#যেখানে_পথচলা_শুরু
#সাদিয়া_মেহরুজ
১১ .
গরম পড়েছে ভীষণ। অতিরিক্ত গরমে নাস্তানাবুদ তীরু। তাদের নতুন রুমটায় এসি নেই। সেট করা হয়নি এখনো। মাত্রাতিরিক্ত গরমের জ্বালাতনে তীরু এই রাতের বেলা গোসল করেছে একপ্রকার বাধ্য হয়েই! হাতের ভেজা টাওয়ালটা ব্যালকনিতে মেলে দিয়ে তীরু চঞ্চল পায়ে রুমে এসে বসলো। তপ্ত শ্বাস ফেলে বিছানায় এলিয়ে দিল দেহ। ক্লান্ততা আষ্টেপৃষ্টে ঝাপটে ধরেছে তাকে। অবসন্ন মনে চোখ দুটো মুদে নিতেই ও খেয়াল করে শুনল পদশব্দ। কেও আসছে এদিকটায়। এই সময় কে এলো?
অরোন রুমের বাহিরে দাঁড়িয়ে ঠকঠক শব্দ করলো দরজায়। হাঁক ছেড়ে ডেকে উঠলো,
-” তীরু, তীরু! ”
তীরু ঝট করে উঠে বসল। গায়ের ওড়নাটা টেনে – টুনে ঠিক করে জবাব দিল,
-” ভেতরে আসুন। ”
পা বাড়ায় অরোন। দরজাটা খুলতেই চক্ষু সম্মুখে ভেসে ওঠে তীরুর স্নিগ্ধ মুখোশ্রী। টপটপ করে পানি পড়ছে চুল থেকে। ফ্লোর ভিজে একাকার! দৃশ্যটা দেখামাত্র কপালে বলিরেখার উদয় হলো অরোনের। মেয়েটা তো দেখছি ধারণার থেকেও বড্ড বেশি কেয়ারলেস!
-” লোক এসেছে। এসি লাগাবে। কষ্ট করে আপনি আমার রুমে গিয়ে একটু বসুন। বেশি দেরি লাগবে না। ” ভাবনা ঠেলে চট করে বলে উঠলো অরোন।
তীরুর বুক চিঁড়ে বেড়িয়ে এলো লম্বা দীর্ঘ নিঃশ্বাস। তার ছোট্ট বাচ্চাদের মতো হাত – পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে এখন কাঁদতে বসতে ইচ্ছে করছে। জেদ ধরে বলতে মন চাইছে, যাবো না আমি। দূর হোন আপনি! বলা হলো না। সে বাধ্য মেয়ের ন্যায় রুমটা থেকে বেড়িয়ে এলো কেবল ধীরস্থ পায়ে।
অরোনের রুমে এসে আশপাশ না দেখে তীরু ফের বিছানায় এলোমেলো হয়ে শুয়ে পড়লো।ঘুমিয়েই পড়েছিল কিন্তু কিয়ৎক্ষণ বাদে অরোনের একাধারে ডাকাডাকিতে বিরক্ত হয়ে চোখ খুলে চেঁচাল,
-” হয়েছেটা কি? ঘুমোতে দিন না আমায়। দোহাই লাগে। ”
অরোন অদ্ভুত নজরে তাকাল। নম্র গলার স্বর এবার গম্ভীর শোনাল।
-” উঠুন তীরু। খেতে হবে। ”
প্লেট শব্দ করে টি – টেবিলে রেখে অরোন বের হয়ে যাচ্ছিল। যেতে যেতে ভারী বিরক্তি ধরা গলায় বলে উঠলো,
-” মনে হচ্ছে ছোট একটা বাচ্চাকে বিয়ে করেছি। বিরক্তিকর! ”
তীরু! অবাধ্যতা যার রক্তে মিশে। সেই মেয়েটাই কেন যেন অরোনের ব্যাপার আসতেই আর অবাধ্য হতে পারে না। অদ্ভুত সুন্দর লোকটার সব কথা তার মানতে ইচ্ছে করে। কি আশ্চর্যজনক ব্যাপার! তীরু কে তবে স্বামী পাগল বউ হয়ে গেল নাকি? উঁহু! অরোনটাই এমন। এই ছেলেটার অবাধ্য কারোরই হতে বোধহয় ইচ্ছে করবে না।
খাবার হিসেবে তীরুকে দেয়া হয়েছে বাগেট। ফ্রুট কাস্টার্ড, অরেঞ্জ জুস আর একটা ডিম। রাতের বেলা এখানে মূলত এসবই খাওয়া হয়। ‘ বাগেট ‘ প্যারিসের একটি জনপ্রিয় খাবারের মধ্যে পড়ে যা আসলে দেখতে অনেকটা লম্বা পাউরুটির মতোন। এমন লম্বা শক্ত পাউরুটি খেতে যে এতোটা দারুণ সুস্বাদু হয় তীরু তা প্রথম যেদিন দেখেছিল তখন ভাবেনি একবারও। খাওয়াদাওয়া করতে বেশি সময় লাগেনি তার। খাবার শেষ হতেই তীরুর চট করে মনে পড়ল অরোনের কথা। ছেলেটা খেয়েছে কিনা তা জিজ্ঞেস করা হলো না! কি বি শ্রী কান্ড! জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল না একবার?
রুমের বাহিরে বেরুলো তীরু। উপরতলাটা ধু ধু করছে। কেমন গা ছমছমে পরিবেশ। আঁধারে ছেয়ে থাকা করিডর দেখে তীরুর গা কেঁপে উঠল। সারা জীবন মানুষের মাঝে থেকে আসা তীরু এখন আর ফাঁকা, বিরান পরিবেশ মেনে নিতে পারেনা। কষ্ট হয় তার! কেমন ভয় ভয় লাগে। একাকী অনুভূত হয়। আর তীরু জীবনে একটা জিনিসকেই প্রচন্ড ভয় পায়। তা হচ্ছে ‘ একাকীত্ব ‘!
নিচতলায় আসার পর তীরুর দর্শন মিলে অরোনের। ছেলেটা সোফায় মাথা এলিয়ে চোখ বুঁজে আছে। দেখে মনে হচ্ছে রাজ্যের ক্লান্তি নেমে এসেছে তার মুখোশ্রীতে। মায়া হলো তীরুর, ভীষণ! ও এগোল। জড়তা নিয়ে অরোনের কাঁধে হাত রেখে নম্র গলায় শুধাল,
-” অরোন শুনছেন? ”
ঝট করে চোখের পল্লব উন্মুক্ত করে তীরুর পানে চাইল অরোন নিজের অদ্ভুত সুন্দর চোখ দু’টি দিয়ে। প্রশ্ন ছুড়ল,
-” খেয়েছেন? ”
ঘন ঘন মাথা নেড়ে সায় জানায় তীরু। বলে,
-” আপনি খেয়েছেন? ”
-” খেয়েছি। আমি এখন ঘুমোব। আপনি কি জেগে থাকবেন আরো সময়? ”
-” না আমিও ঘুমোতেই যাচ্ছিলাম। ”
অরোন উঠে দাঁড়াল। বলল না কিছু। হাঁটার গতি তার কিয়ৎ অস্বাভাবিক ঠেকল তীরুর নিকট। কণ্ঠ স্বরটাও কেমন যেন ছিল। তার মনে হলো, ছেলেটা অসুস্থ!
বিছানায় শুয়ে পড়তেই কেমন অস্বস্তি ঘিরে ধরলো তীরু কে। শ্বাস রুখে আসতে চাইল। জীবনে প্রথম একজন পুরুষের সাথে বেড শেয়ার করে ঘুমোচ্ছে! অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। ভাল লাগছেনা তীরুর নিকট। পাশ ফিরে শুতেই ফোন বাজল। তীরুর না! অরোন উঠে ফোন হাতে নেয়। ক্ষণে অরোনের মুখোশ্রী জুড়ে শোভা পাওয়া গম্ভীরতা উবে যায়। কেমন উজ্জ্বল হয়ে ওঠে মুখোবয়ব। কৌতূহলী হয় তীরু। কে ফোন দিল? কার জন্য অরোনের মুখোশ্রীর এই পরিবর্তন?
-” আব্বা ভাল আছেন? ” অরোন হেঁসে শুধাল।
তীরুর বোধগম্য হলো কলদাতা ব্যাক্তি কে! তবে লহমায় ফের অরোনের মুখোশ্রী জুড়ে আঁধারের রাজ শুরু হয়। অস্পষ্ট মলিনতা ছেয়েঁ যেতে থাকে আস্তে- ধীরে। ও টের পাচ্ছে, অরোন নিচু গলায় আকুতি মিনতি করছে! অনুরোধ জানাচ্ছে। কিন্তু কি? তা অস্পষ্ট। তীরুর অন্তঃকরণে চিন্তার উপদ্রব হলো। মনে করল পিছে ফেলে আসা দিন গুলোর কথা। তার মনে আছে, ফুপি বলে ছিল অরোনের বদলে যাওয়ার কারণ, অদ্ভুত বিষন্নতার কারণটা ‘ পরিবার ‘। সে ভেবেছিল অরোনের মা অর্থাৎ তার শাশুড়ী মা রা যাওয়ার ঘটনায় অরোনের এরূপ অবস্থা। কিন্তু আজ, আজ মনে হচ্ছে তার ধারণা ভুল! গড়বড়টা হয়ত অন্য কোথাও রয়েছে।
অরোন ফোন কেটে এসে তীরুর পাশে শুয়ে পড়ে। কতক্ষণ অস্থির মনে এপাশ – ওপাশ করে। ঘুমোয় না! অরোনের ঘন ঘন নড়াচড়াতে তীরুর ঘুমে ব্যাঘাত ঘটছে। ও চোখ খুলে। জিজ্ঞেস করে,
-” কিছু কি হয়েছে? ”
অরোন কপাল থেকে হাত সরাল। তাকাল তীরুর পানে। আকাশে আজ মস্ত বড় থালার মতো চাঁদ উঠেছে। সেই চাঁদের আলো এসে পড়েছে তীরুর পুরো গা জুড়ে! অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে অরোন। হয়ে যায় অবিন্যস্ত। নিজেকে দমিয়ে রাখার শত চেষ্টা তার বিফলে যায়। জ্বরাক্রান্ত চোখে তীরুকে পরখ করতে করতে এগিয়ে যায় সন্নিকটে। নিজের উতপ্ত দেহের সাথে নমনীয় তীরুকে মিশিয়ে নিয়ে উদ্ভ্রান্তের ন্যায় বলে,
-” আমায়.. আমায় একটু ছুঁতে দাও তোমাকে তীরু। সত্যি বলছি একটুখানি স্পর্শ করব। শান্তি চাই আমার। জাগতিক কষ্ট থেকে কিছুক্ষণের জন্য মুক্তি চাই। ”
অরোনের দেহ অস্বাভাবিক উত্তপ্ত। জ্বরে গা পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে! নিভু নিভু চোখে তাকিয়ে তীরু। কিছু বলার সুযোগ হয়না তার। বলা বাহুল্য সে সুযোগ অরোন তাকে দিলোই না। তীরু চুপ রয়। কথা বলে না। তবে ভেতরে বইছে তার গ্রীষ্মের ঝড়।
চলবে~
#যেখানে_পথচলা_শুরু |১২|
সাদিয়া মেহরুজ
অরোনের মন উচাটন! হাসঁফাসঁ করছে। অস্থিরতা যেন অস্থিমজ্জায় গেঁথে গিয়েছে তার। গলা শুকিয়ে কাঠ! পানি খেয়েও বিশেষ লাভ হচ্ছে না। ধৈর্যহারা হয় অরোন। চেয়ার ছেড়ে পায়চারি শুরু করে। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ক্ষোভ নিয়ে আপনমনে শুধায়,
-” কিভাবে, কিভাবে আমি এতটা নি কৃ ষ্টে র মতো কাজ করতে পারলাম কিভাবে? আল্লাহ! ”
কাল রাতের ঘটনা অরোনকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। য ন্ত্র ণা দিচ্ছে ভীষণ। অপরাধবোধে মন সংকীর্ণ হয়ে আছে তার। অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটা অবশ্য পূর্ণতা পায়নি। তার পূর্বেই অরোন ছিটকে সরে এসেছিল। গুটিশুটি হয়ে থাকা তীরুকে সরি টরি বলে রাতেই বেড়িয়ে গিয়েছিলো বাসা থেকে। রাতটা কেটেছে তার বিরান সড়কে। জ্বরাক্রান্ত দেহ নিয়ে রাস্তাতেই বসে ছিল। নিজেকে ধিক্কার জানাচ্ছিল বারংবার। অক্ষিপটে ভেসে উঠছিল তীরুর ভীত মুখোশ্রী। যা অরোনকে করেছে ক্ষ ত বি ক্ষ ত! মেয়েটার সাথে এ কি করে বসলো? এতোটা পাষাণ তো অরোন নয়। তীরুটা নিশ্চয়ই এখন তাকে অমানুষ ভাবছে। থাক ভাবুক! ভাবাই উচিত! এই কাজের পর তো তাকে অমানুষের কাতারেই ফেলতে হয়।
বিপ! বিপ! প্রখর শব্দ। অরোন পদচারণ থামালো। কপাল চুইয়ে পড়া ঘাম টিস্যু দিয়ে চটপট মুছে নিল। কেও ভেতরে আসার অনুমতি চাচ্ছে। অরোন তাকে ভেতরে প্রবেশ করার অনুমতি দিয়ে চেয়ারে বসলো। সামনে তাকাতেই খেয়াল করলো ম্যানেজারকে। ও কৃত্রিম হাসল। জিজ্ঞেস করলো,
-” হ্যালো এলেন! কি অবস্থা? ”
এলেনের হাত ভর্তি ফাইলে ঠাসা। সে আস্তে ধীরে হেঁটে এসে ফাইল রাখল টেবিলে।
-” সব ভালো স্যার। ” ঝরঝরে হাসি দিয়ে নিজের মাতৃভাষায় প্রতিত্তুর করে এলেন। একটুখানি থেমে পুনরায় যোগ করে,
-” স্যার ফাইলগুলো একটু দেখে দিলে ভালো হতো। এ মাসের হিসাবনিকাশের তথ্য রয়েছে। তাছাড়া কিছু অর্ডারও করা হয়েছে। তারও হিসাব এখানে আছে। আপনি দেখে সাইন করে দিলে ভাল হতো। ”
ফাইল হাতে নিতে নিতে অরোন শুধায়,
-” ওকে। সাইন করে দিব। তুমি এখন যেতে পারো। ”
এলেন জায়গাটা ছেড়ে চলে যায়। অরোন চেষ্টা করে কাজে মনোনিবেশ করার। সকাল থেকে এ পর্যন্ত তার সময় কেটেছে অস্থিরতায়! আজ কাজের কাজ কিছুই করেনি বলতে গেলে। হাত ঘড়িতে সময় দেখে নিয়ে চটজলদি ফাইলের পিপীলিকার ন্যায় ছোট্ট ছোট্ট অক্ষর গুলোতে চোখ বুলায়। বিকাল হয়েছে। সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরা দরকার। কাল থেকে নিরুদ্দেশ সে! একবার বাসার খোঁজ খবর নেওয়া প্রয়োজন।
_
বাড়ির পেছনটা ভূতুড়ে। যতদূর চোখ যায় কেবল ঝোপঝাড়ই নজরে পড়ে। বড় বড় গাছপালা গুলো বাতাসে নৃত্য করে শো শো শব্দ করে অদ্ভুত ভুতুড়ে শব্দের আবির্ভাব ঘটায়। ভূমিতে ঠাসা ঠাসা পাতা। যেন ম রা পাতার গালিচা। সোনালি রৌদ্দুর সেই পাতায় কিরণ ফেলে দ্যুতি ছড়ায়। বেশ কিছু পাইন ট্রি কে টে ফেলা হচ্ছে। কেন কাটা হচ্ছে তা তীরুর জানা নেই। এখন তো ক্রিসমাস সিজনও না তবুও কেন তারা গাছ গুলো কে টে নিয়ে যাচ্ছে তা জানা নেই কারও! প্যারিসে খুব বেশি প্রয়োজন না হলে গাছ কা টা হয়না। এখানে অকারণে গাছ কা টা গুরুতর পাপ! অকারণে গাছ কা ট তে দেখলেই তাকে ধরে কঠিন শাস্তি দেয়া হয়।
তীরু কন্ঠের খাদ নামিয়ে প্রশ্ন করল,
-” ওরা গাছ কাটছে কেন প্রিয়? ”
প্রিয় ফুল গাছে পানি দিচ্ছিল। তীরুর প্রশ্ন শুনে কাজ থামিয়ে সে সন্নিকটে এগোল। সামনের দৃশ্য দেখে বলে উঠলো,
-” সম্ভবত ক্রিসমাস ট্রি তৈরি করার জন্য। ”
-” কিন্তু ক্রিসমাস তো ডিসেম্বরে না? এখন তো কেবল মাত্র মার্চ মাস চলছে। ”
-” হ্যা কিন্তু ওরা ক্রিসমাস আসার আগেই ওদের সুপারশপে ক্রিসমাস ট্রি তৈরি করে সাজিয়ে রাখে। সরকার থেকেও অনুমোদন নিয়েছে ওরা। ”
তীরু ঠোঁট বাঁকায়। ” অদ্ভুত তো! ”
প্রিয় বাংলাদেশী। থাকত অরোনদের গ্রামেই। প্রায় একবছর হতে চলল সে প্যারিসে এসেছে। অরোনই এনেছে তাকে। ছোটবোনের মতো স্নেহ করে সে প্রিয় কে। তাদের পরিবারের দুরবস্থা দেখে প্রিয় এবং ওর সমবয়সী ভাই অন্তিককে অরোনের সাথে নিয়ে যাওয়ার শক্তপোক্ত আবদার করে বসে ওদের মা। অরোন অবশ্য নিয়ে আসতে চাইছিল না। বলেছিল দেশেই ভালো একটা কাজের ব্যাবস্থা করে দেবে কিন্তু প্রিয়র মা শুনলে তো! সেই থেকে প্রিয় আর অন্তিক এখানে থাকে। অন্তিক অরোনের রেস্টুরেন্টে কাজ করলেও প্রিয়কে অরোন কাজ করতে দেয়নি বাহিরে। ও বলতে গেলে ফ্রীতেই থাকে এ বাড়িতে। মাঝেমধ্যে অরোন খুব বেশি রাতে বাড়ি ফিরলে রাতের রান্নাটা সে নিজেই করে। ব্যাস! এই তার কাজ।
-” ভাবী তোমার চুল থেকে তো পানি পরছে। চুল মুছো জলদি। ”
অবেলায় গোসল করেছে তীরু। পুরো দিনটা তার কেটেছে ব্যাস্ততায়। রুম সেটআপ করার কাজ শেষ হয়েছে কিয়ৎ পূর্বে। প্রিয়কে পাঠিয়েছে অরোন তার কাজে সাহায্যের জন্য। আরো দু’জন অবশ্য ছিলো সঙ্গে তবে তারা পুরুষ। ভারী জিনিসপত্র সেটআপ করে তারা চলে গিয়েছে দুপুরেই। বাকি সময়টা প্রিয় কে সঙ্গে করে কেটেছে তীরুর। অলস হাতে চুল ছুঁয়ে তীরু নম্র গলায় বলল,
-” ভাগ্যিস তুমি ছিলে প্রিয়। নয়ত এখন হয়তোবা দাঁড়ানোর শক্তিটা অব্দি পেতাম না। ”
প্রিয় একগাল হাসল। বলল,
-” এখন থেকে প্রতিদিন আমাকে পাবে ভাবী। এই কয়েকদিন একটু ঘোরাঘুরির ওপর ছিলাম। অরোন ভাই জোর করে ঘুরতে পাঠালো। অবশ্য আমার অনেকদিনের শখ জানো ভাবী? পুরো প্যারিস ঘুরে দেখব। অরোন ভাইয়ের জন্য শখটা পূরণ হলো। ভাইয়া যে আরো কতো ঋণি করবে আমাদের। সেই বার যখন বাবা পঙ্গু হয়ে গেলেন। আমাদের পরিবার এর হাল ধরার মতো এক আমি আর অন্তিক। দেশে চাকরি পাচ্ছিলাম না মন মতো। পড়াশোনাটা করা হয়নি নিম্নবিত্ত বলে। ঐ সময়ে শহর ছেড়ে গ্রামে এলাম। দেখা হলো অরোন ভাইয়ের সাথে। চলে এলাম এখানে আমি আর অন্তিক। আল্লাহ তায়ালা ভালই রেখেছে এখন ভাবী। বাবার চিকিৎসা চলছে, মাকে তিনবেলা খাওয়াতে পারছি। আর কি চাই জীবনে? অরোন ভাই আমার মতো এমন অনেক মানুষকে গ্রাম থেকে নিয়ে এসে নিজের রেস্টুরেন্টে কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছেন। আমাদের মতো অসহায় মানুষ গুলোর জীবনে চলার মতো একটা পথ তৈরি করে দিয়েছেন। ভাইয়ের কাছে আমরা সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকব ভাবী। তুমি খুব ভাগ্যবান মানুষ জানো তীরু ভাবী? অরোন ভাইয়ের মতোন একটা ভালো মানুষ আল্লাহ তোমার কপালে লিখে রেখেছেন। ”
প্রিয় থামল একটু। দম ফেলে পুনরায় বলল,
-” অবশ্য অরোন ভাইয়াও লাকি। তোমার মতো একজন ভালো মানুষ পেয়েছে বলে কথা। ”
তীরু বলল না কিছু। কেবল মৃদু হাসল! ভেজা চুলে তোয়ালে লাগিয়ে আনমনে ভাবতে লাগল অরোনের কথা। অমনি মনে পড়ল তার কাল রাতের ঘটনাটা। অরোন যখন তাকে কাছে টেনে নিতে গিয়ে ছিটকে দূরে সরে সরি বলে চট করে রুম ছেড়ে পালালো! সে মূর্হতে তীরু যারপরনাই অবাক হয়েছিল। তবে সত্যি বলতে স্বস্তিও পেয়েছিল কারণ অরোনের সাথে অতটা ঘনিষ্ঠতার জন্য তার অন্তঃকরণ প্রস্তুত ছিল না। তীরু উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটা ধরল। ছেলেটার সাথে তার আজ দেখা হয়নি একবারও। কোথায় আছে অরোন? আসবে কখন? কাল রাতে যখন ছেলেটা ছুটে রুম থেকে বেড়িয়ে গেল তখন আর তীরু খোঁজ করেনি তার। সকাল বেলা ফাঁকা বাড়ি মিলেছে। তার কিয়ৎক্ষণ পর প্রিয়র আগমনে তীরু বেমালুম ভুলে বসেছিল অরোনের কথা।
_
মাঝরাতে ঝট করে উঠে বসল তীরু। চোখ লেগে এসেছিল তার। অরোনের অপেক্ষাতে ছিল। ঘড়িতে সময় দেখে বুঝল প্যারিস এখন মধ্য রজনীতে ডুবো প্রায়। ও চটজলদি বিছানা ছাড়ল। রুম তো খালি। অরোনের ফেরার কথা তো এতক্ষণে। ছেলেটা তবে কি রুমে আসেনি? গেল কোথায় অদ্ভুত!
তীরু গেল অরোনের রুমে। সেখানেই পাওয়া গেল অরোনকে। শুয়ে আছে। ঘুমোচ্ছে বোধহয়। তীরু দরজা চাপিয়ে চলে যেতে নিবে তৎক্ষনাৎ চাপা কন্ঠের আ র্ত না দ বাড়ি খেল তার কর্ণকুহরে। পা বাড়াল ও। বসল অরোনের নিকটে। গায়ে হাত দিতেই বুঝল অরোনের হাড়কাঁপানো জ্বর এসেছে পুনরায়। তীরুর তখন মাথায় হাত! এতো জ্বর লোকটার আর সে কিনা পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছিল! উঠে দাঁড়িয়ে প্রয়োজনীয় জিনিস আনতে যাবে তখন হটাৎ অরোনের বিড়বিড়ানো শুনে তার পদচারণ স্তব্ধ হলো। অরোন তখন যন্ত্রের মতো আওড়াচ্ছে,
-” বাবা মাকে মা রে নি। বাবা মাকে মা রে নি। ”
চলবে~