যেখানে পথচলা শুরু পর্ব-১০

0
241

#যেখানে_পথচলা_শুরু |১০|
#সাদিয়া_মেহরুজ

ইলি ক্ষুদ্ধ! মন অশান্ত তার। রাগের প্রকোপে নিজের সবথেকে পছন্দের কফি মগটা অব্দি ভেঙে চুরমার করেছে। তার এই বেসামাল রাগের কারণ ‘রাদিফ ‘। যখন শুনেছে তীরুর সাথে অসভ্য ছেলেটা এতোবড় বিশ্রী ঘটনা ঘটিয়েছে ঠিক তখনই ক্ষোভে আছড়ে পড়েছে! বড় বোনের এমন অপ্রকৃতিস্থের মতোন আচরণ দেখে উইলি বিষ্মিত! ইলি তীরু কে নিয়ে এতোটা ডেস্পারেট তা জানা ছিল না। প্রথমবারের মতো উইলি উপলব্ধি করল তার বোন অন্য কাউকে বেশি গুরুত্ব দিলে তার হিংসাত্মক মনোভাব জন্মায়! উইলি নিজেও অবশ্য তীরুর সাথে ঘটমান ঘটনাটি নিয়ে দুঃখ পেয়েছে। অমন শান্তশিষ্ট মেয়েটার সাথে এমন জ ঘ ন্য কাজ হয়েছে ভেবে তার একটুখানি খারাপ লাগছে।

দুই বোন যখন অন্তরালে নানানরকম চিন্তা করতে ব্যাস্ত তখনি শান্ত কক্ষে আগমন ঘটে তীরুর। উইলি সর্বপ্রথম তাকে খেয়াল করে। পরিপাটি তীরুকে লক্ষ্য করে বলে উঠে,

-” হ্যাই টীরু! ”

তীরু হাত নাড়িয়ে উইলিকে প্রতিত্তুর করে।

ইলি চেতনা ফিরে পেল। চট করে মাথা তুলে তাকাল ও। তীরুকে দেখে মৃদু হেঁসে উঠে দাঁড়াল। ঝটপট এগোল তীরুর নিকট। বলল,

-” হেই গার্ল, আই মিস ইউ সো মাচ। ”

তীরু স্বাভাবিক গলায় উত্তর দেয়, ” মিস ইউ টু। ”

ইলি আর কি বলবে তা খুঁজে পেল না। এমনি সময় কথার টপিকের অভাব থাকে না। কিন্তু এখন? এই সময়টা তো ভিন্ন! তীরুকে কি তার সান্ত্বনা জানানো উচিত? সান্ত্বনা জানালে যদি মেয়েটার পূর্বের কথা স্বরণ হয়ে খারাপ লাগা কাজ করে? কিয়ৎক্ষণের মাঝেই দ্বিধাদ্বন্দে ভুগতে থাকা ইলিকে উদ্ধার করে তীরু। ও বলে,

-” গাইজ আমি হোস্টেল ছেড়ে দিয়েছি। ”

উইলি, ইলি চমকাল! ইলি ছটফটিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

-” ছেড়ে দিয়েছ মানে? হোস্টেল ছেড়ে যাবে কই? তোমার তো কোনো আত্নীয় নেই এখানে তাই না! ”

এইটুকু বলে ইলি থামল। হটাৎ মনে পড়ে যাওয়া ভঙ্গিতে পুনরায় শুধাল,

-” ওহ হ্যা তুমি তো বলেছিলে যেদিন তোমার পরিক্ষা শেষ হবে সেদিন তোমার হ্যাজবেন্ডের বাসায় যেতে হবে। তুমি কি ওখানেই যাচ্ছো?”

তীরু ইশারায় ‘ হ্যা ‘ বলল। আঁধার নেমে এলো ইলির মুখোশ্রী জুড়ে। মেয়েটা চলে যাবে ভাবতেই বুক ভার ভার লাগছে। কেমন এক অদৃশ্য শূন্যতা অনুভূত হচ্ছে। তীরু চলে গেলে সে যে বড্ড একা হয়ে পড়বে!

তীরু স্বাভাবিক। এখন অনেকটা শান্ত হয়েছে তার অন্তঃকরণ।স্বাভাবিক হয়েছে তখনি যখন অরোনের বুকে আছড়ে পড়ে বেকুবের মতো কান্না করছিল! কি যে লজ্জা পেয়েছিল তখন! রাস্তায় এতো এতো মানুষের মাঝে এত্তো বড় একটা মেয়ে হয়ে কেমন গরুর মতো কাঁদছিল। সেখান থেকে যখন পুলিশ স্টেশনে গেল তখন থেকে বাকি সময়টা শক্তপোক্ত হয়ে আঁটসাঁট বেঁধে বসেছিল। অরোনের সাথে আর কথা হয়নি। মূলত লজ্জা, সঙ্কোচ কাজ করছিলো। তবে তীরু যতই শক্ত হওয়ার চেষ্টা করে না কেন তার অক্ষিপটে বারংবার ভেসে বেড়ায় সেই দৃশ্য, যখন রাদিফ তাকে বা জে ভাবে স্পর্শ করেছিল। আহ্! সেই নিষ্ঠুর সময়টা তীরু যদি রাবার দিয়ে মুছে ফেলতে পারত তবে কতই না ভাল হতো! কিন্তু আফসোস তা কখনোই সম্ভব না।

পোশাক গোছানো শেষ প্রায়। এবার বইখাতা ব্যাগে রাখার পালা। ইলি সাহায্য করছে তীরুকে মনমরা হয়ে। উইলি মৌন হয়ে বসে। কাপড়চোপড় গোছাতে গোছাতে অতিষ্ঠ তীরু! মনে মনে ভারী বিরক্ত হলো অরোনের ওপর। আজই চলে যাওয়ার কি আছে? বাসায় ছেড়ে যাওয়ার সময় হটাৎ অরোন তার পথ রোধ করে শক্ত গলায় বলে দিল, আজ তাকে নাকি শশুরবাড়িতে যেতেই হবে! কঠিন গলা। তীরু কেন যেন না করতে পারল না। ছেলেটার গলায় অদ্ভুত একটা জোর ছিল, চোখের দৃষ্টি কঠোর ছিল! না আর করা হলোই না তার।

ইলি আচানক ম্লান কণ্ঠে বলে উঠলো, ‘ আমায় ভুলো না টীরু। ”

ইলির কণ্ঠটা কেমন নির্জীব, নিষ্প্রাণ শোনাল! কাজ ফেলে তীরু চট করে তাকাল। দেখল ইলিকে। কিয়ৎ বিচলিত হয়ে শুধাল,

-” তোমাকে ভোলা অসম্ভব ইলি! এমন মন খারাপ করে আছো কেন? আমাদের ভার্সিটিতে তো প্রতিদিনই দেখা হবে। ”

-” ভার্সিটিতে দেখা হলে কি হবে? এইযে রাতের বেলা আড্ডা দিতাম, একসাথে ডিনার করতাম। উইন্টারে মধ্যরাতে ব্যাডমিন্টন খেলতাম তা তো আর হবে না। ”

ইলির এ কথার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু বলার মতো খুঁজে পেল না তীরু। কি বলবে? তার নিজেরও তো ভীষণ খারাপ লাগছে! মেয়েটার সাথে আর আগের মতো সময় অতিবাহিত করা যাবে না। তা ভাবলেই তো চট করে মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে তার!

অরোন ব্যাস্ত ভঙ্গিমায় হাত ঘড়িতে নজর বুলাল। অলরেডি পঁচিশ মিনিট হয়ে গেছে। এখন নিচে কেন নামছে না মেয়েটা? অদ্ভুত তো! অস্থিরতা নিয়ে পায়চারি ধরল। তার কারো জন্য অপেক্ষা করতে ভাল লাগে না। ‘ অপেক্ষা ‘ জিনিসটা তার কাছে বিরক্তিকর! হাঁটার মাঝেই খেয়াল অরোন খেয়াল করল তীরু আসছে। পেছনে দু’টো মেয়ে। একজন ব্যাগ নিয়ে আসছে আরেকজন মাথা নুইয়ে। অরোন সামনে এগিয়ে গেল।

-” আমার কাছে দিন ব্যাগ। ” অরোন ইলিকে বলল।

ইলি তৎক্ষনাৎ অরোনের নিকট ব্যাগ দিয়ে দেয়। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তীরুকে। কান্না পাচ্ছে তার! গলায় দলা পাকিয়ে রয়েছে কান্নার কুণ্ডলী। কান্না চেপে রেখে ও নম্র গলায় বলে উঠলো,

-” ভালো থেকো তীরু। সৃষ্টিকর্তা তোমার মঙ্গল করুক। সবসময় সুখে থেকো। ”

তীরু কথা বলতে পারল না। শক্ত করে কেবল ধরে রইল ইলিকে। অক্ষিকোটরে জল জমে! তীরু তাদের গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ার আদেশ দিল না। অসহায় অশ্রুমালা তাই আর অক্ষিকোটরের বাহিরে আসার সাহস পেল না। কেবল পড়ে রইল নিজ স্থানে চুপটি করে।

_

-” ক্লান্ত লাগছে? ”

তীরু অন্ধকার থেকে দৃষ্টি সরাল। তাকাল সম্মুখে। ঘর্মাক্ত দেহ নিয়ে অরোন দাঁড়িয়ে। তীরুর দেখে বেশ মায়া লাগল। ছেলেটার কপাল চুইয়ে ঘাম পড়ছে। এতো কিসের ব্যাস্ততা, ছোটাছুটি ছেলেটার?

-” উঁহু। বসেই তো আছি ক্লান্ত লাগবে কেন? ”

অরোন পাশে বসল। পকেট থেকে টিস্যু বের করে কপাল মুছল। নোংরা হয়ে যাওয়া টিস্যুটা ডাস্টবিনে ফেলে তারপর জবাব দিল।

-” বসে থাকাতেও ক্লান্তি আছে। এটা অবশ্য অন্য রকম ক্লান্তি। একাধারে অনেকক্ষণ বসে থাকলে বিরক্ত লাগে! এটাকে ‘ বিরক্তির ক্লান্তি ‘ বলে। ”

তীরু আড়মোড়া ভাঙল। প্রসঙ্গ পাল্টে জিজ্ঞেস করল,

-” গাড়ি ঠিক হতে কতক্ষণ লাগবে? ”

-” এইতো আর বিশ – পঁচিশ মিনিট। ”

তীরু তপ্তশ্বাস ফেলে। আরো বিশ – পঁচিশ মিনিট? মাই গড! চল্লিশ মিনিট যাবৎ বসে সে। ধৈর্যে কুলাচ্ছে না আর। ও অধৈর্য্য গলায় বলল,

-” আপনার ফ্রেন্ডের গাড়ি ফিরিয়ে দেননি কেন? ”

জবাব এলো শীতল কন্ঠে, ” গাড়িটা আমার তীরু। যেদিন ফ্রেন্ডের গাড়ি নিয়ে আপনাকে রিসিভ করতে গিয়েছিলাম তখন আমার গাড়িটা দুলাভাই নিয়ে প্যারিসের বাহিরে গিয়েছিল। তাই ফ্রেন্ডেরটা নিয়ে আপনার কাছে গিয়েছিলাম। ”

তীরু ছোট্ট করে উত্তর দিল, ” অহ আচ্ছা। ”

গাড়ি ঠিক হতেই পাঁচ মিনিটের মাথায় বাড়ি ফিরে আসে তারা। বাড়িটা খালি খালি লাগছিল তীরুর। এখানে মূলত অরোন ছাড়া আর কেওই থাকে না। বাড়িতে কোনো সার্ভেন্ট নেই। নিজের কাজ নিজেই করে অরোন।

সিঁড়ি বেয়ে উঠে অরোনের রুমের দিকে যেতে নেবে তখন হুট করে অরোন চাপা গলায় বলে,

-” ওদিকে না এদিকে আসুন। ”

তীরু কিয়ৎ চমকাল! অরোনের রুমে তাহলে কি সে থাকবে না? অরোন তীরুকে নিয়ে এলো একটা ফাঁকা রুমে। যেখানে বেড ব্যাতীত আর কিছুই নেই। ফ্যালফ্যাল করে প্রশ্নবিদ্ধ নয়নে তাকাল তীরু। অরোন তখন নম্র গলায় বলল,

-” এখন এই বাড়িটা আপনারাও। সংসারটা আপনার। নিজের সংসার কিভাবে সাজাবেন তা আপনার ইচ্ছে! আপনারও তো কোনো ইচ্ছে – শখ থাকতে পারে। তাই এই রুমটা ঠিক করেছি। নিজের মতো করে গুছিয়ে নেবেন। আমার বেডরুমটা তো আমি আমার শখ অনুযায়ী সাজিয়েছি। আমাদের বেডরুমটা নাহয় আপনার শখ অনুযায়ীই গোছানো হোক! ”

তীরু মুগ্ধ নয়নে পরখ করল অরোনকে। ছেলেটা ভীষণ অন্যরকম। একটুখানি অদ্ভুত বটে তবে বেশ দায়িত্ববান।

চলবে~