যেখানে মন হারায় পর্ব-০৫

0
12

#যেখানে_মন_হারায়
#হামিদা_আক্তার_ইভা_Hayat

৫.
বারান্দার পাশে বসে আছে রুহা। লম্বা চুল ছড়িয়ে দিয়ে বসে আছে মেঝেতে। ইলমা বেগম কোলের কাছে একটা নারকেল তেলের শিশি রেখে আদর করে চুলে তেল দিয়ে দিচ্ছেন। বাতাসে মিশে আছে কাঁচা নারকেল তেলের ঘ্রাণ আর মায়ের স্নেহ। হঠাৎ রুহা মুখে হাত দিয়ে বলে ওঠে,

“মা একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”

ইলমা বেগম চুলে আলতো করে তেল দিতে দিতে বললেন,
“হুম, বল মা।”

“সংসার জীবনে টাকাটাই কি সব মা? মানে… মানুষজন বলে না, টাকা ছাড়া সংসার চলে না,তবেই সুখ আসে।”

এক মুহূর্ত চুপ করে থাকেন ইলমা বেগম। হাতের তালুতে আরেকটু তেল নিয়ে মাথার মাঝে লাগাতে লাগাতে ধীরে ধীরে বলেন,

“সংসার টাকায় চলে ঠিকই, কিন্তু টাকায় সংসার টিকে না মা।জীবনসঙ্গী যদি ভালো না হয়, যদি সম্মান না করে, ভালোবাসা না থাকে… তাহলে কোটি টাকার সংসারও একদিন ভেঙে পড়ে।
একটা নারী যখন রাতের খাবার শেষে শান্তিতে ঘুমাতে পারে, তখন বুঝতে হবে, তার স্বামী তার সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা।”

“তাহলে আমি যদি কাউকে বিয়ে করি, টাকা দেখে করব?”

“টাকা দরকার মা, কিন্তু সেটা মুখ্য না।
যার চোখে তোর সম্মান আছে, যে তোর হাত শক্ত করে ধরবে ঝড়ের মধ্যেও,তাকেই জীবনের পাশে রাখিস।”

রুহা আলতো হেসে বলে,
“বুঝেছি মা! তাহলে যার চেহারা সুন্দর, গাড়ি আছে, ব্যাঙ্কে টাকা আছে, কোকা-কোলা খাওয়ায় তাকেই না করব?”

ইলমা বেগম হেসে কপালে টোকা দিয়ে বললেন,
“ঐ জন্যই বলি, তোর মাথায় শুধু দুষ্টুমি!
তেল দিচ্ছি আর ভিতরে ঢুকছে কেবল ঠাট্টা!”

দুজনেই হেসে ফেলে। রুহা হালকা হেসে মায়ের কোলে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে। বাতাসে ভেসে আসে মায়ের মমতা আর জীবনের গভীরতা।কী আছে এই ভাগ্যে?

পরের দিন সকাল বেলা নাবিল অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিল নিজের ঘরে।রুহা পা টিপে টিপে ভাইয়ের ঘরের সামনে এসে দেখল ভাই তৈরি হতে ব্যস্ত।সে হালকা গলায় শব্দ করতেই ভেতর থেকে নাবিল বলল,
“কটকটি রাণী আবার কী চাই?”

রুহা নাক কুঁচকে ঘরে ঢুকল।বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে আবার মাথা নিচু করে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোমার বিছানা এত উঁচু কেন?আমার পা ঝুলছে দেখেছ?”

নাবিল আড়চোখে রুহার পায়ের দিকে তাকাল।তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
“বিছানা ঠিকই আছে,বরং তুই দেড় ফুট।”

রুহা ভাইয়ের অপমানে কান না দিয়ে বলল,
“একটা কথা হঠাৎ মাথায় এলো জানো?আপু আর তোমার এক্স গার্লফ্রেন্ডের নাম কিন্তু সেম।আপুর নামও রিফা আর তোমার প্রাক্তন প্রেমিকার নামও রিফা।”

নাবিল হঠাৎ থমকে গেলো।বুকের বা পাশটায় কোথায় যেন হালকা চিনচিনে ব্যথা অনুভব হলো।নাবিল কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
“রিফা তুই ডাকিস তা ছাড়া সবাই বোনকে রাইমা বলেই ডাকে।”

“সে যাইহোক,একটা নিউজ পেয়েছি শুনতে চাও?”

“না বললে চুপ থাকবি তুই?”

রুহা পায়ের জুতা খুলে বিছানায় পা উঠিয়ে বসলো।ভাইয়ের দিকে দৃষ্টি রেখে এক দমে বলল,
“পরশু রিফা আপুর সাথে দেখা হয়েছিল কলেজে যাওয়ার সময়।আপু বলল সামনেই নাকি উনার বিয়ে।”

নাবিলের ভাব ভঙ্গি বুঝা গেলো না।রুহা চোখ ছোটো ছোটো করে তাকিয়ে রইলো ভাইয়ের গম্ভীর বদনে।বাড়ির সব গুলো পুরুষ’ই বোধহয় করল্লা ভীষণ পছন্দ করেন।সবার মুখ তেতো হয়ে থাকে।রুহা বিরক্ত হলো ভাইয়ের উপর।নাবিল ফোন প্যান্ট এর পকেটে ভরে অফিস ব্যাগ হাতে নিয়ে ঘরের বাইরে বের হতে হতে বলল,
“ভালো খবর,তাই বলে আমাকে বলছিস কেন এসব?তোর বিয়ে খাওয়ার হলে চলে যাস।”

নাবিল হনহন করে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে।রুহা নাক মুখ কুঁচকে বসে রইল সেখানেই।পুরুষ মানুষ আসলে চায় কী?ভালোও বাসবে আবার অবহেলাও করবে।
..
শেখ বাড়ির সকালটা আজ যেন একটু আলাদা।
কলিং বেলটা একটানা বাজছে।
ইলমা বেগম রান্নাঘর থেকে এপ্রোন মোছার ভঙ্গিতে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। দরজা খুলেই এক মুহূর্ত থেমে গেলেন তিনি।
দরজায় দাঁড়িয়ে আছে রাইমা। কোলের ভেতর বাহার বাবু—অর্ধঘুমে চোখ, ঠোঁটে আধো আধো বকবক,
“নানি আইতি..মা নানি?”

ইলমা বেগম অবাক হয়ে বলেন,
“এই সকাল সকাল? বাবা তো এসেছেন দুদিন, কিন্তু…”

রাইমা হেসে উঠে বলে,
“আসতে পারছিলাম না মা… আজ ভাবলাম আর না।”

কথার ভেতরেও ক্লান্তি। চোখের নিচে হালকা কালি, মুখে মেকআপের সামান্য প্রলেপ—কিন্তু যেনো কোনোকিছুই ঢেকে রাখতে পারছে না সেই চিরচেনা ক্লান্ত মুখ।বাহার বাবু তখন কোল হাতড়ে হাতড়ে মায়ের গলা টেনে বলছে, “নানু কুই? কুই কুই কুই?”

ইলমা বেগম আদর করে ছেলেটাকে কোলে নিলেন, “এই যে নানু! আয় খোকা, আয়…”

দুই বছরের বাহার বাবু এখনো স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারে না। কিছু শব্দ বারবার করে। আধো বুলি দিয়েই তার ভুবন গড়া। কিন্তু শেখ বাড়ির সবাই যেন এই আধো ভাষার মধ্যেই মায়া খুঁজে পায়।
রুহা বারান্দা থেকে ছুটে এলো।
“বাহার বাবু আসছিস? ”

বাহার চোখ বড়ো বড়ো করে তাকাল,
“কুলে নিও!”

রুহা হেসে উঠল।হাত বাড়িয়ে বাহারকে কোলে নিয়ে গাল ভরে চুমু খেল।তবে হাসির ভেতরেও ইলমা বেগম একবার রাইমার মুখের দিকে তাকালেন। সেই মা, যার চোখ জানে সন্তানের মুখ দেখে মন পড়তে।
কামরুল শেখ তখন পেছনের সোফা থেকে উঠে এলেন,
“দুইদিন হয়ে গেলো এসেছি,দেখা করতে এলি না যে?”

“মাফ করে দাও আব্বু… অনেক দিন হয়ে গেলো আসি না।ব্যস্ত ছিলাম খুব।”

কামরুল শেখ কিছু না বলে শুধু কপালে হাত রাখেন। বাবা-মেয়ের চোখে চোখ পড়ে যায় এক মুহূর্ত।

রুহার ঘরের জানালায় স্ল্যাব গ্লাস দিয়ে হালকা আলো পড়েছে। কিচেন থেকে ভেসে আসছে লেবু পাতার গন্ধ। বাহার বাবু পাশের খাটে শুয়ে আছে। খেলনার ভেতর থেকে একটা ছোটো পুতুল নিয়ে ফিসফিস করে বলছে,
“মাম্মা… টু টু পাপা…”

রুহা চুপচাপ বসে আছে। আর তার পাশে বসে আছে রাইমা। আজকে যেন কোনো মুখোশ নেই। চোখে জল, কাঁপা গলায় সে বলছে,

“রুহা… আমি আর পারছি না। ছয়টা বছর। ছয়টা বছর ধরে আমি শুধু চুপ করে সংসার করে যাচ্ছি।”

রুহা চমকে তাকায়,
“কি বলছিস?”

“সে আমাকে মানুষ বলে মনে না। ছোটো ছোটো বিষয়ে মারধর, গালি… এমনকি বাহারকেও ঠিকমতো ভালোবাসে না। ছেলের জন্মদিনে বাসায় থাকেনি… আর কিছুদিন আগে একটা গরম প্লেট ছুঁইয়ে দিয়েছে আমার হাতে… শুধু চা ঠাণ্ডা কেন হয়েছে, এই জন্যে।”

রুহা কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থাকে। যেন কানেই আসছে না এই কথাগুলো।

“তুই কখনো কিছু বলিসনি… আমাদের কিছু বুঝতেই দিসনি।”

রাইমা মাথা নিচু করে।

“জানিস, আমি ভয় পাইনি। লজ্জা পেয়েছি। যেনো আমি ব্যর্থ, আমি পারিনি ঘর সামলাতে। এখন বাহারকেও নিয়ে ভাবি। ও যেন ওর বাবার মতো না হয়,কিন্তু কোথায় পালিয়ে যাব বল তো?”

রুহা ধীরে ধীরে বোনের হাত ধরে। কিছু বলার মতো শব্দ তার কাছে নেই। শুধু চোখে চোখ রেখে বলে,
“দুলাভাই তোর গায়ে হাত তোলে?”

রাইমা কেঁপে ওঠা নিঃশ্বাস ফেলল।
“রুহা আমি কাউকে বলি না, কারণ জানি, কেউ আমাকে বাঁচাতে পারবে না। কেবল শুনে কষ্ট পাবে। মা-বাবা হয়তো ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে যাবে।”

কণ্ঠ ভারী হয়ে আসে তার।
“ওর রাগের কোনো সীমা নেই। অনেক সময় মাঝরাতে ধাক্কাতে ধাক্কাতে ঘুম থেকে উঠিয়ে চিৎকার,ঝগড়া করে। একদিন বাহার অসুস্থ ছিল, আমি হাসপাতালে ছিলাম… ফোন ধরতে পারিনি… বাড়ি ফিরে দেখি সব বাসন মেঝেতে ভাঙা। বলেছে, ‘তুই যদি আমার কথা না শুনিস, তোরেও দরকার নাই, তোর এই বাচ্চাকেও না।’”

রুহা শ্বাস আটকে শুনছে।
“বাহার তখন এত ছোট ছিল… কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়েছিল আমার বুকের ওপর। আমি শুধু চুপ করে ওকে আঁকড়ে ছিলাম।”

রাইমা আবার বলে,
“সবচেয়ে কষ্ট হয় যখন দেখি, ও বাহারের দিকে তাকিয়েও কখনো মমতা দেখায় না। আমার বাচ্চাটা বাবার ভালোবাসা কী জিনিস, তা জানেই না। একবার বাইরে সবাই ছিল, তখন বাহার ‘বাবা’ বলে ডাকলো—ও শুধু তাকিয়ে ছিল, কোনো সাড়া দিল না।”

রুহার চোখ ভিজে উঠল।
“আপু… তুই এগুলো এতদিন একা সহ্য করছিস?”

রাইমা মাথা নেড়ে বলে,
“সহ্য করা ছাড়া আমার হাতে কিছু নেই। আমি ভেবেছিলাম হয়তো সময় গেলে বদলাবে, কিন্তু এখন জানি, কিছু মানুষ কখনো বদলায় না। আমি শুধু চেষ্টা করি, বাহারের জন্য হাসি ধরে রাখতে, যাতে ও বুঝতে না পারে।”

রুহা আস্তে করে বোনের কাঁধে হাত রাখল—
“তুই যতদিন চাইবি, আমি কাউকে কিছু বলব না,কিন্তু তুই আর চুপ থাকবি না।এভাবে একজন কাপুরুষের সংসার করা সম্ভব?”

বাহার বাবু তখন আধো ঘুমে হাত বাড়িয়ে মায়ের গলা জড়িয়ে বলল,
“মা… মাম্মা… বাহার বাবু বালো।”

রাইমা বুকের ভেতর বাচ্চাটাকে চেপে ধরল, যেন ওর সব নিরাপত্তা আর ভালোবাসা এক জায়গায় দিতে চাইছে।রুহা চুপচাপ তাকিয়ে রইল—জানল, এই আলিঙ্গনের ভেতরেই রাইমা বেঁচে আছে।
কামরুল শেখ নিজে ছেলে দেখে বিয়ে দিয়েছিলেন রাইমার।বাবার পছন্দ মতোই হাজার স্বপ্ন নিয়ে বিয়ে বসেছিল ঐ কাপুরুষের সাথে।টাকা পয়সা দেখে মেয়ের বিয়ে দিয়ে নিজের কাঁধ হালকা করেই যেন কামরুল শেখ মেয়ের খোঁজ খবর নেয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি।আজ বিয়ের ৬টা বছর কেটে গেছে অথচ বাবা একবারও জিজ্ঞেস করেননি স্বামী কেমন?শ্বশুর বাড়ির মানুষজন কেমন?

বাহার বাবু মায়ের বুকে চোখ বুজেছে।রুহা বোনের ব্যথাতুর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,

“কিছুই কি ঠিক হবে না?”

রাইমা নিঃশব্দে হেসে মাথা নাড়ল। সেই হাসি কেমন জানি ভাঙা,
“তুই তো জানিস, বাবা সবসময় বলে—‘বিয়ের পর মেয়ের আসল ঘর স্বামীর ঘর।’ আমি যদি কিছু বলি, উনি হয়তো বলবেন, আমি সংসার সামলাতে পারিনি।”

রুহা গলা শক্ত করে বলল,
“তাহলে বাবা ভুল। মেয়ের ঘর হলো সেই জায়গা, যেখানে সে নিরাপদ। সেটা স্বামীর ঘর হোক বা বাবার—যেখানে তোকে সম্মান দেয়া হবে, সেখানেই তোর ঘর।”

রাইমার চোখ ভিজে ওঠে। সে বাহারকে বুকের কাছে আরও জোরে টেনে নেয়, যেন এই ছোট্ট শরীরটাই তার শেষ আশ্রয়।
“আমি শুধু চাই, বাহার যেন এইসব সহিংসতা দেখে বড়ো না হয়। আমি চাই না ওর ভেতর রাগ জমে থাকুক, চাই না ও ভাবুক, মায়ের ওপর হাত তোলা স্বাভাবিক।”

রুহা গভীর নিঃশ্বাস ফেলল। তার ভেতর রাগ আর অসহায়তা মিশে গেছে।
“আপু, তুই চাইলে আমি এখনই গিয়ে মায়ের সাথে কথা বলি?”

রাইমা তাড়াতাড়ি মাথা নাড়ল,
“না! মা জানলে কষ্টে মরেই যাবে। উনি ভেতরে ভেতরে গলতে শুরু করবেন। আমি তা দেখতে চাই না। আমি চাই মা যেন ভাবে, আমি সুখে আছি,অন্তত উনার বয়সের এই সময়ে শান্তি পাক।”

এক মুহূর্ত চুপচাপ থাকে দু’জনেই। ঘরের বাইরে বারান্দায় পাখির ডাক শোনা যায়, আর দূরে রান্নাঘরে ইলমা বেগম থালা-বাসন ধোয়ার শব্দ। বাইরের দুনিয়ায় সব স্বাভাবিক, কিন্তু এই ঘরে যেন এক টুকরো ভাঙা পৃথিবী বসে আছে।

রাইমা আস্তে করে বলে,
“রুহা… আমি জানি না আমার ভবিষ্যতে কী হবে। আমি শুধু চাই, যদি কোনোদিন আমি ভেঙে পড়ি, তুই যেন আমার হাত ধরে রাখিস। আমি চাই না, বাহার বাবু একদিন আমার মতো একা হয়ে যাক।”

রুহা বোনের হাত নিজের হাতে শক্ত করে চেপে ধরল,
“আপু, আমি তোর হাত কখনো ছাড়ব না।”

রাইমা চোখ মুছল। বাহার তখন আধো ঘুমে হালকা গলায় বলল,
— “মা… নানি… কুই কুই?”

দু’জনেই তাকিয়ে রইল ছেলের দিকে। রাইমা গালে চুমু দিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“নানি আছেন, আর মা-ও আছে।”

খানিক আগেই মুরসালীন তার শেষ প্রাইভেট পড়িয়ে বাড়ি ফিরেছে। ঘরের আলো-আঁধারিতে মা নাসরিন হয়তো রান্নাঘর গুছোচ্ছে, নিচতলার বারান্দায় নাবিল ফোনে কথা বলছে। আর ছাদে—পুরো আকাশটাকে একলা নিজের করে নিয়ে বসে আছে রুহা।

চুপচাপ।
চোখ তার স্থির, কিন্তু মনে বোন রাইমার কথাগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে। “মেয়েদের হাসি যত রঙিন হোক, বিয়ের পরে তা গুমোট হয়ে যায়।”—এই লাইনটাই যেন কানে ধ্বনিত হচ্ছে বারবার।
হালকা শীতল বাতাসে ওড়নার কোণা উড়ে গিয়ে কাঁধ থেকে পড়ে আসে। রুহা টেরও পায় না।

মুরসালীন সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে আসে। হাতে পানির বোতল, চোখে সেই গম্ভীর ভাব। রুহাকে দেখে ভ্রু কুঁচকে বলে,
“বাঁচাল, আজ চুপচাপ কেন? “

রুহা আস্তে মাথা তোলে, মুরসালীনকে একবার দেখে আবার আকাশের দিকে তাকায়। কণ্ঠ ভারী, কিন্তু চোখে জেদ,
“মুরসালীন ভাই, পুরুষ মানুষ কিসে আঁটকায়?”

মুরসালীন হঠাৎ থেমে যায়।
“মানে?”

রুহা এবার সরাসরি তাকায়।
“যাকে ভালোবাসা হয়, তাকে আগলে রাখতে কী কী করতে হয়? সংসার কিভাবে হয়? শুধু রান্না-বান্না, কাপড় কাচা দিয়ে হয়? নাকি আর কিছু লাগে?”

মুরসালীন তার প্রশ্ন শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। মুখে স্পষ্ট বোঝা যায়, এই ধরনের কথোপকথন রুহার কাছ থেকে আশা করেনি।
“ সংসার শুধু কাজ দিয়ে হয় না। ভরসা লাগে, ধৈর্য লাগে… আর সবচেয়ে বড়ো কথা, দু’জনকেই চাইতে হয় একে অপরকে।”

রুহা ঠোঁট কামড়ে হাসার চেষ্টা করে, কিন্তু চোখে জল চিকচিক করে ওঠে।
“তাহলে যদি একপক্ষ চাইতে না পারে?”

মুরসালীন কিছু বলার আগে রুহা আবার আকাশের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলে,
“আমার মনে হয়, মেয়েরা যতই আগলে রাখুক, যদি পুরুষ মানুষ ক্লান্ত হয়ে যায়… তখন কিছুই থাকে না।”

মুরসালীন রুহার শেষ কথাটা শুনে চুপ হয়ে যায়।
তার মুখে গম্ভীরতা আগেও ছিল, কিন্তু এবার যেন কিছু ভেতরে দোলা খেল।
পানির বোতলটা হাতের আঙুলে ঘুরাতে ঘুরাতে সে দূরে তাকায়।কথা বলার আগে শ্বাস নিতে হয় যেন।

“ক্লান্ত হওয়া মানেই শেষ হয়ে যাওয়া না। কিন্তু যদি কেউ চাইলেই ছেড়ে দেয়, তাহলে বুঝবি, সে তোকে কখনো আঁকড়ে ধরতে চায়নি।”

রুহা আঙুল দিয়ে চেয়ারের হাতল ঘষতে থাকে, গলায় ফিসফিস স্বর,
“তাহলে ভালোবাসা এত ভঙ্গুর কেন? এত সহজে কেন হারিয়ে যায়?”

মুরসালীন এবার রুহার দিকে সরাসরি তাকায়। চোখে অদ্ভুত একটা দৃঢ়তা, যেন তার নিজেরও কিছু না বলা গল্প আছে।
“ভালোবাসা ভঙ্গুর না… মানুষ ভঙ্গুর। যাদের ভেতরে শক্তি নেই, তারা সামান্য ঝড়েই ভেঙে পড়ে। আর যারা সত্যি চায়… তারা আঁকড়ে ধরে রাখে, যতই কষ্ট হোক।”

রুহার চোখ ভিজে ওঠে, সে তাড়াতাড়ি মুখ ঘুরিয়ে ফেলে যেন মুরসালীন না দেখে।
মুরসালীন ধীরে ধীরে বলে,
“সংসার রান্নাঘরে না, সংসার হয় মন আর মন মিলিয়ে। যদি দু’জনের একজনও ফাঁকা থাকে… ওই ঘরটাও ফাঁকা হয়ে যায়।”

কিছুক্ষণ কেউ কথা বলে না।
শুধু ঠান্ডা বাতাস, ছাদের সীমানায় আছড়ে পড়া রাতের নীরবতা, আর আকাশে আধচাঁদের আলো,সব মিলিয়ে মুহূর্তটা ভারী হয়ে ওঠে।

মুরসালীন হঠাৎ নরম গলায় বলে,
“সবাইকে আঁটকানো যায় না, রুহা। কিছু মানুষকে ছেড়ে দিতে হয়।”

রুহা ধীরে মাথা নাড়ে, কিছু বলে না।
তার মনে যেন নিজের জন্যও, বোনের জন্যও উত্তর খুঁজে ফেরার যুদ্ধ চলছে।

খানিকক্ষণ নীরবতার পর রুহা বলে,
“মুরসালীন ভাই,আপনার কাছে ভালোবাসা মানে কী?”

প্রশ্নটা শুনে মুরসালীন এক মুহূর্ত থেমে যায়। হাতে ধরা পানির বোতলটা পাশে রেখে ধীরে ধীরে রুহার পাশে এসে বসে। ছাদের ওপরে বসা চাঁদের আলোতে তার চোখে এক অদ্ভুত স্থিরতা।

“ ভালোবাসা?ভালোবাসা মানে এমন একজনকে খুঁজে পাওয়া, যে তোর সব খুঁত, তোর সব ভুল, তোর সব রাগ—সব জেনেও তোর পাশে থাকে।
যে মানুষ তোর হাসির চেয়ে তোর কান্নার কারণ বেশি মনে রাখে, যাতে তুই আবারও হাসতে পারিস।
ভালোবাসা মানে… তুই ভুল করলে তোর দিকে আঙুল না তুলে, তোর হাত ধরে পথ দেখানো।
আর ভালোবাসা মানে… তুই যত দূরেই থাকিস না কেন, তার দোয়ায় তোর নাম থাকবেই—তুই জানতেও পারবি না।”

রুহা মন দিয়ে শুনছিল। ঠোঁট সামান্য কাঁপছে, যেন কিছু বলবে আবার থেমে যাচ্ছে।
“ তাহলে যে মানুষ ভালোবাসে, সে কি সবসময় আগলে রাখে?”

“আগলে রাখা মানে সবসময় পাশে বসে থাকা না।কখনো কখনো দূরে থেকেও আগলে রাখা যায়।
যেমন… চাঁদ সাগরকে ছুঁতে পারে না, তবুও তার ঢেউ নিয়ন্ত্রণ করে।
ভালোবাসা অনেকটা তেমনই—দূরে থেকেও তোর জন্য শান্তি এনে দেয়া।”

“ যদি কেউ ইচ্ছে করেই ছেড়ে দেয়?”

“ তাহলে বুঝবি, সে ভালোবাসতে জানতই না।
যে ভালোবাসে, সে আঁকড়ে ধরতে জানে।”

হাওয়ার দমকা এসে রুহার চুল উড়িয়ে দেয়। মুরসালীন একবার তার দিকে তাকায়।
ছাদের নীরবতায় যেন তাদের কথাগুলো ভেসে থাকে—অর্ধেক উচ্চারিত, অর্ধেক নীরব।

রুহা হঠাৎ নিচু স্বরে বলে,
“আপনি কখনো কাউকে হৃদয় দিয়ে ভালোবেসেছেন?”

মুরসালীন কিছুক্ষণ চুপ থাকে। তারপর ঠান্ডা গলায় বলে,
“ভালোবাসা,এই শব্দটা সবাই বলে, কিন্তু সবাই অনুভব করে না। কারও কাছে এটা অভ্যাস, কারও কাছে শখ, আর কারও কাছে কেবল সময় কাটানোর উপায়।”

রুহা তার দিকে কৌতূহলী চোখে তাকায়।
“তাহলে আপনার কাছে ভালোবাসা মানে?”

মুরসালীন একটু ভেবে উত্তর দেয়,
“আমার কাছে ভালোবাসা মানে… দায়িত্ব। কারও জন্য নিজের স্বপ্ন, নিজের স্বাচ্ছন্দ্য, এমনকি নিজের অহংকারও ত্যাগ করার ক্ষমতা। ভালোবাসা মানে শুধু বলার বিষয় নয়— এটা প্রতিদিন প্রমাণ করার বিষয়। ভালোবাসা মানে সুখে-দুঃখে পাশে দাঁড়ানো, এমনকি সে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিলেও তার জন্য অপেক্ষা করা।”

রুহা মুগ্ধ হয়ে শোনে, তারপর ধীরে বলে,
“মানে… আপনি যদি কাউকে ভালোবাসেন, তার ভুল-ত্রুটি, রাগ, অভিমান সব সহ্য করবেন?”

মুরসালীন হালকা হাসে,
“সহ্য করব না, বরং বুঝব। কারণ ভালোবাসা মানে পরিবর্তন নয়, গ্রহণ করা।”

রুহা কিছুক্ষণ চুপ থাকে, তারপর তার চোখের কোণে যেন অদ্ভুত আলো ঝলকে ওঠে।
“তাহলে কি আপনার জীবনে এমন কেউ আছে,যাকে আপনি এভাবে ভালোবেসেছেন?”

মুরসালীন তার দিকে তাকায়, চোখে এক মুহূর্তের জন্য থমকে থাকা অনুভূতি ভাসে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মুখ ফিরিয়ে নেয়।
“কিছু কথা বলার জন্য নয়, অনুভব করার জন্যই জন্মায়!”

#চলবে…?