যেখানে দিগন্ত হারায় পর্ব-২১+২২

0
343

#যেখানে_দিগন্ত_হারায়
#পার্ট_২১
জাওয়াদ জামী জামী

” ও মা গো, গেলাম গো। আমি আর নেই। ” মাশিয়ার আর্তনাদ শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে আসলেন আয়েশা খানম।

পিচ্ছিল উঠানে ধপাস করে পরেই ব্যথায় চিৎকার করছে মাশিয়া। আরমান কেবলমাত্র বাড়িতে ঢুকেছে। ও কুসুমকে রাখতে গিয়েছিল। বাড়িতে ঢুকেই মাশিয়াকে উঠানে চিৎপটাং হয়ে পরে থাকতে দেখে হাহা করে হেসে উঠল। লজ্জায় জড়োসড়ো মাশিয়া কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে আরমানকে দেখছে। ও না হয় শখের বশে উঠানে নেমেছিল। আগে কখনোই বৃষ্টিভেজা উঠানের কাদায় মাখামাখি হয়নি মেয়েটা। তাই বৃষ্টি থামতেই শাশুড়ীর বারণ স্বত্বেও উঠানে এসেছে। কিন্তু উঠান পিচ্ছিল হওয়ায় ব্যালান্স রাখতে পারেনি। আবার শাড়িও এরজন্য কিছুটা দায়ী। শাড়িতে পা বেঁধে না গেলে হয়তো এই বেইজ্জতি থেকে কিছুটা রেহাই পাওয়া যেত। কিন্তু না ভাগ্যই যেখানে ওর সাথে বেইমানী করেছে, সেখানে এমনটা হওয়ারই ছিল।

আরমানকে আজ প্রথমবার হাসতে দেখল মাশিয়া। তবে আরমানের হাসি দেখে মুগ্ধ হওয়ার বদলে রেগে গেল ও।

” অসভ্য মাস্টার, আর একবার হাসলে আপনার দাঁত আমি ভেঙে ফেলব। হাসি থামান বলছি। ” কাদায় মাখামাখি মাশিয়া উঠান থেকে একটা ইটের টুকরা নিয়ে আরমানের দিকে ছুঁড়ে মা’র’তে চাইল।

” আম্মা, তুমি কেন এই অপদার্থ মেয়েকে উঠানে যাওয়ার অনুমতি দিলে? যে মেয়ে মাছের কাঁটা বাছতে জানেনা, সেই মেয়ে বৃষ্টিভেজা উঠানে হাঁটতে পারবে, এই ধারনা তোমার হলো কিভাবে? নিজের চোখেই দেখলেতো এই মেয়ের কাণ্ডকারখানা? ” আরমানের হাসি কিছুতেই থামছেনা।

” আম্মাআআআআ, ঐ অসভ্য মাস্টারের মুখ যদি আরেকবার খোলে, তবে আই সয়্যার ওর মাথা আজ আমি ফাটিয়ে দেব। আমার কোমড় মনে হয় ভেঙেই গেছে। সেদিকে ঐ হিটলারের খেয়াল নেই। সে আমার গুনগান গাইতে ব্যস্ত আছে। বদের হাড্ডি ফাজিল মাস্টার। অসভ্য হিটলার। ”

মাশিয়াকে পরে যেতে দেখে শশীরও প্রচন্ড হাসি পাচ্ছে। কিন্তু মাশিয়ার রণমুর্তি দেখে ও অনেক চেষ্টা করে হাসি চেপে রাখল। ও ভালো করেই জানে, এই মুহূর্তে মাশিয়ার সামনে হাসা আর যূপকাষ্ঠে মাথা দেয়া একই কথা। তাই আপাতত হাসার কথা ভুলে গিয়ে উঠানে নেমে মাশিয়াকে তোলার চেষ্টা করল। ততক্ষণে সুধাও এগিয়ে এসেছে। আয়েশা খানমও ছুটে এসেছেন মাশিয়ার কাছে। শুধু আরমান কলপাড়ে গিয়ে মুখহাত ধুয়ে নিজের ঘরে চলে যায়।

সুধা আর শশী মাশিয়াকে নিয়ে কলপাড়ে যায়। আয়েশা খানম ঘরে যান মাশিয়ার কাপড় আনতে।

ভর সন্ধ্যায় গোসল করে ঠান্ডায় জমে যাচ্ছে মাশিয়া। বৃষ্টির কারণে আবহাওয়া এমনিতেই শীতল ছিল। তারউপর অসময়ে গোসল করে ওর শরীর ম্যাজম্যাজ করছে। বিছানায় কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে।

আয়েশা খানম গরম দুধ এনে খাইয়ে দিলেন তার প্রানপ্রিয় পুত্রবধূকে। চুল শুকিয়ে, চুলে তেল দিয়ে দিলেন। রাতে শুধু একটা রুটি খায় মাশিয়া।

গভীর রাত। হঠাৎই আরমানের ঘুম ভেঙে যায়। কারণ খুঁজতে এদিকওদিক তাকিয়েই বুঝতে পারে মাশিয়া কিছু একটা বলছে। ভালো করে খেয়াল করতেই বুঝতে পারল, ও ঘুমের ঘোরে বিরবির করছে। আরমান বিরক্তিতে ভুরু কোঁচকায়। এদিকে মাশিয়া বিরবির করেই চলেছে। মাঝেমধ্যে আবার কেঁপেও উঠছে। এবার আরমানের টনক নড়ে। ও মৃদু গলায় মাশিয়াকে ডাক দেয়। পরপর তিনবার ডাকলেও মাশিয়া সাড়া দেয়না। বাধ্য হয়ে আরমান মাশিয়ার হাতে স্পর্শ করে ডাক দিতেই চমকে উঠল আরমান। মাশিয়ার শরীর ভিষণ রকমের গরম। জ্বরে পু’ড়ে যাচ্ছে ওর শরীর।
আরমান বিছানা থেকে নেমে ফার্স্ট এইড বক্স খুলে জ্বরের ট্যাবলেট নিল। মাশিয়াকে ডাকতে গিয়ে ওর মনে পরল, খালি পেটে ওকে ঔষধ খাওয়ালে সমস্যা হতে পারে। তাই ঔষধ রেখে খাবার ঘরে যায়। টেবিলে রুটি আর তরকারি ছাড়া অন্য কোন খাবার দেখলনা। ফ্রিজ খুলে সেখানে আপেল আর সেমাই পেল। কিন্তু মাশিয়ার এই অবস্থায় ওকে ঠান্ডা খাবার দেয়া যাবেনা বিধায় ও একটা ডিম ভেজে, দুইটা রুটি নিয়ে ঘরে আসে।

” মাশিয়া, ওঠ। একটা রুটি খেয়ে ঔষধ খেয়ে নাও। ” মাশিয়ার কপালে হাত রেখে আরমান মৃদুস্বরে ওকে ডাকল।

আরমানের স্পর্শ পেয়ে মাশিয়া নড়ে উঠে অস্পষ্ট গলায় বলল,

” অসভ্য মাস্টার, খবরদার আমার অসুস্থতার কোন সুযোগ নিবেননা বলে দিলাম। সুযোগ পেয়েই আমার গায়ে হাত দিচ্ছেন কেন? ”

মাশিয়ার এহেন কথায় আরমান রাগে গজগজ করতে থাকে৷

” আজ একটা কথার প্রমান পেলাম, মানুষের উপকার করতে নেই। জ্বরে জ্ঞান হারিয়ে পরে থাকতে, এটাই তোমার জন্য পারফেক্ট ছিল। বেয়াদব মেয়ের নষ্ট মন। মনে খালি আজেবাজে চিন্তা আসে। অসুস্থ জন্য আজ তুমি বেঁচে গেলে। নইলে থাপ্পড় দিয়ে তোমার কয়েকটা দাঁত ফেলে দিতাম। ”

আরমানের ধমকে মাশিয়া মিইয়ে যায়। বুঝতে পারল আরমানকে এসব বলা ঠিক হয়নি।

” একটা অসুস্থ মেয়েকে এভাবে বলতে আপনার কষ্ট হচ্ছেনা! একটা নিষ্পাপ মেয়ে বিছানায় নেতিয়ে আছে, আর আপনি থাপ্পড় দিয়ে তার দাঁত ফেলে দিতে চাইছেন! আজ মনে হচ্ছে আমার দেয়া হিটলার নাম স্বার্থক হয়েছে। ” মাশিয়া এই কথাটুকু বলতেই হাঁপিয়ে উঠেছে। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে।

” তুমি থামবে? অসুস্থ বলেই আজ তোমার দাঁত খোয়াতে হলোনা। এবার উঠে রুটি খেয়ে ঔষধ খেয়ে নাও। একা উঠতে পারবে তো? না পারলেও কষ্ট করেই উঠতে হবে। কারন তোমার শরীরে হাত দিলেই তুমি আবার উল্টাপাল্টা কথা বলবে। ”

” এই অসময়ে রুটি খেতে পারবনা। আপনি বরং ঔষধই দিন, আমি খেয়ে নিচ্ছি। আর আলতো করে আমাকে ধরুন। খবরদার গভীরভাবে ধরতে যাবেননা। ”

” মাফ করে দাও। তুমি নিজে নিজেই ওঠ। তোমার গায়ে হাত দেয়ার কোন ইচ্ছেই নেই আমার। তোমাকে দেখে ফিলিংসের বদলে রাগ হয় আমার। আর শোন, রুটি না খেলেও অন্তত ডিম ভাজিটা খেয়ে নাও। খালি পেটে ঔষধ খাওয়া ঠিক হবেনা। ”

আরমানের কথা শুনে রাগে শরীর রি রি করতে থাকে মাশিয়ার। মাথা ঘুরছে, পুরো শরীর ব্যথা করছে নয়তো আজ সে আরমানের কথার উপযুক্ত জবাব দিত। ঠোঁট কা’ম’ড়ে রাগ হজম করে উঠে বসার চেষ্টা করল। কিন্তু কিছুক্ষণ চেষ্টার পরও ওকে ব্যর্থ হতে হল।

” একটু ধরে তুলুন। আমি একা একা উঠতে পারছিনা। ”

আরমান বিরসবদনে মাশিয়াকে উঠে বসায়। এরপর মাশিয়াকে জোড় করে ডিম ভাজি খাইয়ে দেয়। ঔষধ খেয়েই মাশিয়া শুয়ে পরল। ওর মাথা দপদপ করছে।

বাকি রাতটুকু আরমানের ঘুম হলোনা। মাশিয়ার পাশে বসেই রাতটুকু কাটায়। মেয়েটা কখনো জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকেছে, তো কখনোবা ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লে একটু আরামবোধ করতেই আরমানকে খোঁ’চা দিয়ে কথা বলেছে৷ আরমান ওকে কিছু না বলে দাঁতে দাঁত চেপে সবটা সহ্য করে গেছে। সারারাত ও নিজেও ঘুমায়নি আবার আরমানকেও ঘুমাতে দেয়নি।

সকালের দিকে মাশিয়া ঘুমালে আরমান উঠে গিয়ে আয়েশা খানমের ঘরে গিয়ে শুয়ে পরল। তবে তার আগে মাশিয়ার কথা জানাতে ভুলেনা।

চারদিন পর পুরোপুরি সুস্থ হয় মাশিয়া। আরমান কিংবা ওর পরিবার কেউই মাশিয়ার সেবার কোন ত্রুটি রাখেনি। আরমান বাড়িতেই ডক্টর এনে মাশিয়ার চিকিৎসা করিয়েছে। মাশিয়ার পাশে বসে রাত জেগেছে। আয়েশা খানম রাতে মাশিয়ার সাথে থাকতে চাইলে আরমান না করে দিয়েছে। কারন তিনি নিজেই অসুস্থ। আরমান চায়না ওর আম্মা এসব করতে গিয়ে আরও অসুস্থ হয়ে পরুক।

চারদিন পর ঘর থেকে বেরিয়ে এসে শ্বাশুড়ির বারান্দায় থাকা চৌকিতে বসল মাশিয়া। মাথাটা মাঝেমধ্যেই চক্কর দিচ্ছে। তাই রিস্ক না নিয়ে দেয়ালে হেলান দিল।

আরমান হাতে কিছু একটা নিয়ে বাড়িতে ঢুকল। জিনিসটা মাশিয়া না চিনলেও বুঝতে পারল এটা চাষাবাদ করতে প্রয়োজন হয়।

মাশিয়াকে বারান্দায় বসে থাকতে দেখে আরমান ওর দিকে এগিয়ে যায়।

” এখানে বসে আছ কেন? ভেতরে গিয়ে রেস্ট নাও। আকাশে মেঘের আনাগোনা। যখন-তখন বৃষ্টি নামবে। বৃষ্টিতে ভিজলে আবারও অসুস্থ হয়ে যাবে। ”

” মাস্টার হওয়ার সুবিধা এটাই। যখন তখন যে কাউকেই জ্ঞান দেয়া যায়। আমিতো দেখতেই পাচ্ছি আকাশে মেঘ করেছে। বৃষ্টি আসার ভাব বুঝলে আমি নিজেই ভেতরে যাব। মহাজ্ঞানীর জ্ঞানের ঠ্যালায় আর বাঁচিনা। ” মাশিয়া মুখ বাঁকিয়ে বলল।

” তোমার সাথে কথা বলতে আসাটাই ভুল। তুমি হচ্ছ গিয়ে ঠ্যাটা একটা মেয়ে। থা’প্প’ড়’ই তোমার জন্য উপযুক্ত। যার কাছে থা’প্প’ড়’ই সকল অসুখের ঔষধ। তার কাছে অন্য কারো ভালো কথা খারাপ লাগবে এটাই স্বাভাবিক। ”

” এহ্ আবার জ্ঞান দেয়। অসভ্য মাস্টার। ” মাশিয়ার কথার মাঝেই মেঘের গর্জনে প্রকম্পিত হয় ফুলবাড়িয়া গ্রাম। মাশিয়া ভয়ে এক চিৎকার দিয়ে দৌড়ে ঢুকে যায় আয়েশা খানমের ঘরে। ছোটবেলা থেকেই ও মেঘের গর্জনকে ভয় পায়।

আরমানও চলে যায় বাড়ির পেছনের বাগানে।
পুরো বাড়িতে মাশিয়া একা। আয়েশা খানম বাহিরের উঠানে কিছু একটা করছেন। শশী তাকে সাহায্য করছে। সুধা কোচিং-এ গেছে। এদিকে হঠাৎই বজ্রপাত শুরু হয়েছে। মেঘের মুহুর্মুহু গর্জনে মাশিয়ার বুক দুরুদুরু করছে। ও ঘরের এক কোনে চুপটি মেরে ব’সে আছে। এদিকে হুট করেই লোডশেডিং শুরু হয়েছে। অন্ধকার ওকে গ্রাস করেছে। যত দোয়াদরুদ জানে মনে মনে সেগুলো পাঠ করছে।

আরমান বাড়িতে এসে মাশিয়াকে কোথাও দেখতে পেলোনা। ও ফোর্নের টর্চ অন করে আয়েশা খানমের ঘরে যায়। হাতের কাস্তে কাঠের বাক্সের ওপর রেখে ঘর থেকে বের হতে গিয়েই দেখল সামনের কোনে মাশিয়া জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। ওর চোখ বন্ধ। বিরবির করে কিছু একটা বলছে।

” এই যে সভ্য সমাজের ভদ্র মেয়ে, এখানে এভাবে বসে আছ কেন? তুমি জানোনা এই ঘরে অশরীরীরা বাস করে? তারা যদি তোমার শরীরে স্পর্শ করে কিংবা তোমার ঘাড় মটকে দেয় তখন কি করবে? ” আরমান ওর কথা শেষ করতে পারেনা মাশিয়া এক ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। উঠানে গিয়ে নামতেই আবারও কোথাও ব’জ্র’পা’ত হলো। আরমান তখন বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। ব’জ্র’পা’তে’র শব্দ শুনে মাশিয়া উঠানে দাঁড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল।

চলবে..

#যেখানে_দিগন্ত_হারায়
#পার্ট_২২
জাওয়াদ জামী জামী

মুর্হুমুহু বজ্রপাতে প্রকম্পিত ধরনী। আয়েশা খানম মাশিয়াকে নিজের সাথে ধরে রেখেছেন। ধরিত্রী কাঁপিয়ে প্রভঞ্জন দামামা বাজিয়ে নিজের অস্তিত্বের প্রমান দিতে তৎপর। সেই সাথে টিনের চালে করকাপাত আঘাত হেনে চলেছে অবিরাম।

আয়েশা খানম আল্লাহকে ডাকছেন। থেকে থেকে কেঁদে উঠছেন তিনি। সুধা, শশী চিন্তিত বদনে ঘরময় পায়চারী করছে। মাশিয়া বুঝতে পারছেনা ওর শ্বাশুড়ি কেন কাঁদছেন।

” আম্মা, আপনি কাঁদছেন কেন? আপনিও কি ঝড়বৃষ্টিকে ভয় পান? ” মাশিয়া একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করল।

” না গো, মা। আমি ভয়ে কাঁনতাছিনা। আমি কাঁনতাছি আমার ছেলের কথা ভাইবা। ছেলে আমার এই প্রথমবার ধান চাষ করছে। মাঠের ধানগুলান আর পনের দিন পরই কাটন লাগব। ইমুন ঝড়বৃষ্টি হইলে আধাপাকা ধানগুলান সব শেষ হইয়া যাইব। আমার আরমান পথে বসব গো, মা। ও আল্লাহ তুমি আমার ছেলেরে বাঁচাও। তুমি ঝড়বৃষ্টি থামায় দেও। দুনিয়াডারে শান্ত কর। ও সুধা, তুই আমার মা’য়ের কাছে আইসা বস। আমি আমার ছেলেডার কাছে যাই। আমার ছেলেডার চিন্তায় না কিছু হইয়া যায়। ”

মাশিয়ার চিৎকার শুনে আয়েশা খানম বাড়ির ভেতরে এসে দাঁড়াতেই শুরু হয় ঝড়বৃষ্টি। মনে হচ্ছে ঝড়ের তাণ্ডবে বুঝি বাড়িটাই ভেঙে পরবে। তখন থেকেই আয়েশা খানম মাশিয়াকে নিয়ে নিজের ঘরে বসে ছিলেন। ঝড়ের তাণ্ডব বাড়তেই তার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। টেনশন সইতে না পেরে তিনি এক সময় কেঁদেই ফেললেন।

ঘরের বাহিরে এসে আয়েশা খানম দেখলেন, আরমান চিন্তিত মুখে বারান্দায় বসে আছে। সে দেয়াল ঘেঁষে বসে আছে। তার উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টিতে শঙ্কার ছায়া। ঝড়বৃষ্টির দাপটে তার চুল এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টির ছাট এসে শরীর ভিজিয়ে দিয়েছে। ভিজে জুবজুবে আরমানের মন থেকে ভয়ডর যেন গায়েব হয়ে গেছে। নয়তো কেউ এই তাণ্ডবের সময় বাহিরে বসে থাকতে পারেনা।

” ও বাপ, তুমি এখানে এম্নে বইসা আছো কেন? ঘরে চল, বাপ। তুমি চিন্তা কইরনা, তোমার ফসলের কোন ক্ষতি হইবনা। আম্মার দোয়া তোমার সাথে আছে। ”

” ও আম্মা, শিলাবৃষ্টিতে যদি সব ধান নষ্ট হয়ে যায়, তবে আমাদের কি হবে! আমার বোনদুটো জীবন শুরুই করতে পারলনা। ওদের পড়াশোনা করাতে হবে, ওদের স্বপ্ন পূরণের সারথি হতে হবে আমাকেই। আজ মনে হচ্ছে, আমার একটা ভুল সিদ্ধান্তের জন্য ওদের অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। জব ছেড়ে দিয়ে আমি কি ভুল করলাম, আম্মা? ” আরমান টেনশন সইতে না পেরে বলল। ওর গলা ভারী শোনাচ্ছে। মনে হচ্ছে কান্না চেপে রেখে কথা বলছে।

” তুমি কোন ভুল সিদ্ধান্ত নেও নাই, বাপ। আমি সব সময়ই বিশ্বাস করি, আমার বাপে কোন ভুল করবান পারেনা। একটা কথা মনে রাইখো, আল্লাহ তার বান্দার ভালোর জন্যই সবকিছু করেন। আর তোমার আব্বা তোমাদের জন্য যা রাইখা গেছে, সেইগুলান দেইখাশুইনা খাইলেও তোতোমার কুনদিন অভাব হইবনা। তোমার দুই বোনরে লেখাপড়াও শিখাইতে পারবা, এমন ব্যবস্থা তোমার আব্বা কইরা রাইখা গেছে। তুমি এখন ঘরে চল। ভিজা কাপড় বদলায় নেও। ভিজা কাপড়ে এম্নে থাকলে, তুমিও অসুখে পরবা। ” আয়েশা খানম ছেলেকে টেনে ঘরের ভেতরে নিয়ে গেলেন।

কাপড় পাল্টে আম্মার ঘরে আসল আরমান। মাশিয়া তখনো জড়োসড়ো হয়ে বিছানায় বসে আছে। ওর দুই পাশে সুধা আর শশী বসে আছে।
মন ভালো না থাকায় মাশিয়াকে এই অবস্থায় দেখেও কিছু বললনা। সটান হয়ে শুয়ে পরল বিছানার এক পাশে। আরমানকে শুতে দেখে সুধা সরে গিয়ে শশীর পাশে বসল। সুধা সরে যেতেই আরমান আরেকটু জায়গা নিয়ে শোয়। ও প্রায় মাশিয়ার পাশ ঘেঁষে শোয়৷ মাশিয়া আরমানকে এভাবে দেখেও কিছুই বললনা।

আধাঘন্টা পর ঝড়বৃষ্টি থামলে আরমান কাজের ছেলেকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। ওর গন্তব্য ধানের ক্ষেত।

দুই ঘন্টা পর আরমান বাড়িতে আসলে আয়েশা খানম হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেলেন ছেলের কাছে। মা’কে দেখে আরমান মলিন হাসল।

” আম্মা, যতটুকু ক্ষতির চিন্তা করেছিলাম, তত ক্ষতি হয়নি। এখন শুধু দোয়া কর সামনের পনের দিন যেন কোন দুর্যোগ না হয়। তাহলে আর কোন চিন্তা থাকবেনা। ”

ছেলের কথায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন আয়েশা খানম।

রাতে বিছানায় গিয়ে মাশিয়াকে দেখে আরমান ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ।

” তুমি আজ থেকে সুধার ঘরে থাকবে। ঝড়বৃষ্টি দেখে তোমার যে অবস্থা হয়েছিল, তাতে আমার ভয় হচ্ছে। রাতে আবার যদি ঝড়বৃষ্টি হয়, তাহলেতো পুরো রাত তোমাকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকতে হবে। যেটা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তোমাকে জড়িয়ে ধরা আর কিং কোবরা কিংবা ব্ল্যাক ম্যাম্বাকে জড়িয়ে ধরা একই কথা। ”

” অসভ্য মাস্টার, মুখ সামলে কথা বলুন। বিকেলে চেহারা হয়েছিল আমসত্তের মত। যেই বিপদ উৎরে গেছে অমনি আমার পেছনে লেগেছে। আমি যদি কিং কোবরা কিংবা ব্ল্যাক ম্যাম্বা হই তবে আপনি ছুঁচো। আর ছুঁচো জন্যই সব সময় আমার সাথে ছুঁচোবাজী করেন। ”

” থা’প’ড়ে দাঁত ফেলে দেব, বেয়াদব মেয়ে। আমি অসভ্য হলাম কিভাবে? এতদিন ধরে আমার সাথে এক ঘরে থাকছ, কখনো তোমার সাথে অসভ্যতা করেছি? আর একদিন যদি তোমাকে অসভ্য বলতে শুনেছি, তবে সেদিনই তোমার সব দাঁত মুখের মায়া ত্যাগ করবে। ”

” বেশ করেছি অসভ্য বলেছি। আবারও বলব, একশোবার বলব, হাজারবার বলব। অসভ্য মাস্টার, অসভ্য মাস্টার, অসভ্য মাস্টার। একবার থা’প্প’ড় মে’রে দেখুন আম্মার কাছে আপনার নামে বিচার দেব। আমাকে বলে কিং কোবরা, ব্ল্যাক ম্যাম্বা! ছুঁচো একটা। কথায় কথায় থা’প্প’ড় দেয়ার ভয় দেখায়! আমাকে অবলা নারী পেয়ে যা খুশি তাই করতে চায়। ” মাশিয়া প্রচন্ড রেগে গেছে।

” কি বললে, তুমি অবলা! তুমি যদি অবলা হও, তবে আজ থেকে অবলার সংজ্ঞা পরিবর্তন হয়ে যাবে। তুমিও অবলা আর কিং কোবরাও নির্বিষ! ”

মাশিয়া পদে পদে আরমানের কাছে হেনস্তা হচ্ছে ও সেটা বেশ বুঝতে পারছে। আরমানকে কিছুতেই শায়েস্তা না করার আফসোস ওকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। এবারেও ও তেমনি আরমানের কাছে চরম হেনস্তা হয়ে শাস্তির খাতায় আরমানের নাম আরেকবার টুকে রাখল। যে খাতার হদিস ও ছাড়া কেউ জানেনা, আর জানতেও পারবেনা। যে খাতাটি সংরক্ষিত আছে ওর স্মৃতির গোপন কুঠুরিতে।

আকাশে এখনও মেঘের ঘনঘটা। যখনতখন দুনিয়া ভাসিয়ে আবারও বৃষ্টি নামবে। বিকেল ভর বৃষ্টি হওয়ায় শীতল আবহাওয়া বিরাজমান। মাশিয়া একটা কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পরল। তবে ওর মন-মস্তিস্ক আরমানকে গালি দিচ্ছে অবিরাম। আরমানকে গালি দিতে গিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে গেছে মাশিয়া। হঠাৎই ধরনী কাঁপিয়ে মেঘের গর্জন শোনা যায়। এমন আগ্রাসী গর্জনে মাশিয়া চমকে গিয়ে আরমানকে জড়িয়ে ধরল। আরমান মাশিয়ার পেছন ফিরে শুয়ে আছে। আচমকাই মাশিয়া ওকে জড়িয়ে ধরায় ও চমকে গেছে। ফলশ্রুতিতে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল।

” এই তুমি আমাকে এভাবে জড়িয়ে ধরছ কেন? ফাজিল মেয়ে, দিন দিন নির্লজ্জের খাতায়ও নাম লিখাচ্ছ দেখছি! ছাড় আমাকে। তিন হাত দূরে গিয়ে শোও। ” আরমান মাশিয়াকে ছাড়ানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়।

” এভাবেই থাকতে দিন, প্লিজ। আমার ভয় করছে। ” মাশিয়া কাঁপতে কাঁপতে বলল।

” তোমার যেখানে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই, সেখানে সেদিন রাতে আমাকে সাবধান করে দিলে! নাটক বাদ দিয়ে দূরে গিয়ে শোও। ”

” এমন ভাব করছেন যেন আমি আপনাকে রে’প করতে চাচ্ছি! নেহাৎই মেঘের গর্জনে ভয় পাই, তাই আপনার মত ফাজিল মাস্টারকে চিপকে আছি। কান খুলে শুনে রাখুন, রে’প করা মেয়েদের কাজ নয়। তাই নির্ভয়ে জড়িয়ে ধরতে দিন । ” মাশিয়ার কথা শুনে আরমান তব্দা খেয়ে গেছে।

” বেয়াদব মেয়ে এসব বলছে কি! এখানে রে’প করার কথা আসছে কোথায় থেকে! তুমি কি জানো, তোমার মন-মস্তিস্ক নষ্ট হয়ে গেছে? সন্দেহ তো আমার হচ্ছে তোমার ওপর। ”

” আমার মন-মস্তিস্ক নষ্ট হয়েছে তো কি হয়েছে, আপনারটা ঠিক থাকলেই হবে। আর তাছাড়া আমি ভালো করেই জানি, আর যাই করুন না কেন, কাউকে রে’প করার ক্ষমতা বা সাহস আপনার নেই। নয়তো কবেই আমি রে’প হতাম। শুধু থা’প্প’ড় মা’রা’তে’ই আপনার বিরত্ব, অন্য কিছুতে নয়। আমি আর যাই করিনা কেন কাউকে রে’প করার ক্ষমতা রাখিনা। সেই ক্ষমতা থাকলে আপনি এতদিন ভার্জিন থাকতেননা। অবশ্য আপনি ভার্জিন কিনা সেটা আমি জানিওনা। ”

মাশিয়ার কথা শুনে আরমানের শরীর অবশ হয়ে আসছে। মেঘের গর্জনে মাটির দোতলা ঘর থেকে থেকেই কেঁপে উঠছে। দক্ষিণের জানালা খোলা থাকায় হুহু করে শীতল মলয় আছড়ে পড়ছে ঘরের অভ্যন্তরে। বাতাসে এলোমেলো হয়ে যায় মাশিয়ার দীঘল কালো কেশরাশি। মলয়ের দাপটে তারাও মাতাল হয়ে ছুটোছুটি করছে। নিজের চোখেমুখে চুলের স্পর্শ পেতেই আরমান চোখ বন্ধ করল। ঠিক তখনই মাশিয়া নড়ে উঠল। আরমানের নাক দেবে গেছে চুলের ভেতর। একটা মিষ্টি গন্ধ দখল করে নিয়েছে আরমানের সত্তা। কারও চুলের ঘ্রানও যে এত অদ্ভুত হতে পারে তা জানা ছিলনা আরমানের। অজান্তেই ওর হাত মাশিয়ার কোমড় পেঁচিয়ে ধরেছে।

অম্বরে ঘনঘন বিজলির চমকে থেকে থেকেই ঘর আলোকিত হচ্ছে। অম্বরে যেন আলোকবাজির প্রদশর্ন চলছে। দূরে কোথাও বজ্রপাত হলো। ধরনীর সাথে সাথে কেঁপে উঠল মাশিয়া। আরমান ওকে আগলে নেয় বুকের ভেতর। মাশিয়া নিশ্চিন্তে শরীরের ভার ছেড়ে দিয়েছে আরমানের ওপর।

চলবে..