যেখানে মন হারায় পর্ব-০৬

0
12

#যেখানে_মন_হারায়
#হামিদা_আক্তার_ইভা_Hayat

৬.

সিলেটের শীতের শহরের সকাল গ্রামাঞ্চলের শান্তির চেয়ে আলাদা একধরনের ব্যস্ত অথচ কোমল আবহ নিয়ে আসে।
ভোরবেলাতেই কুয়াশা পুরো শহরটাকে এক ধূসর চাদরে ঢেকে রাখে। রাস্তার লাইটগুলো তখনও মৃদু আলো ছড়ায়, আর সেই আলো কুয়াশার ভেতর দিয়ে যেন সোনালি কুণ্ডলী হয়ে ভেসে বেড়ায়। ফুটপাতের চায়ের দোকানে বড় বড় কেটলিতে গরম চা ফুটছে, ধোঁয়া মিশে যাচ্ছে কুয়াশার সাথে। ঠান্ডা থেকে বাঁচতে রিকশাওয়ালারা মোটা সোয়েটার আর গলায় মাফলার জড়িয়ে একে অপরের সাথে গল্প করছে, যাত্রী খুঁজছে।

শীতের সকালে শহরের শব্দও যেন নরম হয়ে আসে,গাড়ির হর্ন কম শোনা যায়, মানুষের কথাবার্তা ধীর লয়ে চলে। দোকানের সামনে ভাজা সমুচা আর গরম সিঙ্গাড়ার গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে, আর অফিসগামী মানুষেরা কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে, কোটের কলার তুলে তাড়াহুড়ো করে রাস্তায় হাঁটে।
শেখ বাড়ির ভোর সকাল কিছুটা অন্যরকম।ছোটো থেকে বড়ো,প্রত্যেকটা মানুষ এই সময়ে জাগ্রত থাকে।নরুল শেখ,মুরসালীন,নাবিল,আফনান এবং কামরুল শেখ নামাজে গিয়েছিলেন।রুহা নামাজে দাঁড়িয়ে আবার কম্বলের নিচে ঢুকেছে।এখন একটু চোখ না বন্ধ করলে পরীক্ষা দিতে পারবে না।আজ ক্লাসটেস্ট আছে।তাও আবার মুরসালীনের।

রুহার পাশে বাহার বাবু শুয়ে আছে।অন্যপাশে রাইমা শুয়ে আছে।বাহার বাবু খালার শরীরটা আঁকরে ধরতে ব্যস্ত।ছোটো শরীর টেনে টুনে খালার শরীরের উপর নিয়ে এলো।রাইমা ভ্রু কুঁচকে ছেলের কাণ্ড দেখছে।বাহার রুহার গালে ছোটো ছোটো চুমু এঁকে বলল,
“উত্ত কালা উতো না?”

রুহা ঘুমু ঘুমু চোখে বাহারকে নিজের উপরে দেখে বলল,
“আব্বা ঘুমাতে দে।”

“উতো উতো।”

রুহা ঝাঁপটে জড়িয়ে ধরে কম্বলের নিচে নিয়ে গেলো বাহারকে।বুকের সাথে শক্ত করে চেপে ধরে বলল,
“ঘুমা রামুর বাচ্চা।জ্বালালে তোর খবর আছে।”

রাইমা বোনের পাশে একটু চেপে এসে বাহারকে ছাড়িয়ে এনে বলল,
“খাল বজ্জাত হয়েছে বুঝলি বাহার?তোর খালার কাছে আর যাবি না।”

বাহার ছলছল চোখে রুহার বদনপানে তাকিয়ে বলল,
“কালা পঁচা।”

রুহা মুখ ভেঙ্গাল।আড়মোড় ভেঙে বিছানায় উঠে বসল।
“আজ আর ঘুম হলো না তোর বিচ্ছুর জন্য।”

“নামাজের পর আবার ঘুমাতে হয়?ঐ সময় একটু পড়তে পারিস না?”

“পড়া?বাড়িতে এমনিতেই মাস্টারের অভাব নেই,এখন তুইও মাস্টারগিরি করিস না আপু।”

রুহা বিছানা থেকে নেমে ফ্রেশ হয়ে এলো ওয়াশরুম থেকে।কিছুক্ষণ পড়ার টেবিলে বসে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল রাইমা এবং বাহার ঘুমিয়ে গেছে।সে দরজা খুলে বাইরে বের হলো।নিচে নেমে দেখল নাসরিন বেগম ও ইলমা বেগম রান্না ঘরে কাজে ব্যস্ত।রুহা রান্না ঘরে আসতেই ইলমা বেগম বললেন,
“চার কাপ রং চা বানিয়ে বাবাদের দিয়ে আয় রুহা।”

রুহা লক্ষ্মী মেয়ের মতন চার কাপ চা বানিয়ে প্রথমে বাবার ঘরে গেল।বাবাকে চা দিয়ে চাচাকে এক কাপ চা দিয়ে এলো।আর বাকি দুই কাপ নাবিল ও মুরসালীনের।রুহা নাবিলের ঘরে চা দিয়ে এসে মুরসালীনের ঘরে নক করল।খানিকক্ষণ পর মুরসালীন দরজা খুলতেই রুহা চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে বলল,
“আপনার চা।”

মুরসালীন চায়ের কাপ হাত নিতে না নিতেই রুহা উল্টো ঘুরে হাঁটা ধরলো।বিস্ময়ে মুরসালীনের চোখ কুঁচকে এলো।এই মেয়ে সুযোগ পেলেই প্রত্যেক দিন সকালে হুড়মুড়িয়ে তার ঘরে ঢুকে।তারপর শুরু হয় মাথা পাগল করা বকবক।আজ কি হলো?এমন চুপচাপ কেন?

সকাল ৮টায় ডাইনিং টেবিলে সবাই উপস্থিত।রুহা কলেজ ড্রেস পড়ে তাড়াহুড় করে খাচ্ছে।বাহার বাবু ছোটো নানির কোলে বসে ডিম্ সিদ্ধ খাচ্ছে।মুরসালীন খাওয়ার ফাঁকে গম্ভীর মুখে তাকাচ্ছে রুহার দিকে।আফনান স্কুল ড্রেস পড়ে এসেছে,রুহার সাথে একই রোড দিয়ে যাবে সে।রুহাকে এমন গরুর মতো খেতে দেখে সে বলল,
“রুহাপু এমন গরুর মতো খাচ্ছো কেন?”

রুহার গলায় খাবার আঁটকে এলো।তাড়াতাড়ি পানি খেয়ে বলল,
“চুপ থাক,তাড়াতাড়ি খা নাহলে তোকে রেখেই চলে যাব আমি।”

মুরসালীন গম্ভীর চোখে রুহাকে পরখ করে বলল,
“এখনো অনেক সময় আছে,আস্তে ধীরে খা।”

খাওয়া দাওয়া শেষে যে যার কাজে ব্যস্ত হয়ে গেছেন।রুহা আফনানকে নিয়ে বের হয়েছে।টাকা বাচানোর জন্য প্রত্যেকদিন রুহা হেঁটেই জান্নাতের বাড়ি অব্দি আসে।আফনানের স্কুল বাড়ির কাছে হওয়ায় তারও রিক্সা নিতে হয় না।রুহা জান্নাতের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে।এই রাস্তা দিয়েই প্রত্যেকদিন রিফা অফিসে যায়।তবে আজ দেখা হলো না তার সাথে।জান্নাত আর মিথিলা আসতেই তারা একটা রিক্সা নিয়ে কলেজের উদ্দেশ্যে বের হলো।

ক্লাসরুমে বসে রুহা নিজের ফোন বের করে ফেসবুকে একজনের প্রোফাইলে ঢুকলো।তারপর জান্নাতের সামনে ধরে বলল,
“দেখ তো একে চিনিস নাকি?”

জান্নাত ভালো করে দেখল।তারপর প্রোফাইলে ঢুকে ঠোঁট কামড়ে বলল,
“উনি আমাদের নিউ ইংলিশ টিচার না?”

“কী নাম যেন?”

“আদিব আহমেদ।”

“উনি আমার আইডি পেলো কোত্থেকে?”

জান্নাত ঠোঁট উল্টালো।মিথিলা মাথা চুলকে মিনমিন করে বলল,
“আমি দিয়েছি।”

রুহা কটমট করে মিথিলার দিকে তাকিয়ে দাঁত চেপে বলল,
“চেয়েছে বলে দিয়েও দিবি?”

“সমস্যা কী তাতে?”

“সমস্যা নেই কিন্তু এসব আমার পছন্দ নয়।”

তখন’ই ক্লাসে ঢুকলো মুরসালীন স্যার।গায়ে সাদা শার্ট,কালো প্যান্ট,শার্টের হাঁটা গোটানো এবং চোখে চশমা।রুহা আড়চোখে সেদিকে তাকিয়ে চুপচাপ ব্রেঞ্চে বসল।মুরসালীন রুহার এত নীরবতার মানে বুঝল না।চিন্তায় কপালে গভীর ভাঁজ পড়ল।যে মেয়ে ২৪টা ঘণ্টা পিছু লেগে থাকে সেই মেয়েই আজ দুদিন ধরে একদম নীরব।
কলেজ শেষ হতেই রুহা জান্নাত আর মিথিলার সাথে বের হলো।মাঠ পেরিয়ে গেটের দিকে যেতেই আদিব স্যার রুহার সামনে এসে দাঁড়াল।রুহা হতভম্ব হয়ে সালাম দিতেই আদিব বলল,
“কোথায় যাবে এখন?”

“কোচিং-এ যাচ্ছি স্যার।”

“তোমার বাবা তোমাকে কিছু বলেনি?”

রুহা আশ্চর্য হয়ে বলল,
“আমার বাবা আবার কী বলবে?আমার বাবার সাথে আপনার কথা হয়েছে?”

“তোমার বাবাকে আমি অনেক আগে থেকেই চিনি।আর কাল থেকে তোমাকে পড়াতে যাওয়ার কথা আমার।আই থিঙ্ক তুমি যেখানে কোচিং করো সেখানে মানা করে দিয়েছেন তোমার বাবা।”

রুহা অবাকের চরম পর্যায় পৌঁছে গেল।বাবা এত কিছু করে ফেলেছে আর সে জানেই না?রুহা শুষ্ক ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
“কিন্তু আমি তো এসব কিছুই জানি না।”

“তোমার বাবাকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করো।আর কাল থেকে আমি তোমাকে পড়াতে যাব।এখন আসছি।”

মুচকি হেসে আদিব স্যার হাঁটা ধরলেন।জান্নাত রুহার কাঁধে হাত রেখে বলল,
“তাহলে আমাদের সাথে আর পরবি না?”

রুহা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
“বাবা যদি এমনটা করে থাকে তাহলে আমার কিছু করার নেই।বাবার মুখের উপর কিছু বলতে পারব না।”

পেছন থেকে মুরসালীন এগিয়ে এসে রুহার পাশে দাঁড়াল।মুরসালীনকে দেখেই জান্নাত আর মিথিলা চলে গেলো বিদায় জানিয়ে।তাদের লেট হয়ে যাচ্ছে।রুহা মাথা উঁচিয়ে মুরসালীনের গম্ভীর মুখ দেখে বলল,
“বাবা কী শুরু করেছে মুরসালীন ভাই?বাড়িতে তো আপনিও ছিলেন তাহলে অন্য কেও কেন পড়াবে?”

মুরসালীনের পিছু পিছু হাঁটা শুরু করল রুহা।কলেজ গেট পেরিয়ে একটা রিক্সা ডেকে দু’জন উঠে পড়ল সেখানে।মুরসালীন নীরবতা ভেঙে বলল,
“স্যার ভালো পড়ায়।দুষ্টুমি বাদ দিয়ে পড়ায় মন দে।”

“আমার তো পড়তে কোনো সমস্যা নেই কিন্তু আপনি কেন পড়াবেন না?”

“তোর বাপ বলেনি তাই পড়াবো না।”

“বাবাকে তো আপনিও বলতে পারতেন।”

মুরসালীন রুহার অস্থির মুখ পানে একবার তাকাল।আবার সামনে দৃষ্টি রেখে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“আমার কাছেই কেন পড়তে হবে?আমি তো বাড়িতেই আছি।যখন পড়া বুঝবি না তখন আমার কাছে চলে আসবি।”

রুহা মুখ একটু করে মুরসালীনের একহাত কম্পিত হাতে আঁকরে ধরে বলল,
“আপনি সব সময় এত রাগ করেন কেন?একটু ভালো ভাবে কথা বলা যায় না?আমি তো চাই না আমাকে আপনি ব্যতীত অন্য কেও পড়াক।”

মুরসালীন নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে শুকনো ঢোক গিলল।রুহার থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে
মুরসালীন এক মুহূর্ত রুহার দিকে তাকাল, তারপর দৃষ্টি ফেরাল সামনের পথে। কণ্ঠটা ছিল নিচু, কিন্তু প্রতিটি শব্দ যেন ভারী হয়ে পড়ল রুহার কানে।

“ সবকিছুর কাছে যাওয়া উচিত না। কিছু জিনিস দূর থেকেই সুন্দর লাগে—যেমন আকাশে ভেসে থাকা মেঘ, কিংবা জ্বলজ্বলে তারা। দূর থেকে দেখলে মনে হয় ওরা শুধু আলো আর সৌন্দর্য… কিন্তু কাছে গেলে বোঝা যায় তার আসল ক্ষমতা।”

রুহা নীরব হয়ে শুনলো। মুরসালীন একটু থেমে গলা আরও নিচু করল,

“অনুভূতিও তেমন। কিছু অনুভূতি দূরে রাখাই ভালো… কারণ কাছে আনলে সেটা আগুনের মতো জ্বালায়, পুড়িয়ে ছাই করে দেয়। আর ছাই থেকে কখনো ফুল ফোটে না।”

রুহা মাথা নিচু করল।দু’হাত একসাথে করে ঠোঁট কামড়ে ধরল,যেন চোখের পানি আঁটকাবার চেষ্টা।কণ্ঠে কাঁপন ধরলেও কিছুটা নিচু স্বরে বলল,

“আগে যদি জানতাম,আপনাকে পাওয়া মানে নিজের সুখ, স্বপ্ন, শান্তি—সব কিছুর সাথে যুদ্ধ করা, তাহলে কখনো আপনার দিকে তাকাতাম না। কখনো আপনাকে ভালোবাসতাম না। কারণ যুদ্ধ জেতা আমার জন্য নয়,আর আপনাকে হারানোও আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি মাঝখানে আটকে গেছি, মুরসালীন ভাই—যেখানে জিতলেও হার, হারলেও হার।”

#চলবে..?