদের বোর্ড কর্তৃক গোপন তথ্যে একটা বিষাক্ত ভাইরাস সংক্রমণের কথা জানানো হয়েছিলো। ইতালি মাফিয়া গ্যাং, তারা বেশকিছু বিশেষজ্ঞ দিয়ে একটা ভাইরাস ডোজ আবিষ্কার করেছে। এধরণের ভাইরাস, শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়। এটা মানব দেহে একবার পুশ করলেই দুই থেকে তিন দিনের মধ্যেই আক্রান্ত হয়ে এর লক্ষণ দেখা যায়। তারা মূলত এটা তাদের ইন্টারন্যাশনাল মাফিয়া মিত্রদের সাথে মিলে তাদের শত্রু দেশের সাধারণ জনগণের মাঝে ভিবিন্ন ইনজেকশনের মাধ্যমে ছড়িয়ে ফেলতে চাইছে। কয়েক দেশে এমন দু’একটা রোগীর সন্ধান পাওয়া গেছে। এই সম্পর্কে আমাদের আগেই এলার্ট করা হয়েছিল। গবেষণা এসকল রোগীদের লক্ষন গুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। এটা কোনো সংক্রমণ ভাইরাস নয়। যা আমার মতে, হুবুহু ইনায়ার সাথে মিলে গেছে। ”

কথা গুলো বলে একপর্যায়ে থামলেন ডাঃ চার্লস। গম্ভীর দৃষ্টিতে চোখ বোলালেন সামনে বসা চারজন পুরুষের দিকে। বিশেষ করে জায়ানের দিকে তার পরোক্ষ দৃষ্টি স্থাপন করলো। নাভান আর ফাহাদ ও শান্ত দৃষ্টি বোলায় জায়ানের পানে। কিন্তু তার মুখ দেখে বুঝতে পারলোনা, কি চলছে ভেতর টায়। ফাহাদ হাত রাখে জায়ানের পিঠে। কিছুসময় নিস্তব্ধ হয়ে রইল সবাই। হটাৎ জায়ানের ভরাট কন্ঠ ডাঃ চার্লসের উদ্দেশ্যে,

-” তাহলে এর উপায় কি ডাঃ চার্লস? নিশ্চয়ই এর কোনো প্রতিরোধ করা উপায় আছে? ”

ডাঃ চার্লস নিশ্চুপ রইলেন। এর কোনো প্রতিরোধ করার উপায় বের হয়নি। জায়ান হালকা ডুক গিললো। চোখের মধ্যে পানিরা ভিড় করেছে। ঝড়ে পরার পালা শুধু। ডাঃ চার্লসের নিশ্চুপ থাকা তাকে অনেকে কিছুই বুঝিয়ে দিয়েছে। নিশ্চুপ জায়ানের ভেতর বেজে উঠলো একটা কথা শুধু। তার জন্যই ইনায়ার এই অবস্থা। তার এই জীবনে ইনায়াকে জড়িয়ে সে বড্ড ভুল করে ফেলেছে। উন্মাদের ন্যায় ডাঃ চার্লসের রুম থেকে বেড়িয়ে আসে জায়ান। চোখ দুটি সেই বোকা হরিণীটির খোজে। জায়ান যেতেই ডাঃ চার্লস গম্ভীর গলায় বলে ওঠে,

-” এতে আক্রান্ত যে কজন ছিলো, তাদের আয়ু ছিলো মাত্র সাপ্তাহ দশদিনের মতো। ”

ফাহাদ আর নাভান চমকে উঠলো। কি থেকে কি হয়ে গেলো? সব যাতনা কেনো ইনায়ার হয় সবসময়? নাভানের বুকটা মুচড়ে উঠলো। চোখে ভাসলো ইনায়া স্নিগ্ধ মুখখানা। ডাঃ চার্লস শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করে উঠলো,

-” ইনায়া, ইনায়া নামের অর্থ কি নাভান? ”

নাভানের চমকিত নয়ন কিছুটা ঝাপটালো। চল্লিশ বছরের চার্লস এর সাথে নাভানের খুব ভালো একটা সম্পর্ক। নানুর মৃত্যুর আগে থেকে তার সাথে সম্পর্ক ভালো হয়েছিল। নাভান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে ওঠে,

– ” ইনায়া নামের অর্থ হলো, ‘ যে সবার ভালো মঙ্গল সম্পর্কে উদ্বিগ্ন ‘ ”

হন্তদন্ত পায়ে কেবিনে ঢুকে জায়ান। ইনায়ার জ্বর আবার আসছে। শরীরে ব্যথাটাও সামান্য কমেছিলো। এখন যেনো তারও বধ হবে। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে খুব। কারো আসার শব্দে মাথা তুলে তাকায় ইনায়া। জায়ানের চেহারা চোখে স্পষ্ট হতেই ঠোঁট ছড়িয়ে হেসে উঠে। মিহি কন্ঠে জিজ্ঞেস করে উঠলো,

-” কই ছিলেন আপনি? কখন থেকে উঠে বসে আছি আপনাকে দেখার জন্য। ”

জায়ানের মুখ খুবই করুন দেখালো। ইনায়া হাসলো। দু হাত জায়ানের পানে তুলে কাছে ডাকলো। বিধ্বস্ত মনের জায়ান উড়ে গিয়ে যেন জড়িয়ে ধরলো তার হরিণীকে। চোখের পানিরা বাঁধ ভেঙেছে সেই কখন। ভিজে যাচ্ছে ইনায়ার কাঁধ। ইনায়া জায়ানের পিঠে হাত বুলিয়ে দূর্বল কন্ঠে জিজ্ঞেস করে উঠলো,

-” কাঁদছেন কেনো? ঠিক আছি তো আমি। এই দেখুন একদম সুস্থ আছি তো। ”

জায়ান মুখ সামনে এনে ধরে ইনায়া। গালে দুহাত ধরে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে উঠে,

-” নেতা সাহেব কাঁদছেন কেনো? আপনার চোখে পানি মানায় না। ”

জায়ান মুখ তুললো। ওষ্ঠ ছোঁয়ায় ইনায়ার তপ্ত ওষ্ঠজোড়ার সাথে। পরপর কয়েকবার চুমু টেনে কপালে কপাল মেশালো জায়ান। ইনায়া ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলছিলো। কাঁপা কাঁপা ওষ্ঠদ্বয় জোড়া দিয়ে আস্তে করে জিজ্ঞেস করে,

-” আমার কি হয়েছে নেতা সাহেব? শরীরটা একটুও ঠিক লাগছে না। ”

জায়ান নরমাল হলো। ঠান্ডা গলায় বলে উঠলো,

-” তোমাকে ড্রাগস দেওয়া হয়েছিল। এজন্যই শরীরটা দুর্বল লাগছে তোমার। চিন্তা করো না। আমরা তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যাবো। ”

-” আর এই রেশ গুলো? আমার পুরো শরীরে এমন রেশ হয়ে আছে। এ দেখুন। ”

জায়ান না দেখার ভান করে তড়িঘড়ি করে বলে ওঠে,

-” ও কিছু না। তোমার এলার্জির সমস্যা আছে। ”

-” মিথ্যা কেনো বলছেন নেতা সাহেব? আমি বাঁচব না। তাইতো? ”

জায়ান স্তব্ধ হলো। ভেজা চোখ দুটি রাখলো ইনায়ার চোখের পানে। নিস্তব্ধতায় মোড়া সময়টা। জায়ান কোনো কথা বলতে পারলো না। তার কন্ঠ যেন বসে আছে। ইনায়া চোখ রাখলো তার সুদর্শন নেতা সাহেবের দিকে। কালো শার্ট পড়নে জায়ান কে দেখে ইনায়া হেঁসে উঠলো। জায়ানের অতিরিক্ত কালো রঙের কাপড় পড়া ইনায়ার অপছন্দ ছিল। কিন্তু এই কালো তেই যেন তার সন্ত্রাসী স্বামীকে ভালো মানায়। তার কালো জগত, কালো জীবন শেষমেশ তার সে নিজে,তার বোকা হরিণী। জায়ানের জীবনে একপাশ আধার হয়ে থাকবে। ইনায়ার আফসোস হলো এযাত্রা তার জীবন টা কে নিয়ে। কখনো তার জীবনের দুঃখ নিয়ে এতো কষ্টের আফসোস হয়নি। কিন্তু আজ ভিষণ ভাবে হচ্ছে। তা কি এই পুরুষটির সাথে বাকি জীবন থাকতে পারবেনা বলে? ইনায়া চোখ বন্ধ করলো। নাহ, সে জায়ানের সামনে ভেঙে পরবে না। ইনায়া মিষ্টি হেসে জায়ানের বুকে মাথা রাখে। তারপর শান্ত গলায় বলে ওঠে,

-” ভাইরাস সিরিজ দেওয়ার সময় আমার শেষ পরিনতি কি হবে? সেটা আন্দ্রে আমাকে জানিয়ে দিয়েছিল। তখন মনে শুধু একটা ভয় জেঁকে বসেছিল। সেটা আপনাকে শেষ বারের মতো দেখার। কিন্তু দেখুন না, আমি কতো ভাগ্যবতী। শুধু দেখা নয়, আপনাকে ছুঁতেও পারছি আমি। ”

জায়ানের হৃদয়ের তোলপাড় বুঝি ইনায়া অনুভব করতে পারলো। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বুকে মিশে থাকলো। জায়ানও দমলো না। নিজেও জোর করে মিশিয়ে রাখলো ইনায়াকে। অতঃপর কান্নারত গলায় বিরবির করে বলে ওঠে বারবার,

-” আমি তোমায় ছাড়া বেঁচে থাকবো কি করে হরিণী? ”

-” থাকতে পারবেন। কেউ কাউকে ছাড়া সহজে মরে না। ”

-” তুমি ছাড়া আমার খুব কষ্ট হবে। ”

-” শিখে যাবেন। বাবা মাকে ছাড়া আমারও প্রথম এমন মনে হতো। শেষে আপনাকে পেয়ে বহু বছর বেঁচে থাকার ইচ্ছে জন্মেছিল। ”

-” এমন কেনো বলছো? ”

জায়ান কাতর হয়ে জিজ্ঞেস করলো ইনায়াকে। ইনায়ার চোখের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে গাঢ় ভরাট গলায় ফের বলে উঠলো,

-” আমার বোকা হরিণী। তুমি নামক অতল গহ্বরে হারিয়েছি আমি কবেই। ভালোবাসি! বড্ড ভালোবাসি তোমাকে। ”

ইনায়া অশ্রুসিক্ত চোখে জায়ানের কাতর মুখের পানে তাকিয়ে। জায়ান তার ভালোবাসা, কাজে কর্মে ইনায়াকে বহুবার বুঝিয়ে দিয়েছে। কিন্তু, এমন মুখ দিয়ে স্বীকার করলো বোধহয় আজ। ইনায়ার চোখের অশ্রু গুলো গাল বেয়ে গড়িয়ে পরলো। চোখ বন্ধ করে চিৎকার করে বলে উঠলো,

-” আমিও অনেক ভালোবাসি আপনাকে। এটাই হয়তো আপনাকে প্রথম এবং শেষ বার বলা। ”

বাইরের বৃষ্টিটা এখন প্রখর রূপ ধারণ করেছে। অন্ধকার কালো হয়ে আছে বাইরের রূপ। দুজনের চোখ এখন জানালা বেধ করে বৃষ্টির উপর পানে। জায়ান ইনায়ার হাতে হাত রেখে বিরবির করে বলে,

-” এই বৃষ্টির সাথে আমাদের অনেক সময় কেটেছে। এর সাথে মিল বন্ধনও খুব গাঢ়। ”

ইনায়া মলিন হেঁসে বলে উঠলো,

-” আমি আপনার আকাশে আধার জমানো কালো মেঘ। যার বৃষ্টি হয়ে, ধরনীর মাটির সাথে মিশে যাবার সময় এসেছে। মাত্র কিছু সময়, দেখবেন আকাশটা আবার নীল রঙে বদলে যাবে। ”

-” এমন সময় না আসুক। আর কখনো না আসুক। ”

জায়ান বিরবির করে বলে উঠলো বারংবার। ইনায়া চোখ বন্ধ করে শুনলো শুধু জায়ানের হৃদয় নিংড়ানো হাহাকার। কিছু সময় আবার নিস্তব্ধ। হঠাৎ ইনায়া গুনগুনিয়ে বলে গেয়ে উঠলো,

-” আমি হবো ব’লে চরণ দাসী, হবো বলে চরণ দাসী, ও তা হয়না কপাল গুনে, ও তা হয় না কপাল গুনে। আমার মনের মানুষের সনে, আমার মনের মানুষের সনে।

হাসপাতালে সময় রাত তখন চারটা। কিছুসময় পরেই ভোরের সকাল ফুটে উঠবে। বৃষ্টির বারিধারা বয়ে আনবে নতুন স্নিগ্ধ মধুময় একটা সকাল। তবে সে সকাল ইনায়ার জন্য হবে কি? ইনায়াকে আইসিইউ তে নেওয়া হয়েছে কিছু সময় আগে। রাতেই তার সমস্ত শরীর ঠান্ডা হয়ে এসেছিল। অক্সিজেন লেবেলে পৌঁছে গেছিলো তখন। জায়ান সেই রাত থেকেই বসা আইসিইউর সামনে। এখানে অন্য কারো থাকার পারমিশন না থাকলেও। ডাঃ চার্লস এর খাতিরে তারা তিনজনেরই এখানে আসা যাওয়া। জায়ানের চোখ শুধু আইসিইউর দরজাতেই নিবদ্ধ। হঠাৎ, হিমেল ধমকা হাওয়া জায়ানের গা ছুঁলো। মনে হলো বোকা হরিণী তাকে ডাকছে। উন্মাদের ন্যায় ছুটলো দরজার সামনে। ফাহাদ বাংলাদেশে ফোন দিয়ে মির্জা বাড়ি ও করিম ভিলায় খবর জানিয়েছে। সকলের ভিতর এক দুমড়ানো মোচড়ানো নিস্তব্ধতায় বিদীর্ণ হয়ে গেছে। নিধি আর তিথি যেনো বিশ্বাস করতে পারছে না এই কথা। ইনায়া আর থাকবেনা তাদের মাঝে। সোহানা মির্জা পাথর বনে গেলেন। তার মুখটাও আজ বন্ধ। ফাহাদ ফোন কল শেষ করে ঢুকতেই নাভানকে লক্ষ্য করে। যে হসপিটালের বাইরে নিশ্চুপ হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। ফাহাদ নাভানের পাশে এসে দাঁড়াতেই নাভান গলা ছেড়ে বলে ওঠে,

-” সব যাতনা শুধু একজনের কেন হয় বলতে পারিস? ভালো থাকার অধিকার তো সবার আছে? ”

ফাহাদ মলিন মুখ চুপ রইলো কিছুক্ষন। প্রথম থেকে শেষ যাতনা শুধু একাই একটা মেয়ের হয়েই থাকলো। নিস্তব্ধতা মুড়িয়ে ফাহাদ শান্ত গলায় বলে ওঠে,

-” হয়তো জন্ম থেকেই তার ডেস্টিনি এমন লেখা ছিল। কষ্ট হলেও এটা আমাদের মানতে বাধ্য। ”

হটাৎ শোরগোলে তারা দু’জনের দুটি কথা ফুরিয়ে গেলো। ফাহাদ আর নাভান চমকে উঠে ভেতরের দিকে অগ্রসর হলো। আইসিইউর সামনে জায়ানকে দুজন আটকে রাখার চেষ্টা করছে। ডাঃ চার্লস ও তার চেম্বার থেকে বেড়িয়ে আসলো। ফাহাদ যেতেই জায়ান অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে উঠলো,

-” কখন থেকে ওকে এখানে এনে রেখেছে। আমি দেখতে যাবো। আমার সামনে থেকে সরতে বলো ওদের। না হলে খুন করে ফেলবো। ”

মেয়ে নার্স গুলো সামনে দাড়িয়ে তীক্ষ্ণ আওয়াজে বারবার নিষেধ করছে। আইসিইউতে সাধারণ মানুষ যেতে পারবেনা। ডাঃ চার্লস নার্স গুলোকে অনুমতি দিলো জায়ানকে ভিতরে দিতে। নার্স দুটো রাস্তা ছাড়তেই জায়ান ঢুকে পড়লো। আয়নার বাহিরে দাঁড়িয়ে তার বোকা হরিণীর মলিন মুখটা দেখলো। জায়ানের ঘন ঘন নিঃশ্বাস আর বিপ বিপ শব্দে পুরোটা স্থান। বাইরে হঠাৎ উত্তাল হাওয়া বইতে লাগলো। জায়ান তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো।

-” তুমি তো বৃষ্টি হয়ে ধরনীতে ঝরে গেলে। এক আকাশ সমান যাতনায়, আমায় বিদীর্ণ করে গেলে। হোক, সব যাতনা আমার হোক! আমার। ”

নিস্তব্ধ হয়ে আসলো পরিস্থিতি। জায়ানের চোখ থাকলো ইনায়ার মুখে। এভাবে নিস্তেজ হওয়ার জন্য দায়ী একমাত্র জায়ান করিম থাকলো। ভেতরের দহন বাইরে বেড়িয়ে এলো। চিৎকার করে বলতে থাকলো,

-” আমার কল্প গুলো হয়তো গল্প হয়েই রয়ে যাবে। কারণ তুমি আমার হয়েও হওনি। ধোঁকা? এ-তো ধোঁকা কি করে হৃদয় মানবে, প্রাণনাশিনী? ”

,

,

সমাপ্ত